Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

রজতজয়ন্তী পেরিয়ে বাংলাদেশের নাটক

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

[প্রবন্ধটির রচনাকাল এর শিরোনাম দেখলেই বোঝা যায়, অনেক আগের। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার চর্চার রজতজয়ন্তী পার হবার পর নিজের তাগিদেই হোক আর কোনো না কোনো সম্পাদকের অনুরোধেই হোক, শ্রদ্ধেয় শান্তনু কায়সারকে এই প্রবন্ধটি লিখতে হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে লেখাটি কোথাও ছাপা হয় নি এদ্দিন। কয়েকদিন আগেই বন্ধুবর নাট্যজন ফয়েজ জহিরের কল্যাণে প্রবন্ধটি আমার হাতে আসে। বুঝতে সক্ষম হই, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ২৫-২৭ বছরের থিয়েটারচর্চার একটি অপূর্ব পর্যবেক্ষণ লেখাটি ধারণ করে আছে। অগ্রজ প্রজন্মের তো বটেই, বর্তমান প্রজন্মের নাট্যজনদের ভেতরেও এই লেখাটি পড়ে বাংলাদেশের থিয়েটার সম্পর্কে এক-ধরনের মূল্যায়ন তৈরি হবে, এই আশা থেকেই লেখাটি থিয়েটারওয়ালার বর্তমান সংখ্যায় ছাপা হলো।- সম্পাদক]

বাংলাদেশের জন্মের বহু পূর্ব থেকেই অবিভক্ত বঙ্গ ও ভারতবর্ষের অংশ ও উত্তরাধিকার হিসেবে পূর্ব বাংলায় নাটক ও নাট্য আঙ্গিকের প্রচলন ও চর্চা ছিল। যাত্রাভিনয়, কবির লড়াই, কথকতা, রামায়ণ গান ইত্যাদি নানা আঙ্গিক ও মাধ্যমে তা জনজীবন ও চিত্তে নান্দনিক আনন্দদানের সঙ্গে তাকে গভীরতায়ও বদ্ধ করেছিল। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘মোমেনশাহী গীতিকা’র অন্তর্ভুক্ত মাধব মালঞ্চী কইন্যা কলকাতার ‘অন্য থিয়েটার’ কর্তৃক বাংলাদেশের রাজধানীসহ কটি প্রধান নগরীতে অভিনীত হওয়ার দীর্ঘকাল আগে থেকেই মাধব-মালঞ্চী পালাটি যে ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে অত্যন্ত পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিল তা থেকে এর প্রমাণ মেলে।১ এ থেকে এ-ও বোঝা যায়, আমাদের বাস্তবতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে নাট্যসাহিত্য সর্বত্র ও সবসময় লিখিত পাণ্ডুলিপি-নির্ভর ছিল না। অধিকন্তু নাটক নিজেই যেহেতু একটি যৌথ ও সমবায়ী এবং মঞ্চ-নির্ভর শিল্প, সেহেতু নাট্য সাহিত্যের চৌহদ্দি ও চারিত্র্য সাহিত্যের অন্যান্য আঙ্গিকের চেয়ে ভিন্ন ও আলাদা।

এ-ধরনের নাট্যে প্রকৃতির বন্ধনহীনতার মধ্যে লোককবিদের কল্পনার বিশালতার যে পরিচয় পাওয়া যায় তার মূল কারণ এঁদের চিত্তের স্বাধীনতা। পরাধীন ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ যে ডাকঘর, রথের রশি কিংবা রক্তকরবী লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন তার মূল কারণ ঔপনিবেশিক পরাধীনতার সঙ্গে তিনি স্বাধীন চিত্তের গভীর দ্বন্দ্ব অনুভব করেছিলেন। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিলের ফাঁস গলায় পরে পেশাদার থিয়েটার যখন জমিদারদের কাছ থেকে ব্যবসাদারদের হাতে গিয়ে পড়লো তখনকার ঐ পরাধীন পরিবেশ কীভাবে নাট্য সাহিত্যের গতিকে রুদ্ধ করেছিল তা সমকালীন একজন নাট্যকারের জবানবন্দী থেকে বোঝা যেতে পারে: “নাটক বা কাব্য লিখিতে যে কয়েকটি বৃত্তির আবশ্যক হয় তন্মধ্যে স্বাধীনতা বৃত্তিই সর্বপ্রধান; তাহাই (যখন) ভারতে নাই তখন কোনোক্রমেই ‘সর্বাঙ্গ সুন্দর’ নাটকের প্রত্যাশা করা যাইতে পারে না। ... যখন কোন একটি বিষয়ে কল্পনাময়ী মূর্তি মনোমধ্যে অঙ্কিত করিয়া বর্ণনা করিতে লেখনীকে হস্তে ধারণ করা যায় তখনই পরাধীনতার ভীষণ মূর্তি আসিয়া লেখনীকে বলপূর্বক নিরস্ত করে- সুতরাং হৃদয় হইতে সকল ভাব তিরোহিত হইয়া হ-য-ব-র-ল হইয়া পড়ে।”২

পাকিস্তান পর্বে ঐ চাপ এতোটাই প্রবল ছিল যে ‘ড্রামা সার্কেল’-এর মতো পরিশীলিত নাট্যদল বা মুনীর চৌধুরীর মতো নাট্যব্যক্তিত্ব থাকা সত্বেও নাট্যান্দোলন দূরে থাক, প্রকৃত অর্থে নাট্যচর্চাও সম্ভব হয় নি। তৃণমূলের নাট্য লক্ষণসমূহ অর্থনৈতিক বাস্তবতায় হয় ম্রিয়মান হয়ে এসেছিল অথবা ক্ষীণ মাটির প্রদীপের মতো নিজের যা সাধ্য তা করে যাচ্ছিল। তারচেয়েও ক্ষতিকর যা, নাগরিক নাট্যচর্চার সাথে তার কোনো সৎ বা অর্থবহ যোগাযোগ ঘটছিল না। যাত্রাপালাও রস ও রসদের অভাবে বিচ্ছিন্ন বিনোদন পণ্যে পরিণত হয়েছিল। সৈয়দ শামসুল হক যথার্থই বলেছেন, ‘যে সমাজ মুক্ত নয় তার নাটক বিকশিত হতে পারে না’। ‘এ বড় কান্তিহীন পরিস্থিতি, এ বড় বাস্তব নির্মিতি’।৩

ফলে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এ রক্তাক্ত যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে তাই এতদিন পর্যন্ত প্রায় অবরুদ্ধ একটি শিল্পমাধ্যমের বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে। ‘মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তরুণ লেখক বা শিল্পকর্মের মনোযোগ যে মাধ্যমটির প্রতি সামগ্রিকভাবে আকৃষ্ট হয় সেটি হচ্ছে নাটক। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে মানুষের, সীমাবদ্ধ মানুষের সঙ্গে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর যে পরিচয় ঘটেছিলো তাকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে রূপায়ণ ও ব্যাখ্যা করবার একটি প্রধান সাংস্কৃতিক অস্ত্র ছিলো নাটক। এটি হয়ে ওঠে সমষ্টিগত যোগাযোগের শিল্পমাধ্যম। যে আকাক্সক্ষাসমূহ এতদিন সুপ্ত ছিল সেসব তখন বিকশিত হওয়ার ইচ্ছায় জনচিত্তে প্রবল অভিঘাতের সৃষ্টি করে। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থা তার লালন ও বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। সমাজে সৃষ্ট এই দ্বন্দ্বকে নাটক ছাড়া অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমে বিশ্বস্ততা ও সততার সঙ্গে চিত্রিত করা সম্ভব ছিল না বলেই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তা এতটা জীবন্ত ও শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে’।৪  


দুই
বাংলাদেশ-উত্তর নাট্য সাহিত্যের সাতাশ বছরের খতিয়ান সাধনের আগে এর আরম্ভের শুরুর প্রতি আমাদের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। বিভাগ-পূর্ব কাল বা তার কিঞ্চিৎ পর থেকে যারা নাটক রচনা করেছেন সেই নূরুল মোমেন ও আসকার ইবনে শাইখের পরিবর্তে একাত্তরে যারা যথাক্রমে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন ও আল বদরের হাতে শহীদ হন সেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও মুনীর চৌধুরী কীভাবে বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের পথিকৃৎ হয়ে উঠেছেন সেটা বিবেচনা করলে ঐ শুরুর আরম্ভের স্বরূপ বোঝা সম্ভব। পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিতে লেখা নূরুল মোমেনের নেমেসিস-এ নাট্য আঙ্গিক যতটা প্রাধান্য পেয়েছে বিষয় তথা এর প্রকৃত দ্বন্দ্ব ততটা বিবেচিত ও বিকশিত হয় নি। আর আসকার ইবনে শাইখ ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহকে পটভূমি করে রক্তপদ্ম লিখলেও বাদশাহ বাহাদুর শাহর জন্যে যতটা আর্তি প্রকাশিত হয়, ঐ বিদ্রোহের গণ-চারিত্র্য ততোটাই অননুন্মোচিত থাকে। ফলে তাঁর তিতুমীর থেকে লালন ফকির বিশেষ ঝোঁককে প্রমাণ করলেও নাট্যদ্বন্দ্ব তার উপর্যুক্ত ক্ষেত্র খুঁজে পায় নি।

অন্যদিকে জেলের অবরুদ্ধ পরিবেশে কবর রচনা করে মুনীর চৌধুরী বাংলাদেশের নাটকের ক্ষেত্রে মাইলফলক প্রোথিত করেন। ভিন্ন প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক যাকে ডযবহ ষরসরঃধঃরড়হ রং ধ ভৎববফড়স৫ বলেছেন এ যেন ঠিক তাই। কারণ ‘রাত দশটার পরে জেলের বাতি নিভিয়ে দেয়ার পর লণ্ঠনের আলোতে তা মঞ্চস্থ’ করার এবং ‘নাটকটিতে মেয়ে চরিত্র এমনভাবে থাকে যেন পুরুষদের দ্বারা অভিনয় করা চলে’র শর্ত মেনেই তিনি তা রচনা করেছিলেন।৬ শর্তসমূহ তাঁকে বন্দী করে নি, বরং প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নতুন প্রক্রিয়া উদ্ভাবনে সহায়তা করেছে। ম্যানিলায় বন্দুকের নিচে থেকে নাট্যাভিনয় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বা ষাটের দশকে নাইজেরিয়ার কারাগারে অথবা ক্যূয়ের পর চিলির কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নাট্যাভিনয়ের৭ সঙ্গে এর তুলনা করেও বলা যায়, আমাদের বাস্তবতায় তার অতিরিক্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। স্বয়ং নাট্যকার বলেছেন, ‘কবর নাটকটিতে শুধুমাত্র একুশের তাৎপর্য খোঁজা হলে খানিকটা ভুলই বরং করা হবে, হয়তো আরো বেশী কিছু বলার চেষ্টা করেছি আমি। আরো বেশী কিছু’।৮ ১৯৬৬ তে কবর-র সঙ্গে মানুষ ও নষ্ট ছেলে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে এ ত্রয়ীনাট্য সামগ্রিক যে বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে তা থেকে বোঝা যায় ‘আরো বেশী কিছু’ বলতে নাট্যকার আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন। নষ্ট ছেলে-র পটভূমি ১৯৪৮ ও তার পরবর্তীকাল। এর কাহিনী গড়ে উঠেছে একজন আত্মগোপনকারিণী রাজনৈতিক কর্মীকে ঘিরে। গ্রন্থটি যাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে নাট্যকারের সেই সহোদরা নাদেরা বেগমও ছিলেন তাই। কিন্তু ব্যক্তিগত এই সম্পর্কের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে সামগ্রিক নাট্যবাস্তবতা যখন ১৯৫০-এর সাম্প্রদয়িক দাঙ্গার পটভূমিতে লেখা মানুষ-এ অধ্যাপক এমরান বলেন, ‘শুধু অর্থ আত্মসাৎ করলেই চুরি হয় না, শ্রম আত্মসাৎ করলেও চুরি হয়’। আমাদের বাস্তবতায় নাট্যকার ইতিহাস, ধারাবাহিকতা ও অগ্রযাত্রার সৃজনশীলতাকেই শনাক্ত করেন যখন তাঁর ঐ চরিত্র এ-ও বলে, ‘আমিনকে ছেলে মানুষ বোলো না। ওর বয়স কত জান? আমার বায়ান্ন বৎসর, এটা ওর, তোমার আটাশ, সেটাও ওর, নতুন পৃথিবীর কয়েক হাজার বছরের অতীত তাও ওর, সেই সঙ্গে ওর নিজের বার বছর। সব যোগ করে তবে ওর বয়স।’ সেইসঙ্গে আমরা যদি স্মরণ করি যে নাট্যকার উল্লেখ করেছেন, রচনার সময় এতোটা সচেতন না থাকলেও পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ৪৩-৪৪ সালে আমেরিকার বেশ কিছু বামপন্থী সৈনিকের সঙ্গে কুর্মিটোলায় তাঁর যে আলাপ হয়েছিল এবং তাঁদের মধ্যে ড. নরমান ¯িপ্রংগার যে তাঁকে আরউইন শ’র বেরি দ্যা ডেড নাটক পড়তে দিয়েছিলেন৯ তার প্রভাবও অবচেতনভাবে কবর-এ পড়েছে। তা থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না, বিদ্যমান বাস্তবতাকে তিনি (মুনীর চৌধুরী) একটি বৈশ্বিক পটভূমিতেও দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কিন্তু তা সত্বেও পাকিস্তানোত্তর বিদ্যমান বাস্তবতাই ছিল এ নাটকের ভিত্তিভূমি। নাটকের প্রথম দিকে ইন্সপেক্টর হাফিজ যে ইঙ্গিত করে পাকিস্তান হয়ে ‘সকলে’র নানা সুযোগ হলেও তার বা তাদের কিছু হয় নি (‘পরে’ অবশ্য তাদেরও ‘হয়’) তা ছিল অত্যন্ত রূঢ় বাস্তবতা। সুযোগ সন্ধানের ঐ মাৎসন্যায়ে ‘প্রজা’ সাধারণের সামগ্রিক অবক্ষয়ের মধ্যে মুসলিম লীগের নেতা থেকে পাতি কর্মীদের অনেককেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠতে দেখা যায়, জমিদারী উচ্ছেদের পর রাষ্ট্রই জমিদারে পরিণত হয়। আর এর ফলে ১৯৪৮-৪৯ এবং একান্নয় পূর্ব বাংলায় দুটি দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মূলত মুসলিম লীগের আশ্রয়পুষ্ট ফটকাবাজ ও মজুতদারদের কারণে সৃষ্ট ঐ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর একটি অংশ আসাম চলে যেতে বাধ্য হলে মুসলিম লীগ সমর্থক দৈনিক ‘আজাদ’ পর্যন্ত ‘আসমে হিজরত’ শীর্ষক সম্পাদকীয় না লিখে পারে না। আবার ১৯৪৮-এর ১০ জুলাই ‘আজাদ’ তার সম্পাদকীয়তে বলে, ‘ইহা একটি দুর্বোধ্য রহস্য যে পাকিস্তানের এক অংশে যখন প্রচুর খাদ্য রহিয়াছে এবং শুধু তাই নয় সেই খাদ্য হইতে কিছু পরিমানে বিদেশে রপ্তানী করা সম্ভবও হইতেছে পাকিস্তানের অন্য অংশে তখন দারুণ খাদ্যাভাব দেখা দিয়া দুর্ভিক্ষ ঘনাইয়া আসিতেছে।’১০ অতএব কোনো শৈল্পিক প্রেরণা থেকে নাট্যকার তাঁর সৃষ্ট চরিত্র মুর্দা ফকিরকে দিয়ে লাশের মুখে ভাত গুঁজে দিতে চান তা বোঝা যায়। কবর’র ঐ চরিত্র যে মনে করে ‘মানুষ শুধু এক রকমেই মরতে পারে, খেতে না পেয়ে’ তা ছিল ঐ বাস্তবতারই রূঢ় কিন্তু শিল্পিত প্রকাশ।

অন্যদিকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর নাটক লেখার বেশ আগে পঞ্চশের (১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ) মন্বন্তরের পটভূমিতে ‘নয়নচারা’র যে গল্পগুলো লেখেন তাতে ভাতের প্রসঙ্গটি খুব তীব্রভাবে এসেছে। ‘মৃত্যুযাত্রা’র দুটি বর্ণনা ঐ তীব্রতাকে প্রকাশ করে:

ক.    হাত ভরে মুঠো মুঠো যখন কোপানো মাটি তুলে ফেলছে তখন করিম একবার আড়চোখে তাকালো তিনুর পানে। হাতভরা মাটি হাতভরা ভাতের মতো মাটি, অথচ ভাত নয়।

খ.    যে গাঁয়ে তিনুরা গেছে সে গাঁয়ে কি এমন দুয়েকটা ঘর নেই যাদের কাছে একান্তভাবে চাইলে চারটে ভাত মিলবে?

আর গ্রন্থনামের ‘নয়নচারা’র আমুর মনোবিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক যখন বলেন ‘শক্তিশালীর সে ক্ষমা চায়। যেহেতু শক্তিশালীর অন্যায়ও ন্যায়, সে ন্যায়ের প্রতি অন্যায় করা গুরুতর পাপ। সে পাপ করেছে এবং তাই ক্ষমা চায়, দুটি ভাত দিয়ে শক্তিশালী তাকে ক্ষমা করুক’ তখন বোঝা যায়, আলাদা আলাদা সময়ে দুই ভিন্ন মাধ্যমে রচিত হলেও উভয় লেখক তথা নাট্যকারের অন্বিষ্ট এক। মুনীর চৌধুরীর উৎস পাকিস্তানোত্তর দুর্ভিক্ষ, আর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পটভূমি পঞ্চাশের মন্বন্তর। এ-ও স্মর্তব্য, পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় অবিভক্ত বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন এবং ক্ষমতাসীন দল ছিল মুসলিম লীগ। ঐ মুসলিম লীগের উত্তরাধিকার বিভাগোত্তরকালে পূর্ব বাংলায় খুব স্বাভাবিকভাবেই বর্র্তেছিল। পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় কলকাতায় জিন্নাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এ.এইচ. ইস্পাহানী চাল সংগ্রহের এজেন্ট হিসেবে যে ন্যাক্কারজনক স্বৈরাচারী ভূমিকা পালন করেন তা দুর্ভিক্ষে মানুষের কষ্ট ও অসহায়ত্বকে তীব্রতর করে। তিনি এবং তাঁর অগ্রজ মির্জা আহমদ ইস্পাহানী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে এ. কে. ফজলুল হকের নির্বাচনী ইশতেহারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিল ও সর্বজনীন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার দাবীর প্রবল বিরোধিতা করেন। ফলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যখন তাঁর নাটক তরঙ্গভঙ্গ-এ ভিখারিণীর জবানীতে জানান কেন আমিনা তার স্বামী ও সন্তানকে হত্যা করেছে, তখন তা এই পটভূমিতেই বিচার্য ‘রোগে মরণাপন্ন, তবু পেটে এক ফোটা ওষুধ নেই। কেবল তাবিজটা লকলক করে শীর্ণ বাহু থেকে। একদিন স্বামীর কষ্ট আর সহ্য হয় না। তাই ধুতরা পাতার রস বানিয়ে তার কষ্টের শেষ করে।’ ‘অতি দরিদ্র মেয়ে, স্বামী বেঁচে নেই, কোনো রোজগারের পথ নেই, অথচ ঘাড়ে চার-চারটে সন্তান। একদিন সহ্য করতে না পেরে কোলের শিশুটাকে গলা টিপে মেরে ফেলে।’

কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও স্মর্তব্য যে ভিখারিণী বলে, ‘আমি ঝোপ-ঝাড়ের সাপ নই, পানি ঢোঁড়া সাপ নই। আমার বিষ-থলি কখনো শূন্য হয় না, ক্রোধও নিঃশেষ হয় না। এই বিষ দিয়ে, এই ক্রোধ দিয়ে আমি তাকে রক্ষা করবো।’ তুলনীয় কবর’র মুর্দা ফকিরের সংলাপ: ‘বাসি মরার গন্ধ আমি চিনি না? এ লাশের গন্ধ অন্যরকম। ওষুধের, গ্যাসের, বারুদের গন্ধ। এ মুর্দা কবরে থাকবে না। বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ হাত যত নীচেই মাটিচাপা দাও না কেন- এ মুর্দা থাকবে না। কবর ভেঙ্গে বেরিয়ে চলে আসবে।’ তরঙ্গভঙ্গ-এ ভিখারিণী যেখানে ‘বিষ’ দিয়ে, কবর-এ সেখানে মুর্দা ফকির শহীদের মধ্য দিয়ে তৃণমূল তথা সাধারণ মানুষের উত্থান কামনা করেছে। কিন্তু বিষয়টি যে খুবই গভীর সেটা বোঝা যায় যখন দেখি বহিপীর’র পীর ‘বহি’র ভাষায় কথা বলে তার বিভিন্ন এলাকার মুরিদদের সঙ্গে যোগাযোগের সর্বজনীন ভাষা উদ্ভাবন করলেও প্রকৃতপক্ষে গণবিচ্ছিন্নতাকে লালন করে এবং সেকারণে হাতেম আলীর পুত্র হাসেমের সঙ্গে নিজের স্ত্রী তাহেরা পালিয়ে গেলেও তাতে বিচলিত না হয়ে বরং হাতেম আলীর জমিদারী ‘রক্ষা’ অথবা নিজেদের ‘থাকিবা’র বন্দোবস্ত বিষয়ে মনোযোগ দেয়। ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের কালু মিঞা যেমন মসজিদে মিথ্যা কথা বলে পার পেয়ে যায় (‘যাকে আমরা প্রায় ধরে ফেলেছিলাম সে হাত ফস্কে গিয়ে একটি দুর্গের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। দুর্গটি সাধারণ দুর্গও নয়, আকায়িদ ঈমানে তৈরি দুর্গ’) তেমনি পাকিস্তানোত্তর বাস্তবতায় শাসকশ্রেণীর মধ্যে তা ছিল এক সাধারণ সত্য। সে-কারণে সমাজে সৃষ্ট দ্বন্দ্বকে লালন করার সবচেয়ে সক্ষম যে সাহিত্য আঙ্গিক সেই নাট্যে, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ থেকে তরঙ্গভঙ্গ-এ ‘আকায়িদ-ঈমান’ ‘মাজহাব-তারিখ আখলিয়াতে’ পরিবর্তিত হয়। সে কারণে এ নাটকের জজ বলেন, ‘পোষাক-পরিচ্ছদ, চেহারা-অবয়ব আসল সত্য নয়।’ নাটকে অন্যত্র তা আরো স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশিত ‘শয়তান যে-কোনো মানুষে রূপান্তরিত হতে পারে। এমনকি সাদা ধবধবে লেবাসপড়া মৌলভী মানুষের আকারও সে ধারণ করতে পারে।’ এ নাটকের বারিশ পীর তাই খুবই ‘বিবেচক’, কারণ তাতেই রয়েছে স্বার্থের রক্ষাকবচ ‘দুই দিক (খোদার খেয়াল ও দুনিয়াদারি) ভালো থাকলে আদমীর কিসমত হয়, পীরেরও ভালাই হয়।’

কবর নাটকে শহীদ ‘মূর্তি-২’ যে বলে ‘গুলি দিয়ে গেঁথে দিয়েছেন। ইচ্ছে করলেও আলগা হতে পারবো না’ তা স্বয়ং নাট্যকার সম্পর্কেই প্রযোজ্য। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে ঘৃণ্যতম দালালদের হাতে যে মুনীর চৌধুরী শহীদ হন তা তাঁকে শুধু এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তার ইতিহাসের সঙ্গেই গেঁথে দেয় নি, জীবনের দ্বন্দ্বে তিনি বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যেরও অন্যতম পথিকৃতে পরিণত হয়েছেন। প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হওয়ায় পাকিস্তানী স্বৈরশাসনের কুৎসিত মনোভঙ্গীর কারণে চাকুরিচ্যুত হয়ে অক্টোবরে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যে প্যারিসে প্রয়াত হন তা তাঁর অন্যান্য সাহিত্যকর্মের সঙ্গে নাট্যরচনারও ঐতিহাসিক পরিণতি।

তিন
মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ঐরকম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও মুনীর  চৌধুরী প্রমাণ করেছেন নাটকে তাঁরা যে দ্বন্দ্বকে লালন করেছিলেন তা আসলে ছিল জীবনেরই দ্বন্দ্ব। পটভূমি ও চারিত্র্যের ঐ শৈল্পিক বিশ্বস্ততাই তাঁদেরকে কালোত্তীর্ণ নাট্যকার ও আমাদের নাট্যের পথিকৃতে পরিণত করেছে। তাঁর নাট্যে স্মিত হাস্যের একটি ধারা নিয়ত প্রবহমান থাকলেও দ্বন্দ্ব আবিস্কার ও রূপায়ণে মুনীর চৌধুরী খুবই যতœবান ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর নাট্য রচনায় কখনো মোহের কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি। বহিপীর-এ পীরের স্ত্রী ও হাসেমের মধ্যের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে যে মেলোড্রামার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অত্যন্ত সহজে তাকে পরিহার করেছেন। তিনি জানতেন এটি প্রকৃত নয়, নকল দ্বন্দ্ব। ঐ দ্বন্দ্বের ওপর নির্ভর করলে নাট্যের বাস্তবতাই যে শুধু লঙ্ঘন করা হবে তাই নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে শৈল্পিক ঔচিত্যকেও হত্যা করা হবে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর কাল থেকে এই সাতাশ বছরে বাংলাদেশের নাটকের যে সদর্থক ধারা রচিত হয়েছে অথবা হয়ে চলেছে তাতে এই মাত্রাগুন অনুসরণের চেষ্টা অন্তত রয়েছে। কারণ তা ছাড়া এর অগ্রগতি ও বিকাশ সম্ভব ছিল না।

কবর-এ ‘কম্যুনিজম’-এর প্রসঙ্গ তুলে যে ধারাটিকে তখনকার দূষিত নেতৃত্ব বারবার অস্বীকার করতে চেয়েছে তা তৃণমূলের উত্থানকেই নির্দেশ করে। বহিপীর’র নেতি কিংবা তরঙ্গভঙ্গ’র ইতির মধ্য দিয়ে ঐ অন্বিষ্ট প্রকাশিত। মুক্তিযুদ্ধোত্তর নাট্যধারায়ও এর বিকাশ ঘটেছে, কিংবা অন্তত তার প্রয়াস চলেছে। সাধারণভাবে সৈয়দ শামসুল হক, মামুনুর রশীদ বা সেলিম আল দীনের নাট্যকুশীলব বা কেন্দ্রীয় চরিত্রদের দিকে তাকালে এর প্রমাণ পাই। সৈয়দ শামসুল হকের নূরলদীনের সারাজীবন দু'শো বছর পূর্বের পটভূমিতে লেখা হলেও এর ষষ্ঠ দৃশ্যের শুরুতে তৎকালীন সময়ের পটভূমিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘গেরিলা’ যুদ্ধের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। সেই সঙ্গে এটাও বোঝা যায় তরঙ্গভঙ্গ’র ভিখারিণীর ‘বিষ’ আসলে কী বা কবর’র লাশেরা কী অর্থে সেখানে না থেকে উঠে আসবে:

[ঢাকের শিঙার মিলিত ধ্বনি। নূরলদীনের নেতৃত্বে লাল কোরাস এসে জড়ো হয়। তাদের ঘাড়ে লাঠি ও পলো। সঙ্গে আছে আব্বাস ও দেওয়ান দয়াশীল।]

নূরলদীন    এ- হে, বা- হে।
    আর বাদ্য নহে- এ।
    এইবার জোট নয়, ছোট ছোট দল।
    ছোট ছোট দল ছোট ছোট দল,
    ছোট ছোট দল ছোট ছোট দল।
নূরলদীন    তবে আশেপাশে তবে আশেপাশে।
লাল কোরাস    তবে আশেপাশে তবে আশেপাশে।
দয়াশীল    ছোট ছোট দল ছোট ছোট দল
    তবে আশেপাশে।
    যার যার লাঠি পলো কান্ধে করি, ছোট ছোট দল।
    কাঁইও না সন্দেহ করে, সব আশেপাশে।
    য্যান মাছ ধরিবার যান,
    হয়, হয়, নদীতে নিশীথে মাছ মারিবার যান।
নূরলদীন    হয়, হয়,
    মাছ ধরিতে যান।
    ভাল করিয়া শোনেন কথা কইছে কি দেওয়ান।
    তোমরা- মাছ মারিতে যান।
    তবে শোনেন, কাঁইও আসি তোমার শরীলে হে,
    আঘাত করিলে হে-
দয়াশীল    ভাইও, আঘাত করিলে হে-
নূরলদীন    ফেলান পলো তেলেসমাতি,
    তোলেন লাঠি তেলেসমাতি,
দায়শীল    তেলেসমাতি, তেলেসমাতি-
নূরলদীন    চড়াও হয়া যান।
দয়াশীল    তার আগোতে তোমরা বাহে এই করিবেন ভান-
নূরলদীন    মাছ মারিতে যান, নিশীথে মাছ ধরিতে যান।

এই নূরলদীন একেবারে তৃণমূল থেকে উঠে এসেছে, যার পিতা লাঙলের জোয়াল বাইতে বাইতে ‘গরুর হাম্বা’য় নিজের কন্ঠস্বর বদলে ফেলে অবশেষে মৃত্যুমুখে পতিত হয়:

    তখন নূরলদীন দেখিবার পায়,
    বাপ নয়, বলদ গড়ায়,
    পাও খিঁচি একবার স্থির হয়া যায়,
    স্থির দৃষ্টি দূর নিলক্ষায়,
    শকুন ঝাপটি ওঠে দূরন্ত পাখায়,
    বড় স্থির বলদ পড়িয়া আছে, মানুষ নোয়ায়।

স্ত্রী আম্বিয়ার কাছে সমস্ত বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরে নূরলদীন বলে:

    আগুন, আগুন।
    আগুন শাড়িতে নয়, প্যাটোতে, প্যাটোতে।
    আগুন, আগুন জ্বলে, এই ঠাঁই, হামার প্যাটোতে,
    কিষাণের সন্তানের প্যাটের ভিতরে।
    আর ঐ আগুন পাটের শাড়ি বোনে যাঁই,
    উদাম, উদাম তাঁই,
    এক সুতা বস্ত্র নাই কঙ্কাল গতরে।
    আগুনপাটের শাড়ি কেড়ে নেয় কোম্পানী কুঠিতে,
    আগুনপাটের শাড়ি জ্বলি ওঠে তাঁতীর প্যাটোতে।
    আগুনপাটের শাড়ি দাউ দাউ করি জ্বলে সারা বাংলাদেশে।

কাব্যনাট্যের শরীরে এখানে যেমন তেমনি সাজেদুল আউয়ালের ফণিমনসা'তেও দেখা যায়
প্রান্তিক মানুষের দুঃসহ বাস্তবতা। মালো সম্প্রদায়ের অনিবার্য ধ্বংসের মধ্যে দাঁড়িয়ে পরভু যখন ‘তুই পুটি কোন ভুল কোটাঘরে গেলি/ কুলের কলঙ্ক হয়া বেবুশ্যে হইলি’- জিজ্ঞেস করে, তখন সে যা বলে তাতে তৃণমূলের মানুষের সমষ্টিগত বাস্তবতাই ভাষা পায়:

    সবার তো ছিল সব কিছু।
    পিতলের কলস, বাসন
    কাঁসার ঘন্টা, নাকের বেঁসর
    রূপার হাঁসুলী, বেচনের বস্তু।
    আমার কী ছিলো?
    বুড়া বাপ,
    তাও ছানি পড়া চোখ,
    আমার কি ছিলো গঞ্জে বেচনের মতো আর?
    কতো ভাতের মার,
    কতো কচু-ঘেচু, শাপলার লতা
    আহার হইছে দুই বেলার
    দিনে দিনে নদীর মতোন
    আমার শুকাইছে-নাড়ী।

‘ভাতের মার’ সবার বাড়, এবং তা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মুনীর চৌধুরী হয়ে সাজেদুল আউয়াল পর্যন্ত বর্তমান। একারণে অধিকতর তরুণ আবদুল্লাহেল মাহমুদও জানেন না কি করে তাঁর নানকার পালা শেষ করবেন। নাটকটির অন্তিমাংশ:

কাশেম    নানকার পালার কিসসা হেইদিন শেষ করবার পারি নাই, গেন্দু মিয়ার পুলিশ সবাইরে বাইন্ধা নিছিলো। অনেকদিন হাজতে বেগার খাইটা ছাড়া পাইছি। মইজুদ্দিন, নূরু, হাসেম, কমলা, কেডা কুনহানে আছে জানি না। কিন্তুক নানকার পালার কিসসা আইজ রাইতে শেষ কইরা যাইবনি। ক্যামনে শেষ করবাম এই পালা, তাতো জানি না।

    নানকার যুদ্ধ আইজোরে ভাই হয় নাই শ্যাষ
    কোটি কোটি নানকারে ভইরা গেছে দ্যাশ।
    এই পর্যন্ত করি খ্যান্ত সালামও জানাই
    ভুল দোষ হয় যদি ক্ষমা করবেন ভাই।

তৃণমূলের মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা: সার্বিক বিস্তার ও বিকাশের সঙ্গে নিজেরও বিকাশ, কিন্তু অসংখ্য মানুষের সামান্য ঐ আকাক্সক্ষার গলা টিপে ধরার মধ্যেই রয়েছে স্বল্পসংখ্যক নিয়ন্ত্রকের অস্বাভাবিক স্ফীতি ও বাড়-বাড়ন্ত। সেজন্যে সাতাশ বছরের বাংলাদেশের নাট্যচর্চা দ্বন্দ্বের ঐ ঘুর্ণায়মান বাস্তবতা থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাবনা ছিনতাই হয়ে যায়, পূর্বতন কাঠামোর বাইরের চেহারা ও ঢং-ঢাং খানিকটা বদলালেও ভেতরের কলকব্জা এবং তার দর্শন প্রায় অপরিবর্তিতই থেকে যায়। ফলে ফণিমনসা’র প্রবীণ মালো ছিদাম যে স্বপ্ন দেখে তা অধরাই থাকে:

    সবুজ ধানের চারা
    নাচ করবো হেমন্তের মিয়ানো
    সোনা রং রদ্দুরে
    দুধকমল, চন্দ্রমণি, চিনিস্বাক্ষর নামের
    ধানের মাড়াই হইবো
    আমাদিগের উঠানে,
    ডবকা মাইয়ালোকের নাখান
    ভরা থাকবো-ধানের গোলা।
    ঢেকির ওঙ্কারে
    আমাদিগের গেরস্থ অঙ্গনারা হইবো
    কামোত্তেজা
    পার্বণে উৎসব হইবো
    নাচ হইবো, গান হইবো
    সব হইবো-
    কিন্তুক,
    আইলের চিহ্ন দিয়া-
    অধিকারের কোন সীমানা আঁকুমনা
    এই লক্ষীচরে।
    এই চর হইবো
    জাল্লাপাড়ার একশো আটচল্লিশ ঘরের-
    সব্বাইর বাণিজ্যবস্তু
    সব্বাইর বেসাতির বিত্ত।

কিন্তু দ্বন্দ্বকে লালন করেন বলে নাট্যকাররা নানাভাবে বিষয়টির অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা করেন। সেলিম আল দীনের ট্টিলজির কেন্দ্রীয় এবং অসংখ্য চরিত্রের প্রায় সবাই তৃণমূলের মানুষ। কিত্তনখোলা-র মেলায় বহু মানুষ এসেছে, যাত্রার দল, লাউয়া সম্প্রদায়, বায়োস্কোপওয়ালা প্রমুখ, এসেছে সোনাই, যার পিতামহ তাঁত বুনতো, বাবা জমি চাষ করতো, আর সে নিজে নিঃস্ব দিনমজুর। নাট্যে অনুসৃত বর্ণনারীতিও কুশীলবদের প্রায় ঘটনাহীন শ্লথ জীবনধারার সঙ্গে মেলে। মামুনুর রশীদের ওরা কদম আলী বা ওরা আছে বলেই শিরোনাম থেকেই বোঝা যায়, ঐ নাট্যকুশীলবদের পরিচয়, পাথর’র শুভবোধ বা রাষ্ট্র বনাম’র নাট্যঘটনা সাধারণ মানুষকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। এমনকি গিনিপিগ’র গিনিপিগরাতো তৃণমূলের ঐ সাধারণ মানুষ যারা খাদ্যোৎপাদন পাঁচ গুণ বাড়ালেও তার ফল পায় না, বার বার তাদের কেবল এই আর্তনাদ করে যেতে হয়: ‘দেইনগো চাচা- আমাগো দুই মন ধান দেইন।’ উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তিরা উৎপাদকের সকল শ্রম লুন্ঠন করে। উৎপাদন করে একজন, তার ফল ভোগ করে অন্যজন, পরিশ্রম কাকের, কিন্তু ফলের অধিকার কোকিলের, বসন্তের কোকিলের আরও বেশি।

অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের হাতে ও বৃত্তে বন্দী রাজনীতিও স্বাধীন হতে পারে না। সেকারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার রাষ্ট্রকাঠামোর হাস্যকর দিকটি, এর তাথাকথিত আদর্শের অন্তঃ সারশূন্যতাকে সাধারণ মানুষের অবস্থান থেকেই সেলিম আল দীন তাঁর কেরামতমঙ্গল’র ‘রাজাকার খণ্ডে’ অত্যন্ত স্পষ্ট করে তোলেন:

কমান্ডার    শালা বাইঞ্চোথ- উরদু সমঝতা নেহি। বয়স কত?
কেরামত    আমি অশিক্ষিত।
কমান্ডার    ধরা পড়ছস ক্যা?
কেরামত    পালবার পারি নাই দেইখ্যা।
কমান্ডার    পালাবার চাইছিলি ক্যা?
কেরামত    যাতে ধরা না পড়ি।
কমান্ডার    ওহ রে, ধরল ক্যা তরে?
কেরামত    ঐ যে পালাবার নুইছিলাম।
কমান্ডার    কলমা জানস?
কেরামত    জানি।
কমান্ডার    ক।
কেরামত    ক্যা?
কমান্ডার    তুই হিন্দু না মুসলমান পরমান নাগবো।
কেরামত    এই কয় কি। এই তানেরে জিগান। ধরবার নগে নগে নুঙ্গি তুইলা দেহায়া দিছি না।

এই বিষয়টি আরো বি¯তৃত করেন সৈয়দ শামসুল হক এখানে এখন-এর রফিকের সংলাপে, যাতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কালু মিঞা বা বারিশ পীরের সঙ্গে কবর’র নেতার উত্তরসূরীর পরিচয় পাওয়া যায়। বোঝা যায় কী গভীর রাষ্ট্র কাঠামোর মুখোশে তারা নিজেদের আড়াল করেছে:

    প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় রীতিবদ্ধভাবে
    ধার্মিক না হয়ে লোকে ধর্মে বাস করে;
    পাপে কোনো পাপবোধ নেই, কিন্তু আল্লাকে ডরায়,
    অবশ্য তা প্রয়োজনবোধে।
    এই যে দেখছ তুমি পরকালচর্চা বড় বেশি
    এই যে সর্বদা শুধু উর্ধ্বলোকে চোখ
    সারাক্ষণ অবনত বাস্তবিক এই যে মস্তক,
    এই যে মাজার ঘোরা, রাশিচক্র ফলাফল পড়া, সুলতানা
    আমি তো নিশ্চিত, এর পেছনেই
    আছে কোনো গূঢ় রাজনৈতিক কারণ-
    কোনো এক শ্রেণী কিংবা শক্তি বিশেষের।
    আমাদের দুর্বল, দৈবনির্ভর তারা করে দিতে চায়।
    অথচ কোরআনে আছে, আল্লাই বলেন-
    যে জাতি নিজের ভাগ্য নিজে না ফেরায়
    তিনি তার হন না সহায়।
    আমরা মায়ের পেট থেকে পড়ে উত্তরাধিকার
    হিসাবে ধর্মটা পাই, তাই কেউ আর
    বড় বেশি তলিয়ে দেখি না, কোনো প্রশ্নও করি না,
    যেমন করি না
    একদিন আয়নার আবিস্কৃত পিতৃদত্ত এই মুখ নিয়ে।
    মানুষ মুখেই তাই বলছে ‘বিপ্লব’,
    তারা বিপ্লব করে না।
    গাফফারও মজে আছে এবাদত নিয়ে
    এবাদত আসলে করে না।

এই ভান ও ভণ্ডামীকে শণাক্ত করতে পারে বলেই মামুনুর রশীদের ইবলিশ’র তালবেলেম পর্যন্ত তার বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে এসে দেশবাসীকে আহবান জানায়: ‘জাগো, জাগোরে গেরামের মানুষ, জাগো, মানুষ মাইরা ফালাইলো, তোমরা জাগো।’ তার এই আহবান সমস্ত কুশীলবের কন্ঠে নাটকের অত্তিম সংলাপ হিসেবে প্রভাবে ধ্বনিত হয়: ‘জাগো- জাগো, জাগো, জাগো, জাগো দেশবাসীরে- জাগো, জাগো, জাগো, জাগো দেশবাসীরে।’ আবদুল্লাহেল মাহমুদ যখন তাঁর নাট্য-রচনার জন্যে শতাব্দী পর শতাব্দী পিছিয়ে যান তখনও তাঁর দৃষ্টি থাকে সমুখে। প্রাকৃতজন কথা’য় তিনি যখন বহিঃশত্র“র প্রতিরোধ ও আমাদের আত্মপরিচয় শনাক্ত করতে চান তখনও তাঁকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে চিত্রণ করে তার অগ্রযাত্রার ওপর আস্থা স্থাপন করতে হয়।

চার
সাতাশ বছরের বাংলাদেশের নাট্যচর্চার আমাদের নানা জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্তি এক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ও ঘটনা। ঢাকা থিয়েটারের প্রয়োজনায় সেলিম আল দীনের পাণ্ডুলিপি এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। স্বয়ং নাট্যকারের কাছ থেকেই বরং তা শোনা যাক: ‘একটি মারমা রূপকথা নির্বাচনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে এদেশের বিভিন্ন  নৃগোষ্ঠীর উত্তরাধিকারের সঙ্গে বাঙলা ভাষাভাষীদের পরিচয় ঘটিয়ে দেয়া এবং অন্যদিকে এর মাধ্যমে মারমা সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক, নৃতত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের ঔৎসুক্য জাগ্রত করা। বক্ষ্যমান প্রয়াস হয়তবা জাতিগত সহমর্মিতার এক সূচনামুখী পথ উন্মোচন করতে সক্ষম হবে। রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞা, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, অর্থনৈতিক নিপীড়নের যে দায় শতবর্ষের, তার খানিকটা অন্তত বহন করুক আমাদের কালের শিল্প।’

একটি মারামা রূপকথা-য় মনরি মংৎসুমুইর যে কাহিনী ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে এনেছে তার প্রস্তুতি প্রসঙ্গে জাতিতত্ত্বের আলোকে কেরামতমঙ্গল-এ চিত্রিত হাজং ও গারো -এ দুটি নৃগোষ্ঠীর কথা পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। এছাড়া চাকা নাটকে রাজশাহী দিনাজপুরের সাঁওতাল জীবনের চিত্র রয়েছে। পরবর্তী নাটক যৈবতী কন্যার মন-এ আছে মারমাদেরই অন্য একটি সম্প্রদায় রাখাইনদের প্রসঙ্গে। কিন্তু সে-সকল ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ সমগ্র নাটকের একটি অংশ হিসেবেই ধৃত। একটি মারমা রূপকথা সেদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ সামগ্রিক অর্থেই আদিবাসী থিয়েটার। অর্থাৎ মূলে এর কাহিনী, সুর ও নৃত্যছন্দ একটি বিশেষ নৃগোষ্ঠীর যে সকল পরিচয় বহন করে- বক্ষ্যমান প্রযোজনা অনেকাংশে তাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। মনরির পালা একটি কৃত্যনাটক, মারমাদের ভ্রমণ, প্রজ্ঞা ও বিবাহ উপলক্ষে পরপর তৈরি করে এই পালা পরিবেশিত হয়। সমতলে এক পাশে বাদ্যযন্ত্র অন্যপাশে ঘের দেয়া সাজসজ্জা গ্রহণের আড়াল তৈরি করে এই পালা পরিবেশিত হয়। আধুনিককালে সাজানো মঞ্চেও এর পরিবেশনা চলে। আমরা পাঙ্খুর ভূমি সমতলে পরিবেশনা রীতি অনুসরণ করেছি। পাঙ্খু শব্দের অর্থ কীট, পিঁপড়া বা মাকড়সা। সম্ভবত কীটদের সারিবদ্ধ চলন এবং বয়নকালে মাকড়সার ভঙ্গি থেকে এ ধরনের নৃত্যছন্দের উদ্ভব।’

‘একটি মারমা রূপকথায় আমরা গোষ্ঠীবদ্ধ পরিবেশনার মারমাই রীতি অনুসরণ করেছি। সম্প্রদায় বা জাতিগত নাট্যের অন্তর্গত স্পর্শ সংরক্ষণের তাগিদেই তা করা হয়েছে। পাশ্চাত্য রীতির অভিনয় চরিত্রকেন্দ্রিক এবং সেকারণে তা অনুপুক্সক্ষ, ধারাবাহিক। আমরা এ নাট্যে সে পন্থা পরিত্যাগ করেছি। একটি মারমা রূপকথা বদলি অভিনয়রীতির আশ্রয়ে পরিবেশিত হয়। বাংলাদেশের মঞ্চে ঢাকা থিয়েটারের কেরামতমঙ্গল-এ নাসির উদ্দিন ইউসুফ এ রীতির প্রবর্তন করেন। সেখানে তিনজন পরপর কেরামত চরিত্রে অভিনয় করে থাকেন। বাঙলা থিয়েটারের বর্ণনাত্মক অভিনয় রীতির সঙ্গে মনরি মংৎসুমুইর সাদৃশ্য আছে। অর্থাৎ এ হচ্ছে গীত-নৃত্য অভিনয়ের ত্রিসঙ্গমজাত নাট্য। এ-ধারাটা সর্বভারতীয় লোকনাট্যেরও বটে। মারমাদের পরিবেশনা তা থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয়।”১১

নাট্যকারের নিজের রচনায়ও মৃত্তিকালগ্ন ঐ নিরীক্ষার স্বাক্ষর রয়েছে। নাট্যবর্ণনা ও নির্দেশনা ধৃত বন্ধনীচিহ্নকে বিচ্ছিন্নতাজ্ঞাপক বিবেচনা করে হাত হদাই- এ তিনি একে বর্জন করেছেন। একই নাট্যে ‘নোনা দেশের নোনাস্বাদ’ আনার জন্যে ‘ফেনী-নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচলিত ভাষা ব্যবহার করেছেন, তবে এক্ষেত্রে ঐ অঞ্চলের ‘সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি সাধারণীকৃত ভাষাভূমি’ অনুসৃত হয়েছে।

পাঁচ
বাংলাদেশে ঢাকার বাইরে প্রধানত ছোট শহরগুলিতে যাঁর নাটক সবচেয়ে বেশি অভিনীত হয়েছে তিনি আবদুল্লাহ আল-মামুন। সুবচন নির্বাসনে দিয়ে যার শুরু তার তালিকা খুব সংক্ষিপ্ত নয়। নাটককে দর্শকপ্রিয় করায় তাঁর ভূমিকা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাঁর নাট্যে সরলীকরণ ও চমক সৃষ্টির প্রয়াসের সঙ্গে যখন বিনোদনের উপাদান যুক্ত হয় তখন তা বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ধারাকে উপর্যুক্ত মাত্রায় আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হয়। তাঁর সুবচন নির্বাসনে নাটকে তিনি যেসব ‘সুবচন’ নির্বাসনের কথা বলেছেন সেগুলো আসলে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের চেতনার পক্ষে ছিল বেমানান। লেখাপড়া করে গাড়ি ঘোড়া চড়ার প্রত্যাশা কিংবা রমণীর গুণে সংসার সুখের হওয়ার ধারণাই বরং পশ্চাৎপদ ও ভ্রান্তিপূর্ণ। এর বেশ পরে তাঁর নাটক কোকিলারা’র একটি অংশে পতিব্রতা স্ত্রী যে ‘এই বয়সে, জীবনের এই পর্যায়ে’ ‘সর্বনাশ ও কেলেংকারীর মাত্রা’ না বাড়াবার জন্যে ‘সতীনের সংসার করতে’ পর্যন্ত রাজী হয় তা আসলে সুবচন নির্বাসনে’র কেরানীর স্ত্রীরই রকমফের। নাট্যকার হয়তো বলবেন সমাজে ও বাস্তবতায় নারীর অবস্থান এতোটাই দুর্বল ও নাজুক যে তাতেও সে রক্ষা পায় না- এটা দেখানোই তাঁর উদ্দেশ্য, কিন্তু ঐ অতি-নাটকীয়তা আসলে কোনো কিছু প্রতিষ্ঠায় সক্ষম নয়। কোকিলারা’র এই অংশেই কোকিলার স্বামীর ঐ সংস্কার কিংবা বস্তুগত লোভ থেকে নামাজ পড়ার যে উদাহরণ নাট্যকার দিয়েছেন তা খুবই হাস্যকর, কারণ, অন্যদের এভাবে বিভ্রান্ত করতে চাইলেও কিংবা তাতে সক্ষম হলেও তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত আচরণে কিন্তু তারা তা অনুসরণ করে না। অন্য সব কিছুর মতো ধর্মকে তারা পণ্য করে ঠিকই, কিন্তু এর প্রক্রিয়া মোটেই তা নয়। সেনাপতি নাটকের কাহিনী বিন্যাসই ত্র“টিপূর্ণ, তাকে চলচ্চিত্রে রূপায়ণ করে নাট্যকার অবশ্য বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। তোমারাই নাটক আবেগকে যতোটা আশ্রয় করে, যুক্তি ও শৈল্পিক শৃঙ্খলাকে ততোটাই পরিহার করে। এখনও ক্রীতদাস-এ রেললাইন সংলগ্ন বস্তিকে মঞ্চে তুলে আনা সত্বেও ‘আগাপাসতলা আস্তা একখান মাইয়া মানুষে’র বিনোদনের সঙ্গে এর তড়িঘড়ি ও ইচ্ছাপূরণের সমাপ্তিকে বিবেচনায় নিলে একেও পুরনো ধারারই অতি-নাটকীয় প্রয়াস বলে বিবেচনা করতে হয়।

তাহলে প্রশ্ন, আবদুল্লাহ আল-মামুনের ঐ নাটক সমষ্টি এতটা জনপ্রিয় ও অধিক মঞ্চায়িত হল কেন? এর কারণ, রাজধানীর নকলনবিশী এবং সেই প্রয়াসে এইসব নাটককে অনুকরণের সহজ সুবিধা। বাংলাদেশের সাতাশ বছরের নাট্যচর্চার ধারায় এটি একটি দুঃখজনক প্রবণতা যে, নিজেদের সৃজনশীলতার প্রতি আস্থা অর্জনের চেয়ে দেশের ব্যাপক অংশে রাজধানীকে নকল করার প্রয়াসের মধ্যেই নাট্যকর্মীদের অধিকাংশের শ্রম ও শক্তি ব্যয় হয়। অবশ্য এজন্যে রাজধানীর নাট্য প্রয়াস, তার ধরন এবং তার প্রতি মোহও কম দায়ী নয়। রাজধানীর বাইরে নাট্যচর্চার ধারাটি শক্তিশালী নয় কিংবা দলের ওপর নির্ভর করে নাট্যরচনা এবং নাট্যকার সৃষ্টি হয় বলে তার অভাবে সারা দেশব্যাপী নাট্যসাহিত্যে এক-ধরনের বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালের নবীন প্রয়াসে ঐ ধারা অনেকটা সক্রিয়, সম্ভাবনাপূর্ণ ও আশাবাদী থাকলেও রজতজয়ন্তীর পথে এগুতে এগুতে এবং তা পেরিয়ে ঐ নাট্যধারা ক্রমাগত শিথিল ও নিষ্ক্রিয় হয়েছে। ‘গ্রুপথিয়েটার আন্দোলনে চট্টগ্রামের পনের বছরের একটা মোটামুটি হিসেব নিতে গিয়ে ১৯৮৯-এ যা বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের সাতাশ বছরের সময়সীমার তার কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটে নি। সেইসঙ্গে এটাও বিবেচনা করা যায়, দেশের দ্বিতীয় প্রধান নগর চট্টগামের এই অবস্থা হলে অন্যত্র তা কেমন হবে। প্রতিবেদক উল্লেখ করেছেন, রূপান্তরিত ও অনূদিত নাটকের মধ্যে তির্যকের ভোমা, ব্রেখট অবলম্বনে সমাধান, অরিন্দমের লালসালু, ব্রেখট থেকে রূপান্তরিত রাইফেল, প্রতিনিধির তাসের দেশ, কালপুরুষের ইনফরমার, চট্টগ্রাম থিয়েটারের যুদ্ধ, রক্তের অক্ষর, রঙ্গনের আভ্যন্তরীণ খেলাধুলা ইত্যাদি প্রযোজনা দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। যদিও তিনি সাধারণভাবে এটাও বলেছেন, ‘কয়েকটি মৌলিক নাটক জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও রূপান্তরিত কিংবা অনূদিত কোন নাটক তেমন দর্শকপ্রিয় হয়নি।’

অতঃপর চট্টগ্রামের নাট্যরচনা বিষয়ে প্রতিবেদক তাৎপর্যপূর্ণ মূল্যায়ন করেছেন: ‘অনিয়মিত হলেও চট্টগ্রামের গ্রুপথিয়েটার চর্চার সূচনালগ্নে গতানুগতিকতার পথ ছেড়ে নতুন আঙ্গিকে নাটক উপস্থাপনের সংকল্প বিষয়ে কয়েকটি দল আত্মপ্রকাশ করে। স্বাভাবিকভাবেই এদের রুচি ও শিক্ষা নতুন নাটকের পক্ষেই আশাবাদ ব্যক্ত করে। গ্র“পের কর্মীরাই প্রধানত নাটক রচনায় হাত দেয় এবং ক্রমাগত গ্র“পের চাহিদা মেটাতে গিয়ে তাঁদের কাঁচা হাত ক্রমেই পাকা হতে থাকে। প্রথম দিকে যেরূপ নাট রচনার ক্ষেত্রে উৎসাহ কাজ করেছিল ক্রমেই তাতে ভাটা পড়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম একাধিক প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার থাকলেও মর্মান্তিক সত্য যে, এঁরা কেউই কিন্তু ইদানীং আর তেমন মনোযোগ দিয়ে লিখছেন না।’ ‘নাট্য রচনার ক্ষেত্রে এই শূন্যতার কারণ একাধিক। আসল নৈরাশ্য প্রযোজনা। বিভিন্ন কারণে কেউ কেউ নিয়মিত প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারছেন না। ফলে লেখকরাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। এরপর আসে প্রকাশনা। নাট্যকাররা স্ব-উদ্যোগে প্রকাশ না করলে তৃতীয় পক্ষ সম্ভবত চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে আজও এগিয়ে আসে নি। কোনো নাট্যকাররা চন না তাঁদের নাটক বছরখানেক অভিনয় হবার পর তা কালের গর্ভে হারিয় যাক। নাটকের পত্রিকার অপ্রতুলতাও এর জন্য দায়ী। এসবের পরেও আসে নাট্যকারের জীবিকা। বিদেশে নাটকের কপিরাইট এবং রয়েলটি বলে একটা কথা আছে। আমাদের নাট্যকারদের দুর্ভাগ্য এমন যে, এসব কিছুর কথা বাদ দিলেও নাটক মঞ্চায়নের পূর্বে কর্মকর্তারা তাঁকে সংবাদটুকু দেওয়ার প্রয়োজনও অনুভব করেন না। সমগ্র নাট্যানুষ্ঠানে আসলে নাট্যকাররাই হচ্ছেন সবচেয়ে অবহেলিত ব্যক্তি। নাট্যকারের হতাশ হওয়ার পেছনে একারণটিও কম দায়ী নয়। নাটক অন্যসব শিল্পকর্মের ন্যায় নয়, যার সফলতা রচনায় সীমাবদ্ধ। এর জন্য প্রয়োজন প্রযোজক, নির্দেশক, সঙ্গীত, আলো, অভিনেতা, দর্শক ইত্যাদি। এসবের কোনো কোনটির অভাববোধে নাট্যরচনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।’১২

মূলত এসব কারণে ঢাকার প্রান্তবর্তী বা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেখানে উনবিংশ শতাব্দী বা এ শতাব্দীর প্রারম্ভিককাল থেকে নাট্যরচনা ও চর্চা হয়েছে সেখানে তা স্তিমিত হতে হতে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের প্রকৃত সমৃদ্ধির জন্য স্থানীয় ঐতিহ্য, লোকনাট্যের ধারা এবং নাট্য-আঙ্গিকের অননুন্মোচিত বিষয় ও অধ্যায় সম্পর্ক অনুসন্ধান প্রয়োজন, যাতে নাট্য রচনায়ও তার প্রকাশ ঘটে। নগরকেন্দ্রিক একরৈখিক নাট্য-সাহিত্যের বিকাশ একসময় অবশ্যই মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। রজত জয়ন্তী পেরিয়ে তাই সমগ্র দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে আত্মউন্মোচন প্রয়োজন। যে দ্বন্দ্ব বৃহত্তর জীবন অথবা তৃণমূলে বর্তমান তাকে এড়িয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সময় এসেছে সম্পূর্ণভাবে তার মুখোমুখি হওয়ার।

ছয়
সাতাশ বছরে অনুবাদ ও রূপান্তর বাংলাদেশের নাট্য-সাহিত্য ও চর্চাকে যেমন ঋদ্ধ করেছে, তেমনি নানা জিজ্ঞাসারও জন্ম দিয়েছে। পাকিস্তানী আমলে প্রধানত মুনীর চৌধুরীর হাতে বিশ্বসাহিত্যের যেসব অনুবাদ হয়েছে তা পাঠ কিংবা বেতারে অভিনয়ের বেশি এগুতে পারে নি। ঞযব ঞধসরহম ড়ভ ঃযব ঝযৎব’ির অনুবাদ মুখরা রমণী বশীকরণ টেলিভিশনে প্রদর্শিত হলেও মঞ্চে অভিনীত হয় নি। ওথেলো’র অসম্পূর্ণ অনুবাদ সম্পূর্ণ করেন নাট্যকারের অগ্রজ কবীর চৌধুরী এবং সেটি একটি জনপ্রিয় প্রযোজনা হিসেবে দীর্ঘদিন অভিনীত হয়। মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বদেশে এর বাইরে শেক্সপীয়র অনুবাদ করেছেন মফিজ চৌধুরী ও আবু শাহরিয়ার। কিন্তু মঞ্চের আনুকূল্যে সৈয়দ শামসুল হক রূপান্তরিত ম্যাকবেথ ও টেম্পেষ্ট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই নাট্যকার জুলিয়াস সীজার-এর নতুন পাঠ থেকে লেখেন গণনায়ক। তাঁর ভাষায়, ‘অনুবাদ আমি করি নি, রূপান্তরিত রচনাও একে বলা যাবে না, আমি বরং বহুপূর্বে গত এক অগ্রজের সঙ্গে বসে সচেতনভাবে নতুন একটি রচনায় হাত দিয়েছি।’১৩

দলগত অনুবাদ ও রূপান্তরে বেশি সময় ও মনোযোগ দিয়েছেন ঢাকার নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়। ১৯৭৩ সালে মলিয়ের-র দ্যা ইন্টেলেকচ্যুয়াল লেডিজ অবলম্বনে আলী যাকের বিদগ্ধ রমণীকূল অনুবাদ করেন। তিনিই রূপান্তর করেন এডওয়ার্ড এ্যালবির এভরিথিং ইন দ্য গার্ডেন অবলম্বনে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে, ব্রেশটের গুড উইম্যান অব সেটজুয়ান অবলম্বনে সৎ মানুষর খোঁজে, কার্ল সুখমায়ার রচিত ক্যাপ্টেন অব কোপেনিক অবলম্বনে কোপেনিকের ক্যাপ্টেন। আসাদুজ্জামান নূর রূপান্তর করেন ব্রেশটের দ্যা রাইজ এ্যান্ড দ্য ফল অব দ্য সিটি অব মেহগনি’ (মোহনগরী) এবং ঐ একই নাট্যকারের হের পুন্টিলা এ্যান্ড হিজ ম্যান ম্যাট্টি অবলম্বনে দেওয়ান গাজীর কিসসা। তিনি এবং আতাউর রহমান একসঙ্গে ফেরেঙ্ক মলনারের লিলিয়ম অবলম্বনে রচনা করেন ভেঁপুতে বেহাগ। জামালউদ্দীন হোসেন আরউইন ’শ রচিত বেরি দ্য ডেড অবলম্বনে লেখেন কবর দিয়ে দাও। কবীর চৌধুরী এই দলের জন্যে স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো’র অনুবাদ করেন গডোর প্রতীক্ষায় শিরোনামে। ব্রেশটের দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও গ্যালিলে অবলম্বনে আবদুস সেলিম রচনা করেন গ্যলিলিও এবং এটি যথেষ্ট দর্শক সমাদৃত হয়। এই অনুবাদকেরই ব্রেশট অবলম্বনে হিম্মতী মা নাগরিকের অন্যতম সাম্প্রতিক প্রযোজনা। অন্য দল ও অনুবাদকের হাতে ঢাকার মঞ্চে মলিয়ের, গোগোল প্রমুখের রচনাও দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সৈয়দ মহিদুল ইসলাম এডওয়ার্ড এ্যালবির দ্য জু স্টোরি অবলম্বনে লিখিছেন চিড়িয়াখানা। নাট্যচক্র করেছে ব্রেশটের চক সার্কেল, ইতালীয় নাট্যকার দারিও ফো-র ইংরেজি রূপান্তরিত নাটক থেকে বাংলা অনুবাদে আহ কমরেড করেছে ঢাকা পদাতিক। পদাতিক প্রযোজনায় অভিনীত হয়েছে গোর্কির কাহিনী অবলম্বনে ব্রেখটের নাটক মা।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় ও ঢাকা থিয়েটার রূপান্তরিক ও মৌলিক নাটক মঞ্চায়ন বিষয়ে প্রায় পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পরে নাগরিক যেমন মৌলিক নাটক মঞ্চায়নে এগিয়ে এসেছে তেমনি ঢাকা থিয়েটারও রূপান্তর বিষয়ে আর দ্বিধা করে নি। ব্রেশট অবলম্বনে ঢাকা থিয়েটারের ধূর্ত উই মঞ্চায়ন তার সাক্ষ্য। নাগরিক ও থিয়েটার যৌথভাবে ম্যাকবেথ মঞ্চায়ন করে অবশ্য আগেই এই সহমর্মিতার স্বাক্ষর রেখেছে। টেম্পেষ্ট প্রযোজনাটির জন্য যে আটটি দল থেকে চৌদ্দজন অভিনেতা-অভিনেত্রী নেয়া হয়েছে তা-ও ঐ সহমর্মিতাকে প্রকাশ করে।

কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যেসব বিদেশী নির্দেশক ও কলাকুশলীর সাহায্য আমাদের নাট্যদল গ্রহণ করেছে তা আমাদের নাট্যচর্চাকে কতটা অনুপ্রাণিত অথবা সাহায্য করেছে কিংবা করতে পারে সে বিবেচনাকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। একজন সক্রিয় অংশগহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী, জামিল আহমেদ মনে করেন: ....“These plays failed to create impact because non-native directors and designers, unaware of the root paradigms of the local spectators, failed to send (aesthetic) signals which would `burn' a lasting impression. AZGe m½Z Kvi‡YB wZwb e‡j‡Qb, It was a simple lesson that I learnt: authentic exchange occurs only when I have something of my own to offer. And I can have something of my own to offer only when I stand firmly on my own identity.""১৪

কিন্তু জামিল আহমেদ নির্দেশিত বিষাদ-সিন্ধু’র সেট ও প্রযোজনা যতোটা আকৃষ্ট করে, তার বক্তব্য কিংবা এই নাট্যে মূল রচনায় ধৃত মীর মোশাররফ হোসেনের প্রাগ্রসরতা ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা, যার মধ্যে আমাদের আত্মপরিচয়ের বীজও লুক্কায়িত, কতোটা দর্শকের কাছে পৌঁছুতে পেরেছে সে প্রশ্নও ওঠে।

সাত
ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রবক্তা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর মাত্র নয় বছর বয়সের, ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সেই সময়ে (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার) নবীনগরের সমাজের বাস্তব অবস্থা খুব খারাপ ছিল। কারণ তখনকার সেই সমাজ সমাজের প্রতিপত্তিশালী জমিদারদের প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হইত। তাহারা তাহাদের যে কোন উৎসবে ঢাকা হইতে বাঈজি আনিয়া নাচের জলসা করিত, আর তাহার সহিত সবরকম মাদকদ্রব্যের যথেচ্ছ ব্যবহার হইত। তাহাতে সমাজের নৈতিক অধঃপতনের দৃশ্য দেখিতে পাইয়াছি। অপরপক্ষে নবীনগরে যাত্রাগান শুনিয়াছি। প্রহলাদ চরিত্র, ধ্র“ব ও প্রবীর-পতন যাত্রাগান শুনিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম। প্রহলাদের একনিষ্ঠা, সত্যের প্রতি মর্যাদা, নীতি রক্ষার জন্য সর্বস্বত্যাগ পরবর্তীকালে আমার মহৎ উপকার করিয়াছে। এছাড়া কবিগানের প্রচলন ছিল। কবির সরকারের বাকযুদ্ধ একটি দর্শনীয় ব্যাপার ছিল।”১৫ অমলেন্দু বিশ্বাস উল্লেখ করেছেন, ’৪৭ পূর্বকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘জয়দুর্গা অপেরা’ যাত্রাদল খোলেন, পরে তিনি ‘ভোলানাথ অপেরা’ও চালু করেছিলেন। ১৯৫০-এর দিকে ঝালকাঠিতে ‘নাথ কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘জয়দুর্গা’ ও ‘ভোলানাথে’ কলকাতা থেকে শিল্পীরা এসে মরসুম শেষে ফিরে যেতেন, কিন্তু ‘নাথ কোম্পানী’র বৈশিষ্ট্য ছিল, এখানে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার শিল্পীরাও সমানে পাঞ্জা দিয়ে অভিনয় করতেন। কিন্তু অতঃপর আমাদের নিজস্ব যাত্রাশিল্পের বিকাশকে অমলেন্দু বিশ্বাস এভাবে চিত্রণ করেছেন: ‘দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে রেলওয়ের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামের ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটের নাট্যশিল্পীবৃন্দ ১৯৫০ সাল থেকে দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চা ও প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে লোকজ নাট্যকলা যাত্রারও নিরীক্ষাধর্মী চর্চা শুরু করে। তারই ফলে সৃষ্ট হয়েছিল এদেশের দর্শক নন্দিত যাত্রাশিল্পী সাদেকুন্নবী, সাদেক আলী, নজির আহমদ, আবদুল হামিদ, সাধনা চৌধুরী, মঞ্জুশ্রী মুখার্জি, জাহানারা বেগম, শান্তি দেবী ও প্রবন্ধকার। তাঁরা প্রত্যেকে নাটক থেকে যাত্রায় এসেছিলেন। তদানীন্তন পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালে উপরোক্ত শিল্পীদের দ্বারা বাবুল থিয়েটার নামে একটি ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল তৈরি করা হয়। এরা ছুটির অবকাশে বিভিন্ন স্থানে দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শন করতো। পরবর্তীকালে এই বাবুল থিয়েটারই পূর্ব বাংলার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সহযোগে গঠিত পূর্ব বাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের নির্ভেজাল প্রথম যাত্রা সংগঠনে রূপান্তরিত হয়ে পেশাভিত্তিক যাত্রা ব্যবসায়ে অবর্তীর্ণ হয়।’ ‘পঞ্চাশের দশকে কলকাতার যাত্রায় গুফো পুরুষদের নারী চরিত্রে অভিনয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটা নিশ্চয়ই দুঃসাহসিক প্রয়াস ছিল।’ ‘শাহজাদপুরে নারী-পুরুষ সম্বলিত দ্বিতীয় যাত্রাদল বাসন্তী অপেরায় এ প্রবন্ধকারের পরিচালনায় তুষার দাশগুপ্ত, ঠাকুর দাস ঘোষ, কালী দত্ত, ফণীভূষণ, জ্যোৎøা বিশ্বাস, জয়ন্তী প্রামাণিক, অমির সরকার প্রমুখ শিল্পীগণ যুক্ত ছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশে নারী-পুরুষ নিয়ে যাত্রাদল গঠিত হতে থাকে।’ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ‘আমার দলসহ আমি দিনাজপুরের পীরগঞ্জ থানাধীন রাণীসংকৈল মেলায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি।’ ঐ এলাকা তখন মুক্তাঞ্চল ছিল। অতঃপর মধ্য-এপ্রিলে পাকবাহিনীর আক্রমণে তিনি পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুরে উপস্থিত হন। যানবাহন না থাকায় দলের সরঞ্জাম সীমান্তের এপারে ফেলে যাওয়ায় ওখানে গিয়ে সৌখিন নাট্য সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জিনিসপত্র ধার করে অভিনয় করেন। এর মধ্যে অবরুদ্ধ স্বদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার তুঙ্গে ওঠায় নিজেদের পোষ্য ও আত্মীয়স্বজনদের বিষয়ে সদস্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলে তিনি দল ভেঙ্গে দেন।১৬

১৯৭৯ ও ’৮০ তে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী জাতীয় ভিত্তিতে যে যাত্রা উৎসবের আয়োজন করে তার দুই বছরেই শ্রেষ্ঠ শিল্পীর মর্যাদা পান অমলেন্দু বিশ্বাস। কিন্তু যাত্রাশিল্পের বিপর্যয়ে তিনি ছিলেন আমৃত্যু উদ্বিগ্ন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং প্রদর্শনী-নির্ভর যাত্রাশিল্পের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয় তা এই শিল্পকে প্রায় মুমূর্ষু করে ফেলেছে। অথচ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় আমরা দেখেছি, যাত্রাশিল্প ঐতিহ্যগতভাবে অশ্লীলতা বর্জিত।

নাট্যশিল্পের লোকজ ও বৃহৎ জনজীবনের এই ধারাটিকে অশ্লীলতা ও জুয়াখেলার অজুহাতে কার্যত যে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে উদোর পিন্ডিকে বুদোর ঘাড়ে চাপানোর সামিল। এই পরিস্থিতিতে লোকজ এই ধারাটিতে সাহিত্যরচনার সুযোগ প্রায় ঘটে নি বললেই চলে। স্বয়ং অমলেন্দু বিশ্বাস লিখেছেন, ‘অনেকের অনুরোধে এবং মঞ্চের প্রয়োজনে নাটক লেখার চেষ্টাও যে না করেছি তা নয়, কিন্তু হয়ে ওঠে নি, সময়ের অভাবে যতটা না, অনুপ্রেরণার অভাবটাই বেশি।’ অথবা তিনি জানেন আমাদের এখানে ‘পশ্চিম বাংলার যাত্রাদল কৃত ছাপা যাত্রা নাটক বাজার থেকে কিনে আনা’য় তা দর্শকদের তেমনভাবে আকর্ষণ করতে পারে না। তিনি উল্লেখ করেছেন, পশ্চিম বাংলার কোনো দলে ‘ছাপা নাটক করা হয় না। প্রতিটি দল নাটক লিখিয়ে নিয়ে করে, কারণ সেখানকার দর্শক সমাজ নতুন নাটক ছাড়া গ্রহণ করতে নারাজ।’১৭ ফলে প্রসেনিয়াম মঞ্চের বাইরে আমাদের এখানে লোকআঙ্গিকে যে নাট্য শিল্পের ধারা গড়ে ওঠার সুযোগ ছিল বিরুদ্ধ পরিবেশে তা শুরুতেই বাধাগ্রস্ত হয়।

কিন্তু তা না গড়ে উঠলেও প্রচলিত গ্রুপথিয়েটারের নাট্যচর্চা একসময়ে সচেতন নাট্যকর্মীর সামনে এই জিজ্ঞাসা উপস্থিত করে যে ঐ চর্চা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বা যাবে। এ অন্বেষণ থেকে বাদল সরকার তৃতীয় নাট্যে১৮-র কথা বলেছেন, গ্রোটোভ্যেস্কি বলেছেন চড়ড়ৎ ঃযবধঃৎব-১৯ এর কথা। আমাদের বাস্তবতায় এটি আরো বেশি প্রযোজ্য। এক দশক গ্রুপথিয়েটার চর্চার পর ‘আরণ্যক নাট্যদলে’র মনে হয়, তারা যতোটা না নাট্যকর্মী তার চেয়ে বেশি মঞ্চদাস।‘ এ যেন এক নতুন ধরনের দাস। মুখে বঙ মেখে সঙ সেজে মঞ্চের পাদপ্রদীপে দাঁড়িয়ে কতগুলো প্রভুর আনন্দের যোগান দেই আমরা।’ এ উপলদ্ধি থেকে তারা মুক্ত নাটকের ধারণা গড়ে তোলে। এর প্রথম বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এ নাট্যের কোনো ‘লিখিত পান্ডুলিপি নেই।’ ‘আশিভাগ নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর এই দেশে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন লোকের অভাবে যাতে নাটকের মত একটি শক্তিশালী মাধ্যম নিষ্ক্রিয় হয়ে না পড়ে সেকারণেই উদ্ভাবন এই নতুন আঙ্গিকের।’২০ ‘গ্রাম থিয়েটার’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে নাসির উদ্দিন ইউসুফও এ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশের নিরন্ন ও নিরক্ষর মানুষদের মধ্যে দ্রুত জীবন সম্পর্কে সমকালীন অনুসন্ধিৎসা জাগ্রত করার ব্যাপারে এই মৌলিক রীতির নাটক অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস, উপরন্তু গভীর চেতনা বিচিত্র অনুভব ও কৌশলে এর মধ্যে প্রবেশ করানো সম্ভব।’২১

পাণ্ডুলিপিহীন নাটকের উদাহরণ হিসেবে অগাষ্টো বোল তাঁর `Theatre of Depressed'-এ২২ চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় এর সমস্যাও রয়েছে, যা থেকে বোঝা যায়, পাণ্ডুলিপি বর্জিত নাট্যসাহিত্য গড়ে ওঠা এখানে প্রায় অসম্ভব। বর্তমান লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, ‘আরণ্যকের কর্মীদের পরিচালনার তাঁদের মুক্ত নাটক কর্মসূচীর প্রথম পর্যায়ের শেষদিকের একটি প্রকল্পের কাজ দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। তাতে লিখিত পাণ্ডুলিপি না থাকার সুবিধা অসুবিধা দুইই প্রত্যক্ষ করেছি। লিখিত পাণ্ডুলিপি নেই বলে মূল প্রস্তাবনা ও কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চরিত্র রূপায়ণকারীরা স্বচ্ছন্দে সংলাপ উচ্চারণ করেছে, আড়ষ্টতা ও কৃত্রিমতামুক্ত হতে পেরেছে। লিখিত পাণ্ডুলিপি নেই বলে নতুন ঘটনা ও বাস্তবতায় নাটকটি ক্রমাগত সমৃদ্ধ হওয়ার ও পরিণততর মাত্রা অর্জনের সুযোগ লাভ করে। কিন্তু পাণ্ডুলিপি না থাকায় নাটকের সংলাপ অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রলম্বিত হওয়ার অথবা তা মূল প্রসঙ্গের বাইরে চলে যাওয়ার আশংকাও লক্ষ্য করা গেছে। পাণ্ডুলিপির অভাবে নতুন নতুন ঘটনা, চরিত্র ও পল্লব বিস্তারের ফলে নাট্য ঘনবদ্ধতা ও সংহতি বিনষ্ট হওয়ার সঙ্গে এক ধরনের শিথিলতাও নাটককে দুর্বল করে। আমি যে প্রকল্পটির মঞ্চায়ন দেখেছি তার অভিনেতাদের দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়: নিরর শ্রমজীবী মানুষ ও স্কুল-কলেজের মোটামুটি ‘আলোকপ্রাপ্ত’ ছাত্র। লক্ষ্য করেছি শ্রমজীবী মানুষেরা সংলাপের বাহুল্য বর্জন করে মূল বিষয়ের প্রতি যথাসম্ভব বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছেন, অন্যদিকে ছাত্ররা নিজেদের ব্যক্তিগত উদ্ভাবনের পরিচয়কে স্পষ্ট করার জন্যে দীর্ঘায়িত করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাট্য সংহতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর জন্যে দায়ী মনে হয়েছে, প্রথমোক্তদের জীবনাভিজ্ঞতার পরিপক্কতা ও যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি, দ্বিতীয়োক্তদের অভিজ্ঞতার অভাব ও ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের বিশিষ্টভাবে দেখাবার লোভ।’২৩

আমরা এও লক্ষ্য করবো ঢাকা থিয়েটার যখন সুবেষ্টিত দেয়ালঘেরা মঞ্চের বাইরে মঞ্চবর্জিত নাট্যচর্চার চিন্তা থেকে ছিয়াত্তরে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় নাটক করা শুরু করে তখন তাদের সফল প্রযোজনা চর কাঁকড়ার ডকুমেন্টারী পাণ্ডুলিপিবর্জিত ছিল না। মান্নান হীরার ফেরারী নিশান, ক্ষুদিরামের দেশে, আদাব, মৃগনাভি, শেকল, ভগবানের মা প্রভৃতি সব কটিই লিখিত পাণ্ডুলিপি-নির্ভর পথনাটক। মুক্ত নাটকের অভিজ্ঞতা থেকে সঙ্গত কারণেই আবদুল্লাহেল মাহমুদ লেখেন পূর্ণাঙ্গ নাটক সাত পুরুষের ঋণ।

লিখিত পাণ্ডুলিপির অনুপস্থিতিতে এর সাহিত্য ও নাট্যচর্চা বিকশিত হওয়ার বিষয়ে নানা সংশয়ে বিদ্ধ হয়ে ১৯৮৬’র জানুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় মুক্ত নাটক সম্মেলনের ১৭ তারিখের ‘আমাদের গ্রামীণ শিল্পরূপ ও মুক্ত নাটক’ শীর্ষক সেমিনারের মূল প্রবন্ধে আজকের প্রবন্ধকার বলেছিল, ‘মুক্ত নাটকের বৈশিষ্ট্যগুলোকে যেভাবে নমনীয় করে রাখা হয়েছে তাতে শিল্পকর্ম হিসেবে এর ভুল ব্যবহারের আশংকা অত্যন্ত বেশি। গম্ভীরা ও কবিগনে যেভাবে অশ্লীলতা প্রবেশ করেছে এই শিল্পরূপও তেমনি নানা স্থূলতার শিকার হতে পারে। এই নমনীয়তার জন্যে সম্ভবত বাদল সরকার উদ্ভাবিত থার্ড থিয়েটার নানাভাবে মৌল লক্ষ্যবিচ্যুত ও প্রার্থিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে বা হচ্ছে।২৪ এটিকে যদি আমরা একটি শিল্পরূপ বিবেচনা করি এবং ভাবি এটি একটি উন্নততর সমাজব্যবস্থা সৃষ্টির জন্যে প্রাথমিকভাবে হলেও কাজ করবে তাহলে তার শিল্প আঙ্গিকটিতে নিশ্চয়ই ভুল ব্যবহারের সুযোগ থাকা বাঞ্চনীয় নয়। এখানে ঢাকা থিয়েটারের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিলে মনে হয় এ বিষয়ে আমরা স্পষ্ট ধারণা লাভে সক্ষম হবো। ঢাকা থিয়েটার বা তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম গ্রুপঅথবা গ্রাম থিয়েটারগুলো ভূমি-লগ্ন মানুষের জন্যে নাটক করলেও, আমি যতদূর জানি, পাণ্ডুলিপিবিহীন কোনো নাটক মঞ্চস্থ করে নি। সয়ফুল মূল্ক বদিউজ্জামান-এর লোকজ রূপটিকে পরিশ্র“ত করে ও অন্যদিকে গ্রামে মেলা বা নাটক মঞ্চায়ন করলেও তালুকনগরের আজহার বয়াতি ও পরিপার্শ্বের ঘটনা ও জীবনচিত্র নিয়ে রচিত নাটক কিত্তনখোলা বা বিদেশী যন্ত্রানুসঙ্গ বর্জিত পুঁথি ও কারবালার গানের সুরসমৃদ্ধ কেরামতমঙ্গল সেখানে মঞ্চস্থ করা সম্ভব হয় নি। তাহলে কি গ্রামীণ শিল্পরূপের সরলীকরণই কাম্য? এটিও তাৎপর্যপূর্ণ, যে গ্রামীণ মেলা কিত্তনখোলা’য় উঠে আসছে তাকে সত্যিকার মেলায় স্থাপন করা খুবই দুরূহ। প্রযোজনার এই দূরত্ব কি পরিশ্র“ত শিল্প মাধ্যমের কোনো অন্তর্দুর্বলতা? তাদের কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাওয়ার এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই কি রয়েছে কোনো ফাঁক অথবা ফাঁকি? বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীর জন্যে তাহলে কি বরাদ্দ তরলায়িত সংস্কৃতি? প্রশ্নগুলো ও পরিস্থিতি খুবই জটিল। একদিকে বৃহৎ জনগোষ্ঠী গ্রামে যাওয়া আন্তরিক তরুণ নাট্যকর্মীদের পূর্ণ আস্থায় গ্রহণ করতে পারছে না বা গ্রহণ করলেও ঐ তরুণরা হতে পারছে না তাদের জীবনের শরিক, অন্যদিকে তাদের জীবন নিয়ে গড়ে উঠছে যে রূপকল্প তা পৌঁছুতে পারছে না তাদেরই কাছে, উভয় পক্ষের যোগাযোগ গড়ে উঠছে না কিংবা তা ব্যর্থ হচ্ছে।’২৫

আট
এই যোগাযোগহীনতার অন্তর্গত ক্ষতটি খুবই গভীর, সাতাশ বছরে তা বেড়েছে বৈ কমে নি। নির্মোহ মূল্যায়ন থেকে দেখা যাবে আমাদের কথিত অর্জনেও রয়েছে কতটা ফাঁক অথবা ফাঁকি। আমাদের নাটকের কিছু প্রত্যক্ষ উদাহরণ থেকে ব্যাপারটি বোঝা যাক। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর গণনায়ক-এর ‘সবিনয় নিবেদন’-এ জানিয়েছেন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাট্যটি লিখে ফেলবার পর গণনায়ক লেখা আমার পক্ষে অনিবার্য হয়ে পড়ে।’ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমি করে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় লেখা হলেও এর মধ্যে ভ্রান্তি ও যুক্তির যথেষ্ট ফাঁক রয়েছে। গ্রামবাসী মাতবরকে বলছে-

    আপনের হুকুম মতো এই সারা সতেরো গেরামে
    কোনোদিন কোনো ব্যাটা মুক্তিবাহিনীর নামে
    আসলেই খেদায়া দিছি যেমন ভিটায়
    খা-খা কাক ডাকলে দুপুর বেলায়
    লাঠি হাতে বৌ-ঝি খেদায়।
    আপনের হুকুম মতো খোলা রাখছি চাইরদিক চোখ
    গেরামের মধ্যে কোনো সন্দেহজনক
    ঘোরাফেরা দেখলেই পাছ নিছি সাপের মতন
    হুজুরে হাজিরও করছি দুইচাইরজন।

বাংলাদেশের কোন সতেরো গ্রামের কোন কালের কথা বলছেন নাট্যকার যারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মাতব্বরের কথা মত তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে কিংবা হুজুরে হাজির করেছে? তাহলে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার শুরুতেই নগরের লক্ষ লক্ষ মানুষ যে গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল সেগুলোই বা কোন গ্রাম এবং সে সময়ই বা কোন সময়? যে গ্রামগুলো দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে তাদের গেরিলা ও প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সহায়তা করেছে নাট্যকারের কল্পনাশক্তি কেন ও কীভাবে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করলো সেটাই বরং বিস্ময়কর! আর ১৯৭১-এ সতেরো গ্রামের একচ্ছত্র মাতব্বর হওয়ার সুযোগ কি বাস্তবত কারো ছিল? এর বেশ আগে থেকে প্রচলিত ইউনিয়ন পরিষদ কাঠামোর বাইরে থেকে এরকম মাতব্বরের অস্তিত্ব কল্পনা কি স্বাভাবিক? ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি’র এই রকম অপপ্রয়োগ শিল্পকেই বরং তুচ্ছ করে। চমক সৃষ্টির এই মোহ থেকেই হয়তো নাট্যকার গণনায়ক’র রচনাকালকে ‘১৩ জুন, ১৯৭৫-২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬’ পর্যন্ত দেখিয়ে নিজেকে ‘প্রফেটিক’ প্রমাণ করতে চেয়েছেন। আবার নূরলদীনে’র প্রথম মঞ্চায়নের স্যুভেনিরে ঐ চরিত্রকে যেখানে শেখ মুজিবের পূর্বসূরী বলে নিজেই উল্লেখ করেছেন সেখানে গণনায়ক-এ দেশবন্ধু ওসমানকে স্পইতই শেখ মুজিব হিসেবে চেনা যাওয়া সত্বেও নাটকটিকে তিনি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বর্জিত’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই ঢাক গুড় গুড়ের মধ্য দিয়ে শিল্পের যে চমক তিনি সৃষ্টি করতে চেয়েছেন তা পরিণামে তাঁর জন্যে বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-এর পরে গণনায়ক লেখা কেন অনিবার্য হয়ে পড়ে তা বোঝা আসলে মুস্কিল। কিন্তু ঐ ভ্রান্তির উত্তরাধিকার এখানেও বর্তেছে। গণনায়ক-এ স্বদেশের প্রকৃত মুক্তির জন্যে সানাউল্লাহ যে নিজেদের লেনিন ও কাস্ত্রোর সঙ্গে তুলনা করেছে তা কতোটা ইতিহাসসম্মত? আমাদের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক বাস্তবতায় কি তার সমর্থন মেলে? তাহলে কি এও স্বীকার করতে হয় না দেশবন্ধু ওসমানের হত্যাকারীরা ইতিহাসের এক ইতিবাচক শক্তি? আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা, তার নির্মোহ তথ্যাবলী এবং স্বয়ং নাট্যকারই কি তা স্বীকার করবেন? আর তা যদি না হয় তাহলে ঐ ‘অনিবার্য’ সংবাদ কি নেহাতই কথার কথা হয়ে ওঠে না? কবির মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য হলেও ইতিহাস সমর্থিত নিকট অতীতের প্রত্যক্ষ সত্য ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এবং তার বিরুদ্ধে গিয়ে কি তা রচনা করা সম্ভব? এজন্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-উত্তর এ কাব্য নাট্যে নানা গোঁজামিল লক্ষ্য করা যায়। দেশবন্ধুর হত্যার পর একবার ‘সকলে’ ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিলেও এ কারণেই হত্যার ষড়যন্ত্রের সময় নিজেদের মধ্যে ও হত্যাকাণ্ডের সময় ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দেয়। ‘কাব্যনাট্য সংগ্রহে’ অন্তর্ভূুক্তির সময় তিনি এর কিছুটা ‘পরিমার্জন’ করলেও সামগ্রিক গোঁজামিলকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি, কারণ এটি ছিল নাট্যকারের সামগ্রিক দৃষ্টি ও দর্শনেরই অংশ।

সেকারণে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-এর সতেরো গ্রাম সম্পর্কিত ভ্রান্তি অন্যভাবে নাট্যকারের উপন্যাস ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’এ-ও পরবর্তীকালে লক্ষ্য করা যায়। উপন্যাসের এ উদাহরণ থেকে নাট্যকারের ভ্রান্তি অধিকতর স্পষ্ট হবে। ১৯৭১-এর এপ্রিলে যখন ‘আকাশবাণী থেকে শোনা গেল যে ঢাকার পথে পথে লড়াই চলছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে, আত্মগোপন করে শেখ মুজিবুর রহমান বিপ্লবী বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন’ তখনও ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’র প্রধান চরিত্র মহিউদ্দিনের সমস্ত বিষয়টিকে ‘শহরের যুবাদের বার্ষিক নাটকে’র অতিরিক্ত কিছু বলে মনে হয় নি।’ আমরা আরো বিস্মিত হই এই কারণে যে বাঙালিরা যখন পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাত পার হয়ে আরও কঠিন দুঃসময়ের মুখোমুখি তখন একটি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপকের কাছে তা বার্ষিক নাটকের মহড়া মাত্র। পঁচিশে মার্চ-পূর্ব উত্তাল গণজাগরণের দিনগুলোতে ইতিহাসের এই অধ্যাপক কি অন্ধ ও বধির হয়েছিলেন? মহিউদ্দিন যে কলেজে অধ্যাপনা করতো সেটি কি বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ ছিল?২৬ তার এই ‘নির্লিপ্ততাকে কি মানসিক সুস্থতার লক্ষণ বলে মনে করা যায়? মুক্তিযুদ্ধে মহিউদ্দিনের একটি পরিকল্পনায় এই সংশয় বরং দৃঢ়তর হয়েছে। সে পরিকল্পনা করেছে তার আধ্যাত্মিক পূর্বপুরুষ সৈয়দ কুতুবউদ্দিনের মাজার সম্পর্কে এমন একটি ধারণা প্রচার করবে যার ফলে দখলদার পাকিস্তানী সেন্যরা তা খনন করে গণক্রোধের শিকার হবে। সে ঠিক করেছে এটা প্রচারের ব্যবস্থা করবে যে, সৈয়দ কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর অসিয়ত মত তাঁর সঙ্গে দাফন করা আলখাল্লায় প্রচুর হীরে জহরত ছিল যা তিনি সম্রাট আকবরের দিল্লীর দরবার থেকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না, মুক্তিযুদ্ধে এ মিথ্যাচারের কী প্রয়োজন ছিল? জনচিত্ত বা তার ক্রোধকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে মিথ্যাচারেরই বা প্রয়োজন হবে কেন? যে জনগণ ছিল পাশবিক নির্যাতনের প্রত্যক্ষ শিকার তার ক্রোধ থেকেই কি মুক্তিযুদ্ধের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয় নি? অথবা পাকিস্তানীরা কি ঐ সময় এদেশের জনগণের ওপর যথেষ্ট নির্যাতন করে নি যে তাদের বিরুদ্ধে জনগণকে প্ররোচিত করবার জন্য ঐ রকম একটি ‘পরিকল্পনা’র প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল? সত্যি বিভ্রান্ত না হয়ে উপায় নেই। নাকি মহিউদ্দিন একটি অনন্য ও ব্যতিক্রমী পরিকল্পনার মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে নি বলেই এরকম একটি ইতিহাস ও তথ্য-বিচ্যুত ও বৈরী সিদ্ধান্ত নিতে নিজেই নিজেকে ‘উদ্বুদ্ধ’ করেছে? নাকি এ সিদ্ধান্ত স্বয়ং লেখকের, মহিউদ্দিন তার বাহক মাত্র?

আমাদের এরকম মনে হওয়ার কারণ তাঁর নূরলদীনের সারাজীবন-এর প্রথম মঞ্চায়ন উপলক্ষে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় প্রকাশিত স্যুভেনিরে নাট্যকার নূরলদীনের ‘স্বেচ্ছামৃত্যুকে (যদিও ইতিহাসে এর কোনো সমর্থন নেই) মিথ নির্মূলের উপায় হিসেবে নির্দেশ করেন। এ বিষয়ে ঐ সময়েই বক্ষ্যমান প্রবন্ধের প্রবন্ধকার আপত্তি উত্থাপন করে লিখেছিলেন, “নূরলদীনকে ঘিরে জনচেতনার বা তার স্ত্রীর মনে মিথ গড়ে ওঠার সুযোগ কেন হলো, আর হলোই যদি নূরলদীন অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট করতে পারলেন না কেন, যেখানে আব্বাসের মত (যুক্তিনিষ্ঠ) বন্ধু তার সহগামী? নাট্যকার লিখেছেন, ‘নবাব ঘোষণা করবার পরপরই তিনি ইংরেজবাহিনীকে সরাসরি আক্রমণ করেন এবং পরিণামে শহীদ হন, আমার কাছে মনে হতে থাকে এ তাঁর আত্মহত্যাই বটে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর পেরিয়ে যিনি এসেছেন, নবাব জমিদার মহাজনদের পৈশাচিক ভূমিকা যিনি লক্ষ্য করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ সিপাহীর মতো অস্ত্র ধরেছেন তিনি নিশ্চয়ই সৈন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নবাব এর দম্ভ দেখাতে নয়- আরো একজন নবাব তাঁর নিজেকেই নির্মূল করবার জন্য।’ এ মন্তব্য শেষে তিনি নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘অথবা তাই কি?’ আমরা বলি, না, তা নয়, কারণ স্বেচ্ছায় আত্মাহুতির রোমান্টিকতা একজন গণনায়কের থাকার কথা নয়। নয়, কারণ নূরলদীন ও নাট্যকার উভয়েরই জানার কথা, মৃত্যু মিথ তৈরিতেই বরং অধিকতর সাহায্য করে, নির্মূল করতে একেবারেই নয়।”২৭

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-এর রচনাকাল- ‘১ মে- ১৩ জুন, ১৯৭৫’, আর গণনায়ক- ১৩ জুন, ১৯৭৫-২৭ ফেব্র“য়ারি, ১৯৭৬।’ দুটি নাটকই লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড-এ লেখা। দেখা যাচ্ছে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় শেষ করে সেদিনই তিনি গণনায়ক লিখতে শুরু করেন। কিন্তু এই ‘বিবেকের পালা’টি লিখবার জন্যে নাট্যকার কেন এত অস্থির হয়ে উঠেছিলেন, বোঝা যায় না। তিনি কি আশংকা করেছিলেন বাংলাদেশে সামরিক শাসন আসন্ন? তা যদি নাও করে থাকেন ঐ নাটকটি লিখবার সময়ই সপরিবারে শেখ মুজিব অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগষ্টের দীর্ঘদিন পরে, পরের বছর ২৭ ফেব্রুয়ারিতে নাট্যকারের কাছে সানাউল্লাহ কিভাবে ইতিহাসের ইতিবাচক চরিত্র হতে পারে সেটাই আশ্চর্যের! বোঝা যায়, নাটক দুটি রচনার সময় স্বদেশ ও তার বাস্তবতা থেকে শারীরিকভাবেই শুধু নয়, মানসিকভাবেও তিনি অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন।

এই দূরত্ব, আগেই উল্লেখ করেছি, দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনের। সেকারণে নাটককে যিনি ও যাঁদের দল বিনোদনের পরিবর্তে ‘শ্রেণী সংগ্রামের সুতীক্ষè হাতিয়ার’ বলে মনে করে, সেই ‘আরণ্যকে’র মামুনুর রশীদের সমতট-এ তার পরিচয় পাওয়া যায় না। আশিকের সঙ্গে তার পরিবারের যে দূরত্ব রচিত হয়েছে তা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সারা দেশেই তা ব্যাপ্ত, বিচ্ছিন্ন সে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা থেকে। সেজন্যে পনের বছর পরিবার-বিচ্ছিন্ন থেকেও সে ভাবে তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পূর্ণ অক্ষত থাকবে, যখন সমস্ত দেশ ও তার পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঘটেছে। ফলে সত্যের মুখোমুখি হয়ে তার সমস্ত বিপ্লবীয়ানা ধ্বসে পড়ে এবং সে ছিচকাদুনে মধ্যবিত্তে পরিণত হয়। সমতট’র বিরাট প্রেক্ষাপট এভাবে নাট্যকারের হাতে অপচিত হয়। একই কারণে পাথর’র হৃদয়টি দ্রবীভূত করলেও এর রাজনৈতিক দৃষ্টি ও দর্শন অস্বচ্ছই থাকে। যেমন অস্বচ্ছ জয়জয়ন্তী’র চরিত্রসমূহের প্রতীকায়ন ও ঐতিহাসিক অবস্থান। একইভাব মমতাজ উদদীন আহমদের হাস্য লাস্য ভাষ্য-এ শেক্সপীয়র, বোকাসিও, রূপকথা, লোককথা মিশে এমন নাট্যদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় নি যাতে ‘কারণ ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না, কারণ ছাড়া রাজাকার রাষ্ট্রপতি হয় না’র কোনো সমর্থন পাওয়া যায়। মান্নান হীরার একজন লক্ষিন্দর-এ-ও ফতোয়াবাজ মৌলনা যখন লক্ষিন্দরের মীথকে আশ্রয় করে তখন বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। শিল্প madness e‡U, wKš there is method is't.

নয়
সমাজে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব পরিশ্র“ত ও শিল্পিত হয়ে নাট্যে রূপায়িত হয়। নাট্য সাহিত্য তথা নাটকের পাণ্ডুলিপি এর প্রধান উপায় ও বাহন। কিন্তু সে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বাংলাদেশের সাতাশ বছরের নাট্য চর্চার ধারাবাহিকতায় তা নানাভাবে প্রকাশিত। আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশের একটি পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধোত্তর নাট্য সাহিত্য ও নাট্যচর্চা দানা বাঁধে, কিন্তু ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার থেকে সে সংগ্রহ করে তার রূপ, রস ও শক্তি। এক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের প্রকৃত রূপায়ণে ত্র“টি ঘটলে শক্তিমানকেও যে সে ক্ষমা করে না তা আমরা দেখেছি। আর দ্বন্দ্বের প্রকৃত রূপায়ণের জন্যে প্রয়োজন সঠিক দৃষ্টি ও দর্শন। খণ্ডিত দৃষ্টির পরিবর্তে দরকার সামগ্রিকতার বোধ ও অনুভব। সে যেমন তৃণমূলে যাবে তেমনি খুঁজে নেবে ও আবিষ্কার করবে প্রকাশের উপর্যুক্ত মাত্রা ও আঙ্গিক। বাংলাদেশের সাতাশ বছরের নাট্যচর্চার বিষয়ে যেমন হতাশ হওয়ার, তেমনি আত্মসন্তুষ্টিরও কোনো সুযোগ নেই। কারণ দ্বন্দ্ব নির্মোহ। কিন্তু সেইসঙ্গে তার দুটি চোখ এক তৃতীয় নয়নের জন্ম দেয়। বস্তুকে, বাস্তবতাকে যে যথাযথ দেখে, কিন্তু সৃজনশীলতায় তার রূপান্তর ঘটে।

সাতাশ বছরে বাংলাদেশের নাটক তার সম্ভাবনা ও সংকটের একটি পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকেই তাকে তার ভবিষ্যতের পথ খুঁজে নিতে হবে।

তথ্যসূত্র ও টীকা:

১.    পালাগানটি সংগ্রহ করেন বাংলা একাডেমী নিয়োজিত লোক-সংগ্রাহক মোহাম্মদ সাইদুর। এটি ‘কিশোরগঞ্জের নিকলী থানার গোপদীঘি ডাকঘরের এলাকাধীন ইব্রাহিম মিয়ার কাছ থেকে সংগৃহীত।’ পালাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় ইব্রাহিম মিয়ার বয়স ছিল ষাট বছর। তাঁর পিতা জহির মামুদ তিরিশ-পয়ত্রিশ বছর আগে স্বগ্রামের কাউছার বাপ বয়াতীর কাছ থেকে পালাটি শেখেন। সে সময় বয়াতীর বয়স ছিল পঞ্চাশ-ষাট বছর বোঝা যায়, বংশ ও যুগ-পরম্পরায় এ ধরনের পালা ঐ অঞ্চলে ও পূর্ব বাংলায় প্রচলিত ছিল। এর গায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে যে জানা যায় ‘গানের মধ্যে বিশিষ্ট চরিত্রের ভূমিকা নিয়ে গায়েন প্রশ্ন করে এবং দোহারও প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিয়ে সে প্রশ্নের উত্তর দেয়। একটি সম্পূর্ণ পালাগানের যতগুলি চরিত্র স্বাভাবিকভাবেই গানের আসরে সেই সংখ্যক দোহার থাকে না বলে হয়ত একই বা দুজন দোহার গায়েনের সবরকম জিজ্ঞাসার জবাব দেয়। ... একই পালাগানের অন্তর্ভুক্ত চরিত্রের প্রয়োজন অনুসারে গায়েনের কন্ঠ কখনও তেজোদৃপ্ত কঠিন হয়, আবার কখনও হয় কোমল-মমতা, প্রেম এবং øিগ্ধ সহানুভূতি যার ঐশ্বর্য। পালাগানের ক্ষেত্রে ত্র“টি বিশেষ লক্ষণীয় যে, কন্ঠের সঙ্গে শ্রোতার মনও অনবরত সহিষ্ণু, প্রতিবাদমুখর কিংবা সজল হয়ে আসে। একই কন্ঠে আসে নায়িকার করুণ আর্তনাদ এবং সমাজের কাঠোর অনুশাসন, আসে শ্রোতার আনন্দাশ্র“র উপাদান। মাঝে মাঝে দোহারের কন্ঠ সংযোগে সমস্ত বিষয়টি আরো উপভোগ্য হয়ে ওঠে’ কিংবা ‘অনেক ক্ষেত্রে কথোপকথন ছাড়াও গদ্যে বর্ণনা আছে, সেখানে গদ্যে বর্ণনা প্রসঙ্গে বিশেষ একটি সুর সঙ্গতি করা হয়’ তাতে বোঝা যায় পালাগান নাট্যের চেহারা নিত এবং তৃণমূলে ঐ ভূমিকা, সীমিতভাবে হলেও, পালন করতো।
    দ্রষ্টব্য: ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ প্রকাশ প্রসঙ্গে ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যার কথা’ ও ‘মৈমনসিংহ গীতিকায় পালাগান অনুষ্ঠানের পদ্ধতি’, গ্রুপথিয়েটার, ফেব্রু-এপ্রিল, ১৯৮৯, কলকাতা
২.    ‘প্রকৃত বন্ধু’র ভূমিকা প্রসঙ্গে এর নাট্যকার ব্রজেন্দ্রকুমার রায়, উদ্ধৃত তৃতীয় অধ্যায় ব্যবসায়ী কবলিত মঞ্চের নতুন মাত্রা গিরিশচন্দের অভ্যুদয়। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাট/পুলিন দাস, কলকাতা
৩.    বাংলাদেশের নাটক সৈয়দ শামসুল হক/ একুশের প্রবন্ধ, ১৯৮৫, বাংলা একাডেমী, ঢাকা
৪.    বর্তমান লেখকের ‘কাব্যনাটক’, এক (অধ্যায়); ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালা বাংলা একাডেমী, ঢাকা
৫.    When Limitation is a Freedom, The world of theatre, 1990-92, International Theatre Institute: Bangladesh
৬.    মুনীর চৌধুরীর কবর, মমতাজউদদীন আহমদ, থিয়েটার (রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত), ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭, ক্রোড়পত্র, ঢাকা।
৭.    Theatre under the shadow of gun, Prison theatre twpin, the third Wold popular theatre Newsletter Caribean edition, জানুয়ারি, ১৯৮৩
৮. ৯.    সংস্কৃতিপত্র ‘পারাপার’ (১৯৭১)-এর পক্ষে আলী ইমামকে দেয়া সাক্ষাৎকার
১০.    বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য-পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (দ্বিতীয় খণ্ড), বদরুদ্দীন উমর, ঢাকা।
১১.    একটি মারমা রূপকথা-র ভূমিকা/সাংস্কৃৃতিক অনুষংগ, বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসী অংশীদারীত্বের নতুন দিগন্ত/অক্টোবর, ১৯৯৩, হাফিজ রশীদ খান সম্পাদিত, বান্দরবন, চট্টগ্রাম
১২.    গ্রুপথিয়েটার জেলায় জেলায় : গ্রুপথিয়েটার আন্দোলনে চট্টগ্রামের পনের বছর- কুমার প্রীতীশ বল/ থিয়েটার, প্রাগুক্ত, মার্চ, ১৯৮৯, ঢাকা।
১৩.    ‘কাব্যনাট্য সংগ্রহ’-এ গণনায়ক-এর ‘সবিনয় নিবেদন’ এবং নাটকটি বাংলা একাডেমীর ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র ‘উত্তরাধিকার’-এ (জানুয়ারি-মার্চ, ১৯৮৩), প্রকাশ উপলক্ষে নাট্যকারের ‘সবিনয় নিবেদন’
১৪.    Cultural Interaction in Theatre through Directors and Designers: A Third wold View, Shilpakala: Volume VI, 1994, Bangladesh Shilpakala Academy, Dhaka
১৫.    জন্ম ও বাল্যজীবন: শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা, সম্পাদক আনিসুজ্জামান, ঢাকা।
১৬.    বাংলাদেশের যাত্রা- অতীত ও বর্তমান, থিয়েটার, প্রাগুক্ত জুন, ১৯৮৭, ঢাকা।
১৭.    কিছু কথা, কিছু স্মৃতি: অমলেন্দু বিশ্বাস, থিয়েটার, ক্রোড়পত্র, থিয়েটার, প্রাগুক্ত; ডিসেম্বর, ১৯৮৭
১৮.    থিয়েটারের ভাষা ও দি থার্ড থিয়েটার, কলকাতা
১৯.    Towards a poor theatre/ Jerzy Grotowski, NewYork, USA
২০.    ২৩ বর্তমান লেখকের ‘আরণ্যকের মুক্ত নাটক’, সচিত্র সন্ধানী, ৩১ অক্টোবর, ১৯৮২; ঢাকা
২১.    ‘গাজীর গান: জামাল কামালের পালা’র শ্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনির, উদ্ধৃত ‘গ্রাম থিয়েটার: একটি বিকল্প পাঠশালা’/ সাজেদুল আউয়াল: থিয়েটার, প্রাগুক্ত, জুন, ১৯৮৭
২২.    বিস্তারিত বিবরণের জন্যে দ্রষ্টব্য: রবার্ট ব্রাস্টেইনকে আশ্রয় করে বর্তমান লেখকের ‘বিদ্রোহী নাট্যতত্ত্ব ত্রয়ী নাট্যকার’/ বিদ্রোহী নাট্যতত্ত্বের ত্রয়ী নাট্যকার ও তাঁদের প্রাসঙ্গিকতা’ বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
২৪.    নির্মোহ মূল্যায়ণে অন্যান্য বাধার সঙ্গে এটিও একটি উল্লেযোগ্য বাধা যে ‘বাদলবাবু নিজেও এই ব্যাপারটিতে স্পর্শকাতর।’ তৃতীয় থিয়েটার ও বাদল সরকার/ অভিজিৎ কর গুপ্ত, চতুরঙ্গ, এপ্রিল, ১৯৮৭, কলকাতা
    ১৯৯৫-র ৮ অক্টোবর কুমিল্লায় বাদল সরকারের মত বিনিময় অনুষ্ঠানে এই ‘স্পর্শকারতা’ আমিও লক্ষ্য করেছি
২৫.    অধুনা, জুলাই, ১৯৮৬ উপদেষ্টা সম্পাদক: শামসুর রাহমান, ঢাকা
২৬.    ১৯৯৮-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’র অখণ্ড সংস্করণে পত্রিকায় ও দু’খণ্ডে বেরুনো অসম্পূর্ণ ‘খসড়া’টিকে ‘নাকচ’ করলেও লেখকের ঐ প্রবণতা ও দর্শন মিথ্যে হয়ে যায় না
২৭.    সচিত্র সন্ধানী, ২ জানুয়ারি, ১৯৮৩, ঢাকা


শান্তনু কায়সার : অধ্যাপক, লেখক