Full premium theme for CMS
মোহাম্মদ জাকারিয়া-নাজমা আনোয়ার-হুমায়ূন ফরীদি-খালেদ খানের অভিনয়ে সৃজন-স্বাতন্ত্র্য : অর্বাচীনের চোখে স্ফুলিঙ্গ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
অভিনয়তন্ত্র এক হারিয়ে যাওয়া বর্ণমালা।
অবাক লাগে পিছনের পঞ্চাশ বছর বা আরও পিছনের দুইশত বছরের দিকে ফিরে তাকালে। থিয়েটারের ইতিহাস, নাটক বা নাট্য কিংবা মঞ্চের কথা কিছু পাওয়া যায়। অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাম-ধাম ঠিকুজির ঠিকানা পাওয়াও কঠিন নয়। কিন্তু অভিনয়? এ নিয়ে কথাবার্তা সামান্য। সময়ে ধরে রাখতে না পারলে অভিনয় লুপ্ত হয়ে যায়।
অভিনয় স্বতন্ত্র-শিল্পের মর্যাদা পাবে কি না এ সংশয় নিয়েই শুরু করছি। শুরুতেই একটা কথা জানিয়ে রাখি, শিল্প হিসেবে অভিনয়কে যারা খুব হালকাভাবে নেয়, তারা মঞ্চে উঠে মুখস্ত সংলাপ বলে যায়। অভিনয়ের মুহূর্তকে নিজেই বিশ্বাস করে না। মুখস্থ কিছু মুদ্রা ব্যবহার করে বাজিমাৎ করতে চায়। সারাদিন সুতা-বোতামের হিসাব মিলিয়ে সন্ধ্যায় সংলাপ উগড়ে দেয়। এতেই নিজেকে বিরাট অভিনেতৃ ভেবে অহংকার করে। সেই বাচাল না-অভিনেতৃর অভিনয়চর্চায় এই লেখার কোনো গুরুত্ব নেই।
যে অভিনয়ে সত্যের সঙ্গে অনুভবের যুক্তি থাকে, উদ্দেশ্যের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটে, সেই অভিনয়চর্চায় কিছু কিছু স্ফুলিঙ্গ উড়ে যায়। অভিনয়-শিল্প বহুমাত্রিক। একটা মঞ্চ। পরিকল্পিত আলো আছে। অভিনেতৃর অঙ্গসজ্জা নিখুঁত। মেপে মেপে আবহ-ধ্বনির ব্যবহার। অভিনেতৃর স্বর কণ্ঠ উচ্চারণ সব ঠিকঠাক। তবু অভিনয়টা না-ও হতে পারে। কোথায় যেন একটা শূন্যতা থেকে যায়।
থিয়েটারের প্রধান অঙ্গ অভিনয়। এর সৃষ্টি যৌগিক। বাতাস যেমন অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমান মতো মিশ্রণ। তেমনি অভিনয়, কণ্ঠ, ধ্বনি, আঙ্গিক, সাত্তিক- সমস্ত বৈশিষ্ট্য মিলে সৃষ্টি হয়। ছন্দ মিল, ভাব, অনুপ্রাস সব ঠিকঠাক রেখে কবিতা অনেকেই লিখেন। তবু ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। তেমনি অভিনয় অনেকেই করেন। সকলেই অভিনেতৃ নয়, কেউ কেউ অভিনেতৃ। শিল্পের নান্দনিকতা গজফিতা দিয়ে মাপা যায় না। অনুভব দিয়ে মাপতে হয়।
অভিনয়-শিল্পের প্রকৃতি এবং নির্মাণ-পদ্ধতি জটিল। চিত্রকলায় প্রতিকৃতি দেখলে বুঝি এটা সত্যি মানুষ নয় মানুষের আকৃতি নিয়ে আঁকা। মোনালিসার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা যায়। কিন্তু মোনালিসার মুভমেন্ট নাই। সে কী ভাবে আমরা জানি না। গল্প উপন্যাস পাঠে চরিত্র দেখে বুঝি এ সত্যিকারের মানুষ নয়। পদ্মা নদীর মাঝির ‘কুবের’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টি। প্রতি পাঠক কুবেরকে তার মতো কল্পনা করে নেয়। তেমনি চাঁদ বণিক, হ্যামলেট, শাজাহান যতক্ষণ পাণ্ডুলিপিতে ততক্ষণ নিরীহ নিহত পড়ে থাকে। অভিনীত হতে গেলেই জেগে উঠতে হয়। মঞ্চে যে মানুষ হাঁটাচলা করে সে তো সত্যিকারের মানুষ। কিন্তু সে আবার সেইমানুষ নয়। কথা, স্বর, আচার-আচরণ, তাকানোর ভঙ্গি, আবেগ-প্রকাশ যে করছেন, সে সত্যিকার চাঁদ বণিক বা হ্যামলেট নয়। নাটকের চরিত্রের হয়ে সে এসব করছেন। অর্থাৎ নাট্যকার নির্দেশকের আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ সৃষ্টি করছেন। তিনি অভিনয় করছেন। এই অভিনয়রূপ সৃষ্টি করতে গিয়ে অভিনেতৃ রূপ থেকে অরূপ এবং অরূপ থেকে রূপে সঞ্চরণ করেন। এভাবে অভিনয়-শিল্পকর্মটি সৃষ্টি হয়। এই সৃষ্টির জন্যে বুদ্ধির দরকার। নির্বুদ্ধিতা বা চাতুরী দিয়ে অভিনয় হয় না। লোক ঠকানো ব্যবসা বা তেলবাজি বা নকল ডক্টরেট করার বুদ্ধি নয়। সৎ বুদ্ধি থাকতে হবে। আজকাল দৈনিক পত্রিকার অর্ধেক পাতা জুড়ে ‘ভীষণ ভালো’, ‘দেখে মুগ্ধ হলাম’, ‘বহুল প্রচার হোক’ পাটোয়ারি বুদ্ধি খাটিয়ে এসব প্রশংসাপত্র নেয়া হয়। তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই নিজের প্রচারের ভাঙা রেকর্ড বাজাতে থাকে। এসব অভিনয় না-বোঝা, অভিনয়ের ভাষা না-বোঝার দৈন্যের প্রকাশ। এই অক্ষমতা নিয়েই আমরা অভিনয় করি, অভিনয় দেখি, অভিনয়ের প্রশংসা করি। অভিনয় করতে দরকার বোধ। ধীশক্তি। উপলব্ধি। কীসের বোধ? ইতিহাস ও রাজনীতির বোধ। সেই সাথে নান্দনিক বোধ। সেইসব বোধ জারিত হয়ে তৈরি হয় একটা দৃষ্টিভঙ্গি। একজন লেখক বা নির্দেশক সময় সমাজ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে চরিত্রকে ভাবে। অভিনেতৃকে সেই ভাবনার সক্ষমতা থাকতে হবে। অভিনেতৃ সে, যে মনে রাখে। ছোটবেলা মনে রাখে। অবহেলা মনে রাখে। মনে রাখে গর্ববোধ। মনে রাখে বেড়ে ওঠা। চিনতে পারে শরীরে জমে থাকা আদিম জড়তা। তীব্র ক্ষুধা বুকফাটা তৃষ্ণা। পরম তৃপ্তি এমনকি যৌক্তিক বা অযৌক্তিক ঘৃণা। তাকে মনে রাখতে হয় সংলাপ। নিজের কিউ। সহঅভিনেতার শেষ সংলাপ। প্রবেশ-প্রস্থান। আলোর প্রক্ষেপণ। মিউজিকের প্রয়োগ। এই সবকিছু গাণিতিক নিয়মে ঠিকঠাক প্রয়োগ করেও অভিনয় ব্যর্থ হতে পারে। আবার এর কিছুটা ঘাটতি নিয়েও অনেকে হয়ে উঠেন অভিনেতৃ। স্মৃতি নেই এমন মানুষ অভিনেতা বা অভিনেত্রী হয় না। অভিনেতৃকে সব মনে রাখতে হয়। অভিনয় থিয়েটারের প্রধান অঙ্গ।
আমাদের সময়ের কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী। কিছুদিন আগেও মঞ্চে যাদের ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাদের কিছু কিছু অভিনয়ের স্ফুলিঙ্গ কালের অতল থেকে উদ্ধার করার এই চেষ্টা। এ এক অক্ষম চেষ্টা। তাদের মূল্যায়ন করার সক্ষমতা আমার নেই। যারা এই নান্দনিক হীরক-দ্যুতি তুলে ধরতে পারতেন তারা অনেকেই নীরব। এই সুযোগে এক অর্বাচীনের আস্ফালন।
বাংলাদেশের থিয়েটারচর্চা পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়সীমা পার করেছে। আমাদের চারপাশে এখনও অনেক প্রথিতযশা নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতৃ রয়েছেন। থিয়েটারের অন্দরমহলের খুঁটিনাটি খবর যাদের নখদর্পণে। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের ইতিহাস সংরক্ষিত হয় না। তা জাতীয় ইতিহাসই হোক আর সংস্কৃতির ইতিহাসই হোক। সব একপেশে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়।
থিয়েটারের ইতিহাস মানে নাট্যের ইতিহাস। মঞ্চের ইতিহাস। সেটের ইতিহাস। আলোর ইতিহাস। রূপসজ্জার ইতিহাস। অভিনয়ের ইতিহাস। স্থান-কাল-সময়ভেদে অভিনয়ের ধরন পাল্টায়। ট্র্যাজেডির অভিনয়ের ধরন আর কমেডির অভিনয়ের ধরন এক নয়। ঐতিহাসিক নাটকে আর প্রহসনে একই মেথডে অভিনয় হয় না। মহাকাব্যের অভিনয় আর লোকনাট্যের অভিনয়ের নিরীক্ষা ভিন্ন। ভিন্ন বর্ণনাত্মকরীতি আর বাস্তববাদী ঘরানা। অভিনয়ের মহাফেজখানায় নানান উপাদান সংরক্ষিত থাকে। অভিনেতৃকে শুধু নাবিক হলে হয় না ডুবুরিও হতে হয়।
থিয়েটারের বিষয়গুলো সেট, পোস্টার, পোশাক, প্রপস সংরক্ষণের নামে একটা অন্ধকার ঘরে আটকে দিলে হবে না। এগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। এমনভাবে সাজিয়ে দিতে হবে যাতে পরের প্রজন্ম কাজে লাগাতে পারে। সংযোগ সেতুটি এমন হওয়া চাই যাতে ব্যবহার করতে আগ্রহ জাগে।
নৃত্যশিল্প শুধু দেখার। অভিনয়-শিল্প দেখার এবং শোনার। অভিনয় লিখে বর্ণনা করা যায় না। তবে অভিনয় অপরাপর শিল্পের সহযোগে অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্যরূপ নির্মাণ করতে পারে। সেই দৃশ্য উপভোগ এবং বোঝার জন্য দর্শকেরও প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। একাই বাজে না সুর। তন্ময় আর তানে মিলে তবে বাজে সেই সুর।
গ্রিক অভিনয় থেকে রোমান, রোমান থেকে এলিজাবেথীয়। স্তানিস্লাভস্কি-ব্রেখট-পিসকাটর নানামুখী অভিনয়-চিন্তা। অ্যারিষ্টটলের অনুকরণ তত্ত্ব বনাম স্তানিস্লাভস্কির বাস্তববাদ। স্তানিস্লাভস্কির বিপরীতে চেকভ। আবার ব্রেখট আর পিসকাটরের এপিক থিয়েটার ভাবনা আলাদা। এলিয়েনেশন না ইলিউশন। ব্রেখট চাইলেন অভিনেতৃর বিচ্ছিন্নকরণ। নাটক লিখে তা প্রযোগ করে দেখালেন। দ্বৈত, না অদ্বৈত, না দ্বৈতাদ্বৈত, কোথায় দাঁড়াবে অভিনেতৃ? নাট্যকারের দেখানো নির্দেশকের পথ। কোনদিক থেকে আসবে আলোর ভাষা। কোন ব্লকিংয়ে থাকতে হবে। অভিনয়ের নান্দনিকতা একা অভিনেতৃর শৈলী নয়।
শিল্প-সৃষ্টির গাণিতিক হিসাব অনেকটা এরকম:
ক. কথা ও ভাষা দিয়ে সৃষ্টি হয়: মহাকাব্য, নাটক, কবিতা, গল্প ইত্যাদি। কথ্য এবং লেখ্য দুভাবেই সৃষ্টি হয়।
খ. কথা ছাড়া সৃষ্টি হয়: চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নৃত্য, মুকাভিনয় ইত্যাদি।
গ. ধ্বনি এবং কথা থেকে হয়: যন্ত্রসংগীত এবং গান।
ঘ. অভিনয় সৃষ্টি হয় সবকিছু মিলিয়ে।
অভিনেতৃর প্রস্তুতির দরকার হয়। শরীরচর্চা থেকে কণ্ঠ-সাধনাÑএ এক বাহ্যিক-অনুশীলন। এর বাইরে আছে সাত্তিক অভিনয়। সেখানে তাকে হতে হয় শ্রুতিধর। থাকতে হয় সমাজ-বিশ্লেষণের ধারণা। একটা বিট থেকে আরেকটা বিট ধরে ফেলতে হয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীকে হাঁটতে হয় বিটুইন দা লাইন।
অভিনয়-বিষয়ক নানাবিধ মতবাদ বিবেচনায় রেখে শিরোনামের চার অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় স্মরণ করা যাক।
মোহাম্মদ জাকারিয়া (১৯২৩-১৯৯৩)। মূলত থিয়েটার দলের হয়ে অভিনয় করেছেন। প্রায় চল্লিশ বছরের অভিনয়-জীবনে পঁচিশটা নাটকে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ-পর্বে অভিনয় করেছেন দশটা নাটকে। অভিনীত নাটকের বেশিরভাগের নাট্যকার-নির্দেশক ছিলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। ১৯৪৮ সালে ‘বহুরূপী’ দলের নবান্ন নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। শরণার্থী/ভিক্ষুক চরিত্রে। রক্তকরবীর ফাগুলাল বা ডাকঘর’র দইওয়ালাকে আমরা পাই নি।
বাংলাদেশ-পর্বে কবর নাটকে ইন্সপেক্টর চরিত্র দিয়ে শুরু। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এবং থিয়েটার এর যৌথ প্রযোজনা ম্যাকবেথ নাটকে চিকিৎসকের ভূমিকায় অভিনয় করেন। থিয়েটার-প্রযোজনা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকের মুখ্য চরিত্র ‘পীর’ সাহেবের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্যে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। এ নাটকের মধ্য দিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের নাট্যকার হিসেবে আবির্ভাব ঘটে। বিশেষ-করে এই নাটকে পীর সাহেবের যে কস্টিউম এবং মেকআপ, তা বহুদিন এ ধরনের চরিত্রের রূপায়ণে প্রভাব বিস্তার করেছে। লম্বা দাড়ি, সুরমা দেয়া চোখ, কপালে নামাজের দাগ, ঘাড়ে চেককাটা রুমালÑএক বাস্তব-পীরের অবয়ব দেয়। সাদা জোব্বা আর বুকে কোরাণ ধরে, চোখ গভীর এবং স্থির রেখে দৃঢ়কণ্ঠে প্রথম প্রবেশে উচ্চারণ করেন:
-লা ইলাহা ইললেল্লা।
সহজেই দর্শকের সমীহ আদায় করে নেন। তারপর যখন আভিজাত্যের সঙ্গে জবাবদিহি চায়:
পীর এই,কী চাস,কী চাস তোরা?
মাদী-মরদ জোড়া জোড়া
খাড়ায়া আছো সঙের ঘোড়া
শ্বাস নিবার শব্দ নাই
মুখে কোনো বাক্য নাই
কী চাস,কী চাস তোরা?
সেই বনেদি-কণ্ঠ শুনে গ্রামবাসীর সঙ্গে দর্শকও যেন তলিয়ে যায়। সহসা তার কথার কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। এভাবেই সারানাটক জুড়ে পীর সাহেব তার অভিনয়ে মুগ্ধ করে রাখেন। জনতার বিরুদ্ধ চরিত্র হওয়া সত্ত্বেও একটা সমীহভাব জেগে থাকে। মাতব্বরের মৃত্যুর পর শেষদৃশ্যে যখন পীরের উপর স্পট লাইট পড়ে, আর সত্তার গভীর থেকে উচ্চারণ করেন:
পীর দাগ, একটা দাগ রাইখা যায়
আনো লাশ, আরও লাশ, লাশের পাহাড়
সকলে দাঁড়াও ভাই কাতারে কাতার।
এভাবে তিনিও বাংলা-নাটকের অভিনয়ে একটা ‘দাগ’ রেখে যান। পরবর্তীসময়ে এখানে এখন বা এখনও ক্রীতদাস কিংবা সেনাপতি নাটকে তার দক্ষ-অভিনয় আমরা দেখেছি। বাস্তববাদী অভিনয়ের ধারায় তিনি অভিনয় করতেন এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
অভিনেতা-অভিনেত্রী পছন্দের চরিত্র পেলে এক ধরনের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। গতানুগতিক চরিত্রের বাইরে বা বলা যায় চরিত্রের উপর জোর খাটালে সেই অভিনয় টের পাওয়া যায়। নাজমা আনোয়ার (১৯৪১-২০০৪) ছিলেন শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ অভিনেত্রী। সংগ্রামী চরিত্রের মুখ। নদীর ভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানুষের শোষণে সৃষ্ট যে নিরন্ন মুখ ‘আরণ্যক নাট্যদল’ তার বিভিন্ন নাটকে তুলে ধরে, তার নারী-চরিত্র অভিনয়ে নাজমা আনোয়ার ছিলেন অপরিহার্য। সমতট’র ‘মা’, গিনিপিগ’র ‘পপির মা’, নানকার পালার ‘মতির মা’ কিংবা সাত পুরুষের ঋণ’র ‘জয়মন’। সমতট নাটকে ফয়েজ জহিরের দড়ি দিয়ে করা জটাজাল, তার উপর ঠাণ্ডু রায়হানের অন্তর্মুখী আলো মঞ্চের উপর এক ধরনের মুড তৈরি করে আবার ভেঙে দেয়। এর ফলে চরিত্রগুলোকেও বিভিন্ন মুডে দ্রুত পরিবর্তিত হতে হয়। নাটকের ঘটনাগুলো ঘটে বাইরে। এর প্রতিক্রিয়া দেখাতে হয় মঞ্চে। ডাক্তাররূপী মামুনুর রশীদ এবং মা চরিত্রে নাজমা আনোয়ার বাস্তববাদী অভিনয় করেন। ঘরের ভিতর মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ রূপ এমনভাবে প্রতিফলিত করেন, যেন সত্যি সত্যি ঘরের বাইরে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে ঘটে যাওয়া বিষয় বর্ণনা করতে গিয়ে যে অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটান, কান্নায় ভেঙে পড়েন, সেই বাস্তব-অভিনয় চরিত্রের সাথে একাত্ম করে দেয়।
নাজমা আনোয়ার রাঢ়বঙ্গ সমতটের শোষিত রুক্ষ বঞ্চিত নারী-চরিত্রের জন্য ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি ডিটেইলে কাজ করতেন। কাজের মধ্যে কমিটমেন্টের ছাপ থাকত। তার খটখটে কণ্ঠ আর প্রতিবাদী শারীরিক-ভাষা তাকে বৈশিষ্ট্যময় অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ব্যতিক্রম দেখি কোরিওলেনাস নাটকে ভলিউমনিয়া চরিত্রে। শাড়ি পরা পোড় খাওয়া বাঙালি নারীটি সেখানে হারিয়ে যায়। ভিন্ন পোশাকের ভিন্ন আহার্যে বাচিক আর আঙ্গিক যেন কোনঠাসা হয়ে পড়ে। মনে হয় আরোপিত অভিনয়। অনুদিত সংলাপে কেমন একটু আড়ষ্ট বলেই মনে হয়। দৈহিক ও বাচিক অভিনয়ের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অভিনয়টা ঠিক লাগসই হয়ে ওঠে না।
মঞ্চের বাস্তব-অভিনয় দেখে দর্শক যাতে আবেগ-আপ্লুত না হয়, এই ভাবনা থেকে পিসকাটর এবং ব্রেখট এপিক থিয়েটারের কথা বললেন। বাস্তব-অভিনয়ের বাইরে এক বিচ্ছিন্নতার অভিনয়তত্ত্ব। কার্ল মার্কসের উদ্বৃত্ত তত্ত্ব থেকে এই ফর্মের আগমন। ব্রেখট শুধু এই নাট্যতত্ত্বের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলেন না, নাটক লিখে এবং নির্দেশনা দিয়ে এর স্বরূপ প্রকাশ করলেন। বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়কে ব্রেখট চর্চার পথিকৃৎ বলা যায়। ১৯৭৫ সালেই সৎ মানুষের খোঁজে নাটকের মধ্য দিয়ে তাদের ব্রেখট যাত্রা শুরু হয়। এরপর একে একে দেওয়ান গাজীর কিসসা, মোহনগরী, গ্যালিলিও, হিম্মতি মা প্রযোজনা করে। আশির দশকে আরও কিছু নাট্যদল ব্রেখট প্রযোজনা করে। নাট্যচক্র চক সার্কেল, পদাতিক নাট্য সংসদ মা, অরিন্দম রাইফেল, তির্যক সমাধান।
এই সময়ে দেশজ আঙ্গিক নির্মাণে বিশ্বাসী দল ঢাকা থিয়েটারও প্রতিজ্ঞা সরিয়ে রেখে ব্রেখট প্রযোজনা করল। অষ্টাদশ প্রযোজনা ব্রেখটের দ্য রেজিস্টেবল রাইজ অব আর্তুরো উই অবলম্বনে ধূর্ত উই। জার্মান থেকে নির্দেশক ক্লস ক্যুসেসবার্গ আসলেন। নির্দেশকের সঙ্গে আসা গুন্টার হেলউইগ মঞ্চ, আলো, পোশাক, রূপসজ্জা পরিকল্পনা করে দিলেন। রূপান্তরিত এই নাটকের প্রধান চরিত্র ‘উই’ এর ভূমিকায় অভিনয় করেন হুমায়ূন ফরীদি।
ঢাকা থিয়েটারের কেরামতমঙ্গল নাটকের বিশাল প্রেক্ষাপট। কেরামত চরিত্রে অভিনয় করেন তিনজন। এর মধ্যে পৌঢ় কেরামতের ভূমিকায় হুমায়ূন ফরীদি। এই দুরূহ চরিত্রে বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়ের জন্য ফরীদি প্রশংসাধন্য হয়ে আছেন। শকুন্তলা নাটকে একটা দৃশ্যে ‘তক্ষকে’র ভূমিকায় উজ্জ্বল উপস্থিতি এই অর্বাচীন দর্শক দীর্ঘদিন ধরে মনে রেখেছে। শরীর বাঁকিয়ে কণ্ঠধ্বনি এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলায় অবগাহন করতে করতে অধিক বয়সের একটা চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা এ বেশ বড়ো অভিনেতার কাজ। দলগত অভিনয়ের ধারা ঠিক রেখে এ রকম শক্তিশালী অভিনয় শুধু ঢাকার মঞ্চে না, বিশ্বের যে কোনোও মঞ্চেই দুর্লভ।
ধূর্ত উই নাটকে শক্তিশালী কুশীলববৃন্দ, দেশ বিদেশের অভিজ্ঞ কলাকুশলীর পরিকল্পনা, গ্যেটে ইন্সটিটিউটের সহযোগিতা, সবকিছুকে ব্যর্থ করে দিয়ে নাটক কিন্তু জমল না। কোথায় যেন একটা অভিনয়ের গ্যাপ তৈরি হলো। দস্যু দলের প্রধান উইকে যেকোনো ভাষাতেই সনাক্ত করা যায় যে, সে একটা খুনি। হিটলারকে ইঙ্গিত করেই এই চরিত্র নির্মাণ। কিন্তু এই নাটকে রূপান্তরিত সংলাপ দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে বাধাপ্রদান করে। ফলে ফরীদি যতই গভীর আত্মবিশ্বাসী দ্ব্যর্থ অভিনয় করার চেষ্টা করেন, অন্য অভিনেতৃর সঙ্গে গুণগত পার্থক্য বেড়ে যায়। ফলে দলগত অভিনয় হয়ে পড়ে ছাড়া ছাড়া।
আহার্য, আঙ্গিক, বাচিক, সাত্তিক- সব রকমের অভিনয়ের অভিজ্ঞতা নিয়েও সামষ্টিক অভিনয়ের সমন্বয়ের অভাবে নাটক প্রযোজনা ব্যর্থ হয়ে যায়।
এদিক থেকে নাগরিকের দেওয়ান গাজীর কিসসা কিংবা গ্যালিলিও অনেক বেশি কমিউনিকেটেড। দর্শকের সঙ্গে অনেক বেশি যোগাযোগ স্থাপন করে- রূপান্তরিত এবং অনুদিত হওয়া সত্ত্বেও। কোনো বিশেষ দর্শন বা মতবাদের প্রতি শূন্য আগ্রহ নিয়েও বিখ্যাত সব নাটকের সুঅভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকচিত্ত জয় করে নেয় এই দলটি। অভিনেতা আলী যাকের দেওয়ান গাজীর গাজী থেকে গ্যালিলিও নাটকের গ্যালিলিও হয়ে নূরলদীনের সারাজীবনের নূরলদীন চরিত্রের মাধ্যমে অতিকায় অভিনেতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। এই দলে আসাদুজ্জামান নূরসহ অসংখ্য সুঅভিনেতা অভিনয় করেন। দেওয়ান গাজীর কিস্সা নাটকে মাখন একটা অন্যতম চরিত্র। সে আগে রিক্সা চালাত, এখন গাজীর খাস বেয়ারা। পড়াশুনা ক্লাস থ্রি। দেখতে শুনতে ভালো। তারচেয়েও তার মন ভলো। নেশা করা দেওয়ান গাজীর ভাষায় মাখন একটা খাঁটি মানুষের বাচ্চা। এই চরিত্রটির নিয়মিত অভিনেতা আবুল হায়াত। আবুল হায়াতের বিকল্প অভিনেতা হিসেবে মাখন চরিত্রে প্রবেশ করেন খালেদ খান। বিশ বছরের তরুণ। ব্রেখটীয়রীতির সঙ্গে বোঝাপড়া আছে কি নেই। জ্যেষ্ঠ অভিনেতার উচ্চতায় থাকতে হবে। রপ্ত করে নিলেন বাচিক অভিনয়। সংলাপের টেক্সট সাব-টেক্সট আলাদা করলেন। এমন কী বাক্যের মাঝখানে বিট আলাদা করে সংলাপের মাঝখানে কণ্ঠের উঠা-নামা অধিগত করলেন। সেই নান্দনিক অভিনয় উপভোগ্য হয়ে ওঠে গ্যালিলিও এবং ঈর্ষা নাটকেও।
গ্যালিলিও নাটকে দুর্দান্ত সব অভিনেতার পাশে আন্দ্রিয়া চরিত্র আলাদা সমীহ আদায় করে নেয়। আন্দ্রিয়া গ্যালিলিওর শিষ্য। কলকাতার একটা প্রযোজনায় এই সম্পর্কটিতে সমকামিতার ইঙ্গিত টেনে অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করা হয়। নাগরিকের এই প্রযোজনায় সেইরকম কোনো ইঙ্গিত নেই। যদিও ব্রেখটের নাটকগুলোতে টোটাল কমিটমেন্টের চাইতে সস্তা প্রশংসার দিকে তাদের ঝোঁক রয়েছে। এই নাটকে স্পষ্টতই আন্দ্রিয়া একান্ত বাধ্যগত ছাত্র। অনেকটা যেন গ্যালিলিওর মানসপুত্র। নাটকের বক্তব্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ গ্যালিলিও এবং আন্দ্রিয়ার মধ্যে হয়। এখানেই বিভিন্ন স্তরে স্বরের উঠা নামার খেলা চলে। কণ্ঠের আবেগ এবং শরীরের পরিমিত পরিশীলিত ব্যবহার পুরো দলটার কঠিন শৃঙ্খলার অনুশীলনের প্রতি সম্ভ্রম আদায় করে নেয়। গ্যালিলিও এবং আন্দ্রিয়ার সংলাপের মধ্য দিয়ে নাটকের ইনার মিনিং প্রকাশ পায়। সেই পকেট খালির দিনে এই অর্বাচীন দর্শক মোহগ্রস্তের মতো একবার দুইবার দেখতে দেখতে উনিশবার দেখে ফেলে এই কালোত্তীর্ণ নাটক। ভীনদেশি পোশাকে অনূদিত সংলাপ দেশী অভিনেতার কণ্ঠে মনে হয় দেশকাল ছাপিয়ে গ্যালিলিও সর্বকালের। সংগীত এখানে আলাদা সংগীত নয়। চোঙ্গার ভিতর দিয়ে আসা আলো আলাদা আলো নয়। অসংখ্য চরিত্র অভিনয় করে তবু অভিনয় আর অভিনয় থাকে না। এরা যেন সত্যিই গ্যালিলিও আন্দ্রিয়া বিচারপতি পোপ ভার্জিনিয়া সিনেটর। সবটা মিলে একটা দৃশ্যকাব্য তৈরি হয়। প্রথম দৃশ্যেই গ্যালিলিও-আন্দ্রিয়াকে পেয়ে যাই। আন্দ্রিয়া গ্যালিলিওর জন্য দুধ আর রুটি নিয়ে প্রবেশ করে। তারপর যুক্তি পাল্টা যুক্তি, দ্বন্দ্ব বিরোধীতার মধ্য দিয়ে নাটক এগিয়ে যেতে থাকে।
২২ শে জুন ১৬৩৩ গ্যালিলিও তার পৃথিবী আবর্তনের মতবাদ ভুল বলে প্রত্যাহার করতে স্বীকৃত হলেন। তেইশ দিন জেলে থাকার পর ধর্ম-আদালত রায় ঘোষণা করবে। বাইরে তরুণ যাজকদের সঙ্গে আন্দ্রিয়ার পক্ষে-বিপক্ষে কথোপকথন চলতে থাকে। আন্দ্রিয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না গ্যালিলিও স্বীকারোক্তি দিবেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত গ্যালিলিও ধর্ম-আদালতের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এতে ভেঙে পড়ে আন্দ্রিয়া চিৎকার করে বলে:
আন্দ্রিয়া অভাগা সেই দেশ যার বীরপুত্র নেই!
বিধ্বস্ত গ্যালিলিও একটা টুলের উপর ক্লান্ত বসে পড়ে। তারপর দূরগত গভীরস্নেহময় কণ্ঠে আন্দ্রিয়াকে এর প্রতুত্তর দেয়:
গ্যালিলিও তুমি ভুল বলেছিলে আন্দ্রিয়া। অভাগা সেই দেশ যার বীরপুত্রের প্রয়োজন।
এসব দৃশ্যে চোখ মুখ আঙুলের ব্যবহার সেই সাথে বাচিক অভিনয় অপার্থিব দৃশ্যের সৃষ্টি করে।
অচলায়তন পর্ব থেকেই সংলাপের বিভিন্ন স্তরে খালেদ খান পারঙ্গমতার ইঙ্গিত দেন। অচলায়তনের ‘পঞ্চক’ একটি বিদ্রোহী চরিত্র। সে মহাপঞ্চকের ভাই। গান গায় হাসে খেলে নাচে অচলায়তনের এই ছাত্র। অচলায়তনের নিয়মে যা প্রলয়ঙ্করী পাপ। অচলায়তন শুরুই হয় পঞ্চকের কণ্ঠে গান দিয়ে:
পঞ্চক তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে
কেউ তা জানে না
নাটকের শেষ সংলাপটিও পঞ্চকের:
পঞ্চক প্রস্তÍত আছি। গুরু তবে প্রণাম করি। আচার্যদেব আশীর্বাদ করো।
অচলায়তনের কেন্দ্রীয় চরিত্র দাদাঠাকুর। এই চরিত্রটি করেন আলী যাকের। পঞ্চক থাকে দাদাঠাকুরের পাশে। দাদাঠাকুরের নির্দেশে পঞ্চক শোনপাংশুদের সাথে মিশে পুরনো সৌধের উপর নতুন সৌধ গড়ার কাজে লাগে। পঞ্চক চরিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় অচলায়তনকে ভেঙে মুক্ত বিস্তৃত এবং কর্মময় জীবনের আহ্বান করে।
নূরলদীনের সারাজীবন নাটকে খালেদ খানকে বিক্ষুব্ধ চরিত্রে পাই। অচলায়তনের মতো এত বেশি সংলাপ এখানে নেই। মূলচরিত্র নূরলদীন করেন আলী যাকের। নূরলদীনের বন্ধু আব্বাস চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর। খালেদ খান করেন দেওয়ান ‘দয়াশীল’র চরিত্র। নূরলদীনের সাথে জনতার সংযোগকারী হিসেবে কাজ করে দয়াশীল চরিত্র। নাটকের মূলভিত্তি দ্বন্দ্ব। ভালো আর মন্দের দ্বন্দ্ব। আদর্শবান নূরলদীনের সাথে বস্তুমুখী আম্বিয়ার দ্বন্দ্ব। স্থির আব্বাসের সঙ্গে অতিউৎসাহি জনতার দ্বন্দ্ব। সবকিছু ছাপিয়ে এই নাটকের প্রধান সুর হচ্ছে শ্রেণিদ্বন্দ্ব। আছে ইংরেজ চরিত্রের শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব। তেমনি দয়াশীল চরিত্রের আছে শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব। আঞ্চলিক ভাষার কাটা কাটা শুদ্ধ ছন্দবদ্ধ সংলাপ। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার লোকজ টান পুরোপুরি না আসলেও শিক্ষিত অভিনেতাদের এক ধরনের মিশেল-ভাষা শুনতে খারাপ লাগে না। বিষয়গতভাবে দ্রোহের পক্ষের চরিত্র এক ধরনের সহানুভূতি আদায় করে। শত শত কণ্ঠ যখন নূরলদীনের সাথে যোগ দিতে এগিয়ে আসে দয়াশীল তাদের প্রশ্ন করে:
দয়াশীল কাঁই তোমরা কাঁই?
কোথা হতে আসেন তোমরা?
যাইবেন কোন ঠাঁই?
জনমত যখন জানায়:
ধ্বনি অন্ন দিবে নূরলদীন
বস্ত্র দিবে নূরলদীন
তারায় হামার নবাব হামার নবাব নূরলদীন
জয় নবাব নূরলদীন।
দয়াশীল নিজের সঙ্গে নিজের এবং ভাবোদ্বেল জনতার সঙ্গে এক ধরনের দ্বন্দ্বের খেলা করে। পাকা খেলোয়ারের মতোই সে বল থ্রো করে।
দয়াশীল নবাব নয় নবাব নয় তোমার মতো মানুষ
তাঁই তোমার মতো মানুষ
তাঁই হামার মতো মানুষ
নবাব নয় নূরলদীন
তাঁই সবার মতো মানুষ।
তরুণ খালেদ খানকে ব্যক্তি বয়সের সমবয়সি চরিত্রেই বেশি দেখা যায়। প্রায় তিরিশটি মঞ্চ নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। খালেদ খানের সমান বয়সি এক যুবককেই আমরা পাই সৈয়দ হকের ঈর্ষা নাটকে। তিন চরিত্রের সাত সংলাপ। জামালউদ্দিন হোসেন, সারা যাকের, খালেদ খান। কেউ কারে নাহি ছাপায় সমানে সমান। ইগো অলটার ইগোর খেলা। সাতটি দীর্ঘ সংলাপ। পৌঢ়ের সংলাপ তিনটি। যুবক আর যুবতীর দুটি করে। পৌঢ় আর যুবতীর মুখোমুখি অবস্থান থেকে নাটক শুরু হয়। প্রথম সংলাপ পৌঢ়ের। তারপর যুবতীর সংলাপ। যুবতীর সংলাপের শেষে মঞ্চে প্রবেশ করে যুবক। প্রথম দুই চরিত্রের দুর্দান্ত অভিনয়ের পর আর কী করার থাকে! ফ্লপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এরকম একটি হটকারী সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়ে ফেলে দর্শক। আর তখনই প্রবল ঝঞ্জার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে যুবক। প্রথম দুই অভিনেতৃর চেয়ে অভিজ্ঞতায় এই যুবক অনেকটা নবীন। কিন্তু নাটকের মাঝখানে ঢুকে প্রথম সংলাপের প্রথম লাইনেই দর্শক সতর্ক হয়ে যায়।
যুবক তাহলে এখানে তুমি? কিসের প্রদর্শনীর কথা হচ্ছিল? নগ্নিকাটি কে?
কার ছবি দেখে মানুষ চিনে নেবে তোমাকে
না বাংলার গৌরব এই শিল্পীটিকে?
পরপর কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। প্রশ্ন নয় যেন তীর ছুঁড়ে দিলেন। সহঅভিনেতৃ নাকি দর্শকের দিকে? দর্শক টান টান সোজা হয়ে বসলেন। তারপর দীর্ঘ দীর্ঘ এক সংলাপ বলে গেলেন। তিনজন অভিনেতৃ নিজস্ব স্বরলিপিতে অভিনয় করলেন। দর্শক ক্রীড়নক হয়ে রইল। হাতের ভঙ্গি, মুখের অভিব্যক্তি। ক্রোধের প্রকাশ, ভালবাসা, ভাবালুতা। পুরো শরীর দিয়ে প্রকাশ করলেন। ক্রোধে যখন উচ্চারণ করেন:
যুবক আমি সেই বাংলার ছেলে যে-বাংলা একদিন
রক্তে স্নান করে উঠেছিল, ধর্ষিত হয়েছিল, লুন্ঠিত হয়েছিল।
যে-বাংলা একদিন মুক্তিসেনা গেরিলার জন্ম দিয়েছিল।
আমি সেই মায়ের সন্তান যে-মা রক্তাক্ত আঁচল ছিঁড়ে একদিন
রাইফেল বেঁধে দিয়ে বলেছিল-
‘তুই না ফিরিস তাতে দুঃখ নেই, দিন যেন ফেরে।’
তখন দর্শক এক কাল্পনিক-বাস্তবতার ভিতর ঢুকে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ সত্যি হয়ে ওঠে। এক ভিন্ন স্তরের প্রতিভাস তৈরি হয় যা বাংলা ভাষাভাষি এবং মুক্তিযুদ্ধের সমাজবাস্তবতা ভিন্ন অন্য ভাষায় ধরা অসম্ভব। অনিবার্য সত্য বলে মনে হয় এই যুবক একদিন দেশকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। সংলাপ যত এগিয়ে যায় ততই নেপথ্য ধ্বনি, আলো এমনকি মঞ্চে রাখা ভাস্কর্য জীবন্ত হয়ে ওঠে। সবকিছু মিলিয়ে অভিনেতার দ্বিধা থরথর কণ্ঠস্বর এক শৈল্পিক ঘোর তৈরি করে।
যুবকের সংলাপের পর প্রৌঢ়ের দ্বিতীয় সংলাপ। তারপর যুবকের দ্বিতীয় এবং শেষ সংলাপ। যুবকের দ্বিতীয় সংলাপ শেষে যুবক মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর যুবতী এবং প্রৌঢ়ের শেষ দীর্ঘ সংলাপ। যুবকের কোনো উপস্থিতি নেই। কিন্তু সারা নাটক জুড়েই যেন যুবকের উপস্থিতি। শেষ সংলাপে রেশ রেখে যায়।
যুবক যাক, তবে কবরের গর্ভে যাক ভালোবাসা,
কাবিনের কাগজে ঠোঙা অন্ধ বুড়ি এখন বানাক।
প্রেম যদি প্রতারণা করে তবে শিল্প দেবে আমাকে আশ্রয়
আমার শিল্পের হাত কেড়ে নেয় আছে সাধ্য কার?
এ নারী আপনার।
প্রশ্নটি করে নারীকে প্রৌঢ়ের কাছে রেখে চলে যান। আঙ্গিক অভিনয়ে তার হাত হাতের আঙুল অসাধ্য স্বরলিপিতে খেলা করে। আঙুল চলে যায় চুলে। কখনো এমন ভঙ্গি করেন যেন ভাস্কর্য শিল্পির কাক্সিক্ষত ভঙ্গিমা তুলে ধরেন।
এই অভিনেতাকে আমরা দর্পণ নাটকে পাই প্রধান চরিত্র দর্পণ চরিত্রে।
হ্যামলেট নাটক রূপান্তরিত হয়ে দর্পণ। গল্প এবং কাহিনি একই রেখে চরিত্রগুলোকে লোকজ প্রেক্ষাপটে সাজানো। ডেনমার্কের শাসনকর্তা এখানে শিবগঞ্জের বড় সর্দার। রাজার ছোট ভাই ক্লডিয়াস এখানে নতুন সর্দার। রাজার সদ্য বিধবা স্ত্রী হ্যামলেটের মা এখানে বেগম। হ্যামলেটের পলোনিয়াস এখানে নায়েব হারুণ কাজী। ওফেলিয়া দর্পণ নাটকে কুলসুম। এরকম সব বদলি চরিত্র। আর যুবরাজ হ্যামলেট রূপান্তরে দর্পণ।
মূলনাটকের সাত সাতটি খুন এখানে ঘটার পরও নাটকটি খাপছাড়া হয়ে রইল। এলিজাবেথীয় খুন গ্রামীণ সরলতায় খাপ খায় না। তাছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণে প্রমিত উচ্চারণের সংলাপ ডেনমার্কের রাজপরিবারের দ্বন্দ্বের সাথে যায় না। খালেদ খান এখানে দর্পণ চরিত্রে অভিনয় করেন। নাটকটির কিছু সংলাপে লোকনাট্যের ভাষা সার্থকভাবে ব্যবহৃত হলেও সার্থকতাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কেননা কোথাও রূপান্তরিত দেশজ কাব্যময় ভাষা আবার কোথাও সরাসরি অনুবাদ। ফলে এলিজাবেথীয় যুগের শারীরিক মুভমেন্ট এবং শিবগঞ্জের গ্রামীণ-সরলতা একসাথে প্রকাশ হওয়া সম্ভব নয়। তারমধ্যে ব্লকিং এবং কম্পোজিশনে অভিনেতৃর মধ্যে যথাযথ সংযোগ স্থাপিত হয় না। ফলে অভিনয়ের সকল কৌশল রপ্ত থাকলেও কাঙ্ক্ষিত উৎকর্ষ-অভিনয় আমরা পাই না। সহঅভিনেতার সংলাপ যখন অর্থবোধক হয় না তখন প্রধান অভিনেতার যথাযথ সংলাপ প্রক্ষেপণও যথার্থ মনে হয় না।
রক্তকরবী নাটকে খালেদ খানকে সবচেয়ে দুর্বল অভিনয় করতে দেখা যায়। রক্তকরবী মঞ্চে তার শেষ অভিনয়। এ সময়টায় তিনি দীর্ঘ শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। সার্বক্ষণিক এক শারীরিক যন্ত্রণার ছাপ তার চোখে-মুখে ফুটে উঠত। এই যন্ত্রণা অভিনয়ে মানসিক-বাধাগ্রস্থতা সৃষ্টি করত। রক্তকরবীতে তিনি করতেন বিশু চরিত্র। দড়ি দিয়ে বেঁধে প্রহরীরা যখন বিশুকে নিয়ে যায় নন্দিনী তখন এগিয়ে যায়।
নন্দিনী কী দোষ করেছ যে এরা তোমাকে বেঁধে নিয়ে চলেছে।
বিশু এতদিন পরে আজ সত্যকথা বলেছিলুম।
নন্দিনী তাতে দোষ কী হয়েছে।
বিশু কিচ্ছু না।
নন্দিনী তবে এমন করে বাঁধলে কেন।
বিশু এতেই বা ক্ষতি কী হল। সত্যের মধ্যে মুক্তি পেয়েছি- এ বন্ধন
তারই সত্য সাক্ষী হয়ে রইল।
নন্দিনী ওরা তোমাকে পশুর মতো রাস্তা দিয়ে বেঁধে নিয়ে চলেছে, ওদের নিজেরই লজ্জা করছে না? ছি ছি, ওরাও তো মানুষ!
বিশু ভিতরে মস্ত একটা পশু রয়েছে যে- মানুষের অপমানে ওদের মাথা হেঁট হয় না, ভিতরকার জানোয়ারটার লেজ ফুলতে থাকে, দুলতে থাকে।
নন্দিনী আহা পাগল ভাই, ওরা কি তোমাকে মেরেছে। এ কিসের চিহ্ন তোমার গায়ে।
বিশু চাবুক মেরেছে, যে চাবুক দিয়ে ওরা কুকুর মারে। যে রশিতে এই চাবুক তৈরি সেই রশির সুতো দিয়েই ওদের গোঁসাইয়ের জপমালা তৈরি। যখন ঠাকুরের নাম জপ করে তখন সে কথা ওরা ভুলে যায়, কিন্তু ঠাকুর খবর রাখেন।
রক্তকরবী নাটকের এমন চমৎকার সংলাপ বিশুর বাচিক অভিনয়ে পাওয়া যায়। কিন্তু আঙ্গিক অভিনয়ে ক্লান্ত বিষণ্ন এবং অবসন্ন বলে মনে হয়।
আলোচিত অভিনেতৃগণ সকলেই মঞ্চ ছাড়াও টেলিভিশন, সিনেমায় অভিনয় করেছেন। টেলিভিশনের প্রচারে তাদের একধরনের জনপ্রিয়তা এবং পরিচিতি ছিল। ফিতায় বন্দি সে সব অভিনয় অন্য আলোচনার জন্য তুলে রাখা হল। এখানে শুধু মঞ্চ-অভিনয়ের স্ফুলিঙ্গটুকু ধরবার চেষ্টা রইল।
‘দেহপট সনে নট সকলই হারায়’
অপু শহীদ ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যকার, নির্দেশক