Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: জ্যোতিসংহিতা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: জ্যোতিসংহিতা। রচনা: রুমা মোদক মঞ্চ-আলোক-আবহসংগীতপরিকল্পনা ও নির্দেশনা: সুদীপ চক্রবর্তী। পোশাকপরিকল্পনা: ওয়াহিদা মল্লিক জলি। রূপসজ্জা: শুভাশীষ দত্ত তন্ময়। পোস্টার ডিজাইন: কমল পাল। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০১২। একটি ‘জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী’ প্রযোজনা
[হবিগঞ্জের ‘জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী’ প্রযোজনা জ্যোতিসংহিতা নাটকের এই নাট্যসমালোচনাটি ভাটির বীর জগৎজ্যোতি দাসের জলছবি- শিরোনামে ছাপা হয়। ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
সিলেট বিভাগে যখন শিল্পমানোত্তীর্ণ নাটকের ক্রান্তিকাল, তখন নিরবচ্ছিন্ন নাট্যচর্চায় স্বকীয় অবস্থান সংহত রেখেছে হবিগঞ্জের ‘জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী’। এই পরিচয় যেমন গৌরবের, সমানভাবে দায়বদ্ধতারও বটে। দলটির যাত্রা শুরু ১৯৮৬ সালে। সেই থেকে তাদের নতুন নতুন নাট্যনির্মাণের প্রচেষ্টা দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে। ১৯৮৬ থেকে ২০১৬, দীর্ঘ ৩০ বছরের কর্মমুখর নাট্যপথচলায় ‘জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী’ মুখোমুখি হয়েছে নানা সম্ভাবনা ও সংকটের। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য ও শিল্পবিশ্বাসকে সাথি করে বৈচিত্র্যময় আর নিরীক্ষাধর্মী নাট্যপ্রযোজনায় ঋদ্ধ হয়ে চলেছে নাট্যদলটি। রুমা মোদকের রচনায়, সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় আর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় দলটি মঞ্চে এনেছে তাদের ৩৫তম প্রযোজনা জ্যোতিসংহিতা।
‘তারুণ্যের অন্তহীন যাত্রা’ আহ্বান নিয়ে প্রযোজনাটি মূলত গবেষণাধর্মী ও নিরীক্ষার ছায়ায় বর্ণনাত্মক ধারার নাট্য-উপস্থাপনা। রুমা মোদকের এই নাটক কেবলই সরল নাট্যরচনা নয়। ভাটি-বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জগৎজ্যোতি দাস ও কিংবদন্তিসম তাঁর দাস পার্টির অদম্য যুদ্ধগাথা জ্যোতিসংহিতা বিস্মৃতপ্রায় এক যোদ্ধাকে ইতিহাস থেকে খুঁজে আনার প্রয়াস, প্রয়াস সমকালীন-প্রজন্মকে আত্ম-অনুসন্ধান আর আত্মপরিচয়ের মুখোমুখি দাঁড় করানোর। শহিদ জগৎজ্যোতিকে নিয়ে নাট্যরচনা তাই কেবলই একটি শিল্পপ্রয়াসে সীমাবদ্ধ থাকে নি। বরং হয়ে উঠেছে এক অনিবার্য অনুসন্ধানী দর্পণ। যে দর্পণের মুখোমুখি আমরা স্বাধীনতার সুফলভোগী মানুষ বারবার তাড়িত হই প্রায় অনুচ্চারিত কিন্তু অবশ্যম্ভাবী এক প্রশ্নের। স্বপ্নের স্বদেশে এই বীর যোদ্ধারা কি অভিষিক্ত হয়েছেন যথার্থ মর্যাদায়? সাধারণ-মানুষের সারি থেকে উঠে আসা কাদামাখা বীর যোদ্ধাদের কেন জোটে নি বীরত্বের সর্বোচ্চ খেতাব? পাকিস্তানি হানাদারদের বিরাট বহরের সঙ্গে মুখোমুখি তীব্র লড়াইয়ে ভাটির বীর জগৎজ্যোতি দাসের শহিদ হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকার কর্তৃক ঘোষিত মর্যাদা কেন স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে মুছে গেল? নাট্যক্রিয়া, কথা আর বর্ণনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আদৌ এসব খেতাব, পদক বা মর্যাদা পাওয়ার জন্য তাঁরা জীবনপণ করে যুদ্ধে আসেন নি। তবে তাঁরা কী চেয়েছিলেন? যে চেতনায় উন্মাতাল হয়ে যুদ্ধের ময়দানে অগণিত মানুষ, যে চেতনা পতপত উড়েছে রক্ত আর সম্ভ্রমে-ভেজা বাংলার বুকে ১৬ ডিসেম্বরে, যা দিয়েছে স্বাধীন ভূখ-, তা বিকশিত না হয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল? এমন প্রশ্নের জন্মভূমি হয়ে ওঠে জ্যোতিসংহিতা।
নাট্যভাষাটি রচনার জন্য রুমা মোদক কোনো একটি প্রামাণ্য-গ্রন্থের সাহায্য না নিয়ে সংগ্রহ করেছেন ভাটি বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ জগৎজ্যোতি দাস সম্বন্ধে প্রাপ্ত নানা তথ্য-উপাত্ত, জীবিত সহযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার। এ ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শন করেছে অপূর্ব শর্মা সংকলিত জগৎজ্যোতি দাসের জীবনীগ্রন্থ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জগৎজ্যোতির বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা ইলিয়াস আলীর। সৃজনশীলতা আর শিল্পবিশ্বাসের সমন্বয়ে ইতিহাস থেকে বিচ্যুত না হয়ে ঐতিহাসিক চরিত্র নির্মাণ হয়ে উঠেছে অনবদ্য শিল্পমানানুসারী।
সুদীপ চক্রবর্তী নাটকটি নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় এনেছেন অভিনবত্বের বহুমাত্রা। যুদ্ধগাথা উপস্থাপনে বন্দুক, কামান বা এলএমজির প্রচলিত উপকরণের পরিবর্তে ব্যবহার করেছেন প্রতীকী উপকরণ। যে উপকরণ তিনি গ্রহণ করেছেন, তা ভাটি বাংলার যাপিত-জীবনের সঙ্গে আবশ্যিক অনুসঙ্গ হয়ে মিশে আছে নিত্য। প্রায়োগিক-অভিনবত্বে মাছ ধরার জাল হয়ে উঠেছে পাকিস্তানি বধের অন্যতম হাতিয়ার, পলো বা বাঁশের লাঠি হয়ে উঠেছে রাজাকার-দমনের দুর্নিবার এলএমজি। এ যেন এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। অদম্য তরুণ যোদ্ধাদের যুদ্ধগাথা পরিবেশনে এসব উপকরণের সার্থক প্রয়োগ দর্শককে মুখোমুখি করে মুগ্ধ বিস্ময়ের।
দৃষ্টিনন্দন ও অনন্য শৈল্পিকতাময় নাট্যপ্রযোজনাটি মঞ্চে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে ‘জীবন সংকেতে’র একঝাঁক তরুণ-উদ্যমী-শিল্পীর শ্রমে আর মেধায়। অপূর্ব তাদের যুথবদ্ধ কর্মযজ্ঞ। অনবদ্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর একুশ শতকের একদল নাট্যতরুণ এবং মুক্তিযুদ্ধকালের একদল জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে-পড়া তরুণ-যোদ্ধার অদম্য যুদ্ধগাথা যেন একাকার হয়ে যায় পরিবেশনায়। জগৎজ্যোতির তারুণ্যের গৌরবগাথা যেন মঞ্চালোকে গেয়ে যায় কালে কালে সব তারুণ্যের জয়গাথা, আর এই বিশ্বাসে স্থিত করে যে, সর্বকালেই তারুণ্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।
আতিকুল ইসলাম ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক