Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: কোকিলারা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: কোকিলারা। রচনা ও নির্দেশনা: আবদুল্লাহ আল-মামুন। মঞ্চপরিকল্পনা: দীপক রায় ও তৌকীর আহমেদ। আলোকপরিকল্পনা: আব্দুর রহিম দুলাল। পোস্টার ডিজাইন: কাইয়ুম চৌধুরী। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৮৯। একটি ‘থিয়েটার’ প্রযোজনা
[ফেরদৌসীর কোকিলারা দেখবার মতো- শিরোনামে নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন পবিত্র সরকার। কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় ২৩-০৩-১৯৯০ তারিখে এটি ছাপা হয়। ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
ফেরদৌসী মজুমদারের একক-অভিনীত নাটক কোকিলারা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা একক-অভিনয় করেন মূলত দুধরনের প্রস্তুতি নিয়ে। কেউ অসংখ্য চরিত্রের বিচিত্র ও বহুমুখী রূপ দিয়ে ফেলেছেন ভিন্ন ভিন্ন নাটকে, সেই অভিজ্ঞতা তাঁর ক্ষমতাকে প্লাস্টিসিনের মতো নমনীয় করে ফেলেছে, এখন নিজেকে নিয়ে তিনি যা খুশি তাই করতে পারেন, তাই তাঁর ইচ্ছে হলো একক-অভিনয় করবার। এক্ষেত্রে আর তাঁর সামর্থ্যকে টানটান করে আপ্রাণ কসরতে অভিনয়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছবার প্রশ্ন ওঠে না, তিনি স্বচ্ছন্দে চরিত্রগুলোর নামরূপী আরামদায়ক পোশাক পরে দাপটে বিচরণ করেন মঞ্চে। এরকম মনে হয়েছিল পু. লা. দেশপাণ্ডেকে। যিনি মরাঠি নাটক বটাচাচি চাল-এ তিনঘণ্টা দর্শকের মন্ত্রাচ্ছন্ন করে রাখতেন, মনে হয়েছিল তৃপ্তি মিত্রকে, যিনি অপরাজিতা-য় আমাদের একইভাবে আবিষ্ট করেছিলেন।
আরেকটি ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিজ্ঞতার সেই বহুবিস্তৃত সাম্রাজ্যটিকে অধিকার করেন নি তখনও, কিন্তু নিজের বিস্তারযোগ্যতা সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নিতে চাইছেন, আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছেন বড় একটা চ্যালেঞ্জের, এবং গ্রহণ করেছেন সেই চ্যালেঞ্জ, হয়ত মর্যাদার সঙ্গে উৎরেও যাচ্ছেন সেই চ্যালেঞ্জ। সামান্য একটু ঘাম বা অসম নিশ্বাসপ্রশ্বাসের মুহূর্ত হয়ত থেকে যাচ্ছে, কিন্তু তবু সে অভিনয় দর্শকের মনোযোগ এবং সমীহ আকর্ষণ করতে পারছে অবশ্যই।
ফেরদৌসী দ্বিতীয় দলে পড়েন যদি বলি, তা তাঁর সাফল্যকে খাটো করে দেখার জন্য নয়। নাট্যকার, নির্দেশক ও প্রয়োগকর্তা আবদুল্লাহ আল-মামুন তিনটি নারীর বিপর্যস্ত আখ্যানকে নিয়ে একটি সমর্থ-নাটক তৈরি করে দিয়েছেন তাঁর জন্য। তিনজনেরই নাম ‘কোকিলা’। এক নম্বর কোকিলা গাঁয়ের নিরক্ষর মেয়ে, মায়ের দ্বিতীয়-স্বামীর লোলুপ হাত এড়িয়ে সে শহরে এসে পরিচারিকার কাজ নেয় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। সেখানে গৃহকর্তার ভণ্ড-সর্বহারা-প্রেমী ভাইপো আনুর প্রতিশ্রুতির সম্মোহক ফাঁদে পড়ে সে। ‘শিক্ষিত’ মানুষদের প্রতারণায় সে মর্যাদা এবং আশ্রয় দুই-ই হারায় এবং শেষে ট্রেনের চাকার নিচে নিজেকে ও গর্ভের সন্তানকে ধ্বংস করে।
দ্বিতীয় কোকিলা একটু স্বচ্ছল ও রুচিশীল পরিবারের ধর্মপ্রাণ গৃহকর্ত্রী। স্বামী ও দুই তরুণী কন্যাকে নিয়ে তার আপাত সুখের-সংসার। পঁচিশ বছরের সুখী ও সংশয়হীন গার্হস্থ্যের পর সে জানতে পারে, তার স্বামী তার পারসোনাল অ্যাসিস্টেন্টকে বিয়ে করেছে। স্বামী তাকে অম্লানবদনে বিচ্ছেদপত্র লিখে দেয়, অভিযোগের জবাবে ক্রুদ্ধ ও হিংস্র হয়ে উঠে তাকে এলোপাথাড়ি লাথি মারে। ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে এই নারী খুব দ্রুত জীর্ণ হয়ে মারা যায়।
আর তৃতীয় যে কোকিলা, সে একটি আদালতে মহিলা-উকিল সেজে আগের দুই কোকিলার পক্ষে সওয়াল করে। প্রথম কোকিলার ধ্বংসকারী আনু আর দ্বিতীয় কোকিলার স্বামী খোন্দকারের ভদ্র জামাকাপড় খুলে তাদের নগ্ন-জান্তব চেহারা দেখিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সমস্ত সওয়ালের শেষে আদালতে দর্শকের টিটকারি শিস আর হাসি স্তব্ধ করে বিচারকের শীতল কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে, আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই প্রমাণিত হয় নি। তৃতীয় কোকিলা একই সঙ্গে হাসি ও কান্নায় ভেঙে পড়ে।
একক-অভিনেতা বা অভিনেত্রীর কাজ কিছুটা বহুরূপী মাইম-শিল্পীর মতো। এখানে শিল্পী মুহূর্তে মুহূর্তে শ্রেণি, অবস্থান, বয়স, মুখ, শরীর শুধু বদলই করেন না, লিঙ্গান্তর ঘটিয়ে নারী হয়ে যান পুরুষ, পুরুষ হয়ে যান নারী। কোনো সাধারণ নাটকেই একই সঙ্গে এই বহুধা-সঞ্চরণ সম্ভব নয়। এ নাটকেও ফেরদৌসী প্রধান নারী-চরিত্রে রূপ দিতে দিতেই অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে রূপ দিয়েছেন। প্রথম কোকিলা হতে হতে তিনি হয়েছেন শিস্ দেয়া বখাটে ছাত্র অনু, গৃহকর্তা খালুজান বা কর্ত্রী খালাম্মা। দ্বিতীয় কোকিলা হয়েও তিনি কখনো হয়েছেন পাইপ-টানা স্বামী মিঃ খোন্দকার, কখনো ফোন বিলাসিনী পরচর্চাসুখী মিসেস হোসেন, কখনো ঢাকাই-কুট্টি ভিখিরি অন্ধ ফকির। উকিলের গাউন পরে তৃতীয় কোকিলার চেহারায় থেকেও তিনি ফিরে গেছেন প্রথম কোকিলা বা দ্বিতীয় কোকিলায়, এবং আরও নানা চরিত্রে। ফলে মুখ্যত তিনটি হলেও প্রায় একটি জনতার বিচিত্রমুখী-আকৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন ফেরদৌসী এবং এ কাজে তাঁর সাফল্য তাঁকে অভিনেত্রী-জীবনের একটা বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছে, তেমনই যে অতিশয় জরুরি ও দাহময় কথা তিনি আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন তা আমাদের যথাস্থানে এসে আঘাত করেছে। পুরুষশাসিত, পুরুষস্বার্থবাহী এই সমাজ, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের ভণ্ডামি (প্রথম কোকিলা বলেছিল- শিক্ষিত ভদ্রলোক-গ ন্যাংটা কইরা ছাইরা দিমু) ও ‘তেলেসমতি’ কারবার, সবই তিনি মর্মান্তিক দাগে ফুটিয়ে তুলেছেন। এ সামান্য ক্ষমতার কথা নয়। তবু প্রথম কোকিলার গ্রাম্য উপভাষায় ফেরদৌসীকে যতটা স্বচ্ছন্দ দেখি, অন্য দুটি চরিত্রে স্ট্যান্ডার্ড ভাষায় পৌঁছে তাঁর কথা মাঝে মাঝে ফস্কে যায়। যেমন তৃতীয় অঙ্কে দ্বিতীয় কোকিলা বলতে গিয়ে তিনি ‘দ্বিতীয় কলি’ বলে পরে সামলে নেন। এ দুটি চরিত্রে তাঁর ‘র-ড়’ স্পষ্ট থাকে না, চন্দ্রবিন্দুতে কৃপণ হয়ে যান তিনি।
নাট্যকার কয়েকটি জায়গায় তাঁকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সাহায্য করতে গিয়েছেন। দ্বিতীয় এপিসোডে মিসেস খোন্দকার হয়ে তিনি যখন প্রথম কোকিলার মৃত্যু বিশ্লেষণ করেন তা কিছুটা অপ্রাণ বক্তৃতার ঢঙ পায়। তৃতীয় এপিসোডে জীবনানন্দের বনলতা সেন আবৃত্তি কিংবা শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সিজার থেকে ব্রুটাসের বক্তৃতা আলাদা করে কোনো সাড়া তৈরি করে না। দ্বিতীয় এপিসোডেও মিসেস খোন্দকার চট্টগ্রামে গিয়ে তার স্বামী বিয়ে করেছে এবং কক্সবাজারে হানিমুনের জন্য রওনা হয়েছে শোনার পর শেক্সপীয়রেরই কিং লিয়রের ধরনে ‘হে চট্টগ্রাম তুমি কি পারলে না নির্লজ্জ এক পুরুষের বাসনাকে গলা টিপে ধরতে...হে কক্সবাজার, হে উত্তাল সমুদ্র, হে তরঙ্গমালা’...ইত্যাদি বলে যে ব্যাকুল উচ্ছ্বাস করে যায় তা কাব্যিকতায় কৃত্রিম শোনায়। ফেরদৌসী এসব জায়গা আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও তেমন বশে আনতে পারেন নি।
এ ছাড়া নাটকটি বেদনায় ও হিউমারে সজীব, তার গাঁথুনিও বেশ ভালো। নাট্যকার নিজে কবি বলেই কোথাও কোথাও কবিতার পঙক্তির রণন চমৎকার খাপ খেয়ে যায়, যেমন, আনুর অনুরাগমুগ্ধ প্রথম কোকিলার কথা ‘অন্তরে সুখের চিকন সুতার মতো লাগে’। বস্তুতপক্ষে প্রথম কোকিলার সংলাপ যতটা স্বাভাবিক ও সতেজ, পরবর্তী কোকিলাদের সংলাপ সে তুলনায় কিছুটা ভারাক্রান্ত মনে হয়।
নাট্যকার-নির্দেশক-প্রয়োগকর্তা আবদুল্লাহ আল-মামুন গ্রিক ট্যাজেডির ধরনে মঞ্চনির্মাণ করেছেন। পিছনে গুটি তিনেক সিঁড়ি, সিঁড়ির দুপাশে এবং পিছনে একটু উঁচু চাতাল, তার পিছনে খিলানহীন দুটি ন্যাড়া থাম। চটে ঢেকে তৈরি, ফলে একটি জীর্ণতার সংকেত আসে। নাটকে সিঁড়ি খুব কমই ব্যবহার হয়। প্রথম কোকিলার আখ্যানে মঞ্চের একেবারে সামনে ডানদিকে থাকে একটি টেলিফোনের ছোট নিচু টেবিল, বাঁদিকে থাকে রেডিয়োর টেবিল। এতে দুপ্রান্তের সামনে-বসা দর্শকের একটু অসুবিধা হয়, কোকিলা যখন দু-একবার সিঁড়িতে গিয়ে বসে তখন তাকে দেখাই যায় না।
নাটকে নানা গান, সুর ও ধ্বনির সমর্থ প্রয়োগ আছে। প্রথম কোকিলার ব্যতিব্যস্ত সকালকে খবরের কাগজ এসে পড়া দিয়ে গঠন করা যেত, নেপথ্যে অতি সুরেলা রামকেলি রাগিনীর আলাপ ততটা দরকার ছিল বলে মনে হয় না। প্রথম কোকিলার টেলিফোনে কথা বলার সময় ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’ গানের প্রয়োগ নিরর্থক, কিন্তু দ্বিতীয় কোকিলার স্বামীর বিবাহ ও মধুযামিনীর প্রসঙ্গে সামুদ্রিক গাঙচিলের ডাক আবহটিকে চমৎকার দাঁড় করিয়ে দেয়। পোশাকে সাজসজ্জায় তিন কোকিলার পার্থক্য বেশ জেগে উঠেছে। তবে শেষ-দুজনের মধ্যে শ্রেণিসাম্য থাকায় পার্থক্য সংগতভাবেই কম। উকিল-কোকিলা আগের কোকিলার সাজের উপরেই একটি কালো গাউন পরে নেয়, স্লিপারের বদলে পায়ে গলিয়ে নেয় সাদা জুতো।
এ নাটক দেখবার মতো অবশ্যই। প্রাথমিক সামান্য আড়ষ্টতা এবং নাটকের কিছু বাচনিক অলঙ্করণ কাটিয়ে উঠতে পারলে ফেরদৌসীর এই নাটক আরও দুর্ধর্ষ হয়ে উঠবে এবং কোকিলা যা চায়, সরকারি আদালত থেকে গণ-আদালতে পৌঁছে যেতে, ধর্ম আর সমাজ-নামক দুই ‘ঘাতক তরবারির’ বিরুদ্ধে সওয়াল করতে, তাদের সে লক্ষ্য সার্থক হবে।
ফেরদৌসী মজুমদার ও তাঁর সহকর্মীদের অভিনন্দন।
পবিত্র সরকার: নাট্যব্যক্তিত্ব, ভারত