Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

থিয়েটারে মন্দা : প্রয়োজন নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা বাড়ানো

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

স ম্পা দ কী য়

ইদানিং বড় বেশি মূল্য দিয়ে সাক্ষাৎ ঘটছে থিয়েটারওয়ালাদের। নিজেরা এক জায়গায় ব’সে আড্ডা দেয়া কিংবা জড়ো হয়ে হইচই করা, অনেকটা ইতিহাস হয়ে গেছে। সেই ইতিহাসকে বর্তমান করতে বড় বেশি মূল্য দিতে হ’লো।

গত ২৭ জুন, এক তরুণ নাট্যজন, আরজু রহমান চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। তাঁর শোকসভায় জড়ো হয়েছিলেন ঢাকার থিয়েটারওয়ালারা, মহিলা সমিতি মিলনায়তনে। পরস্পর বিচ্ছিন্ন, পরস্পর পরিচয়হীন নাট্যজনদের একত্রিত করতে পেরেছিলো একটি ‘মৃত্যু’।

এই শোকসভায় বক্তারা প্রায় সবাই চেষ্টা করেছেন, আরজু রহমানকে ‘আমাদের লোক’ হিসেবে পরিচয় দিতে। কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছেন এভাবে যে, বক্তারা অনেকেই তাঁদের বক্তব্যে ‘আরজুর সাথে যদিও আমার পরিচয় ছিলো না’ বা ‘গত দু’মাস হলো আরজুকে চিনতাম’ কিংবা ‘যদ্দুর শুনেছি আরজু খুব হাসিখুশি ছেলে ছিলো’ অথবা ‘কয়েকদিন আগে একটি মিটিং-এ আরজুর সাথে আমার প্রথম পরিচয়’- ইত্যাদি ধরনের কথা ব্যবহার করেছেন। তো এই যে, পারস্পরিক দূরত্ব, এই দূরত্ব সত্ত্বেও তাঁর শোকসভা করতে হয়েছিলো, কেননা, আরজু রহমান ছিলেন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের অনুষ্ঠান সম্পাদক। কেবল ‘বর্তমান প্রজন্ম’ না, বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর নাট্যজনরাও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের অনুষ্ঠান সম্পাদককে ‘তেমনভাবে’ চিনতেন না, এটা কম ‘বড়’ কথা নয়।

কাউকে দোষারোপ করার জন্য নয়, কেবল আমাদের, থিয়েটারওয়ালাদের মধ্যকার বর্তমান ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ’ সম্পর্কটা বোঝাবার জন্যই কথাগুলো বলা। স্বাধীনতার পর থেকে মধ্যআশি পর্যন্ত বেইলী রোডে ছিলো কিছু দোকান-পাট, দালান-কোঠা আর দু’টি জমজমাট নাট্যশালা। অবশ্য নাট্যশালা দু’টি জমজমাট ছিলো তাদের স্থাপত্য শিল্পের কারণে নয়, নাট্যজনদের উচ্ছল পদচারণার বদৌলতে। আর এখন, এই নব্বই দশকের শেষে এসে, সেই বেইলী রোডে দাঁড়িয়ে আছে শপিং সেন্টার, বহুতল এ্যাপার্টমেন্ট এবং দু’টি বিরান নাট্যশালা।

থিয়েটারওয়ালাদের এই যে পরস্পর বিচ্ছিন্নতা, এর কারণ কী? কারণ কি এই যে, ঢাকায় এখনো জাতীয় নাট্যশালা নেই? অথবা কারণ কি এই যে, ‘নতুন প্রজন্মের’ থিয়েটারওয়ালারা প্রকৃতপক্ষে থিয়েটার বিমুখ? কিংবা কারণ কি এই যে, এই মাধ্যমের কর্ণধার ব্যক্তিদের থিয়েটারকে অনেক কিছু ‘দেয়া’ হয়ে গেছে বলে ভাবছেন? হ্যাঁ, হতে পারে এই কারণগুলো এককভাবে না হলেও সম্মিলিতভাবে থিয়েটারচর্চায় একটা আপাত স্থবিরতা ডেকে এনেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে কারণটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিতে, তা হ’লো- আমরা, থিয়েটারওয়ালারা, আসলে সমাজ ও রাজনীতে বিমুখ হয়ে পড়েছি। রাষ্ট্রে সমসাময়িককালে ঘ’টে যাওয়া বড় বড় অনিয়ম, অত্যাচারেও আমরা নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছি। অন্যান্য পেশাজীবী কিংবা শ্রমজীবীদের উপর রাষ্ট্রের এই যে অন্যায় অবিচার এবং এতে আমাদের নীরবতা, সেই নীরবতা এক সময় নিজেদের উপর রাষ্ট্রকৃত অনাচারেও নীরব থাকতে বাধ্য করে।

বিষয়টি একটু খোলাসা করা যাক।

দূর অতীত নয়, নিকট অতীতে ঘ’টে যাওয়া দু’একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। কিছুদিন পূর্বে নারায়ণগঞ্জ টানবাজারের পতিতাদের রাতের অন্ধকারে উচ্ছেদ করা হয়েছে ‘পুনর্বাসন’ করার জন্য। পৃথিবীর আদিমতম এই নির্মম পেশায় যারা নিয়োজিত ছিলো তাদের প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো মহলের প্রতারণার শিকার হয়ে সেখানে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। কিন্তু যারা ভোক্তা, তাদেরকে সমাজে অবাধ চলাচলের অধিকার নিশ্চিত করে এই অবহেলিত পেশাজীবীদের কেন উচ্ছেদ করা হলো? আরেকটি ঘটনা, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের একটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন চলছে ‘ধর্ষক গ্রুপ’ আর ‘খুনি গ্রুপে’র ‘অস্তিত্বে’র লড়াই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্তান সার্টিফিকেট নিয়ে ফিরবে নাকি লাশ হয়ে ফিরবে এ নিয়ে এদ্দিন অভিভাককদের মধ্যে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলো না। সেই দুশ্চিন্তায় নতুন সংযোজন ‘ধর্ষক গ্রুপের’ অভিষেক। সেদিন বোধহয় দূরে নয় যেদিন ধর্ষিত ছাত্রীকে ‘পুনর্বাসনের’ জন্য হল থেকে উচ্ছেদ করা হবে। তো এই যে, অ-সভ্য, অ-মানবিক ঘটনা ঘটছে, এর বিপরীতে থিয়েটারওয়ালাদের প্রতিক্রিয়া কী? না, তাদের প্রতিক্রিয়া মোটেই ইতিবাচক না, একেবারে নিষ্প্রভ। এই নিষ্প্রভের কারণ হতে পারে নাট্যজনরা তাদের ‘নাট্য স্থবিরতা’ নিয়ে এতো বেশি চিন্তিত যে, অন্যদের ব্যাপারে ‘নাক গলানো’টা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’-চর্চায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে বলে মনে করছেন। কেউ কেউ হয়তো পতিতাদের ‘দুশ্চারিত্র্য’কে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত পরিবেশে ছাত্রীদের ‘অবাধ বিচরণ’কে দায়ী ক’রে ‘এরকমটা হতেই পারে’- বলে ধরে নিয়েছেন। বিভিন্ন পেশার জনগণের উপর রাষ্ট্রের এই যে অত্যাচার এবং এই অত্যাচারে থিয়েটারওয়ালাদের এই যে ‘পিনপতন’ নীরবতা, এই নীরবতা এক সময় ‘যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে হত্যাযজ্ঞ’ সম্পর্কেও নীরব থাকতে বাধ্য করে। ফলে আমরা, নাট্যজনরা, নিজেদের অজান্তেই পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। আমাদের প্রত্যেকটি সংগঠন, প্রত্যেকটি নাট্যদল, আলাদা আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। একেকটি নাট্যদলের প্রতিটি সদস্যও আবার লড়াই ক’রে যাচ্ছি এককভাবেই। এই যে, এককভাবে বেড়ে ওঠা, পরস্পর বিচ্ছিন্নতা, সম্পর্কহীনতা- এসবই প্রকাশ পেয়েছে আরজু রহমানের শোকসভায়।

এর অবসান প্রয়োজন।

এর অবসানকল্পে এক স্বপ্নের কথা বলা যাক।

এমন কি হওয়া সম্ভব না যে, প্রতিমাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে (ধরা যাক্, মাসের শেষ শনিবার) আমরা, থিয়েটারওয়ালারা, বেইলী রোডের মঞ্চ/করিডোরে একত্রিত হবো? কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা কিংবা সেমিনার না, কেবলই আড্ডায় আড্ডায় কাটিয়ে দেব একটি সন্ধ্যা? সেখানে আমরা সব বিষয় নিয়েই মশগুল হবো। টানবাজারের পতিতা উচ্ছেদ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ধর্ষণ থেকে শুরু করে- নাটকে দর্শক স্বল্পতা, অমুক নাটকের Costume design, তমুক নাটকের performence এ কি খুঁত আছে, কিংবা অমুক নাট্যজনের তমুক দিনের আচরণ কিছুটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ ছিলো কিনা, অথবা আরো আরো অনেক বিষয় নিয়ে হতে পারে এই আড্ডা। আড্ডার ফাঁকে চলবে চটপটি, কিংবা ‘তারাভাই’র চিপস, আর চা তো থাকবেই। এ সব কিছুৃর আয়োজন চলবে মঞ্চের ভেতরে, যেখানে দর্শক বসে, সেখানে। ছোটখাটো একটা মেলার মতো মনে হবে ঐ সন্ধ্যাটা। হট্টগোল আর হৈচৈ এর মধ্যে কেউ যদি হেঁড়ে গলায় ধ্রুপদী সঙ্গীত গাইতে থাকে তাতেইবা কী ক্ষতি? এতো আনন্দের মাঝে কোনো ‘আঁতেল’কে যদি দেখা যায় নাটকের কাগজ ‘নটনন্দন’ কিংবা ‘থিয়েটারওয়ালা’ বিক্রি করছে, তা হলেতো একশোতে একশো।

এতে লাভ কী হবে?

লাভ এটাই যে, আমরা পরস্পরকে চিনবো, জানবো, নিজেরা নিজেদের আরো ঘনিষ্ট হবো। যেমনটি হয়েছিলো সত্তুর থেকে মধ্যআশি পর্যন্ত সময়কালে। আমরা নিজেরা তর্ক করবো, নিজেদের সমালোচনা করবো, ত্রুটিগুলো দূর করবো।

... এবং, এর মাধ্যমেই একটা ‘থিয়েটার সংস্কৃতি’র ভিত গড়ে তোলা সম্ভব।

ইতি
হাসান শাহরিয়ার
সেপ্টেম্বর ১৯৯৯, শুক্রবাদ, ঢাকা