Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

প্রারম্ভিক সেলিম আল দীন

Written by শান্তনু কায়সার.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

হাস্যে-লাস্যে মুনতাসির ফ্যান্টাসী অথবা কালিদাসের নাট্যরচনা বা পুরাণের শক্তিশালী আবেদন সত্বেও শকুন্তলা লিখে নিজের নাট্যশক্তির পরীক্ষা করলেও সেলিম আল দীনের প্রকৃত আবির্ভাব কিত্তনখোলা-য়। আমৃত্যু নাট্যরচনায় তিনি ক্রমাগত পরিণত ও পরিশীলিত হয়েছেন বটে, কিন্তু কিত্তনখোলা ও কেরামতমঙ্গল-এ ঘটেছিল তাঁর প্রকৃত যাত্রা।

এখন সকলেই জানেন, সেলিম আল দীনের প্রতিটি পাণ্ডুলিপিই ছিল দীর্ঘতর। জীবন-দৈর্ঘ্যরে নাটক লিখে তিনি দেখেছেন, মঞ্চ অত্যন্ত ছোট। মঞ্চের মাপে তিনি নাটক লেখেন নি, মঞ্চকেই বরং জীবনের মাপে দীর্ঘ করতে চেয়েছেন। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। ফলে মঞ্চ জীবনের কাছে, কিংবা জীবন মঞ্চের কাছে এগিয়ে এসেছে। এসে দুই-ই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। সেকারণে কিত্তনখোলা দেখতে এসে দর্শক আবিষ্কার করেন, তিনি বা তাঁরাও নাটকের অংশ অথবা কুশীলব। মেলার মধ্যে তাঁরাও যে ঢুকে পড়েছেন। মহিলা সমিতি মিলনায়তনের সীমাবদ্ধতাকেই শুধু নয়, বাংলা মঞ্চের সীমাবদ্ধতাকেও সেলিম এভাবে অতিক্রম করতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি ‘ঢাকা থিয়েটার’ ও নাসির উদ্দীন ইউসুফের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছেন।

বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা যাবে যদি এক্ষেত্রে আমরা মাইকেল মধুসূদন দত্তের অভিজ্ঞতাকে স্মরণ করি। মৃত্তিকায় পা রাখতে গিয়ে মাইকেল লেখেন তাঁর অসাধারণ প্রহসন বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ। সিংহ ভ্রাতাদ্বয়, ঈশ্বর ও প্রতাপচন্দ্র প্রহসন দুটি, বিশেষত ‘বুড়’কে কোনোমতেই তাঁদের নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হতে দিতে রাজি নন। তিক্ত সেই অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখে কৃষ্ণকুমারী-র প্রসঙ্গে তাই তিনি কেশব গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখেছেন, ‘There is no use of writting a play and then leaving it to rot in my desk.’ এমনকি নাটকের বই প্রকাশেও তাঁর উৎসাহ কম, বলেছেন, এটি ‘secondary matter.’ মূল কাজ হচ্ছে ‘to have it acted.’ দীর্ঘতর পাণ্ডুলিপি হ্রস্বতর করা ছাড়া উপায় না থাকলেও ঢাকা থিয়েটার বা নির্দেশক সেটিকে ডেস্ক-এ ফেলে পচতে দেন নি, কিংবা তাকে মুদ্রণ করেও দায়িত্ব শেষ করেন নি। বরং নাট্যরচনার মূল যে লক্ষ্য, তাকে মঞ্চায়ন করেছেন।

কিত্তনখোলা-র প্রস্তাবনা পদ্যাংশে। তাতে দেশজ নাট্যরীতিই শুধু অনুসৃত নয়, নাট্যভাবনাও প্রকাশিত।

    পূর্বেতে এই কিসসা কইছে অনেক মহাজন।
    সেই কিসসা কইলাম আমি সত্য ভাবি মন ॥
    এই কিসসা আইজ আছে, রইব ভবিষ্যতে।
    নানা ছন্দে নানা রীতি রইব নানা মতে ॥

নাটকের সূচনাংশে যাত্রাভিনেতা করিম বলে- ‘যাত্রাদলে যাত্রা করি, কিন্তুক কিত্তনখোলায় যাত্রা করার উদ্দিশে যাত্রা করতে গিয়ে ...।’ মঞ্চ ও জীবনের এই ভেদ একেবারে জীবন থেকে নিয়েছেন নাট্যকার। জনগণের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ার এই বিষয়টি একটি শব্দের ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যেতে পারে। গ্রামের লোকেরা বলেন, উদ্দিশ নাই। ‘উদ্দেশ’ ও ‘উদ্দেশ্য’র ব্যবহারে শিক্ষিত, এমনকি শিক্ষকরাও ভুল করে থাকেন। ‘উদ্দেশ’ বা ‘উদ্দেশে’ যে অর্থে ব্যবহৃত হয় শিক্ষিত লোকদের সাধারণ একটি প্রবণতা তাতে অনাবশ্যক য-ফলা' যোগ করা। তাতে অর্থই যে পাল্টে যায় সেটা তারা বোঝেন না বা বুঝতে চান না। কিন্তু গ্রামের মানুষ ঠিকই এই অর্থে ‘উদ্দেশ’ বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘উদ্দিশ’ই বলেন। করিমের সংলাপে জীবন ও মঞ্চের আপাত বিভেদ যেমন নির্দেশিত তেমনি তা অস্বীকার করে নাটককে জীবনের প্রতিস্পর্ধী করে তোলা হয়েছে। রবিদাশ যে বলে এখানে কেউ ‘অডিয়েন্স না’, ‘পাব্লিক’ তাতেও মঞ্চ ও জীবনের ভেদ সত্বেও ‘পাব্লিক’কেই অডিয়েন্স করতে চাওয়া হয়েছে। সেলিমের মাপটা এতই দীর্ঘ ছিল যে, তিনি পারলে পুরো বাংলাদেশকে তার দীর্ঘতর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিসহ মঞ্চে তুলে আনতেন। কিত্তনখোলা ছিল তারই সূচনা।

রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য থেকে এর গুরুত্বকে বোঝা যেতে পারে। ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন, ‘... দেশের ভাষা ছাড়িয়া, দেশের প্রথা ছাড়িয়া, কেবলমাত্র বিদেশীয় হৃদয় আকর্ষণের জন্য বহুবিধ আয়োজনকেই মহোপকারী পোলিটিক্যাল শিক্ষা বলিয়া গণ্য করা আমাদেরই হতভাগ্য দেশে প্রচলিত হইয়াছে।’ কিন্তু তিনি মনে করেন দেশের হৃদয়ে প্রবেশ করতে চাইলে ‘আমরা বিলাতি ধাঁচের একটা সভা না বানাইয়া দেশী ধরনের একটা বৃহৎ মেলা করিতাম। যেখানে যাত্রা-গান-আমোদ-আহ্লাদে দেশের লোক দূরাদূরান্তর হইতে একত্রিত হইত।’ রবীন্দ্রনাথ যে ‘মেলা’কে ‘আমাদের দেশে অত্যন্ত স্বাভাবিক’ বলে মনে করেছেন পাশ্চাত্য-প্রভাবিত মঞ্চে সেলিম আবার তারই সংস্কারমুক্ত প্রত্যাবর্তন চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এর যে একটি অত্যন্ত সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন, সেলিমের অন্বিষ্ট ছিল তা-ই। ‘চিরকাল ঘরের লক্ষ্মী আমাদের ঘর নিকাইয়া আসিয়াছেন- ম্যুনিসিপালিটির মজুর নয়। ম্যুনিসিপালিটির সরকারি ঝাঁটায় পরিষ্কার করিয়া দিতে পারে বটে, কিন্তু লক্ষ্মীর সম্মার্জনীতে পবিত্র করিয়া তোলে, এ-কথা যেন আমরা না ভুলি।’

নাট্যকার নাট্য-বর্ণনাকেও দীর্ঘ করেছেন। যেমন দ্বিতীয় সর্গের ক, খ, ও গ-এ যথাক্রমে মেলা, খেলার দোকান ও মুখোশের বর্ণনা। কখনো কখনো তাকে কাব্যিক বলেও মনে হতে পারে। যেমন ক-এর প্রারম্ভিক বর্ণনা: ‘সূর্য ডুবুডুবু হতেই লাউজং-এর পূর্বে চাষীবউ-এর হলুদ ছোপানো হাতের মত চাঁদ ওঠে। ত্রয়োদশীর চাঁদ।’ কিন্তু নাট্যকার তো শুধু দৃশ্যকেই নয়, অনুভূতি ও উপলব্ধিকেও বাক্সময় করে তুলতে চান। তবেই চরিত্র অথবা পরিস্থিতির পূর্ণ রূপ প্রকাশ সম্ভব।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অপরিহার্যও হয়ে ওঠে। একটি উদাহরণ; সোনাইয়ের বর্ণনায় পাই- ‘সোনাই দিনমজুর। উত্তরাধিকার সূত্রে চার বিঘা জমি ছিল। এখন বন্ধক আছে সেগুলি। ইদু কন্ট্রাক্টর সে জমি কেনার জন্য প্রস্তুত।’

এই বর্ণনা থেকেই বছির ও সোনাইর সংলাপকে উপযুক্ত মাত্রায় বোঝা সম্ভব হয় এবং নির্দেশকও সেভাবে তাঁর দৃশ্যকে বিন্যস্ত করতে পারেন-

বছির 
... মেলায় লোকজন নাই, ইদু আপনেরে করবেটা কি? ...

সোনাই
হে যদি আমার থিক্যা জমিনের দস্তখত লয়। ...

বছির
কেমনে লইবো?

সোনাই
তা জানি না। কিন্তু অখন খালি ডর করতাছে আমার। যেন ডাইনে রেনলে পরে দেখুম ইদুরে- বায়ে বাঁও কুমারীর মতন দেখুম তারে। আর হে কইব, সোনাই, ক’টাকার দরকার ... নে।

বছির
এহ, অত সোজা না। মনাই বাপের মেলা ইটা। জুর, জুলুম খাটবো না। হেই বাপ- দোহাই। আমার সোনা বাইয়ের যেন মঙ্গল হয় ... আর ই বছর যেন সইরষা বেশি হয় ...

মেলার এই গণচারিত্র্যের ওপর মূল মনোযোগ নিবদ্ধ করেছেন নাট্যকার। সোনাই ভূমিহীন থেকে দিনমজুর হয়েছে যেমন সত্য, তার বড় সত্য তার সাংস্কৃতিক জীবন- আলোমতির পুঁথি, চান্দের কেস্সা থেকে প্রাপ্ত প্রেরণা। সেজন্যে নাটকের অন্য চরিত্র জানতে চায়, ‘আপনে কনচাই ... সারা বছর কাম কাজ কইরা কাত্তিক আঘনে এট্টু যাত্রা দেখলে বউ-এর দোষটা কোনহানে?’ এটি সামাজিক প্রতিরোধ হিসেবেও কাজ করে। নেতিবাচক ঘটনার ইতিবাচকতা থেকে তা বোঝা যায়, ‘... কইতেছিলাম, আমাগো দ্যাশের জামাল পরীর যাত্রার কতা। ধানপান বেইচা এই রকম যাত্রা দেখনের হিড়িক পইরা গেলে গেরামের মৌলভীরা ফতোয়া দিল,- যেতে জামাল পরী দেখতে যাইব হেতের বউও তালাক হয়া যাইব।’

সেলিম আল দীন মেলার বিচিত্র দৃশ্য রচনা কিংবা এর সৌন্দর্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও (একটি চরিত্র মংলা জানাচ্ছে- বনচ্ছিরির এ্যাকটিং সোন্দর, নাচটাও চমৎকার) মেলার আসল ‘সোন্দর’কে চিহ্নিত করেছেন এভাবে- ‘মেলার সোন্দর হইতাছে দশজনের লগে চিন-পরিচয়।’ সেজন্যে রবিদাশের উপলব্ধি, যাত্রাটা সুবল ঘোষের কাছে ‘ব্যবসা’ হলেও বনশ্রীর কাছে ‘বাঁছন-মরণ’। রবিদাশের তাই আরো প্রশ্ন,- ‘চাষীর ছেলে ছায়া। যুদ্ধের সমে তার বাপ-মাও মরছিল গুলি খায়া। তখন সে ইস্কুলে, ক্লাস এইটে পড়ে।’ ‘তার ক্যারেক্টারটা নষ্ট করছে কে?’

এ নাটকে দেখা যায়, অস্তিত্বের প্রয়োজনে চরিত্ররা পেশা বদল করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে। যেমন লাউয়ারা চাষা হতে চায়, জোলারাও। কিন্তু চাষীরাই কি বাঁচতে পারছে? শামছল বয়াতী মওলানা ভাসানীর প্রসঙ্গ তুলে বলে,- ‘একবার তানে মহাজন আর জমিদারগো বিরুদ্ধে পান্দুয়ায় মিটিং করলেন। পরজাস্বত্ব আইন তখনও চালু হয় নাই। একদিন সাদা কাগজে দুই গোরুর গাড়ি টিপসই লইলেন।’ ভাসানী জমিদার ও মহাজন- উভয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন, নাট্যকারও তা মনে করেন। বাংলাদেশের জন্মের বহু পূর্বে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ হয়েছে বটে, কিন্তু জমি চাষীর হয় নি, আর অর্থের নির্যাতন ত রয়েছেই। প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’র প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যে বলেছিলেন, জমিদারের হাত থেকে জমি যদি মহাজনের হাতে যায়, তাহলে চাষীর যেমন লাভ নেই, তেমনি মুক্তিযোদ্ধত্তোরকালেও জমি যেহেতু চাষী হাতে পায় নি অর্থাৎ মৃত্তিকা মৃত্তিকালগ্ন মানুষের পরিবর্তে যে অনুৎপাদনশীল শ্রেণীর হাতে গেছে তা দেশীয় শোষকদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চক্রের যোগসাজশে একবিংশ শতাব্দীর অষ্টম বর্ষে প্রান্তিক মানুষদের কাছে তাদের উৎপাদিত অর্থাৎ তাদের ও সমশ্রেণীর মানুষদের শ্রমের মূল্যে অর্জিত শস্যকণাকে তাদের কাছে ও তাদের জন্যেই দুর্লভ ও দুমূর্ল্য করে তুলেছে।

কিন্তু সেলিম তৃণমূলের মানুষকে লুম্পেন হতে দিতে চান নি বলে তাদের মেলাকে প্রবহমান জীবনের সমান করে তুলতে চেয়েছেন। সে-কারণে এ-নাটকে তার ‘পরিশিষ্ট’ শেক্সপীয়রের এপিলোগের চেয়ে দীর্ঘ হয়েছে। এবং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের দাবিকে জানাজা পড়ার পরিবর্তে বিরাট করে তুলেছে।

দুই

কেরামতমঙ্গল-র শুরুর নখলা খণ্ডেও আছে ‘জমিদার’ ও ‘মহাজন’। শুরুতেই দুটি চরিত্রের সংলাপ-

অখিলদ্দি
আরে ও কেরামতের বাপ। খবর কও। গেছিলা মির্জা সাহেবের কাছে?

ছবীর
গেছিলাম। কিন্তু কাম অয় নাই।

অখিলদ্দি
কেম্বা অবো? হালা কি হরিশ মহাজনের চায়া কম!

এই মির্জা ‘সুদের হারাম’ খায় না। সে-জন্যে তার কথা, ‘জমি আন্, টাকা নে।’ এরাই আকালের সুযোগে অন্যের ঘর-বাড়ি-জমি দখল করেছে। সুদ না খেয়ে তারা ‘ধর্ম’ ‘রক্ষা’ করেছে। কিন্তু লুণ্ঠন করে তারা যে তার চেয়ে বেশি ও বড় ‘অধর্ম’  করেছে সে বিষয়ে তারা ইচ্ছান্ধ। তাদের আসল ও একমাত্র ধর্ম- স্বার্থ। সেজন্যে যে বাস্তবতায় ‘মরা ছাওয়াল ফেইকা দিয়া অনাহারী মাও খাইতে বইছাল’ তারই উল্টো দিকে ‘হুক্কুরবারে’ ‘মেসকে আম্বর’ আতর ব্যবহার করে হরিশ মহাজনকে কিছু কিছু লোক বুঝিয়ে দিতে চায়, ‘পাকিস্তান কি জিনিস।’ এ বাস্তবতায় নাটকের মূল চরিত্র কেরামতের আবির্ভাব।

এই চরিত্র নানা খণ্ডের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় এবং নানাভাবে নিজের মৃত্তিকা, পরিপার্শ্ব ও মানুষকে চিনতে শেখে। ‘হাজোং খণ্ডে’ হাজংদের সংগ্রামের সাথে যুক্ত হয় এবং বলে, ‘আমার কি কপাল- বেবাক কপালপোড়ার নগে আমারই দেহা অয়।’ কিন্তু নিজের সত্য ও সত্তাকে সে ভোলে না। এই ‘খণ্ডে’র শেষে তার সলিলকি- ‘আরে তুই হলি নখলার কেরামত। ... দাদা বুইড়া তুমি যে কইছিলা আদম সুরত আমারে জনমভর ডাকব। দাদা বুইড়া, আপনজনা মরে হারায়া যায়- কিন্তুক তার আদরটা ক্যা বুহের মধ্যে জমা থাহে। তুমি রাখছাও, বাজান রাখছে, নওশাদী রাখছে, অধর দাদা, দশরথ ... বালিশান্দার হেই রাইতে অল্প বয়স্যা হিজরাটা ছমেদ, আজিম, মংলা বাই-এর আদর সব ক্যা জমা থাহে? মুছে না ক্যা? মুছে না ক্যা?’

ধর্মান্তরিত আদিবাসীদের প্রসঙ্গে কেরামত প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হয়। আজমত জানায়, ইংরেজি শিখলেও নিজেদের বর্ণমালা না থাকার বিষয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ নেই। আরো স্পষ্টভাবে এর স্বরূপ সে ব্যাখ্যা করে, ‘যীশু মন্ত্রে দীক্ষিত’ হয়ে ‘তারা অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সংগ্রাম ভুইলা পাপ স্বীকারে ব্যস্ত।’ কিন্তু কেরামত স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। সে যেমন সোমেস্বরী নদীতে ‘মহাশৈল’ ধরতে চায়, তেমনি ঘরের দুয়ারে সুন্দর বেতের ‘নশকা’র মধ্যে এট্টা নয়া বউ’ও চায়। অর্থৎ সে জানায়, সে আছে, তার ধ্বংস হয় নি বা হওয়া সম্ভব নয়।

‘রাজাকার খণ্ডে’ তার রসবোধ কিংবা কাণ্ডজ্ঞান অথবা অসাধারণ প্রজ্ঞা এই মৃত্তিকা ও মৃত্তিকালগ্ন মানুষের যৌথ ও যুগ্ম অর্জন।

কমান্ডার
শালা বাইন্চোথ- উরদু সমঝতা নেহি। বয়স কত?

কেরামত
আমি অশিক্ষিত।

কমান্ডার
ধরা পড়ছস ক্যা?

কেরামত
পালাবার পারি নাই দেইখ্যা।

কমান্ডার
পালাবার চাইছিলি ক্যা?

কেরামত
যাতে ধরা না মরি।

কমান্ডার
ও হরে, ধরল ক্যা তরে?

কেরামত
ঐ যে পালাবার নুইছিলাম।

কমান্ডার
কলমা জানস?

কেরামত
জানি।

কমান্ডার
ক।

কেরামত
ক্যা?

কমান্ডার
তুই হিন্দু না মুসলমান পরমান লাগবো।

কেরামত
এই কয় কি! এই তানেরে জিগান। ধরার নগে নগে নুঙ্গি তুইলা দেহায়া দিছি না?

অতঃপর সে যখন জানায় মুক্তিদের সঙ্গে গতরাতেই তার দেখা হয়েছে তখন তারা তাকে তাদের ইনফরমার বানাতে চায়। কিন্তু তারপর যখন সে প্রকৃতপক্ষে তার স্বপ্নের কথা, আগামীর কথা বলে তখন তার ওপর নির্যাতন নেমে আসে। কেরামত ভাবে, ‘হায়রে নসীব। আর দুই দিন পরে রোজার ঈদ।’ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বদেশে যাদের ‘বিনা খরচায় চিকিৎসা’ করার কথা, তারা দেখে, ‘টাকা ছাড়া কতা নাই।’

নাটকের শেষাংশে তার মনে পড়ে, সে ‘ছবরালীর পোলা কেরামত, আফিন দাদার নাতি’, যে ‘হিন্দু-মুসলমানের রায়টের সময়’ ভিটে-ছাড়া হয়েছিল। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন সে নারীর গর্ভের সন্তান বাঁচাতে চায়। অন্তিমে সে বলে, ‘তোমরা আমাকে কবর দিবা না, চিতায় তুলবে না।’ কুত্তা-হিয়াল-কাক-হকুন দিয়া ‘খাওয়াইও।’

কিন্তু নাটকের এপিলোগে, উপসংহারে নাট্যকার ‘কল্যাণ’ ও ‘পুণ্য’ হোক চেয়েছেন। ‘যে এই নাটক দেখে- সামাজিক মঙ্গল সাধনে সে যেন তৎপর হয়। অন্যায় অবিচার শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।’

তিন

কেরামতমঙ্গল-র একেবারে শেষে নাট্যকার যেমন ‘বাংলা কাব্যের মধ্যযুগের মহান কবিদের’ তেমনি দান্তেকেও প্রণাম জানিয়েছেন। প্রাচ্য নাট্যকারের নাটকেরই শুধু নাম নয়, প্রাচ্য ভাবনা ও দর্শনকেই, আরো স্পষ্ট করে বললে, বাংলার লৌকিক তৃণমূলকেই তিনি আশ্রয় করেছেন। কিন্তু ইতিহাস ও ভূগোলের একটি পর্যায় ও পর্বে দাঁড়িয়ে পশ্চিমকে অগ্রাহ্য করাও তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। ফলে এই দুইয়ের স্বাস্থ্যকর সম্মিলন ও প্রাসঙ্গিক অংশটিই তিনি আমাদের জন্যে চয়ন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যে ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধেই বলেছিলেন ‘আমি একথা বলিতেছি না যে, সকলেই আপন আপন পল্লীর মাটি আঁকড়াইয়া পড়িয়া থাক, বিদ্যা ও ধনমান অর্জন করিবার জন্য বাহিরে যাইবার কোনো প্রয়োজন নাই’ তা সেলিম আল দীনেরও কথা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মত তিনিও চেয়েছেন তাতে যেন ‘ঘর ও বাহিরের যে স্বাভাবিক সম্বন্ধ’ ‘তাহা যেন একেবারে উলট-পালট হইয়া না যায়।’ ‘বাহিরে অর্জন করিতে হইবে, ঘরে সঞ্চয় করিবার জন্যই।’

আরও একটি প্রসঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের প্রায়শ্চিত্ত নাটকে মুক্তিয়ার খাঁ যে উদয়াদিত্যকে বলেছিল ‘মনিবের আদেশ পালন করতে পাপ নেই’ তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘যে ধর্মশাস্ত্র তা বলে সে ধর্মশাস্ত্রও মিথ্যা। ... পাপ আদেশ পালন করলে পাপ।’ সেলিম আল দীন তাঁর এই দুটি নাটকে সেই ভিত্তিকে দৃঢ় করেছেন।

এ ঠিক ‘নৈতিকতা’ নয়, সত্যের জোর। সে-কারণে তাঁর দেশজ ভাবনা বৈশ্বিকও বটে।

সেলিম আল দীনের নাটক মধুর হয়েও কঠোর। কাঠিন্যই তার মাধুর্য। তাঁর প্রকৃত আবির্ভাব থেকে অন্তিম পর্যন্ত ‘অসহজ’ এই গানই তিনি আমাদের শুনিয়েছেন। কঠিন-মধুর এই চর্চা আমাদের বঞ্চনা করে নি ও করতে শেখায় নি।

শান্তনু কায়সার : অধ্যাপক, লেখক