Full premium theme for CMS
কথাহংসবতী
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[শিমূল ইউসুফের ৫০ এবং বিনোদিনী-র ৫০- আমাদের সবার উষ্ণ শুভেচ্ছা]
তিনি বিনোদিনী মঞ্চে এসে দাঁড়ান- একটি অগ্নিকণা ও অশ্রুবিন্দুর সম্মিলন ক্রমান্বয় উন্মোচিত হয়। অভিনয়ে বৈভব, অন্তর্গত বেদনা, ব্যক্তি ও শিল্পজীবনের সঙ্কট আর অনিবার্য দোটানার নৃত্যে, কথনে, অভিনয় সপর্যায় একবিংশ শতকের দর্শকের সামনে নতুন শক্তি ও ভঙ্গিমার উদ্ভাসন ঘটে। যিনি এই মঞ্চকাব্যটি উপস্থাপন করেন তাঁকে কী কিছুটা জেদি আর নিঃসঙ্গ মনে হয়? খানিকটা নিঃসঙ্গ বটে কিন্তু মোটেও বিপন্ন নয়। তিনি অধুনাকালের বিনোদিনী যোদ্ধা- প্রাণপণ এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের শিবিরে, মাঝে মাঝে চোরাবালিতে পা আটকে যায়; অথবা তিনি জয়নুল আবেদীনের সেই গাড়োয়ান, যিনি কাদায় আটকে যাওয়া চাকাটি সচল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন! আশেপাশে বন্ধুদের কাউকে তেমন ঠাহর করা যাচ্ছে না- সবাই বুঝি ঘন কুয়াশার পলেস্তারার পিছনে আটকা পড়ে গ্যাল!
তিনি শিমূল ইউসুফ। যিনি শুরু করেছিলেন আল মনসুরের বিদায় মোনালিসা নাটকে সূর্য চরিত্রে অভিনয়ের সূত্রে। তিনি ত্রিভূজের একটি বাহু- সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দিন ইউসুফ এবং তিনি নিজে, শিমূল ইউসুফ। সৈয়দ জামিল আহমেদ ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে লাগাতার যুক্ত থাকেন নি, কিন্তু আজকের ঢাকা থিয়েটার ঘরানা তৈরি হবার ক্ষেত্রে তাঁর তৎপরতার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। অন্যদিকে সাজেদুল আউয়াল ফণিমনসা-র মাধ্যমে এক আদি কৃষকের বীজ বপন করেছিলেন। তাঁরা শুরু করেছিলেন হিরন্ময় দীর্ঘ ও মৌলিক একটি সমন্বয়ের ভিতরে; সেখানে আরো ছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আল মনসুর, হাবিবুল হাসান, জহির উদ্দিন পিয়ার, আফজাল হোসেন, নায়লা আজাদ নূপুর, হুমায়ূন ফরীদি, সুবর্ণা মুস্তাফা, শতদল বড়ুয়া, বিলু এবং অন্য অনেক তারুণ্যভার বিচলিত নাম। সবাই মিলে যে প্রতিষ্ঠান তাঁরা গড়ে তোলেন তার নাম ঢাকা থিয়েটার। ক্রমান্বয় পূর্ববাঙলার স্নিগ্ধতা, স্বপ্নসম্ভব দূরাভিগামী সংকেত, সর্বোপরি রবীন্দ্র-অভিজ্ঞান মিলে মিশে এই প্রথম বাঙলা নাটকে কবিতার সমকক্ষ একটি রেখা দেখতে পাই।
ঢাকা থিয়েটার তাঁদের কাজে প্রতীচ্য থিয়েটারে ঘটনার আকস্মিকতা, পরিচ্ছেদ ও অঙ্ক বিভাজনে শ্বাসরুদ্ধকর চাক্ষুষ নাটকীয় মুখোমুখিতা পরিহার করে বাঙলা মৌলিক নাটকের কৃষিকাজ- নৃত্য, গীত ও কাব্যনির্ভর বিস্তার তুলে ধরেন। মঞ্চের চার দেওয়াল ভেঙে তাঁরা একের পর এক নির্মাণ করে যান চলমান মঞ্চ ভাস্কর্য। সুবিশাল এই কর্মযজ্ঞে শিমূল ইউসুফ আধুনিক থেসপিস- এক মৌলিক মুখপাত্র, যিনি নৃত্যে, সঙ্গীতে, পরিচ্ছদে সর্বোপরি অভিনয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন এক সামান্য ঘরে অসামান্য দ্যুতি; মঞ্চ, কাঠ, সুড়কি ডিঙিয়ে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যান সীমা ছাড়ানো দিগন্তে যা সতত কল্লোলে ধাবমান- একাকার বিভাজনের দাপট; তিনি অন্তর্লীন দিব্য কোটরে হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালা আমাদের ছুঁইয়ে দেন নৈঃশব্দ্যের মধু।
তিনি সত্যিই ডোম্বী নাম পারানি মাঝি যে-মত ন নৈরামণি নাটকে দখল করেন সদা নৌকার গলুই। অনেক গৃহী সওদা করে মিশে যান আলো ঝলোমল অন্ধকারে; কিন্তু শিমূল ইউসুফ এখনো আছেন নৌকার গলুইয়ে অধিষ্ঠিত- তাঁর অনেক সংলাপ, সুর, নৃত্য ও অভিনয়ের মাধুরী বাঁকা জলের সহজ স্বভাবে আমাদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে আসে। তাঁর অবস্থিতি প্রতিশ্রুতিশীল নৈঃশব্দ্যের মধ্যখানে, যেমন ছিলেন বিদায় মোনলিসা-য়; আমরা প্রতিক্ষণ প্রতীক্ষায় থাকি কখন শুনবো আবার মঞ্চমধ্যে সেই বৃংহতি- তা’ সে ন নৈরামণি হোক, নিমজ্জন কিংবা স্বর্ণ বোয়াল, অথবা যদি মঞ্চের মুখ দ্যাখে হরগজ- আর তিনি অবিকল্প যদি নাট্য পালাটির নাম হয় বিনোদিনী। নৃত্য, সঙ্গীত আর অভিনয়ের এমন ত্রিবেণীযোগ কেবল একটি নামেই পাওয়া যাবে- তিনি শিমূল ইউসুফ।
সৃষ্টি পরম্পরায় এক পর্যায়ে এসে ঢাকা থিয়েটার থিয়েটার গ্রুপ আর থাকে নি- গ্ল্যামার ফ্যাক্টরির পরিণতি লাভ করে; সেই ফ্যাক্টরির মধ্যেও একটি নাম বেঁচেবর্তে যায়, তিনিই শিমূল ইউসুফ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর ভিত্তি, চারুকলায় আগ্রহ ও অধিকার, সর্বোপরি লৌকিক নানাবর্ণ অভিনয় আঙ্গিক, হাশেম আলী বয়াতীর হাস্তর গান, গাজীর গানের হাকিম আলী গায়েন, ম্যাকবেথ, রাজা ইডিপাস-র অভিনয় সূত্র, ময়মনসিংহের লেটোগান, সর্বোপরি মাথার ওপর ধার্যকৃত রবীন্দ্রনাথ- এসব মিলেমিশে শিমূল ইউসুফের ভিতর গড়ে ওঠে এক প্রকৃত অভিনয়ের ইশকুল। এভাবেই তিনি অভিনয়ে নাগালে আনতে চান কবিতা ও সঙ্গীতের বিমুর্ত পাতালযোগ। ফলে তাঁর নিষ্ঠাবান নির্মাণ উদ্যোগ প্রত্যক্ষ করি বিদায় মোনালিসা-র সূর্যে, মুনতাসির ফ্যান্টাসি-র পার্সোনাল অ্যাসিসট্যাষ্ট অথবা নার্স, শকুন্তলা-র গৌতমী, কিত্তনখোলা-য় ডালিমন, কেরামতমঙ্গল-এ শমলা, হাত হদাই-এ চুক্কুনি, যৈবতী কন্যার মন-এ কালিন্দি, চাকা-য় কথক, বনপাংশুল-এ সুকি, প্রাচ্য-এ আবারো কথক, কী বেউলা কী কনিকারাণী, ন নৈরামণি-র ডোম্বী, গ্রন্থিকগণ কহে টিভি সিরিয়ালে যাত্রাদলের মেয়ে, পরিশেষে বিনোদিনী-র বিনোদিনী রূপে আমরা শিমূল ইউসুফকে পাই; নাচাও রাস্তা নাচাও আন্দোলনে তাঁকে চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে দেখি।
যে-কেউ উপর্যুক্ত এ তালিকায় বৈচিত্র্য দেখে বিস্ময় মুগ্ধ হবেন। একজন অভিনয় শিল্পীর তৃষ্ণা কানায় কানায় পূর্ণ হবার কথা, কেননা আমরা জানি বৈচিত্র্যই শিল্পীর প্রকৃত আহার। প্রতিটি চরিত্র রূপায়ণে তাঁকে দেখি পরম নিষ্ঠায় বিন্দুবিন্দু বেদনা যুক্ত করছেন, কী মিশিয়ে দিয়েছেন কুমারের মূর্তি গড়ার বিচলিত হস্তরেখা। যীশুখ্রিস্টের অসীম মমতায় তিনি নিষ্প্রাণে অঙ্গুলি স্পর্শ করে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন প্রাণ। তাঁর সংলাপ, সঙ্গীতে, উদ্বেগ, উৎকন্ঠায় আর কথা বৈভবে আমাদের প্রাণে জেগে ওঠে বর্ষার প্রথম জলে কৈ মাছের উজান, মেঘের ভিতরকার কালো আগুনে দুন্দুভি বাজে। তথাপি তাঁর শক্তির সাকল্য মাঝে মাঝে এক কিনারে এসে শ্রান্ত হয়ে পড়ে; তাঁকে বিরামহীন বলে যেতে হয় ব্যক্তিত্বহীন এক পদ্যভাষা, ভাবালুতানির্ভর এক কিসিমের নিষ্প্রাণ বিবৃতি- ওঝার শত মন্ত্রেও লখিন্দর চোখ মেলে না।
সঙ্গীতে তাঁর সহজ অধিকার নাট্য দর্শকের জন্য এক দুর্লভ প্রাপ্তি। মুনতাসির ফ্যান্টাসি থেকে বিনোদিনী নাটকে বারবার আমরা তাঁর সুরের প্রসবন্মোত হই। সম্প্রতি মুনতাসির ফ্যান্টাসি থেকে ‘ফ্যান্টাসি’ এবং চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি থেকে ‘ডকুমেন্টারি’ শব্দ দু’টি কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। তা-কে জাতীয় নাট্যআঙ্গিক নির্মাণের লাস্যযাত্রার আনন্দে সিরাতুল মোস্তাকিম কায়দায় জাতীয়তাবাদী বাঙালি সংস্কৃতিজাগরী এক তড়িঘড়ি খাৎনাপর্ব ছাড়া আর কী-ই-বা বলা যেতে পারে!
শিমূল ইউসুফে এসে একাত্তরকে তাঁর প্রকৃত পাথেয় দেখি। তাঁকে প্রতিমুহূর্ত তাড়া করে ফেরে মুক্তিযুদ্ধের সেই দুঃসহ স্মৃতি: পাকিস্তানী আর্মি আলতাফ মাহমুদকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বেধড়ক পেটাচ্ছে- তিনি জানালা থেকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছেন- কখনো সেই মুখ তিনি সরিয়ে আনতে পারেন না; নিঃশ্বাস আটকে যায়, চারদিক থেকে ঘিরে আসে খাণ্ডবদাহন। পিছনে আলতাফ মাহমুদ, সামনে নাসির উদ্দিন ইউসুফ; মাঝখানে তাঁর ওপর নিমজ্জনের বিপুল ভার। তিনি বুঝি শিউরে ওঠেন! সেই সর্বনাশের খাঁড়ায় দ্বিখণ্ডিত হয়ে শিমূল ইউসুফ নিবেদন করেন কিছু গানের নৈবেদ্য যা পরবর্তী সময়ে বেরোয় ‘মাটির জায়নামাজ’ নামে গানের সংকলনে। যেখানে অনুমান করি শিল্প বোধের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে দায়িত্ব চেতনা। ফলে সেখানে শিল্পের উত্তাপ ও সংশয় খুঁজে পাওয়া ভার। বাজারি অন্য দুই দশটি সংকলনের সঙ্গে তার পার্থক্য কোথায়? এখানে তিনি শিল্পীর স্থাপত্য থেকে নেমে আসেন সংস্কৃতিকর্মীর কাতারে। আমরা তাঁর সব কাজে দেখতে চাই শিল্পের জারক। মুক্তিযুদ্ধের গান যদি শিল্প না হয়ে সংস্কৃতিকর্মের উচ্ছ্বাসে মিলায় তাকে আমাদের খুব বেশি কাজে লাগবে না। আশা করি শিমূল ইউসুফ আমাদের প্রত্যাশাকে নিতান্ত আবদার বলে দূরে সরিয়ে রাখবেন না।
বরং পাতালগামী লালন সাঁই সন্ধানে তাঁর ব্রতযাত্রা বহুদূর সফল। তাঁর লালনের সমস্ত গান সাফল্যের সহবর্তী হয়। অন্য একমাত্র ফরিদা পারভীন ছাড়া আর কাউকেই পাওয়া যাবে না যাঁর সব গান শ্রোতার অন্তর্গত সরোবর স্পর্শ করে। সাধুর রঙে রঙ মিশাবার আকুল ব্যাকুলতা কখনো নাগরিক ফরিদা পারভীন, শিমূল ইউসুফ, সুফিয়া মনোয়ার, অরুন্ধতী চৌধুরী, প্রহলাদ ব্রহ্মাচারী কিংবা আরতী মুখোপাধ্যায়ের গানে বেহাল সাহ, রশিক শাহ, সুখচাঁদ শাহ, কিংবা অমূল্য শাহ’র সমকক্ষতায় পাওয়া যাবে না। কিন্তু লালন সাঁইয়ের গানে যে গায়ন বৈচিত্র্য তার অনেকখানি পাই শিমূল ইউসুফে। ব্রাত্যজনের আর্তিও তাঁর কন্ঠে দেদীপ্যমান দেখি। সুধীর চক্রবর্তী যেভাবে বলেছেন: লালনের গানে মেদিনীপুর বাঁকুড়ায় ঝুমুরের প্রাধান্য; নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী অঞ্চলে কীর্তনের ঝোঁক; পূর্ববঙ্গে ভাটিয়ালি, আর উত্তরবঙ্গে সুরটা ভাওয়াইয়ার দিকে হেলানো- এ সবের শ্রুতিচিহ্ন শিমূল ইউসুফে মাঝে মধ্যেই পাই; সর্বোপরি তাঁর লালন সাঁইয়ের গানে লোক মানসের উদ্দাম অন্য যে-কোনো প্রধান শিল্পীর চেয়েও বেশি অনুভব করি।
আমরা সামান্য কৃষিজীবীগণ দেখি দিনের দিন বুঝি ফুরিয়ে আসে- আশা সিন্ধু তীরে এসে জড়ো হই; তিনি শিমূল ইউসুফ জলপাই বৃক্ষের আয়ু ও শুদ্ধতা নিয়ে এই ঝড়জলখরা বাঙলায় রোদের মুখে তাঁর অদ্বিতীয় সংলাপ ও সঙ্গীতের বৃষ্টিমন্ত্র বলে যাবেন সেই আশার প্রত্যয়ে আমরা অসংখ্য আগ্রহে চোখ আর কান পেতে রই।
বদরুজ্জামান আলমগীর: নাট্যকার। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী