Full premium theme for CMS
সেলিম আল দীন চরিতমানস
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
বহুবার নদীর কথা, শাখা নদীর প্রসঙ্গও সেলিম আল দীনের লেখায়, কাজে ও কথায় ঘুরেফিরে আসে। যে-নদীর পক্ষে তিনি বলুন: তা’ কিত্তনখোলা হোক, কী যমুনার উদ্দামতায় উদ্বেগ, অথবা শ্রবণমুখর জলসুখা নদীর ওপর পিঠাপিঠি জল; তখন আসলে গাঙ্গের কল্যাণে আমরা পাই গভীর দীঘল একটি জীবনের চিত্রকল্প। আমাদের অরূপ মানসে নদী বা রাত্রীকালীন জ্যোৎস্নার সোনাটায় একটি নদীর বদলে বিপুল দিগন্তে আবির্ভূত হন সেলিম আল দীন নিজে। সোমেশ্বরী নদীর ঠিক কোনো অংশে যেমন আঙুল ঠেকিয়ে দেখানো যায় না খাপেখাপ এই জায়গাটির নাম সোমেশ্বরী, কিংবা ধরা যাক, এই ঘূর্ণিটির নাম কর্ণফুলী- সেলিম আল দীনও সেই রকম; আঙুল দিয়ে নির্দিষ্ট করা যায় না- এই বিন্দুটির নাম সেলিম আল দীন- এইখানে সবটুকু বৈশম্পায়ন ঘনীভূত, সেলিম আল দীন একটি বহমানতার নাম।
তিনি পূর্ব বাঙলার প্রতিটি ধূলার রঙ ও গন্ধ শোঁকার নিমিত্ত ব্যাকুল, কোন নদীর রাগ ও অভিমান কী, শীত দোরগোড়ায় আসি-আসি প্রায়, সাইবেরিয়ার অতিথি পাখিমণ্ডলীর জন্য তাঁর মন কেমন করে, পিঁপড়ারা কীভাবে পরিবার বাঁধে, শতমূলী গাছের ভেষজগুণ তাঁরই জানা সবচেয়ে বেশি, প্রজাপতির পাখায় পাখায় কত কিসিম রঙের বাহার, এ-তো বৈশাখের কুড়ি তারিখ- উত্তরমুখী বাতাসের দমকা পাঠ করে বলে দেন কত বড় ঝড় আসবে কাল। তিনি প্রকৃতিখোর এক বিস্ময় বালকের ঔৎসুক্যে নিত্য ক্রিয়াশীল, তাঁকে তুল্য করা চলে উয়েরাহিউলুর কাঁধে স্থাপিত বর্ণবতী কাকাতুয়ার সঙ্গে যে নিসর্গের প্রতিটি বাঁকের মর্ম বোঝে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর সেলিম আল দীনে পাই অভিমানী, ভালোবাসাসংকুল, ডুমুরপাতার নিয়মে ভঙ্গুর ও স্পর্শকাতর, নৈঃশব্দ্যে দেদীপ্যমান শতমুখী পেশার গ্রামীণ মানুষ, তিনটি ধূলিকণা কাঁপিয়ে সংবেদনশীল দুটি প্রথম পাতার কৌমার্য্য নিয়ে তাঁর চরিত্ররা জাগে- সেলিম আল দীন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আর জীবনানন্দ দাশের এক অনির্বচনীয় যোগফল।
তাঁর অন্বেষণের কিনারা দেখি না: বরগুনার রাখাইন, পাহাড়ী মারমা, সখীপুরের মান্দাই, সুসংদুর্গাপুরের মুনীন্দ্র মারাককে ভুলে যায় কার সাধ্য? উপকূলীয় উপদ্রবসংকুল আনার ভাণ্ডারী কি দিয়ে যায় না জীবনে অপরাজয়ের অনির্বান সূত্র, টর্নেডোয় লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া হরগজ- খেজুর কাঁটায় বিদ্ধ তন্তুবায় রুমুনি, চুক্কুনি ঘুরেফিরে আসে। কালিন্দীর পাশ ঘেঁষে একবার দাঁড়াতে কার-না ইচ্ছা করে? সোনাই-এর জন্য নির্ঘুম জাগি, কেরামত প্রহরে প্রহরে দাঁড়ায় প্রতিটি বাঙালির পাশে, স্বর্গ থেকে নেমে আসা মনুরি, কেরামতমঙ্গল-এ সপ্ত নরকের ভয়াল বর্ণনা, শকুন্তলার ভাগ্য, লাশের প্রতিটি কণার প্রতি বেদনা ও সম্মান, শুকুর চানের ঘোর, সয়ফরের ক্রোধ ও ব্যাপ্তি, সুকি আর অনিলের প্রাকৃত মহাকাব্যিক প্রশ্রয়, দুই পাহাড় ধ্বংস হয়ে তার মাঝখানে আটকেপড়া মানুষ, শরীর বেচা মঙ্গলি, ট্যাঁটায় বিদ্ধ সাঁঝমালা, জনম মাঝির চিরতরে হারিয়ে যাওয়া, প্রচণ্ড সংক্ষোভে ঘুরে দাঁড়ানো যমুনাবতী আবছা, মানুষের চেয়ে অধিক দ্বন্দ্ব আর মানবিক বোঝাপড়া নিয়ে একটি প্রাণী ষণ্ড মহিষ সোহরাব-এর কোনো সাহিত্যেই দ্বিতীয়বার দেখা মেলা ভার, অসহায় ঢেউ এসে নদীকূলে আছড়ে পড়া-মাত্রই আমাদেরকে কি দখল করে নেয় না ডালিমন আর বনশ্রী? কী নেই তাঁর কাজে- এমন কোন মানবিক দিক বা বিষয় প্রায় বলা-ই অসম্ভব যা সেলিম আল দীন স্পর্শ করেননি।
মোটা বাঙলায় যাকে বলে কর্মবীর, তিনি আসলে তাই। তিনি প্রকৃতি ও মানুষের প্রতিটি অতল ভূমিময়তা খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনেন প্রয়োজনীয় সামগ্রী; স্বর্ণকারের নিষ্ঠা ও মেধার বিন্যাসে নির্মাণ করেন একেকটি জেওর, পরিপূর্ণ নাটকের স্থাপত্য। তাঁর তৃষ্ণা সর্বব্যাপী- বাঙলা ভাষায় অধিকতর গতিশীলতা আনার মানসে ভাবেন নোতুন বানানরীতি, অপ্রয়োজনীয় যতিচিহ্ন কীভাবে আটকে দেয় প্রাণের ফল্গুধারা তা ভেবে চিকিৎসার উদ্যোগ নেন। ব্যবহার করেন নিজস্ব বানান ও যতিচিহ্নরীতি- ভাষায় নোতুন বিতর্ক ও বিশৃঙ্খলা আমদানির বিপদ তাঁকে দমাতে পারে নি। রচনা করেন নাটকের অভিধান, তাঁর অনুবাদে পাই নন্দীকেশ্বরের অভিনয়দর্পন। উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসকে পাঠ করি তাঁর ভাষান্তররূপে।
সবকিছুর পরও একটি সংশয় জাগে: নাটকের নোতুন কাঠামো ও দর্শন, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব, পুঁথিসাহিত্য থেকে তুলে আনা তারকাচিহ্নের ব্যবহার, থিয়েটারে উড়–নির প্রথম প্রয়োগ, বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতি এ-সব কিছুই কি তাঁর নিজেকে স্বয়ম্ভূ স্বকীয় একটি জায়গায় চিহ্নিত করার নিঃসঙ্গ অভিপ্রায়, নাকি তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থাকা ব্যাপক জনপদের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে?
বাঙলা ভাষায় অধিকতর চলিষ্ণুতা বিধানের প্রচেষ্টা সবার মনোযোগ কেড়ে নেয় সত্য, কিন্তু এ-ভাষার অন্যতম প্রধান দুর্বলতা যে ক্রিয়াপদ- তার শৈথিল্য ঘুচিয়ে দেবার প্রত্যয়ে তাঁর অভিনিবেশ প্রযুক্ত হতে দেখি না। মৌলে তিনি কবি- তার স্বাক্ষর জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন থেকে ধাবমান পর্যন্ত স্বর্ণপ্রভা শিল্পযাত্রার প্রতি বাঁকে প্রোথিত। গীতলতা বাঙলা কাব্যের এক স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায়- এক অনাকাক্সিক্ষত মূলধন; কবিগণ তা অর্জন করেছেন বিপুল, কিন্তু অভিনন্দন পেয়েছেন যৌক্তিকভাবে সামান্য। বাঙলা আধুনিক কবিতা যে নিজের পায়ে আপন ব্যক্তিত্বে অনেকাংশে উঠে দাঁড়িয়েছে তা কবিতা থেকে গীতলতানির্ভর পদ্যধর্মিতা পরিহার করে বাইরে আসার ফল। তিরিশের কবিতা প্রধানত উপনিবেশী দার্শনিক কাঠামোর অধীনে ম্রিয়মান; কিন্তু তিরিশি কবিতাই এমন একটি কাব্য কাঠামো বিনির্মাণ করে যার ফলে কবিতা গান এবং গীতলতার বাইরে স্বয়ম্ভূ হবার যাত্রা শুরু করে। আজো দেখি কেউ কেউ সেই বিশাল কর্মযজ্ঞে, যেমন- অরুণ মিত্র, রফিক আজাদ, কিংবা মোহাম্মদ রফিক বাঙলা কবিতাকে গীতলতার বাইরে এনে একটি সার্বভৌম শিরদাঁড়া প্রযুক্ত করার চেষ্টা করে যান। অভিযাত্রার এই লগ্নে পুনর্বার সেলিম আল দীনের অতিগীতলতা কীভাবে গৃহীত হতে পারে? দ্বৈতাদ্বৈতবাদী লেখার দাবির মুখে তিনি আসলে নিজেকে একটি কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে দেন। এ-কথা সত্য তাঁর লেখা দেখতে গায়েগতরে কবিতা বা নাটকের মতো লাগে না; দৃষ্টিসীমায় তারা বাঁধা পড়ে গল্প বা উপন্যাসের আদলে। বহুকিছুই দেখতে একাকৃতির মনে হতে পারে। গাবগাছ দেখে অশোকতরু বলে ভ্রম হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু প্রকৃত অর্থে গাবগাছ অশোকতরু নয়। বৃক্ষ তোর নাম কী- যেমন ফলে পরিচয়, তেমনই শিল্প বিচারেও কী আকারে আদল তার থেকে মৌলিক ভিতরকার সারমর্মের স্বরূপ। সেলিম আল দীন বারবার দাবি করেন তাঁর লেখা নাটক নয়, বরং কবিতা, নাটক, মহাকাব্যিক আখ্যান, প্রায়শ প্রাবন্ধিক ব্যাখ্যা, গল্প, উপন্যাস সবকিছুর মহামিলনে মহাকাব্য-প্রয়াসী সার্বভৌম এক অবিসংবাদিত শিল্পখণ্ড। এই দাবি পুরনো আঙ্গিকবাদিতারই এক নোতুনতর নাম। মহাকাব্যিক কথাটির আশেপাশে দাঁড়াতে-বসতে পারলে, বোঝা যায়, তাঁর আনন্দ। মহাকাব্য সাধারণভাবে দৈর্ঘ্য, ব্যাপ্তি এবং গভীরতার একান্নে মিল; ব্যাপ্তি এবং গভীরতাই মৌল দুই বাহু।
শেখ মুজিবর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ পাঁচ লাইনের কিছু কথা, কিন্তু এই পাঁচ লাইন কি আবুল কাশেম ফেরদৌসী রচিত শাহনামা-র ব্যাপ্তি ধরেনি? আযর নাফিসি শাহনামা সম্পর্কে আলোচনায় বলেন, শাহনামা পারস্য সভ্যতার তেরশ বছরের ঐতিহাসিক চিহ্ন নিয়ে এক পারিবারিক উপাখ্যান। ইরানীরা যতবার গৃহহারা হয় ততবার শাহনামা-র ভিতর ফিরে আসে; ঘোর দুর্দিনে তাঁরা পরিবার কী পরিবার গোল হয়ে বসে শাহনামা পাঠ করে, অন্য সব সুফী কবিদের হীরকখণ্ডের জ্যোতি নেয়; শাহনামা আর গ্রন্থমাত্র থাকে না, চরিত্ররা সব বের হয়ে এসে তাদের অন্তর্লোকে আসন পাতে; ফলে তাদেরই কেউ কেউ বনে যায় রুস্তম, কেউবা তাহমিনা, অন্য একজন রূপান্তরিত হয় মেয়াবাশ, ইসফান্দিয়ার বা কাভুস-এ।
মহত্ত্বের দিক থেকে হয়তো দান্তে অ্যালিগিয়েরির ডিভাইন কমেডি ফেরদৌসীকৃত শাহনামা-র সমকক্ষ নয়, কিন্তু ব্যক্তির জাগরণে এক বিপুল সামষ্টিক আয়োজন ডিভাইন কমেডি। গোঁড়া ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসে লিপ্ত দান্তে সপ্ত দোজখের ভয়াল বর্ণনার ভিতর দিয়ে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক বিজয়সহ কীভাবে দুনিয়াকে পরিশুদ্ধ করা যায় তার কথাই বলেন। সপ্ত দোজখ আসলে দূরাভিগম্য কোনো পথযাত্রা নয়, বস্তুত সাত নরক মানুষেরই ভিতরমহলে প্রকীর্ণ সপ্ত রিপু ঈর্ষা, কাম, ক্রোধ, অহংকার, অসাড়তা, বিষয়লিপ্সা ও আতিশয্যবিলাস-এর নানা বিন্যাস। যদিও দান্তে এগিয়েছেন কর্তৃত্ববাদীর একরোখামি নিয়ে- এমনকি ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদকেও দোযখে নিক্ষেপ করতে পিছপা হননি; সক্রেটিস, এরিস্টটল কপালগুণে বেঁচে যান, কারণ তাঁরা জন্মেছিলেন যিশু খ্রিস্টের আগে। ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাস মূল মন্ত্র হলেও তাঁর অভীষ্ট ব্যক্তি মানুষের ভিতর দিয়ে এক সামষ্টিক নৈতিক গন্তব্যের দিকে যাওয়া।
বাঙালির ঘরে আযর নাফিসির কেন্দ্রীয় পাঠে কোনো শাহনামা নেই যার সামনে ঘোরতর কালরাত্রি কালে গোল হয়ে বসতে পারি। কিন্তু আমরা যদি সামষ্টিক আত্ম-আবিষ্কারের কর্মযজ্ঞ ধরে আগাই তাহলে কাঠামো-শৃঙ্খলার বাইরে মহাকাব্যের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতে পারি। বদরুদ্দীন উমর সংকলিত পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি কয়েক খণ্ডে ধারণকৃত এক মহাকাব্য- যার নায়ক পূর্ববাঙলার মধ্যবিত্ত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গের মানুষ। কিন্তু বাঙলায় প্রকৃত মহাকাব্যের কথা যদি বলি তাহলে দেখি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মহাকাব্যের আয়োজন ও নিষ্ঠা নিয়ে শুরু করেন কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকালের মুখে উপন্যাসে এসে স্থির হয়। চোখ তুলে নেওয়া কেরামত চলে কোনো এক অন্ধ গণ্ডীর উদ্দেশে- সে গণ্ডীতে আগুন কালো বনের ছায়াহীন,আলোহীন দোজখের চেয়ে ভয়াবহ। এই অন্তিম দৃশ্যে দর্শকের চৈতন্য স্তব্ধতায় ভেঙে ভেঙে পড়ে; কিংবা সোনাই-এর জন্য পায়ের পাতা তিরতির করে কাঁপে যখন দৃশ্যমান হয়ে সে নিরুদ্দেশে যায় দুখাইপুরের দিকে; কিত্তনখোলার একটি ঢেউ ঝরিয়া গড়ায়- কিন্তু সেই বিচ্ছেদের মর্সিয়া পাহাড়ী ঢলের বিস্তারে সারা বাঙলায় ঘনিয়ে আসতে তখনও বহুদূর বাকি।
ব্যক্তি চৈতন্যের ভিতরমহল খোঁড়াখুঁড়ি করে তার স্ববিরোধ, ক্রোধ ও কৌতুক, প্রণয় আর প্রত্যাখান, মহত্ব এবং ছোট-লোকামি বের করে আনার পরিকল্পনা সেলিম আল দীনের কোথায়! সমস্ত মনোযোগ ও প্রাইওরিটি তিনি মোতায়েন করেন এক অনন্য যাদুঘরে- যার নাম মধ্যযুগ; বিস্ময়কর সব হীরকখণ্ড জ্যোতি ছড়ায়: কায়াতরুবর পঞ্চবি ডাল। বর্তমান উপলক্ষ, মধ্যযুগ তাঁর সাধনা, সাম্প্রতিকে ভাসে দেহতরণী, কিন্তু প্রাণ নোঙর করেন চন্দ্রাবতী কী রূপরাম চক্রবর্তীর কুটিরে। ফলে যা কিছুই তিনি লেখেন মূলে তার নাম রাখেন উপাখ্যান। উপাখ্যানে চরিত্র থাকে, কিন্তু ব্যক্তি লাপাত্তা, গল্প নেই, বদলে পাই কিসসা। পালাকারদের ভাগ্য খোলাশা ও নির্বিঘ্ন, কেননা তাঁরা কাব্য উপস্থাপন করেন প্রচলনের পক্ষে, সেলিম আল দীন কাঁধে তুলে নেন পিতৃঋণ ও সম্মুখগামিতার দায়। তিনি মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য নামে যে অমৃত অভিসন্দর্ভ রচনা করেন তার সমকক্ষ দ্বিতীয় কোনো কাজ বাঙলায় নেই। এই অমূল্য গবেষণায় সেলিম আল দীন ১০টি অধ্যায়ে ভাগ করে মধ্যযুগের বাঙলা নাট্যরীতির পূর্বপটভূমি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আঙ্গিক ও পরিবেশনারীতি, পাঁচালি- পাঁচালির উদ্ভব ও আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য বিচার, ভাবগত পুরাণের অনুসৃতিমূলক গেয়কাব্য, চৈতন্য-চরিতাখ্যান কাব্যের পরিবেশনারীতি, প্রধান ও অপ্রধান মঙ্গলকাব্য, প্রণয়মূলক পাঁচালি ও নাটগীত, পীর পাঁচালি, মধ্যযুগের বাঙলা নাট্যরীতির আলোকে পূর্ববঙ্গ গীতিকা এবং মধ্যযুগে বাঙলা সীমান্তবর্তী বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষার নাটক ও নাট্যরীতি নিয়ে সবিস্তার অনুসন্ধানের কৃত্যে যুক্ত থাকেন বহুদিন। এ আমাদের সম্মিলিত দুর্ভাগ্য- যে কাজ পেশাগত গবেষকদের করবার কথা থাকে, তা সম্পন্ন করতে স্বভাবের বাইরে গিয়ে একজন সৃষ্টিশীল লেখককে দায়িত্ব নিতে হয়। এ-কাজ করতে গিয়ে সেলিম আল দীন এক মহীয়ান ক্ষতির ভিতর দিয়ে যান। তাঁর মৌলিক লেখা আটকে যায় এক ঘেরাটোপের আঙ্গিনায়। ফলে, সব তিনপথের মাথায়-ই যেমন একটি ভূত থাকে, সেলিম আল দীনের লেখা মাত্র-ই হেঁকে বসে মধ্যযুগ। তাঁর শেষ লেখা পুত্র কী ধাবমান পর্যন্ত এ-অভিনিবেশ পূর্ণ দাপটে ক্রিয়াশীল।
আনুগত্য কোনো মৌলিক লেখকের গন্তব্য হতে পারে না, বরং শিল্পযাত্রায় সৃষ্টিশীল বেয়াদবিই কাম্য। সম্মাননা যদি অতিউচ্ছ্বাসে ভক্তির রূপ পরিগ্রহ করে তাহলে নিষ্ফলা কাল হয়। প্রত্যেক কেজো লেখক মন্ত্রবীজ গ্রহণ করতে পারেন নানা উপায়ে, বিভিন্ন যোগসূত্র থেকে, কিন্তু তিনি তার উপর কর্তৃত্ব করবেন যিশুখ্রিষ্টের মাহাত্ম্য আর শয়তানের দমনাধিক বুদ্ধিদীপ্ত জিজ্ঞাসায়। হোর্হে লুই বোর্হেসের অসামান্য কল্পনাপ্রতিভার কথা কে না জানে। তার মূলে দেখি প্রাচ্যদেশীয় ভাবসম্পদ সুফীবাদের প্রভাব। গিওবানা গ্যারায়েলডি হোর্হে লুই বোর্হেস: সোর্সেস অ্যান্ড এল্যুমিনেশন বই-এ ব্যাখ্যা করেন বোর্হেস-এর চিন্তাকাঠামোর সূত্র ও বিন্যাস। সুফীতাত্ত্বিক ইদ্রিস শাহ-র বয়াতে গ্যারায়েলডি বোর্হেস-এর লেখার বিভিন্ন পর্যায়ে বস্তুর জড়তার ভিতর অদেখা রঙ ও দৃশ্যময়তার গহীনে অদৃশ্যের বহুধা বিস্তারের সঙ্গে সুফীতাত্ত্বিক জ্ঞানতত্ত্বের অমোঘ যোগাযোগ আলোচনা করে দেখান। সালমান রুশদীও তাই। প্রাচ্য দেশীয় মিথ, লোকাচার, লোকজীবনে ঐতিহাসিক কালপরম্পরা নিয়ে নানা কালজয়ী মাত্রার উপন্যাস ও চালচিত্র রচনা করেন। লোকজীবনে ঋষিবাক্যের স্তব্ধতা ভেঙে তাঁরা যুক্ত করেন সমসাময়িকতার গোনাগুনতি ও সৃষ্টিশীল গতির সংশয়।
দুঃখজনকভাবে পাই- মধ্যযুগীয় কবিদের দাপট ও লোকজীবনে বহমানকৃত্যের শক্তি সেলিম আল দীনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, অধিকারের বদলে তিনি অধীনস্থ হয়ে পড়েন। বিচারের কষ্টিপাথর বয়ে যায় মধ্যযুগীয় কবিদের হাতে, তিনি যা-কিছুই লেখেন সবই আসে তাঁদের ছাড়পত্র নিয়ে। ফলে সমকালীন জীবনে যে নানামুখী সম্পর্ক, টানাপোড়েন, বিস্তার ও ব্যাপ্তি তার সবটুকুর ওপর তিনি অধিকার ও বোঝাপড়া প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন না। সৃষ্টিতত্ত্বের এক অদৃশ্য ময়ূর আমাদের চৈতন্যের গহীন অন্তর্লোকে নিত্য শিস দেয়- খালি চোখে দেখা যায় না- বোর্হেস তা বোঝেন; কিন্তু সেলিম আল দীন সবকিছু তাঁর পাঠক-দর্শককে ইস্কুলের শিক্ষার্থী ভেবে মোটা দাগ দিয়ে দিয়ে বোঝান- দ্যাখো, এ-হচ্ছে প্রকৃত বাঙলা নাটক, তার নাম দিতে হবে পাঁচালির ঢং, এ-যে দেখছো তা’ উপাখ্যানরীতির নাটক, কৃত্য নাটকের সঙ্গে তার তফাৎটা গুলিয়ে ফেলো না আবার, খেয়াল করে দেখো ধ্রুপদী বাস্তববাদ, তার নাম দিই কথানাট্য, আরেকটু ভিতরে চলো গৃহাঙ্গন থিয়েটার দেখতে পাবে, হাতে সময় নিয়ে বসো বর্ণনাত্মক নাট্যরীতি, অভিনয়রীতি, নাট্য-আঙ্গিক, জাতীয় নাট্য-আঙ্গিক সর্বোপরি দেশজ নাট্যরীতির ব্যাপারগুলো বোঝাতে চাই!
তাঁর প্রায় সব নাটকেই পাত্র-পাত্রীদের দেখা হয় যাত্রাপালার রাতে, তারা গান করতে জানে- বয়াতী না হয় দোহার, পৌষ মেলা ছাড়া কলহাস্য করার আর জায়গা নেই, মনসার মন্দির পাশকাটানো তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব, আদম সুরত পথ দেখায় নীল আসমানের কম্পাসে, এক পর্যায়ে ভ্রুণ হত্যার মর্মান্তিকতায় দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন থেকে ধাবমান অবধি একটা গ্রাফ টানলে দেখতে পাই সেলিম আল দীন তেমন বাঁক বদল করেন নি।
যে প্রতীক সাংকেতিকতায় তার শুরু তা’ কাল পরম্পরায় চিত্রকল্পের শাখা-প্রশাখায় বিস্তার লাভ করে। নাটক মাত্রই যে খাড়া খাড়া দ্বন্দ্বে মুখোমুখি চারিত্রিক সংঘর্ষে টানটান সেলিম আল দীনে সেরকম কখনো হয় নি। তাঁদের মার্গ একেবারেই ভিন্ন, কিন্তু একটা জায়গায় মিলের কারণে বাঙলায় আরেকজন নাট্যকারের নাম করি, তিনি বাদল সরকার। দ্বন্দ্বের ঘনঘটার বদলে তিনি বুদ্ধির গতিময়তা মঞ্চে তুলে আনেন। সেলিম আল দীনের কিছুটা আগে, তিনিই প্রথম বাঙলা নাটকে কল্পনার একটি সূত্র উপস্থাপন করেন। মঞ্চের উপর যা তুলে ধরা হয় সত্য ঠিক সেখানেই খুঁটি গেড়ে বসে নেই; সত্য তার বাইরে কিছু যা ঠিক ওই মুহূর্তে মঞ্চায়তনে মূর্ত নয়। কিত্তনখোলা-র আগে শম্ভু মিত্র লোকজীবন মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করার উদ্যোগ নেন, এবং রচনা করেন চাঁদ বণিকের পালা। লোকজীবনের ঘাম, কাম, বুনন ও উৎকণ্ঠা সেখানে নেই; বস্তুজীবনে ক্লেদ ও সামগ্রিক ডিটেইলে তাঁর আগ্রহ নয়, তিনি মনোনিবেশ করেন জীবন জিজ্ঞাসার দার্শনিক প্রকল্পে। লোক আঙ্গিকের ভিতর সেলিম আল দীন প্রথম কিছুটা রক্তমাংসের মানুষ, তাদের লেন-দেন ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যৌগ স্থাপন করেন কিত্তনখোলা-য়। নাটক যে স্থবির নয় জীবনের রঙে সঞ্চরণশীল এক বাক্সময় প্রবহমানতা কিত্তনখোলা তার প্রথম ফলক। তার আগে শকুন্তলা এক আধাআধি নারী, সেলিম আল দীন শকুন্তলাসহ অন্যদের শনাক্ত করতে পারেন অর্ধেক; শকুন্তলার সমগ্র ও পারিপার্শ্বিক টানাপোড়েন ধরার অভিনিবেশ নাট্যকারের আওতার বাইরে। চক্রান্তদুহিতা শকুন্তলা বলামাত্র যে অভিমানী রঙরূপ, দ্বিধা ও সমর্পনের যৌগ চোখের সামনে ভাসে শকুন্তলা-য় সেটি মাঝপথে ঝুলে থাকে, সামূহিকতার জায়গায় আমরা একরৈখিক শকুন্তলাকে পাই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেভাবে স্থানোত্তীর্ণ ব্যাপ্তির আশা করেন:
মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! চিত্রফলকে আর কি লিখিবে? রাজা কহিলেন, ‘তপোবন ও মালিনী নদী লিখিব; যে রূপে হরিণগণকে তপোবনে সচ্ছন্দে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে এবং হংসগণকে মালিনী নদীতে কেলি করিতে দেখিয়াছিলাম, সে সমুদয়ও চিত্রিত করিব; আর প্রথম দর্শনের দিবসে পিয়ার কর্ণে শিরীষপুষ্পের যেরূপ আভরণ দেখিয়াছিলাম, তাহাও লিখিব।’
সেভাবে লেখা হয় নি। কিন্তু সেলিম আল দীন বরাবর নারী চরিত্র অঙ্কনে দীক্ষায়, মমতায়, অজস্র শ্রদ্ধায় তিলতিল নিষ্ঠা যোগ করেন। তাঁর নারীরা মেন্দিপাতার অপর নাম, দেখতে সবুজ কিন্তু তার ভিতরে কী তীব্র আগুন! শকুন্তলা-য় গৌতমী আর শকুন্তলা, কিত্তনখোলা-য় ডালিমন কী বনশ্রী, কেরামতমঙ্গল কাব্যে শমলা, হাত হদাই কীর্তিমান হয়ে ওঠে চুক্কুনির অবস্থিতি নিয়ে, চাকা-য় রাতদিন শঙ্কাদীর্ণ রেহানা, হরগজ-এ পিয়ারুন্নেসা অথবা রুমুনী বহুদিন পাঠকের বাকরোধ করে রাখে, বনপাংশুল-এ সুকী অথবা সখীপুর মহাজনে গতর বেচা পতিত মঙ্গলি, প্রাচ্য-এ অভিমানী উল্টা লখাই নোলক, একটি মারমা রূপকথা-র মনুরি আমাদের ভেতরকার সব গ্লানি দূর করে দেয়, নিমজ্জন-এ ভাসমান ধর্ষিত যুবতি ও তার বুকে লেপ্টে থাকা শিশুর চেহারা দেখে শিউরে উঠি, স্বর্ণবোয়াল-এ সক্রিয়তার দীপ্তি দেখায় সাঁঝমালা, যৈবতী কন্যার মন-এ কালিন্দী অথবা পরী আদায় করে সবটুকু মনোযোগ, ধাবমান-এ বাঞ্জা মায়্যালোক সবতী, পুত্র’র যমুনাবতী আবছা আমাদের শক্ত পায়ে দাঁড়াবার শক্তি জোগান দেয়।
সর্বোপরি তাঁর নারী শাড়ীর বদলে নদীর তরঙ্গ পরে নেয়, কান্না কোমলে মেঘের কোমর জড়িয়ে ওড়ে। ফলে তাদের ঠিক স্পর্শের নাগালে অনুভব করা যায় না; মনে হয় প্রত্যেকেই দ্বিতীয় রমণী যারা দীর্ঘশ্বাস আর প্রত্যাখ্যানে রঙিন পুনর্জন্মে মর্ত্যে আসে। কেননা, শিল্পে তিনি লুকোচুরি প্রতিপালনের পক্ষে, বাঙলায় বাস্তবতার সমস্ত রূঢ় হাতে তুলে আনার যে উদ্যোগ তাকে তিনি রুগ্ন বাস্তবতা বলে জোর তিরস্কার করেন। সেলিম আল দীনের একটি কবিতাই আছে শিল্প নামে, সে-টি একবার শুনে নিই: যেরকম চঞ্চল চড়–ই/ চলে আসি- স্বাভাবিক। এভাবেই চলবে লুকোচুরি/ বিমুখ নদী ও তৃষ্ণার প্রতিদিন। সারাদিন সারাবেলা/ এই অবহেলা অবহেলা খেলা।।
শিল্পকে তিনি বাস্তবতার নামে নিমজ্জন-এ কান্দাহার থেকে দুশ কিলোমিটার উপশিরোনামে বর্ণিত মর্মান্তিক দম বন্ধ করা দশায় দেখতে চান না: ইনকা মিশরীয় নয় আফগান মমি, বোমার ভয়ে তারা লুকিয়েছিল গুহার আড়াল। ব্লক বাস্টার বোমা গুহামুখে, আরেক পাহাড় ভেঙে দিল আটকে। শিল্পের ভাগ্যে এমন বদ্ধদশা তাঁর অকাম্য- তিনি এখনো কিছু জানালা খোলা রাখতে চান, সবগুলো বাতি নিভিয়ে ফেললে চলবে ক্যান! বিশ্বাসের সবটুকু নির্ভরতা শেষ হয়ে যায় নি; সেলিম আল দীন জানেন প্রাচ্য অদ্যাবধি দুর্ভাগ্য আর বিপন্নতা ভাগাভাগি করে নেয়, একজনের নয়নে ঝরে অন্যের চোখের জল। প্রাচ্যতার এ-একক সৌন্দর্য তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, আরো ঘন কৃষ্ণ কাকচক্ষু জল পান করার দীক্ষায় তিনি কুয়ায় নেমে যান, ফলে সারা দুনিয়া চলে যায় তাঁর দৃষ্টিসীমার বাইরে। পুরো পাশ্চাত্যকে দাঁড় করিয়ে দেন শত্র“ প্রতিপক্ষে। মিশেল ফুকোর নাম শুনতেই সেলিম আল দীন তাঁকে নাকচ করে দেন এক মিনিটেরও কম সময়ে। মিশেল ফুকো-সহ যে কাউকে তাৎক্ষণিক অধৈর্য্যে বাতিল করে দেবার দরকার পড়ে ক্যান? তিনি কেবল বলেছেন শোষণের প্রযুক্তির কথা, দেখিয়েছেন ব্যক্তি কীভাবে জানে না সে শৃঙ্খলার নামে অদৃশ্য শৃঙ্খলে আটকা। মিশেল ফুকো ব্যাখ্যা করেন ক্ষমতা ও ক্ষমতায়নের ব্যাকরণ, তার প্রাতিষ্ঠানিক বিধি ও প্রয়োগ; তিনি কার্ল মার্কসকে সম্মান করেছেন শতবার, কিন্তু প্রত্যাখ্যান করেন মার্কসবাদীদের প্রয়োগ কৌশল। শিউরে উঠতে হয় যখন দেখি প্রাচ্যতার শক্তি শেষ পর্যন্ত এক সর্বনাশা কানাগলির ভিতর মিলায়। সাপ্তাহিক ২০০০ ঈদসংখ্যা ২০০৫-এ প্রকাশিত তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরির একটি ছোট অংশ একবার দেখে নেয়া যাক:
এখানে কিছু মানুষের মুখে শ্বাপদের রোম হাতে বাঘনখ। অনৃত ভাষণ পটু স্নায়ুহীন মগজের কোষে জমাট রক্ত সেজন্য পৃথিবীতে আলো আর দেখে না কিছুতেই। তবু এখানেই কিছু কিছু প্রকৃত প্রার্থনার হাত নিত্য তোমাকে ডাকে শিউলি বকুলে ক্বাশিদায়। প্রাচ্যেই গভীরতর হও ঈশ্বর আপাতত প্রাচ্যেই থাকো।
ঈশ্বরের শুভৈষা একা ভোগদখল করার যে স্বার্থবাদী প্রকল্প তা’ প্রাচ্যদর্শনের পরিপন্থী নয় কী!
আসলে ঝড়জলবৃষ্টিভাঙনমুখর মাতৃজরায়ু সদৃশ এই ছোট অঞ্চলে দুনিয়াজোড়া মহীরূহ বিস্তারের এক ছোট বীজ কোলেপিঠে মানুষ করার সাকল্য বোধি বিদ্যমান দেখতে পাই; বাঙলা ছাড়া আর কোথায় পাবো হাজার বছর বাহিত বিবিধ ধর্ম ও কৃত্যের বিরোধ ও ঐক্য; গৌড়পুণ্ড্র, বরেন্দ্রী, রাঢ়, তাম্রলিপ্তি, সমতট, বঙ্গাল, হরিকেল অঞ্চলে ব্রক্ষ্মপুত্র, করতোয়া, পদ্মা, ভাগীরথী, মেঘনাবিধৌত পক্ষীস্বভাবী বঙ্গজন মিলে যে জনপদ প্রাচ্যের সকল রূপ ও চারিত্র্য তার প্রাণ। পূর্ব বলি কী পশ্চিম সবাই সংকটে দুর্ভাবনায় শীতার্ত; এই শৈত্যে ওম ছড়াতে পারে বাঙলা- কিন্তু আমাদের আরও বহুদিন অপেক্ষা করে থাকতে হয়। প্রাচ্য বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এডওয়ার্ড সাঈদ মূল আলো ফেলেন প্যালেস্টাইনে- সেলিম আল দীন প্রাচ্য বলতে বোঝেন পাঁচালি আর গাজীর গান। কেউ না কেউ তার মৌল মূল বহুদূর অন্বেষণ করবেন জানি।
সেলিম আল দীন মানতে চান না যে ঈশ্বর বধির। তাঁর মেয়ে অন্বিতা, কী সুকি, সোনাই অথবা ডালিমন, কেরামত অথবা সাঁঝমালা কী জনম মাঝির জন্য কল্যাণ কামনার আর্তি ঈশ্বরের চিরায়ত প্রাচীন অনড় চৌকাঠ থেকে আর্তচিৎকারে ফিরে আসে। কিন্তু তারপরও মানুষের পায়ে পায়ে যে অজস্র আগুন দানা বেঁধে ওঠে সেই আঁচ পাবার নৈকট্য তাঁর মধ্যে দেখি না।
মানুষের পাশাপাশি কী সমান্তরালে হেঁটে যাবার একটা ব্যাকুলতা তাঁর মধ্যে বরাবরই ছিল, তার নমুনা সবজায়গায় পাওয়া যাবে। একেবারে শেষের দিকের লেখা ঊষা উৎসব-ও তার বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম নয়। এখানে তাঁর যাত্রাটি এক বিমূর্ততার ভিতর হারায়, ফলে পূর্ব-পশ্চিমের ভেদও লুপ্ত হয়। ছু আর খ্রাম একত্র হলেই যেন ধমনীতে রক্ত সঞ্চালিত হয়- এরকম একটি অর্থ কল্পনা করে ঊষা উৎসব লেখার কাজে আগান- এখানে রবীন্দ্রনাথ ও গ্যাটেকে একসঙ্গে মিলাবার একটি প্রয়াস জাগে। ঈশ্বরের মানব সৃষ্টির যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ, এবং ঈশ্বরদ্রোহী দ্বারা বস্তুর মৌল স্বভাবের পরিবর্তন চেষ্টা এবং পরিশেষে ছন্দতালের মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তি- এই হলো ঊষা উৎসব-এর মূল কথা। অন্যদিকে ইউরোপের অপেরা ও ব্যালে নৃত্যকে এক সঙ্গে মিলাবার চেষ্টাও দুর্লক্ষ্য নয়। কিন্তু সর্বোপরি থাকে তাঁর কল্যাণবোধ; এভাবে অন্তিম ভটিমাগীতির প্রয়োগ দেখি:
মানবপুরাণ এই বলেছে ঊষাতে উৎসবে/ মানুষ প্রথম শিখেছিল শ্রমের যুগ্মতা। শস্যে এবং ছন্দে এবং কৃত্যকতার রঙে/ রাত পোহানোর পৃষ্ঠাতে রোদ সোনার অক্ষরে- যে রচে এই পুরাণ কথা সৃজন নদী রেখা/ নাট গীত নাচ আঙ্গিকে তার শিল্প স্বস্তি হোক।
সেলিম আল দীন এখানে শ্রমের যুগ্মতার কথাও বলেন কিন্তু তাঁর পুরো আয়োজনে একটি সাত্ত্বিক দূরত্ব দেখতে পাই। স্বর্ণবোয়াল বা পুত্র-এও একই রকম লাগে- আবছা বিপুলভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু তার পিছনে কোনো মৃত্তিকাসংলগ্ন বাস্তব কারণ দৃশ্যমান হয় না। যমুনার বিপুল ভাঙন ও ক্ষতি তাকে অস্থির করে তোলে, সে বালুমাটির ওপর দাঁড়িয়ে যমুনার প্রাবল্যের জন্য ছটফট করে, ধান্যের আহ্বানে ব্যাকুল হয়। তাকে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ঠেকে , কিন্তু তার স্বামী সিরাজের সঙ্গে উচ্চকণ্ঠ দ্বন্দ্বের ভিত্তি কোথায়! স্বর্ণবোয়াল ও ধাবমান-এও প্রায় একই ব্যাপার দেখি। যদিও সেখানে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বাইরে এসে একটা গোটা সামাজিক শ্রেণীগোষ্ঠী লোকালয় জুড়ে জেগে ওঠে- রুখে দাঁড়াবার সংকল্প দেখায়। কিন্তু তার গোড়ায় নির্দিষ্ট নৃতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক কী শেষ কথায় কোনো রাজনৈতিক শিকড় না থাকার ফলে স্বর্ণবোয়াল-এ ঘুরে দাঁড়ানোর পিছনে রক্তের প্রবাহ নেই; তাদেরকে নিকারির বদলে মনে হয় বিশেষ কাল্টসহ এক আধ্যাত্মিক উপাসক সম্প্রদায়।
ধাবমান-এ রাজনৈতিক দর্শনে মধ্যবিত্ততা থাকলেও সার্বিকভাবে এক অসামান্য রচনা। যদিও তার প্রারম্ভের বহুদূর পর্যন্ত হাসান আজিজুল হকের গল্প শোণিত সেতু পাঠকের ভ্রমণসঙ্গী হয়। অঢেল গোলাকার এক চাঁদের নিচে হাঁটতে থাকলে যেমন চন্দ্র ভ্রমণকারীর সঙ্গে সঙ্গে যায়, সেই রকম ধাবমান-এ সোহরাব ও অজগরের ক্ষিপ্র লড়াইয়ের মধ্যখানে হাঁসফাঁস করা প্রতিবন্ধী এসাক একান্তে হাসান আজিজুল হকের দুই ষাঁড় সাদা মানিক আর ছাইবর্ণ অবলার লড়াই ও তন্মধ্যে মৃত্যুমুখী কবিরাজ নিশানাথের সন্নিকটবর্তী হয়। কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই পর্বের পর দীর্ঘ কথানাট্য পরিক্রমায় সেলিম আল দীনকে এই প্রথম ধাবমান-এ পাওয়া যায় নিবিষ্ট তুলাদণ্ড-সহ এক কথাকার প্রতিমুহূর্তে সমান দক্ষতায় কৃষকের সহজাত হিসেবে ক্ষেতের সবটুকুজুড়ে এক অনন্য ভারসাম্যে বীজ বপন করে যান। ধাবমান শুরু করার আগে তাকে একশতভাগ প্রাচ্যদেশীয় করার যে সংকল্প গ্রহণ করেন, তার মর্মার্থ পুরোপুরি পরিষ্কার না হলেও ভাষা, বর্ণনা আর বিন্যাসের যে ভারসাম্য আনতে সক্ষম হন তার তুলনা মেলা ভার। পাশ্চাত্যের একটি ছিটেফোঁটও থাকবে না এই স্বঘোষণাসহ ধাবমান রচনায় প্রলিপ্ত হলে একটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ে- প্রায় সব কথানাট্যেই নানাভাবে বিভিন্ন সাঙ্গীতিক রাগের ব্যবহার করেন; সবচেয়ে বেশি দেখি বনপাংশুল-এ; তিনি ৭২টি রাগের উল্লেখ করেন- কিন্তু ধাবমান-এ একটিও রাগের প্রয়োগ নেই! এতদিন পর তিনি কী বুঝতে পারেন যে গদ্যভাষায় আমরা যাকে ঠাসবুনুনি বলি বারবার রাগের উল্লেখ করলে ওই ঘন বুননের ক্ষেত্রে একটা শ্লথগতি আসে? নাকি তিনি অধিকতর নিউ টেস্টামেন্ট-এর কাছাকাছি যেতে চান- যেখানে অন্তর্লীন একটি রাগের প্রয়োগ আছে যার উল্লেখ নেই মাত্র। বাইবেলের ভাষা স্থির ও অভিজাত এক ধরনের দূরত্ব তার মধ্যে সতত ধার্য্য; সেলিম আল দীনের ভাষা ধাবমান-এ এসে অনেক সংগঠিত ও তাজা। বার বার নিউ টেস্টামেন্ট-এর কাছ থেকে অনুমতিপত্র আনার দরকার পড়ে না। ধারণা করি- সেলিম আল দীনের শিল্প দীর্ঘ পথে সবচেয়ে বড় চরিত্র ষণ্ড মোষ সোহরাব। সোহরাব সবাইকে ছিঁড়েফুঁড়ে যায়- সোনাই-এর জন্য আমাদের একবার কিত্তনখোলার পাশ থেকে ঘুরে আসতে ইচ্ছা করে, ডালিমন জানি কোনখানে হারায়, আনার ভাণ্ডারীর অভিযাত্রা কোনোদিন শেষ হবে না, বাতাস ও বেদনার কাজে কেরামত থাকে কিন্তু চারদিক থেকে অধিকার করে ষণ্ড মোষ সোহরাব জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে তার জীবনের ধ্বনি, সংগ্রামশীল ব্যাকুলতা সোহরাবকে এক অসামান্য আকুতি দিয়ে যায়, শত সংগ্রামশীল ধাবমানতার পর চারদিক থেকে মৃত্যু বর্শার মুখে ছোরার নির্লিপ্ত দাঁতে দাঁতে তাকে বেড় দিয়ে ঘন হয়ে আসার নিয়তি শতভাগ জানার পরও সোহরাব বাৎসল্যের ঠিকানায় হারে, স্নেহের কাছে ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করতে সোহরাব সহস্র বিগ্রহ, রক্তক্ষরণ ডিঙিয়ে আবার সুবতী ও নহবত আলীর কাছে ফিরে আসে, সে হয়তো ভাবে শেষমেষ প্রতিবন্ধী এসাকের সঙ্গে আরেকবার দেখা হোক! এতদিন বাঙলা সাহিত্যে কোনো পশুর সংশ্রবের কথা উঠলেই গফুরের মহেশ-এ গিয়ে ঝুলে থাকতো- এখন তার সীমানা বেড়ে দিগন্তে মিলায়। সোহরাবের আগে দেখি সঙ্গমক্লান্ত কূলনাশী মহিষনী হামেলা তুরা দাহালা থেকে বন্য রাত্রির পরতে পরতে পাহাড়ী পথ বেয়ে অক্ষয় বীজ নিয়ে আসে নহবত আলীর ঘরে। বোবা মেয়ে এষা এক স্রোতস্বিনী ভাষা বপন করে, এসাক কেড়ে নেয় সবটুকু স্বস্তি, মুনীন্দ্র মারাকের দিব্যজ্ঞানে কল্যাণের সূত্রপাত, মান্দি এবং ম্রোঙদের সম্মিলিত ধ্বনিরূপ, পাহাড়ী- নগদী দ্বন্দ্ব লড়াই, রুয়া মিল্লাম নিয়ে গারোদের অবিনাশী প্রস্তুতি- তার সবকিছুসহ ধাবমান এক অবিসংবাদিত রচনা।
ধারণা করি সেলিম আল দীন এই প্রথম না-পূর্ব না-পশ্চিম, প্রকৃতপক্ষে তাঁর শিল্পবোধের কাছে নিঃশর্ত নতজানু হয়ে বসেন। পশ্চিমে অনীহা আর প্রাচ্যপ্রিয়তার নামে যে মধ্যযুগীয় আঙ্গিকবাদিতা ওই দুই থেকেই নিজেকে খুলে এনে আপন সরোবরে ডুব দেন।
সামাজিক বা কোনো নৃগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব যে সেলিম আল দীন গৃহীত শিল্পরীতির অনুমোদন পেতে পারে তা’ প্রথম দেখি বনপাংশুল-এ। যে প্রতিরোধ চৈতন্যের গোড়াপত্তন হয় আতর আলীদের নীলাভ পাট, করিম বাওয়ালীর শত্র“ অথবা মূল মুখ দেখা কী বাসন-এ। মৌলিক চাষাবাদে তিনি যত বেশি উদ্যোগী হন, প্রতিরোধ চেতনার নাট্যিক রূপায়ণ থেকে ততোটা দূরে সরে আসেন। সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত ঘরানার শিল্পপ্রয়াসীদের মধ্যে এমত ধারণার প্রচল থাকে যে প্রকৃত শিল্পে রাজনীতি ও প্রতিরোধ অঙ্গীভূত করে নিলে তা’ সৃষ্টিশীলতা হারায়। অথচ এই উদাহরণ দুর্নিরীক্ষ নয় যে কেন্দ্রে রাজনীতি রেখেও কালোত্তীর্ণ শিল্প রচনা হতে পারে। আসলে তৃতীয় বিশ্বে যে-কোনো রচনা বা রচনা বিচারে রাজনৈতিক আভিমুখ্য এড়িয়ে যাওয়া অসঙ্গত, এবং তার জন্যই অসম্ভব। আবার রাজনৈতিক বোধ ও পরিণতি দাঁড়িয়ে থাকে শ্রেণীসত্যের ওপর।
হাস্যমুখরতায় শ্রেণী থাকে, প্রার্থনীয় শ্রেণী অতি প্রাচীন ও গভীরে, যৌনতার শ্রেণী চরিত্র চৌষট্টি কলা দিয়ে ঢাকা যায় না, যে-কোনো শোকসাংস্কৃতিক অবকাঠামোয়, কৃত্যে শ্রেণীর প্রকাশ টের পাওয়া সহজসম্ভব। যে-কারণে নগুগি ওয়া থিয়োঙও তাঁর ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড: দ্য পলিটিক্স অব ল্যাংগুয়েজ ইন আফ্রিকান লিটারেচার বইয়ের দ্য ল্যাংগুয়েজ অব আফ্রিকান থিয়েটার অংশে থিয়েটারে তাঁর সংযুক্তি, সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে লোকনাট্য রক্ষা করার উদ্যোগ, কার্যপ্রণালী ও সংগ্রামের ইতিচিত্র তুলে ধরেন। তিনি দীর্ঘ আলোচনায় ভেঙে ভেঙে দেখান সাম্রাজ্যবাদী থিয়েটারসমূহের আগ্রহ কোথায়, আর কেমন করেই-বা তাঁদের আঁকড়ে ধরতে হয় নিজস্ব নাট্যপ্রবাহ ও লোকনাট্যের আঙ্গিকগুলোকে জীবন্ত করে তোলার কাজে- তিনি বলেন তাদের সবকিছুর মূলে বাঁধা রাজনৈতিক প্রশ্ন। কোনো বিলাসিতার ঝোঁক নেই- তাঁদের নাট্য আঙ্গিক ও সাংগঠনিক কাজ সম্পূর্ণ নির্ভর করে মানুষের জীবন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সৃজনশীল প্রয়োগের ওপর। তাঁর বয়ানের কোথাও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে পলাপলি খেলার মনোভাব নেই।
সেলিম আল দীন শিল্পশুদ্ধতার শুচিবাই-এর কারণে নিজের ব্যাপারেও বলবেন না যে তিনি মধ্যবিত্ত; বলুন আর না বলুন মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের শরীর ও ছায়া তাঁর সমগ্র রচনার খাঁজে খাঁজে বসানো- জন্মদাগের নিয়মে ঘষে তোলা যায় না। চাকা-র মতো অসামান্য কথানাট্য মধ্যবিত্ততার কারণে কোথাও ঝুলে পড়ে নি, কেননা চাকা মানবিক সম্পর্কের যে-অঞ্চলটি নিয়ে বিকশিত হয় তাতে তাঁর মধ্যবিত্ততা বড় কোনো চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ে নি। কিন্তু তিনি বেশুমার আটকে যান নিমজ্জন-এ।
রুক্ষ্মবর্ণ নাম একটি অচল ও বাজেয়াপ্ত লেখার জের ধরে সেলিম আল দীন লেখেন নিমজ্জন। লেখার অন্তে দাবি করা হয় নিমজ্জন-এ কোনো প্রথাগত গল্প নেই- এখানে কোনো পৌরাণিক কাহিনী বর্ণনা করা হয় নি। তাঁর নিজের জবানীতে শোনা যাক:
একটি ব্যর্থ লেখাকে নিয়ে এত কথা লিখবার প্রয়োজন হত না যদি সেই ব্যর্থতাকে আমি নিজের জন্য চরম বিপর্যয় বলে না ভাবতাম। ভেবেছিলাম ঐ কাব্যের পরে হয়তো লেখা থেকেই অবসর নেব। তা হয় নি। বরং সেস্থলে এসে দাঁড়াল নতুন লেখা নিমজ্জন।
নিমজ্জন কোনো একটি শহর, অঞ্চল বা জনপদকে নির্দিষ্ট করে লেখা নয়। সমস্ত সঙ্কটসঙ্কুল বিশ্বকে এ-কাব্যে নগররূপে দেখতে চেয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরির কিছু অংশ যা সাপ্তাহিক ২০০০, ঈদসংখ্যা ২০০৫ সংখ্যায় প্রকাশিত; ওখানে তিনি বলেন, চাঁদপুর শহরে কোনো একবার ধুলিঝড় দেখে নিমজ্জন-র গল্পটা মাথায় আসে। মোটা দাগে নিমজ্জন-এ কোনো গল্প নেই; কিন্তু তার ভিতরেভিতর সোনামুখী সুঁইয়ের সূত্রে একটি অন্তর্লীন গল্পে বিস্তার দেখি। কলেজের এক অধ্যাপক এবং তাঁর বন্ধু নানা প্রসঙ্গে একের পর এক হত্যা, ধর্ষণ, কারফিউ, নিপীড়ন, যুদ্ধের বীভৎসার যোগাযোগ গেঁথে গেঁথে একটি কাঠামো দাঁড় করায়, তাদের নামও জানানো হয় নি, ফলে এ-গল্প শিরোনামহীন গোত্র-কাঠামোর বাইরে কেবল তার অবয়ব দেখায়। সেলিম আল দীনকে তার আগে এতো মেলায় হারিয়ে যাওয়া বালকের মতো আর লাগে নি। যে রাজনৈতিক দার্শনিক শক্তি থাকলে বিশ্বজোড়া গণহত্যা, অন্যায়, গ্লানি, পরাধীনতা, লজ্জা, মিথ্যা সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদের বিপন্ন নগ্ন হিংস্রতা মোকাবেলা করা যায় তার কিছুই সেলিম আল দীনের আয়ত্তে নেই। গণহত্যা যে কুশ্রী, ধর্ষণে, অগ্নিপাতে দুনিয়ার বসন্ত উধাও এমন একটি শিশুসুলভ বয়ান পেশ করার দরকার পড়ে ক্যান! জাতিসংঘের মহাসচিব তাঁর নাম যা-ই হোক কফি আনান, কী বান কী মুন- দুনিয়ার সবচেয়ে বড় খোঁজা- তারাই কী এসব ফালতু চিল্লাচিল্লি করার জন্য যথেষ্ট নন? একই কথা চিত্রকল্পসজ্জিত করে বলার দরকার কী!
এক্ষণে মনে হয় রুক্ষ্মবর্ণ নাম যে রচনাটি বাতিল করে দেওয়া হলো সেটি নিশ্চয়ই এমন অকেজো ছিল না। বোধ করি কিছু দিক তিনি রুক্ষ্মবর্ণ-এ স্পর্শ করেছিলেন যা তাঁর অনুগত স্বস্তিকর শিল্পসূত্রের পরিচিত কাঠামোর সঙ্গে মেলে নি। তিনি দাঁড়াতে পারতেন ভৌগলিক আকারে ছোট মাতৃজরায়ুসম বাঙলার আত্মিক শক্তির সংবেদনশীল দৃঢ়তার ওপর। নিমজ্জন-এ প্রাচ্যের প্রকৃত শক্তি মেলে দেখাবার মোক্ষম সুযোগ ছিল।
সেলিম আল দীন যতবড় লেখক ততোধিক জনক। তাঁর চরিত্ররা সেটুকু ভাঙনের মুখে যায় যতদূর তিনি পিতা হিসেবে সইতে পারেন, তারা কখনো অযাচারে লিপ্ত হয় না, কারণ প্রথাগত সম্পর্কের বাইরে তাঁর কোনো সমর্থন নেই; তিনি অতি সাবধানে পা ফেলেন যাতে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে কোনো আঁচড় না লাগে, তিনি চরিত্রদের বিজয়ীর বেশে দেখতে উৎকণ্ঠিত, তাঁর পুত্র-কন্যারা ক্ষেত্র-বিশেষে বিচ্ছেদের মুখোমুখি দাঁড়ায় এবং মূল্যবোধের রাজটীকা মাথায় নিয়ে পতিত হয়, কেননা মৌলে তিনি ভাবেন, প্রাচ্যে ভাঙন নেই, স্বার্থসংশ্লিষ্টতা যা আছে তার সবই পশ্চিমে। সেলিম আল দীন তাঁদেরই সঙ্গে যাঁরা কখনো ভিলেনকে তার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেন না। মীরজাফর ও মোহনলালের কথা আমরা কেউ কোনোদিন শুনিনি- তারা পূর্বনির্ধারিত বিশ্বাসঘাতক; পারিবারিক পীর-প্রথার বিপক্ষে সজ্ঞান এজিদের বিবেচনা তুলে ধরার গণতান্ত্রিক অধিকার সবাই হরণ করে নেয়। সেলিম আল দীন যদি দাবি করেন তিনি সবই একসঙ্গে লেখেন, উপন্যাসও তাঁর পাণ্ডুলিপির অন্তর্গত সত্য, তাহলে সবার সামনে থেকে নিষেধের তর্জনী সরিয়ে নিতে হবে- চরিত্ররা জোয়ান বা বৃদ্ধ হবে তাদের নিজের কব্জির জোরে। মূল্যবোধের ওজন সরিয়ে নেবার প্রস্ততি সেলিম আল দীনের আছে কী-না তার জোর সন্দেহ জাগে। পিটার ব্র“ক-এর সহকর্মী জাঁ ক্লদ ক্যারিয়ে বেদব্যাস সম্পর্কে বলেন, মহাভারতে এমন অনেক চরিত্র ক্রিয়া করে যারা ব্যাসের রাখঢাকের বাইরে বড় হয়ে ওঠে, তার নিষেধ ও পরিকল্পনার তোয়াক্কা করে না, এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সামলে নিতে ব্যাসকে নোতুন নোতুন ঘটনা ও চরিত্রের সমাবেশ ঘটাতে হয়। ব্যাস পারেন, কারণ তিনি মূল্যবোধের ব্যুহের ভিতর ছিলেন না- সেলিম আল দীন বরং মূল্যবোধের ঘেরাটোপে আটক, তার বাইরে যাবার সাধ্য কী! প্রাচ্য-এ সয়ফর নিজের পছন্দ ও সিদ্ধান্তে বড় হয়ে ওঠেনি। তাকে বলা হয়েছে তুমি মহৎ হও- সয়ফর এক অপ্রতিরোধ্য নায়ক হিসেবে বেরিয়ে আসে সবার সামনে। কীভাবে সয়ফর বেহুলার সমকক্ষতা নিয়ে আবির্ভূত হয় তা’ বোঝা দুরূহ কাজ। ঋগবেদের বৈবাহিক মন্ত্রে পুরুষের এই প্রার্থনা থাকে- তুমি আমারই কর্মভাবনা এবং ব্রতে তোমার হৃদয় আধ্যান করো, তোমার চিত্ত যেন আমার মনের অনুকূল হয়, কণ্ব মুনীর শকুন্তলাকে দেওয়া উপদেশটুকু শোনা যাক- সপতœী সতীনদের তুমি সখীর মতো দেখো; কুন্তীর বিবাহোত্তর কালে পাণ্ডু তাঁর নববধূর মঙ্গলপট্ট এতটুকু মলিন হবার আগেই মাদ্রীকে বিয়ে করতে পারেন; অন্যদিকে কুলসুমের অজস্র কান্না, নিবেদন ও আত্মত্যাগের ফলে তাঁর স্বামী বেলালের আড়াই দিনের আয়ু আল্লাহ বাড়িয়ে দেন আরো বহুগুণ, বাঙলার নারী তার স্বামীকে তুলে নেন সিঁথির সিঁদুরে, ত্যাগে, ধ্যানে, অশ্র“জল ও দীর্ঘ নিঃসঙ্গ অগ্নির দহনে সব নারীর পক্ষে গাঙুরের জলে ভেলা ভাসায় বেহুলা; অন্যদিকে পুরুষ নারীকে অর্ধেক মানুষ হিসেবেও গ্রহণ করেনি, পুরুষ নারীকে অসম্মান করে ধর্মে, সংস্কার তাকে দেয় দানবীর কলঙ্ক, পুরুষতন্ত্র তাকে ঠেলে তোলে সহমরণের চিতায়, যৈবতী কন্যার মন নাটকে ভবানীর আর্ত-চিৎকারে কাল বিদীর্ন হয়; অথচ এই নিষ্ঠুরতা পৈশুন্য উল্টে দিয়ে এক কালোত্তীর্ণ নায়ক হিসেবে বেহুলার সমকক্ষতা নিয়ে সয়ফরকে এগিয়ে আসতে দেখি! এ-ও পুরুষতান্ত্রিক মানসের আর একটি মহৎ ঠাট্টা মাত্র। এ-কথা ঠিক, যা-কিছু প্রকল্পই তিনি গ্রহণ করুন সবকিছুর মূলে প্রতিষ্ঠিত করতে চান প্রাচ্যের শক্তি। সমস্ত শক্তিই আসলে নাট্যিক- নোতুন নোতুন মিথষ্ক্রিয়ার ভিতর দিয়ে তার প্রমাণ মেলাতে হয়, কোনো কাঠামোই স্থির অনড় ঋষিবাক্য নয়, তাকে একটি কম্পযাত্রার ভিতর দিয়ে না গেলে চলবে না। এক ঠাঁয় অনন্তকাল এক জায়গায় খাড়া প্রাচ্যের শক্তি বলে কিছু নেই। হ্যাইসনাম কানহাইলাল তাঁর রিচ্যুয়াল থিয়েটার নিবন্ধে বলেন, ট্রানজিশন- পরিবর্তমুখরতাই সংস্কৃতি; তিনি বলেন ভারতে এই চলমানতার সূত্র তাঁরা শিখেছেন পূর্বসূরী স্তানিস্লাভস্কি, মায়্যারহোল্ড, ক্রেইগ, কোপেও, আর্টুড, ব্রেখ্্শ্ট, গ্রোটওস্কি, বাদল সরকার এবং হাবিব তানভিরের কাছে। এই পরিবর্তনশীলতা গ্রাহ্য করে নিলেই থিয়েটারের মধ্যে নোতুন শিক্ষা ও মূল্যবোধের সংযোগ ঘটবে। থিয়েটার কখনো আঙ্গিক নয়- সারমর্মের গতিশীল মিথষ্ক্রিয়া।
কিন্তু সেলিম আল দীন নাট্যিক মিথষ্ক্রিয়া গ্রহণ করে নেন না, কারণ পাশ্চাত্যে চরিত্রের সঙ্গে চরিত্র যে দ্বন্দ্ব মোকাবেলা করে প্রাচ্যে তার প্রচলন নেই। তিনি পশ্চিমের রীতি গ্রহণ করবেন না বলেই প্রতিজ্ঞা করেন। পশ্চিমে চরিত্ররা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবার কারণ সবটুকু প্রসেনিয়াম থিয়েটারের আঙ্গিকরীতির কারণে ঘটে বলে ধরে নেয়া ঠিক হবে না। এগুলো আসলে ব্যক্তির বিকাশ এবং অবিকাশের ফল। পাশ্চাত্যে যে মাপে ট্র্যাজেডি নাটক হয়, পূর্বে তা’ হয় না। তার কারণ যতোটা নাট্যিক তার চেয়ে বেশি সামাজিক রাজনৈতিক। পশ্চিমের ব্যক্তি হেলে পড়ে না, প্রাচ্যে ব্যক্তি সঙ্কটে, সংঘাতে প্রিয়জনের কাঁধে মাথা রাখে; ক্রান্তি আর দুঃসময় ভাগাভাগি করে নেয়- নোতুন পথ বের করে ফেলে; ফলে ট্র্যাজেডির মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় না- প্রাচ্য জানে কীভাবে মৃত্যুর কঠিন মুখেও রঙিন বন্ধু-র আলো বসিয়ে দেওয়া যায়। মৃত্যুর সরোবরে সাঁতার কেটে নিতে সাগ্রহ অপেক্ষা করে এমন লোকের সংখ্যা প্রাচ্যে কম নয়। তারা জীবনকে মৃত্যুর ওপর শতায়ু দীর্ঘ করে নিতে জানে। পশ্চিমে ব্যক্তি নিদারুণ একা, হিমালয়ের চূড়া যেমন নৈঃসঙ্গে কাঁপে, পশ্চিমের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে সেই ভয়াল একাকিত্বের শৈত্য নেমে আসে। তারা কান্নাও ভাগাভাগি করে না। যৌনতা আর অশ্র“জল দুই-ই তাদের কাছে ব্যক্তিগত। যে-একাকিত্ব দেখি স্যামুয়েল বেকেট-এর গডোর প্রতিক্ষা-য়: ভøাদিমির যখন জিজ্ঞেস করে, বেশ এবার তাহলে যাওয়া যাক? এস্ট্রাগণ বলে, তাই তো, চলো যাই; কিন্তু একজনের কথার কোনো কার্যকারিতা অন্যজনের ওপর থাকে না। তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকে। সেলিম আল দীনের যে শঙ্কা পাশ্চাত্যে নাটক মাত্র-ই দ্বন্দ্বের খাড়াখাড়া সামনাসামনি বোঝাপড়া- এখানে কিন্তু সে-রকম নেই। বের্টোল্ট ব্রেখ্্শ্টের নাটকও কাহিনী আকীর্ণ ঘটনা থাকে না, সারাক্ষণ জুড়ে চলে এক ধরনের তথ্যের খেলা।
আর্টেমিস একা- পুরুষের সঙ্গ বাতিল করে দেয় এক ঝটকায়, তার থেকে ঊর্বশী কামে ঘামে অনেক বেশি নিকটবর্তী, আর জঙ্গম। প্রাচ্যে একাকিত্বে শোভা নয়, সুষমা তার সাহচর্য্য।ে রাধা কৃষ্ণের মান ভাঙাতে তার সখীদের বলে, বারবার মিনতি করে; সইদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা আর দুঃখ দুই-ই ভাগ করে নেয়। রাধা অভিসারে যায় সখীপরিবৃত:
পদ দুই চারি সখী মেলি, ধস ধস অন্তর ধাধস ভেলি॥ ক্ষণে ক্ষণে চঙকি বাদ পালটায়, ক্ষণে কাতর দিঠে সখী মুখ চায়॥ সখীগণ পুনঃ পুনঃ করে আশোয়স, ঐছন কুঞ্জে মিলল হরি পাশ। দূরে হেরই যদুনন্দন দাস॥
অথবা এমন কি হতে পারে যে প্রাচ্যে নারীর গভীর গোপন বেদনা একার পক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, ফলে তার কিছুটা ওজন সখীর ধৈর্য্যরে ওপর ছেড়ে দিতে হয়! বাঙলায় নারীর পোড়া এতটাই দীর্ঘ-ব্যাপক যে সেলিম আল দীন একজন নারীর কথা বললে তার কিনারা হয় না- যৈবতী কন্যার মন-এ তাঁকে বলতে দেখি দুই নারীর কথা। বর্ণে মেঘনীলিম হে ছায়ানারী, এই যন্ত্রধ্বনির সোনার সিঁড়িতে তোমার পা রাখো। তুমি দুই নামে দুই কায়া কিন্তু একই যৈবতী কন্যা। পরলোকের ধূমঅগ্নি যদি ভেদ কর- তবে আইস! এখানে নারীর বস্তুজীবন স্বল্পায়ু। কিন্তু তার অমিমাংসিত তৃষ্ণা জীবনের অধিক, তা প্রলিপ্ত হয় উড্ডয়নশীল মেঘমালা থেকে সামান্য তরুপত্রের রঙে; ফলে সে মরে কিন্তু নিঃশেষ হয় না। কালিন্দী ধর্মবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসে প্রণয়ের টানে, কিন্তু শক্ত অবিচল মাটির ওপর দাঁড়াতে পারে না; দ্বিতীয় খণ্ডে পরী- প্রাকৃত জীবনের গন্ধমাখা নারী- শিল্পের ভিতর বেড়ে ওঠা এক আত্মবিনাসী কাঠামো যে শিল্প ও জীবনকে এক বিন্দুতে মিলাতে চায়।
একই নারীর দুই রূপ, অথবা সম্পূর্ণ দুই স্থিরচিত্র যারা কখনোই এক বিন্দুতে উত্তীর্ণ হয় না; জীবন থেকে তাদের তৃষ্ণা বড়, কোনোদিন সংসারপটে পা ছড়িয়ে বসতে পারে না- কেবলই আকুতির পিছনে হারায়। তাই একই নারীর জন্ম, লাঞ্ছনা, স্বপ্ন, মৃত্যু আর জন্মান্তরবাদী জীবন পরিধির গল্পে সমান্তরালে দেখতে পাই নিযামী- নিযামউদ্দিন আবু মোহাম্মদ ইলিয়াস ইবনে য়ুসুফকৃত সাত রাজকন্যা-র বহুবর্ণিল কাহিনী বর্ণনাকে হার মানায়। সেলিম আল দীন বলেন যৈবতী কন্যার মন রচনার প্রাক্কালে সাত রাজকন্যা-র কাহিনী বর্ণনা তাঁর মধ্যে কিছুটা প্রভাব ফেলে। সাত রাজকন্যা নিযামীর বর্ণনায় সাত রঙের যাত্রা যা শুরু হয় কৃষ্ণবর্ণে আর সমাপ্তি ঘটে শুক্লায়। কিন্তু যৈবতী কন্যা-য় কালিন্দী কিংবা পরী কখনো সাদার মুখ দেখেনি। সেলিম আল দীন হপ্ত পয়করে মুদ্রিত মিনিয়েচার চিত্রের উল্লেখ করে সে কাহিনীমালা অভিনয়রীতির একটি ইঙ্গিত দেন, কিন্তু তা’ সঠিক হবার সম্ভাবনা কম; কেননা বাদশা বাহরাম শাসন করেন পঞ্চম শতকে, মিনিয়েচারগুলো তৈরি হয় পঞ্চম শতকেরই কোনো এক সময়ে, নিযামী সাত রাজকন্যা লেখেন দ্বাদশ শতকে। তবে কোনো না কোনোভাবে সেই কাহিনীগুলো অভিনীত হবার সম্ভাবনা থাকে, সে-কারণেই চেক প্রাচ্যবিশেষজ্ঞ জেন রাইপকা বলেন- বাহরামের সপ্ত ভার্যা বর্ণিত কাহিনী ছন্দোময় এক বর্ণনাত্মক কাব্য এবং প্রতীকের বহুবর্ণিল চলমানতা মন কেড়ে নেয়।
সেলিম আল দীন তাঁর দীর্ঘ শিল্পজীবনে নারীর বেদনা ও অশ্রুপাতের গাথা লিখে যান বারবার, এবং বোধ করি তার কোনো প্রতিকার করতে না পেরে এক সাত্ত্বিক চৈতন্যে নিষ্পত্তি খোঁজেন। এবং কালক্রমে শিল্পও দৃশ্যকাঠামোর বাইরে কিছু প্রতীকের দিকে যাত্রা করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাট্যপথের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে সেলিম আল দীনকে এক ছায়াপুত্র হিসেবে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের নাট্যরচনার শুরু ১৮৮১ সনে বাল্মিকী প্রতিভা নামক এক গীতিনাট্যের ভিতর দিয়ে, যদিও নাটক নিয়ে কবিতার বাইরে একক পরিকল্পনায় ১৮৮৯ সনে লেখা রাজা ও রাণী; এবং বিসর্জন। বাল্মিকী প্রতিভা ঠিক নাটক নয়, নাটকের আদলে লেখা কবিতা। প্রকৃত নাটক রাজা ও রাণী; এবং বিসর্জন। উপরোক্ত ওই দুটি নাটক লেখার সময় তাঁর মাথায় থাকে উইলিয়াম শেক্সপীয়রের বিয়োগান্ত নাটক। রবীন্দ্রনাথ বলেই তিনি বিফল হননি, দুটো নাটকই সাফল্যের প্রোজ্জ্বল মুখ দ্যাখে। কিন্তু অচিরেই তিনি বোঝেন ইউরোপীয় প্রকল্প এবং ট্র্যাজেডি নাটক তাঁর মানস নয়। নাটকের কাঠামো মোক্ষম বিষয় নয়, রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত পার্থক্য তাঁর ভারতীয় দার্শনিক ভিত্তি। তাঁর অভীষ্ট জীবন দেবতার সৌন্দর্য খুঁজে বের করা, সেখানে দুঃখ অস্থিতিশীল, এবং জীবনে ইতিবাচকতা দুঃখের উপরে অবস্থিতি করে। তিনি নিজস্ব নাটগীতিরীতির শক্তি খুঁজে বের করার প্রকল্পে তাঁর নাট্য মনোযোগ প্রযুক্ত করেন; এবং রচনা করেন চিত্রাঙ্গদা, বিদায় অভিশাপ, সতী, গান্ধারীর আবেদন, নরকবাস, কর্ণকুন্তী সংবাদ ও লক্ষ্মীর পরীক্ষা।
ইউরোপীয় নাট্যকাঠামো ভারতীয় নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক বিন্যাস, লৌকিক উপস্থাপনাভঙ্গিমা নাটগীতিরীতি সবকিছুর সংশ্লেষের ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত স্থির করেন তাঁর স্বকীয় ভুবন যা-কিনা প্রতীকী নাটক বলে চিহ্নিত। সারদোৎসব, রাজা, ডাকঘর, অচলায়তন, মুক্তধারা ও রক্তকরবী-র মধ্যে দেখতে পাই রবীন্দ্রনাট্যের এক সামগ্রিক অবকাঠামো। ইউরোপের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যে মৌলিক তফাৎটি দাঁড় করান তা’ বিকশিত হতে দেখি চরিত্রের অন্তর্কাঠামোর দৃশ্যমানতায়, জীবনের অদৃশ্যমান মর্মবস্তুর বাক্সময়তাই প্রধান। তাঁর নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রসমূহ কখনো শারীরিক-বাহ্যিক দ্বন্দ্বে চিত্রায়িত নয়, তাঁরা সবাই আত্মার মুক্তি সন্ধানে ব্যাকুল- রক্তকরবী-র নন্দিনী কখনো পাশ্চাত্যরীতির চাক্ষুষ চরিত্রের সঙ্গে মেলে না, ডাকঘর-এর অমল বস্তুগত লাভ-লোকশানের বাইরে, অচলায়তন-এর পঞ্চক দিগন্তের দিকে ডাকে, মুক্তধারা-র অভিজিৎ নিয়ে আসে দৃশ্যমানতার বাইরে এক অন্তর্বাস্তব।
একইভাবে দেখি, সেলিম আল দীন শুরু করেন সম্পূর্ণ ইউরোপীয় ধাঁচে, এবং রচনা করেন জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন, সংবাদ কার্টুন, এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা ইত্যাদি নাটক। তারপর তিনি রবীন্দ্রনাথের মতোই শকুন্তলা, কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই-এর ভিতর দিয়ে প্রবলভাবে মৌলে ফিরে আসেন। রবীন্দ্রনাথে অন্বেষা হয় নিজস্ব নাটগীতিরীতির উচ্চতর রূপ, সেলিম আল দীন আরো গভীরতার মধু তুলে আনায় ব্রত নিয়ে ডুব দেন মধ্যযুগের বাঙলা নাট্যে। রবীন্দ্রনাথে যা জীবন-দেবতা; সেলিম আল দীনে এসে সেই প্রত্যয় এক ধ্রুবসত্য-র রূপ নেয়। যে-কোনো গভীর অন্বেষণের গন্তব্য অদৃশ্যমানতা- তাই রবীন্দ্রনাথের নাট্যযাত্রা শেষ পর্যন্ত চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা ও শ্যামা-য় এসে কায়াহীন রূপ পরিগ্রহ করে; সেলিম আল দীনও নিজেকে থিতিয়ে ঊষা উৎসব লেখেন; এবং মাটি খুঁড়ে জীবনের সত্য বের করে আনার সংকল্প থেকে একটি চাকমা লোককাহিনীর নৃত্যনাট্যরূপ বিধানের জানান দেন। মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন চিরকুমার সভা, সেলিম আল দীন রচনা করেন মিউজিক্যাল কমেডি মুনতাসির ফ্যান্টাসী।
কাল পরম্পরায় রবীন্দ্রনাথ ও সেলিম আল দীন দুটি ভিন্ন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ নাটকের একটি দীর্ঘ যৌগ প্রক্রিয়ার মধ্যে থিয়েটার হিসেবে উপস্থাপিত হবার গতি ও দায় দেখে যেতে পারেন নি। ধারণা করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি শম্ভু মিত্রকৃত রক্তকরবী-র মঞ্চায়ন দেখতে পারতেন তাহলে ভালো হোক কী মন্দ হোক তিনি নাটক রচনার কোনো কোনো দিক নিশ্চয়ই নোতুন করে ভাবতেন! থিয়েটার এখন এক বিশেষ ধরনের সমবায়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মতোই এখন তাকে নানাদিকের ভারসাম্য মান্য করে চলতে হয়। বাদামতোলা পাতামনৌকার স্বভাবে নাট্যকার যেদিকে খুশি ঘুরে বেড়াবেন- সেই অধিকার তাঁর হাতে নেই মেলা দিন। নাট্যকারের সৌভাগ্য যে একজন নির্দেশক তাঁর রচনায় দ্বিতীয় জন্ম দেবার লক্ষ্যে প্রাণপাত করেন, আবার একই সঙ্গে অনেক সময় পা কেটে জুতার মাপে জুতসই করার প্রয়োজনীয় নির্মমতা তাঁর চোখের সামনে ঘটে। তারপর সৈয়দ জামিল আহমেদ-এর নির্দেশনায় চাকা-র উপস্থাপনা দেখার পর এ-কথা মানতে এক বিন্দু দ্বিধা থাকে না যে নির্দেশনা আর পাণ্ডুলিপির এক-রৈখিক অনুসরণের একঘেঁয়েমিতে আটকে নেই, নির্দেশনা এখন একটি পরিপূর্ণ বিজ্ঞান। নাসির উদ্দীন ইউসুফের নির্দেশনায় কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই, প্রাচ্য, যৈবতী কন্যার মন, বনপাংশুল, কিংবা নিমজ্জন; নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের গ্যালিলিও, কী গডোর প্রতীক্ষা-য়, আরণ্যকের জয়জয়ন্তী অথবা রাঢ়াঙ; কিংবা আশীষ খন্দকারের টি.এস.সি-র ছাদে উপস্থাপিত কারখানা, কী চারুকলা ইনস্টিটিউট-এর পুকুরতলায় প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মেলানো মোহাম্মদ আমিন দেখার পর কার না চৈতন্য নির্দেশনার যাদুর কাছে হার মানে! গিরীশ কারনাড আর ইব্রাহিম আল কাজির যৌথ সৃজনশীলতায় অসামান্য প্রযোজনা থিয়েটারে যুক্ত হয়; পিটার ব্র“ক এবং জাঁ-ক্লদ ক্যারিয়ে-এর বছর বছর একান্নবর্তিতার ফল মহাভারত দুনিয়া কাঁপিয়ে দেয়, অন্যদিকে নির্দেশকের অতি-চাপাচাপির ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বিজয় তেণ্ডুলকার নাটক লেখায় ইস্তফা দেন।
সর্বাঙ্গ থিয়েটারের লোক হিসেবে সেলিম আল দীন নাটকের গানে সুরারোপ করেন, কোরিওগ্রাফিতেও তাঁর আগ্রহের কমতি নেই; সর্র্বোপরি দেখি নির্দেশনার কাজ। দেওয়ানা মদিনা-য় তিনি বেশি ভূমিসংলগ্ন- লোকনাট্যাভিনয়ের বেশি কাছাকাছি। ফলে দেওয়ানা মদিনা নিরাভরণ ও অনাকর্ষণীয়। একটি মারমা রূপকথা-ই তাঁর পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনার কাজ। মজার ব্যাপার হয়, যখন দেখি নাট্যকার হিসেবে পাশ্চাত্যের ঘোরতর বিরোধী কিন্তু নির্দেশনায় পশ্চিমের সঙ্গে বৈরিতার অনেকটাই কমে এসে প্রায় সৌহার্দ্যরে পর্যায়ে পৌঁছে। একটি মারমা রূপকথা-য় ব্লকিং, কম্পোজিশন, সংলাপ, নাট্যমুহূর্ত, কোরিওগ্রাফি সবকিছুর মধ্যেই পাশ্চাত্য থিয়েটারের সহযাত্রী হবার আকাক্সক্ষা অথবা অপরিহার্য অসাবধানতার ছাপ দেখি। সৈয়দ জামিল আহমেদ লোকনাট্যের এক আস্থাবান গ্রাহক হবার পরও চাকা, বিষাদ সিন্ধু, কিংবা বেহুলার ভাসান-এ লোকনাট্যের সঙ্গে আধুনিক থিয়েটারের যোগসূত্র স্থাপন করতে ভোলেননি।
নাটককে থিয়েটারে প্রাণবন্ত রূপান্তরের বাস্তব সমস্যার কারণে সেলিম আল দীন এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ জীবনদীর্ঘ শিল্পসঙ্গী হবার পরও একটি জায়গায় এসে ঠিক অভিন্ন থাকেন নি। সেলিম আল দীন দীঘল পথ-পরিক্রমায় ধাবমান রচনার প্রাক্কালে বলেন তাঁর রচনায় পশ্চিমের একটি চিহ্নও আর থাকবে না। অন্যদিকে বনপাংশুল উপস্থাপনা বিষয়ে এক আলাপচারিতায় নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন- মঞ্চের কাব্যে তাঁর অভীষ্ট থাকে পূর্ব এবং পশ্চিমকে মেলানো।
কবির যে জন্মগত বিষণ্নতা সেলিম আল দীনে তা নিত্য সহচর। বিষণ্নতা নেই কিন্তু বড় কবি এমন কোনো উদাহরণ কী কোথাও পাওয়া যাবে!
তিনি কবিতা যেমন লেখেন, কিছু মৌলিক গান রচনার নমুনাও পাই। একই সঙ্গে লিরিকে সুরারোপনে রাগের উল্লেখ থেকে অনুধাবন করা যায় তাঁর মনোলোকে দুঃখ-সুখের আলো-ছায়াপাত। তিনি মৌলিক গানের সুরে বাছাই করেন মালকোষ আশাবরী- তাল দাদরা, ভীম পলশ্রী তাল-খেমটা কাহারবা ও ত্রিতাল, রাগ বাগেশ্রী, রাগ ভৈরবী, রাগ জয়জয়ন্তী তাল কাহারবা, দাদরা। পণ্ডিত ভাতখণ্ডেকৃত রাগের সময় বিভাজন অনুযায়ী মালকোষ- রাত্রি তৃতীয় প্রহর, রাগেশ্রী- রাত্রি তৃতীয় প্রহর এবং জয়জয়ন্তী- রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে গেয় রাগ।
তিনি যা কিছুই করুন কবিতায় চিত্রকল্পের ছাপ রেখে যাওয়া, কালেভদ্রে দুই একটা বিদেশী কবিতা-ও বাঙলায় অনুবাদ করে নেন, নাটকের গবেষণা পত্রিকা সম্পাদনার টেবিলে দেখা যায় নিয়মিত, ক্লাসরুম ভরে যায় শিক্ষক ও পিতার সম্মিলিত অন্বয়ে, মহড়ার ফ্লোরে একটু আধটু নেচে ফেলাতেও দ্বিধা নেই, উমা বসুর গানে বিস্ময়ে বুঁদ, উপন্যাস নাম উপাখ্যান লিখে ফেলেন একটা দুইটা, টেলিভিশনের নাটকে আয়না- ভাঙনের শব্দ শুনি; লালমাটি কালো ধুঁয়া, গ্রন্থিকগণ কহে, অণৃৃত রাত্রি-র কথা কারো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, গ্রাম থিয়েটারের কাজে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর কোনোদিন আলস্য নেই- এসব যাবতিয়তার পরও সেলিম আল দীনের কেন্দ্রীয় পরিচয় এসে স্থির হয় নাটকে- নাট্যকারের অভিধা রাজটীকার শামিলে জ্বলে; যেমন করে জামদানির ওড়না, দোপাট্টা, গামছা সব কিছু ছাপিয়ে এসে জামদানি শাড়ি পান্না হাজার, দুবালি জাল, নীলাম্বরি, প্রজাপতি, চালতাপদ এবং শেষ পর্যন্ত সোনার জরীকাটা বিলওয়ারিতে এসে স্থিরতার আকার পায়। এবং নাটকে এসে তাঁর প্রাচ্যের সম্পর্ক ও শক্তি খুঁজে বের করার তৎপরতা কেন্দ্রীয় আভিমুখ্যে রূপ নেয়। কিন্তু এতবড় কর্মযজ্ঞে তাঁকে অতি আস্থাশীল, বিজয়ী এবং শিথিল মনে হয়। যে-কারণে তাঁর ভাষা বিবাহিত দম্পতির আচরণে নিরুত্তাপ, অভ্যস্ততায় সহনশীল- অস্বীকৃত প্রেমে হরিণশাবকের যে চঞ্চলতা সেই তরতাজা কম্পন তাঁর ভাষায় অনুপস্থিত কথানাট্যের বর্ণনায় যে নাট্যগুণ থাকা আবশ্যক- তার দিকে সেলিম আল দীনের মনোযোগ নেই; সে-তুলনায় সংলাপ রচনার উজ্জ্বলতা বাঙলা নাটকে আলো ছড়িয়ে দেয় বহুগুণ বেশি: করিম বাওয়ালীর শত্রু অথবা মূল মুখ দেখা, মুনতাসির ফ্যান্টাসী, শকুন্তলা, কিত্তনখোলা, হাত হদাই, কেরামতমঙ্গল, আতর আলীদের নীলাভ পাট, আয়না, একাত্তরের যীশু, গ্রন্থিকগণ কহে- এসব নাটক বা চিত্রনাট্যে আঞ্চলিক ভাষায়, কাব্যিক বিন্যাসে, সংলাপের প্রাণে কোনোদিন ম্লান হবার নয়।
তিনি যা বিশ্বাস করেন তা আবছা-আবছা- সেখানে আনুপূর্বিক নিষ্ঠা ও জিজ্ঞাসা দেখি না- কিন্তু আস্থা অবিচল। ফলে সেলিম আল দীনে কোনো সংশয় নেই- সংশয় ছাড়া একজন মৌলিক শিল্পীর বিকাশের পথ কী! প্রাচ্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা একটা সংক্ষিপ্ত আবর্তে ঘোরে। তিনি মনে করেন একটি ধ্রুবসত্য ছাড়া একজন শিল্পী বাঁচতে পারে না।
ধ্রুবসত্যের কাছাকাছি যেতে তিনি কেবল রাজহংসের পাখায় উড্ডয়নের ঘ্রাণ নিতে যান- বেমালুম ভুলে থাকেন জালালী কবুতরের কথা- যাদের পাখায় থাকতে পারে অমিত আগুনের দানা। তিনি ধরে নেন রবীন্দ্রনাথ আর গ্যাটে-ই পৃথিবীর শেষ কবি যাঁরা মর্ত্যরে ধূলামালিন্যে আনেন নক্ষত্রের পিপাসা। সেলিম আল দীন যদি আশেপাশে খানিকটা নোঙর ফেলতেন, তাকিয়ে দেখতেন তাঁর বাহুর পাশে একান্ত সমকালে কী অসামান্য জ্যোতি নিয়ে জ্বলে থাকেন একজন শহীদুল জহির, কী কাজাও ইশিগুরি, কিংবা বলি মায়া অ্যাঞ্জালোর কথা- তাহলে তাঁর লেখায় আসতো আরো নানামুখী বাঁক। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীত মোহরসদৃশ, একই সাথে এ-সত্য গ্রহণে দ্বিধা থাকে কেন যে সাহানা বাজপেয়ীর পরিবেশনা উদ্দাম হাওয়ার সামিল।
প্রকৃতি ও মানুষের জন্য এখন ধর্মের বিকল্প দরকার। সেই বিকল্প এনে দেবেন সেই শিল্পী যাঁর একটি লোকাল থাকবে বটে, কিন্তু কোনো দেশ লাগবে না। সেলিম আল দীনের জন্য সেই ঝুঁকির ওজন অনেক বেশি। তিনি বরং একটি নির্দিষ্ট ধর্মের সংগঠকের প্রতি হামদ ও নাত পেশ করার মধ্য দিয়ে সাকল্য আত্মসমর্পন করেন।
আমরা প্রাচ্যের একটি গভীরে শক্তি অনুভব করতে পারি। পাশ্চাত্য কেঁপে ওঠে সামান্য দমকা বাতাসে, কেননা তাঁরা ব্যক্তি ও তার আধ্যাত্মিকতার সবটুকু শক্তি তুলে নিয়ে বৈদ্যুতিক বাতি আর পরমাণু পরীক্ষায় সম্পূর্ণ আস্থা সমর্পন করে, প্রাচ্য এক অপরিমিত বোধিমন্ত্রের ভারে ঝড়-জল-অগ্নির মুখে দাঁড়ায়!
ভিয়েতনাম যুদ্ধে, তিব্বত,মায়ানমারে দেখি বৌদ্ধ ভিক্ষু যুদ্ধের প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়- আগুন জ্বলে দাউ দাউ- শ্রমণ তখনও স্থির বসে থাকেন! এই যে মন্ত্রবোধি তা’ কেবল প্রাচ্যেই সম্ভব, পশ্চিমের সেই গভীরতা কোথায়! পূবে-ই লোকদার্শনিক প্রার্থনার ওপর প্রেমের আসর ধার্য করেন।
সেলিম আল দীন সহজে আত্মসমর্পন করেন প্রথায়, কারণ পিতৃবাৎসল্য তাঁকে উৎকণ্ঠিত করে তোলে। কিন্তু যদি খনার শ্লোকধারায় পৃথিবীতে কল্যাণ নামে, সেলিম আল দীন খুশি হবেন তুলনারহিত। মানুষের জন্য তাঁর অমিত কল্যাণ-প্রার্থনা আরেকবার দেখে নিই:
প্রিয় দর্শকমণ্ডলী এই নাটক দর্শনে সামাজিকগণের কল্যাণ হোক। পুণ্য হোক। যে এই নাটক দেখে- সামাজিক মঙ্গল সাধনে সে যেন তৎপর হয়। অন্যায় অবিচারের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। যে এই নাটক দেখে সে যেন শমলার অপরিপুষ্ট ভ্রুণের নিরাপত্তা বিধান করে। পৃথিবীর সমস্ত ভ্রুণের জন্য যেন সে মমতার হাত বাড়ায়। মানব জনমকে সামাজিকগণ যেন স্বাগত জানায়। এই নাটক দর্শনে বন্ধ্যা নারী যেন ফলবতী হয়।
সেলিম আল দীন মূলে, কামে, উৎকণ্ঠায় প্রাচ্য দেশীয়। তিনি মাতৃস্নেহের সংবেদনশীলতায় তাঁর চরিত্রদের নির্মাণ করেন। ফলে অনেক সময় শিল্পীর নির্মোহ দূরত্ব কার্যকর রাখতে পারেন না। তিনি অবিচল ভক্তি নিয়ে পূর্ব পুরুষের বাড়ি-ঘর ও প্রত্নসামগ্রী খুঁজে বের করে আনার সংকল্পে একচক্ষু হরিণের সাদৃশ্যে ধাবিত হন। ফলে তিনি এক খণ্ডিতকে সামগ্রিকতার আয়তনে বাঁধেন। সঙ্গে তাঁর অমৃত শুভৈষা দিগন্তরেখা ডিঙিয়ে আদিগন্তে হারায়।
তাই দেখি, সেলিম আল দীন যদি কোথাও আটকে গিয়ে থাকেন- তা’ কেবল তাঁর পিতৃঋণের কাছে ॥
বদরুজ্জামান আলমগীর: নাট্যকার