Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান : ভবিতব্যের ভূত নাকি অদ্ভুত

Written by মাহবুব আলম.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

যেকোনো সংগঠনের যখন বয়স বাড়ে তখন তার শেকড় বাড়তে থাকে। মাটি আঁকড়ে টিকে থাকে আকাশের দিকে মুখ করে নিজ যোগ্যতাবলে। কিন্তু বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান এমনি এক সংগঠন যা টিকে আছে হাওয়া বাতাসের জোরে। ‘হাওয়া বাতাস’ শব্দ ব্যবহারের পেছনে অবশ্য কারণ আছে। তা হলো প্রাবন্ধিক হাসান শাহরিয়ারের ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’ প্রবন্ধ। প্রাবন্ধিক তার প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদে ‘থোড়াই জ্ঞান’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন বলেই ‘হাওয়া বাতাসের জোরে’ ব্যবহার করছি।

মূলত একরকম স্বেচ্ছাচারিতার মধ্য দিয়েই বিগত প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের কার্যক্রম চলছে (যদিও গঠনমূলক বা সংগঠনগুলোর কোনো-রকম উন্নয়নমূলক-কার্যক্রমে তাদের সহযোগিতা করতে দেখা যায় নি)। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের বিগত দুটি কমিটি এবং বর্তমান (বর্ধিত সময়ের) কমিটি নাটকের দলগুলোকে কোনো-রকম প্রণোদনা বা উৎসাহমূলক কোনো আয়োজন তো করেই নি, উপরন্তু বেশকিছু সংগঠনকে ফেডারেশানের সদস্য-পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বা স্থগিত করে তাদের কার্যক্রমকে স্তিমিত করেছে। যা প্রতিহিংসার উদাহরণ বলেই মনে হয়। ফেডারেশান দলগুলোকে বহিষ্কার বা সদস্য-পদ স্থগিত না করে তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করে সহযোগিতার মাধ্যমে নিয়মিত নাট্যকার্যক্রমে ফিরিয়ে আনতে পারত। কিন্তু ফেডারেশানের নেতৃবৃন্দ ঐ পথে না গিয়ে দলগুলোর প্রতি এক ধরনের প্রহসনমূলক আচরণ করেছে। এতে করে সংগঠনের কলেবর সংকুচিত হয়েছে বৈ বাড়ে নি।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান প্রকাশিত স্যুভেনিরের তথ্য মতে দেখা যায়, সারাদেশে ১৯টি জেলায় ফেডারেশানভুক্ত কোনো নাটকের দল নেই। তাহলে কি সেই সব জেলায় নাট্যচর্চা হয় না? তারা কি নাট্যচর্চা থেকে পিছিয়ে আছে? নাকি তারা বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানকে ‘থোড়াই জ্ঞান’ করে? যদি বিষয়টি এমন হয় যে, যেসকল দলগুলো ফেডারেশানের সাথে যুক্ত হয় নি বা হতে আগ্রহী নয় অথবা থোড়াই জ্ঞান করে তাহলে ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ প্রবাদটি ফেডারেশানের নেতৃবৃন্দের সাথে বেশ মানানসই মনে করি। আবার ভিন্নভাবে ভাবলে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের অপারগতা, হীনম্মন্যতা এবং সাংগঠনিক-অদক্ষতা স্পষ্ট হয়ে যায়। ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ ব্যাপারটি কিন্তু ইদানিংকালে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যখন কিনা আমরা দেখছি ফেডারেশানের একটি পক্ষ (সাংগঠনিক সংবিধান মেনে অথবা না মেনে) এক রকম জোর করেই ফেডারেশানের বর্তমান কমিটির দুইজন সম্পাদককে অব্যাহতি দিলেন। তাদের মধ্যে অবশ্য একজন এখনও লড়াই করেই যাচ্ছেন নিজেকে স্বচ্ছ প্রমাণ করতে। একটি পক্ষ তাকে সম্পাদক মানছেন আবার অন্য পক্ষ মানছেন না। আবার বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে করোনাকালীন সাহায্যের জন্য অনুদান নিয়ে এসে আত্মসাতেরও অভিযোগ উঠেছে। সেটি নিয়েও কেউ কেউ কথা বলছেন। তবে বেশিরভাগই চুপচাপ।  

আসলে বর্তমান পরিস্থিতি হলো, কে কাকে মানল বা না-মানল তাতে কারো কিছু যায় আসে না বা কেউ কাউকে থোড়াই জ্ঞান করে। আবার ফেডারেশানের চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন সম্পাদক আগামী কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে উপলক্ষ্য করে বিভাগীয় পর্যায়ে সম্মেলন করে বেড়াচ্ছেন। সেখানেও কেউ তাদের মানল কী মানল না তাতে কারো কিছু যায় আসে না। অর্থাৎ, যারা নেহায়েৎ নাটক থিয়েটারটাই করে যেতে চায় নীরবে, যারা এসব ফেডারেশান-টেডারেশান নিয়ে ভাবেই না, তাদের কথাও যে নেতৃবৃন্দের মাথায় থাকা দরকার, সেটি ফেডারেশানের নেতৃবৃন্দের মাথায় নেই। তাহলে কি বিষয়টি আসলে ওই-রকমই দাঁড়াল না, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল? যে যাই বলুক বা ভাবুক বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান তাদের মতো করেই কাজ করে যাবে। তাতে কোনো সংগঠন বা নাট্যকর্মীর উপকার হলে হবে অথবা অপকার হলেও হবে। কেউ তাদের কথা শুনলেই কী আর না শুনলেই-বা কী। এখানে বলে রাখতে চাই যে, ২০১৪ সালের রিপোর্ট-অনুযায়ী যেহেতু বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১৯ জেলায় বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানভুক্ত দল নেই; তার মানে দাঁড়ায়, ফেডারেশান সেই সব জেলার নাট্যদলগুলোকে তাদের আদর্শের দিকে নিয়ে আসতে পুরোপুরি ব্যর্থ। মানে ফেডারেশান বিগত এক দশক বা তার বেশি-সময়-ধরে সাংগঠনিক-কার্যক্রমে অসফল। জেলার দলগুলো ফেডারেশানের মধ্যে এমন কিছু দেখে নি যাতে তারা ফেডারেশানভুক্ত হতে আগ্রহী হয়। অর্থাৎ, ফেডারেশান যে শুধু ‘হাওয়া বাতাসের জোরে’ চলছে একথা বলা নেহাত অনুচিত হয় নি বলেই মনে করতে পারি।

মূলত থিয়েটার বা নাটকের কল্যাণে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান বর্তমানে ক্রোধ, ক্ষোভ, ক্ষমতা,  লোভ-লালসা (বর্তমান কমিটির অব্যাহতি পাওয়া দুইজন যদি অপরাধী প্রমাণিত হন এবং চেয়ারম্যানের অনুদান-আত্মসাতের বিষয়টিও যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে অর্থের লোভও আছে বলা-ই যায়), হিংসা, প্রতিহিংসার জলসাঘরে রূপান্তরিত হয়েছে। এমন অবস্থার-প্রেক্ষিতে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা সেটি ভাববার বিষয়।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান যে পথচলা শুরু করেছে তার বয়স তো একেবারেই কম হলো না। উপরে যেসব অসুবিধা, প্রতিবন্ধকতা, সংকীর্ণতার কথা বলা হলো, সেগুলোর আলোকে কি বলা যায় যে, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের আর কোনো দরকার নেই? যে সংগঠন থিয়েটার বা নাট্যকর্মীর কল্যাণে কাজ করে না, সে সংগঠন দিয়ে কী হবে? সর্বোপরি যে সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপর আর্থিক-অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, সেই সংগঠন কি আদৌ ভালো কিছু বয়ে আনতে পারবে?

সর্বোপরি, যেকোনো সংঘবদ্ধতা একটি বিরাট শক্তি হিসেবে কাজ করে। সেটি কাজ করে মূলত বিভিন্ন অনিয়ম থেকে মুক্ত হতে ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একাট্টা হওয়ার জন্য। যেমনটি তারা একত্রিত হয়েছিল এবং নাট্যদলগুলোকে একত্রিত করতে পেরেছিল স্বৈরাচারী এরশাদ-সরকারের পতনের জন্য। তবে এখনকার নেতৃবৃন্দ আদর্শিক-দ্বন্দ্বে ভুগছে কিনা সেটিও বিবেচ্য। কারণ, এমন নৈতিক-স্খলন আগের কোনো কমিটির নেতৃবৃন্দের মধ্যে আমরা দেখতে পাই নি।

সংঘবদ্ধ-শক্তির প্রয়োজন আছে বলেই আমি মনে করি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের টিকে থাকা দরকার। তবে এই সংগঠনের কিছু সাংগঠনিক-প্রক্রিয়া বা নীতি অথবা সংবিধানের কিছু পরিবর্তন করা আবশ্যিক মনে করি। তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘একক ক্ষমতা’র ব্যবহার। একক ক্ষমতা সব সময়ই একনায়কতন্ত্রের জন্ম দেয়। যে একনায়কতান্ত্রিক-মানসিকতা আমরা লক্ষ করছি প্রায় এক দশক হলো। ফেডারেশানের সর্বোচ্চ-পর্যায়ের ব্যক্তি (চেয়ারম্যান) একই সাথে থিয়েটার-সংশ্লিষ্ট একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হলে ফেডারেশানের কতটা বেহাল-দশা হয়, সেটি আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। একই সাথে একটি দলের একজন প্রতিনিধি ভোটাধিকারপ্রাপ্ত হওয়ায় দলগুলোয়ও তাদের আধিপত্য লক্ষণীয়। তাই, একই ব্যক্তি বারবার ভোটার না হয়ে এবং একটি দল থেকে একের অধিক (দুই/তিন) ভোটার ফেডারেশানে যুক্ত হলে, দল ও ফেডারেশানে একক দৌরাত্ম্য কমবে বলে আশা রাখি। সুতরাং ফেডারেশানের নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিও লক্ষ রাখা উচিত বলে মনে করি।

প্রাবন্ধিক হাসান শাহারিয়ার তার প্রবন্ধে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার যে সুবর্ণ-অতীত উল্লেখ করেছেন, সেটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তথ্যবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার শিরোনামের সাথে খুব একটা মানানসই বলে মনে করি না। সেটি অন্য কোনো লেখার ক্ষেত্রে সংযুক্ত হতে পারে। এই লেখায় সেগুলো প্রাসঙ্গিক মনে করছি না।

যাইহোক, এবার খানিকটা সামনে এগিয়ে যাওয়া দরকার। তো, পূর্বসুরিরা সকল প্রস্তুতির পর ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ নাম দিয়ে প্রথম সম্মেলন করলেন ১৯৮১ সালের ২৩ আগস্ট। এখানটায় হাসান শাহরিয়ারের প্রবন্ধ থেকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের গঠনতন্ত্র তুলে দেয়ার প্রয়োজনবোধ করছি আলোচনা এগিয়ে নেয়ার সুবিধার্থে।

‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র গঠনতন্ত্রে ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আমরা দেখতে পাই:
১.    গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামকে সংহত করা।
২.    নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্নসময় বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
৩.    সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪.    নাটককে ব্যাপক সামাজিক-ক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা।
৫.    নিয়মিত নাট্যবিষয়ক প্রকাশনা বের করা।
৬.    নাট্যবিষয়ক সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা।
৭.    বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা
৮.    জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব আয়োজন করা।
৯.    দেশে একটি থিয়েটার ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা।
১০.   মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে নাটককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
১১.   পেশাদারি থিয়েটারের ক্ষেত্র-প্রস্তুত করা।

ফেডারেশানের গঠনতন্ত্রের ১১টির মধ্যে প্রথমটি মূলত বিভ্রান্তিমূলক একটি কথা। গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামকে সংহত রাখার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আদতে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের আদর্শ কী? কোথায় তার উল্লেখ আছে সেটিও জানার বা জানানোর দরকার নেই কী?

যাইহোক, গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শ কী? তা নিয়ে কারো মাথা না ঘামালেও চলবে হয়ত। তবে ধরেই নিচ্ছি যে, আমাদেরকে নাটক করতে হবে, মানে নাট্যচর্চাই আমাদের মূললক্ষ্য আর তা দেশ-বিরোধী না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সেটিও হতে পারে। তবে একটি সরকারের আমলে তাদের আমলনামা নিয়ে যে ধরনের নাটক হয়, তা সরকার পতনের পরপরই অন্য সরকারের আমলে দেশ-বিরোধী নাটক হতে পারে। সেটিও কিন্তু ভাবনায় থাকা দরকার। তার মানে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শ লিখিতরূপে থাকা দরকার।

উপরের ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে প্রথম ৬টির ক্ষেত্রেই যে ফেডারেশান পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশেই ব্যর্থ, সেকথা বলা-ই যায়। তবে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব আয়োজন করার ক্ষেত্রে ফেডারেশান বা ফেডারেশানের নেতৃবৃন্দের বেশ আগ্রহ লক্ষ করা গেছে। এসব আয়োজনে তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কেননা, এমন আয়োজন করলে দেশ ও দশকে তাদের কাজ-কর্ম দেখানো যায়। এতটুকুও না করলে যে কেউ তো যেকোনো সময় বলেই বসতে পারে, ফেডারেশান কী কাজ করল? এমন সংগঠন না থাকলেই ভালো। তাই হয়ত তারা এমন পিঠ-বাঁচানো আয়োজন করে থাকে। বিশেষ করে নাট্যোৎসব আয়োজনের মধ্যদিয়ে নিজেদের প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা অথবা রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা প্রকাশ করতে সুবিধা হয়। তবে ভোট-প্রীতির বিষয়টি এইসব আয়োজনের মধ্যে বেশ কাজে দেয় এবং নজরে আসে।  

লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ৯ ও ১০ নিয়েও আসলে তেমন কিছু বলার নেই। এই দুটি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ফেডারেশান পুরোপুরি ব্যর্থ। স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তকে একটি করে যে নাটক পড়ানো হয়, তা সরকারের শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন ব্যতীত আর কিছুই নয়। উপরন্তু, দুই দশক আগেও স্কুল-কলেজে যেসব সাংস্কৃতিক-অনুষ্ঠান হতো সেগুলোও এখন বন্ধ। যদিও আমাদের বর্তমান আওয়ামী-সরকার নিজেদের সংস্কৃতিবান্ধব-সরকার বলেই দাবি করে এবং আমরা হুক্কাহুয়া ধ্বনি তুলে সেটি সমর্থনও করি।

স্কুল-কলেজ-পর্যায়ে নাটককে পৌঁছে দিতে না পারলে এই জাতির সামনে যে ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে সেটি যেকোনো সমাজসচেতন-মানুষ চোখ বন্ধ করলেও দেখতে পাবেন। এর থেকে উত্তোরণের জন্য ফেডারেশানকে আন্দোলন করতে হবে, ব্যাপারটা হয়ত সেখানেও নয়। এটি নেহাত সরকারের দায়িত্ব-কর্তব্যের অংশ বলে মনে করি। তবে আমাদের সরকারে যারা থাকেন তারা যে শুধু নাট্যোৎসব আয়োজনের মতো ‘লোক দেখানো’ উন্নয়নে ব্যস্ত থাকেন, সেটিও অস্বীকার করি কী করে! সেক্ষেত্রে ফেডারেশান এই দাবি নিয়ে জোরালোভাবে কথা বলতেই পারে।

আলোচনা করার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আছে সেটি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের শেষ। ফেডারেশানের শেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই সংগঠনের এই চল্লিশ/একচল্লিশ বছর পরে এসে প্রধান-আলোচ্য-বিষয় বলে মনে করছি।

পেশাদারি থিয়েটারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।

আমাদের থিয়েটারে পেশাদারিত্ব আছে কিন্তু আমাদের পেশাদারি থিয়েটার নেই। আমরা থিয়েটার কেন করি?
১.    শখের বশে থিয়েটার করি।
২.    অহংকার করার জন্য থিয়েটার করি।
৩.    লোক-দেখানোর জন্য থিয়েটার করি।
যে কারণেই করি বা যেভাবেই করি, আমরা আসলে পেশাদারি মনোভাব নিয়েই থিয়েটার করি। কিন্তু থিয়েটার করে আমাদের পকেটে কোনো পয়সা-কড়ি তো আসেই না, উল্টো যায়। মানে হলো, আমাদের দেশে এখনও পেশাদারি থিয়েটার গড়ে ওঠে নি। কেন গড়ে ওঠে নি সে আলাপ না করে বরং কীভাবে পেশাদারি থিয়েটার হতে পারে সেই আলাপ করা যাক।

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান গত চল্লিশ/একচল্লিশ বছরে পেশাদারি থিয়েটার করতে পারে নি কিন্তু চল্লিশ বছর আগে তারা এ ব্যাপারটি ভেবেছে, সেজন্য ধন্যবাদ দিতেই পারি আমরা। এই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে হলে সরকারকেই করতে হবে। কেননা আমরা গত চল্লিশ বছরে থিয়েটার দিয়ে সমাজ বদলে দিয়েছি, সরকার উল্টে দিয়েছি, মৌলবাদকে পুঁতে দিয়েছি, মানুষকে রাজনীতি-সচেতন করে তুলেছি, আগডুম-বাগডুম অনেক কিছুই করতে পেরেছি। কিন্তু দিনের আলোর মতোই সত্য যে, আমাদের যে অল্প কিছু সংখ্যক নাট্য-দর্শক ছিল তার সংখ্যা কমিয়েছি। তাই পেশাদারি থিয়েটার করতে হলে ঢাকা শহরের ৪/৫ হাজার দর্শক দিয়ে ব্যবসা (নাক-উঁচু মানুষরা ‘ব্যবসা’ কথাটি খারাপভাবে নিবেন না) হবে না। পেশাদারি থিয়েটার গড়ে তুলতে হলে আপনাকে আগে ব্যবসাটা বুঝতে হবে। এক্ষেত্রে নাটকের টিকিট কতটা বিক্রি হলো সে ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা যেহেতু থিয়েটারচর্চার ক্ষেত্রে কল্পনার নানা আলপনা এঁকে এঁকে থিয়েটারকে একটি উচ্চমার্গীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছি। আর থিয়েটার যেহেতু একটি শিল্প এবং আমাদের জাতিকে আমরা যেহেতু শিল্প বোঝার ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষায়ও শিক্ষিত করে তুলি নি। মানে আমাদের কোনো সরকারই এই ছোট্ট দায়িত্ব তুলে নেন নি বা এর পরিসর তৈরি করেন নি। তাই আমাদের পেশাদারি থিয়েটারের দায়িত্ব আমাদের সরকার নিলেই ভালো। সরকারের উপর দায়িত্ব চাপানোর অবশ্য যৌক্তিক কারণ আছে। আমাদের মৌলিক চাহিদার একটি বলা হচ্ছে বিনোদন কিন্তু মাননীয় সরকার আমাদের বিনোদনের জন্য কোনো ভর্তুকি তো দেন-ই না উপরন্তু আমাদের সংস্কৃতিখাতের বাজেট দেখলে বোঝা যায় যে, সরকার কতটা দায়সারাভাবে এই খাত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। তাই থিয়েটার করতে গেলে, মানে পেশাদারি থিয়েটার করতে গেলে আমাদেরকে অর্থকড়ির কথা ভাবতে হবে আগে। এই অর্থকড়ি নিশ্চয়ই দর্শকের টিকিটের টাকা থেকে আসবে না। অথবা যা আসবে তার পরিমাণ এতই কম হবে যে তা দিয়ে হল ভাড়া, সেটের জন্য গাড়ি ভাড়া, রূপসজ্জা ইত্যাদি ব্যয় মেটানোয় দলগুলো হিমশিম খাবে। সুতরাং পেশাদারি থিয়েটার কোনোভাবেই দলগুলোর নিজস্ব প্রচেষ্টায় হওয়া বা এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। অতএব পেশাদারি থিয়েটারের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। মানে নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের (নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, নেপথ্যকর্মী) পেশাদারি-দিকটি আর্থিকভাবে সরকার বিবেচনা করবে।

সরকার বা সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তর এক্ষেত্রে কিছুটা বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে পারে। সেটি এভাবে হতে পারে, প্রত্যেকটি দপ্তরকে সপ্তাহে একদিন করে নাটক দেখার ব্যবস্থা করে দিতে পারে। দপ্তরের যে বিনোদন বা আপ্যায়ন খাত থাকে সেখান থেকে তাদের দপ্তরের প্রত্যেকের জন্য একটি করে নাটকের টিকিট বরাদ্দ দেয়া হতে পারে। এতে করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিনোদিত হলেন এবং নাটকের দলও কিছুটা পয়সা পেল। এতে তাদের (আমাদের) মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনাও বৃদ্ধি পাবে বলেই বিশ্বাস করি। যার প্রভাব সামাজিক ও পারিবারিক-পর্যায়ে পড়বে। অন্তত যে মানসিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আমরা সমাজে লক্ষ করছি তা কিছুটা কমবেই কমবে।

এইখানে আমাদের থিয়েটারের নেতৃবৃন্দ সরকারের সাথে নানা দেন-দরবার, আলাপ-সালাপ করতে পারে। তারা চাইলে/পারলে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারে। তাহলে পরবর্তী-প্রজন্মের জন্য থিয়েটার করার আগ্রহ কিছুটা হলেও থাকবে। তবে নেতাদের মাথায় দেশের এই চক্রবৃদ্ধিহারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টিও থাকতে হবে। কেননা যে হারে প্রতিদিন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তাতে সাধারণের নাকানিচুবানি আমরা উপলব্ধি করছি। সেখানে যদি সরকার পেশাদারি থিয়েটারের (নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, নেপথ্যকর্মীদের) সাথে সংশ্লিষ্টদের অল্প কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দেয় এবং সেই দায়সারাভাবে চলে তাহলে থিয়েটার ঠিক আগের জায়গায়ই থাকবে। সামনে এগোবে না। কেননা একটি সিঙাড়া বা ডালপুরি খেয়ে নাটকের রিহার্সেল করে বা নাটকের শো করে দর্শকের হাততালি কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি যাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু পরবর্তী-দিনগুলোর জন্য শিল্পীর মানসিকতা নষ্ট হয়ে যায়। শিল্পীকে অবশ্যই মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হয়। তার জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক-স্বচ্ছলতা। অর্থাৎ পেশাদারি থিয়েটারে তাদের বেতন কাঠামো যুগোপযোগী হতে হবে। যেন একজন থিয়েটারকর্মী তার স্ত্রী-সন্তান বা স্বামী-সংসার নিয়ে মানসিকভাবে সুস্থ জীবন-যাপনের মাধ্যমে থিয়েটার করে যেতে পারে। তাছাড়া নামকাওয়াস্তে পেশাদারি থিয়েটার হলে যে-কে-সেই হবে। যাইহোক, এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান কাজ করতে পারে বলে মনে করি। আর এই কাজে তারা ব্যর্থ হলে নাট্যকর্মী-ই বলবে, এই সময়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা।

এবার আমাদের নাট্য-পরিসর নিয়ে খানিক আলাপ করা যায় এবং সেখান থেকে নাটকের শো করার একটি ভিন্ন ধারণা পাওয়া যায় কিনা দেখা যেতে পারে।

আমাদেরকে একটি নাটকের শো করার জন্য মূলত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হল এবং মহিলা সমিতির মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু বাস্তব-পরিস্থিতি হলো শুধু ঢাকা শহরেই ফেডারেশানভুক্ত নাটকের দল প্রায় ৭০টির মতো। এছাড়াও অন্তত প্রায় বিশটির মতো নাটকের দল আছে যারা পেশাদারি থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার বা রেপাটরি থিয়েটার নাম নিয়ে চলছে, নিয়মিত নাটক করছে এবং নাটকের প্রদর্শনীর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাহলে এই এতগুলো নাটকের দলের জন্য মোটে চারটা নাটকের হল দিয়ে তারা মাসে কয়টি করে প্রদর্শনী করতে পারবে? এক্ষেত্রে আমাদের বিকল্প-চিন্তা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

বিকল্প-চিন্তার কথায়, আগে থিয়েটারকে আমরা কীভাবে দেখি তার একটি বয়ান দেয়া যাক। নাটক মঞ্চে আসার গল্প উঠলেই আমরা বলি অমুক দলের প্রডাকশনটি বেশ ভালো, তমুক দলের প্রডাকশনটি ভালো হয় নিÑইত্যাদি। তো এই যে আমরা ‘প্রডাকশন’ কথাটি বলে থাকি, তা কিন্তু এমনি এমনি বলি না। হয়ত ভাবি না যে আদতেও কী কারণে ‘প্রডাকশন’ বলি। তো যে কারণেই বলি না কেন, এই প্রডাকশনের মানে হলো, আমাদের প্রদর্শিত নাটকটি একটি প্রডাক্ট। তাহলে প্রডাক্ট যেহেতু বলছি তাহলে এর মার্কেটিং-ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু ওই যে উপরে বলে এলাম, আমরা যেহেতু থিয়েটার চর্চার ক্ষেত্রে কল্পনার নানা আলপনা এঁকে এঁকে থিয়েটারকে একটি উচ্চমার্গীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছিÑএক্ষেত্রে নিজেরাই নিজেদেরকে অনেক উচ্চমার্গীয় লোক মনে করে হাম্বড়া ভাব নিয়ে নিজেদের প্রডাক্টের কোনো রকমের প্রচার বা মার্কেটিং না করে আশায় বুক বেঁধে থাকি যে, দলে দলে লোক হুমড়ি খেয়ে পড়বে আমাদের থিয়েটার দেখার জন্য। মানে আমাদের নাটক বা প্রডাক্ট উপভোগ করার জন্য দর্শক সারি বেঁধে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর আমরা, হাম্বড়া ভাবধারি লোকেরা গোঁফে তা দিয়ে মুচকি হাসি দেবো। আগেই তো বললাম, আমরা অনেক কিছু করেছি-পেরেছি কিন্তু নাটকের দর্শক তৈরি করতে পারি নি, একথা মানতেই হবে। এবার আমাদের নাটক দেখার জন্য যদি দর্শক শিল্পকলা একাডেমি বা মহিলা সমিতিতে না আসে তাহলে কি আমাদের থিয়েটার চর্চা বন্ধ হয়ে যাবে? না, যাবে না। আমাদের বিকল্প ভাবনা ভাবতে হবে।

আমাদের বিকল্প ভাবনার মধ্যে আমাদেরকে ট্রাফিক ব্যবস্থা বা জ্যামের কথা প্রথমে মাথায় রাখতে হবে। আর আমাদের দৈনন্দিন আয়ের সাথে ব্যয়ের অসামঞ্জস্য তো আছেই। লোকে সময়ের অভাবে এই দুই জায়গায় আসতে পারে না আর পারে না সামর্থ্যরে অভাবে।

এই সময় এবং সামর্থ্যরে সমন্বয় ঘটাতে পারলে আমাদের থিয়েটারের দর্শক বাড়বে। থিয়েটার করে আমরা টাকা পকেটে তুলতে পারব কিনা সেটা পরের কথা। অন্তত থিয়েটার বা নাটক নামে যে বস্তু আমরা করে থাকি, সেটি মানুষের সামনে উপস্থাপন করা যাবে। দর্শক, সময় ও সামর্থ্যরে অভাবে যেহেতু নাটক দেখতে আসতে পারে না, তাই আমাদের উচিত নাটক নিয়ে দর্শকের কাছে যাওয়া।

একটি ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা শহরে প্রায় প্রতিটি এলাকায় (ঢাকার বাইরেও হতে পারে) একটি করে সোসাইটি গড়ে উঠেছে। এই যেমন গুলশান সোসাইটি, নিকেতন সোসাইটি, সেগুনবাগিচা সোসাইটি ইত্যাদি। প্রত্যেকটি সোসাইটির একটি করে কমিউনিটি হল আছে এবং একটি করে মাঠ আছে। তারা বছরে অন্তত একটি করে মিলন মেলার আয়োজন করে। বিশেষকরে ভোটের আয়োজন করে। তো তারা এই বিশেষদিনে কীভাবে আমোদ-ফূর্তি করে? ধরে নিচ্ছি তারা নিজেরা নাচ-গান করে দিনটি কাটিয়ে দেয়। তাহলে সেই নাচ-গানের সাথে নাটক হতে পারে! হতেই পারে! এখানেই আসলে ফেডারেশানের কাজ। এই কাজটি ফেডারেশানের অনুষ্ঠান বিভাগ করতে পারে। তারা এইসব সোসাইটির সভাপতি-সেক্রেটারির সাথে মিটিং-সিটিং করে সেখানে নাট্য-সপ্তাহের আয়োজন করতে পারে। তার আগে তারা কিছু নাটক উপভোগ করার আমন্ত্রণ জানাতে পারে শিল্পকলা একাডেমি বা মহিলা সমিতির মঞ্চে। তারা নাটকগুলো দেখে তাদের সোসাইটির মানুষদের দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারে।

সোসাইটিতে নাটক দেখানোর ব্যবস্থাটিও আবার দুইভাবে হতে পারে:
১.    সোসাইটির দর্শকের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা সোসাইটির পক্ষ থেকে করা।
২.    নাট্যদল বা ফেডারেশানের পক্ষ থেকে টিকিটের ব্যবস্থা করা।

সোসাইটির সভাপতি-সেক্রেটারি দায়িত্ব নিয়ে এই আয়োজন করতে পারে। সেক্ষেত্রে নাট্যদলগুলোকে তাদের যথার্থ সম্মানী দিয়ে তারা নাটকের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারে। প্রদর্শনীর জন্য সকল আয়োজন যেমন, নাট্যমঞ্চ, আলো, সাউন্ডসহ সবকিছুর ব্যবস্থা সোসাইটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা করে দিতে পারে। আর যদি নাট্যদল বা ফেডারেশান সেই ব্যবস্থা করে তাহলে সংশ্লিষ্ট সোসাইটিতে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে কাজটি করতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা টিকিট বিক্রিসহ মঞ্চ-ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটিও পালন করবে। এখানে তারা যেকোনো দেশীয় বা আন্তর্জাতিক কোম্পানির স্পন্সর নিয়েও কাজটি করতে পারে। কোম্পানিগুলোও যেহেতু প্রচার চায়, তাই একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে তাদেরও পণ্য-প্রচারের যথেষ্ট সুযোগ থাকবে।

নাটককে দর্শকের কাছে নিয়ে যাওয়ার এই পদ্ধতিই যে কাজে লাগাতে হবে তা নয়। তবে এভাবেও থিয়েটার দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে বলে মনে করি। আবার এটি যে খুব সহজেই হবে, কমিউনিটির লোকেরা যে এক কথাতেই গদগদ ভাব দেখাবে, তাও না। তবে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এই সম্ভাবনাকে সাথে নিয়ে যারা সংঘবদ্ধভাবে কাজটি করতে পারে তারাই ফেডারেশান বা বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান। কেননা সংঘবদ্ধ-শক্তি অনেক কঠিন বিষয়ও সহজ করতে পারে।

এবার আরো একটি নতুন সম্ভাবনার কথা আলোচনা করতে চাই, যা থিয়েটারচর্চার সামনের দিকের অদ্ভুত দ্বার উন্মোচন করবে বলে মনে করি।

আমরা কথায় কথায় বলি আমাদের দেশে নাট্যকার নেই বা ভালো নাট্যকার নেই। আমাদের নাট্যকার নেই বা ভালো নাট্যকার নেই কেন সেই কথা কেউ বলি না। আমরা আসলে তা নিয়ে ভাবার চেষ্টাও করি না। নাট্যকার তো আকাশ থেকে পড়বে না বা মাটি ফুঁড়ে আসবে না। নাট্যকার তৈরি করতে হবে। তো নাট্যকার কীভাবে তৈরি হবে সেটি আলোচনা করা যেতে পারে।

গত এক দশকে বাংলাদেশে হাতে-গোনা দু-চারটি পথনাটক বা মুক্তনাটক হয়েছে, যা আমাদের জন্য খুবই অশনি-সংকেত। কেন অশনি-সংকেত সেই কথা বলি। পথনাটক করা হয় মূলত একেবারে তৃণমূলের মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করতে। দেশে কোনো জাতীয় সমস্যা দেখা দিলে, ক্রান্তিকালের গল্প বলতে, অতীতকালের যন্ত্রণা বলতে। গত প্রায় এক দশক ধরে দেশে পথনাটকের বালাই নেই বললেই চলে। একটি দেশে পথনাটক হয় না মানে কোনো সমস্যা নেই (পথনাটক যেহেতু বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক হয়ে থাকে)। তার মানে কি আমাদের দেশে গত এক দশকে কোনো ইস্যু তৈরি হয় নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। খুন হচ্ছে, গুম হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে, লুট হচ্ছে, বেগুনে আগুন ধরছে, তেলবাজির কারণে তেলের দাম দ্বিগুণ হচ্ছে। কিন্তু নাটক হচ্ছে কি? হচ্ছে না। এগুলো কোনো সমস্যা নয়? অবশ্যই সমস্যা। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিবোদ্ধারা বা ফেডারেশান, পথনাটক পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ সকলেই খুব সচেতনভাবে সেগুলো এড়িয়ে (আগেই বলেছি দু-চারটি নাটক যে হচ্ছে না তা নয়) যাচ্ছে।

কিন্তু পথনাটক হলে কী হতো? মানুষের কল্যাণে কিছু কাজ হতো। আর অনেকগুলো নাট্যকার তৈরি হতো। পথনাটক লেখাকে একজন নাট্যকারের বুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্র মনে করি। পূর্ণাঙ্গ নাটক বা মঞ্চনাটক লেখার হাতেখড়ি মনে করি। যাইহোক, এভাবে আমাদের দেশে অনেক নাট্যকার তৈরি হতো গত এক দশকে। তাহলে ‘আমাদের নাট্যকার নেই’ বলে আজকে এই আহাজারি করতে হতো না। ফেডারেশান দলগুলোকে একত্রিত করে পথনাটক করার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করে এখনও এই দায়িত্ব নিতে পারে।

আরেকটি কাজ ফেডারেশান করতে পারে, যা নাটকের জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর হবে। সেটি হলো উপজেলা থেকে শুরু করে জেলা-পর্যায়ে মৌলিক নাটকের নাট্যপ্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারে। সেখানে জেলার যেকোনো দলই (শুধু ফেডারেশানভুক্ত দল হলে পক্ষপাতমূলক ব্যাপার দাঁড়াবে) প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে। তাদের মধ্য থেকে প্রথম স্থান (বা প্রথম দুটি বা তিনটি দলও হতে পারে) অর্জনকারী দল নিয়ে বিভাগীয়-পর্যায়ে আরেকটি নাট্যপ্রতিযোগিতা হবে। সেখান থেকে কেন্দ্রীয়/জাতীয়-পর্যায়ে মূল-প্রতিযোগিতা হবে। তাহলে আমরা এই প্রতিযোগিতার মধ্যদিয়ে যেমন দেশের সেরা নাট্যকার পাব, তেমনি নির্দেশক, অভিনেতা এবং বিভিন্ন কলাকুশলীও পাব। তাহলে আমাদের এই হায় হায় ব্যাপারটা আর থাকবে না আশা করি। এখানে অনেকেই বলতে পারেন যে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ৬৪ জেলায় নাটক করেছে। হ্যাঁ করেছে। সেগুলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রজেক্ট এবং আয়-ব্যয়ের খতিয়ান ছাড়া আর কিছুই দাঁড়ায় নি। সেখান থেকে আমরা না পেয়েছি কোনো ভালো নাটক; না পেয়েছি নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা। আমরা পেয়েছি শুধুই কিছু সংখ্যা। সেখান থেকে যে মুনাফা এসেছে তা পকেট-কেন্দ্রিক নাট্য-কেন্দ্রিক নয়। সুতরাং নাট্য-কেন্দ্রিক মুনাফা পেতে চাইলে বা নাটককে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাইলে অবশ্যই থিয়েটার-কল্যাণকর আয়োজনের মধ্যদিয়ে এগোতে হবে।

সার্বিক আলোচনা থেকে আমাদের একটি ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষা বা শঙ্কা থাকতেই পারে। তা হলো, গ্রুপ থিয়েটার ভবিতব্যের ভূত নাকি ভবিষ্যতে অদ্ভুত হবে? বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান তাদের কাজে-কর্মে যে পথে এগোচ্ছে, তাতে করে ফেডারেশান হারিয়ে যাওয়ার সমূহ-সম্ভাবনা আছে। যদি তারা হারিয়ে যায় তো আমরা হয়ত ফেডারেশানের ভূত দেখতে পাবো। আর যদি বর্তমান নেতৃবৃন্দ বা আগামী কমিটির নেতৃবৃন্দ থিয়েটারের কল্যাণে কাজ করে তাহলে অদ্ভুত বা অভূতপূর্ব একটি সংগঠনে পরিণত হবে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’।

মাহবুব আলম ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যকার