Full premium theme for CMS
স্মরণ : অভিনয় সম্রাট অমলেন্দু
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
১৩ অক্টোবর, ১৯৮৭। বাংলাদেশের যাত্রাজগতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা নির্দেশক অমলেন্দু বিশ্বাস অবাক করে দিয়ে মারা গেলেন। মুকুট তাঁর মাথায় উঠেছিল বাংলাদেশের অভিনয়, সংস্কৃতি-প্রিয় মানুষের কাছ থেকে। সেই মুকুটহীন সম্রাটের প্রয়াণ দিবস খুব নিরবে এসে চলে যায়। এবারও তাই হলো। ঐ দিন তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন আজকের এবং সেদিনের নাম-করা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিগণ। তিনি ছিলেন আমাদের এক মহান মুক্তিযোদ্ধা। কোলকাতার বিখ্যাত যাত্রাদল ‘নট্ট কোম্পানী’তে নাম লেখালেন। স্ত্রী জ্যোৎøা বিশ্বাস ও সদ্য জন্মানো পুত্র মিঠুকে রেখে শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য নয়, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে অভিনয় পেশায় নাম লেখালেন। গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা ও লালন ফকীর পালায় অসাধারণ অভিনয় করলেন। তাঁর উচ্চারণ, সংলাপ প্রক্ষেপ ও অভিনয় দিয়ে মাতিয়ে দিলেন যাত্রামোদী দর্শককে। বাঙলার পূর্ব ঐতিহ্য বহাল থাকলো। তাঁকে বলা যায় দুই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। বাংলাভাষীদের কাছে তিনি অভিনয় সম্রাট। চলচ্চিত্র, মঞ্চ ও যাত্রামঞ্চ এই তিন শিল্পমাধ্যম মিলিয়ে এখনো কেউ তাঁর কাছে দাঁড়াতে পারলো না।
তাঁর প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, আবদুল্লাহ আল-মামুন, মামুনুর রশীদ, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, শংকর শাওজাল, লিয়াকত আলী লাকী, তারিক আনাম খান প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব। এসেছিলেন চলচ্চিত্র জগতের নায়করাজ রাজ্জাক, ইলিয়াস কাঞ্চন, শহীদুল হক খান, নাজমুল মাসরেক-সহ অনেকে। বেতার থেকে জাকির হাসান চন্দন, শিল্পকলা একাডেমী থেকে এস. এম. মহসিন, টেলিভিশন থেকে কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী, আলাউদ্দিন আহমেদ, মনোজ সেনগুপ্ত-সহ অনেকে। এছাড়াও সমাজের অন্যান্য সংস্কৃতিপ্রেমীরাতো ছিলেনই। অথচ তার পর থেকেই এই অভিনয়-সম্রাট, গ্র“প থিয়েটার, সাংস্কৃতিক জোট কিংবা চলচ্চিত্র সমিতি থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই চরম অবহেলিত।
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের তৎকালীন চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন ইউসুফ শোক বইতে লিখেছিলেন- ‘অমলেন্দু বিশ্বাসের মতো একজন মহান মঞ্চাভিনেতার মহাপ্রয়াণে বাংলাদেশের গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশানের সকল কর্মী শোকাভিভুত। তাঁর মতো সৎ ও প্রতিভাবান মঞ্চ অভিনেতার অভাব আমাদেরকে নিদারুণভাবে পীড়িত করবে। তাঁর সমগ্র অভিনয় জীবন আমাদের কাছে আদর্শ হয়ে থাকবে এবং অনুপ্রেরণা যোগাবে। বাংলার মঞ্চে আমরা অমলেন্দুর মতো আর একজন মাইকেলকে কি পাব?’
এবার দেখা যাক মামুনুর রশীদ কী লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন- ‘অভিনেতা অমলেন্দু বিশ্বাস যাত্রামঞ্চে ও নাট্যমঞ্চে যে অসাধারণ অভিনয়-শৈলী নির্মাণ করেছেন তার কাছ থেকে তরুণ অভিনেতাদের শ্রদ্ধাভরে অভিনয় শেখার ছিল।’
টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ও আবৃতিকার কাজী আবু জাফর সিদ্দিকীর শোক প্রকাশ ছিল এরকম- ‘বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পের অগ্রপথিক ও নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী এবং বাংলা সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সাধক- তুমি ছিলে মহান শিল্পী, পৌরুষদীপ্ত সাংস্কৃতিককর্মী। ... অবহেলিত যাত্রাশিল্পকে তুমি আবার মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করেছ- জানি না যাত্রা শিল্পের কী হবে!’
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পক্ষে আতাউর রহমান লিখেছিলেন- আমাদের মঞ্চের একজন অসাধারণ অভিনেতাকে হারিয়ে আমরা গভীরভাবে শোকাভিভূত।’
গ্রাম থিয়েটর লিখেছিল- আমরা হারালাম আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা।’
কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী তার ব্যথা প্রকাশ করলেন এভাবে- ‘ভিসিআর, সস্তা চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে অমলেন্দু দা’ দেশীয় ও লোকজ সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্যমন্ডিত যাত্রা শিল্পকে আমাদের মাঝে প্রচার করে গিয়েছেন।’
নাগরিক এসব সংস্কৃতিজীবী ছাড়াও তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে সেদিন ছুটে এসেছিলেন, তাঁরই সহযোগী সব যাত্রাদল। ‘যমুনা যাত্রা ইউনিট’ শ্রদ্ধা জানাতে এসে শোক বইতে লিখেছিল- ‘যাত্রালোকের সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্বনামধন্য নট এবং শিল্পীর অভিনয় শিক্ষক শ্রী অমলেন্দু বিশ্বাসের লোকান্তরিত হবার সংবাদে আমরা বেদনা-ভারাক্রান্ত।’
নিউ প্রতিমা অপেরা জানিয়েছিল- যাত্রা জগতের নটগুরু শ্রীযুক্ত বাবু অমলেন্দু বিশ্বাস মহাশয়কে শ্রদ্ধার সাথে জানাচ্ছি অঞ্জলি।’
বঙ্গনাট্য যাত্রা সমাজ শোক বইতে মন্তব্য করেছিল- ‘যাত্রা জগতের স্বনামধন্য নটের পরলোকগমনে আজ বঙ্গনাট্য যাত্রা সমাজ-এর শিল্পীবৃন্দ জানাচ্ছে শ্রদ্ধাঞ্জলি।’
এছাড়াও সমাজের বিভিন্ন স্তরের নেতৃস্থানীয় লোকজন তো ছিলেনই সেই দিনের শোক মিছিলে। নাট্যজন ও যাত্রা শিল্পীদের শোক মন্তব্যে দুটি ভিন্ন মাত্রা চোখে পড়ে। নাট্য জগতের মানুষজন মনে করেন, অমলেন্দু বিশ্বাস ছিলেন অভিনয় জগতের মহান শিল্পী। তাই গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশান তাদের নাট্যোৎসবে অন্তত একদিন যাত্রাপালা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতো। প্রয়াণ দিনে মহিলা সমিতি মঞ্চে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। এমনকি ‘থিয়েটার’ পত্রিকার সম্পাদক রামেন্দু মজুমদার নিজ উদ্যোগে ‘অমলেন্দু বিশ্বাস ক্রোড়পত্র’ প্রকাশ করেছেন। আর যাত্রা জগতের শিল্পীরা মনে করেন, তিনি ছিলেন একান্ত তাদের নিজেদের লোক। যাত্রা জগতের মহান পুরুষ, অভিনেতা, নির্দেশক ইত্যাদি। তাই পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে অভিনয়কালে তাঁরই শিষ্য সুলতান সেলিম যাত্রাদলের সাজঘরে যাত্রা সম্রাটের ছবি টানিয়ে রেখেছেন এবং প্রতিদিন শিল্পীরা মঞ্চে ওঠার প্রাক্কালে ঐ ছবিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন।
যাত্রা শিল্প ক্ষয়িষ্ণু শিল্প। কারণ, তার অভিভাবক নেই। আইটিআই-র অতিথি এলে যাত্রা জগতের লোকদের ডাক পড়ে। যারা বিদেশী, তারা আধুনিক থিয়েটার দেখতে চান না। বাংলাদেশের লোকনাট্য যাত্রাভিনয় তাদের সামনে উপস্থিত করাতে তাই সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ বোধহয় বাধ্য হয়েই অপাংক্তেয় যাত্রা শিল্পীদের তখন ডাকেন। এখানে উল্লেখ করতে হয়, অভিনয়সম্রাট বেঁচে থাকতে নগর নাট্যকারদের দ্বারা দেশীয় ঐতিহ্যের পালা রচনা করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেবল বাকশিল্পী নরেণ বিশ্বাস গোর্কীর মা এবং মামুনুর রশীদ এখানে নোঙর পালারূপে তাঁকে দিয়েছিলেন। আর কোনো নগর নাট্যকারকে এ-কাজে তাঁকে সহযোগিতা করতে পাওয়া যায় নি। একি তবে আমাদের ভদ্রলোকচিত উন্নাসিকতা?
ভদ্রলোকদের জন্য অমলেন্দু বিশ্বাস ‘চারণিকা যাত্রা সমাজ’ ছাড়াও আরেকটি লাইসেন্স করেছিলেন- ‘চারণিকা নাট্য গোষ্ঠী’। সেখানে আমাদের মতো ভদ্রলোকের চোখে আঙ্গুল দিয়ে মহামতি লেনিন, এডলফ হিটলার, মাইকেল মধুসূদন, মহিয়ষী কৈকেয়ী, জাহান্দার শাহ পালা নির্বাচন করেছিলেন। এদেশের ঘুণেধরা সমাজটাকে ভাঙার জন্য পশ্চিমবঙ্গে রচিত পালাগুলো মঞ্চায়ন করতেন। কারণ, তিনি মনে করতেন, সীমান্তের দুই পাড়ের সমাজ আসলে একই ছাদের নিচের মানুষ। তিনি সমাজটাকে জাগাবার জন্য অচল পয়সা, দেবী সুলতানা, দস্যূ ফুলন, মায়ের আঁচল, সাধক রামপ্রসাদ, লালন ফকীর, সিরাজদ্দৌলা, রাণী ভবানী-সহ বিচিত্র পালা দর্শক সম্মুখে এনেছিলেন। দেশীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরে সমাজ ভাঙার গান গেয়েছেন মঞ্চে, গ্রামে, গঞ্জে। এ নিয়ে তাঁর কোনো খেদ ছিল না। একজন সত্যিকার পার্টিজান কমরেড। দলে গিয়ে মার্কসবাদ কপচান নি। সাম্যবাদের কবিতা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পাঠ করেছিলেন তিনি।
মৃত্যু তাঁকে অনেক আগে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। যাত্রা শিল্প ঝিমিেিয় পড়েছে। সরকার ও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর যে উদ্দেশ্য ছিল তা সফল হয়েছে। আমরাই তাতে সহযোগিতা করেছি। রাজনৈকিভাবে যেমন মৌলবাদের উত্থানকে সহযোগিতা করেছি, তেমনি যাত্রা শিল্পের কবর যারা রচনা করেছে তাদের সাথে হাত মিলিয়েছি। আর একজন অমলেন্দু বিশ্বাস তো আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু অমলেন্দু বিশ্বাস হারাবেন না। বিক্রমপুরের কৃতি সন্তান ড. নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় সর্বপ্রথম যাত্রা শিল্পের উপর অভিসন্দর্ভ রচনা করেছিলেন। অনেককাল পেরিয়ে আজ তা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটকের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অমলেন্দু বিশ্বাসও তাই। এদেশের ‘ঐতিহ্যিক অভিনয় রীতি’ জানতে হলে অমলেন্দুকে বাদ দিয়ে পাঠ নেয়া যাবে না।
জয়তু অমলেন্দু। জয়তু যাত্রা শিল্প।।
তোমায় শেষ নমস্কার।
বাবু রহমান: সঙ্গীত শিক্ষক