Full premium theme for CMS
ইশতেহার বদল
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
যে লোকটা হেরে যাচ্ছে
সে তো আর তার জ্ঞানকে এড়িয়ে যেতে পারে না।
ডুবে যাও
ভয় যদি পাও তো পাও। তবু ডুবে যাও।
একেবারে তলদেশে গিয়ে দেখবে
তোমার জ্ঞান
তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
-বার্টোল্ট ব্রেখট
এখন দুই হাজার বাইশ সালের মে মাস। দেখতে দেখতে গ্রুপ থিয়েটারের পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। বছর পঞ্চাশেকের দলিলাদি আমাদের হাতে রয়েছে। নব-চেতনা, নব-উদ্যম, নব-সৃষ্টি দিয়ে শুরু হয়েছিল। সে তুলনায় এখন মন্বন্তরের কাল চলছে বলা অত্যুক্তি হবে না। আশির দশকেও সর্বজনমান্য দু-চারজন শিল্পী-সংগঠক ছিলেন, যাদেরকে বিবেক এবং নৈতিকতার প্রতীক বলে চিহ্নিত করা যেত। স্বৈরাচারী-নীতিহীনতার বিরুদ্ধে যাদের কণ্ঠ থেকে ধিক্কার বেরুত। ক্রোধের আগুন জ্বলত। বর্তমান লেখকের মতো অতি-উৎসাহী অখ্যাত যুবকের দল সেই আগুনের বাহক ছিল।
অতঃপর বিশ্বে অনেক বৈষয়িক-ঘটনা ঘটে গেছে। জীবন থেকে অবসর সময় চলে গেছে। পয়সার হাতছানি বন্ধুদের বিচ্ছিন্ন করেছে। চাকরির প্রলোভন, ব্যবসার প্রসার শিল্পের (আর্ট) কণ্ঠরোধ করে রেখেছে। তবু কিছু নাট্যকর্মী সেই প্রাথমিক উৎসাহের কাছেই নতজানু হয়ে আছে। সেই শিল্পের নৈতিকতাকে উচ্চে তুলে ধরতে চাইছে। তাদের যথাসামর্থ্য নিয়ে নাট্যচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সামর্থ্য বা সক্ষমতা, নাট্যোন্নয়নের দানপত্রের অভাবে বিশেষ তারতম্য হতো বলে মনে হয় না। এভাবেই গত পঞ্চাশ বছরের নাট্যচর্চা চলছে।
অর্থনৈতিক-সূচক দেশের যে সমৃদ্ধি প্রদর্শন করে, শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় তার কানাকড়ি ছাপও নেই। শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করবে কে বা কারা? সরকার? নিজ দলের প্রচার-প্রসারের সুবিধার্থে কিছু শিল্পী-সংগঠককে এরা পোষে বটে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে শিল্পীর পোষণের চেয়ে শিল্পের পেষণই এখানে মুখ্য। ব্যাংক-বীমা আর্থিক-প্রতিষ্ঠানের খেয়াল খুশি জয় করতে পারলে নাটকের উদ্বোধন করে ফেলা যায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিয়মিত প্রদর্শনীর বড়ো পৃষ্ঠপোষক দর্শক। যদিও দর্শক-রুচির উপর খুব একটা ভরসা রাখা যায় না। কেননা, তাহারা বিপুল সংখ্যায় কী দেখিতে চাহে তাহা আমরা অল্পবিস্তর জানি এবং জানি না। কিসের সাবস্ক্রাইবার বেশি তাহা সার্চ করিলেই জনরুচি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাইবে। পাঁচরঙা প্যান্টির দিকে জনরুচি ঝুঁকে থাকবে এটাই ক্যাসিনো পুঁজিবাদের বাস্তবতা। এই বিপুল-সংখ্যক ভিড়ের জনরুচিতে সত্যিকারের শিল্পপ্রচেষ্টা কোণঠাসা হয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড় বেয়ে যাওয়াই যেন থিয়েটারওয়ালাদের ভবিতব্য।
থিয়েটার করতে হলে একরকম পরাক্রমশালী স্রোতের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত দাঁড় টানতে হয়। সেই দাঁড় পাঁজরের দাঁড়। কতিপয় নাট্যকর্মীর পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ শোনা যায় নাট্যমঞ্চে। তবু যারা আমরা তিরিশ পয়ত্রিশ বছর ধরে রক্তক্ষরণ মেনে নিয়েই দাঁড় বেয়ে চলেছি, তারা আজ আশাহত। ক্রমশ সব যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। অন্ধকারে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চারিদিকে কেমন একটা শ্বাসরোধকারী আবহাওয়া। এরকম পরিস্থিতিতে যা হয়, বার্টোল্ট ব্রেখট আর শম্ভু মিত্রের সঙ্গে পরামর্শ করা যায়।
পরিস্থিতিটা কী! যেখানে পঞ্চাশ বছরের সমৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হবে। সত্যিকারের অর্জনগুলো তুলে ধরা হবে। চল্লিশ বছরের ফেডারেশান পুরনো লক্ষ্য-অর্জনে সফল হয়ে নতুন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করবে। কত কত দল লাইফসাপোর্টে চলে গেছে। নতুন গড়ে ওঠা দল মুখ থুবড়ে পড়ছে। রেপাটরি দলগুলো চলতে পারছে না। ব্যবসায়িক বা কমার্শিয়াল থিয়েটার বাস্তবায়িত হলে ভালো কিছু হবে কিনা বলা না গেলেও, একথা বলা যায় যে নতুন কিছু হচ্ছে না। শুধু স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার উপর ভর করে আছে আমাদের থিয়েটার। এর একটা শক্ত ভিত চাই। অবকাঠামোগত ইট-কাঠের ভিতের কথা বলছি না। সংখ্যাবাচক হাস্যকর মূল্যায়ন থেকে সরে এসে গুণগত সামর্থ্য অর্জন করা চাই। থিয়েটার একটা আন্তর্জাতিক-শিল্প। একে আন্তর্জাতিক-মানদণ্ডেই দাঁড়াতে হবে। এখানে আঞ্চলিকতার স্থান নেই। এতসব উপেক্ষিত বিষয়াদি নিয়ে থিয়েটারের কর্ণধাররা ভাবিত হবেন এরকমটাই কাম্য। সাংগঠনিকভাবে এসব নিয়ে গবেষণা-আলোচনা ইত্যাদি কাজ হবে তা নয়, দেখা যাচ্ছে চল্লিশ বছরে একটা লক্ষ্যও ঠিক মতো অর্জন করতে পারে নি। থিয়েটারচর্চায় প্রতিকূল অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে একসময় ফেডারেশান গঠিত হয়। প্রতিটা দলের প্রতিনিধি এখানে প্রতিনিধিত্ব করে। সুনির্দিষ্ট গঠনতন্ত্রের আলোকেই এটা পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখলাম নেতা হওয়াটাই যেন একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। দুহাত দুপাশে পেখমের মতো মেলে বুক ফুলিয়ে মিটিংয়ে যাওয়া আর আসা। অতি উৎসাহে পরস্পরের জন্মদিন পালন করা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি তহবিল ভেঙে কেক আর ফুলের তোড়া উপহার দেয়া। ভোটের রাজনীতি ঠিক রাখতে বিভিন্ন জেলায় জেলায় নেতাগিরি ফলানো। এমনকি ইফতার পার্টি করায় যতটা উৎসাহ, তার কণামাত্র উৎসাহ নেই দলগুলোর সমস্যা-সমাধানে।
বিষয়সমূহ নিয়ে যে ঋষিবৃন্দ গূঢ় কথা বলতে পারতেন তাহারা আজ অলৌকিক ইস্টিমারে ভ্রমণরত আছেন। প্রথমত তারা উপেক্ষা করেন, নচেৎ এড়িয়ে যান। অর্থাৎ আমরা বুঝি, তারা মাথা ঘামান না। ফলত আমরা ডিঙ্গি নৌকার যাত্রীরা আগুন নিভে যেতে দেখলে বেদনাহত হই। আর্ত হয়ে উঠি। আকণ্ঠ চিৎকার করি। অপেক্ষমান না থেকে ঠুলি খোলার চেষ্টা করি। আমরা মানে যারা এখনও শিল্পের সঙ্গে ‘সহিতের’ অর্থাৎ কার সাথে শিল্পের সম্বন্ধ স্থাপন করতে হয় তা জানে। জানে রাষ্ট্রের বরাদ্দ থাকবে না। প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা পাবে না। সংবাদপত্র-মিডিয়া-স্পন্সর গুরুত্ব দিবে না। রাজনৈতিক-সমর্থন থাকবে না। অর্থনৈতিক-সামর্থ্য থাকবে না। সামাজিক-সমর্থন থাকবে না। আত্মীয়-স্বজনের উন্নাসিকতা দেখতে হবে। মধ্যবিত্তের পাতিকাক-চোখ-দিয়ে বন্ধু-পরিজন এমনভাবে তাকাবে, যেন একদল অর্বাচীন উজবুক বছরের পর বছর শ্রমঘণ্টা নষ্ট করে চলেছে। চোখের সামনে গোটা জীবন বাজি ধরে এরকম একদল মানুষ থিয়েটারকে লালন করে চলেছে। হাসতে হাসতে খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়াই যেন এদের ভবিতব্য।
এহেন নাট্যকর্মীরা মঞ্চের বাহিরে হঠাৎ কুরুক্ষেত্র অবলোকন করিল। এমত ভাববেন না যে, ভিতরে দ্বন্দ্বক্ষেত্র হলে গা-সহা হতো আর বাইরে বলেই অসহ্য হয়ে উঠেছে। কিছুই না পাওয়ার আশা নিয়েও দিনের পর দিন যে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছি সেখানেও যদি সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো না যায়, তবে এ চর্চা বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা যারা থিয়েটার করি তারা জানি, চোখের দেখাটাই সবটা নয়। কাগজ-কলমের হিসাবটাই ফলাফল নয়। নিজস্ব অনুভববেদ্যতা দিয়েই আমরা সত্য-মিথ্যা দেখতে পাই। কী দেখছি আমরা:
ক. শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক গং-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। এবং নির্ধারিত সময়কাল শেষ হওয়ার পরও পদ আঁকড়ে বসে থাকা।
খ. বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে চেক জালিয়াতি।
গ. বিদ্যমান সমস্যা সমাধান না করে রাতারাতি বহিষ্কার ঘোষণা।
ঘ. একই সংগঠনের সহকর্মীর প্রশ্নবিদ্ধ বহিষ্কারের পর শূন্য পদের দায়িত্ব প্রাপ্তিতে উল্লাস প্রকাশ।
ঙ. সরকারি তহবিল থেকে ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানাদি পালন।
চ. যত্রতত্র অপরিকল্পিত অনুষ্ঠানাদির আয়োজন। ইত্যাদি ইত্যাদি।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখি:
ক. সমস্ত শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও অর্ধযুগের বেশি সময় নিয়েও ফেডারেশান একটা সচল দলকে সদস্য পদ দিতে পারে না।
খ. কার্যক্রমহীন নিষ্ক্রিয় দলের প্রতিনিধি বহাল তবিয়তে হম্বিতম্বি করে যায়।
গ. হলবরাদ্দের জন্য ব্যক্তিগত অনুরোধ-উপরোধ করতে হয়।
ঘ. ব্যক্তির নামে দলকে চিহ্নিত করা হয়। যেমন, করিমের দল তো রহিমনের দল। এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন।
ঙ. কিছু সাঙ্গপাঙ্গ জোগাড় করে নিজেই নিজের নামের সাথে এক বা একাধিক উপাধি দিয়ে নেয়া।
চ. রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার অসমবণ্টন। ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফলত কী ঘটছে:
ক. অনিয়ন্ত্রিত সদস্য-তালিকা। যার সদস্য থাকার কথা নয়, ভোট-ভাতার হিস্যায় সে অংশ নিচ্ছে। এর জন্য একটা অস্বচ্ছ রাজনীতি বহাল রাখতে হচ্ছে। পূর্বসূরিদের অনুসরণ করেই এ খেলা চলছে।
খ. একটা মেয়াদ-উত্তীর্ণ কমিটি নিজেরাই নিজেদের মেয়াদ বৃদ্ধি করে নিচ্ছে।
গ. রাজনৈতিক-ক্ষমতার অপব্যবহার চলছে। জাতীয়-রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে বাক্প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছে।
ঘ. চাটুকারিতার সুফল হিসেবে কেউ কেউ বিদেশে বসেও জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছে।
ঙ. সুস্থির ব্যক্তিত্ব নেই। বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা নেই। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সংগঠক নেই। সব সংগঠনেরই এই অবস্থা। লেজুড়বৃত্তির ফল।
চ. (আর তাই) সংগঠনে এখন আর উত্তরসূরি বা গুরু-শিষ্য পরম্পরা তৈরি হয় না। তৈরি হয় বশংবদ।
সৃজনশীল-ব্যক্তিবর্গ এতসব অনাসৃষ্টি করে চলেছেন। সুধি নাট্যজনেরা দেখেও না দেখার ভান করছেন। নগর পুড়লে কি আর দেবালয় রক্ষা পায়? চুপ করে থাকলে তো আর দেবালয় পোড়া বন্ধ হবে না। সুতরাং দেবালয়ও পুড়ছে। কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। কী করতে হবেক:
ক. আঞ্চলিকতা-জাতীয়তা-দলীয়তার হীনম্মন্যতাবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
খ. নিষ্ক্রিয় এবং অস্তিত্ববিহীন সংগঠনের অন্তর্ভুক্তি বন্ধ করতে হবে। সক্রিয় দলকে প্রাধান্য দিতে হবে।
গ. তোষণের চেয়ে সক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ঘ. হলবরাদ্দ থেকে সরকারি অর্থ-বরাদ্দ, সর্বক্ষেত্রে বণ্টনে এমন নিয়ম থাকবে যাতে ব্যক্তির মন-মর্জির উপর নির্ভর না করতে হয়।
ঙ. পকেটকর্মী হয়ে আপ্তবাক্য না বলে স্বাধীনকর্মী হয়ে সত্যবাক্য উচ্চারণ করতে হবে।
চ. সর্বোপরি সৃজনশীল সমষ্টির দ্বারা কমিটি গঠন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে ‘টাকা’ একটা শর্তস্বীকৃত মাধ্যম। শিল্প-সৃষ্টিতে, বিশেষকরে থিয়েটারে টাকার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেই সাথে মনে রাখতে হবে, শিল্পে টাকার বড়াই করা শুধু অসুস্থতা নয়, অশ্লীলতাও বটে। থিয়েটার যারা করতে আসে তারা ব্যক্তিগত গাড়ি-বাড়ি দেখাতে আসে একথা নিশ্চয়ই কেউ বলবে না। তেমনি, থিয়েটার করে টাকা পয়সা হয় এ কথাও কেউ বলবে না। শুধু থিয়েটার কেন, এদেশে শুধু শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি করে ধনী হওয়া যায় একথাও নিশ্চয়ই কেউ বলবে না। তারমানে, শিল্পের সাথে টাকাকড়ি, তদুপরি দুর্নীতির সংশ্রব নেই। তা শিল্প-বহির্ভূত অতি লোভে তাঁতি নষ্টের আলাদা গল্প।
শুরুর দিকে যাহারা হাল ধরিয়া ছিলেন, তাহারা ছিলেন হয় নাট্যকার নয় অভিনেতা অথবা নির্দেশক নিদেনপক্ষে সংগঠক (সবগুণে গুণান্বিত ব্যক্তিও হাতেগোনা কেউ কেউ ছিলেন বটে)। তাদের কাজের প্রতি আমরা ছিলাম শ্রদ্ধাশীল। পূর্বজের অভিজ্ঞতার চেয়েও মেধা ও মনন ছিল সমৃদ্ধ এবং শিক্ষিত। যদিও ব্যক্তিগত পেশাকে অতি-মূল্যায়িত করতে গিয়ে শিল্পের দায় তারা এড়িয়ে যান। তাদের পেশাগত জীবনের উন্নতিই এই ইংগিতের সমর্থক। কিন্তু পরবর্তীসময়ে আমরা অবলোকন করলাম আত্মমর্যাদাহীন কিছু মধ্যমেধার মানুষের। যাদের সৃজনশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ। নিজ দলের কাজ বা সংগঠনের সক্রিয়তায় আগ্রহ কম। যারা কাজের চেয়ে পুরস্কৃত হতে বেশি লালায়িত। সভা-সেমিনারে মাথাটা বাড়িয়ে রাখে ছবি তোলার জন্য। যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতাবান-ব্যক্তির সংস্পর্শে তাদের থাকা চাই-ই চাই। এরকম অর্বাচীন-ব্যক্তিত্ব থেকে নেতৃত্ব আশা করা যায় না।
মূলধারারচর্চা এসব ভোগী-স্বার্থপর-ব্যক্তি দিয়ে হয় না। শুধু থিয়েটার নয়, ক্ষমতার-পাণ্ডিত্যে কোনো শিল্পই সৃষ্টি হয় না। ক্ষমতার-শিল্প চকচক করে, চোখ ঝলসে দেয়, বেশি সংস্পর্শে অন্ধ কর দেয়। আর মনে রাখা দরকার যে, কোনো রাজনৈতিক-সংগঠন তাদের সাংস্কৃতিক-অঙ্গসংগঠনের দ্বারা নিজ নিজ ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে পারে। আর যদি এশিয়ার মতো দেশে কোনো দল ক্ষমতায় থাকে, তবে তাদের ইশতেহার পালনের জন্য আমলা থেকে খুদে কেরাণি, সবাই তো সদা-প্রস্তুত আছে। ক্ষমতা চাইলে সমাজকে কমরেড হাজি উপহার দিতে পারে এরকম দৃষ্টান্তও আমাদের নিকট অতীতে বিদ্যমান রয়েছে (এখনও তারা বিদ্যমান)। সর্বোপরি প্রতিটা রাজনৈতিক দলের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক শাখা রয়েছে। তাদের বিপ্লবী ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্য তাদের লড়াকু সৈনিকও রয়েছে। তথাপি, ব্যক্তির স্বাধীন-শিল্পচর্চায় প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না বটে, তবে কোনো কাক যদি ভাতের ভাগ না চায় বা রুটি খেতে চায় বা উপোস থাকতে চায়, সেই ব্যবস্থাটাও থাকা দরকার।
ভিড়ের লোক দিয়ে সৃজনশীলতা হয় না। যারা সত্যিকারের কাজ করতে পারে, তারা ভিড় এড়িয়ে চলে। তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের স্পেস দিতে হবে। যারা হালকাভাবে সংস্কৃতির ফায়দা লুটতে চায়, তারা অহংবোধসম্পন্ন-ব্যক্তিত্বকে ভিড়তে দিতে চায় না। আর অন্যদিকে, প্রচলিত বিভাজন কর্তাব্যক্তিদের ভাগ করে রেখেছে। কেননা, আকবর বাদশা তো একবার বাদশা হয়ে গেছেন। আর সম্রাট আওরঙ্গজেব তো সম্রাটই আছেন। তাদের আর এর বেশি কিছু হওয়ার নেই। ম্লেচ্ছ শুদ্ররা লাঠি মারামারি করুক, বেশি দরকার হলে সামন্তদের বলে দেব চোখ রাঙিয়ে দেবে।
থিয়েটার সাবালকদের কাজ। এর একটা বিশ্ব-রাজনীতি রয়েছে, একটা অভ্যন্তরীণ-রাজনীতি রয়েছে। থিয়েটারের-রাজনীতি আর রাজনীতির-থিয়েটারের পরিপ্রেক্ষিত নির্ণয় করতে হবে। চলমান-রাজনীতির খপ্পর থেকে মুক্তির জন্য ক্ষমতাকেন্দ্র বা ভরকেন্দ্র চিহ্নিত করে সেখানটায় আঘাত করতে হবে। নচেৎ, প্রান্তিকবৃত্তেই ঘোরাঘুরি করতে হবে, ভরকেন্দ্র অটুট থাকবে।
যদি আমরা ভালো কিছু করতে চাই, গুণীদের দায়িত্ব দিতে হবে। যেভাবে শুরুর দিকে ‘নির্বাচিত’ নয় ‘মনোনীত’ করা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, যোগ্যদের খুঁজে বের করতে হয়। আরো মনে রাখতে হবে, অযোগ্যরা অহেতুক ভিড় করে থাকে। আগ্রহ থাকা খারাপ কিছু নয়। নেতা হতে চাওয়ার মধ্যেও নিশ্চয়ই দোষের কিছু নেই। তবে স্মরণ রাখা দরকার, সক্ষমতা একটা বড়ো বিষয়। বিশেষকরে সংকটকালীন সময়ে।
ব্যক্তি যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক
সমষ্টি যদি ব্যক্তিত্বরহিত
তবে শিথিল সমাজকে ভাঙো না কেন?
-ভূপেন হাজারিকা
আমাদের থিয়েটার খুবই একটা ছোট জায়গা। শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে সবার সঙ্গে সবার দেখা হয়। আমাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এমন নয় যে, প্রত্যেকে প্রত্যেকের শত্রু, প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিপক্ষে ছুরি শানায়। আমাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া রয়েছে। এর আদান-প্রদান বাড়াতে হবে। ফেডারেশান থাকবে কী থাকবে না। নির্বাচন-পদ্ধতি থাকবে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি সবকিছুই নির্ভর করে আমরা কোন ধরনের থিয়েটার দেখতে চাই তার উপর।
তাহলে কী হবে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নসমূহ:
ক. থিয়েটার দিয়ে কি শুধু নেতা হতে চাই? নাকি এর গন্তব্য বহুদূর?
খ. ব্যক্তির নয় থিয়েটারের ক্ষমতায়ন চাই কিনা?
গ. জনগণের কাছে থিয়েটার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠুক তা চাই কিনা?
ঘ. রাষ্ট্রের কাছে দয়া-ভিক্ষা না করে রাষ্ট্রকে বাধ্য করা যায় কিনা, শর্তহীন অনুদান আদায় করা যায় কিনা?
ঙ. থিয়েটারের আন্তর্জাতিকতা মেনে নিয়েই এর জাতীয় পরিচয় গড়ে তুলতে চাই কিনা?
এসব অনেক সুদূর-ভাবনা। আপাতত সাধারণ কিছু চাওয়া পাওয়ার বাস্তবায়ন চাই:
১. মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বাতিল ।
২. মনোনীত ব্যক্তিবর্গের কমিটি।
৩. গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন।
৪. সেট রাখার জায়গা ।
৫. মহড়া করার জায়গা।
৬. শিল্পীদের জন্য ভর্তুকির ক্যান্টিন (দেশের সব শিল্পকলা একাডেমি ক্যাম্পাসে)।
৭. হলবরাদ্দে স্বচ্ছতা।
৮. নিষ্ক্রিয়-দলের ছাঁটাই ও সক্রিয়-দলের অন্তর্ভুক্তি।
৯. অনলাইন-কার্যক্রমের সক্ষমতা।
দলগুলো দলের কাজ করুক। দল থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি-সমষ্টি দলগুলো যাতে নির্বিঘ্নে নিজ নিজ চর্চা করতে পারে, সেই সহযোগিতা করুক। প্রশিক্ষণ, উৎসব, প্রকাশনা প্রভৃতির মধ্যদিয়ে থিয়েটার নিজেকে তুলে ধরুক। স্থান-কালের সাথে লক্ষ্য কিংবা উদ্দেশ্য পাল্টে যাবে, এটাই বিবতর্নের ধারা। এই সংগ্রামে অগ্রগামী-ব্যক্তি সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকে। প্রয়োজনে আন্দোলন করতে বাধ্য হয়। পুরনো কথা বাতিল করে যে নতুন কথা আসে তাকেই বলে আন্দোলন। পুরনো ইশতেহার বাতিল করে উঠে আসে নতুন ইশতেহার।
এই অপরিশোধিত-কথন বাংলাদেশের থিয়েটারের প্রকৃত-সক্ষমতার জন্য অপর ইশতেহারের মুখাপেক্ষি হয়ে রইল।
অপু শহীদ ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যকার, নির্দেশক