Full premium theme for CMS
স্বপ্নের কাফেলাটি চলছেই
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স্বপ্নের বাংলাদেশের ভাবনা ছিল আকাশ ছোঁয়া। স্বপ্ন তা-ই নয়। দু-এক দিনের স্বপ্ন তো নয়- দীর্ঘদিনের স্বপ্ন একটি আবাসভূমির। যার আবাসভূমি ছিল আক্রান্ত, ভাষা-সংস্কৃতি ছিল আক্রান্ত। সেখান থেকে নানা স্বপ্ন ভঙ্গের জায়গা থেকে স্বপ্ন দেখা। সেই স্বপ্নিল সুন্দরের মধ্যে ছিল বৈষম্যহীন সমাজ, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নগুলো একটা নিষ্ঠুর সশস্ত্র নিপীড়নের মধ্যে পড়ে যায়। উত্থান হয় এক সশস্ত্র আয়োজনের। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, স্বপ্নের স্পর্ধাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু নিত্য নিষ্ঠুরতা, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ষড়যন্ত্র- এসব ক্রমাগত স্বপ্নের সীমানাকে কমিয়ে আনে, এক অসম্ভব বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করায় স্বদেশকে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র- এসব মৌল আদর্শের বিপরীতে উন্মেষ ঘটে সামরিক শাসনের, সাম্প্রদায়িকতার, বল্গাহীন দুর্নীতির। স্বপ্নটা আপাত ছিন্নভিন্ন হলেও আবারও মানুষ জেগে ওঠে। বঞ্চিত-প্রতারিত মানুষের তবু স্বপ্নের শেষ নেই। এ-দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখায় রীতিমত নেশাগ্রস্ত। তার প্রাত্যহিক জীবনটাই আধো জাগরণ, আধো স্বপ্নের। এই স্বপ্ন দেখার জায়গাটাই তৈরি হয়েছে আবহমানকালের কাব্য-নৃত্য, সংগীত আর নাটক থেকে।
বাংলাদেশে স্বপ্ন দেখার একটা জায়গা তৈরি করেছিল এর মঞ্চনাটক। যুদ্ধ থেকে সরাসরি ফিরে এসেই সারা দেশের তারুণ্যের একটা সমাবেশ ঘটেছিল মঞ্চে। পাদপ্রদীপের তীব্র আকর্ষণ কেন সে অনুভব করেছিল, তা যুক্তি বা গবেষণায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলার মানুষের সহজিয়া কাব্যময়তা বা মরমী কোনো হৃদয় এখানে টেনে এনেছিল কিনা, তা-ও প্রমাণ করা যাবে না। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে পিছিয়ে পড়া একটা শিল্পমাধ্যম উত্তরণের অপেক্ষা করেছিল, সেটা একটা কারণ হতে পারে। সেই স্বপ্নের ঘোরেই হয়তো সূচনা থেকে শুরু করে আজ অবধি কোনো বৈষয়িক ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয় নি এ শিল্প। কথা সাহিত্যে কারও কারও অর্থ এসেছে দেদার, চিত্রশিল্পেও আছে বিনিময়। সংগীত আর নৃত্য বিষয় বুদ্ধিতে বেশ পক্ক। চলচ্চিত্র-টেলিভিশন তো এখন অর্থই মুখ্য বিবেচনা, কিন্তু মঞ্চনাটকে তা একেবারেই শূন্য। এর লগ্নি কোথা থেকে আসে, তা বলতে হলে প্রাচীন প্রবাদের আশ্রয় নিতে হয়- ‘ভূতে জোগায়’। এই ভূতের একটা বিশাল জায়গা জুড়ে আছে মঞ্চের শ্রমিকেরা। এরকম উপার্জনহীন শ্রমিক উপমহাদেশ ছাড়া কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রতিবেশী দেশে তা-ও আছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, পৃষ্ঠপোষকতা; এখানে তা-ও নেই। শুধু একদল স্বপ্ন দেখা দর্শকের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে চলেছে এ-শিল্প। এ-শিল্পকে শুধু এগিয়ে চললেই হয় না, একটা বুদ্ধিদীপ্ত সমাজকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। সেই বুদ্ধিদীপ্ত সমাজ সবকিছু মেনে নেয় না; সে তর্ক করে, যুক্তি খোঁজে, কারণে-অকারণে গ্রহণ করে, বাতিল করে। দিন-রাত মানসিক-শারীরিক পরিশ্রম করে, বিস্তর ঋণ করে শিল্পটাকে করুণার পাত্রের মতো দর্শকের সামনে তুলে ধরে এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে। রহস্যময় দর্শক একেকজন দেবতার মতো আসনে বসে রায় দিয়ে যায়। এমনি এক অনিশ্চয়তায় চলছে দুর্লঙ্ঘ্য পর্বতারোহী এক নাট্যসমাজ। পথে কত স্বজন ছিটকে পড়ছে, অসমাপ্ত স্বপ্ন রেখে যাত্রাবিরতি নিয়ে নিচ্ছে, তারও শেষ নেই। বাস্তবের বাংলাদেশের সূচনায় ১৮৭৬ সালের অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের মতো একটা কালাকানুন ছিল। ২৮ বছরের মাথায় তা উঠে গেলেও বেনামে এখনো নষ্ট রাজনীতিক আর আমলাতন্ত্রের হাতের অস্ত্র হিসেবে রয়ে গেছে। নাট্যমঞ্চ সভ্যতার প্রায় সমবয়সী। সেই নাট্যমঞ্চ স্বপ্নে তৈরি হলেও স্থপতির হাত ধরে নির্মাণের দিকে গেল কমই। ঢাকার মহিলা সমিতির অপরিসর মঞ্চেই রইল তার কার্যক্রম। ৩২ বছর পর শুধু রাজধানীতে ২ টি, আর চট্টগ্রামে ১ টি আধুনিক মঞ্চ নির্মিত হলো। সারাদেশের বাকি ১৩ কোটি মানুষ রইল আধুনিক মঞ্চব্যবস্থার বাইরে।
নাটকের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোথায় যেন একটা অদৃশ্য কঠিন বন্ধন রয়ে গেছে। নাটক মুক্তকণ্ঠ, জনগণের কণ্ঠস্বর। তাই যে-কোনো স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় সে প্রথমে লড়াই করতে নাম। সে মিথ্যা বলে না, জনবিরোধী কোনো অভিযানে তাকে পাওয়া যায় না। তাই বাস্তবের বাংলাদেশে তার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কেন মিলল না, তার জবাবটা সহজেই পাওয়া যায়। একটা স্বৈরাচারী, সাম্প্রদায়িক, দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রব্যবস্থায় এ ধরনের একটি সুস্থ, সুশিক্ষিত, গণতান্ত্রিক শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা কেন দেবে? সে তো কাউকেই ছাড় দেবে না। মানুষের বিক্ষুব্ধ হৃদয় আর স্বপ্নের কাছে সে দায়বদ্ধ।
নাটক আবার আন্তর্জাতিক। খুব দ্রুত সে দেশকালের সীমা অতিক্রম করে। কতশত হাজার বছর আগের গ্রীস, রোম, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, আফ্রিকায় কী ঘটেছিল, তার জ্বলন্ত দলিল রয়ে গেছে সে দেশের নাটকে। সেই স্বপ্ন-দেখা মানুষগুলোর অমর সংলাপকে সে তুলে ধরে আজকের মঞ্চে। শুধু তা-ই নয়, সমসাময়িক কালের এক আন্তর্জাতিক সংলাপও নির্মাণ করে সে অবলীলায়। এ ক্ষেত্রে একেবারেই অপরিসর মঞ্চে বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা সৃজনের এক
ফল্গুধারার জন্ম দিয়েছে, যা একেবারেই অবাস্তব। মহিলা সমিতি বা জেলা শহরের মঞ্চে সে এনেছে সফোক্লিস, শেক্সপীয়র, ব্রেশট, ইবসেন, কার্ল সুখমায়ার, গ্যেটে, বিজয় তেন্ডুলকর, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তসহ বিশ্বের প্রায় তাবৎ নাট্যকারের নাটক। বাংলাদেশের মঞ্চেই পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের নাটক অভিনীত হয় নি, এমন ১ টি মঞ্চও বোধহয় এ দেশে পাওয়া যাবে না।
মৌলিক নাট্যরচনায় ভিন্ন ভাবনাও এখন সুস্পষ্ট। শুধু শিল্পের স্বপ্ন আর অনুশীলন করে করে নির্দেশকেরা কেউ কেউ আন্তর্জাতিক মান স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছেন। মঞ্চে যাদের দেখা যায়, যাদের মধ্য দিয়েই ব্যক্ত-অব্যক্ত সব অনুভবের প্রকাশ ঘটে, তারা অভিনেতা-অভিনেত্রী। সূচনায় একেবারেই প্রশিক্ষণ ছাড়া অভিনেতৃর দল আকৃষ্ট করলো দর্শককে। কালে কালে তা আরও ছড়িয়ে পড়লো। একেবারেই দুর্বল জায়গা ছিল আলোকসম্পাত, দৃশ্যপট নির্মাণ, পোশাক- এগুলো। নির্দেশকের ভাবনাই ছিল এসব জায়গায় মুখ্য। কিন্তু বেশি দিন লাগলো না। নির্দেশকের পাশে এসে দাঁড়ালো একদল তরুণ- ভাবনাসমৃদ্ধ ডিজাইনার।
আবার সবটারই শূন্যে বসবাস। অধিকাংশ দলেরই নেই গৃহ, নেই মহড়াকক্ষ। এগুলো ভাড়া করার সামর্থ্যও নেই। সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উল্লেখ করলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। রাজধানী ঢাকার ইস্কাটনে ১ টি স্কুলে অনেকগুলো দল অর্থের বিনিময়ে মহড়া করতো। এতে স্কুলটিরও আর্থিক সুবিধা হতো। পাশেই সরকারি আমলাদের আবাস। এক মহিলা আমলা আপত্তি তুললেন, মহড়ায় তাঁর অসুবিধা হয়। শব্দদূষণ হচ্ছে। অথচ বহুদিন ধরেই সেখানে নির্বিঘ্নে মহড়া চলছিল। কোনো সংকট কখনো হয় নি। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমলাদের চাপে মহড়া বন্ধ করে দিল। অনেকগুলো দলের মহড়া বন্ধ হয়ে গেল। প্রত্যেকরই নাটক চলছিল মঞ্চে। কোথায় যাবে তারা? এ যেন সন্তান-সন্ততি নিয়ে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া কতগুলো পরিবার। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখা হলো, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবর এলো; কিন্তু সরকার নীরব। বিন্দুমাত্র উদ্বেগ দেখা গেল না কোনো মহলে।
ঢাকার বাইরের চিত্রটা দেখা যাক। এক জেলা শহরে এক অব্যবহৃত ভবনে একটি নাট্যদল মহড়া, কর্মশালা করছিল। একটি ভালো নাটকের মঞ্চায়নের পর তাদের ঝামেলা শুরু হলো। হঠাৎ করেই ওই জায়গাটায় একটা ভোকেশনাল স্কুল করার ভাবনা এলো প্রশাসনের কারও মাথায়। এটার ব্যবস্থাপনায় জেলা প্রশাসকসহ কিছু সংস্কৃতিকর্মীও ছিলেন। রাতারাতি সিদ্ধান্ত, এবং উৎখাত। এ সময় একটি দেবোত্তর সম্পত্তির ক্লাবঘরে তাদের ঠাঁই হলো। কিছুদিন পর সেখানেও শুরু হলো ক্লাবের ভেতরের কিছু দুষ্কৃতির ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্র দ্রুত জয় হয়, এবারও হলো। আবারও উচ্ছেদ।
এভাবেই শূন্যে বসবাস করছে সবচেয়ে সৃজনশীল দেশপ্রেমিক এ দেশের অসংখ্য নাট্যদল।
বাস্তবের বাংলাদেশে আর কোনো শিল্প- যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, পরিশ্রমসাপেক্ষ, নিয়মিত অনুশীলন প্রয়োজন- এভাবে লড়াই করে আছে বলে আমার জানা নেই। স্বপ্নের বাংলাদেশের একটা অবকাঠামোকে বুদ্ধিতে নয়, হৃদয়ে ধারণ করেই সে টিকে থাকছে।
রাজধানীকেন্দ্রীকতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজনে এ শিল্প ঘুরে ফিরেছে সারা দেশে। আশির দশকের গোড়া থেকেই এ আয়োজনের শুরু। মুক্তনাটক দল এবং গ্রাম থিয়েটার শত শত গ্রামে তার কার্যক্রম চালিয়েছে। বিশ্বায়নের ব্যাপক দাপটের মুখেও সে প্রবল ধারাটি ক্ষীণ ধারা হয়ে বেঁচে আছে। তবে যে-কোনো গণতান্ত্রিক উন্নয়নে সে আবার শক্তি অর্জন করবে।
মানুষ স্বপ্ন দেখে, আবার স্বপ্ন ভঙ্গও হয়। বাংলাদেশে স্বপ্নভঙ্গের অনেক কারণও ঘটেছে, তবু এই জনপদের মানুষ বারবার স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত। এ দেশের মঞ্চনাটকের সমাজটা বিশাল জনগোষ্ঠীর তুলনায় ততটা বড় নয়। তবু তারা টিনের তলোয়ার নিয়ে মঞ্চে দুর্দমনীয় সাহস দেখিয়েছে, সন্দেহ নেই। সেই স্বপ্নের বাংলাদেশে শূন্যে বসবাসকারী লোকগুলো অন্তত মঞ্চনাটককে একটা স্বপ্নের জায়গায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। জীবনের মোহের কাছে, বিত্তের কাছে, মিডিয়ার আকর্ষণে কেউ কেউ হয়তো দীর্ঘ স্বপ্নযাত্রায় থাকতে পারে নি- তাতে কোনো ক্ষতি হয় নি, দীর্ঘ স্বপ্নের কাফেলাটি চলছেই।
মামুনর রশীদ : নাট্যব্যক্তিত্ব