Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: নিত্যপুরাণ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: নিত্যপুরাণ। রচনা ও নির্দেশনা: মাসুম রেজা। মঞ্চপরিকল্পনা: কামালউদ্দিন কবির। আলোকপরিকল্পনা: নাসিরুল হক খোকন। পোশাকপরিকল্পনা: শাহনেওয়াজ কাকলী। আবহসংগীতপরিকল্পনা: ইমামুর রশীদ খান। রূপসজ্জা: শুভাশীষ দত্ত তন্ময়। পোস্টার ডিজাইন: শুভাশিস মজুমদার। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০০১। একটি ‘দেশ নাটক’ প্রযোজনা
[নতুন করে আগল ভাঙ্গল নিত্যপুরান- শিরোনামে নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন আতাউর রহমান। তাঁর নাট্যসমালোচনা-গ্রন্থ ‘পাদপ্রদীপের আলোয়’ থেকে সংগ্রহ করে নাট্যসমালোচনাটি ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
মঞ্চে নাটক দেখা নিয়ে আমার ২০০১ সনের সূচনা খুব ভালো। অতি-সম্প্রতি মহিলা সমিতি মঞ্চে মাসুম রেজা রচিত ও নির্দেশিত ‘দেশ নাটক’-প্রযোজনা নিত্যপুরাণ দেখলাম। এক কথায় নিত্যপুরাণ একটি অসাধারণ নাট্যরচনা। বেশ কিছুকাল ধরেই আমি মাসুম রেজার ভক্ত হয়ে পড়েছি, বিশেষ করে নাটক-রচনার ক্ষেত্রে। মঞ্চের জন্যে তাঁর পূর্বতন রচনা আরজচরিতামৃতও আমার মন জয় করেছে। মাসুম রেজা টেলিভিশনের জন্যেও ভালো নাটক লিখে আসছেন বেশ কিছুকাল যাবৎ। নতুন প্রজন্মের এই নাট্যকার আমার মনে বিপুল আশার সঞ্চার করেছেন। স্বাধীন-বাংলাদেশে আমরা অন্তরের তাড়নায় যে নাট্যচর্চা শুরু করেছিলাম তা বৃথা হয়ে যায় নি বলে মনে হয়। নিয়মিত নাট্যচর্চার প্রায় ত্রিশ বছরের প্রান্তে আমাদের মঞ্চনাটকের সার্বিক অবস্থা নিয়ে হতাশা আর নেতির কথা শুনে আসছি। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিত্যপুরাণ দেখে আমার মনে হয়েছে আমাদের নাট্যপ্রয়াস আবার উন্মুক্ত আকাশে পাখা মেলতে শুরু করেছে। মহাভারতের আখ্যান নিয়ে রচিত বেশ কিছু ভালো প্রযোজনা আমি দেশে ও বিদেশে দেখেছি। তুলনায়, রচনার দিক থেকে আমার নিত্যপুরাণ-কে শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে। আমার তরুণ বয়সে পড়া বুদ্ধদেব বসুর মহাভারতের কথা আমাকে অভিভূত করেছিল। বুদ্ধদেব বসুর হিরো অর্জুন বা ভীমসেন নন, যুধিষ্ঠির, যিনি দোষেগুণে একজন গৃহী-মানুষ। পাশাপাশি ত্যাগে, লোভে, দুর্বলতায়, দার্ঢ্যে যুধিষ্ঠির একজন দ্বন্দ্বময়-মানুষও বটে। এই দ্বন্দ্বময়তাই মনে হয় জীবনের মূলবিষয় যা জীবনকে জঙ্গম করে তোলে, অর্থময়তা দান করে। মানুষতো দেবতা বা অপদেবতা নয় যে তার মধ্যে অনড় ও অচল এক সত্তাকে দেখে আমরা তৃপ্ত হব। সবলতার পাশাপাশি দুর্বলতা মানুষকে মানুষ নামের উপযোগী করে তোলে। এইভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে উপলব্ধি করার বোধ দানের কৃতিত্ব অবশ্যই বুদ্ধদেব বসুর।
‘একলব্য’ সংবাদ মহাভারতের একটি সংক্ষিপ্ত আখ্যান। মাসুম রেজা মহাভারতের এই অচ্ছুত তরুণকে পঞ্চপাণ্ডব, দ্রোণাচার্য এবং দ্রৌপদীর সহ-উপস্থিতিতে আমাদের কাছের ও প্রাণের মানুষ করে গড়ে তুলেছেন। নাট্যকার দুঘণ্টার সময়সীমার মধ্যে সমগ্র-নাটকের শরীরজুড়ে এঁকেছেন ‘টু বি’ আর ‘নট টু বি’ এক ঊর্ণাজাল, যার ভিতরে আমি দেখতে পেয়েছি আমার করোটির ভিতর থেকে উদ্ভূত নিত্যকার প্রশ্নমালার উদ্বাহু-সমাধানহীন মিছিল। আমি যুগপৎ বিদ্ধ ও উদ্বেলিত হয়েছি প্রশ্নবানের অভিঘাতে। জীবন-দর্পণের ধোঁয়াশা, কুয়াশা, প্রহেলিকা এবং কুহেলিকাময় দিকের এমন মূর্তরূপ আমি আগে কখনো দেখি নি। রবীন্দ্রনাথের কথার প্রতিফলন আমি দেখতে পেয়েছি এ নাটকে- মেলে নি উত্তর। দেখতে পেয়েছি অদিপাউসের অমোঘ সংলাপের প্রতিধ্বণি- যতক্ষণ না মানুষ পার হয় তার আয়ুর সীমান্ত ততক্ষণ যেন বোল না কেউ সুখী। আবার অন্য কিছু অনুভবেরও প্রতিফলন আমি দেখতে পেয়েছি নিত্যপুরাণ-এ। যেমন, যে মানুষটির বীর হওয়ার কথা নয় তিনিই বীর বনে যান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং যার কাপুরুষ বলে ধিকৃত হবার কথা তিনি হিরো হয়ে যান ঘটনাচক্রে। মানুষের অর্জনের স্বীকৃতি সব মানুষই পেতে চায়- কেউ পায়, কেউ পায় না। প্রাপ্য অর্জনের জন্য মানুষের যে নিরন্তর সংগ্রাম, তারই এক বিক্ষত রূপ আমরা দেখতে পাই নিত্যপুরাণ প্রযোজনায়। এই সংগ্রাম চলেছে, চলবে। এই সত্য প্রতিষ্ঠাকল্পে গ্রিক দেবতা প্রমিথিউস থেকে শুরু করে একলব্যদের চরম-মূল্য দিতে হয়েছে যুগে যুগে, ভবিষ্যতের একলব্যদের সম-অধিকারদানের জন্যে। নাট্যকার এই নাটকে সূতপুত্র কর্ণের প্রসঙ্গ এনে উল্লেখিত বক্তব্যকে আরও শাণিত করেছেন।
মাসুম রেজার নাট্যভাষায় পূর্বতন শক্তিধর কয়েকজন নাট্যকারের প্রভাব লক্ষ করেছি। শিল্পকাজ লেনদেনের মধ্য দিয়েই এগোয়। তবে প্লট-রচনা ও তাকে যথার্থ পরিণতিতে পৌঁছে দেয়ার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব নাট্যকারের। ‘দেশ নাটকে’র নিত্যপুরাণ প্রযোজনা সহজ ও ছিমছাম। নাট্যকার নিজে নির্দেশক না হলে এ নাটকের উপস্থাপনা হয়ত আরেকরকম হতে পারত, সে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রসঙ্গ। প্রযোজনা যা হয়েছে. তাকে উপেক্ষা করা যায় না। নাটকীয় উদ্ভাবনা যা ব্যবহৃত হয়েছে, বিশেষ করে বিভিন্ন অস্ত্রচালনার ক্ষেত্রে, সেগুলো মনোগ্রাহী- যদিও তাতে দেশ-বিদেশের দু-একটি নাট্যপ্রযোজনার প্রভাব দেখা যায়। এ প্রযোজনার সংগীত, আলো, সেট ও পোশাকপরিকল্পনার কোনো খামতি চোখে পড়ে নি। তবে কুশীলবেরা সবাই বাচনিক ও দৈহিক অভিনয়ে সমান পারঙ্গম নন। কেন্দ্রীয় চরিত্র একলব্যের ভূমিকায় দিলীপ চক্রবর্তী প্রশংসনীয় অভিনয় করেছেন। আমি মনে করি উনি আমাদের মঞ্চের একজন সম্ভাবনাময় ভালো অভিনেতা। কোরাসের ভূমিকায় বিশেষ করে অভিনেত্রীরা বাচনিক ও দৈহিক অভিনয়ে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন।
‘দেশ নাটকে’র প্রযোজনা নিত্যপুরাণ-এর প্রদর্শনী দেশের প্রতিটি নাট্যকর্মীর দেখা কর্তব্য- জানার জন্য, আনন্দ পাবার জন্য।
আতাউর রহমান ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যব্যক্তিত্ব