Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: বিষাদ সিন্ধু
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: বিষাদ সিন্ধু। মূলরচনা: মীর মশাররফ হোসেন। প্রাথমিক-পাণ্ডুলিপি: মোস্তফা হীরা। নাট্যভাষ্য: বিপ্লব বালা। নির্দেশনা: সৈয়দ জামিল আহমেদ। মঞ্চপরিকল্পনা: হাবিবুর রহমান ও সৈয়দ জামিল আহমেদ। আলোকপরিকল্পনা: আমিনুর রহমান আজম ও সৈয়দ জামিল আহমেদ। পোশাকপরিকল্পনা: অশোক কর্মকার ও সৈয়দ জামিল আহমেদ। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৯১-৯২ (প্রথম ও দ্বিতীয়পর্ব)। একটি (দুটি) ‘ঢাকা পদাতিক’ প্রযোজনা
[বিষাদ সিন্ধু: ঢাকা পদাতিকের অনন্য প্রযোজনা- শিরোনামে নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন আতাউর রহমান। তাঁর নাট্যসমালোচনা-গ্রন্থ ‘পাদপ্রদীপের আলোয়’ থেকে সংগ্রহ করে নাট্যসমালোচনাটি ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
মার্চ মাস আমাদের জন্যে যেমন দুঃখের তেমনি সুখের। দুঃখের এই জন্যে যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি শকুনেরা তাদের সুতীক্ষ্ম নখরে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিল বাংলার বুক, ক্লেদাক্ত সরীসৃপের পদচারণা কলঙ্কিত করেছিল বাংলার মাটিকে। আর সুখের এই জন্যে যে, এই দুঃখের অমানিশার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার উচ্চারণ অহঙ্কারে অভ্রভেদী হয়ে উঠেছিল এই মাসেরই ২৬ তারিখে। এই উচ্চারণ স্তম্ভিত করে দিয়েছিল সারা পৃথিবীর মানুষকে। এই সবই আমাদের অভিজ্ঞতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যা কিছু করতে, যা কিছু লিখতে যাই, আমরা সময়টিকে মনে করে যাত্রা শুরু করতে চাই। আমাদের জীবন এমনই ঘটনাবহুল যে, হিসাব করে দেখলে দেখা যায়, বৎসরের কোনো না কোনো সময় আমাদের জীবনে কিছু না কিছু একটা ঘটে গেছে এবং তার বেশিরভাগই দুঃখের স্মৃতির পাল্লাকে ভারী করে। মার্চ মাসকে মনে করলে মনটা দুঃখেই ভরে যায় বেশি। বিষাদ সিন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। এই নাটকটির মঞ্চায়ন বেশ কিছুকাল আগে দেখেছি, ভেবেছিলাম এই প্রযোজনা সম্পর্কে কিছু একটা লিখব। কিন্তু হয়ে ওঠে নি। যাক, সুযোগ এসে গেল, মনে হলো মার্চ মাসই বিষাদ সিন্ধু সম্পর্কে লেখার প্রকৃষ্ট সময়। বিষাদ সিন্ধু ‘ঢাকা পদাতিক’-এর সপ্তদশ প্রযোজনা। মীর মশাররফ হোসেনের মূল-রচনা অবলম্বনে বিষাদ সিন্ধুর নাট্যরূপ দিয়েছেন বিপ্লব বালা। এই প্রযোজনার উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় ৮ ডিসেম্বর, ১৯৯১, মহিলা সমিতি মঞ্চে। ‘ঢাকা পদাতিক’ ইতোমধ্যে দেশের অন্যতম প্রধান নাট্যদল হিসেবে দর্শকসমাজে তাদের প্রযোজনার গুণেই স্বীকৃতি পেয়েছে। ইংগিত, আহ্ কমরেড, ইন্সপেক্টর জেনারেল, এই দেশে এই বেশে, জনতার শত্রু, আমিনা সুন্দরী, ইত্যাদি নাট্যপ্রযোজনার সাফল্য ও দর্শকপ্রিয়তা ‘ঢাকা পদাতিক’কে দেশের প্রধান-সারির নাট্যদলগুলোর একটি হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবে বিষাদ সিন্ধু বৈচিত্র্যে, নিষ্ঠায় ও বিরাটত্বে দলটির আগের সব প্রযোজনাকে ছাড়িয়ে গেছে। বিষাদ সিন্ধু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, শুধু ‘ঢাকা পদাতিকে’র নয়, আমাদের দেশের সামগ্রিক-নাট্যচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে একটি অনন্যসাধারণ প্রযোজনা। এই প্রযোজনাটি আমাদের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে অনায়াসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। প্রযোজনা সম্পর্কিত আলোচনাকে কিছুটা বিশদ করা যাক।
বিষাদ সিন্ধুর নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার অধ্যাপনায় নিয়োজিত জামিল আহমেদ ইতোমধ্যে নাটকের একজন সুদক্ষ কারিগরি-নির্দেশক এবং নাট্যনির্দেশক হিসেবে শুধু স্বদেশেই নয়, বিদেশেও নন্দিত ও প্রশংসিত হয়েছেন। দেশ-বিদেশের অনেক সফল প্রযোজনার কর্ণধার জামিল আহমেদ। উনি যদিও ‘ঢাকা থিয়েটারে’র সদস্য, তবুও নিজে একটি বিশেষ নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে, জড়িয়ে পড়েছেন সারা দেশের নাট্যকর্মীদের সঙ্গে, নাটকের বৃহত্তর অঙ্গনে।
বিষাদ সিন্ধু যদিও ‘ঢাকা পদাতিকে’র প্রযোজনা, তারপরও নির্দেশকই এই প্রযোজনার প্রধান ব্যক্তি, অর্থাৎ বিষাদ সিন্ধু নির্দেশকেরই নাটক। এই উক্তির অপব্যাখ্যার হয়ত সুযোগ আছে, ভালো এবং খারাপ দুঅর্থই করা যেতে পারে; কিন্তু এতে সত্যের অপলাপ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ প্রযোজনায় কুশীলব ও কলাকুশলী সবাই ফৌজি নিয়মে নির্দেশকের অঙ্গুলি হেলনে মঞ্চে ক্রিয়াশীল ছিলেন, এই সত্যটি সাধারণ-দেখার-চোখকেও ফাঁকি দিতে পারে না। আড়াই ঘণ্টার এই নাটকে নির্দেশকের সক্ষম ও কঠোর উপস্থিতি প্রতিমুহূর্তে অনুভব না করে কোনো উপায় নেই। এমনকি মনে হয় যে মীর মশাররফ হোসেনের মূল-রচনার নাট্যরূপও নির্দেশকের ইচ্ছানুযায়ী রচিত হয়েছে। বিষাদ সিন্ধু নাট্যপ্রযোজনার সব উপাদানই এভাবে নির্দেশকের করতলগত হয়েছে। নির্দেশকের এই শক্তিমান আত্মপ্রকাশ বিষাদ সিন্ধু-কে যতটা না করে তুলেছে ‘ঢাকা পদাতিকে’র প্রযোজনা তার চেয়ে বেশি গড়ে তুলেছে নির্দেশক জামিল আহমেদের সৃষ্টি হিসেবে। এতে আমাদের নাট্যচর্চার কোনো ক্ষতি হয় নি, ভবিষ্যতের জন্যে আরও শিক্ষিত ও সংগঠিত হয়েছে ঢাকা পদাতিকের নাট্যকর্মীরা এবং আমাদের নাট্যাঙ্গন উপহার পেয়েছে এক অসামান্য প্রযোজনার। ঢাকা পদাতিকের কুশীলব ও কলাকুশলীরা নির্দেশকের নেতৃত্বে নিরলস পরিশ্রম করে মূর্ত করেছেন বিষাদ সিন্ধুর নাট্যঅভিপ্রায়কে।
বিষাদ সিন্ধু দেখতে গিয়ে, অতিপরিচিত মহিলা সমিতির মিলনায়তন ও মঞ্চকে চিনতে কষ্ট হয়, ভোল পাল্টানো মহিলা সমিতির ভেতরটা দেখে, মনে হয় মঞ্চপরিকল্পনাকারীরা অসাধ্য সাধন করেছেন। দর্শকেরা আয়তাকার ঢঙে গ্যালারিতে বসে নাটক দেখছেন এবং কলাকুশীলবেরা অভিনয় করেছেন মাঝখানে, মহিলা সমিতির ফ্লোরে। এবং অভিনয়ের জন্যে মহিলা সমিতির মূল-মঞ্চটিও ব্যবহৃত হচ্ছে। মঞ্চসজ্জা যে খুব জাঁকজমকপূর্ণ তা নয়, তবে নিঃসন্দেহে বিরাটত্বের অনুভূতি দেয়। বিষাদ সিন্ধুর এই প্রযোজনাটি প্রথমপর্ব হিসেবে ‘ঢাকা পদাতিক’ উপস্থাপন করেছে। এই পর্বে যদিও ইমাম হোসেনকে দেখা যায়, এটি মূলত ইমাম হাসানেরই কাহিনি। তাঁর উত্থান, ইয়াজিদের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব এবং বিষক্রিয়ায় তাঁর করুণ-মৃত্যুকে তুলে ধরেছে এই কাহিনিভাগ। আশা করছি দ্বিতীয়পর্বে ইমাম হোসেনের কাহিনি তথা কারবালার যুদ্ধই হবে বিষাদ সিন্ধুর উপজীব্য। ঢাকা পদাতিক এখন বিষাদ সিন্ধুর দ্বিতীয়পর্বের মহড়ায় নিয়োজিত।
বিষাদ সিন্ধু প্রযোজনার সবচেয়ে প্রশংসনীয় বিষয় হলো এর অপূর্ব দলগত অভিনয়, যেখানে সামান্যতম বিচ্যুতিও চোখে পড়ে না। এই প্রযোজনাটি এমনভাবে গাঁথা হয়েছে যে, মঞ্চে প্রতিটি ক্রিয়া ঘড়ির কাঁটার সেকেন্ড ধরে চলে। যাকে বলা যায় নিচ্ছিদ্র। ঢাকা পদাতিকের কর্মীরা তাদের কঠোর শ্রম ও অতন্দ্রপ্রহরীর মতো সজাগদৃষ্টি দিয়ে প্রযোজনাটিকে নিরঙ্কুশ ধরে রাখেন। প্রযোজনাটির আরেকটি শ্লাঘার দিক হলো, এর নিরাভরণ অথচ বিরাটত্বে-মণ্ডিত এবং মহাকাব্যিক-ঢঙের উপস্থাপনা। বিষাদ সিন্ধুর (মূলরচনা) মতো বিরাট প্রেক্ষাপটের কাহিনিকে কখনো ছোট মনে হয় না। এই প্রযোজনার মঞ্চসজ্জার কথা আগেই বলেছি। এই প্রযোজনায় সর্বাঙ্গজুড়ে দক্ষ কারিগরি কাজের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এই নাটকের আলোকপরিকল্পনা ও সম্পাত এবং বেশভূষা বিমোহিত হবার মতোই বটে। পরিচ্ছদপরিকল্পনায় রঙের পরিকল্পিত বৈচিত্র্য আনয়নকে প্রশংসা না করে উপায় নেই। এই প্রযোজনার সুর-সংযোজনা, বিশেষ করে বিচিত্র সব শব্দের ব্যবহার অভিনব মনে হয়। এক কথায় অভিনয়ে, গানে, কোরিওগ্রাফিতে, অ্যাক্রোবেটিকসে, লাঠিখেলায়, মঞ্চময় ঘোড়ার ছুটাছুটিতে বিষাদ সিন্ধুকে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ বলে মনে হয়। এই নাটকে নির্দেশক এমন সব স্পেশাল অ্যাফেক্ট সৃষ্টি করেছেন যা পিটার ব্রুকের মহাভারত প্রযোজনার সঙ্গে তুলনা করতে দ্বিধা হয় না। যেমন, হাসানের বিষপানে মৃত্যুর-কোলো ঢলে পড়ার আগ মুহূর্তে উড়ন্ত মৃত্যুদূত মায়মুনার তাঁকে কালো পোশাকে আবৃত হয়ে স্পর্শ করে যাওয়া, একচোখা ভিলেনের ইমাম হাসানকে নামাযরত অবস্থায় বল্লম ছুঁড়ে মারার সময়ে অনাস্বাদিত যেসব নাট্যমুহূর্তের সৃষ্টি হয়েছে তা অনেকদিন মনে রাখার মতো। তবে স্পেশাল অ্যাফেক্টের ব্যবহার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মনে হয়েছে, ফলে সুন্দর অ্যাফেক্টগুলোর গুরুত্ব অনেকাংশে কমে গিয়েছে। এই প্রযোজনায় ‘ঢাকা পদাতিক’ একটি সাহসের কাজ করেছে, যার উল্লেখ করতেই হয়। ধর্মীয়ব্যক্তিত্ব ইমাম হাসান ও হোসেনকে রক্তে, মাংসে ও কামনার তাপে শরীরি-মানুষ হিসেবেই মূর্ত করা হয়েছে এই প্রযোজনায়, যা আমাদের সমাজে বিরল একটি ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এই নাটকের দুর্বলতম দিক হলো ব্যক্তিগত অভিনয়। ব্যক্তিগত অভিনয়ে পারঙ্গমতা দেখাবার অনিঃশেষ সুযোগ ছিল কিন্তু সেই সুযোগটি দলের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা গ্রহণ করতে পারেন নি। তবুও বলব, মাসুম আজিজ মোয়াবিয়ার ভূমিকায় প্রশংসনীয় অভিনয় করেছেন। নাদের চৌধুরী ও নূসরাত ইয়াসমিন টিসা দৈহিকভাবে সক্ষম-অভিনয় করেছেন। কিন্তু বাচিক অভিনয়ের ব্যাপারে তাঁদের আরও যত্নবান হওয়া উচিত। জন মার্টিন সুত্রধার হিসেবে ভালো কিন্তু ইমাম হোসেন হিসেবে যথার্থ নন।
সবশেষে বিষাদ সিন্ধুর নাট্যরূপ সম্পর্কে দু-চারটি কথা বলতে হয়। নাট্যরূপটিকে অসাধারণ কিছু মনে না হলেও বর্ণনাত্মক ভাষার ব্যবহারে অভিনয়-উপযোগী হয়েছে বলা যায়। লোকনাট্যরীতি ও ধ্রুপদী ঢঙও বজায় ছিল কিন্তু প্রযোজনাটিকে সমসাময়িক করে তোলার প্রয়াসকে আরোপিত মনে হয়েছে। মহাভারত, রামায়ণ, ইলিয়ড, বিষাদ সিন্ধু বিপুল ও বিরাটভাবে মানুষেরই সুখ-দুঃখ, জয়-পরাজয়, হীনম্মন্যতা ও মহানুভবতায় ইতিহাসকে ধারণ করেছে। এবং এই মহাকাব্যগুলো আজকের পৃথিবীর মানুষদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে এতটুকু অনুজ্জ্বল হয় নি। সুতরাং বিষাদ সিন্ধুর কাহিনি শোনাতে গিয়ে মহাভারতের উপমা টানার অথবা বিশেষ শব্দ ব্যবহার করে বর্তমানের কাছে প্রাসঙ্গিক করে তোলার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
সবশেষ কথার পরেও কথা থাকে, কথাটি হলো বিষাদ সিন্ধু আমাদের সাম্প্রতিক-নাট্যচর্চায় একটি অসাধারণ প্রযোজনা হিসেবে বিবেচিত হবে। এই গৌরব সমন্বিতভাবে ‘ঢাকা পদাতিকে’রই প্রাপ্য।
আতাউর রহমান ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যব্যক্তিত্ব