Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: প্রাচ্য
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: প্রাচ্য। রচনা: সেলিম আল দীন। মঞ্চপরিকল্পনা ও নির্দেশনা: নাসির উদ্দিন ইউসুফ। আলোকপরিকল্পনা: ইশরাত নিশাত ও জহিরুল ইসলাম রিপন। পোশাক ও আবহসংগীতপরিকল্পনা: শিমূল ইউসুফ। পোস্টার ডিজাইন: আনওয়ার ফারুক। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০০০। একটি ‘ঢাকা থিয়েটার’ প্রযোজনা
[প্রাচ্য নিয়ে ঢাকা থিয়েটারের প্রাচ্য- শিরোনামে নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন আলমগীর খান। রামেন্দু মজুমদার-সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ পত্রিকার ২২-৩১তম বর্ষ ১ম সংখ্যায় (২০০০ এ প্রকাশিত) এটি ছাপা হয়। ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
সেলিম আল দীন শক্তিশালী নাট্যকার। তাঁর নাটকে প্রধানত গ্রামীণ মানুষের পারস্পরিক সহমর্মিতা, ঈর্ষা, শোষণ, সংগ্রাম, পরাভব, অশ্লীলতা, কাম, প্রেম, প্রতিশোধ, নিষ্ঠুরতা, আত্মত্যাগসহ জীবনের এক বিরাট ছবির উন্মোচন ঘটে। সে ছবি বহুব্রীহি-জীবনের উচ্ছল-গভীর-বীভৎস-সুন্দররূপের। লোকজ-শিল্পচর্চার আঙ্গিকের সঙ্গে আধুনিক-নিরীক্ষার মেলবন্ধন করতে চান তিনি। ‘ঢাকা থিয়েটারে’র এখনকার প্রযোজনা প্রাচ্য-তে তাঁর এ উদ্দেশ্য ও প্রচেষ্টা আরও বৃহৎ ও জটিল।
সেলিম আল দীনের নাটকে বহমান গ্রামীণ-জীবন-প্রবাহের চেয়ে তার ঘনীভূত রূপটি অর্থাৎ উৎসব-অনুষ্ঠানাদি অধিক পরিস্ফুট। লোকজ-নাট্য-আঙ্গিক ও আঞ্চলিক-ভাষাকে অবলম্বন করে হলেও তাঁর নাটকের বর্ণনা, চিত্রকল্প, উপমা ও উপস্থাপনা সহজ নয়। ফলে যে সাধারণ-মানুষের চর্চিত শিল্প-আঙ্গিক, ভাষা, জীবন ও পরিবেশ নিয়ে এই নাটকের রচনা, তাদের কাছে নাটকটি হবে দুর্বোধ্য। এটি শহুরে শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত নাট্যসচেতন দর্শকের জন্য একটি উপভোগ্য নাটক।
সাপের কামড়ে সদ্য-বিবাহিত এক বউয়ের করুণ মৃত্যুবিষয়ক একটি ছোট্ট উপাখ্যান নিয়ে এই নাটক। উপাখ্যানটির অন্তরালে শোষক ও শোষিতের মধ্যেকার যে সম্পর্ক নাটকটির কেন্দ্রীয়-বিষয়, বিচিত্র পাশর্^-ঘটনার ঘনঘটায় তা প্রায় ঢাকা পড়ে যায়। শেষপর্যন্ত এর মূল-আকর্ষণ নাট্যকারের হাতে প্রাচীন গ্রামীণ আচার-অনুষ্ঠানাদির হৃদয়গ্রাহী চিত্রায়ণ ও ‘ঢাকা থিয়েটারে’র কুশীলবদের অপূর্ব অভিনয় ও উপস্থাপনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
মঞ্চস্থ প্রাচ্য মূল-নাটকটি-অপেক্ষা দৈর্ঘ্যে কম। নাটকটির মৌলিক-বিষয়, শোষক ও শোষিতের মধ্যেকার সম্পর্ক, প্রযোজনাটিতে খুবই প্রচ্ছন্ন। মূল-নাটকটি মনোযোগসহ পাঠ করলেই কেবল এই অংশটি উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু নাট্যকারের অহিংসবাদী জীবনদর্শন একে পরিণতিতে দংশন করে পালায়। অথচ শোষক-শোষিতের সম্পর্কের এই গুরুত্বটি বিবেচনা না করলে নাটকটির শেষের ভিটে-খননের অংশটি হয় শুধু একটি রহস্যময় মুখরোচক শব্দ, জীবনের খনন।
প্রাচ্য-তে জীবন ও জগতের বৈপরিত্যের মাঝে ঐক্যের-সূত্র চিত্রিত। একটা ট্র্যাজিক সত্য-কাহিনি নিয়ে ‘মনসাপুরাণের উল্টা দিকটা’ বয়ান করেছেন সেলিম আল দীন। কন্যার বাড়িতে বরযাত্রীদের খাওয়ার অনুষ্ঠান থেকে নাটকের শুরু। বরযাত্রা নিয়ে ফেরার পথে সোমেজ মামা বলেন, ‘বিবাহযাত্রায় আর শেষযাত্রায় আকাশ-পাতাল মিল’। বাসরঘরে সর্পদংশনে নববধূ নোলকের মৃত্যুর ফলে অতি-দরিদ্র কৃষক ‘উলট লখিন্দার’ সয়ফর চানের বরযাত্রা শবযাত্রায় পরিণতি পায়।
হত্যাকারী সাপটিকে খুঁজে পেতে সয়ফর সারারাত ভিটে খুঁড়ে যখন ভোরের আলোয় হঠাৎ সাপটিকে দেখতে পেল, সে দেখে, ‘সাপটি তার দিকে তাকিয়ে সতর্ক হয়।...একবার বামে একবার ডানে নড়ে নড়ে ফণার প্রতাপ দেখায়। প্রতাপ না সৌন্দর্য-রাঙা বাহার। ফাল্গুনের ভোরের রাঙা-মেঘাবলি বিচিত্রিত কমলাবর্ণের ফণা। সে উদ্ভিদ। মাটি ভেদ করে উঠেছে। বৃক্ষরাও ভূমিভেদী বিচিত্র ফণা। সে ফণা দোলে চিকন-বাতাসে। কোনটা তবে কী থেকে পৃথক হবে। হায়, সয়ফর দ্বিখণ্ডিত হয়। তবে কে কার মতো। কিন্তু এই ঐক্য ক্রোধের কাছে এসে সরে যায়।’ তারপর সয়ফরের ক্ষুরধার ছেনি ও গোক্ষুর সাপের ক্রুদ্ধ-ফণার মধ্যে চলে বুদ্ধিমত্তা, ক্ষিপ্রতা, আত্মরক্ষা ও প্রতিশোধের ভয়ানক লড়াই। তখন প্রশান্ত-জলস্রোতের মতো শাদা শাড়িপরা বৃদ্ধা দাদী এসে সয়ফর ও বাস্তুসাপটির মাঝে এক অনতিক্রম্য ব্যবধান সৃষ্টি করেন। এক পাড়ে প্রতিশোধ-পরায়ণ সয়ফর, অন্যপাড়ে হত্যাকারী সাপ। ‘যে যার স্থানে থাকে। এই ছেনি এত দীর্ঘ না যে সে এক গাঙ পারায়া দিগন্তরেখার কাছে উদ্যত সাপের মাথা কাটবে। থর থর করে কাঁপে সে।...সাপটি ধীরে ফণা নামায়। তারপর লোকের নতুন কবরের ওপর দিয়ে শ্লথগতিতে বন্য-অন্ধকারে চলে যায়। সৌন্দর্য, ভয় ও রহস্য সবার অন্তরে সম্ভ্রম জাগায়। হত্যা ভুলে যায় তারা।’ নাট্যকারের বক্তব্য, ‘আমার মনে হয়েছে জীবনের তীব্র মুহূর্তে ক্রোধ, প্রতিহিংসা শেষ-অবধি প্রকৃতি-সংলগ্ন হয়ে যায়।’ নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ লিখেছেন, ‘প্রাচ্য’র দর্শন হলো প্রাচ্য-জনপদের হাজার বছরের জীবনদর্শনের একটি প্রতিফলন। বিষয়টিকে আমি এভাবেই দেখেছি। কিন্তু সেলিম-সৃষ্ট উপাখ্যানটি নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ। ক্ষমার শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতেই হয়ত সেলিম এমন একটি মর্মান্তিক গল্পের আশ্রয় নিয়েছে’। কিন্তু এখানে ক্ষমা অক্ষমতাহেতু শোষককে শোষিতের ক্ষমা, অন্যটি বদ্ধমূল-সংস্কারের বলি। নাটকটিতে জিতু মাতব্বর ও দংশনকারী বাস্তুসাপটি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। নিচের আলোচনা থেকে তা স্পষ্ট হবে।
সয়ফর, জিতু মাতব্বরের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিয়ে একটি গাভী কিনেছিল। কিন্তু ‘সে জানত না দুধ বেচে মহাজনের সুদ শোধ করা যায় না’। শেষমেশ দশ ডিসিম জমি দিয়ে গাভীটিকে মাত্র দুইহাজার টাকায় জিতু মাতব্বরের হাতে তুলে দিয়ে তবে সে জেল-পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পায়। ‘অসম্মান এই যে’, গ্রামের সালিশে শাস্তি নির্ধারিত হয়েছিল বলে ‘এ দুধ কামলাখাটা সয়ফরকে জিতু মাতব্বরের বাড়িতে দুইয়ে দিয়ে আসতে হতো’। আর অন্যদিকে সাপটি কেড়ে নিল তার জমির চেয়ে দামি সবুজ নিশাপরী নোলককে। সয়ফরের কণ্ঠে শোনা যাক, ‘অসম্মান করছে জগৎ-সংসার আমারে। বেবাকে আঙ্গুল তুইলা দেখাবে ঐ যে ব্যাটা রমু নাইঠ্যালের পুত যায়। বিয়ার রাইতে সাপে কাটছে বউ। জিতু মাতব্বরের বাড়িতে গিয়া গরু বেইচা নিজেই দুধ দোহায়া তাগরে রান্নাঘরে তুইলা দিয়া আসছে। কব ঐ যে যায় বাপের-দিন্যা দশ ডিসিম বান্ধা দিয়া বিয়া করছিল’।
সয়ফর তার বিয়ের খরচের টাকা ধার নিয়েছিল জিতু মাতব্বরের ছেলে আইজলের কাছ থেকে। বরযাত্রায় ফেরার পথে একবার অকস্মাৎ মতিভ্রমবশত সে মৃত জিতু মাতব্বরকে অদূরে দেখতে পায়, তার শেষ রবিশস্যের বন্ধকি জমিটা কেড়ে নিতে এসেছে। হত্যাকারী সাপটিকে খুঁজতে গিয়ে এমনি ভ্রমের শিকার হয়ে সে বৃথা একটি ছায়ার ফণাকে ছেনি চালিয়ে দ্বিখ-িত করে। সয়ফর একবার জিতু মাতব্বরকে খুন করার চেষ্টা করেছিল। এক ঘনকৃষ্ণ ঝোড়ো মেঘের রাতে ক্ষুরধার ছেনি হাতে আকন্দ গাছের ঝোপে লুকিয়েছিল সে জিতু মাতব্বরের হাট থেকে ফেরার অপেক্ষায়। কিন্তু পারে নি, জিতু মাতব্বরের টর্চ ও ছাতা নিয়ে ফিরছিল তার জামাই। নোলকের হত্যাকারী সাপের সন্ধানে সে ভিটার গর্তে সাপটিকে দেখে তার ক্ষুরধার ছেনি ঢুকিয়ে দেয় সাপের আঁইশে। ছিঁড়ে-খুঁড়ে যা আনে তা আদত সাপটি নয়, তার ছোলঙ-মাত্র।
মৃত্যুশয্যায় শায়িত জিতু মাতব্বর সয়ফরসহ গ্রামের জনে জনের কাছে ক্ষমা চায়। সয়ফরের দিকে শীর্ণ হাত বাড়িয়ে সে বলে, ‘সব কাইড়া নিছি তর, মাফ কইরা দে।...বেবাক মাতব্বর যা করে আমিও তাই করছি। জমি থাকলেই কেনাবেচা থাকে সয়ফর। আমি যাইতাছি। যে দশ ডিসিম জায়গা, গাইগরু এই বছর কাইড়া নিছিলাম বেবাক ফেরৎ দিলাম। আমার পোলা আইজল থাকল। তুইত বছর ঘুরতে আবার জমি বেচবি, তয় ঐ দশ ডিসিম তুই আইজলের কাছেই বেচিস। মাফ করছিস ত বাবা’। জিতু মাতব্বরের কবরের বাঁশের ছাউনি সয়ফরের বাবার কবরের বাঁশঝাড় থেকেই কেটে বানানো হয়েছিল। শীতকালে মাসকলাই বুনেছে সয়ফর জিতু মাতুব্বরের ‘নতুন কবরের পর যাতে কবরের গহ্বরে স্বর্গ-সবুজের আভা পৌঁছায়’। সে ‘গর্তে সান্দায়ে’ গিয়েছিল সকলের সম্ভ্রম নিয়ে। আর নাটকের শেষে দাদীর বাস্তুসাপ-সংক্রান্ত কুসংস্কার ও নাট্যকারের নিসর্গ চেতনার সুবাদে সাপটিও সকলের সম্ভ্রম জাগিয়েই আপন গর্তে সান্দায়ে যায়।
সাপ বাস করে ইঁদুরের গর্তে। সয়ফর নিজের বন্ধকী জমিটার মতো শোষণের এই গর্তে প্রবেশ করে নতুন করে মহাজনের সাথে তার সম্পর্কটা আবিষ্কার করে। সয়ফর বলে, ‘গর্ত থাকলে সাপ আছে। সাপ থাকলে ইন্দুর থাকে। ইন্দুর থাকে ধানের পিছে। ধান থাকলে ক্ষেত থাকে। ক্ষেত থাকলে ভিটা। ভিটার ওপর আকাশ ও ফণা’। এই ‘ফণা’ কি শুধু নিসর্গের শোভা, না মহাজনের চোখ? নাটকে কথক বলে, ‘এভাবে নিসর্গের সঙ্গে মৃত্যুকে, সাপকে অনিবার্যসত্তায় লীন করে ফেলে সয়ফর’। এভাবে সেলিম আল দীন আমাদেরকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেন। সেলিম আল দীন বড়-মাপের শিল্পী বলেই তাঁর সয়ফর চান চেতনাগতভাবে জিতু মাতব্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং বৃদ্ধা দাদীর বাস্তুসাপ-সংক্রান্ত কুসংস্কারের সুযোগে বেঁচে যায় সাপটি। কিন্তু কেন সয়ফরের ভিটে খননের বিরুদ্ধে ‘এই আকাশ-স্পন্দিত নক্ষত্র নিয়ে সুপারির গাছটায় দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে না না না’? এই বেঁচে যাওয়াকে বৃহত্তর অর্থ দিতে গিয়ে সমাজের শোষণরীতিকে এভাবে বিশ^-প্রকৃতির রীতির সঙ্গে একাকার করে দেন তিনি।
ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে সয়ফর একটি মৃত ইঁদুর টেনে বের করে। ‘হত্যাকারী সাপ লোককে দংশন করে পালাবার সময় এই ইঁদুরটাও শ্যাষ করে দিয়ে গেছে’। তাই বলে জিতু মাতব্বর সয়ফরকে শোষণ করে- পালাবার পথে নয়। তারপর ‘সে চিৎ করে শোয়ায় ছিন্নভিন্ন ইঁদুরটাকে।...সে খোঁড়া বন্ধ করে একদৃষ্টে চিৎ হয়ে ইন্দুরটাকে বড় হতে হতে তার সমান হয়ে যেতে দেখে। এমনকি ইন্দুরের স্থলে নিজেকেও দেখে। ঠিক এই রকম নগ্ন ছিন্নভিন্ন শরীর। হঠাৎ সে বলে, আইজল মিয়া বন্ধকী জমিখান কিনলে তবে আমার থাকে কী? সয়ফর নিজেকে ইঁদুরের সাথে একাত্ম করে রাখে। এখানে নাট্যকার বলছেন, ‘কিন্তু চার-পায় ইন্দুর আর আঁইশওয়ালা কালনাগ এক নয়। একটা শিকার অন্যটা শিকারী। চির চির অযুত নিযুত বৎসর এই রীতি’। না। সভ্যতার বিকাশে একটা স্তরে সমাজে শোষণের উদ্ভব, অন্য একটা উন্নতস্তরে আবার তার বিলুপ্তিও অবশ্যম্ভাবী। শোষণব্যবস্থা সমাজের চিররীতি নয়।
প্রাচ্য-তে জিতু মাতব্বরের মৃত্যুর পর তার ছেলে আইজল তার স্থান দখল করে। সেলিম আল দীন আধুনিক নাট্যকার। তাঁর কাছে কেবল অতীতের হুবহু চিত্র পেলে প্রত্যাশা পূরণ হয় না। কোন কোন শক্তির বলে সেই পুঁথিপড়া মনোরম অতীত ও নিষ্ঠুর-শোষণের রূপ বদলে যায় ও বর্তমানে তা কী রূপ পরিগ্রহ করে তা তাঁর নাটকে অনুপস্থিত। এখন গ্রামে ক্ষুদ্রকৃষক আর দরিদ্র মানুষদেরকে ঋণ দেয় আইজলের পরিবর্তে বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিওসমূহ। শুধু এখন ঋণের দলিলে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের টিপসহির বদলে নামসহি লাগে। এই শোষণপ্রক্রিয়া এখন এত সুক্ষ্ম ও জটিল যে শোষণকারীকে জিতু মাতব্বরের মতো চোখের সামনে যায় না। যাদেরকে দেখা যায়, লুটেরা নব্য-ধনিক-শ্রেণির সমাজব্যবস্থায় তারা যেমন সন্ত্রাসি, বিদেশি ফর্মুলায় উন্নয়নবাদী, আমলা, এমনকি মুৎসুদ্দি পুঁজির ক্ষুদে মালিকরাও একই সাথে শোষক, শোষিত ও শোষণের পাইপ লাইন। সয়ফরের ‘এই ছেনি অত দীর্ঘ না যে’ তা দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে। প্রয়োজন শোষকের প্রকৃতচিত্রটা তুলে ধরে মানুষের চেতনা ও আশার প্রদীপ জ্বালানো।
বর্তমান আলোচনাতে নাটকটির উদ্ধৃত অংশসমূহ নেয়া হয়েছে ‘দুই বাংলার থিয়েটার’-এ (সেলিম রেজা সেন্টু সম্পাদিত, ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯) প্রকাশিত প্রাচ্য থেকে। নাটকটি দৈর্ঘ্যে স্বল্পতর। তথাপি ভিটের ইঁদুরের গর্তখুঁড়ে সাপ খোঁজার দৃশ্যটি যথেষ্ট দীর্ঘ, বিশেষত অর্থের অস্পষ্টতার কারণে ক্লান্তিকর। বিষ নামানো উপলক্ষে ওঝার দৃশ্য ও মৃতকে ঘিরে আত্মীয়স্বজনের কান্না নিরর্থক বিস্তৃত, নাটককে অর্থবহ করে তোলার ক্ষেত্রে যার কোনো ভূমিকা নেই। গ্রামেও এখন সাপকাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য ডাক্তার আনা হয়। ওঝাও আনা হয় তবে অতি পশ্চাৎপদ কিছু গ্রাম ব্যতীত বিষবৈদ্যদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন লম্ফঝম্ফ এখন আর প্রচলিত নেই। নাটকটির এই চিত্রায়ণ স্বাধীনতাপূর্ব বা ঠিক তৎপরবর্তী সময়ের। কিন্তু শিক্ষাবিস্তার, বিদ্যুতায়ন, সরকারি প্রচারণা, এনজিওদের কার্যক্রম ও গ্রামের দরিদ্রমানুষের শ্রমের পণ্য নিয়ে বিদেশযাত্রা এ রকম বহু কুসংস্কার থেকে মানুষের মনকে মুক্ত করেছে। দেখা যায়, সেলিম আল দীনের নাটকে আমরা অতীতের প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করি, ফেলে-আসা দিনগুলোর জন্য বিষণ্ন হই, শিকড়বিচ্ছিন্ন-সত্তার গভীরে ছিন্নসূত্রের টানও পাই; কেবল এগিয়ে যাবার প্রেরণা পাই না।
নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বেশ জটিল একটি নাটককে অত্যন্ত সহজ-সরল উপকরণ ও সংযতউপস্থাপনাশৈলী দিয়ে উপভোগ্য করে তুলেছেন। সয়ফরের ভূমিকায় শহীদুজ্জামান সেলিম, নোলকের ভূমিকায় রোজী সিদ্দিকী, সুরুতালির ভূমিকায় ফারুক আহম্মেদ, ফিরোজা ও রুমার ভূমিকায় অদিতি গুপ্তা, ইস্রাফিলের ভূমিকায় শাহরিয়ার আখতার, এছাড়া নাসরিন নাহার, শিল্পী সিদ্দিকা, চন্দন চৌধুরী ও পালকিনৃত্যক মাহমুদুর রহমান শুভ-সহ প্রায় সকলের অভিনয় হৃদয়গ্রাহী। কথক হিসেবে দুই অভিজ্ঞশিল্পী পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিমূল ইউসুফ নাটকটির বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহকে একসূত্রে গ্রথিত রেখেছেন।
প্রাচ্যর অনেক দৃশ্য, যেমন, মৃত্যুশয্যাশায়ী জিতু মাতুব্বর, নববধূর বিদায়, মাতব্বরকে হত্যার জন্য ছেনি-হাতে সয়ফরের বৃথা অপেক্ষা, গুদারাঘাটের বাকবিতণ্ডা, নববধূকে ঘিরে কিশোরীদের সরল হাস্যরস আশ্চর্য নৈপুণ্যে ও আন্তরিকতার সাথে অঙ্কিত ও অভিনীত। আঞ্চলিক-ভাষায় রচিত সেলিম আল দীনের নাটকের সংলাপ গীতল, চিত্র-কল্পময়, শক্তিমান ও হৃদয়ের অন্তস্থলস্পর্শী। নাট্যকারের ঐতিহ্যসংলগ্নতা, জীবনঘনিষ্ঠতা ও শিল্পীদের অভিনয়গুণে নাটকটির অনেক দৃশ্য ও সংলাপের স্মৃতি বহুদিন মনের আয়নায় লেখা থাকবে। সেলিম আল দীনের কাছে অনেক প্রত্যাশা ও ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ রইল।
আলমগীর খান: নাট্যসমালোচক