Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: কোর্ট মার্শাল
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: কোর্ট মার্শাল। মূলরচনা: স্বদেশ দীপক। অনুবাদ: সলিল সরকার। রূপান্তর ও নির্দেশনা: এস এম সোলায়মান। আলোকপরিকল্পনা: ঠাণ্ডু রায়হান। পোশাক ও আবহসংগীতপরিকল্পনা: রীমা রফিক। রূপসজ্জা: জয়নাল আবেদীন। মঞ্চ ও পোস্টার ডিজাইন: হেমায়েত হোসেন তপন। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৯৩। একটি ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’ প্রযোজনা
[কোর্ট মার্শাল নাটকের এই নাট্যসমালোচনাটি কোর্ট মার্শাল: সময়োপযোগী ভিন্ন মাত্রার প্রযোজনা- শিরোনামে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ ছাপা হয়। ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
সম্প্রতি আমাদের নাট্যচর্চায় এক প্রবল গতির সঞ্চার হয়েছে। নতুন নাটক যেমন নামছে তেমনি নতুন বক্তব্য, অভিনয়ে ভিন্নমাত্রার যোগ সমকালীন বিষয়গুলোর নবতর উপস্থাপনা দর্শককে চমৎকৃত করছে। যারা আশঙ্কায় ছিলেন এই ভেবে যে, নাট্যচর্চা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল, তাদের জন্য এ সংবাদ নিশ্চয়ই সুসংবাদ।
সম্প্রতি অভিনীত হলো ‘থিয়েটার আর্ট’ (‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’-এর আদিনাম)-এর কোটর্ মার্শাল। নাটকটি এই নামেই হিন্দি ভাষায় রচিত-অভিনীত। কলকাতায় এর সফল মঞ্চায়নের সংবাদও শোনা গেছে।
এস এম সোলায়মান নাটকটির রূপান্তর করেছে বাংলাভাষায়। শুধু বাংলাভাষায় নয়, বাঙালিসংস্কৃতির যে জায়গাগুলো সবচেয়ে স্পর্শকাতর, সেই জায়গাটায় আঘাত করেছে এবং বাংলাদেশের গত একুশ বছরের ইতিহাসের একটা যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায়ের যে কুটিল ষড়যন্ত্রগুলো জাতিকে কুরে কুরে খেয়েছে তাও যথার্থই তুলে ধরা হয়েছে।
কোর্ট মার্শাল সোলায়মানের আগের নাটকগুলোর চেয়ে একেবারে আলাদা। কমেডি, মিউজিক্যাল নির্মাণে অত্যন্ত দক্ষ সোলায়মান কোর্ট মার্শাল-এ একেবারে আলাদা। একটি সিরিয়াস বিষয়বস্তুকে একটি সেটের মধ্যে দুঘণ্টা টানটান করে রেখেছে। প্রতিটি মুহূর্ত শ্বাসরুদ্ধ হয়ে দর্শক সংলাপ শোনে। সংলাপই এই নাটকের প্রধান অবলম্বন। প্রতিটি সংলাপকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাদের বাচিক অভিনয় দিয়ে দর্শকের শ্রুতিতে পৌঁছে দিচ্ছে অনায়াসে। এ এক চমৎকার অভিজ্ঞতা।
কোর্ট মার্শাল সত্যিই কোর্ট মার্শাল। সেনাবাহিনীর একজন জোয়ানের কোর্ট মার্শাল কখনোই প্রকাশ্যে হয় না। হয় সেনাবাহিনীর ছাউনির ভেতরে। সেনা-আইনের আওতায় চলে এই আদালত। সেখানে বিচারক আছে, বাদি-বিবাদি পক্ষের উকিলও আছে। জেরা হয়, সাক্ষী নেয়া হয়, বাদ-প্রতিবাদ হয়। তারপর রায়ও হয় সেনাবাহিনীর আইনে। ওখানে আইনজ্ঞরাও থাকেন। কিন্তু সবটাই সেনাবাহিনীর ভেতরের ব্যাপার। বাইরের মানুষের জানবার কোনো উপায় নেই।
তবে কোর্ট মার্শাল আসলেই প্রতীকী। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যেসব আইন-কানুন তৈরি হয়েছে তার বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এখানে। কিন্তু এই কোর্ট মার্শাল ভিন্ন ধরনের। এ যেন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অব্যক্ত অধ্যায়।
আমরা সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে কথা বলি, সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের কথা বলি। সুদীর্ঘদিনের আন্দোলনের ইতিহাসও আমাদের রয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে কীভাবে স্বৈরশাসকের জন্ম হলো তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করি না। মাত্র একুশ বছর পেছনে তাকালেই আমরা একটা মুক্তিযুদ্ধ দেখতে পাই, যেখানে জনগণ আর সামরিক অফিসার এক সাথে যুদ্ধ করেছে, আবার ঐ সময় কিছু সামরিক অফিসার পাকিস্তানের হয়েও যুদ্ধ করেছে এবং ক্যাম্পে আটক থাকার পর দেশে ফিরে এসেছে। বিভাজনটা এখানেই হয়ে গিয়েছিল।
এই কোর্ট মার্শাল অবশ্য অভ্যুত্থানের কারণে নয়। একজন জওয়ানকে প্রতিদিন তার মায়ের নামে গালাগালি করায় পরিণামে একজন অফিসার ঐ জওয়ানের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়। কী সে গালাগাল! জওয়ানের মা একজন বীরাঙ্গনা, সেটাই তার অপরাধ। আর অফিসারটি তার আভিজাত্যের বড়াই করে। তার বাবা ছিল ‘শান্তি কমিটি’র লোক। জওয়ানটি প্রথমেই তার অপরাধ স্বীকার করে। এবং দুইঘণ্টার নাটকে বাদ-প্রতিবাদের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উন্মোচিত হয় দর্শকের সামনে। মৃত্যুর মুহূর্তে একজন নির্ভীক সৈনিক হয়ে মায়ের প্রতি যথার্থ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা রেখে মৃত্যুবরণ করে জওয়ানটি। আসামিপক্ষের ডিফেন্ডার মেজর মাহমুদ বিষয়টিকে শুধু নিছক শৃঙ্খলাভঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একের পর এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে থাকে। মাত্রাও যুক্ত হতে থাকে অবলীলায়। আত্মযন্ত্রণায় দগ্ধ হয় বিচারক কর্নেল। পেশাদার কমান্ডিং অফিসারও আবেগাপ্লুত হয়। মিথ্যে সাক্ষীরাও বাদানুবাদের সময় সঠিক তথ্য প্রকাশ করে ফেলে। সব মিলিয়ে জওয়ান আকবর দর্শকের আবেগ আর যুক্তিকে একটা সর্বোচ্চ বিন্দুতে নিয়ে যায়।
প্রযোজনাগত দিক দিয়ে এর বড় সাফল্য হচ্ছে এই যে, এস এম সোলায়মান ছাড়া প্রায় সবাই নতুন। কারও কারও হয়তো দু-চারটে নাটকে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আছে। আবার কেউ কেউ একেবারেই প্রথম নেমেছে মঞ্চে। শুধু একটি দৃশ্যপটের সামনে দুঘণ্টা বাচিক ও দৈহিক অভিনয় করে এরকম দুরূহ নাটককে ধরে রাখা সত্যিই কঠিন। এখানেই সোলায়মানের সার্থকতা। প্রথম থেকেই তার দলগঠনের প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে নতুনদের নিয়ে কাজ করাতেই তার আগ্রহ। এ নাটকেও তাই হয়েছে। সিপাহি আকবরের মধ্যে এক অদ্ভুত লাবণ্য আর কঠোরতার মিশ্রণ দেখা যায়। নতুন অভিনেতা প্রশান্ত হালদার দর্শকমনে এক মায়ার আবহ সৃষ্টি করে। গার্ডের মঞ্চ-পরিক্রমণই একটা অজানা আশঙ্কার ইংগীত দেয়। এখানেই তার সার্থকতা। বিচারক কর্নেল রাব্বির আত্মদহনের দৃশ্যটিতে তার সংলাপ আরও গভীরতা দাবি করে। কিন্তু কোর্টদৃশ্যে তার অভিনয় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। মেজর এফ এ খানের চরিত্রে এজাজ আহমেদের দৈহিক অভিনয়ের তুলনায় বাচিক অভিনয় একটু দুর্বল। তবে এ দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা খুব কঠিন মনে হয় না। সুবেদার মান্নানের মিথ্যে সাক্ষী দেয়া, ধরা পড়া এবং পেশাগত গৌরবের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়ার মুহূর্তগুলো চমৎকার। কামাল রায়হান এক্ষেত্রে যথার্থই সুবিচার করেছে। মেজর মাহমুদের চরিত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ নাটকে। দীর্ঘ সংলাপগুলোকে কনভিন্সিং করে তোলা, কখনো সংবেদনশীলতার সাথে, কখনো ক্রোধের সাথে ধমক, কখনো অনাবশ্যক চিৎকার, কখনো চ্যালেঞ্জ, আবার কখনো গভীর আবেগের সাথে অভিনয় করতে হয়। সোলায়মানের স্পিচের দক্ষতা এখানে লক্ষ করার মতো। দৈহিক অভিনয় ও শ্লথ-দ্রুত মুভমেন্টের সাথে সব ব্যাপারটাই সিনক্রোনাইজ করে গেছে। ক্যাপ্টেন ডাঃ রত্নার স্পিচে আরেকটু স্পষ্টতা প্রয়োজন, কিন্তু চরিত্রটির মুভমেন্ট তিনি ধরতে পেরেছেন। তবে অভিনয়ের ক্ষেত্রে টিমওয়ার্কটি প্রথম প্রদর্শনীতেই যথাযথ মনে হয়েছে।
মঞ্চনির্মাণটি খুবই বাস্তবানুগ করার প্রয়োজনে বেশি ম্যাসিভ হয়ে গেছে। তবে রঙের ব্যবহার দিয়ে মঞ্চের কিছু অংশ ঢেকে দিলে তীক্ষ্ণ রেখাগুলো ন্যাচারাল হয়ে যাবে। মঞ্চপরিকল্পক হেমায়েত বিষয়টিতে দৃষ্টি দেবেন। সংগীতে সোলায়মান নিজেও খুবই দক্ষ। তবুও নাটকের শুরুতে যে উঁচু পর্দা থেকে উচ্চাঙ্গসংগীতের ধাঁচে যে এফেক্টটা সৃষ্টি করা হয়েছে তা শুরুর অভিনয়ের জন্য একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়। অভিনেতার ঐ জায়গায় থেকে অভিনয় ধরাটা একটু কঠিন। এ ছাড়া সারা নাটকের আবহসংগীত ভালো। বিশেষ করে ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ গানটির ব্যবহার আবেগ সৃষ্টিতে খুবই সাহায্য করে। গানটি বৈতালিক হলে এবং যন্ত্রগুলোকে বাদ দিতে পারলে আরও হয়তো ভালো হতে পারে। সংগীতপরিকল্পনার দায়িত্বে রীমা রফিক এসব নিয়ে ভাবছেন আশা করি। পোশাকও অতিবাস্তব। এর হলুদ অংশটিকে যদি সবুজে নিমজ্জিত করা যায় তাহলে অভিনেতাদের চেহারাগুলোর তীক্ষ্ণ রেখা আরও দৃশ্যমান হবে। ঠাণ্ডু রায়হানের আলোকপরিকল্পনায় কোনো চমক নেই। কিন্তু স্বাভাবিক আলোতেই তিনি আবহ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। শেষদৃশ্যে আলোক প্রক্ষেপনে সৃজনশীলতা আছে। নাটকটির শিল্পমান, অভিনয়, দৃশ্যসজ্জা এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনার অবকাশ আছে। দর্শক, সমালোচকরা এসব নিয়ে ভাববেন আরো।
কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে নাটকটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রয়োজন আমাদের গণতান্ত্রিকরাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিকসংস্কৃতি নির্মাণের প্রয়োজনে। যে কথাগুলো আমাদের চিন্তানায়ক বা রাজনীতিকরা বলেন না, কোর্ট মার্শাল তা অবলীলায় বলে দিল- রাজনীতির জট খুলতে, আমাদের চিন্তার জট খুলতে এ নাটক অত্যন্ত সহায়ক হবে।
আমি পেশায় সমালোচক নই। আমিও একজন নাট্যকর্মী। থিয়েটার আর্ট আমাদের সহকর্মী একটি নবাগত দল। আমার এ লেখা সেই অর্থে সমালোচনা নয়। একটি মূল্যায়ন মাত্র। দলটির এই সাহসী পদক্ষেপ দর্শকের আলোচনায়, জনশ্রুতিতে, সমালোচনায় আরও গৌরবদীপ্ত হোক। প্রযোজনাও হোক আরও সমৃদ্ধ।
মামুনুর রশীদ ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যব্যক্তিত্ব