Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: লোক সমান লোক

Written by অপু শহীদ.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

নাটক: লোক সমান লোক। মূলরচনা: বের্টল্ট ব্রেখ্ট (ম্যান ইস্ত ম্যান)। অনুবাদ: আসাদুজ্জামান নূর। নির্দেশনা: ফ্রিৎস বেনেভিৎস। মঞ্চ ও আলোকপরিকল্পনা: কামরুজ্জামান রুনু। পোশাকপরিকল্পনা: কাজী সাইদা। আবহসংগীতপরিকল্পনা: শংকর সাওজাল। পোস্টার ডিজাইন: সৈয়দ ইকবাল। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৯৩। একটি ‘ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট (আইটিআই) বাংলাদেশ কেন্দ্র’ প্রযোজনা

[লোক সমান লোক নাটকের হাতি বিক্রি এবং আমাদের শিল্প সংস্কৃতি- শিরোনামের অপ্রকাশিত নাট্যসমালোচনাটি ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় প্রকাশ করা হলো]

বার্টোল্ট ব্রেখটের নাটক ম্যান ইস্ত ম্যান। রচনাকাল: ১৯২৪-১৯২৬। প্রথম অভিনয়: সেপ্টেম্বর ১৯২৬। এটিই বার্টোল্ট ব্রেখ্টের প্রথম সার্থক নাটক। প্রথম অভিনয়ের পরও কমপক্ষে দশবার নাট্যকার নিজেই নাটকটি কাটাকুটি করেছেন।

ঢাকার মহিলা সমিতি মঞ্চে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩ নাটকটি মঞ্চস্থ হলো। অনূদিত নামকরণ হয়েছে লোক সমান লোক। নির্দেশক ফ্রিৎস বেনেভিৎসের কঠোর নিয়ন্ত্রণে নাটকটি অনুবাদ করেন আসাদুজ্জামান নূর। এবং অভিনয় করেন ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’, ‘আরণ্যক নাট্যদল’, ‘থিয়েটার (বেইলি রোড)’, ‘অন্যদল’সহ বিভিন্ন দলের কর্মীরা।

মানুষ সমান মানুষ নয়। মানুষ বনাম মানুষ নয়। লোক সমান লোক। এর আগে কলকাতায় অঞ্জন দত্তের অনুবাদ ও প্রয়োগে মানুষ=মানুষ নামে মঞ্চস্থ হয়। ঢাকায় নাটকটি প্রযোজনা করে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট (আইটিআই) বাংলাদেশ কেন্দ্র।

ঢাকায় আমরা ইতোমধ্যে ব্রেখটের ১০-১২টি প্রযোজনা দেখেছি। ব্রেখ্টের নাটকে যে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বা দ্বান্দ্বিকতার উপস্থাপন তা সেইসব প্রযোজনায় ব্যর্থ হয়েছে। ফলত ব্রেখটের নাটক নিছক হাসির নাটকে পরিণত হয়েছে।

লোক সমান লোক নাটকটি ফ্রিৎস বেনেভিৎস আইটিআই-এর অতিথি-নির্দেশক হিসেবে নির্দেশনা দেন। তিনি ব্রেখ্টীয় নাট্যরীতির একজন নামকরা নির্দেশক এবং তাত্ত্বিক। এর আগে কলকাতায় তিনি গ্যালিলিও’র জীবন নির্দেশনা দেন। যাতে গ্যালিলিও’র চরিত্রে অভিনয় করেন শম্ভু মিত্র। পূর্বজার্মানির হাইমর ন্যাশনাল থিয়েটারের রেসিডেন্ট ডাইরেক্টর ফ্রিৎস বেনেভিৎস। তার সম্পর্কে আমাদের ঔৎসুক্য অনেক।

তিনি জার্মানি ছাড়াও আমেরিকা, ভারত, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভেনিজুয়েলাসহ বিভিন্ন দেশে নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন। লোক সমান লোক নাটকটি তিনি মহড়া করেন আড়াই মাস সময়কালব্যাপী। আমরা কয়েকজন থিয়েটারকর্মী আড্ডার অদূরবর্তী রাস্তায় অলস সকালে তাকে একদিন আবিষ্কার করি। বাজারের থলে হাতে হেঁটে যাচ্ছেন। ডান চোখ একটা কালো পট্টি দিয়ে ঢাকা। গায়ে ফুলহাতার ডোরাকাটা হাওয়াই সার্ট। হাতা গোটানো সৌম্যকান্তি, দেখতে নাদুস-নুদুস। চোখের পট্টির জন্য তাৎক্ষণিক আমাদের মনে হলো হলিউডের কোনো ছবির ভিলেন। পরে অবশ্য আমরা জেনেছিলাম, ছোটবেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়।

আমরা তখন জানতে পারি, অভিনেতা বাছাইপর্বে তার নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। বেশ কয়েকটি দলের নবীন-প্রবীণকর্মীদের সমন্বয়ে অভিনেতা ও কলাকুশলী নির্বাচন করা হয়। অভিনেতাকে তার কল্পিত চরিত্রের সঙ্গে মিলতে হবে। এতে করে আমাদের অনেক নামকরা অভিনেতা বাদ পড়ে যান। গেলি গে চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর, বেগবিক চরিত্রে সারা যাকের, উরিয়া চরিত্রে শংকর শাওজাল, বেকার চরিত্রে আজিজুল হাকিমের পাশাপাশি গেলি গে’র স্ত্রীর চরিত্রে রোকেয়া রফিক বেবী, জেসী চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু, জেরায়ে চরিত্রে গোলাম সারোয়ার, চার্লস চরিত্রে আজাদ আবুল কালাম অভিনয় করার সুযোগ পান। এছাড়া অন্যান্য সৈনিক চরিত্রে কামালউদ্দিন কবির, মোস্তফা মিথুন প্রমুখ দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেন।

নির্দেশকের সহকারী ছিলেন আসিফ মুনীর আর সহকারী নির্দেশক হিসেবে ছিলেন সালেক খান। মঞ্চ ও আলোকপরিকল্পনায় কামরুজ্জামান রুনু, সংগীতপরিচালনায় শংকর শাওজাল এবং পোশাকপরিকল্পনায় কাজী সাঈদা।

নাটকের আখ্যানভাগ গড়ে উঠেছে একদল সৈন্য ও গেলি গে নামক একজন কুলিকে কেন্দ্র করে। নির্বিরোধী এক সাধারণ মানুষ অবস্থার চাপে পড়ে ধীরে ধীরে হিংস্র মানুষে পরিণত হয়। সামাজিক চাপের মুখে ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। কিলকোয়াতে মহারানির সৈন্যবাহিনীকে জড়ো করা হচ্ছে যুদ্ধের জন্য। তারা জানে না যুদ্ধটা কার বিরুদ্ধে। আসল কারণ কাঁচামাল সংগ্রহ। যুদ্ধটা উপলক্ষ্ মাত্র।

লোক সমান লোক নাটকের গল্পে আমরা দেখি, গেলি গে’কে সৈন্যবাহিনীতে ঢোকাবার পরিকল্পনা হিসেবে গোলন্দাজরা গেলি গে’কে একটি হাতি উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং সে প্রতিশ্রুতি মতো দুজন সৈন্যের গায়ে একটি নকল মাথা লাগিয়ে, যা কোনোভাবেই হাতির ধারেকাছেও যায় না, তাকেই তারা গেলি গে’র কাছে হাতি বলে চালানোর চেষ্টা করে। গেলি গে হয়তো কোনোদিনই এটাকে হাতি বলে মেনে নিত না, যদি-না বিধবা বেগবিক এটাকে কিনতে চাইতো।

লোক সমান লোক নাটকের এই হাতি বিক্রির ব্যাপারটা শুধু একটা গল্পই নয়, ব্রেখটের কাছে এটাই ছিল পুঁজিবাদী সমাজের বাস্তবতা। পুঁজিবাদী সমাজে এখন যেটা যে নামে বিক্রি হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রকৃত-অর্থে সেটা আসলে সে জিনিস নয়। শিল্প-সংস্কৃতির প্রসঙ্গেই আসা যাক। শিল্প-সাহিত্যের নামে এখানে যা হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হলো লোক সমান লোক নাটকের হাতি বিক্রি। যা হাতি নয়, যা দেখতে হাতির ধারেকাছে দিয়েও যায় না, তাই যেমন লোক সমান লোক নাটকে হাতি বলে বিক্রি হয়, তেমনি যাতে শিল্প-সাহিত্যের ছিঁটে-ফোঁটাও নেই, তাই এখানে শিল্প-সাহিত্যের নামে বিক্রি হচ্ছে। কারণ তার ক্রেতা আছে।

গেলি গে প্রথম ঠিক বুঝেছিল যে, তাকে যেটা উপহার দেয়া হয়েছে সেটা কোনো হাতি নয়, কিন্তু যেই মাত্র উরিয়ার সাজানো খদ্দের বেগবিক যা হাতি নয় তাকেই হাতি হিসেবে কিনতে রাজি হলো, গেলি গে’র তখন আর হাতিটা সত্যি হাতি কিনা সে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন রইল না। ঠিক তেমনি আমাদের চলচ্চিত্র ও শিল্প-সংস্কৃতির দর্শক। যেখানে ক্রেতার ভিড় আছে সেখানেই তারা হাজির। যা শিল্প নয় কিন্তু প্রচারের জোরে যখন তাকে শিল্প বানানো হয়, এবং বিজ্ঞাপনের কারণে সেখানে ভিড় বাড়তে থাকে, তখন প্রায় প্রত্যেক দর্শকই অন্যেরা দেখছে বলে সেটা দেখে, অন্যেরা পড়ছে বলে সেটা পড়ে। পুঁজিবাদী সমাজে মড়ক লাগার মতোই বিজ্ঞাপনের জোরে এভাবে সর্বক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহ সংক্রামিত হয়। বিশ্বকাপ থেকে বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না সবকিছুতে একদল বুদ্ধিবাজ চতুর বেগবিকের মতোই তাদের দৃষ্টিকে, চিন্তাকে, বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বহুদিন আগে থেকেই যা চলচ্চিত্র নয়, তাকেই চলচ্চিত্র বলে চালানো হচ্ছে। এবং এক শ্রেণির দর্শক তা গিলছে। এসব চলচ্চিত্রের সাথে দর্শকের সম্পর্ক শিল্প ও সমঝদারের নয়। সম্পর্কটা হচ্ছে ব্যবসায়ী ও ক্রেতার। শিল্পের থাকে সমঝদার। শিল্প-সাহিত্যেও দর্শক বা পাঠক মানেই সমঝদার। সে ভোক্তা নয়। কারণ, সে ক্রয় করে না, সে রস আস্বাদন করে। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের অবস্থাও একই দিকে ধাবিত। আমাদের নাট্যাঙ্গন এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উরিয়াদের মতো মতলববাজদের দখলে, নাট্যসমালোচকসহ প্রায় সকলেই বেগবিকের মতো সুযোগসন্ধানী আর নাট্যদর্শকের বড় অংশ গেলি গে’র মতো বিভ্রান্ত। নানান অযোগ্যতা নিয়েও কিছু ধান্দাবাজ লোক নাট্যাঙ্গনের পুরোহিত সেজে বসে আছে। তারাই থিয়েটারের ধারক, বাহক এবং দিকপাল।

যারা বিয়ারের বোতলকে হাতি বলে বিক্রি করতে চায়। যথেচ্ছার চলছে, কিন্তু তবুও এর বিরুদ্ধে কিছুই বলবার নেই। যেহেতু ক্রেতা আছে অতএব যা খুশি বিক্রি কর। যত খুশি অশ্লীলতা খিস্তি ঢোকাও নাটকে। যারা এব্যাপারে এতদিন দূরে ছিল, তারাও এখন ক্রেতা পাবার জন্য বেচা-বিক্রি বাড়াবার জন্য সেই একই পথ ধরতে চাইছে। এদের কারো কাছেই আর সমঝদারের মূল্য নেই, এদের দরকার ভোক্তার, যারা পণ্য কিনতে আগ্রহী। প্রতিদিন এরা কিছু সাজানো বেগবিককে (পত্রিকা সমালোচক) ক্রেতা বানাচ্ছে, তাদের মুখে সেই পণ্যের প্রশংসা শুনে দর্শকও গেলি গে’র মতো প্রশ্নহীনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হাতি নামক সেই বিয়ারের বোতলের উপর।

যারা সত্যিকারের হাতি বিক্রি করতে এখানে আসে, তাদের চেয়ে যারা নকল হাতি বিক্রি করছে তাদেরই রমরমা বেশি। কারণ, নকল হাতি বিক্রির ক্ষেত্রে সব সময়ই পাওয়া যাচ্ছে বেগবিকের মতো দালাল খদ্দের। এবং বেগবিকের মতো দালালরা চমৎকারভাবে বিভ্রান্ত করে চলেছে দর্শককে। নকল হাতির রমরমার কারণে এখন আর সত্যিকার হাতিটাই বিক্রি হতে চায় না। একদিকে বোম্বের সিনেমা, অপরদিকে বাংলাদেশের সিনেমা এবং নাট্যাঙ্গনের ক্যারিকেচার দীর্ঘদিন ধরে দর্শকের চেতনাকে ভোঁতা করেছে। হোক সমাজ বিপ্লব কিংবা গণতন্ত্র বা স্বৈরাচার, সবকিছুরই নেতৃত্ব চলে যায় নষ্ট লোকদের হাতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রেফ মূর্খদের হাতে। কিন্তু লোক সমান লোক নাটকের মতোই এই মূর্খরা বুদ্ধিজীবী সেজে বসে আছে।

প্রিয় দর্শক-শ্রোতা এবার বিভ্রান্তি কাটিয়ে আসল হাতি আর নকল হাতি চিনতে শিখুন। কারণ, লোক সমান লোক নাটক আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। লোক সমান লোক নাটক আমাদের বলতে চায়, আমরা যেন উরিয়ার মতো ধূর্ত আর বেগবিকের মতো দালালদের খপ্পরে না পড়ি। যেন আমরা সঠিকভাবে আমাদের সাধারণ বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সঠিক এবং ভুল চিনতে পারি।

আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের এই প্রযোজনা ব্রেখটীয় নাট্যরীতির সঠিক প্রয়োগের উদাহরণ হয়ে রইল।

১৫.০৩.৯৩

অপু শহীদ ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যকার, নির্দেশক