Full premium theme for CMS
থিয়েটারচর্চার সামনের দিন : কিছু প্রস্তাবনা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার এবং ‘থিয়েটারওয়ালা’কে ধন্যবাদ, থিয়েটারচর্চার এমন এক সময়ে এ বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ দেবার জন্য। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান নিয়ে আমার ব্যক্তিগতভাবে কিছু বলার নেই। তবে, থিয়েটারের একজন মানুষ হিসেবে, কী ছিল, কী হতে পারত, আগামীতে আরো কী করা যায় থিয়েটারচর্চাকে আরো গতিশীল করার জন্য, এরকম কিছু চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার অধিকার অবশ্যই রাখি।
প্রথমেই হাসান শাহরিয়ারের প্রবন্ধের কিছু অংশ নিয়ে আমার মতামত প্রকাশের চেষ্টা করছি।
থিয়েটার বা মঞ্চনাটকের একটা আলাদা শক্তি আছে, যা সবকালেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে একটা ভীতির মধ্যে রেখেছে। সেই ইতিহাস আমরা সকলেই জানি। থিয়েটার সারাবিশ্বজুড়েই একটা শক্তিশালী মাধ্যম। স্বাধীনতার আগে থেকেই থিয়েটারচর্চার ইতিহাস আমাদের আছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী থিয়েটার আমাদের সমাজে চমৎকার একটা স্থান করে নিয়েছিল। থিয়েটার/মঞ্চনাটককে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে রাষ্ট্র দ্বারা, প্রশাসন দ্বারা এবং আরো অনেকের দ্বারা। কিন্তু থিয়েটার/মঞ্চনাটকের আবেদন বা তার দেশাত্মবোধের শৈল্পিক-প্রকাশকে রুখতে পারে নি কেউ। এটাই থিয়েটারের বড় শক্তি, কারণ, থিয়েটার সরাসরি দর্শকের মস্তিষ্কে চিন্তার বীজ বোনে, যা কোনো আইন দিয়ে আটকানো সম্ভব না।
যাইহোক, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান তার জন্মের পর থিয়েটারের প্রচার ও প্রসারে যে ভূমিকা রেখেছে তা অবশ্যই মানতে হবে, সেজন্য ফেডারেশানকে সাধুবাদ। তবে কালের পরিক্রমায় ফেডারেশান এখন যে জায়গায় আছে, তা থিয়েটারের উন্নতির বা প্রসারের জন্য মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। যে সংগঠনের দেশজুড়ে এতবড় একটা নেটওয়ার্ক আছে, তার তো কাজের জায়গা অনেক বিশাল হওয়া উচিত।
ফেডারেশানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোর বেশিরভাগই পূরণ হয় নি। স্থায়ী নাট্যমঞ্চ তো হয়ই নি, উল্টো অনেক মঞ্চ উঠে গেছে। মহানগর নাট্যমঞ্চ বা জহির রায়হান মঞ্চ আর ব্যবহার হয় না। থিয়েটার ইনস্টিটিউটের কোনো নামগন্ধ নেই। থিয়েটারকে পেশাদার-অবস্থানে নেয়ার ব্যাপারে ফেডারেশানের অনাগ্রহ দৃশ্যমান। এসব বিবেচনায় হাসান শাহরিয়ারের কথার সাথে আমি একমত যে, লক্ষ্যগুলোর কিছুটা পূরণ হলেও দেশের থিয়েটারচর্চার অবস্থানটা আরো শক্তিশালী হতো। তার বদলে নির্বাচন, নেতা-সৃষ্টি এবং হলবরাদ্দ কার্যক্রমের বাইরে দু-একটা কর্মশালার আয়োজন, এটাই ফেডারেশানের লক্ষ্য হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র হলবরাদ্দ বিষয়ে ফেডারেশানের সাথে দলগুলোকে যেভাবে অনুরোধ, উপরোধ করতে হয়, তা কখনো কখনো বাইরের আড্ডার আলোচনা/সমালোচনার বিষয় হয়ে পড়ে।
ফেডারেশানের কল্যাণে হলভাড়ায় ভর্তুকি-প্রাপ্তি অবশ্যই একটা বিশাল ঘটনা। ফেডারেশানের এটা বড় অর্জন। ধন্যবাদ অবশ্যই দিতে হয়। কিন্তু এই একই ফেডারেশান যখন তার বেশিরভাগ লক্ষ অর্জনে ব্যর্থ হয়, তখন যারা সত্যিই থিয়েটারটা করতে চায়, এর ভেতরেই থাকতে চায়, তারা একটু হতাশ হবেই, ক্ষোভ প্রকাশ করবেই।
আমি এসব সমালোচনার মধ্যে আর না থাকি। খুঁত ধরতে থাকলে থামা যাবে না। তার পরিবর্তে আমার কিছু প্রস্তাবনা আছে, যেগুলো মনে হয়েছে ব্যক্তিগত-উদ্যোগের থেকেও দলগত-উদ্যোগ নিলে নাট্যচর্চার সুদিন আবার ফেরানো সম্ভব। যারা পড়ছেন, তারা বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
প্রথমেই বলে রাখি, একক-চেষ্টার থেকে দলগত-চেষ্টার শক্তি বেশি থাকে। ফেডারেশানের অন্তর্গত একাধিক দল আছে প্রতিটা জেলায়। আর এই দলগুলোর প্রধান-ব্যক্তিদের সামাজিক-অবস্থান, প্রশাসনের সাথে বোঝাপড়া যথেষ্ট ভালো। এসব বিবেচনায় ফেডারেশান নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নিতে পারে:
পদক্ষেপ-১:
আমাদের প্রাইমারি এবং হাইস্কুলগুলো থেকে সাংস্কৃতিক-কর্মকাণ্ড একদমই উঠে গেছে। আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখব, গত কয়েকবছরে যে সব ছেলে-মেয়ে নেশা বা জঙ্গি বা মারাত্মক অপরাধমূলক-কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে, বা মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের বয়স ও শিক্ষাবর্ষ মেলালে দেখা যায়, যে সময়টা থেকে বিদ্যালয় থেকে সাংস্কৃতিক-কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়েছে এরা সেই সময়ের শিক্ষার্থী। সাংস্কৃতিক-কর্মকাণ্ড মানুষকে কিছু দায়বদ্ধতা শেখায়, বিবেকবান করে গড়ে তোলে (এর বিপরীত মানুষও এই অঙ্গনে আছে, যা থাকবেই, তবে পরিমাণে কম)। ফেডারেশানের দেশব্যাপী এই চেইন ব্যবহার করে, স্কুল-কলেজে বাধ্যতামূলক সাংস্কৃতিক-কর্মকাণ্ড যুক্ত করে, ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধ করে, দেশের সংস্কৃতিকে সুসংহত করার পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করি। এভাবে শেকড় থেকে শুরু না করলে কিছুদিন পর থিয়েটারচর্চার জন্য আমরা কাউকে পাব না। তখন পরবর্তী-জেনারেশন আমাদেরকেই দোষারোপ করবে।
পদক্ষেপ-২:
আমরা সকলেই জানি, জেলাশহরগুলোতে থিয়েটার দলগুলো কত কষ্ট করে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ফেডারেশান প্রতিটা জেলার প্রতিনিধিদের দায়িত্ব দিতে পারে এভাবে যে, প্রতিটা দলকে এক জায়গায় এনে তাদের একটা লংটার্ম কর্মশালার মাধ্যমে থিয়েটারের জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রগুলোতে (অভিনয়, নাট্যরচনা, ডিজাইন ইত্যাদি) দক্ষ-জনবল তৈরি করা। একটু খেয়াল করে দেখুন, আমাদের হাতেগোনা কয়েকজন নাট্যকার-নির্দেশক ও ডিজাইনার ছাড়া নতুন কেউ সেভাবে তৈরি হয় নি। ফেডারেশানের পক্ষেই সম্ভব খুব সহজেই এই কার্যক্রম পরিচালনা করা। এমনকি কোন জেলার কতটুকু অগ্রগতি হলো, সেটার মাপকাঠি তৈরি করে একটা প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়া। যাতে সবাই আগ্রহী হয়ে ওঠে।
পদক্ষেপ-৩:
সরকারের সাথে ফেডারেশানের অনেকেরই যোগাযোগ খুবই ভালো। সেটা যে সরকারই হোক, কারো না কারো যোগাযোগ আছেই। ফেডারেশানের উচিত সরকারকে বুঝিয়ে প্রতিটা এলাকায় সংস্কৃতিচর্চার-স্থান নির্দিষ্ট করতে বাধ্য করা। যা এলাকাভিত্তিক সরকারি-প্রতিনিধি এবং ফেডারেশানের প্রতিনিধির সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকবে। তাহলে এলাকাগুলোয় আবারও সাংস্কৃতিক-কর্মকাণ্ড পালে হাওয়া পাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
পদক্ষেপ-৪:
থিয়েটার ইনস্টিটিউট:
এটা ফেডারেশানের লক্ষ্য ছিল, যা কিনা এখনও অধরা। ফেডারেশান ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’-এর কাছ থেকেও শিক্ষা নিয়ে এ বিষয়ে ভাবতে পারত। কিন্তু হলবরাদ্দ আর নির্বাচন নিয়ে ভাবতে গিয়ে হয়ত সময় করে উঠতে পারে নি!
পদক্ষেপ-৫:
থিয়েটারে পেশাদারিত্ব:
পেশাদারিত্ব মানে এই নয় যে, আমি শো করব আর টাকা পাব। পেশাদারিত্ব মানে আপনার কাজটাও পেশাদারি হতে হবে। থিয়েটারের মান-উন্নয়ন করার জন্যই পেশাদার হতে হবে। আমাদের অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার ডিপার্টমেন্ট আছে, কিন্তু আমরা কেউ কি বলতে পারব, তারা নাট্যকলা বিষয়ে পড়ে, কর্মক্ষেত্রে কীভাবে প্রবেশ করবে!!! সেই কর্মক্ষেত্র কি আমরা তৈরি করেছি??? তাহলে এই মানুষগুলোকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করব? ফেডারেশানের যেহেতু একটা বৃহত্তর জায়গা আছে, তারা চাইলেই এই একাডেমিশিয়ানদের সারাদেশে নিয়মিত কাজে লাগিয়ে দেশব্যাপী থিয়েটারের উন্নতিসাধন করতে পারত, পাশাপাশি নাটকলার ছাত্রছাত্রীদের কাজের জায়গাও তৈরি করতে পারত। এবং তাদের অনেকেরই সাময়িক আয়ের-সংস্থান করতে পারত। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে নাট্যকলার বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই থাকছে না। তারা পেশা হিসেবে অন্যকিছু বেছে নিচ্ছে। এটা শেষপর্যন্ত থিয়েটারেরই পরাজয়। আকাশ-সমান স্বপ্ন দেখিয়ে সিঁড়ির একটা ধাপও দেবো না, তা কী করে হয়!
আপাতত এ-কটা প্রস্তাবনাই আমার মনে হয়েছে জরুরি। এই করোনাকালে আমাদের দুর্বলতা পরিষ্কার দেখা গেছে। সবথেকে শক্তিশালী-মাধ্যম আজ সবথেকে দুস্থ প্রমাণিত। তাই বলব, সময় থাকতে পরবর্তী-পদক্ষেপ ভাবা উচিত, তা না হলে আগামীতে থিয়েটার করার মতো কাউকে পাওয়া যাবে না। যেহেতু ফেডারেশান হলবরাদ্দের দায়িত্ব নিয়েছে, থিয়েটার-আন্দোলনের একটা লক্ষ্য তাদের আছে, যেহেতু তারা পুরো বাংলাদেশের থিয়েটার-এর প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত, তাই থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখতে তাদেরই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা থিয়েটারকে আরো সামনে দেখতে চাই। আন্তর্জাতিক-অঙ্গনে দেখতে চাই। থিয়েটারে পেশাদারিত্ব দেখতে চাই।
ধন্যবাদ থিয়েটারওয়ালা-সংশ্লিষ্ট সকলকে, ভাবনা-প্রকাশের এরকম একটা সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
থিয়েটারের জয় হোক । সত্যের জয় হোক।
এ কে আজাদ সেতু ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): অভিনেতা। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি)