Full premium theme for CMS
পরম শান্তিতে জিয়া স্যার ঘুমোচ্ছেন
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
জীবিকার নিরস পাতায় নিমগ্ন চিত্তে কেনা গোলামের চোখ বুলোচ্ছি। কর্তৃপক্ষের হুকুম : বেলা বারটার মধ্যে একটা জরুরি কাজ সমাপ্ত করতে হবে। মেজাজ খুব তিরিক্ষি হয়ে আছে। এক ধরনের অস্থিরতার ভেতরে আছি। ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে বলেছি ল্যান্ডফোনে যেন সংযোগ না দেয়। মোবাইলে পরিচিত-অপরিচিত অনেকের ফোন আসে- রিসিভ করি নি। সকাল তখন সাড়ে দশটা। এক প্রিয় অনুজতম তরুণ কবির মোবাইল থেকে বার্তা আসে : ‘জিয়াভাই নেই’- কোন জিয়াভাই? আমার তো কোনো জিয়াভাই নেই। তরুণ বন্ধু বিষণ্ন কণ্ঠে বললেন ‘কবি জিয়া হায়দার’। হ্যাঁ, আমার প্রিয় ‘জিয়া স্যার’ সবার প্রিয় ‘জিয়া হায়দার’ তাহলে চলেই গেলেন? ‘পঞ্চপাণ্ডব’ খ্যাত হায়দার পরিবারের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ নিভৃতচারী দেবতুল্য বড় ভাইটি প্রিয় অনুজদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে হাসপাতাল থেকে তার স্থায়ী ঠিকানায় আশ্রয় নিলেন!
মাস তিনেক আগে মাকিদ ভাইয়ের কাছ থেকে তার অসুস্থতার খবর পেয়ে এক বিকেলে ছুটে গিয়েছিলাম সিটি হাসপাতালে। অতি সন্তর্পণে স্যারের কেবিনে প্রবেশ করি। জিয়া স্যার শুয়ে আছেন কেবিনের বেডে। এত বিষণ্ন আর নরম চেহারায় তাকে কখনো দেখি নি। ওখানে ছায়ার মতো রয়েছেন তিন অনুজ- রশীদ হায়দার, মাকিদ হায়দার, জাহিদ হায়দার। আমাকে দেখে স্যার উঠে বসতে চাইলেন। রশীদ ভাই আর জাহিদ তাকে সাহায্য করলেন। তিনি ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসলেন। গভীর বিষণ্ন তার সেই অন্তর্ভেদী চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। চিরাচরিত নিয়মে অতি পরিচিত ও স্নেহমাখা কণ্ঠে আমার কুশলাদি জিগ্যেস করলেন, এখন কোথায় আছি, প্রমোশন হয়েছে কি-না ইত্যাদি জানতে চাইলেন। বেশ কিছুক্ষণ স্যারের পাশে ছিলাম। কেবিনের বাইরে এসে মাকিদ ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম অসুখের বিবরণ। দিল্লিতে নিয়ে গিয়েছিলেন রশীদ ভাই। ছয় মাসের জন্য আয়ুরেখা টেনে দিয়েছিলেন ওখানকার চিকিৎসকগণ, তাও আবার শর্তে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসার ভার বহন করেছেন তার সীমিত আয়ের ভাইয়েরা, যাদের রক্তে রয়েছে পাবনার এক বনেদি পরিবারের ঐতিহ্য আর বিনীত অহংকার। অসুস্থ ভাইয়ের চিকিৎসা ব্যয় নিজেরাই নির্বাহ করেছেন। রাষ্ট্র বা অন্য কেউ এগিয়ে এসেছেন বলে আমার জানা নেই। যেখানে রাষ্ট্র তার একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসে না, সেখানে জিয়া হায়দারের মতো কীর্তিমান মানুষেরা কী করে বেঁচে থাকবেন?
হাসপাতালে প্রথম যেদিন তাকে রোগীর পোশাকে দেখি আমার মনটা কেন যেন হাহাকার করে ওঠে। আমি তাকে সারাজীবন একজন সদা প্রাণবন্ত মানুষ হিসেবে দেখেছি। মনে পড়ে তার সঙ্গে আমার সর্বশেষ সাক্ষাতের কথা। গত একুশের বইমেলায় বাংলা একাডেমীর মূল ভবনের দেয়ালঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমি সিগারেট টানছি। সঙ্গে আরো ২/৩ জন তরুণ কবি। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে আমার সামনে দেবদূতের মতো এসে দাঁড়ালেন জিয়া স্যার। এভাবে তাঁর সঙ্গে আমার আর একবার দেখা হয়েছিল হলিফ্যামিলি হাসপাতালের পশ্চিম-পূর্ব পাশে রাস্তায় বেশ কয়েক বছর আগে। পারিবারিক প্রয়োজনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন। পরের দিন চলে যাবেন। চট্টগ্রাম গেলে তার লালখান বাজারস্থ ইস্পাহানি বিল্ডিংয়ে সেই পুরনো বাসায় যাবার জন্য বললেন। কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু যাওয়া হয় নি। বইমেলায় তাকে হঠাৎ পেয়ে গেলাম। আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন, লেখালেখির খবর জানতে চাইলেন। আমিও জিগ্যেস করলাম। হাসতে হাসতে বললেন, শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সর্বনাশ! বলে হঠাৎ চমকে বললেন, নির্ধারিত সময়ে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়া হয় নি। দ্রুত বাসায় চলে যাবেন, উঠেছেন স্বপনের বাসায়। স্বপন মানে জাহিদ হায়দার।
বাংলা একাডেমীর মেলায় সাক্ষাতের পর হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গেছি। এমন করুণ বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকাতে তাঁকে এর আগে কখনো দেখি নি। কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না, ভেতরে ভেতরে অসম্ভব প্রাণবন্ত অথচ বাইরে রাশভারী গুরুগম্ভীর আমার জিয়া স্যারের অনিবার্য যাত্রার বিষণ্ন প্রস্তুতি। খুব কষ্ট লাগছিল। মঞ্চ, থিয়েটার, নাটক ও অভিনয়শিল্প ছিল তাঁর ধ্যান আর জ্ঞানের বিষয়। শিক্ষকও ছিলেন এসবের। জীবনে তিনি কোনো অভিনয় করেছিলেন কি-না আমার জানা নেই; স্কুুল বা কলেজ জীবনে করে থাকলেও করতে পারেন। আমি শুধু জানি আমৃত্যু মঞ্চের কথাই বলেছেন, কিন্তু মঞ্চে কখনো ছিলেন না। আড়ালেই ছিলেন, আড়ালে থাকতে ভালোবাসতেন। কিন্তু জীবনসায়াহ্নে এসে প্রিয় সহোদর অনুজদের বুকে আশা আর ভালোবাসা জাগাতে আমার জিয়া স্যার আরো কিছুদিন তাঁদের মধ্যে বেঁচে থাকার কী চমৎকার অভিনয়ই না করে যাচ্ছিলেন। কেন যেন আমার মনে হয়েছিল যে রোগে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন তার অনিবার্য পরিণতি সবার জানা আছে, তিনিও জানতেন। প্রায় দুরারোগ্য ব্যাধির অনিবার্য পরিণতির কথা জেনেও তিনি সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন নিজের জন্য নয়, পরিবারের অপরাপর সদস্যদের জন্য। মাকিদ ভাই প্রায় বলতেন, পিতার মতো অসম্ভব স্নেহ আর ভালোবাসা দিয়ে জিয়া ভাই আমাদের সারাজীবন আগলে রেখেছেন, প্রতিটি ভাই-বোনকে সমান ভালোবাসা আর আদর দিয়ে বড় করে তুলেছেন, এটি একমাত্র জিয়া হায়দারের পক্ষেই সম্ভব ছিল। অতি সাধারণ জীবনের বাসিন্দারা যারা নিজের সংসার বলতে যা বুঝে থাকেন এমন সংসারে প্রবেশ করেও স্থায়ী হলেন না। পুনর্বার চেষ্টাও করেন নি। জীবনটা ব্যয় করে দিলেন অনুজদের পেছনে। এমন বিরল গুণের অধিকারী কয়জন মানুষ পাওয়া যাবে এ দেশে! পারিবারিক ভালোবাসার বিশাল বন্ধনে থেকেও তিনি একটা নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করতেন চট্টগ্রাম শহরে। এক সময় স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে যে নাট্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। মূলত তাঁকে কেন্দ্র করেই চট্টগ্রামে নাটকের অঙ্গনে নতুন হাওয়া নতুন ভাবনা যুক্ত হয়। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় তিনি কাটিয়েছেন চট্টগ্রামে। আমৃত্যু কবিতা আর মঞ্চ ও নাটকের ভাবনায় নিমগ্ন ছিলেন।
জিয়া হায়দার ৭২ বছর বয়সে চলে গেলেন। একে কি পরিণত প্রস্থান বলা যাবে? জানি না। শুধু এটুকু বলতে চাই, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ২০০৮ সালটা একটা বেদনার সাল হিসেবে বিবেচিত হবে। এ রাহুসাল একে একে গ্রাস করেছে আমাদের বেশ কয়েকজন শক্তিমান কবি ও লেখককে, যাদের মধ্যে আছেন কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির, কবি খালেদা এদিব চৌধুরী, নাট্যজন সেলিম আল দীন, ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হক, কবি সমুদ্র গুপ্ত, গীতিকার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী নাট্যজন আবদুল্লাহ আল-মামুন। মৃত্যুরাজের রঙ্গমঞ্চে সব শেষে প্রবেশ করলেন আমার স্যার জিয়া হায়দার। আমরা খুব আতঙ্ক আর দুর্ভাবনার মধ্যে আছি। অভিশপ্ত ২০০৮ সাল শেষ হতে এখনো তো কিছুটা বাকি।
আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি, অনেকের মতো জিয়া স্যারের চিরপ্রস্থানের জন্য আমিও মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম। তাই জিয়া স্যারের অসুখের পর মাকিদ ভাই কখনো আমাকে টেলিফোন করলে আমার বুকটা অবচেতনে কেঁপে উঠত ‘অনিবার্য দুঃসংবাদ’ পাব বলে। কখনো মনে হতো এই বুঝি মাকিদ ভাই টেলিফোন করে বলবেন, ‘জিয়া ভাই নেই’। কিন্তু না, আজ প্রিয় মাকিদ ভাই টেলিফোন করেন নি, করেছেন অন্যজন। আমি কিন্তু মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ও শুধু বলল, ‘জিয়া ভাইয়ের ওপর আমাদের পাতার জন্য আপনাকে একটা লেখা দিতে হবে। আগামীকাল দুপুর ১২টার মধ্যে।’ আমি নির্বোধের মতো বলেই ফেললাম, আচ্ছা ঠিক আছে- দেব। টেলিফোন রেখেই মনে হলো, জিয়া হায়দার সম্পর্কে কিছু লেখার তেমন উপযুক্ত ব্যক্তি আমি নই। তাঁর সম্পর্কে, তার কর্ম সম্পর্কে লেখার জন্য অনেক যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন। তাদের না বলে আমাকে বলার হেতু কী? আমি তো তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখক নই, স্কুুল জীবনে নাটক নাটক করে চিৎকার করলেও নাটকের সংলাপ প্রায় ৩০ বছর ধরে আর উচ্চারণ করি না। সুশীল সেবকের পাশাপাশি কবিতার একজন সামান্য সেবক। তো আমার কবিতা লেখালেখির পেছনে প্রয়াত কবি জিয়া হায়দারের অনুপ্রেরণা কি কাজ করেছে? যদি বলি আমার লেখালেখির পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যাদের কাছ থেকে প্রেরণা লাভ করেছিলাম তাদের মধ্যে জিয়া হায়দার ছিলেন, বলা যায় প্রধানতম তা কিন্তু বাড়িয়ে বলা হবে না।
১৯৭৪ সালের কথা। আমি তখন সবেমাত্র লেখালেখির জগতে প্রবেশ করার রিহার্সেল দিচ্ছি। পড়ছি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কবি ও লেখক বেলাল মোহাম্মদ থাকতেন চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারের শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফির বাসা ‘মুশতারী লজ’-এ। বেগম মুশতারী শফিও লেখালেখি করেন। বেলাল মোহাম্মদের জন্ম সন্দীপে আমাদের এলাকায়। তিনি আমাদের স্কুুলেরও ছাত্র ছিলেন। তো এক সন্ধ্যায় বেলাল মোহাম্মদ ও মুশতারী শফির কাছ থেকে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিতব্য সাহিত্য পত্রিকা ‘দর্পণ’-এর জন্য কবিতা ও গল্প আনতে ‘মুশতারী লজ’-এ গিয়েছিলাম। আমরা চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে আলাপ করছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে। সন্ধ্যা ৭টার সময় হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। মুশতারী আপা দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকলেন অনূর্ধ্ব-৪০ এক যুবক ও যুবতী। দু’জনই দেখতে চমৎকার লম্বা-চওড়া এবং ব্যক্তিত্বময়। ব্যক্তি কী করে যে ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে তা আমি এ প্রথম দেখলাম; কিন্তু এর আগে আমি এত সুন্দর জুটি কখনো দেখি নি। ওরা এসে সোফায় বসলেন। অসাধারণ সুন্দর বাচনভঙ্গিতে যুবক কথা বলছেন। প্রসঙ্গ নাটক। তারই রচিত একটি নাটকের মঞ্চায়ন নিয়ে মুশতারী আপার সঙ্গে আলোচনা করছেন। অবাক বিস্ময় আর কৌতূহল নিয়ে আমি চুপচাপ সেই আলোচনা শুনছি, বিশেষ করে আগন্তুক যুবকের প্রতি ছিল আমার সব মনোযোগ। কিন্তু তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মতো তখনো আমি তেমন যোগ্যতা অর্জন করি নি। এক সময় চা-নাশতা খেয়ে তারা চলে গেলে বেলাল মোহাম্মদই তাদের পরিচয় জানালেন : যুবকটির নাম জিয়া হায়দার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের নাট্যতত্ত্ব শাখার শিক্ষক, একাধারে কবি ও নাট্যকার। অন্যজন সালমা আহমেদ, ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মেয়ে; নাটক করেন। পেশায় ইসলামিয়া কলেজের ইংরেজির শিক্ষক। এরপর বহুদিন কেটে যায়। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের কবিতাঙ্গনে আমার ব্যাপক কর্মযোগাযোগ ও পরিচিতি ঘটে বলে মনে হলো। কিন্তু জিয়া হায়দারের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ হয় নি। ১৯৭৮ সালের কথা। কবি আবু হেনা মোস্তফা কামালের একান্ত ইচ্ছায় আমি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স পড়ার জন্য বিএ ক্লাসে ভর্তি হই। তিনি তখন বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। তারই পরামর্শে আমার দুটি সহায়ক বিষয়ের মধ্যে একটি ছিল ‘ড্রামাটিক্স বা নাট্যতত্ত্ব’।
নাট্যতত্ত্বের সাবসিডিয়ারি ক্লাস। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। ৩০ থেকে ৩৫ জন। শিক্ষক মহাশয় ক্লাসে প্রবেশ করলেন। আমরা যথানিয়মে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানালাম। তিনি চেয়ারে বসে পড়লেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম শিক্ষকরা দাঁড়িয়েই ক্লাস নিয়ে থাকেন। এ শিক্ষক তো অন্যদের মতো নন। তিনি চেয়ারে বসেই পাঠ দেবেন। নিজের পরিচয় দিলেন : আবদুর রউফ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার। ছাত্রদের পরিচয়, মানে প্রত্যেকের নাম জানতে চাইলেন। আমরা নাম বলা শুরু করলাম। আমি বসেছিলাম একেবারে পেছনের সারিতে। আমার নাম বলার পালা। উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, আসাদ মান্নান। তিনি মুচকি হেসে সঙ্গে সঙ্গে বললেন ‘কবি’। ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে আমার দিকে তাকাল। একদিকে নীরব গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠে, অন্যদিকে লজ্জায়, অপরিচিত শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসে। আমাকে তো এর আগে কোনো শিক্ষক অমন করে কবি হিসেবে কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন নি। বস্তুত তখনো আমার কোনো কাব্যগ্রন্থ বের হয় নি। আর জাতীয় বা স্থানীয় পত্রপত্রিকায়ও তাঁর চোখে পড়ার মতো তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কবিতা প্রকাশিত হয় নি। কিছুদিন পর জানলাম তিনি একজন বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার নাম সংক্ষেপে জিয়া হায়দার। পরিবারের সবাই, বিশেষ করে পাঁচ ভাই লেখালেখির জগতে বাস করেন। ছোট ভাই রশীদ হায়দার কথাসাহিত্যে সুনামের সঙ্গে বিচরণ করছেন, মাকিদ হায়দার কবিতা লিখছেন আর দাউদ হায়দার তো রীতিমতো দেশ-বিদেশে বিখ্যাত হয়ে আছেন তার একটি বিখ্যাত ও বিতর্কিত কবিতার জন্য। জাহিদ হায়দার কবিতার হাত ধরে এখানে-ওখানে ঘুরছেন- ঘুরতে ঘুরতে আমাদের বন্ধু হয়ে ওঠেন। তারপর জেনেছিলাম তার কাছ থেকে যে, সেবার বাংলাদেশ পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত একুশের সাহিত্য প্রতিযোগিতায় জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের বিচারকমণ্ডলীর তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। বলা কি ঠিক হবে যে, কবিতায় আমি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম হয়ে জাতীয় পর্যায়ে শীর্ষস্থান অর্জন করে বাংলাদেশ পরিষদ পুরস্কার লাভ করেছিলাম। মূলত এ কবিতার মাধ্যমেই তিনি আমাকে জানতেন।
আমি এখানে কবি ও নাট্যকার জিয়া হায়দার সম্পর্কে কিছুই বলব না। বলার সময়ও এটা নয়। শোকাচ্ছন্ন কলমে কারও সৃষ্টিমুখর কাজ সম্পর্কে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। উপরন্তু এ-ও তো সত্য, জিয়া হায়দারের প্রতিভার মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে কোনোকালেও সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করবে ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ। প্রিয় শিক্ষককে হারানোর শোক যখন স্থিতি পাবে, যখন ব্যক্তিগত আবেগের জায়গাগুলো পূরণ হয়ে যাবে তখন না হয় তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর কিছু লেখা সহজ হয়। আমি এখানে আমার প্রিয় শিক্ষকের মহাপ্রয়াণে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনার জন্য স্মৃতিচারণমূলক কিছু কথা বলতে চেয়েছি।
এটি একটি একান্ত ব্যক্তিগত রচনা হলেও প্রয়াত কবি ও নাট্যকার জিয়া হায়দারের সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য প্রসঙ্গে কিছু না বললে নয়। বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী আমাদের নাট্য আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি আধুনিক থিয়েটারের বিকাশের ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি নাট্যতত্ত্ব ও বিশ্ব থিয়েটার সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের পাঠ দিতেন। লিখেছেন বেশ ক’টি নিরীক্ষাধর্মী নাটক (শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ, পঙ্কজ বিভাস, এলেবেলে, সাদা গোলাপে আগুন ইত্যাদি) ও থিয়েটারের ইতিহাস সংক্রান্ত অতি মূল্যবান বই ‘থিয়েটারের কথা’ (৫ খণ্ড)। তিনি শুধু নাট্যকার ছিলেন না। ৫০ দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবিও ছিলেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে- একতারাতে কান্না, ভালোবাসা ভালোবাসা, দূর থেকে দেখা, লোকটি ও তার পেছনের মানুষেরা, আমার পলাতক ছায়া ও নির্বাচিত কবিতা।
নাট্যতত্ত্ব, নাট্যচর্চা ও নাট্যকৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন পুরোধা পুরুষ। তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের নাটক ও থিয়েটারের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। জিয়া স্যার চলে গেলেন। পরিবারের সদস্যদের কোনো বিষয়-আশয় নিয়ে তিনি আর ভাববেন না। অনুজের অসুখের খবরে অস্থির হবেন না। নীরবতা ও কোলাহলহীনতা স্যার খুব ভালোবাসতেন। তিনি নীরবতা ও নির্জনতার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন। তাঁর হাতে তৈরি হওয়া নাগরিকের কোনো কোলাহলই আর তাঁকে জাগাতে পারবে না। শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন তিনি, কেউ আর তাকে জাগাবে না।
[লেখাটি দৈনিক সমকালের সাহিত্য সাময়িকী ‘কালের খেয়া’য় ছাপানো হয় ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮। ‘কালের খেয়া’র সম্পাদকের সম্মতি নিলেও লেখকের সম্মতি নেয়া যায় নি। আশা করছি লেখক এটাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]
আসাদ মান্নান: কবি