Full premium theme for CMS
শোকগাথা আর আশা-আশঙ্কা নিয়ে থিয়েটারচর্চা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
শোকগাথা
মনে-প্রাণে থিয়েটার করা লোকের বড় অভাব। করতে হয় বলেই যেনো বেশিরভাগ লোক থিয়েটার করে যাচ্ছেন। তারা নাট্যকর্মী নন, কিংবা নন নাট্যজনও। তারা শ্রেফ ‘লোক’। আলু-পটল বেঁচতে পারতেন, তাজা গরুর মাংসও হয়ত বেঁচতে পারতেন। তা না করে কে যেনো তাদের দিব্যি দিয়েছে থিয়েটার করতে, আর তারা থিয়েটার করে যাচ্ছেন। থিয়েটার করে যাচ্ছেন বলা ঠিক হবে না, কারণ তারা যাচ্ছেন আর আসছেন। কোনো একদিন এসে থিয়েটারটার সমস্ত দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে চলে যান। ফিরে আসেন কয়েকদিন অথবা কয়েকমাস অথবা কয়েকবছর পর। এসেই থিয়েটারটার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং যাবতীয় স্থবিরতার জন্য কে কে দায়ী তা বের করতে থাকেন। এই লোকগুলোর অদ্ভুত চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য! এরা উপস্থিত হন ‘নেতৃত্ব’ নিয়ে, ‘সরগরম’ করেন মহড়াকক্ষ। কিন্তু তাদের চলে যাওয়ায় কোনো শূন্যতা সৃষ্টি হয় না। পানিতে ঢিল ছোঁড়ার মতো- পড়লে শব্দ হয় কিন্তু ক্ষণকাল পরেই অস্তিত্ব হারায়।
এর বিপরীতে কিছু নাট্যজন কাজ করে যায়।
এমন এক নাট্যজন ছিলো সাকি-এ-ফেরদৌস। গত ২১ মে ২০০০ হঠাৎ করেই চলে গেল সাকি। কেনো চলে গেল জানালো না, জানার কোনো উপায়ও রেখে গেল না।
আমাদের দেশে মঞ্চ নাট্যকর্ম এখনো বিনা বেতনে বনের মোষ তাড়ায়। একটা সময় ছিলো, স্বাধীনতার পর পর, যখন এই মোষ তাড়ানোর কাজটা সামাজিক মর্যাদা পেয়েছিলো। সমাজ-ভাবনা নিয়ে মানুষের জন্য, শিল্পের জন্য কেউ মঞ্চে দাপাদাপি করছে, এব্যাপারটা অনেকটা ঈর্ষার চোখে দেখতো সমাজ। মুক্তিযুদ্ধ ফেরৎ বিপ্লবী যুবক আর ষাটের দশকের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যে কাজে হাত দিয়েছে, সেই কাজের প্রতি শ্রদ্ধা না রেখে উপায়ই বা কী? ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত মেধাবী আদর্শবাদী যুবকদের যেকোনো কাজের প্রতিই সমাজের আস্থাটা ছিলো প্রচণ্ড। আস্থা রাখার মতো শিক্ষা, যোগ্যতাও তাদের ছিলো (এবং এখনও আছে)। কিন্তু স্বাধীনতার পর, একদলীয় স্বৈরাচার আর বহুদলীয় স্বৈরাচার আর সামরিক স্বৈরাচার আর গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারের অধীনে শিক্ষিত (এতো বৈরি সমাজ ব্যবস্থায় কি ‘শিক্ষিত’ হওয়া সম্ভব?) লোকজন যখন মঞ্চে আসা শুরু করলো, তখন কিন্তু সেই আস্থা, সেই শ্রদ্ধাবোধ আর রইলো না। যে সমাজ নিজেকে কলুষিত করে একটা প্রজন্মকে ‘অন্ধকার শিক্ষায়’ শিক্ষিত করলো, সেই কুশিক্ষার দায়ভার এখন বহন করতে হচ্ছে সেই অবহেলিত প্রজন্মকেই। বর্তমানে যে ছেলে-মেয়ে মঞ্চ নাটকে (টেলিভিশন নাটকে নয়) সময় দেয় তাকে পরিবার থেকে, সমাজের পক্ষ থেকে অশ্রদ্ধা করা হয়। অশ্রদ্ধার কারণ এই নয় যে, একটা বেগানা গুনাহর কাজে সে সময় নষ্ট করছে। অশ্রদ্ধা করা হয় এজন্য যে, এটা বড়ই ‘অ-অর্থনৈতিক’ এবং ফলেই বোধকরি ‘অ-অর্থপূর্ণ’ কাজ। মঞ্চ নাটকের মতো ‘অসামাজিক কাজ’ করার চেয়ে সল্প বসনে মডেলিং এর মতো ‘সামাজিক কাজ’ করা অনেক পূণ্য বলে স্বীকার করা হয়। কারণ, যে কাজেই নিয়োজিত থাকুন না কেনো, সেই কাজ থেকে- ক. ‘অর্থ উপার্জন করতে হবে, নতুবা খ. ‘নাম’ উপার্জন করতে হবে (দু’টোই উপার্জন করলেতো একেবারে সোনায় সোহাগা)। দুঃখের ব্যাপার হলো মঞ্চ নাটকের বেলায় এ দু’টোর একটিরও ছিঁটেফোঁটা পর্যন্ত নেই। এটা যে কেবল থিয়েটারের বেলায় হচ্ছে তা কিন্তু না। প্রগতিশীল বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদেরও একই হাল। সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ তাদের আছে বলেই হয়ত সমাজ তাদের অকর্মণ্য ভাবতে শুরু করেছে।
পরিবার এবং সমাজের এতো নেতিবাচক মনোভাবকে উপেক্ষা করে কোনো কোনো নাট্যকর্মী মঞ্চ আঁকড়ে থাকছে না এমন কিন্তু নয়। ঠিক সেই মনোভাব সম্পন্ন নাট্যজন সাকি হঠাৎ করেই বিদায় নিলো চিরকালের জন্য। সাকি’র বিদায়-কলাম লিখতে গিয়ে এতোসব ‘আজেবাজে’ কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, পরিবার, সমাজ তথা দেশের এই বৈরি পরিবেশকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এই যে একটি মেয়ে দাপটের সাথে অভিনয় করে গেল, মঞ্চে কাজ করে গেল অবলীলায়, তার মাহাত্ম্য বোঝানো। সাকি একাধারে কাজ করেছে ঢাকার নাট্যদল ‘দৃশ্যপট’ এবং ‘জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার- সাভার’-এ। বিভিন্ন নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে, পার্শ্ব চরিত্রে, এমন কী নেপথ্যে আবহসংগীত নিয়ন্ত্রণসহ হেন কোনো কাজ নেই যেখানে সাকি’র উৎসাহ এবং আন্তরিকতা ছিলো না? একই নাটকের কোনো শো’তে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করার পর পরবর্তী শো’তে বিকল্প (সাবস্টিটিউট) হিসেবে যখন কোরাসে সামান্য একটি চরিত্রে মহড়া দিতো, তখনও কে কবে দেখেছে তার সময়নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার অভাব? ঢাকার মঞ্চে তার সর্বশেষ নাটক ‘সক্রেটিসের জবানবন্দী’-তে তার ভূমিকা কী ছিলো! ‘সাধারণ, অচ্ছুৎ’ আবহসংগীত নিয়ন্ত্রণের কাজ করতো নেপথ্যে বসে। অথচ এই ‘সামান্য’ কাজটির জন্য কত সময়নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার সাথে উপস্থিত হতো মহড়া কক্ষে!
সাকি’র এই থিয়েটারি মনোভাবকে দলের সবাই-ই যে সমীহ করতো এমনটি কিন্তু বলা যাবে না। ঐযে বলা হলো, থিয়েটারে কিছু ‘লোক’ আছে যারা দলে নেতাগিরি করে, দীর্ঘ বিরতি দিয়ে দলে ফিরে দলের স্থবিরতার কারণ খোঁজে, তারা কিন্তু সাকি’র উপর কম মাতব্বরী করেনি। সময়নিষ্ঠ সাকি’কে থিয়েটার শিখতে হতো তাদের কাছেই। থিয়েটারটার ইতিহাসের সাথে ঐ লোকদের সম্পর্ক যে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত সে কথাও সাকি’কে বহুবার শুনতে হয়েছে তাদের মুখ থেকেই। কিন্তু সাকি যে সময় আমাদের ছেড়ে চলে গেল, তার বহু আগেই ঐ লোকগুলোর কেউ কেউ চিরকালের জন্য চলে গেছে থিয়েটার ছেড়ে!
পরিবার চায় না থিয়েটার করা হোক, সমাজ চায় না থিয়েটার করা হোক, রাষ্ট্র চায় না থিয়েটার করা হোক। এতো ‘না চাওয়া’র মাঝে সাকি’র মতো নাট্যকর্মী হারানোর বেদনা কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়? সাকি দৃশ্যপটের নাট্যকর্মী, সে ছিলো আমাদের অনুপ্রেরণা। তার বিদায়ের পর নাট্যকর্মীর অভাব না হয় পূরণ হবে, কিন্তু অনুপ্রেরণার জায়গাটা যে শূন্যই থেকে যাবে- তার কী হবে?
ফিরে দেখা
‘রেট্রোস্পেক্টিভ’ এর বাংলা করা হয়েছে ‘ফিরে দেখা’। যুৎসই অনুবাদ বটে। দু’পক্ষই ফিরে দেখে। দর্শক ফিরে দেখে তাদের শিল্পীর অতীত সৃষ্টিগুলোকে এবং শিল্পী নিজেই ফিরে দেখেন তার সৃজনশীল কাজগুলোকে। এসব আয়োজনে আনন্দিত হন দর্শক আর উপকৃত হন শিল্পী। উপকৃত হন, কেননা, শিল্পী নিজেকে নিজে কতটা অতিক্রম করতে পারলেন তা দেখার সুযোগ তিনি পান। এই দেখাটা একজন শিল্পীর জন্য বড় বেশি প্রয়োজন।
মানুষের সৃজনশীলতার উত্তরণ ঘটার পেছনে সমাজ তথা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শিল্পগুলোর উপস্থিতি একটা বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। আর্থ-সামাজিক ও কৃৎকৌশলগত উন্নতি শিল্পীকে সৃষ্টিশীল রাখতে সহযোগিতা করে। কিন্তু সৃষ্টির শুরুটা হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বিদ্যমান সব শিল্পকর্ম শিল্পীর অনুপ্রেরণা কিন্তু নিজের শিল্পকর্ম তার প্রতিদ্বন্দ্বী। তার সার্বক্ষণিক লড়াই নিজের সৃষ্ট শিল্পের সাথে। নিজেকে নিজে অতিক্রম করতে যখন ব্যর্থ হন, তখনই সৃজনশীল কাজে আসে স্থবিরতা। সুতরাং যখন কোনো শিল্পমাধ্যমে স্থবিরতার ছায়া দেখা যায়, তখন এটা ভাবা অমূলক হবে না যে, এই স্থবিরতা মূলত ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যর্থতার সমষ্টি মাত্র।
নতুন প্রজন্মের নাট্যকর্মীদের মেধা নিয়ে বেশ রসালো আলোচনা আমাদের থিয়েটার অঙ্গনে বহুদিন ধরেই নিয়মিত ‘ভোজ’ হিসেবে পরিবেশন করা হচ্ছে। সম্পূর্ণ মেধাহীন কিছু ছেলে-পুলে কেবল টেলিভিশনে মুখ দেখানোর উদ্দেশ্যেই থিয়েটার করতে আসে- এমন মন্তব্য প্রায় সবার। বিভিন্ন জায়গায় শ্যুটিং করার সময় টিভি-মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ‘মঞ্চকর্মীরা’ নতুন প্রজন্মের নাট্যকর্মীদের সাক্ষাতে বিরক্ত হন। তারা কোনোভাবেই বুঝতে পারেন না, টেলিভিশনে মুখ দেখাবার মধ্যে কী আনন্দ নতুনরা পায়! কী মোহেই-বা নতুনরা দৌঁড়ায়! নতুনদের এই দৌড়াদৌঁড়ির জন্যই থিয়েটার পাড়ায় স্থবিরতা, একথা কথা তারা নির্লজ্জের মতো বলে বেড়ায়। কিন্তু স্থবিরতার আসল কারণ কী?
ঐযে বলা হলো- শিল্পী নিজে নিজেকে অতিক্রম করতে যখন ব্যর্থ হন, তখনই শিল্পে আসে স্থবিরতা- সেটাই হলো আসল কারণ। যারা এতো দীর্ঘসময় ধরে সৃজনশীল কর্মে লিপ্ত আছেন, যাদের সৃষ্ট শিল্পকর্ম দ্বারা বাংলাদেশের মঞ্চ আজ সমৃদ্ধ, তারা কি তাদের নিজেদেরকে সত্যিই অতিক্রম করতে পারছেন? যদি অতিক্রম করে থাকেন, তবে কি থিয়েটারপাড়া স্থবির হওয়া সম্ভব? আর যদি অতিক্রম না করে থাকেন, তবে কি তারা এই স্থবিরতার দায়ভার একটুও গ্রহণ করবেন না? ব্যাপারটা মোটেই তর্কের নয়, ব্যাপারটা সম্পূর্ণই বোধের, অনুভবের এবং আত্মসমালোচনার। এই আত্মসমালোচনার সুযোগ তৈরি করে দেয়ার জন্য ‘ফিরে দেখা’ বা ‘রেট্রোস্পোক্টিভ’ এর কোনো বিকল্প নেই।
গত একবছরে আমাদের থিয়েটার পাড়ায় তিন-তিনটি ‘ফিরে দেখা’র আয়োজন হয়ে গেল। বাংলা নাট্যের আঙ্গিক নিয়ে যিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, সেই নাটককার সেলিম আল দীনকে নিয়ে ‘ঢাকা থিয়েটার’ গত সেপ্টেম্বরে (১৯৯৯) আয়োজন করেছিলো নাটোৎসব। এরপর বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের অন্যতম সব্যসাচী শিল্পী নাটককার, অভিনেতা, নির্দেশক ও সংগঠক আবদুল্লাহ আল-মামুনকে নিয়ে ‘থিয়েটার’ (বেইলী রোড) গত নভেম্বর-ডিসেম্বর (১৯৯৯) আয়োজন করেছিলো ‘ফিরে দেখা’ এবং এ বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চে (২০০০) আমাদের আরেক সব্যসাচী গুণীজন নাটককার, নির্দেশক, অভিনেতা ও সংগঠক মামুনুর রশীদকে নিয়ে ‘আরণ্যক নাট্যদল’ শেষ করলো ‘দ্রোহ দাহ স্বপ্নের নাট্য আয়োজন’। সেই তিনটি আয়োজনেই নাট্যপাড়া ছিলো মুখরিত। দর্শক তাদের প্রিয় শিল্পীদের নতুন-পুরনো সৃষ্টিগুলোকে পর্যবেক্ষণ করেছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। অন্যদিকে তিন শিল্পীর সুযোগ হয়েছে নিজেদের সৃজনশীল কাজগুলোকে সমালোচনার চোখ দিয়ে দেখার। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের এই ঠা-া আবহাওয়ায় এই দেখাটার প্রয়োজন ছিলো প্রশ্নাতীত। তিন শিল্পী আত্মসমালোচনার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব স্থবিরতা (যদি থাকে) কাটিয়ে উঠবেন, এ প্রত্যাশা নাট্যজনদের। ধন্যবাদ সেই সংগঠনগুলোকে যারা গুণীজনদের সম্মান দিল। শত প্রণাম সেই গুণীজনদের যারা এমন সংগঠন তৈরি করলেন। আমাদের আরো যারা গুণীজন আছেন তাদের সৃজনশীল কাজগুলোকেও সবাই ‘ফিরে দেখা’র সুযোগ পাব, এ আশা আমাদের সবার। তা না হলে বাংলার নাট্যমঞ্চে নাটক নিয়ে ‘খামাখা খামাখা’ যে-হারে ‘ঠাট্টা তামাশা’ শুরু হয়েছে, তা রোধ করে স্থবির নাট্যপাড়াকে গতিশীল করা যাবে না।
আশার ভেতরে আশঙ্কার উঁকি মারা
কয়েকদিন আগেও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় একটি ‘আলোচিত’ বিষয় ছিলো। ‘আলোচিত’ হওয়ার কথা ছিলো না, তবুও ‘আলোচিত’ হয়েছিলো, বাংলা মায়ের এ এক দুর্ভোগ!
প্রায়শই এমন হয়। কোনো না কোনো অজুহাতে যেভাবেই হোক, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সামনে আনা হয়। তার সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করা হয় প্রগতিশীল জনতাকে। প্রগতিশীল জনতা কেবল মৌলবাদ বিরোধী নয়, তারা বেকারত্ব-বৃদ্ধি বিরোধী আর সন্ত্রাস বিরোধী আর অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি বিরোধী আর নারী নির্যাতন বিরোধী আর এমনকি ঢাকায় ক্লিনটনের দ্বারা গ্যাস চুক্তিরও বিরোধী। এতো কিছুর বিরোধী যে জনতা, তাদের সন্তুষ্ট রাখা কষ্টের বৈকি। তাই ঐ প্রগতিশীল শ্রেণীকে অন্যত্র ব্যস্ত রাখার ‘দায় দায়িত্ব’ পড়ে সরকারের উপর। ফলে যে বিষয়ে এই জনতা একটু বেশি মাত্রায় সচেতন, ঐ যে বলা হলো মৌলবাদ, সেই বিষয়টার প্রতি সরকার তখন নজর দেয়। যেকোনো উপায়ে ঐ মৌলবাদকে মাথাচাড়া দেবার সুযোগ করে দেয়া হয় এবং প্রগতিশীল অংশকে ব্যস্ত রাখা হয় তাদের সাথে যুদ্ধে। ‘লাভের লাভ’ যেটা হয়, অন্যান্য ইস্যুগুলো নিয়ে বিদ্রোহ করার সময়টা যায় পিছিয়ে। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত চিন্তার পীঠস্থান, তার উপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়তো আরো এক কাঠি সরস হওয়ার কথা। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম শ্রদ্ধেয় জাহানার ইমাম-এর নামে হতেই পারে। এই পানিতো এদ্দুর গড়াবার কথা না। তবুও গড়ায়। পানিকে যত গড়ানো যায়, পরিস্থিতি ততই ঘোলা হয়, সময়ক্ষেপণ ততই দীর্ঘ হয়, মূল সমস্যাগুলোর বিদ্রোহ তখন চাপা পড়ে- সে কথাতো বলাই হলো।
যেকোনো সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বেই প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে হয়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন কিংবা ব্যক্তি কেবল ঐ আন্দোলনের পক্ষে ইতিবাচক প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। এ ধরনের উদাহরণ ব্রিটিশ আমলে আর বায়ান্নতে আর ষাটের দশকে আর উনসত্তুরে আর একাত্তুরে আর এমনকি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও দেখা গেছে। এসব পরিস্থিতিতে, ক্ষেত্র বিশেষে, কোনো কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এমন অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন যা জনগণের উপর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের চেয়েও বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তিনি যা বলেন জনগণ তা গ্রহণ করেন। অনেক আগে, বছর সাত-আটতো হবেই, বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি ধারাবাহিক নাটকের শেষ পর্বের আগে ঢাকাসহ সারাদেশে ‘বাকের ভাই-এর ফাঁসি দেয়া চলবে না’ শ্লোগান নিয়ে মিছিল হয়েছিলো। সাপ্তাহিক বিচিত্রাসহ কয়েকটি পত্রিকায় বড় বড় প্রচ্ছদ প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিলো। বিটিভির নাটক সম্পর্কে অবহিত নন এমন ব্যক্তি ঐ শ্লোগান শুনে আঁৎকে ওঠবার কথা। কে এই ‘বাকের ভাই’? কে এই ‘জাতীয় নেতা’ যার ফাঁসি মওকুফের দাবিতে এ এত মিছিল? আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম একজন শিল্পীর ঈর্ষণীয়, জনপ্রিয়তা। বাঙালি এখনো অর্ধ শিক্ষিত জাতি, ফলেই বোধকরি আবেগপ্রবণ। তাদের সহজেই বশে আনা যায়, নেতৃত্ব যদি প্রগতিশীল হয় তবে এর দ্বারা সুফল পাওয়া সম্ভব। আবার মন্দ এই অর্থে যে, প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব একে ব্যবহার করতে পারে ভিন্ন খাতে।
আমাদের সম্পর্কে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ন্যূনতম ধারণা অবশ্যই আছে। তারা অনেক আগেও দেখেছে, এই সেদিনও দেখলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাহানারা ইমামেরই নেতৃত্বে কত লোক তাদের (প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের) প্রাণপ্রিয় নেতার মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে গণরায় দিয়েছিলো। সুতরাং তারা জানে প্রয়োজনে আমরা কী পরিমান বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারি। তবুও তাদের চেষ্টা তারা করে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তারা ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার হুমকি দিয়েছে, এমনকি কাফনের কাপড় পর্যন্ত পাঠিয়েছে। প্রগতিশীল জনতা এতে অবাক হয়েছে বলে মনে হয় না।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের টাল-বাহানার এক পর্যায়ে প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব হুমায়ূন আহমেদ ঘোষণা করলেন, তিনি তাঁর পরিবারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে স্বাধীনতা দিবসে দিনব্যাপী অনশন করবেন। যদিও তিনি আপামর জনগণকে এই অনশন কর্মসূচিতে অংশ নিতে বলেননি তবুও জনগণ তাদের নিজ দায়িত্বেই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলো। সারা দেশেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ হয়ে প্রগতিশীল জনগণ অনশন কর্মসূচি পালন করে। দেশব্যাপী একটি অন্যরকম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করলো জনগণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বেও একবার অন্যরকম স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়েছিলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এবারে জনগণের স্বতঃস্ফূর্র্ত অংশগ্রহণ প্রগতির পথে আশা জাগায়, আশায় বুক ভরে এই দেখে যে. আমরা প্রয়োজনের মুহূর্তে জ্বলে উঠতে পারি। বিদ্রোহ আমাদের সংস্কৃতি।
এতো আশার ভেতরেও মনের কোনো এক কোণে কেমন যেন ক্ষীণ আশঙ্কাও উঁকি মারে। সেই আশঙ্কার কথাটি এবার বলা যাক।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্ট পরিস্থিতির পানি যখন অনেকদূর গড়িয়ে গেল তখন শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদ ঘোষণা করলেন, ওনার চুপ করে ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়। মনে প্রশ্ন জাগে, এই বিদ্রোহের উদ্দেশ্য কি ভাইকে রক্ষা করা নাকি মৌলবাদ-প্রতিক্রিয়শীল চক্রের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা? একজন শিল্পীর উপর গভীর শ্রদ্ধা আছে বলেই আমরা বিশ্বাস করি, ভাই নয় মৌলবাদ-প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করাই তাঁর বিদ্রোহের মূল উদ্দেশ্য ছিলো। কিন্তু তাঁর অন্য একটি উক্তি আমাদের বিশ্বাসের আঘাত হানলো। তিনি বলেছেন- তাঁর কর্মকাণ্ডের সমস্ত অনুপ্রেরণা তিনি শাহজালাল (রা:) এর দরগাহ থেকে পান এবং প্রত্যেক কাজের পেছনে শাহজালালের (রা:) ‘দোয়া’ আছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। অবাক করা কথা! আধ্যাত্মিক সাধকের দোয়া-কলমা নিয়ে একজন প্রগতিশীল মানুষ পথ চলছেন, এটা কী করে গ্রহণযোগ্য? তারপর অনশন শেষে তিনি সদলবলে শাহজালালের (রা:) মাজার ‘জিয়ারত’ করলেন। তিনি এবং আরো কয়েকজন জনপ্রিয় শিল্পী হাত তুলে ‘দোয়া’ চাইছেন এমন ছবিও পত্রিকায় এসেছে। প্রশ্ন জাগে এই ‘দোয়া’ কার কাছে চাওয়া? মৌলবাদ-প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আর আমাদের বিশ্বাস যদি একই হয় তবে তাদেরকে (মৌলবাদ-প্রতিক্রিয়াশীল চক্র) শক্র হিসেবে চিহ্নিত করা কিভাবে সম্ভব? কথাগুলোতে অনেকে মনে আঘাত পেতে পারেন, এটাই ‘স্বাভাবিক’। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমরা স্মৃতিসৌধে আর শহীদ মিনারে গিয়ে যদি দোয়া-দরূদ পড়ি তবে সেই অনুপ্রেরণা আমাদের কতটুকু প্রগতিশীল করবে তা-ও ভাববার বিষয়। মনের কোনো বিশেষ জায়াগায় যদি ধর্মীয় কোনো উন্মাদনা লুকিয়ে থাকে তবে সেই উন্মাদনা একসময় মৌলবাদীদের কাতারে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করতে পারে বলেই আমাদের ধারণা।
শ্রদ্বেয় হুমায়ূন আহমেদ আরেকটি চমক লাগানো উক্তি করেছেন। অনশন উত্তর সাক্ষাৎকারে ভোরের কাগজকে তিনি বলেছেন- ‘আমার দায়িত্ব শেষ। এখন অন্যদের পালা’ (!)। একজন সমাজ সচেতন শিল্পীর দায়িত্ব কোনো একটি বিশেষ কাজের কোনো একটি বিশেষ অংশের পর শেষ হয়ে যেতে পারে- এটা অবিশ্বাস্য- যুক্তিহীন। এবং ‘এখন অন্যদের পালা’-বলে তিনি যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন ‘অন্যদের’, সেটাই বা কতটুকু বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন হলো?
আমাদের আশঙ্কার আরও একটি জায়গা আছে। হুমায়ূন আহমেদের ডাকে এই যে পাগল প্রায় জনগণ সাড়া দিলো তাঁরা অন্য কোনো ইস্যুতে, যেসব ইস্যুগুলোর ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদের মাথা ব্যাথা নেই, সেগুলোতে কি প্রতিবাদী হবেন না? অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যুর কথা বাদ দিয়েও যদি বলি টানবাজার থেকে পতিতাদের উচ্ছেদ কিংবা উদীচী হত্যাকাণ্ড কিংবা সন্ত্রাসের ‘গণতন্ত্রায়ণ’ কিংবা তেল-গ্যাস চুরির যে পাঁয়তারা চলছে, সেসব বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদ ডাক দেননি বলেই কি জনগণ ভাবছেন যে তাদের দায়িত্ব সেগুলোর ব্যাপারে নেই?
শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা আমদের কাছে ঈর্ষণীয়। আমরা তাঁকে সাধুবাদ দিই। এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা আমাদের আশার আলো দেখায়। একজন শিল্পীর জনপ্রিয়তা সমাজের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেয়। মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তোলে। কিন্তু তিনি নিজেও যদি দোয়া-দরূদ-কলমা দিয়ে মৌলবাদ রুখতে চান তবে সেই আশার ভেতরে আশঙ্কারও গন্ধ পাওয়া যায় বৈকি। ঐ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তিনি যদি হঠাৎ ডাক দিয়ে বসেন যে, স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারকে ‘মাজার’ বানাতে হবে- তখন ভয় হয়, না জানি লক্ষ লক্ষ জনতা সেই ডাকেও সাড়া দিয়ে বসবে।
হাসান শাহরিয়ার
সেপ্টেম্বর ২০০০
সেন্ট্রাল রোড, হাতিরপুল, ঢাকা