Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

নোহ্-কাবুকি: অদ্ভুত নারীত্ব

Written by গোলাম শফিক.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

জাপানের ঐতিহ্যবাহী নাটক নোহ্ ও কাবুকি। অতি প্রাচীন এ নাট্য-সহোদর। পঞ্চদশ শতাব্দীতে উৎপত্তি হয়ে আজ অবধি সমান দাপটে টিকে আছে। জাপানের লোকনাট্যের যথাযথ প্রতিনিধিত্বকারী এই নোহ্ ও কাবুকি নাটক। ২০০০ সালে দেশটি ভ্রমণ করার সময় প্রাচ্যের নাট্যকলায় উৎসুক হলেও উপভোগের তেমন সুযোগ ঘটে নি। যতটুকু নাগালে পাওয়া গেছে নিবিড় পর্যবেক্ষণের অবকাশ একেবারেই ছিল না। ২৩-২৭ নভেম্বর (২০০৫) ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় জাপানী পারফরমিং আর্টস বিষয়ক কর্মশালা। যৌথ আয়োজক জাপানের উত্তরণ, বাংলাদেশ কালচারাল গ্রুপ এবং অই.টি.আই, বাংলাদেশ কেন্দ্র। তাতে ড. কিয়ুজু তাকাই, অধ্যাপক তরু ইতাইয়া ও ইন্টারপ্রেটার ইউসুফ হাসান অর্কের সাথে ত্রয়ী মিথষ্ক্রিয়ায় নাট্যকর্মীদের ঔৎসুক্যের নিবৃত্তি ঘটেছে।

নোহ্ ও কাবুকিনাট্য বুদ্ধেরই আরাধনা। প্রার্থনার এক অভিনব অবলম্বন এ নাট্য প্রক্রিয়া। মুখোশের ব্যবহার ও ব্যাকস্ক্রীনে পাইন গাছের ছবি এগুলোকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। নোহ্ ও কাবুকি উভয়টিই মিউজিক্যাল থিয়েটার, অতি ধীরগতি সম্পন্ন ও বর্ণনাত্মক। এদের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য টেক্সট-এর কাব্যিক রহস্যময়তা। নোহ্-কাবুকির প্রচলিত নাট্য বলয়ের হাজার রহস্যরাজির একটি উদাহরণ টানা যায়, নোহ্ নত্র সিআমি’র নাটক থেকে:

‘আহ্। কেমন ভীষণভাবে বরফ পড়ছে।
অনেক আগে, যখন আমি ছিলাম সংসার জগতে
তখন দেখতে ভালোবাসতাম
‘এখানে, ওখানে চারপাাশে বরফ ঝরছে
রাজহাঁসের পালকের মত উড়ছে।
অনেক-অনেক আগে, আমি দেখতাম এই বরফ বর্ষণ
যতক্ষণ না তুষার, সাদা আস্তরণের মতো
আমাকে আবৃত করে ফেলত।’
এই গান আমি গাইতাম।
যে তুষার এখন ঝরছে, তখনও এমনি ঝরত।
কিন্তু, এখন আমি নিজেই শ্বেত তুষারাবৃত।”
(নাটক হোচি-নো-কি)

নোহ্ নাটকে মৃত ব্যক্তির আত্মার চরিত্রাভিনয় উপস্থাপিত হয়। উপরের সংলাপটি ‘ৎসুনেইয়ো’ নামের এক মৃত ব্যক্তির। এসব আত্মারা সাধারণত অতৃপ্ত থাকে। মঞ্চে তারা অতৃপ্তির কারণ ব্যাখ্যা করে। তাদের সীমাহীন দুঃখের বর্ণনা নির্বাণাকাক্সক্ষায় গিয়ে গড়ায়। জীবিত চরিত্রগুলোও নানা কারণে অতৃপ্ত থাকে। তবে নাটকে গল্প কোনো বিষয় নয়, নৃত্যই মুখ্য। নাচ-গান-অভিনয় এতোটাই শ্লথগতি সম্পন্ন যে, দু’তিন পৃষ্ঠার নাটক দু’ ঘন্টা পর্যন্ত প্রদর্শিত হয়। এক সময় ৮ ঘন্টা পর্যন্ত নোহ্ নাটকের অভিনয় চলতো। ‘নোহ্’ অর্থ শক্তি। এ শক্তি প্রকৃত অর্থে ধর্মের। কাবুকি নাট্যও ধর্মের প্রভাবযুক্ত। এতে নাট্যময়তা, প্রদর্শন প্রবণতা নোহ্-এর অধিক। এগুলো সাধারণত সমর কাহিনীমূলক এবং প্রাত্যহিক মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত জনিত।

জাপানী লোকনাট্যের কুশীলব এশীয় লোকনাট্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এশীয় লোকাভিনয়ের এটাই রীতি যে, নারী চরিত্রগুলো পুরুষরাই রূপায়ণ করে। উপমহাদেশীয় বাংলা লোকনাট্য আঙ্গিকেও লক্ষযোগ - আলকাপ, ঘাটু, লেটো, পালাগান, যাত্রা ইত্যাদিতে ব্যাপকভাবে পুরুষরা নারীর অভিনয় করেছে। তবে পাঁচ/ছয় শ’ বছরে জাপানে এ নাট্যকর্মের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা’ ভিন্ন মাত্রার। একটা সময় ছিল দর্শক হিসেবে মেয়েদের নাটক উপভোগেরও অধিকার ছিল না। বর্তমানে দর্শকদের অর্ধেকই নারী। জাপানী নাটকে নারীদের ভিন্নভাবে ব্যবহারের প্রধান কারণ সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা। সপ্তদশ শতকে যে বুনরাকু বা পুতুলনাট্যের উদ্ভব তাতে মেয়ে পুতুলের পা’ থাকে না। পুতুল বা পাপেট নাট্য একই অবয়ব নিয়ে জাপানে আজও বিদ্যমান।

জাপানী নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয়কারীদের বলা হয় অন্নাগাতা (Onnagata). মঞ্চের বাইরে বাস্তব জীবনেও এরা নারীদের অনুকরণ করে, তাদের মতো জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়। নাটকে এরা মেকআপ নেয় না, তবে কস্টিউম-জুতো এসব পরিধান করে। নোহ্-কাবুকির অভিনেতা তার তীক্ষè, কেন্দ্রীভূত শক্তি ও ভাবনার সমন্বয় ঘটান এবং তার অভিব্যক্তিহীন বা মুখোশাবৃত মুখ, ধীরগতি ও পোশাকাদির মধ্য দিয়েই তা’ প্রকাশ পায়। সুন্দরী রমণীর ভূমিকায় অভিনয়কারী কৌশলে উচ্চতা বৃদ্ধি করে, যদিও অধিকাংশ সময় সে পায়ে মোজা পরে এবং হাঁটু গেড়ে থাকে। মুখোশাবৃত বিখ্যাত অভিনেতারা গোড়ালি উঁচু না করে কখনো আস্তে, কখনো দ্রুতগতিতে মঞ্চে আসে। তাদের মঞ্চে প্রবেশের দৃশ্য খুবই আনন্দ সঞ্চারী। এ গতিভঙ্গিও কাব্যময় যা’ দর্শকদের বাস্তব থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নেয়।

কেন জাপানী লোকনাট্যের নারী চরিত্রে পুরুষ কুশীলব? এসবের কারণগুলো নৃ-তাত্ত্বিক ও ধর্মীয়। এ অবস্থার পটভূমি ঘেটে অতলস্পর্শী বিশ্লেষণে কিছু কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। এর নির্যাস হিসেবে নিয়ে আসা যায় ৩টি হেতু:

সৌন্দর্য অনুধাবনের দৃষ্টিভঙ্গি
নারীর যে শরীরগত সুবিধা বিধাতাপুরুষ দিয়েছেন তাকে পাশ কাটিয়ে অভিনয়-আনন্দ অপার। যা’ হতে পারি নি, তা’ হওয়ার আনন্দবোধ অভিনেতাকে তাড়িত করে। তা’ ছাড়া নারী কি সত্যিই পারে নিজের সৌন্দর্য যথাযথভাবে অনুধাবন করতে। বিপরীত লিঙ্গের কেউই হয়তো তা’ করতে অধিকতর সক্ষম। পুরুষ দ্বারা নারী চরিত্রে অভিনয় প্রচেষ্টা নতুন ব্যাখ্যার মাধ্যমে ভিন্নভাবে নারীকে উপস্থাপন করতে পারে। প্রত্যহ মানুষ আরশিতে স্বমুখশ্রী বার বার দেখে যেমন পুলকিত হয়, অভিনেতাও সাজগোজ নেয়ার সময় তেমন পুলক অনুভব করে। এ এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। এতদ্ব্যতীত, পুরুষ কর্তৃক নারীর অভিনয়ে কতোটা দক্ষতা প্রদর্শন করা যায় এও বিচার্য।

বিধাতার সন্তুষ্টি
জাপানীদের কল্পনায় কামিসামা বা ঈশ্বর পুরুষ, নারী কিম্বা ক্লীব নয়। তাই বিধাতাপুরুষকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য পুরুষ কর্তৃক অভিনয় করানোই বুদ্ধিমানের কাজ। থিয়েটারে নারীর সম্পৃক্তিতে বিধাতা কুপিত হতে পারেন।

প্রসঙ্গক্রমে জাপানী থিয়েটারে প্রপ্স এর ব্যবহার উল্লেখ্য। প্রপ্স হিসেবে হাতপাখার অবস্থিতি খুব দৃষ্টিগ্রাহ্য। এর একটি ভিন্ন অর্থ আছে। জাপানী মাত্রই বিশ্বাস করে পুরুষের মাধ্যমেই কামিসামা দুনিয়াতে কাউকে জন্মদান করান। কোনো কারণ ছাড়াই একটি চরিত্রের ঘন ঘন পাখা সঞ্চালন ভিন্নার্থক, এটি পুরুষাঙ্গের প্রতীক। বিধাতা এ শিশ্নের মাধ্যমেই পৃথিবীতে নব মানব জন্মদানের ব্যবস্থা করবেন। তাই জাপানী লোকনাট্যে প্রপ্স ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকী অর্থেও ব্যবহৃত।

সমকামিতার ধারণা
ড. কিয়ুজু সমাজের উচ্চস্তরে একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন যে, ১০% জন জাপানী সমকামিতায় বিশ্বাসী। হোমো সেক্সচুয়ালিটিজনিত সামাজিক এ অবস্থাটি জাপানী লোকনাট্য, বিশেষত কাবুকি নাটকে প্রভাব বিস্তার করেছে। এক ধরনের পুরুষ সহজাতভাবেই নারীর ন্যায় জীবন যাপনে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এক সময় তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তাই থিয়েটারে তাদের অংশগ্রহণ বিস্তার লাভ করে। জাপানে এখনও একদল পুরুষ নারী সেজে শহরের বিশেষ বিশেষ স্থানে ব্যবসা করার পদ্ধতি চালু রেখেছে। এটি একটি প্রবণতা, নোহ্ কাবুকি নাটকও যার প্রভাবমুক্ত নয়।

নারী চরিত্রে অভিনয়কারী পুরুষ অন্নাগাতারা সমাজে স্বীকৃত। নারীর ভাবভঙ্গি, আচার-আচরণ, সর্বোপরি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রপ্ত করাতে সমাজ তাদের বিশেষ সহায়তা প্রদান করে। এ সহায়তার একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জাপানী সংস্কৃতিতে হট স্প্রিং বাথ একটি জনপ্রিয় রেওয়াজ। প্রকৃতির কোলে পাহাড় ঘেরা একান্ত উন্মুক্ত স্থানে বসন্তকালে তারা এ স্নান উৎসবে মেতে উঠে। তা ছাড়া বিশেষ উপলক্ষে অনসেন বা বড়ো চৌবাচ্চায় জাপানীরা বিবস্ত্র হয়ে øান সারে। তবে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট চৌবাচ্চায় পুরুষদের, পুরুষদের জন্য নির্ধারিত জলাধারে নারীদের প্রবেশাধিকার নেই। পুরুষ-মহিলা পৃথকভাবেই øানে অংশ নেয়। তারপরও অন্নাগাতাগণ নারীদের চৌবাচ্চায় যেতে চাইলে কোনো সামাজিক বাধা নেই, এ অধিকার তারা অনায়াসেই পেতে পারে। এটাই রীতি।

রহস্যময় জাপানী লোকনাট্যের বিষয়বস্তুতে প্রার্থনা, প্রেম, স্মৃতি রোমন্থন কিম্বা প্রতীক্ষা- এ সবই যে এটিকে বিশ্বের অপরাপর লোকনাট্য থেকে পৃথক করেছে তা-ই নয়, নোহ্-কাবুকি-কিয়োগেন-বুতো-বুনরাকু এসব বিভিন্ন আঙ্গিকের থিয়েটারকেন্দ্রিক যেসব সামাজিক রীতি-নীতি গড়ে উঠেছে তাও জাপানকে দান করেছে স্বকীয় সাংস্কৃতিক পরিচিতি।

গোলাম শফিক: নাট্যকার। সদস্য- পালাকার