Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

সৈনিক ও জননী

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

দৃশ্য- ১

(একজন পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি টেবিলে বসে লিখছে- তার নাম খালেদ হুসেন)

খালেদ
১৯৭১ সালের শেষ ভাগ। দেশজুড়ে চলছে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ। আমি তখন সীমান্তবর্তী একটি পাকিস্তানি ক্যাম্পে বন্দি। আরো কয়েকজন বন্দির সাথে অপেক্ষা করছি জীবনের অন্তিম মুহূর্তটির জন্যে। বন্দুকের নল থেকে বেরিয়ে আসবে কয়েকটা গুলি তারপর সব শেষ। হঠাৎ করে একদিন এই দুর্ভেদ্য দূর্গে ঢুকে গেল একটা কুকুর। তারপর শুরু হলো নাটক। শেষ পর্যন্ত এই ভাষাহীন প্রাণীটিই বাঁচিয়ে দিয়েছিল আমাকে।

(ফ্ল্যাশ ব্যাক)

দৃশ্য- ২

(সময় সন্ধ্যা। পাকিস্তানি সেনাছাউনি। ছাউনির ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে- ফৌজি অনুষ্ঠানের গান- আয়া মেরে ওয়াতানকে পেয়ারে পেয়ারে পাকিস্তান... ইত্যাদি। দু’জন সৈনিক পাহারারত। একজন গানের সাথে সাথে শিস দিচ্ছে)

সৈনিক- ১
শালা তোর মনে এত আনন্দ আসে কোত্থেকে?

সৈনিক- ২
তুই একটা আওরত-

সৈনিক- ১
খবরদার আওরত আওরত করবি না-

সৈনিক- ২
কেন? বিবির কথা ইয়াদ হয়? দিলে চোট লাগে? আকেলে না জানা- আমার অবশ্য বউটার কথা মনে হয়- বিয়ের পর ভালো করে চেনা জানাটাও হলো না- সোজা যুদ্ধের ময়দানে- চেহারাটা মনে করবার চেষ্টা করি কিন্তু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায়- অবশ্য তোর কার কথা মনে পড়ে জানি না- মালাউন চিজগুলো খুব মনে ধরেছে না?

সৈনিক- ১
শালা শিয়ালকোটের পাঠা-

সৈনিক- ২
দুনিয়াকি মজা লেলো দুনিয়া তুমারি হ্যায় দুনিয়া তুমারি হ্যায়-

সৈনিক- ১
তুই একটা আজব চিজ- একবার ভেবে দেখেছিস- এই যে শত শত হাজার হাজার ছেলে পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সিন্ধু আর খাইবারপাশ থেকে এসে হারিয়ে যাচ্ছে এখানকার কাঁদাপানিতে- এদের বাপ-ভাই, বউ-ঝি’দের কী অবস্থা?

সৈনিক- ২
বউয়ের আঁচলে শুয়ে থাকলেই পারতি, যুদ্ধ করতে আসলি কেন? এসব বদখেয়াল ছোড়দো দোস্ত- আপনা আপনা কাম বানাও- এত ভাবিস কেন? গত কয়েক মাসে বাড়িতে যা পাঠিয়েছিস তাতে তুই মরে গেলেও তোর বউ জিন্দেগিভর বসে বসে খেতে পারবে- তার উপর তুই পাবি সারা জাঁহামে আপনে ওয়াতানকে উচা নাম কিয়া নিশান-ই-হায়দার- এসবের পরেও যদি ইচ্ছে করে তাহলে পাত্রের অভাব হবে না-

(একটা সামরিক কনভয় এসে থামে ক্যাম্পের সামনে। গায়ে কাদামাটি মাখানো অবস্থায় কিছু সৈনিক ও রাজাকার প্রবেশ করে। দূরে একটা কুকুরের শব্দ পাওয়া যায়। সৈনিক- ১, এগিয়ে যায়)

সৈনিক- ১
তুই আবার কোন ফ্রন্ট থেকে?

সৈনিক- ৩
আয় আয় আতু চো চো-

(গলার চেনটা ধরে টেনে নিয়ে আসে। কুকুরের একটা পা রক্তাক্ত)

সৈনিক- ২
চালাও মোহাম্মদ আলী কুত্তার গাড়ি-

সৈনিক- ১
একটা জিনিস খেয়াল করেছো দোস্ত?

সৈনিক- ২
এ শালা কুত্তার রক্ত আর মানুষের রক্ত দুটোই লাল-

(সৈনিক- ৩ একটা ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসে। তারপর গজ আর আয়োডিন দিয়ে পা বাঁধতে থাকে)

সৈনিক- ৪
বাব্বা- একেবারে ফিড হাসপাতালের ডাক্তার-

সৈনিক- ২
কতগুলো মানুষ গুলি খেয়ে এলো সেদিকে খেয়াল নেই- ওনারা শুরু করেছেন কুত্তার চিকিৎসা- ইয়ার্কির একটা মাত্রা আছে-

সৈনিক- ৪
যুদ্ধে এসে যদি গুলিই না খেলো তো খাবে কী? সেরে গেলে ভালো করে ট্রেনিং দিও- ইন্টেলিজেন্সে ঢুকিয়ে দেব-

সৈনিক- ১
ইনফেন্ট্রিতে ঢোকাবো-

সৈনিক- ৪
না- সিগন্যালে ঢোকাবো-

সৈনিক- ২
ঠিক আছে বাবা যেখানে খুিশ সেখানে দিস-

সৈনিক- ৫
ইনি আবার কোন গেরাই? একেবারে ক্যাম্প পর্যন্ত চলে এসেছেন?

সৈনিক- ৪
ইনি হলেন থার্টি নাইন ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের এগার হাজার তিনশত একান্ন নাম্বার সিপাই আব্দুর রহমানের ভগ্নিপতি-

সৈনিক- ৪
দুলাভাই গুলি খেয়েছেন নাকি?

সৈনিক- ৩
তাইতো মনে হয়-

সৈনিক- ২
কার গুলি লেগেছে? আমাদের না মুক্তিদের?

সৈনিক- ১
কী পাগলামি শুরু করেছিস তোরা?

সৈনিক- ৪
দাঁড়াও না বাবা একটু জিজ্ঞেস করে নেই- কী ক্যাপ্টেন সাব আপনি কোন পক্ষের? পাকিস্তানের না জয়বাংলার?

(লাথি দিলে ঘেউ ঘেউ করে উঠে)

সৈনিক- ২
পাকিস্তান জিন্দাবাদ- বলেছে পাকিস্তানের, প্রেজেন্ট আর্ম-

(সৈনিক- ২ ও ৪ স্যালুট করে)

সৈনিক- ৪
একটা ভালো ট্রিটমেন্ট দরকার, এক কাজ করো, ঢাকায় সি.এম.এইচে পাঠিয়ে দাও, কর্নেল রুশদীর কাছে-

সৈনিক- ৩
কর্নেল রুশদীতো ব্রেইন সার্জন-

সৈনিক- ৪
তাতে কী- কুত্তার বুঝি মগজ নাই?

সৈনিক- ৩
আরে ধ্যাৎ এই ব্যান্ডেজেই কাজ হয়ে যাবে- সকালে না হয় কমান্ডারের কাছে নিয়ে যাবো-

সৈনিক- ৪
তা জনাবের দৌলতখানা কোথায়? পাঞ্জাব, সিন্ধু-বেলুচিস্তান না-

সৈনিক- ৩
কী যে বলছিস না-

সৈনিক- ৪
বুঝেছি তোর মতোই লান্ডিকোটালের কাবুলিওয়ালা-

সৈনিক- ৩
বেশি ইয়ার্কি মেরো না- ওস্তাদ যদি শুনতে পারে আর ক্যাপ্টেন সাহেবের কানে যায়, তাহলে সব শালার কোর্ট মার্শাল-

সৈনিক- ৪
ঠিক আছে বাবা, মনে হয় সারাদিন কিছুই খায় নি- লাঙারীদের বলে দ্যাখো কিছু জোটে কিনা? বেশ কাহিল হয়ে গেছে- এক কাজ করো গরম পানি দিয়ে দু’পেগ ব্রান্ডি খাইয়ে দাও- সব ঠিক হো যায়গা-

সৈনিক- ১
তোরা যা শুরু করেছিস তাতে মনে হচ্ছে স্বয়ং টিক্কা খান এসে হাজির-

(নেপথ্যে আকরাম খা আকরাম খা বলতে বলতে কমান্ডার এসে হাজির হয়)

কমান্ডার
কী ব্যাপার? এটা কী?

সৈনিক- ১
আব্দুর রহমানের কাজ-

কমান্ডার
কী করবে এটা দিয়ে?

সৈনিক- ৩
পালবো ওস্তাদ-

কমান্ডার
পালবে? তোমাদের পাগলামির কোনো শেষ নেই-

দৃশ্য-৩

(পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পের ভিতরের একটি বন্দিকক্ষ। কয়েকজন মানুষ পড়ে আছে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায়। সবার শরীরই রক্তাক্ত। বন্দিরা জীবিত না মৃত ঠিক অনুমান করা যায় না। একজন সৈনিক তাদের ইন্টারোগেশন করছে। একজন বন্দি চিৎকার করে উঠে)

বন্দি- ২
মাগো পানি-

সৈনিক- ৬
চোউপ কাফেরের বাচ্চা, তোর মাতো ইন্ডিয়া, শালা গাদ্দার-

(বন্দুক দিয়ে গুতো মারে)

বন্দি- ২
পানি-

সৈনিক- ৬
পানি দেওয়া নিষেধ-

বন্দি- ২
ভাইরে তোমার দুইডা পাও ধরি, আমারে একটু পানি দ্যাও-

সৈনিক- ৬
এই নে পানি-

বন্দি- ২
(মুখে পানি নিয়ে ফেলে দেয়) পানি না পেশাব-

সৈনিক- ৬
চোউপ কাফেরের বাচ্চা, মালাউনের পয়দা মুক্তিবাহিনী ক জয়বাংলা-

(বুট দিয়ে লাথি মারে। একজন দলত্যাগী বাঙালি অফিসার ও রাজাকার ঢোকে)

বাঃ অফিসার
কোনো ইনফরমেশন পাওয়া গেল?

সৈনিক- ৬
না-

রাজাকার
এই সমস্ত আপনাদের কাম না- বাঙালি কায়দায় প্যাদানি দিলেই দ্যাখবেন কেমুন পাখির মতো কথা কইতাছে-

সৈনিক- ৬
ঠিক আছে তুমি চালাও- আমি একটু ঘুরে আসি-

(চলে যায়)

রাজাকার
কী সোনার চান কথা কওনা ক্যান?

খালেদ
যারা নিজের মা-বোনের ইজ্জত কাড়ে, বাপ-ভাইয়ের বুকে গুলি চালায়, আমি তাদের কোনো কথার জবাব দেই না-

রাজাকার
চুপ বেয়াদব- সারাজীবনের মতো মুখ বন্ধ কইরা দিমু-

খালেদ
তুই হলি বেঈমান, রাজাকার- কথা যদি বলতে হয় তাহলে তোদের জেনারেল নিয়াজীকে নিয়ে আয়-

রাজাকার
ক শালা অস্ত্র কই?

বন্দি- ২
আমার কাছে কোনো অস্ত্র নাই- বিশ্বাস করেন আমি ফুড অফিসে চাকরি করি- আপনে খোঁজ নিয়া দেখেন-

বাঃ অফিসার
এসব তোমার কাজ না- আমার সাথে কথা বলেন-

খালেদ
কী কথা বলবো তোমার সাথে? তুমি আমার ছাত্রদের বয়সী, সম্মান করে কথা বলছো, তাই দু’একট কথার জবাব দিতে পারি- শোনো, প্রথমে আমি যে কথাটি বলবো- তাহলো তোমাকে আমি প্রচণ্ড ঘৃণা করি। যে ব্যক্তি তার জন্মভূমির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সে অমানুষ, পশু-

বাঃ অফিসার
আমাকে দেশপ্রেম শেখাতে হবে না- যা বলার ঝটপট বলে ফেলুন-

খালেদ
তাই বলছি- তুমি জানো কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছো? তুমি একজন দলত্যাগী বাঙালি অফিসার, ওহ ভুলেই গিয়েছিলাম ওরা তোমার সবই কেড়ে নিয়েছে, একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি পাকিস্তানি সৈনিকদের অনেকেই তোমাকে স্যালুট দেয় না- এটাই বুঝি তোমার দেশপ্রেমের পরিণাম-

বাঃ অফিসার
চোপ-

রাজাকার
এইভাবে না স্যার আপনে আমার উপর ছাইড়া দ্যান-

বাঃ অফিসার
না- (খালেদকে) আপনি জানেন কোথায় আছেন?

খালেদ
জানি-

বাঃ অফিসার
কথা না বলার পরিণাম জানেন?

খালেদ
জানি- তুমি আমাকে ভয় দেখাও? তোমার মতো বহু ছেলে আমার চোখের সামনে পাজামা লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পড়তে শিখেছে, ভেবেছো তোমার ভয়ে আমি আত্মসমর্পণ করবো? অসম্ভব-

বৃদ্ধ বন্দি
বাবা তোমারে একটা কথা কই-

বাঃ অফিসার
বা-বা, কী আদরের ডাক- বাবা তোমারে একটা কথা কই- কোনো কথা নাই, দুই দিন সময় দিলাম-

বৃদ্ধ বন্দি
না, আমি কইতেছিলাম কী-

বাঃ অফিসার
কী?

বৃদ্ধ বন্দি
তোমার মায়েরে এই শহরে আমরা সবাই চিনি, তমালতলা প্রাইমারি স্কুলের হেডমিস্ট্রেস মেহের আপার মতো মাটির মানুষ খুব কমই আছে, তার হাত দিয়া মানুষ হইছে শতশত শিশু-

বাঃ অফিসার
এই সমস্ত চালবাজি ছাড়ো বুড়া শয়তান-

(বৃদ্ধকে একটা চড় মেরে চলে যায়। রাজাকার তাকে ইন্টারোগেশন করতে শুরু করে এবং সৈনিক- ৬ আসে)

সৈনিক- ৬
কাজ হলো?

রাজাকার
জ্বী না ওস্তাদ-

সৈনিক- ৬
সে আমি আগেই জানতাম- ঠিক আছে আমি দেখছি- বল অস্ত্র কোথায়-

(সৈনিক- ৪ একজন বন্দিকে নিয়ে ঢুকে। বন্দিকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলে সে চিৎকার করে স্থির হয়ে যায়)

সৈনিক- ৪
শালা ইন্ডিয়ার দালাল, কালকের মধ্যে সব কথা না বললে তোর ওপর মেশিনগান চালাবো-

সৈনিক- ৬
খবর কী দোস্ত?

সৈনিক- ৪
মজার খবর আছে, একজন নতুন গেরাই আসছে-

সৈনিক- ৬
মানে?

সৈনিক- ৪
একটু পরেই এখানে আসছে, ইন্টারোগেশানে এক্সপার্ট, তুমি চালাও আমি আসছি-

(চলে যায়)

সৈনিক- ৬
অস্ত্র কোথায়?

বন্দি- ২
খোদার কসম আমার কাছে কোনো অস্ত্র নাই-

সৈনিক- ৬
সত্যি করে বল-

বন্দি- ২
পানি-

সৈনিক- ৬
(বোতল থেকে একটু পানি ঢেলে দেয়) সত্যি করে বল তাহলেই ছেড়ে দেবো-

বন্দি- ২
খোদার কসম-

রাজাকার
(মারে) ক- শুয়রের বাচ্চা-

বন্দি- ২
মাইরেন না ভাই কইতাছি-

সৈনিক- ৬
এইতো বেশ, শান্ত বালকের মতো বলে ফেল- কী কী আছে?

বন্দি- ২
বন্দুক  

(সৈনিক- ৫ আসে)

সৈনিক- ৬
কী বন্দুক? সেভেন পয়েন্ট ফাইভ, মার্ক ফার না থ্রি নট থ্রি?

বন্দি- ২
জ্বি-

সৈনিক- ৫
ব্যাটা উল্লুক কি পাঠা, জ্বি মানে কি? (গুতো মারে) সবগুলোই আছে?

বন্দি- ২
জ্বি-

সৈনিক- ৬
আর কী আছে, গ্রেনেড?

বন্দি- ২
জ্বি-

সৈনিক- ৫
এস.এম.জি?    

বন্দি- ২
জ্বি-

সৈনিক- ৬
এস.এল.আর?

বন্দি- ২
জ্বি-

সৈনিক- ৫
এল.এম.জি?

বন্দি- ২
জ্বি-

সৈনিক- ৬
মেশিনগান?

বন্দি- ২
জ্বি-

সৈনিক- ৫
মর্টার?

বন্দি- ২
জ্বি-

সৈনিক- ৫
শালা এত অস্ত্র চালাস কোথায়?

সৈনিক- ৬
এতো দ্যাখছি রীতিমতো অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি, আর কী আছে?    

(রাইফেল দিয়ে গুতো দেয়)

সৈনিক- ৬
শালা গাদ্দার- (রাইফেলের নল বুকের উপর চেপে ধরে) বল তা না হলে দিলাম শেষ করে-

বন্দি- ২
কইতেছি- কামান আছে, ট্যাংক আছে, প্লেন আছে-

সৈনিক- ৬
ইয়ার্কি মারো সোনার চাঁদ?

সৈনিক- ৫
শালা ভয় পেয়ে গেছে-

(কুকুর সহ ৩য় ও ৪র্থ সৈনিকের প্রবেশ)

সৈনিক- ৬
ইনি আবার কোন মুক্তিবাহিনী?

সৈনিক- ৪
মুক্তিবাহিনী না- এর কথাই বলছিলাম-

সৈনিক- ৬
মানে?

সৈনিক- ৩
ইনি হলেন থার্টি নাইন ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের এগার হাজার তিনশত একান্ন নাম্বার সিপাই আব্দুর রহমানের টু আই সি-

সৈনিক- ৬
ঘটনা কী দোস্ত?

সৈনিক- ৪
অপারেশান থেকে ফিরবার পথে পিছু নিয়েছিল- তাই নিয়ে এলাম, রাখবার কোনো জায়গা নেই- আপাতত এখানেই রাখতে চাই-

সৈনিক- ৬
ইন্টারোগেশনটা তাহলে ভালোই হবে, খবর টবর কিছু আছে নাকি?

সৈনিক- ৪
টাইগার ব্রান্ড এক কেইস-

সৈনিক- ৫
শুকরিয়া-

সৈনিক- ৬
চলো তাহলে-

(রাজাকারসহ সব সৈনিক চলে যায়)

বন্দি- ২
আপনে তো সাংঘাতিক, কোনো কথাতো কইলেনই না আরো উল্টা গালাগালি করলেন। দারুন সাহস আপনের-

খালেদ
এটা সাহসের বিষয় না- আপনি জানেন আমি সত্য বললেও মেরে ফেলবে, না বললেও, কিন্তু আমি যদি চুপ করে থাকি তাহলে বেঁচে যাবে অনেকগুলো মানুষ-

বন্দি- ২
আপনে?

বন্দি- ৩
আমারে মাইরেন না-

বন্দি- ২
না ভয়ের কিছু নাই- আমিও আপনের মতো- আমার নাম শরাফত আলি। বড় বাজারে মনোহারি দোকান করি- আপনি কেমনে ধরা পড়লেন?

বন্দি- ৩
আমিতো যুদ্ধে যাই নাই-

বন্দি- ২
না ভাই সন্দেহের কিছু নাই- আপনে কুন কোম্পানিতে আছেলেন?

বন্দি- ৩
বিশ্বাস করেন আমি কোনোদিন বন্দুক হাতে নিয়া দেখি নাই, দ্যাশের বাড়ি যাইতেছিলাম, রাস্তার মাঝে ধরছে, এহন মনে অয় যুদ্ধে গেলেই ভালো করতাম-

(দরোজা খুলে বন্দি- ৪ কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে রেখে যায় দুই সৈনিক)

বন্দি- ৪
স্যার আপনে?

খালেদ
হ্যাঁ ধরে নিয়ে এলো, তা তোমাকে কেন ধরেছে?

বন্দি- ৪
ধরে নাই, ধরা খাইছি, আন্ধাইর রাইতে গেছি কাটাখালী ব্রীজ উড়াইতে, ব্রীজের গোড়ার মইধ্যে এক্সপ্লোসিভ বাইন্ধা ডেটোনেটরডা লাগাইতেছি- এমুন সময় পিছন থেইকা হ্যান্ডস আপ- অল্পের লাইগা ধরা খায়া গেলাম- সঙ্গে সঙ্গে না মাইরা ক্যান যে নিয়া আইলো কিছু বুজতাছি না- আপনেরে ধরলো ক্যান?

বৃদ্ধ বন্দি
ছেলে মুক্তিবাহিনীতে গেছে, কয় দুইদিনের মইধ্যে ছেলেরে নিয়া আসতে- ছেলে কই আছে আমি কী জানি- আর জানলেই কি জল্লাদের হাতে তুইলা দিমু? (দু'তিন রাউন্ড গুলির আওয়াজ ও একটা আর্ত চিৎকার শোনা যায়, সবাই উৎকর্ণ হয়ে শোনে ) মনে হয় গুলি কইরা মারছে একজন।

বন্দি- ৪
হ, মনে হয়-

বৃদ্ধ বন্দি
মুক্তিবাহিনীতে গেছে ভালোই করছে, এইরহম কুত্তা বিলাই এর মতো গুলি খায়া মরণের চাইতে যুদ্ধ কইরা মরণ অনেক ভালা। আমারে ছাইড়া দিছে- বাইরেতো কারফিউ ভোরে কারফিউ শ্যাষ অইলেই যামু-

বন্দি- ৩
আমার বাড়িত একটা খবর দিবার পারবেন?

বৃদ্ধ বন্দি
কী খবর?

বন্দি- ৩
ঠিকানামতো খালি খবরটা দিবেন- কইবেন আমি ধরা পড়ছি-

বন্দি- ২
আমার খবরটাও দিবেন-

খালেদ
কোনো লাভ নেই, সম্ভবত আগামীকাল রাতেই সবাই শেষ হয়ে যাচ্ছি-

বন্দি- ২
মাইরা ফালাইবো?

খালেদ
হ্যাঁ যুদ্ধ মানেইতো তাই-

বন্দি- ২
আপনের ভয় করতাছে না?

খালেদ
মরতে তো একদিন হবেই খামাখা ভয় পেয়ে কী লাভ? তাতেতো কষ্টই বাড়বে, তার চাইতে যতক্ষণ আনন্দে থাকা যায় সেটাই ভালো-

বন্দি- ৪
ঠিকই কইছেন স্যার- যদি বাইচা থাকেন তাইলে দ্যাখবেন আইজ হোক কাইল হোক দ্যাশ একদিন স্বাধীন হইবই-

বন্দি- ২
আমি মরবার চাই না-

খালেদ
তাহলে অপরাধ স্বীকার করে মাফ চান গিয়ে ওই বেঈমান বাঙালি অফিসারের কাছে- তার হাতেই এসবের কলকাঠি- আমরা নিজেরা যদি নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করতাম তাহলে ওই পাঞ্জাবিদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল?

বৃদ্ধ বন্দি
ঠিক কথাই কইছো বাবা- আল্লায় হের অন্তরডা কহর দিয়া বাইন্দা দিছে- ও হইলো একটা হাইওয়ান-জানোয়ার- হেরে পাইছে ক্ষমতা আর রক্তের নেশায়। বাঘ একবার মানুষের রক্তের স্বাদে যেমন পাগল অইয়া যায়, হের অবস্থাও তেমনি-

বন্দি- ২
একদম সত্যি কথা-

বৃদ্ধ বন্দি
এই হারামজাদার ভয়ে সারা শহরে কুনো মায়ের চোখে ঘুম নাই- কুনসময় কারে নিয়া যায়- কিন্তুক-

বন্দি- ২
কিন্তুক কী?

বৃদ্ধ বন্দি
হের মা মেহের আপা মাটির মানুষ, পরের ছেলে মানুষ করলো হাজার হাজার, কিন্তুক নিজের ছেলেরে মানুষ করতে পারলো না- এরেই কয় বাতির নিচে অন্ধকার-

বন্দি- ৩
আপনে চিনেন?

বৃদ্ধ বন্দি
এই শহরের বেবাক মাইনষেই চিনে- হের বাপ আছিলো সেটেলমেন্ট অফিসের কেরানি, অল্প বয়সে একটা একসিডেনে মারা যায়। তারপর এই মেহের আপা কী কষ্ট কইরাই না ছেলেরে মানুষ করছে- সব আমার নিজের চোখে দ্যাখা-

(নেপথ্যে- কোনো কথা নাই- চুপচাপ থাকো)

বন্দি- ২
পাগলা কুত্তা নাতো?

খালেদ
না- পাগলা হলে আর এরকম চুপচাপ ঝিমিয়ে পড়ে? কীরে তুই আবার কী ইন্টারোগেশন করবি?

বন্দি- ২
আমার খুব ডর করতাছে যদি কামড় দেয়-

খালেদ
কুত্তা দেখেই ভয়? এর পরতো ছাড়বে বাঘ, বাঘের খাঁচায় মানুষ, একটা ইংরেজি ছবিতে দেখেছিলাম-

বন্দি- ৩
সত্যি কইতেছেন?

বন্দি- ৩
অসম্ভব কিছুইনা-

বন্দি- ২
তার চাইতে চোখ বাইন্ধা গুলি কইরা মারাই ভালা-

বন্দি- ৩
সেটাতো আর আপনার আমার ইচ্ছায় হবে না-

খালেদ
বাঁচা মরার চিন্তা বাদ দেন। যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ বেঁচেই থাকতে চাই। খামাখা মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করবার কোনো মানে হয় না।

বন্দি- ২
কেমনে?

খালেদ
যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণ আনন্দের সাথে বাঁচার চেষ্টা করুন-

বন্দি- ৪
ঠিকই কইছেন স্যার-

বন্দি- ৩
ছোট বেলায় আমি একটা কুত্তা পালতাম, কুত্তা খুব প্রভুভক্ত হয়- জানেন?

বন্দি- ২
জ্বি-

বন্দি- ৪
কিরে ব্যাটা তুইনা ইন্টারোগেশান করবি তো ঝিমিয়ে পড়লি ক্যান? (খেয়াল করে)এতো দেখছি গুলি খাওয়া-

বৃদ্ধ বন্দি
পশু পাখিও অনেক সময় মানুষের মতো সব বুঝবার পারে- আসহাবে কাফের গল্প জানেন?

বন্দি- ৩
জ্বি না- বলেন, গল্প করতে করতেই রাইতটা পার কইরা দেই, কি কন?

বৃদ্ধ বন্দি
কোরান শরীফে সূরা কাফে আছে- অনেকদিন আগে এক জালেম বাদশার রাজত্বে বাস করতো কয়জন বুজুর্গ মানুষ। কিন্তু সেই জালেমের অত্যাচারে তারা দেশ ছাড়া হইয়া একটা পাহাড়ের গর্তে পলাইলো। তাগোর লগে আছিলো একটা কুত্তা। কুত্তাডাও লগে লগে রইয়া গ্যালো- পাহাড়ের গর্তে তারা ঘুমায়া পড়লো। সবই আল্লার ইচ্ছা। এক ঘুমে কয়েক’শ বছর। তারপর তারা যখন থেইকা জাগলো, জাইগা দ্যাহে কী-

বন্দি- ৩
কী?

বৃদ্ধ বন্দি
দ্যাহে- দেশে তহন ঈমানদার বাদশার রাজত্ব- কিতাবে আছে হেই বুজুর্গ আলেমগর লগে লগে কুত্তাডাও বেহেশতে যাইবো-

বন্দি- ৩
কিরে ব্যাটা তুইও যাবি নাকি আমাগো সাথে? বেহেশতে যামু কিনা জানি না- তবে নদীর পারে গুলি খাওনের লাইগা যাইবার পারি-

বন্দি- ২
বাঁচবার কি কোনো পথ নাই?

বন্দি- ৪
আছে, আবার নাই-

বন্দি- ২
যদি উপায় কিছু একটা থাকে তাইলে কন-

খালেদ
উপায় একটা আছে-

বন্দি- ২
কী?

খালেদ
গুলি করবার এক সেকেন্ড আগে নদীতে ঝাপ দেয়া-

বন্দি- ৩
সমস্যাও একটা আছে-

বন্দি- ২
কী?

বন্দি- ৩
তখন চোখ বাঁধা থাকবে কালো কাপড়ে-

খালেদ
তবুও অনেক মানুষ বেঁচে গেছে এরকম লাফ দিয়ে পড়ে-

বন্দি- ২
বুজছি- বাঁচবার কুনো আশা নাই- এহন আল্লাহ ভরসা-

বৃদ্ধ বন্দি
আপাতত ঘুমাইবার চেষ্টা করেন। মনে করেন আমরাও আসহাবে কাফের মতো, হাজার বছর পর যহন কেউ ঘুম থেইকা জাগায় দিবো তহন দ্যাখবেন সব উল্টা পাল্টা হইয়া গ্যাছে-

(হুট করে দরোজা খুলে প্রবেশ করে কয়েকজন সৈনিক ও বাঙালি অফিসার। তারা ৩য় বন্দির চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। একটু পরে শোনা যায় গুলির শব্দ)

দৃশ্য-৪

(ফিল্ড হাসপাতাল। চার-পাঁচটা বিছানায় আহত সৈনিকরা শুয়ে আছে। দূরে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আহত সৈনিকদের নিয়ে আসা একটা গাড়ির শব্দ শোনা যায়)

সৈনিক- ১
মনে হয় আরেক গাড়ি এলো-

ডাক্তার
হ্যাঁ, যারা মোটামুটি কম আহত তাদের সরিয়ে নিতে হবে-

সৈনিক- ১
একটা কেটেছে, আরেকটা তো আছে- সরফরাজ খানেরতো দুটো পা-ই কেটে ফেলে দিতে হলো। ভাবছিস কেন? খুব শিগগিরই বাড়ি ফিরে যেতে পারবি-

সৈনিক- ৭
সত্যি বাড়ি ফিরে যাবো?

সৈনিক- ১
অবশ্যই-

সৈনিক- ৭
সত্যি?

সৈনিক ১
সত্যি- এই অপারেশনের ঝামেলা গেলেই তোর ছুটি- তুই-ই বল এক পা’ওয়ালা সৈনিক দিয়ে কী হবে?

সৈনিক- ৭
আমি মনে হয় কোনোদিন ফিরবো না-

সৈনিক- ১
কী আজেবাজে কথা বলছিস দোস্ত- এরকম এক আধটা পা কেটে ফেলা খুবই মামুলি ব্যাপার- শরীফ খানের কথা ভেবে দেখ- একটা হাত আর একটা পা ছেটে দিয়েছে- ওসব ভাবনা বাদ দে- অপারেশনের পর ওরকম সবারই হয়- পেট ভরে খাও দাও আর ফূর্তিতে থাকো- সব ঠিক হো যায়গা-

সৈনিক- ৭
স্কুলে পড়বার সময় স্বপ্ন দেখতাম আমি ডাক্তার হবো-

সৈনিক- ১
সে তুই এখনো হতে পারবি- আজকাল খুব সুন্দর সুন্দর নকল হাত পা তৈরি হচ্ছে। তুই বুঝতে পারবি না যে তোর একটা পা নেই-

সৈনিক- ৭
কোনো মিথ্যে সান্ত্বনা দিচ্ছিস? আমি জানি আমি আর কোনোদিন ফিরে যাব না- এই দ্যাখ জায়গাটা পচতে শুরু করেছে। নওশের-এর জন্যে আমার এ ঘড়িটা নিয়ে যা ওর খুব পছন্দের-

সৈনিক- ১
দুর্ভাবনা করিস না- আমরা এসে মাঝে মাঝে দেখে যাবো-

সৈনিক- ৭
আমার ট্রাঙ্কে কিছু চিঠিপত্র আর ছবি আছে- ওগুলো বাড়িতে পাঠিয়ে দিস- যদি আর দেখা না হয় তাহলে মাফ করে দিস-

সৈনিক- ১
আসিফ তুই ঘুমাচ্ছিস না কেন? একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর- অপারেশনের পর এরকম ব্যাথা একটু আধটু হবেই-

সৈনিক- ৯
আমি মনে হয় আর বাঁচবো না- জানিস আজ আমার পাশের বেডের একজনসহ তিনজন মারা গেছে-

সৈনিক- ১
ধ্যাৎ! কিসব ভাবতে শুরু করেছিস- তুই আবার ঘুমানোর চেষ্টা কর- আমি এখন যাই- পরে আবার আসবো-

(চলে যায় এবং ডাক্তার আসে)

ডাক্তার
আপনার কী অসুবিধা? (সৈনিকটি কানে কানে কী যেন বলে) বুঝতে পেরেছি। তা এ অবস্থা কতদিন?

সৈনিক- ৮
প্রায় এক সপ্তাহ-

ডাক্তার
কোনদিকে যাই- গুলি খাওয়া রোগী দেখবো না এসব দেখবো? গতকাল তিনজন এসেছে একই কেস- ওষুধপত্র লিখে দিলাম- এক সপ্তাহ পরে আবার আসবেন, আর এক মাসের মধ্যে মদ মাছ মাংস খাওয়া চলবে না- আর একটা কথা জিন্দেগিতে এরকম যেখানে সেখানে যাওয়া একদম নিষেধ। এখন আসুন, আপনার কী অসুবিধা?

সৈনিক- ৩
রোগী বাইরে-

ডাক্তার
বাইরে রেখে রোগীর চিকিৎসা করা যায় নাকি?

সৈনিক- ৩
এখানে নিয়ে আসবো?

ডাক্তার
ডাক্তারের সামনে লজ্জার কী আছে? আগের জনেরও একই কেস ছিল-

সৈনিক- ৩
মানে রোগীতো-

ডাক্তার
বুঝেছি লজ্জার কিছু নেই- যান নিয়ে আসুন-  (সৈনিক কুকুরটিকে নিয়ে আসে) একি করছেন? রোগী কই?

সৈনিক- ৩
এইতো-

ডাক্তার
ধ্যাৎ! কী বলছেন?

সৈনিক- ৩
ঠিকই বলছি- যা বলছি তাই করুন-

ডাক্তার
আপনাদের খেয়াল খুশি বোঝার উপায় নেই- রাস্তার একটা নেড়িকুত্তা ধরে নিয়ে এসে বলছেন রোগী-

সৈনিক- ৩
কথা রেখে কাজ করুন-

ডাক্তার
কী হয়েছে?

সৈনিক- ৩
সম্ভবত গুলি লেগেছে।

ডাক্তার
গ্যাংগ্রিন হয় নি তো? এন্টিবায়োটিক দিয়েছেন?

সৈনিক- ৩
না-

ডাক্তার
কুকুরটা কার, ক্যাপ্টেন সাহেবের?

সৈনিক- ৩
না-

ডাক্তার
নাইনটিন হানড্রেড ফিফটি ফোরে এল.এম.এফ. পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছিলাম, তারপর আর পরীক্ষা দেয়া হলো না- এই মফস্বল শহরে স্টেথিসকোপ নিয়ে বসে পড়লাম কিন্তু পসার জমলো না- এখন যুদ্ধের বদৌলতে হয়ে গেছি খোদ মিলিটারি ডাক্তার- আর আপনার পাল্লায় পড়ে ভেটেরনারি সার্জন-

সৈনিক- ৩
ডাক্তার ডাক্তারই, কুকুর আর মানুষে কী আসে যায়?

ডাক্তার
তবুওতো কোন ওষুধ দিলে কাজ হবে তা জানা দরকার- তাছাড়া ডায়াগনসিসটাই বা করি কেমন করে? তারপর যদি আবার ওষুধের সাইড এফেক্ট দেখা দেয়?

সৈনিক- ৩
আপনিতো বহুত ধড়িবাজ লোক- আর কোনো কথা নয়-

ডাক্তার
ঠিক আছে ভালো করে ড্রেসিং করে দিচ্ছি- একটা এন্টিবায়োটিক দিলাম- সকাল দুপুর ছ’ঘন্টা পর পর খাওয়াবেন- বেশ দুর্বল। আর ওষুধটা সকাল বিকাল গরম দুধের সাথে খাওয়াবেন- ভেতরে কোনো ইনফেকশন হলো কিনা বুঝতে পারছি না। এক্সরে করতে পারলে বোঝা যেত কোথাও ফ্রাকচার হয়েছে কিনা?

সৈনিক- ৩
ঠিক আছে সব ব্যবস্থাই হবে- যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আপনাকে যাতে আর্মির ডাক্তার করে নেয়া হয় সেজন্যে সুপারিশ করবো- চলি-

ডাক্তার
পাগল-

দৃশ্য- ৫

(গভীর রাত। সেনাছাউনির সামনে দুজন সৈনিক পাহারারত)

সৈনিক- ৫
একটা সিগ্রেট দাও দোস্ত-

সৈনিক- ৬
সিগ্রেটতো আছে ম্যাচ নাই-

সৈনিক- ৫
আছে আমার কাছে- চুপ- মনে হয়ে কে যেন আসছে- হল্ট-

সৈনিক- ৬
হ্যান্ডস আপ- খবরদার নড়বে না, নড়াচড়া করলেই গুলি-

সৈনিক- ৫
কে?

মা
আমি

সৈনিক- ৬
আমি কে?

মা
আমি মা- (টর্চ ধরে মায়ের মুখে)

সৈনিক- ৬
ইস্ আরেকটু হলেইতো দিতাম ফায়ার করে-

সৈনিক- ৫
আপনি এতরাতে?

মা
দিনের বেলা আসি কেমন করে? সবাই দূর থেকে দেখে আর নানান কথা বলাবলি করে- বলে অই যে যায় রাজাকারের মা-

সৈনিক- ৬
তাই বলে এত রাতে?

মা
তাতে কী?

সৈনিক- ৫
আপনার কি জীবনের মায়া নাই? কে কোন সময় গুলি করে মারলো তা নিয়ে কেউ ভাববে না। আমাদেরও কিছু করার থাকবে না-

মা
আমি জানি- তোমাদের অফিসার কই?

সৈনিক- ৫
যান ওই ঘরে- এখনো সজাগ, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

মা
বলো-

সৈনিক- ৫
রাতের বেলা জীবনের এত ঝুঁকি নিয়ে কেন আসেন ক্যাম্পে?

মা
সে তুমি বুঝবে না বাবা-

সৈনিক- ৬
কিছু মনে করবেন না- আপনাকে আমাদের খুব সন্দেহ হয়, কিন্তু কিছু বলবার উপায় নেই, শত হলেও একজন অফিসারের মা-    

মা
তোমাদের অফিসারকে বললেই পারো, আমাকে একটা গুলি করে দিলেই সব মিটে যায়- এ কাজটাতো তোমরা ভালোই জানো-

সৈনিক- ৬
রাগ করবেন না, এমনি মনে হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম-

বাঃ অফিসার
কে?

মা
খোকা আমি-

বাঃ অফিসার
মা তুমি এতরাতে?

মা
কেনো সন্তানের কাছে আসতে রাতদিনের কোনো বাধা আছে? আমাকে সন্দেহ হয়? আমাকে তোর কুকুরগুলোও সন্দেহ করে-

বাঃ অফিসার
আমি ঠিক তা বলি নি- বলছিলাম কখন কী হয়ে যায় তাতো বলা যায় না- হয়তো আমার লোকজনই করে বসলো, ঠুস করে একটা শব্দ, তারপর সব শেষ-

মা
তাহলেতো বেঁচেই যেতাম, বুকের মধ্যে এমন যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে সেও অনেক ভালো-

বাঃ অফিসার
তুমি এসব কী বলছো মা?

মা
ঠিকই বলেছি, যা সত্য তা-ই বলছি-

বাঃ অফিসার
মা তুমি মাথা ঠিক রাখতে পারছো না।

মা
ঠিক তাই- সবই আমার কপাল, পরের ছেলে মানুষ করলাম শতশত কিন্তু নিজের ছেলেকে মানুষ করতে পারলাম না-

বাঃ অফিসার
মা তুমি ঠাণ্ডা হও।

মা
ঠাণ্ডা হবো? খুব সুন্দর কথা শুনলাম তোর মুখে- দুনিয়ার সব মায়েরাই তার ছেলের কাছে আসে আনন্দে। বুকটা তাদের ফুলে যায় গর্বে। আর আমি? আমি আসছি চোরের মতো রাতের অন্ধকারে পালিয়ে। আমাকে দেখলেই লোকজন ঘৃণায় আরেক দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে ওই যে যায় রাজাকারের মা-

বাঃ অফিসার
মা-

মা
খোকা তোর ছোটবেলার কথা মনে আছে?

বাঃ অফিসার
খুব মনে আছে, বাবা মারা যাওয়ার পর কী দুর্দিনই না গেছে? চাচারা ফিরিয়ে দিলেন খালি হাতে। আত্মীয় স্বজনরাও কোনো সাহায্য করলো না। শুধুমাত্র স্কুলের চাকরিটাকে সম্বল করে জড়িয়ে ধরেছিলে আমাকে। শহরতলির সেই ভাড়াটে বাড়ির বারান্দায় খুঁটি ধরে কতদিন একা একা কেঁদেছি তোমার জন্য-

মা
এখনো কী তোর আগের মতো ভালোবাসা আছে?

বাঃ অফিসার
আছে-

মা
না- নেই। যদি থাকতোই তাহলে আমি কেনো তোকে আগের মতো ভালোবাসতে পারি না। তবু কেনো বার বার তোর কাছে ছুটে আসি তাও বুঝি না। মনে হয়ে যতটা ভালোবাসি তার চেয়েও বেশি ঘৃণা করি। অথচ একদিন তোকে নিয়েই ছিল আমার সমস্ত জগৎ সংসার। স্কুলে যারা তোর সাথে পড়তো তারা আমার সন্তান না হলেও তাদেরকেও আমি তোর মতোই স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছি। আর তুই তোর সেই সব ভাইয়ের রক্তে হাত লাল করেছিস- তুই একটা কসাই-

বাঃ অফিসার
হোঃ হোঃ-

মা
খবরদার হাসবি না- একদিকে সারা দেশের মানুষ যখন যুদ্ধ করছে বিদেশি জানোয়ারদের বিরুদ্ধে তখন তুই সেজেছিস সেই জানোয়ারদের পা চাটা সেনাপতি। আমার নিজের উপরেই ঘৃণা হচ্ছে- আতুর ঘরেই কেনো তোর গলা টিপে মেরে ফেললাম না-

বাঃ অফিসার
মা চুপ করো-

মা
না তুই আমাকে চুপ করতে বলবি না- তোর জন্য আমার একমুহূর্ত শান্তি নেই- শুধু আমার শান্তি নয় তুই কেড়ে নিয়েছিস অসংখ্য মায়ের শান্তি- তুই একটা জল্লাদ, চেঙিস খান, তৈমুরলঙ, হিটলার-

বাঃ অফিসার
আর কিছু বলবে?

মা
মা হয়ে আমি তোর কাছে অনুরোধ করছি- তুই ফিরে আয়। তোর সমস্ত অপরাধের শাস্তি আমি নেবো- তুই পালিয়ে যা-

বাঃ অফিসার
অসম্ভব-

মা
কেনো অসম্ভব?

বাঃ অফিসার
এ হয় না মা। আমিতো লড়ছি বেদীন কাফেরদের হাত থেকে দেশটাকে বাঁচাতে-

মা
তুই অন্ধ হয়ে গেছিস, তুই আজ কিছুই দেখতে পাসনে। মানুষের চোখের জলও আজ তোকে স্পর্শ করে না। ক্ষমতার মোহ তোকে অন্ধ করে দিয়েছে-

বাঃ অফিসার
উফ্ অসহ্য- রাত বাড়ছে মা, আমার এখন ঘুমানের দরকার-

মা
তুই কি আমার কথা শুনবি না?

বাঃ অফিসার
মা পৃথিবীতে তুমিই আমার সবচেয়ে দুর্বল স্থান। নইলে এত কথা বলার পরিণামে-

মা
গুলি করে মারতি?

বাঃ অফিসার
হ্যাঁ তাই-

মা
হ্যাঁ তাই কর-

বাঃ অফিসার
পাগলামি করো না- তুমি কী থাকবে না যাবে?

মা
ঠিক আছে আমি চললাম-

বাঃ অফিসার
একা একা যাবে কীভাবে? দুজন সেন্ট্রি দিয়ে দেই-

মা
দরকার হবে না- একাই যেতে পারবো-

বাঃ অফিসার
ঠিক আছে যাও, তবে তোমার যখন খুশি এসো, তোমার জন্যে আমার দুয়ার সবসময় খোলা-

মা
দুয়ার বন্ধ হয়ে গেলেই সবচেয়ে ভালো হতো-

দৃশ্য-৬

(সৈনিক- ৩ কুকুরটির সাথে খেলা করছে)

সৈনিক- ৩
সাব্বাস, আর একমাস পরে তোকে কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল বানিয়ে দেবো। শালার যুদ্ধ আর ভালো লাগে না। সেই কবে ঘর থেকে বেরিয়েছি। আর কোনো খবর নাই। যুদ্ধ শেষ হলে তোকে নিয়ে সোজা চলে যাবো গ্রামের বাড়িতে। খাইবারপাসের হাওয়া খেয়ে দেখবি তোর শরীর স্বাস্থ্যই অন্যরকম হয়ে গেছে। তোকে নিয়ে আমি বেড়াতে যাবো কাবুল, কান্দাহার, পাঘমান, পানকির-

(২য়, ৪র্থ ও ৫ম সৈনিকের তর্ক করতে করতে প্রবেশ)

সৈনিক- ২
অসম্ভব এরকম চলতে পারে না-

সৈনিক- ৪
সব চলতে পারে, যুদ্ধ আর প্রেমে কোনো কানুন নাই-

সৈনিক- ৫
তাই বলে কোথাকার একটা নেড়িকুত্তা নিয়ে এত মাতামাতি- এই যে মহামান্য জেনারেল বাহাদুর-

সৈনিক- ২
সাথে একেবারে প্রেমিকা লাইলী-

সৈনিক- ৩
কী ব্যাপার?

সৈনিক- ৫
ব্যাপার এখনো জানো না- শালার যত সব হুজ্জত বাধানের ওস্তাদ-

সৈনিক- ২
আমরা যখন হাতের তালুতে জীবন নিয়ে ঘুরছি তখন উনি মেতেছেন একটা নেড়িকুত্তা নিয়ে-

সৈনিক- ৫
একটা মেয়ে মানুষ হলেও না হয় কথা ছিল-

সৈনিক- ৪
তোরা খামাখাই ক্ষেপছিস-

সৈনিক- ৩
কী হয়েছে?

সৈনিক- ২
কী হয় নি আবার? কাল আমার বিছানার পাশে শুয়েছিল।

সৈনিক- ৩
শুয়ে থাকবে নাতো কি দাঁড়িয়ে থাকবে?

সৈনিক- ২
আরে বাবা বলতে দে-না- অন্ধকারে খেয়াল করি নাই একটা পা যেমনি ফেলেছি আর অমনি শালা ঘেউ ঘেউ-

সৈনিক- ৫
ভাগ্য ভালো যে কামড়ে দেয়নি, চিন্তা করতে পারো একবার কামড়ালে নাভির গোড়ায় রাইফেলের ব্যারেলের মতো সুঁই দিয়ে চৌদ্দটা ইনজেকশন-

সৈনিক- ২
এ শালাকে আমি গুলি করে মারবো-

সৈনিক- ৪
ইস্রে কী বাহাদুর, গুলি করে কুত্তা মারবেন, কুত্তা মারেতো মিউনিসিপালটির সুইপাররা- পারলে দুই একটা মুক্তি ধরে মারো না-

সৈনিক- ৫
আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না- এই ব্যাটা আফ্রিদী গাড়লের মতো তোরও এত কুত্তা প্রেম উথলে উঠছে কেন? যা না দুই একটা মেয়ের সাথে এশ্ক মুহাব্বত কর না- এখানে এসেছিস কী করতে?

সৈনিক- ৪
যুদ্ধ করতে-

সৈনিক- ৫
সেটাই কর-

সৈনিক- ৪
সেটা যুদ্ধ ক্ষেত্রেই করছি- এই ক্যাম্পের ভিতর না, আমিও বুঝতে পারছি না- তোরা এরকম একটা সাধারণ বিষয়
নিয়ে কেনো ক্ষেপেছিস?

সৈনিক- ২
ক্ষ্যাপাক্ষ্যাপির কিছু নেই। আমার সোজা কথা এই জানোয়ারটাকে সরাতে হবে- এসব নাপাক জন্তু জানোয়ার আমি সহ্য করতে পারি না- শালা কখন কী খায়. কোথায় শোয়, পায়খানা প্রশ্রাব করে তার ঠিক আছে? কুত্তার গায়ের ছোঁয়া লাগলে ওজু নষ্ট হয়ে যায় তা জানিস?

সৈনিক- ৪
জানি- এরকম মানুষও আছে যাদের ছোঁয়া লাগলে সারা জীবনের এবাদত বন্দেগি বরবাদ হয়ে যায়- সে তুলনায় এসব কিছুই না-

সৈনিক- ৫
আরে বাবা এতো আর আসহাবে কাফের কুত্তা না যে বেহেশতে যাবে- এমন না যে দেশের জন্য জীবন দিয়ে দিচ্ছে-

সৈনিক- ৩
এবার একটু থামো, আমরা এখানে যুদ্ধ করতে এসেছি- অবশ্য জানি না কেনো এই যুদ্ধ- যাকগে সেসব, কিন্তু এই রসকষহীন জীবনে যদি এরকম ছোট খাটো দু’একটা সখ আহলাদের দাম না থাকে তাহলে কেমন করে চলবে বলো?

সৈনিক- ২
এত লেকচারের কাজ নাই- সোজা কথা তোমার সাথীটাকে তাড়াবার ব্যবস্থা করো-

সৈনিক- ৩
না তাড়ালে কী করবি?

সৈনিক- ৫
তর্ক করছিস কেন? আর্মিতে কোনো মায়াদয়ার জায়গা নাই, কুত্তা বিলাই পোষার মতো ছেলেমানুষি আর যেখানেই চলুক, এখানে চলবে না-

সৈনিক- ৩
সে আমি দেখবো- তোমাদের কোনো ক্ষতি না করলেই হলো-

সৈনিক- ৪
আমি আছি তোর সাথে- এ ব্যাটাকে এমন ট্রেনিং দেবোনা একেবারে কাবুল মিলিটারি একাডেমির ট্রেনিং-

সৈনিক- ২
ব্যাপারটা জমাদার সাহেবকে জানাতে হয়-

সৈনিক- ৩
জমাদার সাহেব কেনো মেজর সাহেবকে জানাও, আমার তাতে কিছু যায় আসে না-

(সামরিক কনভয়ের শব্দ, হুইসেল, ছুটে আসে জমাদার)

জমাদার
গার্ডস স্ট্যান্ডবাই-

(কয়েকজন অফিসারসহ একজন কর্ণেলের প্রবেশ)

কর্ণেল
প্রিয় সৈনিক ভায়েরা, গতকালকের যুদ্ধে আপনারা যে বীরত্ব দেখিয়েছেন, সেজন্যে মোবারকবাদ জানাতে আমি নিজেই চলে এসেছি। আপনাদের রণনৈপুণ্যে ভীত সন্ত্রস্ত শত্রু পালিয়ে গেছে। আমি আপনাদের মাঝে একটা কুকুর দেখতে পাচ্ছি- মনে হচ্ছে পোষা কুকুর-

জমাদার
জ্বি স্যার, কুকুরটা ক’দিন ধরে ক্যাম্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে সিপাইদের সাথে বেশ ভাব করে নিয়েছে-

কর্ণেল
গুড, আপনারা জানেন কুকুর অত্যন্ত প্রভুভক্ত প্রাণী। প্রভুর নিরাপত্তার জন্য সে জীবনকেও বাজী ধরেছে, এরকম বহু গল্প আপনারা বই পুস্তকেও পড়েছেন, একজন সৈনিককেও হতে হবে সে রকম, কুকুরের সাথে তুলনা করলাম বলে মনে কষ্ট নেবেন না-

বাঃ  অফিসার
না স্যার-

কর্ণেল
গুড, আমি শুধু বলতে চেয়েছি কুকুর যেমন তার প্রভুর প্রতি অনুগত থাকে, সৈনিকও তেমনি অনুগত থাকবে তার কমান্ডারের প্রতি- একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আমি তখন বার্মা ফ্রন্টে। আমাদের কমান্ডার ছিলেন কর্ণেল শেফার্ড। তার একটা পোষা কুকুর ছিল। সব সময় থাকতো তার সাথে। শুনেছি কুকুরটা আর্মহার্স্ট মিলিটারি একাডেমির গ্রাজুয়েট। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডেও নাকি ছিল কয়েক মাস। যা হোক, একদিন শুরু হলো জাপানিদের প্রচণ্ড আক্রমণ, উপর নিচ দু’দিক থেকেই। অর্ডার হলো ট্রুপস রিট্রিট, দশ মাইল পিছিয়ে আসার পর খবর হলো কমান্ডার ফেরেন নি। সাংঘাতিক ব্যাপার। ততক্ষণে বেশ রাত হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গেই সার্চিং পার্টি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখলাম জঙ্গলের মধ্যে কী যেন নড়াচড়া করছে, এগিয়ে যেতেই আমাদের দেখে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো কুকুরটা। কাছে গিয়ে দেখি কী কর্ণেল শেফার্ড গুলি খেয়ে অচেতন আর কুকুরটা তার জামার কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে। তারপর আমরা তাকে কাঁধে করে নিয়ে এলাম। সাড়া পড়ে গেল সমস্ত ক্যাম্পে। একজন বৃটিশ সোলজারতো কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগলো পাগলের মতো। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। একমাস পরে বৃটেন থেকে সেই কুকুরটার জন্যে এলো সৈনিকের সর্বোচ্চ খেতাব ভিক্টোরিয়া ক্রস। যা হোক, আমি যা বলতে চেয়েছি তা হলো সৈনিকের জন্য চাই তার কমান্ডারের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য। আজ আপনারা যে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন সেজন্যে জাতি আপনাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। খোদা হাফেজ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ-

(অফিসারদের সাথে কর্ণেল বিদায় নেয়)

সৈনিক- ২
শালা আমরা এখানে কাদাপানির মধ্যে জীবনটাকে ধরে দিচ্ছি আর উনি কিনা শুনিয়ে গেলেন প্রভুভক্ত কুকুরের গল্প, শালা তোর জন্যেই-

সৈনিক- ৪
তবে যাই বলো, সত্য কথাটাই কিন্তু বলে গেছেন- শালার কুত্তা আর ফৌজের মধ্যে কোনো তফাৎ নাই, দু’জনেরই কাজ হচ্ছে প্রভুর পাহারাদারি করা-

সৈনিক- ২
মাঝে মাঝে জীবনটার উপরেই ঘেন্না ধরে যায়, এ শালার কেমন জীবন, শুধু ইয়েস-নো, জ্বি স্যার-নো স্যার, নো কোশ্চেন- চল, শালার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল-

বিরতি

দৃশ্য-৭

(রাতের বেলা। সারা ক্যাম্পে হুলুস্থূ পড়ে গেছে। সৈনিকরা এদিক সেদিক খোঁজাখুঁজি করছে)

জমাদার
সার্চ করো চারদিক, সাবধানে, নইলে পালিয়ে যেতে পারে। সব দিক সেন্ট্রি বসিয়ে দাও-

(দু’তিনজন সৈনিক বন্দুক তাক করে খুঁজে বেড়ায়। হঠাৎ একটা খসখস শব্দে চিৎকার করে উঠে)

সৈনিক- ৫
হ্যান্ডস আপ-

সৈনিক- ২
ধুস্ শালা- এ-তো শুকনা পাতা-

সৈনিক- ১
চুপ কোনো কথা নেই-

সৈনিক- ২
হল্ট- শালা চোখে ধাঁধা লেগে গেছে। যেদিকে তাকাই মনে হয় আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে বন্দুক নিয়ে-

সৈনিক- ১
গলাটা শুকিয়ে গেল, কিছু আছে নাকি?

সৈনিক- ৫
কী?

সৈনিক- ১
শরাবুন তহুরা-

সৈনিক- ২
তোর কথা শুনে আমারো গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, যুদ্ধের সময় এসবের সাপ্লাই দেওয়া উচিত-

সৈনিক- ১
শালার যুদ্ধ-

সৈনিক- ২
ক্ষেপে যাচ্ছিস কেন?

সৈনিক- ১
শালার আমার আর ভালো লাগে না। প্রায় দুই মাসের মতো বাড়িঘরের কোনো খোঁজ খবর নাই। শেষ চিঠিতে খবর পেয়েছিলাম ছোটো ছেলেটার অসুখ, অবস্থা খুবই কাহিল। পারলে যেন ছুটি নিয়ে বাড়ি যাই। ওস্তাদের কাছে ছুটি চাইলাম, বলে এখন কোনো ছুটি হবে না। ছেলেটা মরলো কী বাঁচলো জানি না।

সৈনিক- ২
আমার কথা আর কী বলবো- এখানে আসার মাত্র তিনমাস আগে বিয়ে করেছি। নতুন বউ এর সাথে ভালো করে জানা পরিচয়টাও হলো না- এরই মধ্যে নোটিশ এলো ছুটি ক্যান্সেল। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট করো। রিপোর্ট করলাম। পরদিনই সকালের প্লেনে সোজা ঢাকা। প্রথম প্রথম খুব ঘন ঘন চিঠি লিখতাম। চিঠিও আসতো। এখন শালা একমাসেও কোনো খোঁজ খবর পাই না- শালার জীবন- যন্ত্রের মতো খালি গুলি করো আর মানুষ মারো-

সৈনিক- ১
হ্যান্ডস আপ-

সৈনিক- ৬
ফ্রেন্ডস-

সৈনিক- ২
সেম সাইড-

সৈনিক- ৫
আমিতো শালার দিয়েছিলাম ফায়ার করে- কী সর্বনাশটাই না হতো-

সৈনিক- ১
ঠিক আছে এবার চারদিকে খোঁজা যাক-

(ঘুরতে ঘুরতে চারজন একসাথে ধাক্কা খেয়ে চিৎকার করে উঠে)

সৈনিক- ২
উফ্। আমিতো ভেবেছি শালার উল্টা ধরা পড়ে গেছি-

সৈনিক- ৫
না বাবা আমি আর পারবো না- কোনো মানে হয়? গলাটা একদম শুকিয়ে গেছে-

সৈনিক- ২
নিকল কর দির আওর কাবাসে
গর মিলতানা ম্যায় খানা-
খোদা জানে
ইয়ে বেওয়াফা ইনসান কাহা যাতে-

সৈনিক- ৫
ওস্তাদ মির্জা গালিব তোমার কথা শুনে আমার কলজে পর্যন্ত শুকিয়ে গেল-

সৈনিক- ২
না এভাবে গরু খোঁজার কোনো মানে হয় না- তারপর এত অন্ধকার, চোখে কিছু দেখা যায় না, এক কাজ করলে হয় না?

সৈনিক- ৫
কী?

সৈনিক- ২
ওই কুত্তাটা নিয়ে সার্চ করলে কেমন হয়?

সৈনিক- ১
হো-হো একটা ভালো জাতের কুত্তা হলেও না হয় কথা ছিল, কোথাকার একটা ঘা খাওয়া নেড়িকুত্তা-

সৈনিক- ২
আমার আর ভালো লাগছে না, সারাদিন এত কষ্টের পর কোথায় একটু ঘুমাবো, না সার্চ করো-

সৈনিক- ৫
কয়জন ঢুকেছে?

সৈনিক- ২
তা আমি কী জানি?

সৈনিক- ১
শালার মুক্তি, সাহস আছে ব্যাটাদের। আমার মনে হয় কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আসে যেই টের পেয়েছি অমনি শালা দে দৌড়- চোখের পলকে নাই, শালা জ্বীন-পরী নাতো?

(দূর থেকে নির্দেশ শোনা যায়, সামনে ঘাপটি মেরে বসে আছে, সবাই আস্তে আস্তে এগিয়ে যাও, আমরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছি)

সৈনিক- ২
ওই যে শালা মনে হয় পালাচ্ছে-

(সবাই এগিয়ে যায়, তারপর চিৎকার করে উঠে হ্যান্ডস আপ, অপর প্রান্ত থেকেও একই সময়ে চিৎকার করে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে কুকুরটি। সবাই এগিয়ে গিয়ে কুকুরটিকে ধরে নিয়ে আসে)

সৈনিক- ১
শালা তুমি? এতগুলো মানুষকে তুমি ঘোল খাইয়েছো- শালা এবার তোর উপর ম্যাগজিন খালি করছি-

সৈনিক- ৫
আরে থাম, গুলি করলেতো সবই শেষ, তার চাইতে এটাকে নিয়ে চল, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে- কাফফারা আদায় করবো-

সৈনিক- ২
চলো-

দৃশ্য-৮

(পরদিন সকাল বেলা। সাত আটজন সৈনিক ও কুকুরসহ খুব খাওয়া দাওয়া চলছে)

সৈনিক- ২
প্রথমবার অল্প কাফফারাতেই ছেড়ে দিলাম-

সৈনিক- ৫
একটা বিষয় আমি শালার বুঝতে পারছি না-

সৈনিক- ৬
কী?

সৈনিক- ৫
রাতে মনে হয়েছিল এ ব্যাটার উপর চেম্বারটা খালি করে দেই, কিন্তু এখন আমারই কেমন যেন মায়া হচ্ছে- সত্যিই, এটাকে মেরে কী হবে, এ ব্যাটাও আমাদের মতোই-

সৈনিক- ২
উফ্ অসহ্য- আর কোনো কথা নয়- এরপর যদি আর একটা ঘটনা ঘটে তাহলে আর তোমাকে জিজ্ঞেস করবো না- নে শালা তুইও খা একটু- (কুকুরটাকে)

সৈনিক- ৩
আমি কথা দিলাম আর হবে না-

সৈনিক- ২
আবার যে এরকম হবে না তার গ্যারান্টি কী?

সৈনিক- ৩
আফ্রিদী পাঠান কোনোদিন কথার খেলাপ করে না- এই রাইফেল ছুঁয়ে বলছি, আমার বয়স যখন বার বছর তখন আমার জান্নাতবাসী আব্বাজান তাঁর রাইফেলটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন- সব সময় সৎপথে চলবে, ওয়াদার বরখেলাপ করবে না। নারী শিশু আর বুড়োদের উপর অস্ত্র ধরবে না, শত্রুকে কোনোদিন পেছন থেকে গুলি করবে না- নিরীহ প্রাণীর উপর সদয় থাকবে-

সৈনিক- ২
তোর এত বড় বড় লেকচার কে শুনতে চেয়েছে?

সৈনিক- ৩
না শুনতে চাস নি, কিন্তু তোর কথায় হঠাৎ মনে পড়ে গেল। আব্বাজান ছিলেন সীমান্তগান্ধী বাদশাহ খানের সমর্থক একজন নেতা। বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন তবু পরাধীনতা মেনে নেন নি। বৃটিশ সরকার তারে খান বাহাদুর উপাধি দিয়েছিলেন, পাকিস্তান-ইন্ডিয়া ভাগাভাগি স্বীকার করেন নি-

সৈনিক- ১
সবই বুঝলাম আর কোনো কথা নয় এবার কাজে দেখতে চাই-

সৈনিক- ৮
এত ক্ষেপছিস কেনো?

সৈনিক- ১
আমার সোজা কথা- এসেছি যুদ্ধ করতে, ব্যস- শখ আল্লাদের জায়গা এটা না- কুত্তা পালার শখ, রসে টসটস করছে-

সৈনিক- ৮
কথাটা সত্যি সৈনিকদের এত রস থাকতে নেই, সৈনিক হলো এক ধরনের যন্ত্র, কলের পুতুলের মতো, চাবি দিলেই চলে-

সৈনিক- ৫
যেসব কথা বলছিস তাতে নির্ঘাৎ ফায়ারিং স্কোয়াড-

সৈনিক- ৮
তাহলেতো বেঁচেই যেতাম, আর কিছুদিন এরকম চললে মনে হয় পাগল হয়ে যাবো-

সৈনিক- ৪
আগে চা-টা খেয়ে নে তারপর পাগল হোস-

সৈনিক- ৮
’৬৫ সালে ইন্ডিয়ার সাথে যুদ্ধের সময় ফৌজে নাম লেখালাম, ঢুকতে না ঢুকতেই যুদ্ধ শেষ, যুদ্ধটা কী তা আর দেখা হলো না-

সৈনিক- ২
এবার টের পাচ্ছিস নিশ্চয়ই?

সৈনিক- ৮
তা ঠিক, তবে টের পেয়েছি অনেক আগেই-

সৈনিক- ১
তুই কি লাইফ হিস্টোরি শুরু করেছিস?

সৈনিক- ৫
সে রকমই তো মনে হচ্ছে-

সৈনিক- ৪
থামলি কেন?

সৈনিক- ৮
ঠিক আছে বলছি, পাকিস্তান-ইন্ডিয়া যুদ্ধ শেষ। কোনো কাজ নাই, শুধু লেফট রাইট, পজিশন, এডভান্স, টার্গেট এন্ড ফায়ার। দেখতে দেখতে কয়েকটা বছর ভালোই কেটে গেল। ’৬৯ সাল সারা দেশে তখন আইয়ুব শাহীর পতন চাই। একদিন দুপুর বেলা আমাদের পুরো কোম্পানিকে তোলা হলো ট্রাকে। সবার যুদ্ধের প্রস্তুতি। কোথায় যাচ্ছি কেনো যাচ্ছি কিছুই জানি না- যেতে যেতে শুনলাম সমস্ত করাচি শহরে কারফিউ- এই প্রথম শুনলাম শব্দটা, কোনো কথা নেই দেখামাত্র গুলি, উফ্ সেদিনের কথা মনে হলে এখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না-

সৈনিক- ২
লম্বা গল্প শুরু করেছিস দেখছি-

সৈনিক- ৮
আমাদের ট্রাক দ্রুতগতিতে চলছে। হঠাৎ দেখি এক বিশাল মিছিল- হাজার হাজার মানুষ- ছেলে বুড়ো সব বয়সের। অর্ডার হলো ফায়ার- কোনো কথা নেই, চোখ বন্ধ করে ট্রিগার টিপে দিলাম, কেনো জানি হাতটা কেঁপে উঠলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পড়ে গেল অনেকগুলো লাশ, গুলি খাওয়া পাখির মতো ডানা ঝট্পট্ করে স্থির হয়ে গেল কালো রাজপথে। সেই প্রথম গুলি- প্রথম যুদ্ধ নিজের বুকের মাঝে- কেনো গুলি করেছিলাম, তাতে কার লাভ হলো- কিছুই জানিনা- অনেকদিন স্বাভাবিক থাকতে পারিনি- রাতে ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠেছি- পরে নিজেকে বুঝিয়েছি সৈনিকের মাঝে এসব অনুভূতি থাকতে নেই- তার কাজ শুধু টার্গেট এন্ড ফায়ার-

সৈনিক- ২
বাবা বাঁচা গেল- বহুদিন পর অনেক বড় বড় কথা শুনলাম- চলো যাই-

(৩য় ও ৪র্থ সৈনিক ছাড়া সবাই চলে যায়)

সৈনিক- ৩
কী করি বলতো? শালার এই অর্থহীন যুদ্ধের মাঝে একটা কিছু করবার মতো কাজ পেয়েছিলাম, কিন্তু সবাই যে রকম বিগড়ে গেছে তখন এ ব্যাটাকে কতদিন রাখতে পারবো কে জানে-

সৈনিক- ৪
অবশ্য ক্ষেপে যাওয়ারই কথা। আরেকটু হলেই সেদিন রমজানকে কামড়ে দিতো, আমার মনে হয়ে এর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ঘা টা যে রকম বাড়ছে তাতে শেষ পর্যন্ত না পাগল হয়ে যায়, কথায় আছে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল-

সৈনিক- ৩
ঘা তো পায়ে-

সৈনিক- ৪
ওই একই কথা-

সৈনিক- ৩
খরচপত্র যা করতে হয় আমি আছি, কিন্তু ভালো করা চাই, এটা আমার চ্যালেঞ্জ-

সৈনিক- ৪
এক কাজ কর চল আমার সাথে, শহরে পঙ্গু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই-

সৈনিক- ৩
চল-

দৃশ্য-৯

(গ্রামের এক প্রান্তে একটি মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প। কমান্ডার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলছে)
    
কমান্ডার
না, এখনো কোনে বড় অপারেশনে যাওয়া ঠিক হবে না-

মুক্তিযোদ্ধা- ১
কিন্তু রাজাকাররা প্রতিদিন যেভাবে মানুষজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে, বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে তাতে আমাদের-

কমান্ডার
সবই বুঝতে পারছি, আমাদের আরো শক্তি অর্জন করতে হবে। একটা বিষয় লক্ষ্য করেছো?

মুক্তিযোদ্ধা- ১
কী?

কমান্ডার
প্রথমে রাজাকারদের পাঠিয়ে আর্মি আসছে পেছনে। ওরা শুধু কভারিং দিচ্ছে আর্টিলারির। এখন আমরা যদি রাজাকারদের পেছনেই সব শক্তি খরচ করে ফেলি তাহলে মুশকিলে পড়ে যাবো-

মুক্তিযোদ্ধা- ২    
তাহলে কী করতে চান?

কমান্ডার
এখন আমাদের প্রধান কাজ হবে শত্রুর শক্তি জানা আর ছোট ছোট সংঘর্ষে ওদের শক্তি ক্ষয় করা-

(৩য় মুক্তিযোদ্ধার প্রবেশ)

মুক্তিযোদ্ধা- ৩
একজন মহিলা আপনার সাথে দেখা করতে চান।

কমান্ডার
কী ব্যাপার? কিছু বলেছে?

মুক্তিযোদ্ধা- ৩
না-

কমান্ডার
ঠিক আছে নিয়ে এসো-

মুক্তিযোদ্ধা- ২
কোনো রকম পরিচয় না জেনেই আসতে বলছেন, কোথাকার কে? কী উদ্দেশ্য?

কমান্ডার
আগে আসতে দাও

(মা আসে)

মা
আমি একজন রাজাকারের মা।

মুক্তিযোদ্ধা- ১
রাজাকারের মা! কী বলতে চান আপনি?

মা
আমার ছেলে তোমাদের শত্রু, দেশেরও শত্রু, ও একটা জল্লাদ-

কমান্ডার
কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি কী বলতে চান?

মা
আমার ছেলে সেনাবাহিনীতে ছিল। সে এখন পাকিস্তানিদের সাথে যোগ দিয়েছে। শহরের ক্যাম্পে থাকে-

কমান্ডার
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না-

মুক্তিযোদ্ধা- ২
তা আপনি কী বলতে চান?

মা
আমি ওর মা, আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসি-

কমান্ডার
সব মায়েরাই তাদের সন্তানকে ভালোবাসে-

মা
আমি মনে করি ও যা করছে তার জন্যে আমিও দোষী-

কমান্ডার
আপনি দোষী হতে যাবেন কেন?

মা
আমি ওকে মানুষ করতে পারি নি, তোমরা আমাকে শাস্তি দাও, গুলি করে মারো নয়তো জিম্মি করে রাখো-

মুক্তিযোদ্ধা- ২
কেমন যেন মনে হচ্ছে? অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেইতো? এ্যারেস্ট করে ফেলি?

কমান্ডার
থামো-

মা
বিশ্বাস করো বাবারা, আমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নাই।

কমান্ডার
বুঝতে পারছি- কিন্তু ছেলের অপরাধের জন্য আপনাকে শাস্তি দেয়া অযৌক্তিক। আপনি নিশ্চয়ই একাজের জন্য
ছেলেকে উৎসাহিত করেন নি-

মা
আমি তাকে ফেরাতে চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি-

কমান্ডার
আপনাকে জিম্মি রেখেও কোনো লাভ নেই। আপনার জন্য কিংবা দেশের জন্য তার কোনো ভাবনা নেই। সন্তানের অপরাধের জন্য যদি শাস্তি পাওয়া দরকার বলে মনে করে থাকেন তাহলে এটাই যথেষ্ট শাস্তি। এ শাস্তিতো মৃত্যুর চেয়েও কষ্টকর-

মা
হ্যাঁ বাবা, মৃত্যুর চেয়েও কষ্টকর। তোমরাও আমাকে ফিরিয়ে দিলে-

কমান্ডার
হ্যাঁ- মা যান আপনি আবার চেষ্টা করে দেখুন- হয়তো ফিরিয়েও আনতে পারেন। সারা পৃথিবীর ত্রাস জল্লাদ তৈমুরলঙও হেরে গিয়েছিলো একজন সাধারণ মায়ের কাছে-

মা
সে কেমন করে বাবা?

কমান্ডার
সময় নেই তবু আপনার মতো একজন মাকে সে গল্প বলা উচিত বলে মনে করি। যুদ্ধজয়ের পর রাজকীয় ভোজসভা চলছে তৈমুরলঙের। চারদিকে আনন্দ উচ্ছ্বাস, সৈনিকদের কসরত, কুচকাওয়াজ। এমন সময় তৈমুরলঙের সামনে এসে দাঁড়ালো একটি মেয়ে। একটুও না কেঁপে তৈমুরকে জিজ্ঞেস করলো- সুলতান বায়েজিদকে যে পরাজিত করেছে সে কি তুমি? তখন তৈমুর বলছে- হ্যাঁ। আমি অনেক জয় করেছি এখনো জয়লাভে ক্লান্ত হই নি, তুমি কী বলতে চাও? তখন সেই মেয়ে বলছে আমি এসেছি সুদূর ইতালির সার্লেনো থেকে। আমার পিতা এবং স্বামীকে হত্যা করে সুলতান বায়েজিদ আমার সন্তানকে লুট করে এনেছে। আর তুমি বায়েজিদের সব লুট করে এনেছো। তুমি জানো আমার ছেলের খবর, তাকে ফিরিয়ে দাও। তৈমুরের পাত্রমিত্র সভাসদ তাকে পাগলী বলে তাড়িয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু পাষাণ তৈমুরের ভিতরে ঘটলো এক আলোড়ন। তখন তৈমুর বলছে- বছরের পর বছর আমার পায়ের নিচে কেঁপেছে মাটি, বাতাসে উঠেছে ঝড়, পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে তিরিশ বছর পর একের পর এক ধ্বংস করে ফিরেছি সমস্ত পৃথিবী, অর্থ আর সাম্রাজ্যের জন্য যুদ্ধ করতে এসেছে সবাই কিন্তু কোনোদিন কেউ আসে নি মানুষের জন্য যুদ্ধ করতে। আমার চোখে মানুষের কোনো মূল্য ছিল না। পথের মাঝে কাউকে রেহাই দেই নি। কিন্তু আজ আমি মাতৃত্বের কাছে পরাজয় মানছি। এই মুহূর্তে রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে ছুটে যাবে আমার ঘোরসওয়ার, তারা খুঁজে নিয়ে আসবে তোমার সন্তানকে-

মা
আমি আবার যাবো-

কমান্ডার
যান, আমাদের বিশ্বাস আপনি সফল হবেনই-

দৃশ্য-১০

(ক্যাম্পের ভিতরে কয়েকজন সৈনিককে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। প্রত্যেকেই খুব ক্লান্ত। জমাদার দাঁড়িয়ে থেকে হুকুম দিচ্ছে)  

জমাদার
পজিশন-এ্যাডভান্স-ডাবল আপ-পজিশন-এ্যাডভান্স-

সৈনিক- ২
কোন শালা নিয়েছিস এখনো বলে দে-

সৈনিক- ৪
এখনো বলে দে দোস্ত, খোদার কসম আমি তোকে একটা দারুন জিনিস প্রেজেন্ট করবো-

জমাদার
পজিশন-এ্যাডভান্স-পজিশন-মার্কটাইম-

সৈনিক- ২
শালার কী এমন ছিল যে চিঠিগুলো মেরে দিয়েছিস, শালার বউরা চিঠি লেখবে আর আমরা সেই চিঠি লুকানোর দায়ে শাস্তি খাবো? দোস্ত তোর বউকে নিষেধ করে দিবি আর যেন না লেখে-

সৈনিক- ৫
ঠিক আছে নিষেধ করে দেবো- তবু বলে ফ্যাল কে সরিয়েছিস আমার বিছানা থেকে-

সৈনিক- ৬
আমি নেই নাই দোস্ত- বিশ্বাস কর-

সৈনিক- ৫
ঠিক আছে তুই নিস নি, যে-ই নিয়ে থাকো চোখ বন্ধ করে বলে ফ্যালো- আমি কিছু বলবো না-

সৈনিক- ৪
দোস্ত মাফ করে দে, আমি নিয়েছি। কেনো নেব না, শালার এই বিদেশে যখন কারো বাড়ি থেকে চিঠি আসে তখন কার না ইচ্ছা হয় খবরাখবর জানতে- তোর কাছে চাইলাম তুই শালা পড়তে দিলি না- তোর বউ এর ছবিটা কিন্তু দারুণ- একেবারে শামীম আরার মতো-

সৈনিক- ৫
ওস্তাদ-

জমাদার
কী?

জমাদার
আর যেন এরকম না হয়- ঠিক আছে যাও, সাব্বির খা-

সৈনিক- ২
জ্বি ওস্তাদ-

জমাদার
তুমি সেন্ট্রিতে যাও-

(চলে যায়)

সৈনিক- ২
জ্বি ওস্তাদ- শালা এবার তোর চিঠি আসলে হয়, দেখবি মজা-

সৈনিক- ৪
দেখাস-

(সৈনিক- ৫, ৪ ও ৬ চলে যায়। সৈনিক- ২ পাহারারত সৈনিক এক এর পাশে যায়)

সৈনিক- ১
কী ওস্তাদ কেমন লগেলো?

সৈনিক- ২
ভালোই- এবার একটু নেশা না করলে হচ্ছে না- শালার গায়ে ব্যথা হয়ে গেছে- দোস্ত-

সৈনিক- ১
কী?

সৈনিক- ২
(খৈনি মুখে দেয়) শালার বাঙাল মুল্লুকের তামাকের স্বাদটাই আলাদা। কেমন নোনতা নোনতা- এক পুরিয়া খৈনিতেই মনে হয় হাওয়ার মধ্যে উড়ছি। মাইরি বলছি ওস্তাদ, যখন নেশা চাপে-না তখন শালার মনে হয়ে এক পুরিয়া খৈনির জন্য হাতের রাইফেলটা পর্যন্ত দিয়ে দেই। যাই বলো দোস্ত- বাঙাল মুল্লুকের চুন তামাকের স্বাদটাই আলাদা-

সৈনিক- ১
শালা নেশাখোর- এত শাস্তি খাওয়ার পরও তোর তেল কমে না-

সৈনিক- ২
এই জন্যেইতো এরকম একটা যুদ্ধের মধ্যেও বেঁচে আছি- খালি তামাকের স্বাদ? শালার আওরাত- জেনানাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেছিস? তোর গুজরানওয়ালার রসকসহীন শুকনো কাঠের মতো না- মনে হয়ে গালে টিপ দিলেই মাখনের মতো গলে পড়বে- দেখলেই নেশা চেপে যায়, মাথা ঘুরতে থাকে- ইচ্ছে করে এখানেই থেকে যাই-

সৈনিক- ১
শালা শিয়ালকোটের পাঠা- তোর বুঝি এসব বদমায়েসী ভাবনা ছাড়া আর কিছু নাই- ওসব ভাবনা বাদদে- যুদ্ধের গতি যেরকম পাল্টে যাচ্ছে তাতে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে ফেরত যাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ- শালা বদমায়েশ এবার একটু মানুষ হ-

সৈনিক- ২
মাস্টার মশাইদের মতো নীতিজ্ঞান দিচ্ছিস যে বড়? শালা আমি তোর মতো ফেরেশতা না, আগাপাছতলা একটা জলজ্যান্ত মানুষ। প্রায় এক বছর বিয়ে করেছি বউটার সাথে ভালো করে কথাই বলতে পারলাম না। এখনতো মনে হয় চেহারাটাও ভুলে গেছি। বিকেলে একটা টেলিগ্রাম পেয়েছি। আমিতো শালার ইংরেজি পড়তে পারি না। বিদ্যার দৌড়তো এই ট্রিগার পর্যন্ত। সবাইকেতো আবার পড়তে দেয়া যায় না। আব্দুর রহমানটা এলে হয় ও ব্যাটা আবার পড়তে লিখতে জানে-

সৈনিক- ১
দেখি টেলিগ্রামটা-

সৈনিক- ২
তুইও তো আমার মতো লেফ্ট রাইট্ পাশ-

সৈনিক- ১
তবুও দেনা দেখি- আপন লোকজনদের চিঠিপত্র হাতিয়ে দেখার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে দোস্ত-

সৈনিক- ২
সেই জন্যেইতো এতক্ষণ শাস্তি খেলাম-

(গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়)

সৈনিক- ১
অপারেশন থেকে ফিরছি-

(স্বশব্দে একটা কনভয় এসে থামে। কাদামাখা ও রক্তাক্ত অবস্থায় কয়েকজন সৈনিক নেমে আসে)

সৈনিক- ২
আদর যতœটা মনে হয়ে ভালোই করেছে-

সৈনিক- ৩
শালা কথা বলবি না- অল্পের জন্যে ফিরে এসেছি-

সৈনিক- ২
খুব খারাপ লাগছে বাক্সটা আনতে পারলাম না-

সৈনিক- ৩
তুই মানুষ হবি না-

সৈনিক-২
দোস্ত তোকে আমার ভীষণ দরকার-

সৈনিক- ৩
কেনো?

সৈনিক- ২
টেলিগ্রাম এসেছে পড়ে শোনাতে হবে-

সৈনিক- ৩
আচ্ছা- দেখি, ছেলে হয়েছে নাকি?

সৈনিক- ২
তাই লিখেছে?

সৈনিক- ৩
তুইতো দেখি আচ্ছা পাগল, এই অন্ধকারে পড়া যায় নাকি? আমি তাবুতে গিয়ে পড়ে রাখছি, তোর ডিউটি অফ হয়ে গেলে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসবি- ঠিক আছে?

সৈনিক- ২
 ঠিক হ্যায় ওস্তাদ।

(সৈনিক- ৩ চলে যায়)

সৈনিক- ১
তোর শালা মেয়ে হবে-

সৈনিক- ২
না ছেলে-

সৈনিক- ১
না মেয়ে-

সৈনিক- ২
ছেলে-

সৈনিক- ১
মেয়ে-

সৈনিক- ২
ঠিক আছে বাজি হয়ে যাক-

সৈনিক- ১
বাজি-

সৈনিক- ২
যদি ছেলে হয় তাহলে পুরো কোম্পানিকে গরু জবাই করে খাওয়াবো, আর যদি মেয়ে হয় তাহলে বিয়ে দেব তোর ছেলের সাথে- রাজি?

সৈনিক- ১
রাজি-

(হাসতে হাসতে দু’জনে গান ধরে)

দৃশ্য-১১

(ক্যাম্পের ভেতরে সৈনিক- ৩ কাপড় চোপড় খুলছে। পকেট থেকে টেলিগ্রামটা রাখতেই ছো মেরে নিয়ে যায় ৪র্থ সৈনিক)

সৈনিক- ৪
মনে হচ্ছে জরুরি প্রেমপত্র-

সৈনিক- ৩
শালা দেখতে পাচ্ছিস না টেলিগ্রাম-

সৈনিক- ৪
খারাপ কিছু-

সৈনিক- ৩
আমার না, ওই ব্যাটা আহাম্মক সাব্বির খানের, এখনো পড়ে দেখি নি-

সৈনিক- ৪
তাইতো বলি ও শালার মনে এত খুশি কেন? বোধ হয় ছেলে-মেয়ে হওয়ার কথা

সৈনিক- ৩
আমারো তাই মনে হয়, দে পড়ে দেখি-

সৈনিক- ৪
কী ব্যাপার- তোর মুখটা এত কালো হয়ে গেল হঠাৎ

সৈনিক- ৩
তুইতো সাব্বিরের পাশের গ্রামের?

সৈনিক- ৪
হু- তাতে কী হলো?

সৈনিক- ৩
ও শালা বউকে খুব ভালোবাসে তাইনা? বউ কেমনরে?

সৈনিক- ৪
দারুণ, মিথ্যে বললে জিভ খসে যাবে। ও শালার বউটাও ওর জন্য পাগল। আমি অবশ্য চিনি অনেকদিন থেকেই। ওরকম ঠাণ্ডা মাটির মতো মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। শালার বউ এর ভাগ্যটা দারুণ। সাব্বিরকেও চিনি ছোটবেলা থেকে। একসঙ্গেইতো ফৌজে নাম লেখালাম। বিয়ে করে ও ব্যাটা এলো রাওয়ালপি-ি ক্যান্টনমেন্টে। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই শুরু হয়ে গেল চিঠির বন্যা। প্রতিদিন লাল নীল খামে তিনটা চারটা করে চিঠি। এখানে আসার আগে দুজনেই ছিলাম ছুটিতে। টেলিগ্রাম এলো- ছুটি ক্যান্সেল আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট করো- দুজনে একসাথে যাবো বলে চলে গেলাম ওর বাড়ি। তারপর সে এক ঘটনা। ওর বউ কেঁদে কেটে অস্থির, কিছুতেই যেতে দেবে না-

সৈনিক- ৩
কিন্তু সেই বউইতো ওকে ছেড়ে গেল-

সৈনিক- ৪
মানে?

সৈনিক- ৩
ওর বউ বেরিয়ে গেছে কোন এক আসিফ খার সাথে। ওর মা টেলিগ্রাম করেছে- ও যেন এক্ষুণি চলে আসে-

সৈনিক- ৪
শালার মেয়ে জাতটাই এরকম- এদের বিশ্বাস করতে নাই- হাওয়াকে বিশ্বাস করেই ডুবলো আদম-

সৈনিক- ৩
সে যাই হোক- এরকম খবর আমি দিতে পারবো না- ভাই তুই দে-

সৈনিক- ৪
আমিও পারবো না-

সৈনিক- ৩
খবরটা পেলেইতো তুলকালাম কাণ্ড শুরু করে দেবে- ঠিক আছে দেখি কী করা যায়-

(সৈনিক- ২ আসে)

সৈনিক- ২
কী খবর দোস্ত? খারাপ কিছুনাতো?

সৈনিক- ৩
মনে হয় না- তবে শালার আমিও ঠিক বুঝতে পারলাম না-

সৈনিক- ২
মানে?

সৈনিক- ৩
এমন খটোমটো ইংরেজি লিখেছে যে আমার বিদ্যায় কুলালো না- এখন ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে গেলে হয়-

সৈনিক- ৪
এখন গিয়ে বিরক্ত করা কী ঠিক হবে? পেয়েছি-

সৈনিক- ৩
কী?

সৈনিক- ৪
বন্দিদের মধ্যে একজন কলেজের মাস্টার আছে- ভালো ইংরেজি জানে- ওর কাছে গেলে পড়ে শোনাতে পারবে-

সৈনিক- ২
দাও দোস্ত-

(টেলিগ্রামটা নিয়ে ছুটে যায়)

সৈনিক- ৪
ও যেরকম মানুষ উল্টা পাল্টা কী করে বসে কে জানে-

সৈনিক- ৩
আমার আর কিছু ভালো লাগছে না- শালার যুদ্ধ- মানুষ মারার চাকরি-

দৃশ্য-১২

(সেলের মধ্যে দৌড়ে এসে ঢোকে সৈনিক- ২)

সৈনিক- ২
এখানে কলেজের মাস্টার কে?

বন্দি- ১
আমি-

সৈনিক- ২
দেখতে তো সেরকম মনে হয় না- যা হোক আমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে-

বন্দি- ১
কী কাজ?

সৈনিক- ২
ইংরেজি জানো?

বন্দি- ১
জানি-

সৈনিক- ২
তাহলে পড়ো- আর যা লিখেছে বুঝিয়ে বলো-

বন্দি- ১
আপনার নাম কি সাব্বির খান?

সৈনিক- ২
হ্যাঁ

বন্দি- ১
আপনার স্ত্রী-

সৈনিক- ২
কী হয়েছে? ছেলে না মেয়ে?

বন্দি- ১
সে আসিফ খানের সাথে চলে গেছে-

সৈনিক- ২
মিথ্যে কথা- আমি সব শালাকে গুলি করে মারবো- কামান চালাবো কামান-

(উন্মত্তের মতো বন্দি ও অন্যদের মারতে থাকে। চিৎকার শুনে ছুটে আসে সবাই)

সৈনিক- ৪
মাথা ঠাণ্ডা কর সাব্বির-

সৈনিক- ২
সব শালাকে খুন করবো- কামান দাগাবো কামান-

সৈনিক- ৩
মাথা ঠাণ্ডা কর- চুপ কর-

সৈনিক- ১
তুই শালা এরকম হাউমাউ শুরু করেছিস কেনো? তুই পুরুষ মানুষ না? মনে কর তোর বউ মরে গেছে- কথায় আছে- অভাগার গরু মরে ভাগ্যবানের বউ- তোকে আবার বিয়ে করাবো-

সৈনিক- ২
অসম্ভব- আমি বাড়ি যাবো- আমাকে ছুটি জোগাড় করে দে তোরা-

সৈনিক- ৫
ঠিক আছে আমরা সবাই তোর জন্যে বলবো- এখন মাথা ঠাণ্ডা করে আমাদের সাথে চল-

দৃশ্য-১৩

(মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প- সন্ধ্যা। চোখ বাঁধা অবস্থায় মা)

মুক্তিযোদ্ধা- ১
বুড়ি কুটনি মাগি- সোজা বলে ফেল, পাকবাহিনীর ক্যাম্পে আমাদের কথা কী বলেছিস?

মুক্তিযোদ্ধা- ২
একটা ব্রাশ ফায়ার করে দেই-

মুক্তিযোদ্ধা- ১
না-থাম, আমার সেদিনই সন্দেহ হয়েছিল। পাকিস্তানি স্পাই সেজে এসেছে দেশপ্রেম দেখাতে, খেলাটা ভালোই শিখেছো-

মা
তোমরা আমাকে মেরে ফেল- তবু এরকম অপবাদ দিও না-

মুক্তিযোদ্ধা- ২
ওস্তাদের সেদিন বিশ্বাস করা উচিত হয় নি-

মুক্তিযোদ্ধা- ১
শুধু বিশ্বাস। মাতৃত্বের জয়গান করে তৈমুরলঙের গল্প শুনিয়ে দিলেন- আমাদের এতটা বিশ্বাস করা উচিত হয় নি-

মা
ঠিকই বলেছো- যে মার সন্তান পাকিস্তানি বাহিনীর একজন অফিসার, সে যদি রাতের অন্ধকারে পালিয়ে একবার পাকিস্তানি ক্যাম্প আরেকবার মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পে যাতায়াত করে তাহলে তাকে কে বিশ্বাস করবে বলো?

মুক্তিযোদ্ধা- ২
এতো সহজে কথা বের করবে না- মালিশ লাগাবো নাকি? ওই বুড়ি ঝটপট যা বলার বলে ফেল-

মা
বাবারা- আমি জানি তোমরা আমাকে ভুল বুঝছো- আমি গোয়েন্দাগিরি করি নি, তোমরা যেমন আমাকে সন্দেহ করছো ঠিক তেমনি পাকবাহিনীও আমাকে সন্দেহ করছে-

মুক্তিযোদ্ধা- ১
মারহাবা- কথার প্যাঁচ ভালোই জানো দেখছি-

মা
তোমাদেরকে আমি বিশ্বাস করাবো সে ক্ষমতা আমার নেই- তোমরা আমাকে মারো- মেরে একদম শেষ করে ফেলো-

মুক্তিযোদ্ধা- ২
মরতে তোমাকে হবেই- ছেলেকে সেনাপতি বানাতে চাও- সেজন্যে সৈন্যরা যথেষ্ট নয়, নিজেই মাঠে নেমে গেছো-

মা
বাবারা- তোমরা বুঝবে না- কী যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আমি বারবার উদ্ভ্রান্তের মতো এই ক্যাম্প থেকে ওই ক্যাম্পে ছুটে বেড়াচ্ছি-

মুক্তিযোদ্ধা- ১
বুঝেছি- এর কাছ থেকে আর কোনো কথা বেরুবে না- দেশপ্রেম আর মাতৃত্বের গল্প শোনাতে চায়- আর কোনো কথা নয়-এবার শেষ করে দেই-

(মুক্তিযোদ্ধা এক মাকে দাঁড় করিয়ে গুলি করবার প্রস্তুতি নিচ্ছে- এমন সময় ৩য় মুক্তিযোদ্ধা ও কমান্ডারের প্রবেশ)

কমান্ডার
কী করছো তোমরা!

মুক্তিযোদ্ধা- ১
বুড়ি পাকিস্তানি স্পাই-

কমান্ডার
না স্পাই না- ওর চোখের বাঁধন খুলে দাও- মা- যান আপনি মুক্ত, আপনাকে আমি চিনতে ভুল করিনি-

মুক্তিযোদ্ধা- ২
আমার মনে হয় আপনি ভুল করছেন, পরে এজন্যে খেসারত দিতে হতে পারে-

কমান্ডার
সে আমি দেখবো- কী ব্যাপার আপনি যাচ্ছেন না যে?

মা
বাবা শেষ পর্যন্ত তোমরাও আমায় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলে না?

কমান্ডার
চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি-

মা
লাগবে না, আমি একাই যেতে পারবো-

কমান্ডার
ঠিক আছে তাই যান- কী আশ্চর্য মানুষ!

দৃশ্য-১৪

সৈনিক- ১
দোস্ত না খেয়ে শুয়ে আছিস যে?

সৈনিক- ৩
ইচ্ছে করছে না-

সৈনিক- ১
শরীর খারাপ?

সৈনিক- ৫
বিরহ চলছে বিরহ- প্রিয় সঙ্গিনী কুত্তাটা পাওয়া যাচ্ছে না-

সৈনিক- ৪
আমি অনেক খোঁজ করেছি- কিন্তু কোনো চিহ্ন পেলাম না- পালিয়ে গেল নাতো?

সৈনিক- ৩
অসম্ভব- আমার বিশ্বাস এটা তোর কাজ-

সৈনিক- ৫
খামাখা উল্টাপাল্টা কথা বলবি না- আমারতো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই- তোর ওই কুত্তাটার পেছনে লাগি- এতই যখন প্রেম তখন গলা জড়িয়ে শুয়ে থাকলেই পারতি-

সৈনিক- ৩
ইয়ার্কির একটা মাত্রা আছে- আর একটা কথাও বলবি না-

সৈনিক- ৫
কী করবি? কুত্তার জন্যে কান্দে আরেক কুত্তা-

সৈনিক- ৩
শুয়রের বাচ্চা-

(সৈনিক- ৩ ঘুষি মারে। তারপর দু’জনের মধ্যে শুরু হয়ে যায় ধস্তাধস্তি। অন্যরা হাততালি দিয়ে মজা করে। শেষে জমাদারের গলার আওয়াজ শুনে ৪র্থ সৈনিক দু’জনকে ছাড়িয়ে দেয়)

জমাদার
কী ব্যাপার?

সৈনিক- ৪
কুস্তি খেলা ওস্তাদ-

জমাদার
আমি ভেবেছিলাম মারামারি- তোমাদের তো আর বিশ্বাস নাই- আব্দুর রহমান-

সৈনিক- ৩
জ্বি ওস্তাদ-

জমাদার
তুমি বিকেলে দেখা করবে-

সৈনিক- ৩
ওস্তাদ-

জমাদার
কিছু বলবে?

সৈনিক- ৩
জ্বি-

জমাদার
বুঝেছি কুকুরের ট্রিটমেন্টের কথা-

সৈনিক- ৪
ওটাকে পাওয়া যাচ্ছে না-

সৈনিক- ৩
পেয়ে যাবো নিশ্চয়ই-

জমাদার
না পাওয়া গেলেই ভালো- আর পাওয়া গেলে একটা ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে-

সৈনিক- ৩
জ্বি-

জমাদার
ঠিক আছে- ব্যবস্থা একটা নিশ্চয়ই হবে-

(চলে যায়)

সৈনিক- ৪
দিলাম সব ব্যাটাকে বাঁচিয়ে- জলদি সিগারেট বের কর- সোজা কোর্ট মার্শাল-

সৈনিক- ৫
ঠিক আছে চল ক্যান্টিনে- মন খারাপ করার দরকার নেই- ওস্তাদ যখন বলেছে তখন ব্যবস্থা নিশ্চয়ই একটা হবে-

দৃশ্য-১৫

(কয়েকজন বন্দির উপর ইন্টারোগেশন চালাচ্ছেন দু’তিনজন সৈনিক ও বাঙালি অফিসার। এমন সময় একজন সৈনিক আসে)

বাঃ অফিসার
কিছু বলবে?

সৈনিক- ৬
আপনার মা এসেছেন-

বাঃ অফিসার
যাও নিয়ে এসো- আর এদেরকে নিয়ে যাও-

(সবাই চলে যায়)

বাঃ অফিসার
মা তুমি!

মা
হ্যাঁ বাবা- আমি তোকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি-

বাঃ অফিসার
আচ্ছা মা বলতো তুমি কী?

মা
সামান্য একজন মা। তুই কি জানিস না বনের পশু পাখিও সন্তানের মঙ্গলের জন্য, নিরাপত্তার জন্য মানুষের চেয়ে কম লড়াই করে না-

বাঃ অফিসার
তুমি কী শুরু করেছো?

মা
খোকা, আমার কথা তোকে শুনতেই হবে। আমি মা, মৃত্যুর চেয়েও বড়। চিরদিন আমারাই জন্ম দিয়ে এসেছি জ্ঞানীর, বীরের আর সাধারণ মানুষদের। পৃথিবীেেত আমরাই বুনেছি ভালোবাসার বীজ। খোকা তুই কি আমাকে দেখাতে পারবি পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ আছে যে মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নেয় নি?

বাঃ অফিসার
মা তোমার এসব ইমোশনাল কথাবার্তা রাখো। আর কদিনের মধ্যেই দেখবে সমস্ত দেশ আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। তখন সমস্ত শহর তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে- পাথর খোদাই করে লেখা হবে আমার নাম-

মা
পাথরে! মানুষের মনে নয় কেন?

বাঃ অফিসার
হ্যাঁ মা মানুষের স্মৃতিতেই বেঁচে থাকে বীর-

মা
হ্যাঁ- সে-ই হলো বীর, যে মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবন সৃষ্টি করে, জয় করে মৃত্যুকে-

বাঃ অফিসার
যে ধ্বংস করে, যে প্রাণ সংহার করে, সেও স্রষ্টার মতোই বিখ্যাত, আর ক’টা দিন মাত্র-

মা
খোকা-

বাঃ অফিসার
নিঃসন্দেহে-

মা
আজো কি তুই আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে পারবি?

বাঃ অফিসার
কেনো পারবো না? এই দ্যাখো-

মা
আমি তোকে শেষবারের মতো বলছি বাবা ফিরে আয়, আর মায়ের কোল খালি করিস নে- তুই পালিয়ে আয়-

বাঃ অফিসার
আমাকে হাসালে মা- এই পৃথিবীতে তুমি আমার সবচেয়ে দুর্বল স্থান, নইলে-

মা
থাক আর বলতে হবে না- আমাকে ছাড়া তুই আর কী ভালোবাসিস?

বাঃ অফিসার
খ্যাতি, প্রতিপত্তি আর ক্ষমতা-

(মা বোরখার আড়াল থেকে একটা ছুরি বের করে বসিয়ে দেয় ছেলের বুকে)

মা
দেশের জন্য আমার যা করণীয় ছিল মনে হয় তা ভালোভাবেই পালন করেছি- মা হিসেবে আমার জায়গা সন্তানের পাশে-

(বলে ছুরিটা তুলে নিজের বুকে বসাতে যাবে এমন সময় সৈনিকরা এসে ধরে ফেলে)

জমাদার
আশ্চর্য- যাও একে নিয়ে যাও, হাত পা বেঁধে ফেলে রাখো- অবাক কা- বাঙাল মুল্লুকেও এমন মেয়ে আছে?

সৈনিক- ৫
এটা আমাদের মরুভূমিতে হলে না হয় বিশ্বাস করা যেত- সাংঘাতিক-

সৈনিক- ৩
তা-ঠিক, তবে মা হলে এরকমই হওয়া উচিত-

দৃশ্য-১৬    

জমাদার
অসম্ভব দু’দিন ধরে সাব্বিরের পাগলামি সহ্য করেছি- আর সম্ভব না-

সৈনিক- ৩
কিছুই কি ব্যবস্থা করা যায় না? অন্তত পনের দিনের ছুটি- আমরা সবাই বলছি-

জমাদার
না- ক্যাপ্টেন সাহেবকে আমি নিজে বলেছি- স্পেশাল কেস, কিন্তু ওনার এক কথা- এখন কাউকেই ছুটি দেয়া যাবে না। (দূরে চিৎকার শোনা যায়- সব শালাকে খুন করবো, কামান দাগাবো, আমার বউ বাড়িঘর সব শেষ হয়ে গেল) ওকে নিয়ে আসো-

(সৈনিক- ৫ গিয়ে দ্রুত নিয়ে আসে)

জমাদার
সাব্বির খাঁ-

সৈনিক- ২
জ্বি ওস্তাদ-

জমাদার
তুমি জানো তুমি এখন কোথায়?

সৈনিক- ২
জ্বি যুদ্ধে-

জমাদার
তাই আমি আশা করবো ক্যাম্পের ডিসিপ্লিন ভাঙবে না-

সৈনিক- ২
আমার ছুটি-

জমাদার
এখন কোনো ছুটি মিলবে না- এখন শুধু যুদ্ধ-

সৈনিক- ২
ময়দানের যুদ্ধে জয়ী হয়ে কী লাভ? ঘরের যুদ্ধে তো হেরে গেলাম। এ কেমন যুদ্ধ ওস্তাদ- তাহলে যুদ্ধ মানে কি ঘর ভাঙা?

জমাদার
আমি বুঝতে পারছি তুমি খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছো- বউ চলে গেছে তো তাতে কী? সৈনিকের ঘরে কেনো বউ থাকবে? সেওতো একটা মানুষ নাকি? সৈনিকের ঘরে বউ থাকবে না এটাইতো হওয়া উচিত- বউ মানেই পিছুটান। আমি জানি তুমি তোমার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতে, সেটাই স্বাভাবিক। তোমার দুর্ভাগ্যের জন্য আমার দুঃখ হয় কিন্তু কী আর করবে, দুর্ভাবনা না করে বরং এক কাজ করো, এখন থেকে বউ এর নামে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দাও- তারপর যুদ্ধ শেষ হলে আরেকটা বিয়ে করে নিও-

সৈনিক- ২
ছুটি তাহলে পাবো না?

জমাদার
না-

সৈনিক- ২
সব শালাকে শেষ করে ফেলবো- আমার ঘর সংসার-

(হাউমাউ করে জমাদারকে মারতে শুরু করলে অন্য সৈনিকরা তাকে ধরে ফেলে)

জমাদার
ওকে সেলে নিয়ে রাখো- কী! কথা শুনছো না কেন? সিপাই সাব্বির খান- এবাউট টার্ন- কুইক মার্চ-

দৃশ্য-১৭

(মা, সাব্বির খান সব সেলের বন্দিরা যে যার মতো নিশ্চুপ)

বন্দি- ১
আপনার ভয় করছে না?

মা
না-

বন্দি- ১
সত্যিই আপনি আমাদের অবাক করেছেন-

মা
বাবারা আমাকে একটু একা থাকতে দাও-

বন্দি- ১
তাই থাকুন, আপনাকে আবার আমাদের মধ্যে ঢোকালো কেন?

সৈনিক- ২
যুদ্ধ, সব শালাকে আমি গুলি করে মারবো- আচ্ছা ভাই একটা কথা বলতে পারো?

বন্দি- ১
কী?

সৈনিক- ২
যুদ্ধ মানেই কি মানুষ মারা, ঘর ভাঙা আর সমস্ত স্বপ্ন লুটপাট করা?

বন্দি- ১
বড় কঠিন প্রশ্ন-

সৈনিক- ২
যত কঠিনই হোক তোমাকে বলতে হবে-

বন্দি- ১
কী জানি ঠিক বলতে পারবো না- তবে বহু আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা গল্প পড়েছিলাম- গল্পটা পড়ে মনে হয়েছিল যুদ্ধের অন্যরকম অর্থও আছে-

সৈনিক- ২
বলো ভাই- তোমার সে গল্পটাই বলো-

বন্দি- ১
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষ। জার্মানি পরাজিত হয়ে পিছু হটছে। জার্মানিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমেরিকান আর রাশিয়ান ট্যাংক বাহিনী। হঠাৎ হলো কী রাশিয়ান ট্যাংক বাহিনীর সামনে পড়ে গেল একটা মুরগী আর তার ছানা। সঙ্গে সঙ্গে ট্যাংক বাহিনী থেমে গেল। তারপর ট্যাংক থেকে সৈনিকরা নেমে মুরগী আর বাচ্চাগুলোকে সরিয়ে দিয়ে আবার চলতে শুরু করলো। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আমেরিকানরা এটা নিয়ে খুব গালগল্প তৈরি করলো। বললো- যারা মুরগী দেখে ট্যাংক থামিয়ে দেয় তারা আর কী যুদ্ধ করবে? খুব টিটকারি করলো রুশদের। তারপর এই টিটকারি শুনে স্ট্যালিন তার জবাবে বললেন- রাশিয়ানদের কাছে একটা মুরগীর জীবনেরও দাম আছে। কারণ রাশিয়ান সৈনিকরা মনে করে যুদ্ধ মানে জীবন নেয়া নয়, জীবন দেয়া-

সৈনিক- ২
দারুণ কথা বলেছো ভাই- তোমার কথাটায় আমার মাথায় দারুণ ওলটপালট শুরু হয়ে গেছে- আচ্ছা তোমরা কিসের জন্য যুদ্ধ করছো?

বন্দি- ২
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি-

সৈনিক- ২
আমি জানি না আমার কী হবে? তবে একটা কথা বলে যাই-

বন্দি- ১
কী?

সৈনিক- ২
এই যুদ্ধে তোমরা জিতবেই-

দৃশ্য-১৮

(ক্যাম্পের একপ্রান্তে নদীর ধারে উঁচু জায়গায় চোখ বাঁধা অবস্থায় মা ও দু’তিনজন বন্দি। একটা খুটিতে কুকুরটাও বাঁধা। জমাদার হুইসেল দিলে সব সৈনিক এসে লাইন ধরে দাঁড়ায়)

জমাদার
আব্দুর রহমান- সামনে আসো- গুলি লোড করা আছে। সামনে তোমার টার্গেট এক এক করে সব ক’টাকে ফায়ার করবে-

সৈনিক- ৩
ওস্তাদ-

জমাদার
আমি বুঝতে পারছি কুকুরটার জন্যে তোমার খারাপ লাগছে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে ডিসিপ্লিন নষ্ট করছে এমন কিছু রাখা যাবে না- তারপর আবার কুত্তা-

সৈনিক- ৩
ওস্তাদ-

জমাদার
বুঝেছি, চিকিৎসার কথা বলতে চাও- এটা যুদ্ধক্ষেত্র, গুলি খেয়ে বুুকের ভিতর গর্ত হয়ে যাচ্ছে তার চিকিৎসা হচ্ছে না- আর কোথাকার একটা নেড়িকুত্তার চিকিৎসা- এসেছো মানুষ মারার চাকরি নিয়ে-

সৈনিক- ৩
কথাটা সত্য- তবে আমি মনে করি যুদ্ধ প্রাণ নেয়ার জন্য নয়, দেয়ার জন্য-

জমাদার
নো টক- আমার হুকুম, তুমি জানো হুকুম অমান্য করার অর্থ কী?

সৈনিক- ৩
জ্বি কোর্ট মার্শাল-

জমাদার
নাও হাতিয়ার তুলে ধরো- আর্মপিট পজিশনসে ওঠাও- কী হলো? প্রথমে কুত্তাটার উপর, তারপর অন্যগুলি। কী হলো? তোমরা সবাই দেখ খাইবারপাসের আফ্রিদী পাঠান কী রকম মেয়ে মানুষের মতো কাঁপছে- সবাই চুপ করো- একটা কথা মনে রেখো সেনাবাহিনীতে কোনো মায়া দয়ার স্থান নেই- সেদিন কর্ণেল সাহেব তোমাদের কুকুরের গল্প বলেন নি? অর্ডার, কমান্ডারের অর্ডার পালন করা ছাড়া সৈনিকের আর কোনো কাজ নেই- টার্গেট এট ইয়োর ফ্রন্ট- ফায়ার-

সৈনিক- ৩
না-

(বন্দুক উপরে তুলে গুলি করে- বন্দিরা ঝাঁপ দেয় নদীতে)

(ফ্ল্যাশব্যাক শেষ)

খালেদ
আমি ঝাঁপ দিয়ে নদী সাঁতরে বেঁচে গিয়েছিলাম। সেই সৈনিকটির কী হয়েছিল জানি না। সম্ভবত কোর্ট মার্শাল- নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি। মা’কেও নিশ্চয়ই গুলি করা হয়েছিল। কুকুরটার কথা ভুলেই গেছি। কিন্তু আমি আজো অপেক্ষা করে আছি সেই মা আর সৈনিকটির জন্যে। যাদের কাছে জীবন নেয়া নয় জীবন দেয়াটাই সৈনিকের মহান ব্রত। আজ এইক্ষণে তাকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন- প্রেজেন্ট আর্ম-

আব্দুল্লাহেল মাহমুদ- নাট্যকার, সদস্য-আরণ্যক নাট্যদল