Full premium theme for CMS
নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টারের বিদায়
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
বিশ্বনন্দিত ব্রিটিশ নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার সম্প্রতি ৭৮ বছর বয়সে পৃথিবীকে তাঁর দিনান্তের শেষ অভিবাদন জানালেন। তাঁর নিত্য জীবন অনিত্য হয়ে গেল, সবার ক্ষেত্রেই তাই হয়, কিন্তু পিন্টারের মতো এমন নাট্যকারের চির-প্রস্থানে সৃজনশীলতার জগৎ দরিদ্র হয়ে যায় বৈকি। হ্যারল্ড পিন্টার নাট্যকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও তিনি একজন সফল নাট্যনির্দেশকও ছিলেন। তিনি একবার ডেভিড ব্যারন ছদ্মনামে অভিনয়ও করেছিলেন।
পিন্টারের নাটককে এক সময় নাট্য-সমালোচকরা দুরূহ অভিধা দিতেন। তাঁকে নাট্যকার এন এফ সিম্পনস, ইউজেন ইউনেস্কো ও স্যামুয়েল বেকেটের মতো অ্যাবসার্ডধর্মী নাট্যকারদের পঙক্তিভুক্ত করা হতো। বিশ্বের অনেক উঁচুমানের লেখকই দুরূহতা, এমনকি দুর্বোধ্যতার অপবাদ পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে দুর্বোধ্যতার অপবাদে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন গত শতাব্দীর ঔপন্যাসিক জেমস জয়েস। তাঁর একসময়ের ব্যক্তিগত সচিব স্যামুয়েল বেকেট ও ইউজেন ইউনেস্কোর নাটকের ক্ষেত্রেও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ উঠেছিল। অথচ পরবর্তী সময়ে দুজনেই অতি সফল নাট্যকার হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো আমাদের দেশে সফলভাবে মঞ্চায়িত হয়েছে। ইউজেন ইউনেস্কোর নাটক দ্য লেসন-ও আমাদের দেশে সুনামের সঙ্গে মঞ্চায়িত হয়েছে।
আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই শতাব্দীর সূচনালগ্নে আইরিশ ঔপন্যাসিক জেমস জয়েসের বিখ্যাত উপন্যাস ইউলিসিস শতাব্দীর অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত ও গৃহীত হলো। এই উপন্যাসটি তিনবার পড়ার পর আমারে বোধগম্যতায় ধরা দিয়েছিল। তখন আমার মধ্যে একটি বোধের জন্ম হয়েছিল। বোধটি হলো- শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে গভীর সৃষ্টিকে স্পর্শ করতে গেলে যেমন কষ্ট করতে হয় তেমনি সহিষ্ণু হতে হয়। পরিণামে সুবর্ণ সৃষ্টির স্পর্শ লাভ করে ধন্য হওয়া যায়।
হ্যারল্ড পিন্টার আরেক স্বনামধন্য ব্রিটিশ নাট্যকার সিমন গ্রের নাট্যভাবনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সিমন গ্রে রচিত নাটকে অ্য্যলেক গেনিস ও অ্যালেক বেটসের মতো খ্যাতিমান অভিনেতা অভিনয় করেছেন। গ্রের কমেডি চরিত্রের নাটকে হেঁয়ালির মধ্য দিয়ে সমাজ থেকে নানা কারণে বিযুক্ত মানুষের চরিত্র চিত্রিত হয়েছে। হ্যারল্ড পিন্টার রচিত নাটকে তাঁর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে শেষ বিবেচনায় পিন্টারের নাটককে বিশেষ কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। তিনি নাট্যরচনার ক্ষেত্রে মূর্ততা থেকে বিমূর্তায় এবং বাস্তবতায় অনায়াসে পরিভ্রমণ করেছেন।
সাহিত্যের জন্য পিন্টারের আগে যেদিন ইতালিয়ান অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক এবং সর্বোপরি নাট্যকার দারিয়ো ফো নোবেল পুরস্কার পেলেন, সেদিন আমি আনন্দ বোধ করেছি। হ্যারল্ড পিন্টার যখন ২০০৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন আরো বেশি আনন্দিত হই। কারণ, পিন্টারের রচনার সঙ্গে আমার দারিয়ো ফো-র রচনার আগে পরিচয় ঘটে। পিন্টার ‘আভাঁ গার্দ’ (নব্য নিরীক্ষামূলক) আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। স্যামুয়েল বেকেটের সঙ্গে তাঁর নাট্যরচনার মিল আছে অন্তর্গত বোধের ক্ষেত্রে এবং রচনার কাব্যময়তায়। বেকেটের মতো পিন্টারের নাটক সহজ-সরল বোধগম্য আর দশটা নাটকের মতো নয়। এঁরা দুজনেই শিল্পের দুরূহ পথের পথিক। পিন্টারের নাটকে আছে রহস্যময়তা ও হেঁয়ালি, যে কারণে তাঁর রচনাকে অ্যাবসার্ডধর্মী নাট্যকার ইউজেন ইউনেস্কোর নাটকের সমগোত্রীয় বলেছেন একাধিক সমালোচক।
পিন্টার লন্ডনের প্রখ্যাত ন্যাশনাল থিয়েটারে সহযোগী পরিচালক ছিলেন, যখন, পিটার হলের মতো নামকরা নাট্যব্যক্তিত্ব ন্যাশনাল থিয়েটারের পরিচালক। স্যার জন গিলগুল্ড ও রালফ রিচার্ডসনের মতো দুর্ধর্ষ দুই অভিনেতাকে হ্যারল্ড পিন্টার ১৯৭৫ সালে তাঁর লেখা নাটক নো ম্যানস ল্যান্ড-এ অভিনয়কালে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। নাট্যনির্দেশক হিসেবেও হ্যারল্ড পিন্টার সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি নাটক লিখেছেন ২৯টি। তাঁর রচিত নাটকগুলোর মধ্যে দ্য কেয়ারটেকার, দ্য রুম, দ্য বার্থ ডে পার্টি, দ্য হোম কামিং, নো ম্যানস ল্যান্ড, এ কাইন্ড অব আলাস্কা, সাইলেন্স, ওল্ড টাইমস ইত্যাদি নাট্যাঙ্গনে বিশেষভাবে পরিচিত।
হ্যারল্ড পিন্টার নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় আমার বেশি ভালো লেগেছে এ কারণে যে, ষাট ও সত্তরের দশকে যখন আমরা দুরূহ বিষয়ে বিদ্যা ও বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার প্রয়াস পেয়েছিলাম তখন পিন্টারের নাটক নিয়েও আমরা কয়েকবার আলোচনা করি, বিশেষ করে তাঁর দ্য কেয়ারটেকার নাটকটি আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল।
পিন্টার ইরাকযুদ্ধের প্রতিবাদ করে কবিতা লিখতে বসেন এবং তাঁর কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ওয়ার নামে। ১৯৭৩ সালে চিলিতে আলেন্দে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রতিবাদে পিন্টার যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করেন। এভাবে তিনি পৃথিবীর তাবৎ অন্যায়, অত্যাচার ও দুঃশাসনের সমালোচনা করে আসছিলেন। নিজেকে তিনি লেখকের চেয়ে একজন সচেতন সমাজকর্মী ভাবতে ভালোবাসতেন। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে খুব হতাশা বোধ করতেন তিনি। তাঁর মতে পৃথিবী অবক্ষয়ের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। তিনি রাণীর দেয়া ‘স্যার’ উপাধি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মঞ্চে হ্যারল্ড পিন্টার গৌরবের সঙ্গে তাঁর জায়গা করে নিয়েছেন। পিন্টার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ তাঁর নাটকের সপ্তাহব্যাপী উৎসবের আয়োজন করেছিল। নাট্যপ্রযোজনাগুলো ছিল গুণগত মানে ঋদ্ধ।
সবাই চলে যায়, সবাইকে যেতে হয় কিন্তু যাওয়ার আগে তাদের সৃজনশীলতার ছাপ রেখে যেতে পারেন খুব কম মানুষ, যার সাহায্য নিয়ে আগামী পৃথিবী বোধে, অনুভবে, বিদ্যা ও বুদ্ধিতে ঋদ্ধ হবে। পিন্টারের মতো সৃজনশীল মানুষেরা সব সময়ই প্রাণী ও উদ্ভিদ জগৎকে মনে করিয়ে দেয়, বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডে তাদের অস্তিত্বের কথা এবং দিয়ে যান অনিত্য জীবনের করণীয় বিষয়ের প্রকরণ ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর রসদ। তাঁরা মানুষের মধ্যে অশেষ হয়ে বেঁচে থাকেন।
বিদায় হ্যারল্ড পিন্টার। আপনার নাটকের চর্চার ভেতর দিয়ে আপনাকে আমরা মনে রাখব। বিশ্ববাসীও আপনাকে মনে রাখবে। মানবতাবাদী লেখকের মৃত্যু হয় না, আপনারও মৃত্যু নেই। নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম আপনাকে বারবার স্মরণ করবে।
আতাউর রহমান: নাট্যব্যক্তিত্ব