Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

আত্ম জৈবনিক

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

দৃশ্য-১
[দেখা যায় একটা দেয়াল, দেয়ালের ওপাশে ১জন লোক দৃশ্যমান, পর্দার ভেতর দিয়ে। ভোরের অস্ফূট আলো ফুটে উঠবে]

১ম জন
আসবে, কেউ না কেউ তো নিশ্চয় আসবে। সমস্ত জীবনটা এখানে বসে কাটিয়ে দিতে হবে- এতোটা অভিশপ্ত নিশ্চয়ই আমি নই। উৎসমূলের সন্ধানে- খুঁড়তে খুঁড়তে নিতান্ত খনি শ্রমিকের মতো, নয়তো নিতান্ত অবচেতনে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই এসে পড়বে। (অপ্রকৃতস্থর মতো হাসতে থাকে) অথবা ক্লাইম্যাটিক চেঞ্জের সহজাত ধারায় একদিন এই মরুভূমির তপ্ত বালু গ্রাস করবে এ দেয়ালকে, সবুজ বৃষ্টিতে তরুণ বটের শেকড় নাচিয়ে দেবে এ দেয়ালের ভিত-অস্থি-মজ্জা। ততোদিন আমি এখানে বসে থাকব। (হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে) কাউকে না কাউকে তো আসতেই হবে। স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেবতা, প্রেতাত্মা, প্রেমিক, ঈশ্বর অথবা শয়তান। সে যে-ই হোক না কেনো- সে-ই হবে আমার ভাগ্যনিয়ন্তা। আমি তার হাত ধরে বলল ‘আমাকে বাঁচাও, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও’।

[হঠাৎ দেখা যায় দেয়ালের উপর শায়িত এক (২য়) ব্যক্তি ধীরে ধীরে উঠে বসছে]

২য় জন
ধুশ শালা, সারারাত জেগে স্বপ্ন দেখেছি, ভোরের দিকে একটু চোখটা লেগে আসছিলো অমনি ষাঁড়ের মতো চিৎকার। এই যে, এই যে মশায়- দিব্যি আরামসে বসে আছেন, কিন্তু চিৎকারতো করছেন ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে। তা কী হয়েছে? পিঁপড়ে কামড়েছে, নাকি নেংটি ইঁদুর তাড়া করেছে? না তেলাপোকা..

১ম জন
উফ, এই যে, আপনি আছেন- আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম- আপনি যে-ই হোন না কেনো- সাধু, সন্ত, খুনী, বদমাশ কিংবা উন্মাদ- তাতে কিছুই যায় আসে না- ঈশ্বরের কসম খেয়ে বলতে পারি আমি আপনাকেই খুঁজছি।

২য় জন
লে ঠ্যালা- এ যে দেখছি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তা আমি আপনার আরব্যি দেবতা হয়ে উঠলাম কী কারণে, শুনি?

১ম জন
আপনার ঘুম ভাঙিয়ে বিরক্ত করলাম বলে আপনি রেগে আছেন?

২য় জন
না, না। বিরক্ত করবেন কেন, উপকার করেছেন। আমার চৌদ্দ-পুরুষকে একেবারে ঋণের নাগপাশে বেঁধে ফেলেছেন। যত্তোসব।

১ম জন
দেখুন আমি নিতান্ত নিরুপায়। আপনি না শুনলে আমার সারাটা জীবন হয়তো চিৎকার করে কাটিয়ে দিতে হতো। বিশ্বাস করুন, তাই করতাম আমি। তবে এখন আপনাকে দেখে কেমন যেনো সাহস পাচ্ছি মনে। মনে হচ্ছে আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।

২য় জন
সাহায্য করব আমি! (হেসে ওঠে) আমিতো নিজে নিজেকেই সাহায্য করতে পারি না।

১ম জন
আমাকে আপনার সাহায্য করতে হবেই।

২য় জন
ভাই, আমি নিতান্ত দরিদ্র এবং সাধারণ একজন লোক। লোকে বলে, আমার মধ্যে নাকি অনেক প্রতিভা লুক্কায়িত ছিলো। (বিদ্রুপের সুর কণ্ঠে)। সেই প্রতিভার উস্কানিতে সীমানা অতিক্রমের একটা নেশা আমায় পেয়ে বসলো। সবকিছুকে চ্যালেঞ্জিং মনে হতো। তারপর ভাঙতে ভাঙতে, তারপর খুঁজতে খুঁজতে, তারপর দেখতে দেখতে দু’দিন আগে এই দেয়ালে চড়ে বসেছি এবং এখনোতো বসেই আছি। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। আমি আপনাকে সাহায্য করবো দূরের কথা বরং আপনি আমাকে কিছু খাবার দিয়ে সাহায্য করতে পারেন কিনা দেখুন।

১ম জন
মাফ করবেন, আমার কাছে কোনো খাবার নেই।

২য় জন
ধূর!

১ম জন
আর সে ধরনের কোনো সাহায্য আমি আপনার কাছে চাইছি না।

২য় জন
তাহলে কোন ধরনের সাহায্য চাইছেন?

১ম জন
আমি এই দেয়ালের এপাশটায় আটকা পড়েছি।

২য় জন
আরে মহা-জ্বালাতো। আটকা পড়েছেন তো আমি কী করবো? আপনাকে কোলে করে তুলে আনবো? লাফ দিয়ে দেয়ালটা টপকে ফেলুন, নয়তো হেঁটে অন্যপথে বেরিয়ে যান, ব্যস সমস্যা শেষ। (একটু থেমে) আচ্ছা, আপনি পঙ্গু নন তো? (দেখার চেষ্টা করে) নাহ, সব কাজে সাহায্য চাওয়াটা মানুষের একটা বদ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। ঐ যে ছোট বেলায় পড়ানো হলো, আমরা সমাজবদ্ধ জীব- তাই একে অন্যের উপর নির্ভরশীল- ব্যস, হয়ে গেল। সুযোগ পেলেই অন্যের ঠ্যাঙটা লাউয়ের ডগার মতো পেঁচিয়ে শুয়ে পড়ি। যত্তোসব।

১ম জন
কিন্তু ভাই...

২য় জন
আর বিরক্ত করবেন নাতো ভাই। ঘুমটা যখন ভেঙেছেন তখন একটু শান্তিমতো চিন্তা করতে দিন। চিন্তা মনের খোরাক। আর মন প্রফুল্ল হলে শরীরের জ্বালা ততোটা বোঝা যায় না। খিদেটা...

১ম জন
শুনুন আমি অনেক চেষ্টা করে দেখেছি, কিন্তু কোনোভাবেই দেয়ালটা পার হতে পারছি না। আর অন্য কোনো পথও নেই।

২য় জন
তাহলে ভাবুন, বসে বসে ভাবুন। আমিও ভাবছি। ভাবতে ভাবতেই হয়তো আমরা দু’জনের জন্য কোনো পথ, দু’জনের জন্য দু’টি পথ অথবা দু’জনের জন্য অনেকগুলো পথ বের করতে পারব।

১ম জন
আপনি বুঝতে পারছেন না- ব্যাপারটা আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

২য় জন
এইবার চুপ না করলে কিন্তু আপনার মাথায় আমি ইয়ে করে দেব।

[প্রস্রাব করার ইঙ্গিত দেয়। প্রথমজন চুপ করে যায়। ২য় জন গুনগুন করে শুয়ে পড়ে]

১ম জন
আচ্ছা, ওপাশে কি সমুদ্র আছে? এখানে বসে আমার মাঝে মাঝে কেন যেন মনে হয় সমুদ্রের গর্জন গুনতে পাই। আমার শরীরে সমুদ্রের ফেনা উঠে আসে। নোনা বাতাসে আমার জিভে আবার স্বাদ ফিরে পাই। মনে হয় আমি ভাইকিং জলদস্যুদের জাহাজে দাঁড়িয়ে। আমি যুদ্ধে যাই- আমি মরে যাই- আর আমার শরীর নোনা স্রোতে ভেসে যায় অজানা দ্বীপে।

২য় জন
সমুদ্র! আশপাশে কয়েক’শ মাইলের মধ্যে সমুদ্রতো দূরে থাক, একটা দীঘি পর্যন্ত নেই। আর আপনি যেটাকে সমুদ্র ভাবছেন, সেটা হলো- মন্নান চাচার পঁচা ডোবা। আপনার ওই সমুদ্রে ছোটবেলায় একবার নেমে সারা শরীরে হয়েছিলো চুলকানি। দাদীর দেয়া শেকড় বাটা মেখে তবে নিস্তার। এখানে শুয়েও ওটার গন্ধে আমার বমি আসছে। আর আপনি বলছেন সমুদ্র।

১ম জন
(উত্তেজিত) আপনি ঠিক বলছেন সমুদ্র নেই? তাহলে আমি যে এতোদিন ভাবলাম ... দেখুন, আপনি আমার উপর বিরক্ত হয়ে আমাকে নিরাশ করার জন্য মিথ্যে বলেছেন নাতো? সত্যি কথা বলুন- প্লীজ দয়া করুন। ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ- একজন মানুষের কাছে একটা জীবন যতটা।

২য় জন
হ্যাঁ ভাই আমি মিথ্যে বলছি। সমুদ্র আছে। প্রশান্ত মহাসাগরটা শ্রিঙ্ক করে মন্নান চাচার পায়খানার সাথে যুক্ত হয়ে গেছে- হলো?

১ম জন
ওফ! অসহ্য, অসহ্য। আপনি সাহায্য না করতে পারেন- কিছুটা মানসিক সার্পোট তো দিতে পারতেন? মিথ্যে করেও তো বলতে পারতেন... আপনাকে আমি ঘৃণা করি। প্রচণ্ড ঘৃণা (গুমড়ে ওঠে)

২য় জন
আরে কী মুশকিল ভাই। কসম খেয়ে বলতে পারি আমি আপনার সমুদ্র নেইওনি, হারাইওনি। সত্যি কথা বলে তো দেখি ঝামেলায় পড়লাম। এখন থেকে বলে দেবেন, কখন সত্যি কথা বলতে হবে আর কখন মিথ্যে। আপনি আবার কান্নাকাটি শুরু করলেন নাকি?

১ম জন
না, কাঁদছি না- তবে আরও একটা হতাশা যোগ হলো এই আর কী। এপাশে শুধুই মরুভূমি, তপ্ত বালু। সবুজ, শুধুই ক্যাকটাস আর মানুষের মত রঙ বদলানো গিরগিটি। ভেবেছিলাম ওদিকে নিশ্চয়ই আছে সমুদ্র, বন- নিবিড় লোকালয়। বলতে পারেন এই দেয়ালটাই এখনও আমাকে আশা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। (একটু থেমে) থাক এসব কথা। আচ্ছা, আমি না হয় নিরুপায় হয়ে এখানে বসে আছি। কিন্তু আপনি দু’দিন না খেয়ে ঐ দেয়ালের উপর বসে আছেন কেন বলুনতো?

২য় জন
আমার ইচ্ছে।

১ম জন
ইচ্ছে হলে তো আর খিদে বলে চেঁচাতেন না। সত্যি করে বলুনতো ঘটানটা কী?

২য় জন
দেখুন, আপনার সাথে আমরা এমন কোনো ঘনিষ্টতা হয়নি যে, আপনাকে আমার ব্যক্তিগত সব স্বাদ, আহ্লাদ, উদ্দেশ্য, বিধেয় খুলে বলতে হবে। আর আমার হাঁড়ির খবর না জানলে কি আপনার ঘুম হচ্ছে না নাকি?

১ম জন
যত হাস্যোজ্জল বিদ্রুপই করুন না কেন, কথায় যতই চটক থাকুক না কেন, কোথায় যেনো একটা নিরুপায়, অসহায় ভাব ফুটে উঠেছে। কেন যেনো মনে হচ্ছে অন্য কোনো উপায় নেই বলেই আপনি ওখানে বসে আছেন। আচ্ছা, বউয়ের দাবড়ানি খেয়েছেন নাকি, বলুনতো?

২য় জন
মোটেও তা নয়, এখনো বিয়েই করিনি।

১ম জন
আপনি কি কোনো কিছু থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন?

২য় জন
না।

১ম জন
আপনাকে কি কেউ খুঁজছে?

২য় জন
না।

১ম জন
আপনি কি খুনের আসামী? পুলিশ আপনার পেছনে...

২য় জন
আরে ধ্যাৎ, আপনি জেরা করছেন কেন?

১ম জন
জেরা করছি না- জানতে চাইছি। মানুষের দুর্বলতা তো থাকবেই, মানুষতো আর ঈশ্বর নয়।  তাই বলে তাকে আড়াল করার বা তাকে নিয়ে লজ্জিত হবার তো কিছুই নেই। এই দেখুন না আপনার সামনে আমি নিজের অসহায়ত্ব কেমন অকপটে নগ্ন করে সাইন বোর্ডের মতো তুলে ধরেছি। সে জন্য নিজেকে অনেকটাই হাল্কা মনে হচ্ছে, আপনি চাইলে হাল্কা হতে পারেন। নাকি আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না?

২য় জন
না তা কেন হবে- আসল ব্যাপরটা হলো...

[এমন সময় দূরে বাজনা বেজে ওঠে। কোথাও উৎসব হচ্ছে। অনেক মানুষের কলরোল শোনা যায়]

১ম জন
ওদিকে কি হচ্ছে? ওগুলো কিসের শব্দ?

[২য় লোক উঠে দেখার চেষ্টা করে]

২য় জন
মনে হচ্ছে, কোথাও উৎসব শুরু হয়েছে।

১ম জন
উৎসব! উহ কী সুন্দর বাজনা!

২য় জন
হ্যাঁ, উৎসবের বাজনা সবসময় মধুরই হয়। হতভাগা মানুষগুলো এমন হত দরিদ্র নিরামিষ দিন কাটায় যে, এক উৎসবের জন্য তারা বোয়াল মাছের মতো হা করে থাকে। তাই উৎসবের দিনগুলো এমন বর্ণাঢ্য।

১ম জন
এমন মধুর বাজনা আমি কখনো শুনিনি। আচ্ছা, উৎসবের রঙ কী? আমি তো কখনও উৎসব দেখিনি- তাই জানতে চাচ্ছি।

২য় জন
কপালে থাকলে এবার দেখতেও পারেন। কারা যেনো এদিকে আসছে। (কতগুলো লোক রঙিন কাপড়, ফিতা আর বাজনা বাজাতে বাজাতে এদিক থেকে ওদিক চলে যায়) এই যে ভাই, এই যে... (তার কথা কেউ শোনে না। সকলে প্রস্থান করে কেবল এক যুবক ফুল নিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে  দেখতে থাকে) এই যে ভাই- ব্যাটা কালা নাকি?

৩য় জন
প্রিয়তমা, স্বর্গের আলো তোমায় অলোকিত করুক, অনন্ত করুক, স্বর্গের জল তোমাকে ধৌত করুক আর স্বর্গের বাতাস তোমাকে দিক নিবিড় স্পর্শ। এই রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে পথ তোমাকে আলগোছে তুলে নিয়ে আসবে আমার কাছে। এই ফুল গ্রহণ করবে  আর সেই সাথে গ্রহণ করবে আমার ভালোবাসা।

২য় জন
সে ধরনের কেস এ অঞ্চলে কখনো ঘটেনি।

[৩য় জন ঝট করে ঘুরে তাকায়]

৩য় জন
কে আপনি, কী বলছেন এসব?

২য় জন
না- মানে- বলছিলাম যে- আমি এ এলাকার অনেক পুরনো লোক। এখানে অনেক যুবক ফুল হাতে দাঁড়িয়ে ফুল গাছ, আর গাব হাতে দাঁড়িয়ে গাব গাছ হয়ে গেছে। ফুল নিতেও কেউ আসেনি- গাব নিতেও না।

৩য় জন
(হা হা শব্দে হাসে) বিদ্রুপ করছেন? করুন, যতখুশি করুন। কিন্তু একটু পরে যখন এই শহরের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী তার রুপালী মনের রিনিঝিনি শব্দ করে আমার বাহুতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে তখন করবেন ঈর্ষা। সফলতা জন্ম দেয় ঈর্ষার আর সকল মানুষকে সকলেই ঈর্ষা করে। হ্যাঁ, ঈর্ষা সপ্ত-পাপের শ্রেষ্ঠ রিপু। কাম দমন করা যায়, ক্রোধ দমন করা যায়, মদ ও মোহ ত্যাগ করা যায় কিন্তু ঈর্ষাকে কেউ বশ করতে পারে না। একটু পরে সেই ঈর্ষা গ্রাস করবে আপনাকে। আর আমার বাহুতে তার শরীর ছন্দে ছন্দে কেঁপে উঠবে সুন্দরী ব্যালেরিনার মতো। আমি তার অধর স্পর্শ করে বলব আমরা দু’জন ছাড়া আর কোনো সত্য নেই পৃথিবীতে।

২য় জন
এমন কথা তো গেলোবারও একজনের মুখে শুনেছিলাম।

৩য় জন
কী বলতে চান আপনি?

২য় জন
বলতে চাই, আপনি যখন প্রেমলীলা করবেন, তখন আমরা দু’জন কী কররো বলে দিলে একটু সুবিধা হতে আরকি।

৩য় জন
জাহান্নামে যেতে পারেন নিশ্চিন্তে। কিন্তু দু’জন মানে? আপনি তো দেখছি একা।

২য় জন
এই যে, এদিকে আরও একজন আছেন।

৩য় জন
ও তা উনি ওখানে বসে কী করছেন?

২য় জন
দেয়ালটা পার হতে পারছেন না বলে খানিকক্ষণ পরপর দুঃখের হেঁচকি দিচ্ছেন।

১ম জন
ওনার কথায় কান দেবেন না। শুনুন, আপনি যে-ই হোন না কেনো আমাকে সাহায্য করুন। আমি ভীষণ দুঃখে আছি।

৩য় জন
দুঃখে আছেন? তাহলে থাকুন। আমি তো দুঃখে নেই। আর নিজে যখন দুঃখে নেই, তখন আপনাদের দুঃখের কথা শুনে আমি কী করবো? এই পৃথিবীতে বেদনাই একমাত্র মৌলিক এবং নিজস্ব ব্যাপার, কেউ কারো দুঃখের ভাগীদার হওয়াতো দূরে থাক, স্পর্শ পর্যন্ত করতে পরে না। তাছাড়া আপনাদের এইসব বিচিত্র সমস্যার সাথে আমি পরিচিতও নই, সেগুলো সমাধানে আগ্রহীও নই। আমি এখন অত্যন্ত প্রফুল্ল আছি। এখন দুঃখের কথা শুনে কাতরতার ভান আমি করতে পারব না। আপনারা বরং আপনাদের চাইতে দুঃখি কাউকে খুঁজে দেখতে পারেন। তাতে যদি দুঃখ কিছুটা লাঘব হয়। (ক্ষণিক বিরতি) আচ্ছা সে এখনও আসছে না কেনো? পথে কোনো সমস্যা হলো না তো?

২য় জন
পথ এখন শীতল, নদীর মতো স্থির। প্রেমিকের কাছে যাবার পথ প্রেমিকারা ঠিকই পেয়ে যায়। যদি সে সত্যিই ভালোবাসে।

৩য় জন
বাসায় কোনো সমস্যা হলো না তো?

২য় জন
প্রেমিকের কাছে যেতে সব সমস্যাই তারা উপেক্ষা করতে পারে, যদি সে সত্যিই ভালোবাসে।

৩য় জন
উফ, আপনি বড় বিরক্ত করছেন। আপনি কি বুঝবেন ভালোবাসার? দেয়ালের উপর বসে নির্বিঘ্নে পা দোলাচ্ছেন। নামুন তো, নেমে যান ওখান থেকে। আমার আজ তার সাথে কিছুটা সময় একা কাটানো প্রয়োজন। নেমে  যান প্লীজ। (এদিক ওদিক পায়চারী করে) আপনার কি মনে হয় সে ভুলে গেছে?

২য় জন
বেঁচে থাকার চেয়ে যেমন মৃত্যু সত্যতর। তেমনি মনে রাখার চেয়ে সত্যতর ভুলে যাওয়া।

১ম জন
আর ভালোবাসার চেয়ে প্রতারণা...

৩য় জন
না না, তা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই আমার কোথাও ভুল হয়েছে। গতকালই তো ছিলো আকাশে মেঘেদের মিছিল- ঠাণ্ডা বাতাস আর ঝড় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম দু’জন। তারপর তাকে বাড়ি পৌঁছে দিলাম- আজই তো তার আসার কথা।

[আনমনে ফুলের পাঁপড়ি ছিঁড়তে থাকে]

২য় জন
শী লাভস মি নট।

৩য় জন
তা হতে পারে না। নিশ্চয়ই আমার ভুল। নিশ্চয়ই তার আগামীকাল আসার কথা। অবশ্যই আমার ভুল।

২য় জন
ভুল তো সবার। ভালোবাসলেও ভুল- না বাসলেও ভুল। (হা হা শব্দে হেসে উঠে) এই যে শুনছেন?

১ম জন
হ্যাঁ।

২য় জন
এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম কী মনে করে যেনো এই দেয়ালটার উপর চড়ে বসলাম। ওঠার পর কিন্তু ভালোই লাগছিলো। বেশ একটা ফূর্তি ফূর্তি ভাব। মনে হচ্ছিল, আমি এক পাহাড় চূড়ায় উঠে বসেছি। নিচে কুয়াশা, আরও নিচে পিপীলিকার মতো মানুষ তাদের সুখ দুঃখের ঘর বানিয়ে এক প্রহসনে মেতে উঠেছে। এইসব ভেবে যখন মানুষগুলোর জন্য করুণায় আমি আর্দ্র হয়ে উঠেছি- তখন হঠাৎ নিজের কথা মনে হলো। মনে হলো, আমি সত্যি সত্যিই এক সংকীর্ণ পাহাড় চূড়ায় উঠে বসেছি। এখানে শুধুই আকাশ। নামবার কোনো পথও আমি যেনো রাখিনি। এখন তাই আর নামতে পারছি না ভয়ে। (হো হো করে হাসে) বুঝুন অবস্থা, উঠে মনে হলো উঠে ভুল করেছি। না উঠলে মনে হতো, না উঠে ভুল করেছি। হা-হা-হা উঠেও ভুল, না উঠেও ভুল। ভালোবেসেও ভুল, না বেসেও ভুল।

[অপ্রকৃতস্থর মতো হাসতে থাকে আর লাইনটি বিড়বিড় করে বলতে থাকে। বাতি নেভে]

দৃশ্য -২
[ভোরের আলো ফুটে ওঠে। গীর্জার ঘন্টা বেজে ওঠে। একজন পাদ্রীর কণ্ঠ শোনা যায়। তিনি বাইবেল পড়ছেন]

পাদ্রী    
(নেপথ্যে) “আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন। পৃথিবী ঘোর শূন্য ছিল এবং অন্ধকার জলধির উপর ছিলো। পরে ঈশ্বর কহিলেন, ‘দীপ্তি হউক’, তাহাতে দীপ্তি হইল, ঈশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক করিলেন।”

[ধীরে ধীরে তার কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসে। যাজক দল একপাশ থেকে প্রবেশ করে। প্রথমজনের হাতে ঘন্টা, দ্বিতীয়জন ক্রুশ ও তৃতীয়জন বাইবেল হাতে। পেছনে অনুসারীবৃন্দ। হুমম হুমম শব্দ করে চলে যায়। যাওয়ার সময় একজন যাজক ঘোষণা দেয়ার মতো বলে যায়]

যাজক
ঈশ্বর সকলের মঙ্গল করেন।

[২য় ব্যক্তি শায়িত অবস্থা থেকে উঠে বসে]

২য় জন
(স্বগোতোক্তি) ঈশ্বর সকলেরই মঙ্গল করেন। যে পাপী তার, যে পাপ লঙ্ঘন করে তারও। প্রার্থনায় কেউ যায় পাপের ঘড়া ভাঙতে, কেউবা ভরে নিয়ে আসে পূন্যের কলস। কারা ওরা? আমি তো ওদের কেউ নই।
 
১ম জন
ঘুম ভাঙলো বুঝি?

২য় জন
হ্যাঁ। আরও একটা সকাল। এক অক্ষবিন্দু থেকে যাত্রা করে আবারও সেই বিন্দুতে ফিরে আসার পৃথিবীর চিরন্তন প্রয়াস। কী রকম নিয়তি নির্ধারিত। পুনরাবৃত্ত। তবে যাই বলুন, প্রতিটা সকালই কিন্তু আমাকে উদ্যম জোগায়। খুব নতুন লাগে প্রতিটা সকাল।

১ম জন
প্রতিটা শিশুতো একই রকম কাঁদে। অথচ প্রতিটা শিশুর কান্নাই কেমন নতুন।

২য় জন
ভালো বলেছেন। আপনি ঘুমাননি?

১ম জন
নাহ ঘুম আসে না আমার। তবে আপনাকে দেখে কেমন অবাক লাগে। এরকম অবস্থাতেও কেমন ফূর্তি ফূর্তি ভাবে কাটিয়ে দিচ্ছেন।

২য় জন
(হাসে) দেখুন, দুঃখ-বিষাদ এসব হচ্ছে স্থায়ী। জীবন পাথর- সুর হচ্ছে শ্যাওলা। কখনও স্রোত এসে ধুয়ে নিয়ে যায়। কখনও তা ধীরে ধীরে জন্মায়। কিন্তু দুঃখটাইতো মূলরূপ। তা ওটা নিয়ে হৈচৈ মোটেই পছন্দ করি না। সহজভাবে নিজের অবস্থান মেনে নিয়ে যুদ্ধ করাটাই তো জিতে যাওয়া। কাতর হয়ে ঘেমে গেলেই বুঝতে হবে আপনি হেরে গেছেন।

১ম জন
বাহ জীবনের সুন্দর মেরুকরণ করলেন তো। যুক্তিকে একদিকে আর আবেগকে একদিকে রেললাইনের মতো সমান্তরালে ফেলে নিজের সুবিধা মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছেন জীবনের রেল। কিন্তু মাঝামাঝি বলেও তো একটা কথা আছে, তাই না?

২য় জন
তথাগত বুদ্ধের মতো যারা মধ্যপন্থায় জীবনে মোক্ষ লাভ করতে চান তারা তাই করুন, আমি আমার পথেই আর আপনিও আপনার পথেই চলুন।

১ম জন
চলা নয়। আমার তো এখন অনন্ত থেমে থাকা। শুধু অন্ধকার, নিজের আঙ্গুল স্পর্শ করে বেঁচে থাকা। (২য় জন চুপ করে যায়। একটু পর) আমি ছিলাম আজন্ম অন্ধ। জ্ঞান হবার পর থেকেই আমি পাগলের মতো আমার দৃষ্টি ফিরে চাইলাম ‘মানুষ’ চিনবো, ‘মানুষ’ দেখবো, ‘মানুষ’ ধরবো বলে। আমি মুখ দিয়ে শব্দ করি। হাতড়ে, স্পর্শে চিনে নিতে চাই ‘মানুষ’, মেধার ইশারায় বুঝতে চাই ‘মানুষ’। একদিন আমার বোবা বাবা আমার স্বেচ্ছাচারী মায়ের অত্যাচারে আত্মহত্যা করল। সেদিনই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। বোবা বাবার চিৎকার আমাকে তাড়া করে ফিরল। তবুও আমার মানুষ দেখার সাধ যায় না। তারপর একদিন ফিরে পেলাম দৃষ্টি। দেখলাম, জীবনের উজ্জ্বল যেটুকু রঙ, তা শুধু রক্তের। নারীরা সব এখানে বেশ্যা, পুরুষেরা নপুংসক দালাল। সেই থেকে ছুটছি। মরুভূমি পেরিয়ে এই দেয়াল এসে ঠেকেছি। বিশ্বাস করুন, পথে যতগুলো ক্যাকটাস পড়েছে তার প্রত্যেকটা দিয়ে উপড়ে নিতে চেয়েছি এই চোখ। হায়রে, আমার অন্ধকার অন্ধত্ব! আপনিই বলুন, এখন যদি ধ্বংসের অনিবার্য নেশা আমাকে পেয়ে বসে তা কি অন্যায়?

২য় জন
কিন্তু সৃষ্টিবিহীন ধ্বংসতো কোনো সমাধান নয়।

১ম জন
তবে কি ফিরে যাব? ফিরে গেলে হতে হবে লম্পট, ব্যভিচারী, শয়তানের উপাসক- নইলে যে ওরা আমাকে দলে টেনে নেবে না। আমি হবো পরিত্যক্ত। তবু মাঝে মাঝে, ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়, আমি হেরে গেছি?

২য় জন
যতক্ষণ দেয়ালের এপাশে আসতে চাইছেন- ততোক্ষণ নয়।

১ম জন
আপনার কি মনে হয় আমার আত্মহত্যা করা উচিত?

২য় জন
আমি তো জানি না আপনার কী করা উচিত। তবে আমি জানতে চাই, বুঝতে চাই- সে জন্যই তো একমুখ থেকে অন্যমুখে সারাজীবন নিজের মুখের ছায়া খুঁজে গেলাম। এই যে, আমাদের অকর্মণ্য পরিত্রাতা এসে গেছেন।

[৩য় জনের প্রবেশ]

৩য় জন
অকর্মণ্য! যথার্থ বিশেষণ বটে।

২য় জন
আহহা ঠাট্টা করছিলাম আরকি? তা কী হলো? ভুল কি আপনারই ছিলো? আজই তার আসার কথা?

৩য় জন
ভুল আমার ছিলো না অথবা ঠিক এর উল্টোটা। পুরোটা সময়ই আমি এক ভুলের মধ্যে ছিলাম।

২য় জন
আরে ভাই হেয়ালী রাখুন তো- কৌতূহলে তো আমার একেবারে কলজে ফেটে যাচ্ছে। তাহলে সে দেখা করতে আসেনি, বলুন?

৩য় জন
আসেনি নয়, এসেছিলো।

২য় জন
তবে আমার সাথে নয়- আমার বন্ধুর সাথে।

১ম জন
ব্যাপারটা দুঃখজনক।

৩য় জন
দুঃখজনক! আপনার কাছে শুধু দুঃখজনক মনে হচ্ছে? আমার সমস্ত জীবন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে আর আপনার কাছে শুধুমাত্র দুঃখজনক? আপনি জানেন, ক্রোধে আমি উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলাম? মনে হলো তার গলা টিপে তাকে আমি...

২য় জন
হ্যাঁ, হ্যাঁ। তার গলায় দশটি আঙ্গুলের ছাপ বসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, যেমন আমার পাশের বাড়ির স্ত্রীর গলায় চেপে বসেছিলো তার অধম স্বামীর দশটি আঙ্গুল। সেটুকুই শুধু তার পৌরুষ...

৩য় জন
কিন্তু এর প্রতিশোধ যে করেই হোক আমায় নিতে হবে। এই প্রতারণার শোধ আমি নেবই।

২য় জন
কেউ কাউকে প্রতারিত করতে পারে না। আমরা নিজেরাই শুধু নিজেদের প্রতারিত করি। (বিরতি দিয়ে) আপনার বন্ধু কি আপনার চেয়ে বিত্তশালী?

৩য় জন
হ্যাঁ।

২য় জন
রূপবতী?

৩য় জন
হয়তো!

২য় জন
তবে তো নিশ্চিতভাবেই সফলতর।

৩য় জন
সফলতর?

২য় জন
হ্যাঁ, সফলতার বলেই তো সেই রমণী এখন তার হাত ধরে হাঁটছে। আপনিই তো বলেছিলেন, সফলতাকে সবাই ঈর্ষা করে। হয়তো ভালোবাসা নয়, সেই ঈর্ষাই এখন আপনাকে তাড়িত করছে!

৩য় জন
তাই বলে সে এমন নিচ, স্বার্থপরের মতো...

২য় জন
স্বার্থপর! কে স্বার্থপর নয়? আপনি কি নিজেই নিশ্চিত, আপনি তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছেন? বরং শ্রেষ্ঠ সুন্দরী আপনার জয়ের খাতায় নিতান্ত এক ট্রফি ছাড়া কিছুই ছিলো না- যা আপনার অহমের ক্ষেত্রকে সুপরিসর করেছে- যাকে ছুঁয়ে আপনি আপনার অস্তিত্বকে উচ্চকিত করেছেন।

৩য় জন
না এ সত্যি নয়। (চিৎকার করে উঠে) আমার ভেতরে পৃথিবীর সমস্ত আগ্নেয়গিরি যেনো জ্বলে উঠল। আমি সব কিছু ভেঙে-চুরে দিতে চাইলাম।

২য় জন
তাই দিলেন না কেন?

৩য় জন
তাই দিতাম। কিন্তু পরক্ষণেই সে আমার হাত ধরে বলল, সে এখনও আমাকে ভালোবাসে। আমি আবার বিভ্রান্ত হলাম। আপনাদের কি মনে হয়, আমার তাকে এখনো বিশ্বাস করা উচিত?

১ম জন
বিশ্বাস নামে কোনো শব্দ এখনকার অভিধানে নেই।

২য় জন
আপনি কি নিজেকেই বিশ্বাস করতে বা করাতে পারছেন যে- আপনি তাকে ভালোবাসেন? (হেসে ওঠে) আমাদের ভালোবাসা কি প্রাইমারীর সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের খুব বাইরে যেতে পেরেছে কখনও? আমাদের বিশ্বাস কি নিজের অস্তিত্বকে ছুঁয়ে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভূত নয়? পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে আমরণ সাথে থাকার যে তীব্র শপথ- টিল ডেথ ডু আস পার্ট- তাই যদি সত্যি হতো, তবে কেনো চারিপাশে কাঁচের পেয়ালার মতো ভেঙে যায় গান্ধর্ব বিবাহ?

৩য় জন
তবে কি ভালোবাসা-প্রেম-বন্ধুত্ব এসবের কোনো অর্থ নেই? এসবই শুধুমাত্র জীবনের ব্যবহার্য তৈজস? ব্যবহৃত হলেই ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়?

২য় জন
না, এ হচ্ছে মাদক, যা আমাদের মাতাল করে রাখে। আমাদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা বাঁচিয়ে রাখে অনন্তকাল।

১ম জন
তবে কি মানুষ আর কথায় কথায় সেতু গড়তে পারবে না- স্পশে স্পর্শে সেতু গড়তে পারবে না, বিশ্বাসের সেতু গড়তে পারবে না? অবিশ্বাসের নীল ছুঁয়েছে শরীর। আমরা কি আর কখনও সম্পন্ন বিশ্বাসে জেগে উঠতে পারব না?

৩য় জন
উফ! কোন অলুক্ষণে পাপে যে আপনার সাথে দেখা হয়েছিলো- এ কোন উলম্ব আর্শীতে আমায় দাঁড় করিয়ে দিলেন? চারপাশে চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ছে যেনো আমারই সব মুখোশ। আমি আর নিজের দিকে তাকাতে পারছি না। কদাকার, ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে নিজেকে।

২য় জন
এই-ই মানবজন্ম। অন্যকোনো জন্মের অন্যকোনো পাপের প্রায়শ্চিত্ত মাত্র। খুব ছোট বয়সেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমি বড় বেশি সাধারণ। আমার চারিদিকে বড় বেশি সীমাবদ্ধতা। আমার সম্মুখে অপেক্ষমান এক পুনরাবৃত্ত জীবন। আমি যতবেশি শৃঙ্খলহীন হবার চেষ্ট করি না কেন- আমাকে অতিক্রমের সাধ্য আমার নেই।

গাছের বিপদজনক ডাল থেকে যে বন্ধু ঘুড়ি পেড়ে আনত, মধ্যম ডাল থেকে নেমে তাকে বলেছি, আরেকটু হলে আমিও পারতাম, পারতাম কিনা কখনও পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। কারণ আমার আগেই কেউ না কেউ পৌঁছে যেতো সুউচ্চ ডালে।

যে বন্ধুটি বরাবর পড়াশোনায় প্রথম হয়েছে, তাকে উৎসাহ দিয়েছি। যে বন্ধু দৌঁড়ে প্রথম হতো, তার সাথে প্রতিযোগিতায় যাইনি। যে বন্ধুটি বখে গিয়েছিলো তার সমালোচনা করেছি মুখরভাবে। তবু তার বখে যাওয়ার স্পর্ধা তার প্রতি আমাকে শ্রদ্ধাশীল করেছে।

প্রতিদিন নিজেকে আবিষ্কারের মাঝেই তো বেঁচে থাকার আনন্দ। কিন্তু একটা মানুষ যদি নিজেকে পুরোপুরি জেনে যায়, তখন শুধুমাত্র বেঁচে থাকা ছাড়া তার কিছুই করার থাকে না। পলেস্তার খসা এক পোড়োবাড়ি হয়ে যায় তার মন, বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ হয়- যার কাঠামো স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। কিন্তু আমি যদি কোনো জন্মন্ধর কাছে জেনে নিতাম দৃষ্টির ভেদ, কোনো পঙ্গুর কাছে জানতাম গতির সাবলীলতা, বোবার কাছ থেকে জানতাম ভাষার অর্থ- তবু আমি নিজের অবস্থান মেনে নিই না। নিজেকে ঠেলে দিতে চাই নিজস্ব সীমানার ওপারে। যেনো মহাকাব্যিক এক সংশপ্তক। আমি দাঁড়াই, শেকলের ঝনঝন শব্দ বেজে ওঠে। আমি ভাঙতে চাই, সেই শেকল আমাকে তাড়া করে পাগলা কুকুরের মতো।

৩য় জন
কিন্তু আমার তো আলোকোজ্জ্বল সকাল ছিলো, বিশ্বাসী দুপুর ছিলো, ছিলো প্রফুল্ল বিকেল। এখন মনে হচ্ছে আপনাদের বোধ আমার বোধের সাথে একাত্ম হয়ে আছে। কাল উপহাস করে যে দুঃখকে মনে হয়েছে অলীক, অচেনা- মনে হয়েছে যে আগন্তুকের সাথে আমার কখনো দেখা হবে না। আজ মনে হচ্ছে সেই আগন্তুককেই আমি আমার ভেতরে বয়ে চলেছি বহুকাল ধরে। এ যেনো আমার সত্ত্বার মতোই সত্য।

১ম জন
আমি যখন কাঁদি, তখন আমি দূরবর্তী বিলাপ শুনতে পাই। যখন বাঁচাও বলে চিৎকার করি, তখন সাহাস্য কণ্ঠের চিৎকার ধ্বনি আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয়ে আসে। যারা চিৎকার করে, তারা নিজেরাই হয়তো শুনতে পারে না সেই চিৎকার।

২য় জন
একই সমতলে তিনটি বিন্দু আমরা। একই রেখায় বসবাস। তবু নিতান্ত অপরিচিত। একজনের ব্যক্তিগত অন্ধকার স্পর্শ করে আছে অন্যজনের আাঁধার।

৩য় জন
আপনাদের কী মনে হয়? আমরা একে অন্যকে উপলব্ধি করতে পারছি?

১ম জন
আপনাদের কী মনে হয়? আমরা একে অন্যকে স্পর্শ করতে পারছি?

২য় জন
আমরা নিজেরাই কি নিজেদের কখনও স্পর্শ করতে পারি?

শাহেদ  ইকবাল: নাট্যকার, অভিনেতা। সদস্য, প্রাচ্যনাট, ঢাকা।