Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

মঞ্চ’৯৮ : আশা-নিরাশার ইতিবৃত্ত

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

অনেক আনন্দ আর আশা নিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের নিয়মিত নাট্যচর্চা। অথচ আজ সাতাশ বছর অতিক্রমের পর সার্বিক হিসাবের ফলাফলে যতটা আনন্দ তারচে, বেশি বিষণ্নতা এবং আশার বদলে হতাশার চালচিত্র ফুটে ওঠে। এর অন্যতম প্রমাণ হলো, আজও আমরা নাট্যমঞ্চ তৈরি করতে পারি নি! মঞ্চ তৈরি করা না করা প্রসঙ্গে মস্ত যুক্তিতর্ক বা সন্দর্ভ করা যেতে পারে। সে প্রসঙ্গে না গিয়ে নাট্যপ্রয়োগ বা প্রযোজনা বিষয়টির দিকে লক্ষ্য করলে, আমরা কি দেখি? নাটক রচনার রূপ-রীতি থেকে শুরু করে তার বিষয় ভাষ্যে এবং প্রয়োগ আঙ্গিকের ক্ষেত্রে সিংহভাগ নাট্য প্রযোজনা এখনো গতানুগতিকতা ও প্রথাবদ্ধতার বৃত্তে আবদ্ধ। বাংলাদেশের নাট্যসৃজন মণ্ডলে নবতর বিষয় ও আঙ্গিক চর্চার বিষয়টি যেন  নিঃসঙ্গ পথ তৈরি করে চলছে। হোক সে পথ ক্ষীণ বা সংক্ষিপ্ত; অবজ্ঞার নয় কোনোমতেই। বরং সৃজনশীলতার দিক দিয়ে গৌরব ও গর্বের শীর্ষভূমিকা তারই প্রাপ্য।

দু’শ বছরের বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার প্রভাব বা সৃজনশক্তির সংকট যা-ই হোক আমাদের নাট্যচর্চাতে নিজস্ব বা দেশজ নাট্যঅভিজ্ঞান যুক্ত হতে স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রায় দু’যুগ সময় লাগলো। নাটক রচনার ক্ষেত্রে যেমন অন্ধভাবে ইউরোপীয় ঢংকেই অনুকরণ করা হচ্ছিল, তেমনি উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও ইউরো-মার্কিন রীতি পদ্ধতির অনুসরণই ছিল মুখ্য কর্ম। এই সেদিনও নিজস্ব নাট্য নির্মাণের প্রত্যয়কে অনেকেই বাহুল্যজ্ঞান করেছেন। বলেছেন এ অনাবশ্যক। বলেছেন- নাটক তো নাটকই, এর আবার দেশ অঞ্চল বিভাজন কেন? অথচ সামান্য বিশ্লেষণেই দেখা যাবে, দেশ অঞ্চল এবং জাতিভেদে বোধ বিশ্বাস তথা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের বিভিন্নতা রয়েছে এবং সে যুক্তিতেই ভিন্নতর নাট্য নির্মাণের প্রসঙ্গটি যুক্তিসিদ্ধ করা সম্ভব। নাটক বা নাট্যের স্বাতন্ত্র্যময় শিল্প বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা জানি। পাশাপাশি এ-ও আমরা নিশ্চয়ই মানবো যে, দেশ কাল ভেদে এর প্রকৃতি প্রকরণ স্থির গণ্ডীবদ্ধ বা গতানুগতিক হতে পারে না। কিন্তু বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে দু’শো বছরের যে আরোপিত ইতিহাস আমরা মেনে আসছিলাম, তাতে একদিকে আমরা স্বঐতিহ্যকে উপেক্ষা করছিলাম, অন্যদিকে নাট্যবিষয় ও আঙ্গিকের এক ঘেয়ে সীমাবদ্ধ উপস্থাপনা শৈলীর চর্চাতে ক্লিন্ন ও ক্লান্ত হচ্ছিলাম। সুখের বিষয়, আমাদের সমকালেই স্বল্পায়তনে হলেও, নতুন ও শক্তিমান পথ-পদ্ধতি প্রত্যক্ষ করলাম। নাটক রচনা ও প্রয়োগে যথার্থই প্রযুক্ত হলো ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। এবং একই সাথে রয়েছে তা সমকালের শিল্প শর্তে সনিষ্ঠ। সাম্প্রতিক নাট্যচর্চার দিকে চোখ ফেরালেই এ সত্য মিলবে।


সংক্ষিপ্ত সালতামামি

ঊনিশ’শ আটানব্বইয়ের মার্চ-এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় নাট্যোৎসব। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির যৌাথ আয়োজনে উদযাপিত হলো এ উৎসব। আঠারদিন ব্যাপী জাতীয় নাট্যোৎসব দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নাট্যপ্রযোজনা উপস্থাপিত হয়েছে। মোট পঞ্চান্নটির মধ্যে রাজধানীর বাইরের ছিলো সাতাশটি প্রযোজনা। এ উৎসেবের উল্লেখযোগ্য দিকগুলোকে এভাবে চিহ্নিত করা যায়- ক. উৎসবের সামগ্রিক আয়োজন ছিলো খুবই দায়সারা, খ. প্রচার-প্রচারণা ছিল গৌণ রকমের; ফলে দর্শকের উপস্থিতি চিত্র ছিলো বড়ই করুণ। দশজন, বিশজন, পঁচিশজন এরকম সংখ্যক দর্শক এসেছেন শিল্পকলা ও গাইড হাউস মঞ্চে। মহিলা সমিতি মঞ্চে দর্শক সংখ্যা ছিলো তুলনামূলক ভালো। গ. উৎসবে রাজধানীর নাট্যকর্মী-নাট্যজনদের উপস্থিতি ছিলো নগণ্য। ঘ. ‘জাতীয় নাট্যোৎসব’- অথচ এ উপলক্ষে হয় নি কোনো সেমিনার বা মুক্ত আলোচনা বা প্রাসঙ্গিক অন্য কোনো অনুষ্ঠান। থিয়েটার (বেইলী রোড) এর ‘মেহেরজান আরেকবার’ দিয়ে নাট্যোৎসবের উদ্বোধন হয়েছিলো। যে নাট্যদলটি অনেক উৎকৃষ্ট প্রযোজনা উপহার দিয়েছে সারাদেশকে, সেই ‘থিয়েটার’, নাটকের বিষয় ও আঙ্গিকের বহুবিচিত্র নিরীক্ষা ও প্রয়োগের এই কালে অতি নাটকীয় ও চটুল প্রসঙ্গবহুল ‘মেহেরজান’ দিয়ে আমাদেরকে এক নৈরাশ্যের প্রান্তরেই ফেলে রাখে। চট্টগ্রামের খ্যাতনামা দল ‘অরিন্দম’ও আমাদের হতাশ করেছে। তারা নিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রযোজনা ‘সাজন মেঘ’। অরিন্দম এর পূর্ব প্রযোজনা দেখার অভিজ্ঞতা যাদের আছে ‘সাজন মেঘ’ দেখার পর দলটির ‘টিম স্পিরিট’ তাদের সংশয়ী করে তোলে। ‘সাজন মেঘ’ এর নিরাভরণ মঞ্চবিন্যাস ও দৃশ্যান্তরে পেইন্টিং এ ব্যবহার যেমন আধুনিক শিল্প শর্তকে মনে করিয়ে দেয়, তেমনি পাশাপাশি দৃশ্যান্তরে আলো নেভানোর জন্য ফ্রিজ হয়ে যাওয়ার সেই গতানুগতিক রীতি আধুনিক প্রযোজনাশৈলীকে অনেকটাই ম্লান করে দেয়।

‘কিনু কাহারের থেটার’ করেছে রাজশাহীর অনুশীলন নাট্যদল। আঙ্গিক ও সৌষ্ঠবের দিক থেকে এটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। মনোজ মিত্র রচিত এবং মলয় ভৌমিক নির্দেশিত এই ‘... থেটার’ এ আগ্রাসী ঔপনিবেশিক শক্তির স্বরূপ এবং ‘গরিব মানুষের এক রঙ তামাশার দলে’র মর্মগাথা উপস্থাপনে অনুশীলনের শিল্পীবৃন্দ সার্থক হয়েছেন। রাজশাহী থিয়েটারের ‘দেওয়ানা মদিনা’ও ছিল একটি আকর্ষণীয় প্রযোজনা। নানাবিধ লোকআঙ্গিক যেমন, কিসসা, নৌকা বাইচের গান, জারি, বায়োস্কোপ, গ্রামীণ কবিতা, যাত্রাপালা পুঁথি উপস্থাপনরীতি প্রয়োগ করে ময়মনসিংহ গীতিকার এই ‘দেওয়ানা মদিনা’ নির্দেশনা দিয়েছেন নিতাই কুমার সরকার।

উৎসবে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় ছিলো চট্টগ্রামের তরুণ নাট্যশিল্পী আহমেদ ইকবাল হায়দার এর নির্দেশনায় পাঁচটি প্রযোজনা ওই নাট্যোৎসবে উপস্থাপিত হওয়া। তাঁর নিজ দল ‘তির্যক’ প্রযোজিত ‘রক্তকরবী’ দর্শককে কমবেশি মুগ্ধ করলেও প্রত্যাশার চূড়া তিনি আমাদের স্পর্শ করাতে পারেন নি। তবে প্রযোজনাটির মঞ্চ ও আলোর বৈচিত্র্যপূর্ণ বিন্যাসসহ নন্দিনী চরিত্রের অভিনয়শিল্পীর অভিনয় এবং একাধিক চরিত্রে আহমেদ ইকবাল হায়দার এর প্রাণবন্ত অভিনয় দর্শকরা দারুণ উপভোগ করে।

এই জাতীয় নাট্যোৎসবটি যে দায়সারাভাবে সম্পন্ন হয়েছে তার অন্যতম প্রমাণ হলো, এই উৎসবের স্মারক প্রকাশনা আয়োজকরা বের করেন নি। অথচ জাতীয় সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রকাশনার গুরুত্ব নেহাত কম নয়। আটানব্বইয়ের নাট্যাঙ্গনে ‘জাতীয় নাট্যশালা’ একটি বিশেষ সংবাদ হতে পারতো। সংবাদ কিছুটা হয়েছিলো, তবে তা পুরোটাই নেতিবাচক। বেশ দীর্ঘ একটা সময় অপেক্ষার পর নাট্যকর্মীদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল ১৯৯৬ এর শুরুতে নাট্যশালা নির্মাণের কাজ শুরু হওয়াতে।  কিন্তু তা-ও বহু বিচিত্র ঘটনা দুর্ঘটনার বেড়াজালে বন্দি হয়ে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত ফাইলে আটকা পড়ে নির্মাণ প্রক্রিয়া এখন মুখ থুবরে পড়ে আছে। মঞ্চ নাটকের দর্শক সংখ্যা আজ যে করুণ দশায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার জন্য অন্যান্য সংকটগুলোর মধ্যে মঞ্চ সংকটই অন্যতম। রাজধানীর বহুল পরিচিত মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস মঞ্চ দু’টিতে আধুনিক শিল্পশর্ত রক্ষা করে নাট্যনির্মাণ যে কতোখানি ঝক্কি ঝামেলার ব্যাপার তা ভুক্তভোগী নাট্যজন মাত্রেই জানেন। দর্শকের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে নতুনতর নান্দনিক অভিজ্ঞানই যদি না মেলে তবে কেন বারংবার (দর্শক) নিজেকে টেনে নিয়ে যাবেন একঘেঁয়ে ক্লান্তিকর পরিবেশে? প্রতিবেশী দেশ ভারতে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে সেখানকার প্রতিটি জেলায় সরকারি উদ্যোগে স্থাপন করা হয়েছে রবীন্দ্র মঞ্চ। স্বাধীনতা স্মারক মঞ্চ- স্বাধীনতা মঞ্চ। এতে আমাদের জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় বিষয়টি স্মরণের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হতো আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য।

ঊনিশ’শ সাতানব্বইয়ে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব আমরা পেয়েছি। হাবিব তানভীর, রতন থিয়াম, শাঁওলী মিত্র, ঊষা গাঙ্গুলি, বিভাস চক্রকর্তী, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, গৌতম হালদার প্রমুখ বিশিষ্ট নাট্যজনের নাট্যসমাবেশে মুখর ছিল আমাদের নাট্যাঙ্গন। আটানব্বইয়ে তেমন উৎসবের আয়োজন হয় নি। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সৌজন্যে ওয়াটার মিল থিয়েটার কোম্পানীর প্রযোজনা শেক্সপীয়রের ‘হেনরী দ্য ফাইভ’ উপভোগ করা গেল। ভারতীয় দূতাবাসের সৌজন্যে কলকাতা থেকে উৎপল দত্তের ‘তিতুমীর’ নিয়ে এসেছিল পিপলস লিটল থিয়েটার। আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে বিশেষ সঞ্চয় হয়ে রইলো সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সোভা সেন, সমীর মুখোপাধ্যায়ের অনন্য অভিনয়। বের্টোল্ট ব্রেখট এর মাদার কারেজ (হিম্মত মাঈ) নিয়ে এসেছিলেন ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর অনন্য নির্দেশনা ও অভিনয়শৈলীতে মুগ্ধ হলাম হাজার দর্শক।

উল্লেখযোগ্য উৎসবের আয়োজন না হলেও দেশের প্রধান সারির প্রায় সব ক’টি দল এবার (’৯৮) ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন উৎসবে অংশ গ্রহণ করেছে। এই অংশ গ্রহণে তারা সুনাম-দুর্নাম দুই-ই অর্জন করেছে। মমতাজউদদীন আহমদ রচিত নির্দেশিত ও অভিনীত ‘খামাখা খামাখা’র উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় কলকাতায়। নাটকটি নিয়ে সেখানকার নাট্যপত্রিকায় বিরূপ (বা বলা চলে আক্রমণাত্মক) সমালোচনা প্রকাশিত হয়। অবশ্য দেশেও মমতাজউদদীন আহমদ এর আটানব্বইয়ে প্রযোজিত দু’টি নাটকই (খামাখা খামাখা এবং হাস্য লাস্য ভাষ্য) বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের উদ্যোগে গঠিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার’ সেপ্টেম্বর ’৯৮ এ যোগ দিয়েছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা নাট্যোৎসবে। নাট্যকলা’র শিক্ষার্থীদের প্রযোজনা ‘কমলা রাণীর সাগর দীাঘি’ এবং ‘টোবাটেক সিং’ প্রযোজনা দু’টো বিপুল দর্শকের প্রশংসা পেয়েছে। ‘কমলা রাণীর সাগর দীঘি’ সাতানব্বইয়ের ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত চতুর্দশ নান্দিকার নাট্যমেলায় প্রদর্শিত হয়ে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে।

কিশোরগঞ্জের পালাকার ইসলাম উদ্দিনের প্রশিক্ষণে এবং ডঃ সৈয়দ জামিল আহমেদ এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছে লোক নাট্য ‘কমলা রানীর সাগর দীঘি’। সাদাত হাসান মান্টো’র গল্প নিয়ে নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক ডঃ ইসরাফিল শাহীন নির্দেশনা দিয়ে তৈরি করেছেন ‘টোবাটেক সিং’। এ দু’টি প্রযোজনার বেশ ক’টি প্রদর্শনী করা হয়েছে নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের স্টুডিও থিয়েটারে। এবং তা বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

আটানব্বই সালে পূর্ব প্রযোজনার মধ্যে ঢাকা পদাতিকের ‘বিষাদ সিন্ধু’ আরণ্যকের ‘জয়জয়ন্তী’ থিয়েটার আর্টের ‘কোর্টমার্শাল’ ও ‘গোলাপজান’, জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার-ঢাকা’র ‘সক্রেটিসের জবানবন্দী’র প্রদর্শনীতে দর্শকের সমান আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে।  

৩    
আটানব্বইয়ের আশা জাগানিয়া প্রযোজনা

নতুন প্রযোজনা আটানব্বইয়ে খুব একটা কম হয় নি। যদিও সবগুলো প্রযোজনা বর্তমান আলোচকের দেখা সম্ভব হয় নি। যতগুলো দেখেছি তার মধ্য থেকে বিষয় (Content), আঙ্গিক (Form) ও উপস্থাপনার (Performance) গুণগত মান মূল্যায়নে যেগুলোকে উল্লেখ করা যায় সেগুলো: ঢাকা থিয়েটারের ‘বনপাংশুল’, নাট্যকেন্দ্রের ‘ক্রুসিবল’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগের ‘এ ডলস হাউস’, আরণ্যকের ‘প্রাকৃতজন কথা’, প্রাচ্যনাট্যের ‘সার্কাস সার্কাস’।

৩.১
বনপাংশুল

ঢাকা থিয়েটারের রজত জয়ন্তী স্মারক প্রযোজনা ‘বনপাংশুল’। পাশ্চাত্য রীতি নির্ভর সংলাপ, দৃশ্যবিভাজন, বর্ণনার যে ধারা বাংলা নাট্যে বিরাজ করছে, তার মুখোমুখি দেশজ নাট্যের অনন্য সম্ভার নিয়ে মঞ্চ আলোকিত করে চলেছে ঢাকা থিয়েটার। বাংলা নাটক ও নাট্যের সুলুক সন্ধানী নাট্যকার ডঃ সেলিম আল দীন বাংলা নাট্যতত্ত্ব বা দর্শণের ক্ষেত্রে একাধিক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন। ‘হাত হদাই’, ‘চাকা’, ও ‘যৈবতী কন্যার মন’ নাটকের ভেতর দিয়ে যে বর্ণনাত্মক নাট্যরীতি, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পচিন্তা প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে, সে ধারার সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘বনপাংশুল’। সেলিম আল দীন ‘বনপাংশুল’ রচনার পর অবশ্য এই ধরনের আরও একটি নাটক রচনা করেছেন। নাম ‘প্রাচ্য’ (পাক্ষিক শৈলীতে প্রকাশিত বর্ষ ৪ সংখ্যা ৫, ১৬ এপ্রিল ১৯৯৮)। একটি ব্যাপার, বলা বা লেখার ক্ষেত্রে আমরা ‘নাটক’ বা ‘নাট্য’ অভিধা প্রয়োগ করলেও সেলিম আল দীন একে অভিষিক্ত করেন ‘উপাখ্যান’ নামে। ‘চাকা’ ‘যৈবতী কন্যার মন’কে সরাসরি নাটক না বলে বলেছেন ‘কথানাট্য’। তাঁর বিশ্বাস, বিশ্বসাহিত্যে একবিংশ শতাব্দী শিল্প বিষয়ে এক আঙ্গিক ও পদ্ধতিগত সংকটে নিপতিত হবে’। তাই তিনি আশা প্রকাশ করেন ‘বাংলা কথানাট্য বা পাঁচালির রীতিটা সেক্ষেত্রে বিশ্বসাহিত্য বা বিশ্বনাট্যে নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম’। পাঁচালি, যা কিনা বাঙালির অভিনয় অনুষ্ঠানের (Performance) চিরায়ত আঙ্গিক। পাঁচালি এমন একটি নাট্যআঙ্গিক যেখানে উপন্যাস, গান, নৃত্য, নাটক সবটাই এক সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই পাঁচালি রীতিতেই রচিত হয়েছে ‘বনপাংশুল’। নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ এই প্রযোজনাতে এসে একেবারেই আলাদা কাজ করেছেন। তিনি মনে করেন যে, প্রাচ্যের যে অভিনয়রীতি আছে, বাঙালির যে রীতি আছে, বনপাংশুল-এ এসে তিনি এই রীতির সফল প্রয়োগ করতে পেরেছেন। ‘মান্দাই’ নামের লুপ্ত প্রায় এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন যাপনের জগৎ নিয়ে তৈরি এই নাট্য ‘বনপাংশুল’। প্রায় তিন ঘন্টা ব্যাপী দর্শকের সামনে পড়তে পড়তে খুলতে থাকে জীবন্ত এক নৃতত্ত্ব। সত্যি, নাট্যকার এবং শিল্পীদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। দেশের আদি নৃ গোষ্ঠী নিয়ে শিল্প মাধ্যমেতো দূরের কথা, গণমাধ্যম ও শিক্ষা ব্যবস্থায় যেখানে প্রাসঙ্গিক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বিরাজ করছে নানা অনীহা, সেখানে নাটকের এই মানুষগুলো জাতির এই গুরুদায়িত্ব পালন করছেন, তাদের মতো করে।

মান্দাইদের পূজা-পার্বণ, তাদের বিশ্বাস-মিথ, প্রাচীনের সঙ্গে নতুনের দ্বন্দ্ব, বাঙালি মহাজনদের সঙ্গে সংঘর্ষ, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সুযোগে ধর্ম বিশ্বাসের টানাপোড়েন, নর-নারীর প্রণয়, বিচ্ছেদ এবং সর্বোপরি মান্দাই অরণ্য, সে অরণ্যের বৃক্ষডালে ছুটে বেড়ানো দুই বানর ... সবই উঠে আসে মঞ্চে। মহিলা সমিতি মিলনায়তনের প্রায় গোটা জায়গা জুুড়ে করা হয়েছে বনপাংশুলের অভিনয় ক্ষেত্র। যে জন্য দর্শক সংখ্যাও রাখতে হচ্ছে সীমিত। সমস্ত উপস্থাপনাটি দর্শক ঘনিষ্টতায় সম্পন্ন হয়। মঞ্চের এই পরিবেশে একদিকে গ্রামীণ অভিনয় আসর শর্ত যেমন থাকলো, তেমন আবার অ্যাকটিং-স্পেইসের আধুনিক নিরীক্ষাধর্মিতাও রইলো।

এই প্রযোজনায় সঙ্গীতের বিশেষত্ব উল্লেখ করতেই হয়। শিমূল ইউসুফ এর সুর ও গায়নে বিশেষ নান্দনিক ব্যঞ্জনা তৈরি হয়। যদিও মান্দাইদের ভাষা বা তাদের নিজস্ব সুর সঙ্গীতের কোনো আভাসই আমরা পাই না। শুদ্ধ ভাষা এবং উচ্চাঙ্গের বিভিন্ন রাগ সমবায়ে যে সঙ্গীত এবং আবহ তৈরি হয়েছে তাতে আমাদের নাটকের বিষয় বা ঘটনা প্রবাহ এবং চরিত্রসমূহের আনন্দ আকাক্সক্ষাা ও বেদনা মূর্ত হয়ে উঠে।

পোশাকের ক্ষেত্রেও মান্দাইদের নিজস্ব পোশাকের কোনো প্রতিফলন না থাকলেও, এক্ষেত্রে নবতর নান্দনিক অভিজ্ঞানের সাক্ষাৎ মেলে। প্রকৃতির সাহচর্যে বেড়ে ওঠা বনবাসীদের পরিধেয় বস্ত্রাদির বাস্তব অনুকৃতি যে হয় নি তা সহজেই বোঝা যায়। মেয়েদের পোশাকে শরীরের রঙে রঙ মিলিয়ে ব্লাউজ, বাহুতে সাদা ফুল এবং সাদা রঙের শাড়িতে লাল সবুজের পাড়। পুরুষ শিল্পীদের চরিত্রানুগ পোশাকের ইঙ্গিতপূর্ণ প্রয়োগসহ সকল অভিনয় শিল্পীর পোশাকে রঙ রেখার সাযুজ্য ইত্যাদি সবমিলিয়ে পাওয়া যায় পোশাক পরিকল্পনার আধুনিক কৃতি।পরিকল্পনার নেপথ্যে মেধা মননের যে নিবেদন অনুধাবন করা যায়, তা নবীন নাট্যশিল্পীদের অনুপ্রেরণার বিষয় হয়ে থাকবে। তবে একটি সুনির্দিষ্ট নৃ-গোষ্ঠীর জীবন-কৃষ্টি নিয়ে এই যে নাট্য, তাতে ভাষা, সুর, পোশাক ইত্যাদি প্রয়োগে উক্ত নৃ-বৈশিষ্ট্য অনুধাবন আমাদের নাগালের বাইরে থেকে যায়।

‘বনপাংশুল’ এর মূল পাঠ বজায় রাখলে এটি তিন খণ্ডের তিনটি প্রযোজনা তৈরি হতে পারতো। এবং সেরকমটি সত্যিই হলে, তা হতো বাংলাদেশের এবং বাংলা নাট্যাঙ্গনের গৌরবময় কীর্তি।

৩.২
ক্রুসিবল

আর্থার মিলারের নাটক ‘ক্রুসিবল’। তাহমিনা আহমেদের অনুবাদে এটি মঞ্চে এনেছে ‘নাট্যকেন্দ্র’। নবতর ধারণা পাওয়া যাবে বা চিন্তা ও মননের ছাপ আছে এমন প্রযোজনার যখন বড়ই আকাল আমাদের নাট্যাঙ্গনে, তখন নির্দেশক তারিক আনাম খান নাট্যবিষয় ও প্রয়োগের ঐশ্বর্যময় এক সম্ভার নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হলেন। ‘তুঘলক’, ‘হয়বদন’ এর পর প্রায় তিনবছর বিরতি দিয়ে আটানব্বইয়ের শেষ দিকের প্রযোজনা এই ‘ক্রুসিবল’।

প্রায় তিন’শ বছর আগেকার এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে মিলার ১৯৫৩ সালে রচনা করেছেন ‘দ্য ক্রুসিবল’। সপ্তদশ শতাব্দীতে নিউ ইংল্যান্ডের সালেম শহরে কুসংস্কার এবং গোঁড়ামির প্রবল প্রতাপে এক মস্ত সামাজিক ধস নেমেছিলো। ওখানকার প্রথা অনুযায়ী লেখাপড়া, নাচ-গান-নাটক-এ সব কিছুই ছিলো অর্থহীন আনন্দ উপভোগ। সমাজের ক্ষমতাধর, স্বার্থপর, লোভী আর ধূর্ত ব্যক্তিরা ঈশ্বর এবং শয়তানের চিরায়ত দ্বন্দ্বকে নিয়ে ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠতো। সেই করাল গ্রাস থেকে সরল, সুন্দর-শান্তিপ্রিয় ধর্ম ও অন্তপ্রাণ কেউই রক্ষা পেতো না। প্রকৃতির ছন্দে মেতে ওঠা শিশু-কিশোররাও ছাড় পেতো না। তাদের নাচ-গানকে ডাইনি বা শয়তান আরাধনার সাথে এক করে অপব্যাখ্যা করা হতো। ইতিহাসের এমন এক অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্করতম অধ্যায় থেকে রসদ সংগ্রহ করে রচিত হলো ‘ক্রুসিবল’।

কালের ধারাবাহিকতায় আজও সেই অন্যায় অনাচার আমাদের সামনে প্রতিনিয়তই চলছে। আর এ প্রেক্ষিতেই নাট্যকেন্দ্রের ‘ক্রুসিবল’ প্রযোজনার প্রাসঙ্গিকতার ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যায়।

‘ক্রুসিবল’ এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী (২৬ এপ্রিল ১৯৯৮) মুগ্ধচিত্তে উপভোগ করেছিলাম। অবশ্য অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে দেখা যাবে, ওই মুগ্ধতার আড়ালে আক্ষেপ বা ঘাটতির বহরও নিতান্ত কম নেই। কাঠামোগত দিক দিয়ে ‘ক্রুসিবল’ একটি ‘কন্ডিশনড’ নাটক। অর্থাৎ অভিনয়শিল্পী কোত্থেকে, কোন দরজা দিয়ে, কীভাবে মঞ্চে এসে মুভমেন্ট করবে ইত্যাদির সবিস্তারে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন আর্থার মিলার। কোথায় বেঞ্চি, কোথায় টেবিল এবং এমনকি কোন জানালা দিয়ে কতটুকু আলো মঞ্চে পড়বে তারও নিখুঁত বর্ণনা আছে পা-ুলিপিতে।

পা-ুলিপির নির্দেশনা সমূহের নিখুঁত রূপায়ণ আমরা প্রথমেই লক্ষ্য করি ক্রুসিবলের মঞ্চ পরিকল্পনায়। যথার্থই রচনা করা হয়েছে ‘সালেম শহরের রেভারেন্ড প্যারিসের ওপরতলার একটি স্বল্প পরিসরের শোবার ঘর, বাঁ দিকে একটি অপ্রশস্ত জানালা। জানালার পাল্লার ভেতর দিয়ে ভোরের সূর্যালোক প্রবেশ করছে। ডানদিকে বিছানার পার্শ্বে মোমবাতি ....’। সবই সুচারু সংস্থাপিত হয়েছে মঞ্চে, এমনকি ‘ছাদের কড়িকাঠ বাইরে আছে এবং কাঠের রঙ ধূসর ও কাঁচা’।

প্রায় প্রত্যেক অভিনয়শিল্পী মনোগ্রাহী অভিনয় উপস্থাপন করেছেন। অর্থাৎ সার্থকতার সঙ্গেই সকলে মঞ্চমায়া তৈরি করতে পেরেছেন। কিন্তু কথা হলো, আধুনিক শিল্পরুচির পরিপ্রেক্ষিতে নাট্যভিনয়ে ‘মায়া’ বা ‘ইল্যুশন’ তৈরি করা কতোখানি যুক্তিযুক্ত। সরাসরি ‘সেই সময়ের আবহ’ রচনার বদলে সময় এবং পারিপার্শ্বিকতার বিশ্লেষণই তো কাম্য। বাস্তবানুগ বিষয়ের নাট্যউপস্থাপন মানে তো হুবহু অনুকরণ বা উপস্থাপন নয়।  বরং সেই বাস্তব অভিজ্ঞতার অন্তর্নিহিত নানা স্তর, না বলা কথা ইত্যাদিসহ বিচিত্র মাত্রাকে পরিস্ফুট করে দর্শকের কল্পনাকে চাড়িয়ে দেয়াই তো মুখ্য হওয়া উচিত। এতে করে বাস্তবের অন্তর্নিহিত সত্য এবং অনুভূতিরাজি মূর্ত হয়ে উঠতে পারে।

‘ক্রুসিবল’ প্রযোজনায় অভিনয়শিল্পী সমাবেশের একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, এখানে যশস্বী অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি বেশ ক‘জন নবীন নাট্যশিল্পী প্রায় সমান তালে, এমনকি বলা যায়, দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন।

ভালো নাটক, ভালো দর্শকের বর্তমান সংকটকালে নাট্যকেন্দ্রের ‘ক্রুসিবল’ কে একশোভাগ পরিচ্ছন্ন ও মানসম্পন্ন প্রযোজনা হিসেবে চিহ্নিত করা অসঙ্গত হবে না।

৩.৩    
নাটমণ্ডলে ‘এ ডলস হাউস’

দেশের নাট্যাঙ্গনে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ। প্রাতিষ্ঠানিক নাট্য অধ্যয়ন বা চর্চার একটি নিজস্ব নাট্যগৃহ প্রতিষ্ঠিত হলো আটানব্বইয়ের নভেম্বরে। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সংলগ্ন বৃত্তাকার ভবনটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বদান্যতায় এবং রাজকীয় নরওয়েজিয়ান দূতাবাসের সহায়তায় অত্যাধুনিক নাট্য আয়তনে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলা নাট্যের ঐতিহ্যবাহী মঞ্চধারণার সূত্র ধরে এর নাম রাখা হয়েছে ‘নাটমণ্ডল’।

নাট্যকলা বিষয়ের স্নাতকোত্তর প্রথম পর্বের শিক্ষার্থীদের ‘শ্রেণী প্রযোজনা’ হেনরিক ইবসেন রচিত ‘এ ডলস হাউস’ মঞ্চায়নের মাধ্যমে ‘নাটমণ্ডল’ উদ্বোধন করা হলো। প্রযোজনাটির শিক্ষক-নির্দেশক ড. ইসরাফিল শাহীন। ইবসেন ‘এ ডলস হাউস’ রচনা করেছিলেন ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দে। সেই থেকে শুরু করে ইউরোপ হয়ে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র মঞ্চায়িত হয়ে আসছে নাটকটি। দেশ বা অঞ্চলভেদে নাটকটির অনুবাদ বা রূপান্তরে অনেক ক্ষেত্রে মূল প্রেক্ষাপটে বিভিন্নতাও এসেছে। যেমন শম্ভু মিত্রের অনুবাদে (রূপান্তরে) নাটকটি কলকাতার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রেক্ষাপটে ‘পুতুলখেলা’ নাম হয়েছে। ইতোপূর্বে রাজধানীর নাট্যদল ‘কণ্ঠশীলন’ খালেদ খান-এর নির্দেশনায় ‘পুতুল খেলা’ মঞ্চে এনেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে কুন্তল বড়ুয়ার রূপান্তর ও নির্দেশনায় ‘এ ডলস হাউস’ মঞ্চে এসেছে ‘খেলাঘর’ নামে। নাট্যকলা বিভাগ তাদের স্নাতকোত্তর শ্রেণী প্রযোজনায় সরাসরি অনুবাদ ‘এ ডলস হাউস’ নামেই মঞ্চে এনেছে। প্রযোজনার প্রকাশনায় (ফোল্ডারে) যদিও অনুবাদকের নাম উল্লেখ করা হয় নি, তবুও সহজে বোঝা যায় তারা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশিত, খায়রুল আলম সবুজ অনূদিত ‘নোরা’ পাঠ (Text) নিয়েই কাজ করেছেন। যেহেতু এটি একটি শ্রেণী প্রযোজনা, তাই এর প্রযোজনা কার্যক্রমে অত্যন্ত কঠোরভাবে বাস্তবানুগ অভিনয় (Realistic-Naturalistic) শৈলী অনুসৃত হয়েছে। প্রযোজনা কার্যক্রমে ব্যতিক্রমী একটি দিক হলো-সকল শিক্ষার্থীর বিভিন্ন চরিত্রে রূপদান করা। নাটমণ্ডল উদ্বোধনের পর একটানা সাতদিন নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এই সাতদিন নোরা’র চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাতজন শিক্ষার্থী শিল্পী। হেলেনা, মিসেস লিণ্ডে, অ্যানা মারিয়া, ডা. র‌্যাংক ও পোর্টার চরিত্রে ভিন্ন ভিন্ন জন অভিনয় করেছেন। হেলমার এবং ক্রোগস্ট্যাড এর ভূমিকায় একজন করে অভিনয় শিল্পী ছিলেন। অভিনয় শিল্পীদের প্রত্যেকের কাজেই দীর্ঘদিনের মনোযোগ ও শ্রমের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। ন্যাচারালিস্টিক অভিনয় নির্মাণে শিল্পীর মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি এবং অভিনয় চরিত্রের ভাবনা, ক্রিয়া বা সামগ্রিক পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ততা যে কত জরুরি, তা এই প্রযোজনা দেখলে সহজেই অনুধাবন করা যাবে।

৩.৪    
আরণ্যকের প্রাকৃতজন কথা

‘বহিরাগতদের বিরুদ্ধে আমাদের যে বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের এক গৌরবময় ইতিহাস আছে সেদিকে এবার দৃষ্টি ফেরানো দরকার। আত্মসম্মানজ্ঞান সম্পন্ন কোনো জাতি তার আত্মপরিচয় বিস্মৃত হয় না, হতে পারে না। ...’ এই ভাবনা থেকেই আরণ্যক মঞ্চে এনেছে নাটক ‘প্রাকৃতজন কথা’। নাটকটি রচনা করেছেন আব্দুল্লাহেল মাহমুদ এবং নির্দেশনা দিয়েছেন মামুনুর রশীদ।

হাজার বছর আগেকার ভারতবর্ষের এক জনপদের গৌতমবুদ্ধের অনুসারী সংঘবাসী ভিক্ষু এবং প্রাসাদবাসী সামন্ত স্বৈরশাসকদের দ্বন্দ্বের আবর্তে তথা কিছু প্রাকৃত নর-নারীর সুখ-দুঃখ ও সংগ্রামের কাহিনী বিবৃত হয়েছে ‘প্রাকৃতজন কথা’ নাট্যে। গৌতমবুদ্ধের অনুসারী সংঘবাসী ভিক্ষুকদের আশ্রমে ত্যাগে, প্রজ্ঞায়, সহিষ্ণুতায় ও দায়বদ্ধতায় প্রজ্জ্বল এক তরুণ ভিক্ষু সর্বানন্দ। প্রাকৃতজনদের ওপর সামন্তপ্রভুদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বানন্দ দ্রোহ প্রকাশ করেন। সতীর্থ ভিক্ষুকবৃন্দ এবং মহাস্থবিরের সিদ্ধান্তে তাকে আশ্রম ত্যাগ করতে হয়। সর্বানন্দের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় মানবিক শক্তির শঙ্খধ্বনি:  আমিও মানুষ- তাই অন্যায়কে অন্যায় বলতে চাই। নাটকের শেষ পর্বে সংঘবাসী ভিক্ষু প্রাকৃতজনদের বঞ্চনা, ক্ষোভ এবং দ্রোহের পক্ষে অবস্থান নিলে নাটকটি আর হাজার বছর আগের কাহিনীর চিত্রায়নই শুধু থাকে না, অবলীলায় তা হয়ে ওঠে কাল থেকে কালান্তরের যাবতীয় নিগ্রহ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ।

৩.৫    
প্রাচ্যনাট এবং সার্কাস সার্কাস

প্রাচ্যনাট। স্বাতন্ত্র্যসূচক এই নামটির কারণে শুরু থেকেই দলটির প্রতি আমাদের আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। সেই অনেকটা সময় ধরে আমাদের নাট্যাঙ্গনে নাটকের বিষয় ও আঙ্গিকে গতানুগতিক রীতি-পদ্ধতি বা প্রথাবদ্ধতা জেঁকে বসেছে। মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রমী দু‘একটি ভিন্ন উদ্যোগ আমাদের আগ্রহ আকাঙ্ক্ষাকে চাড়িয়ে দিলেও সামগ্রিকভাবে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে স্বকীয় চিন্তা-চেতনার প্রসার এখনো হয় নি। অনেক ক্ষেত্রে বাংলা নাটকের স্বতন্ত্র বিষয় ও আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যকে বাহুল্য বা অনাবশ্যক বিবেচনা করতে অনেকে দ্বিধা করেন না।

অঞ্চলভেদে বা সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন শিল্পাঙ্গিক হওয়াই স্বাভাবিক। নাট্যশিল্পের উদ্ভব ও বিকাশের বিভিন্ন গতিভঙ্গিতেও এই সত্য প্রমাণিত। প্রাচ্যের নাট্যকলার আঙ্গিকেও একটি বিশিষ্ট রূপ রয়েছে। নাটকের পাণ্ডুলিপি থেকে শুরু করে প্রয়োগের প্রতিটি পর্যায়ে সেই বিশিষ্টতা আছে। কিন্তু বাংলা নাট্যকলার উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাসে দুঃখজনকভাবে দূর ইউরোপীয় রূপ ও রীতির আবদ্ধতায় বাংলা নাটকের উপস্থাপনা আধুনিকমঞ্চে এখনো নিরীক্ষার পর্যায়ে আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানকার নাট্যাঙ্গনের একঘেঁয়ে মঞ্চ-উপকরণ, পদ্ধতি এবং অপরাপর প্রথাবদ্ধতার প্রতিকূলে অবস্থান নিয়ে প্রাচ্যনাট অবশ্যই নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রটি তৈরি করেছে। আমরা আশা করতে পারি, সেলিম আল দীনের দেয়া নাম (বি. দ্র. প্রকৃতপক্ষে সেলিম আল দীনের ‘প্রাচ্য থিয়েটার’ আর দলের প্রস্তাবিত ‘নাট মন্দির’ এর সমন্বয়ে চূড়ান্ত হয় ‘প্রাচ্যনাট’- সম্পাদক) নিয়েই কেবল নয়, ওই বিশিষ্ট নাট্যজনের গবেষণায় যে নিজস্ব বা দেশজ নাট্যরীতির কথা আমরা জানলাম, তার যথার্থ প্রয়োগ চর্চাতেও প্রাচ্যনাট এগিয়ে আসবে। তবেই সাংগঠিক নামটির স্বাতন্ত্র্যময় ব্যঞ্জনা কার্যকররূপে প্রমাণিত হবে।

প্রাচ্যনাট বেশ স্বল্প কার্যকালে চারটি প্রযোজনা দর্শকের সামনে এনেছে। ‘সার্কাস সার্কাস’ তাদের চতুর্থ প্রযোজনা। রচনা ও নির্দেশনা আজাদ আবুল কালাম। আটানব্বইয়ের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ‘সার্কাস সার্কাস’ মঞ্চে এসেছে।

প্রাচ্যনাট সংগঠনটির গোড়াপত্তন একটু অন্যরকম। দু’টি সাজানো বা জৌলুসের ঘর থেকে দু’দল তরুণ গড়ে তুলেছে প্রাচ্যনাট। দলছুট এই তরুণরা বেশ সহজেই একই নামের ব্র্যাকেটবন্দী আরো দু‘একটি দলের জন্ম দিতে পারতেন। নতুন দল গঠন করার জন্য মলিঁয়ের থেকেই হোক বা নিজেদের ‘বিশেষ প্রতিভা’ খাঁটিয়ে হোক, ‘হাসির নাটক’. ‘দম ফাটানো হাসির নাটক’ মঞ্চে এনে হৈ হুল্লোড়ও করতে পারতেন। তারা তা করেন নি।

‘সার্কাস সার্কাসে’র শুরুতে মঞ্চ জুড়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী, সার্কাসের খেলোয়াড়দের বিভিন্ন দেহ ভঙ্গিমার স্থির দৃশ্যরূপ- এরই মধ্যে সহসা কথা বলে ওঠেন সার্কাস দলের প্রধান সাধন দাস। এরপর একে একে উন্মোচিত হতে থাকে দু’টি ভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া অভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ঘটনা এবং দৃশ্যমালা। নাটকের অন্তিমে গিয়ে বোঝা যাবে যে, শেষ দৃশ্য দিয়েই নাটকের শুরুটা হয়েছিলো।

দু’টো স্বতন্ত্র ঘটনার প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘সার্কাস সার্কাস’ নাট্যাবয়াব। মুক্তিযুদ্ধকালে বরিশাালে এবং বিশ বৎসর পরে কক্সবাজারে ঘটে যায় প্রায় সমান ঘটনা। ১৯৭১ এ মৌলবাদীদের তা-ব থেকে রক্ষা পায় নি বরিশালের কিংবদন্তী সমান লক্ষণ দাসের সার্কাস। বিশ বছর পরও যেন সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে স্বাধীন বাংলার আর এক জনপদে। এখানেও (কক্সবাজার) সেই মৌলবাদীরা অসামাজিক কার্যকলাপের দোহাই দিয়ে রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দেয় সার্কাস প্যান্ডেল। নৃশংসতার এই দু’টি অধ্যায়কে আজাদ আবুল কালাম নিপুণভাবে মঞ্চে তুলে এনেছেন। বরিশাল, খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সরল কথনভঙ্গিমায় এক একটি চরিত্র প্রাণবন্ত নাট্যমুহূর্ত নির্মাণ করেছে।
      
প্রায় প্রত্যেক অভিনয়শিল্পীর একাধিক ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের চরিত্ররূপায়ণ এই প্রযোজনার বিশেষ একটি দিক। বিশেষ ভাষা-ভঙ্গি এবং অভিনয়ের বিভিন্ন ধরণ প্রত্যেকটি চরিত্রকে স্পষ্ট ব্যঞ্জনা দিয়েছে। প্রযোজনাটির প্রায়োগিক অন্যান্য দিক (মঞ্চ, আলো, পোশাক ও সঙ্গীত) নিয়ে সবিস্তারে আলোকপাত বর্তমান পরিসরে সুযোগ নেই। তবে নির্দ্বিধায় এ কথা বলা যায় যে, বর্তমানকার আপাত স্থবির নাট্যাঙ্গনে প্রাচ্যনাটের এ নাট্য অভিযাত্রা আমাদেরকে আশান্বিত করে।

সামগ্রিকভাবে আটানব্বইয়ের নাট্যাঙ্গনকে হয় তো অনেকে নৈরাশ্যের চোখে দেখে থাকবেন। সে দেখাতে সত্যও আছে। কিন্তু আরো সত্য এই যে, গভীর প্রাণবন্ত মগ্নতায় নির্মিত বনপাংশুল, ক্রুসিবল, এ ডলস হাউস, প্রাকৃতজন কথা, সার্কাস সার্কাস বা এরকম আরো দু’একটি প্রযোজনা যাবতীয় স্থবিরতায় আক্রান্ত নাট্যকার্যক্রমের বিপরীতে অনেক বেশি শক্তিমান হয়ে প্রতিভাত হয়- আমাদেরকে আশার আলো দেখায়।

কামালউদ্দিন কবির : নির্দেশক, নাট্যকার। সাংবাদিক-ভোরের কাগজ