Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটার : কিছু আলো কিছু অন্ধকার

Written by অপু শহীদ.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

এই লেখা থেকে হয়তো উন্মোচিত হবে না চিন্তা রাজ্যের একটি ঘুলঘুলিও। তবু আমরা যারা ছোট গণ্ডির মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেদের মনোজগতের ব্যাসের মধ্যে চেনা মানুষ পার হয়ে দেশ সমাজ পৃথিবীর বয়ান নিয়ে উপস্থিতি জানাই- তাদের এক সবিনয় স্মৃতি-সম্মেলনের সম্ভাবনা থেকে যাবে। দেখার বিবিধ চশমা আবিষ্কারের পূর্বেই ঢুকে পড়েছিলাম থিয়েটারে। তাই খোলা চোখে কিছু আলো কিছু অন্ধকার দেখবার সুযোগ ঘটে যায়। থিয়েটার নিয়ে সেই মায়াঘোরবিভ্রমের দিনগুলোতে ফিরে তাকালে দেখতে পাই স্বৈরাচার নিপাত যাক, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সমাজবদলের হাতিয়ার, কবিতা পরিষদ, মিছিল, কারফিউ, জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক।

থিয়েটারের আকাশ অনেক বড়। অসংখ্য নক্ষত্ররাজি সেখানে বিরাজ করে। দাঁড়িয়ে আছি একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষে। এখানে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে দেখবার চেষ্টা করি। কতটুকুই-বা দেখি। দেশের বাইরে এবং দেশের ভিতরে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ হয়তো দেখা হয় কিন্তু নিয়মিত খোঁজখবর রাখা হয় ঢাকার শিল্পকলাকেন্দ্রিক এবং ইদানিং আবারো মহিলা সমিতিকেন্দ্রিক প্রযোজনাসমূহের।

আমরা যেখানে ‘দাঁড়িয়ে’ আছি কথাটা একটু স্পষ্ট করা যাক। অর্থাৎ কোন সময়ে দাঁড়িয়ে আছি। সবকিছু ভেঙে পড়ার সময়। লক্ষ বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজের ভেতর যে শৃঙ্খলা তৈরি করেছিল তা ভেঙে পড়ছে। হাজার বছরের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, রুচিবোধ, রাতারাতি পাল্টে যাচ্ছে। ভার্চুয়াল পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ। বিজ্ঞানের চেয়ে এখন প্রযুক্তি অনেক বড়। অসীম ক্ষমতাধর। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সকলে প্রযুক্তির রথে চড়ে বসেছি। গতি বাড়তে বাড়তে বায়ুর গতি, প্রকৃতি, আলোর গতি সব ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির ধর্ম হলো সব একসাথে গড়া। সবাই এক ভাষায় কথা বলুক একভাবে চিন্তা করুক, একই খেলা সবাই দেখুক। একজন বাঙালির আর বাঙালি থাকার দরকার নেই। একজন মঙ্গোলিয়ার মঙ্গোলিয় থাকার দরকার নেই। সবাই বিশ্বমানব হয়ে উঠুক। ঐতিহ্যের পরম্পরায় স্থানীয় বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত করে দিয়ে একই সংস্কৃতি চালু করুক। সবাই একসঙ্গে একই আনন্দে মেতে উঠুক। মানুষ কোথায় বাস করবে, কাকে জীবনসঙ্গী করবে, কী পেশা বেছে নেবে, সংসার করবে নাকি লিভ টুগেদার করবে, সমকামী হবে নাকি বহুগামী হবে, না এক সঙ্গী নিয়ে পড়ে থাকবে, নাকি একাই জীবন যাপন করবে- সবই এখন অনিশ্চিত এবং গুরুত্বহীন। সব ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে।

আমরা অনাধুনিক ছিলাম। আধুনিক হলাম। এরপর আধুনিকতা পার হয়ে উত্তরাধুনিক। এখন আবার উত্তর উত্তর আধুনিক। আধুনিকতায় আমরা ঈশ্বরের ভূমিকাকে অস্বীকার করেছিলাম। বলেছিলাম মানুষই সব। তারপর আমরা ঈশ্বরের আসনে বসালাম বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি জেনেটিকমুক্ত মানবশিশুর জন্ম দেবে। মানুষ লক্ষ বছরের প্রকৃতিকে ভেঙে কল্পনার প্রকৃতি গড়ে নেবে। বিজ্ঞান প্রাণ সৃষ্টি করতে পারবে এরকম একটা জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি।

এই কথাগুলো বলে নিলাম এই কারণে যে, আমাদের থিয়েটারের নাট্যকার-অভিনেতা-নির্দেশক-সমালোচক-দর্শকের মধ্যে প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিককাল সমানভাবে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়াশীল। এর আবার একটা গালভরা কাব্যিক নাম আছে সর্বমতে সহমত। বর্তমানে দাঁড়িয়ে ৩০-৩৫ বছর পেছনে তাকালে দেখতে পাই, অনেকগুলো প্রজন্ম এখনও সক্রিয়। স্বাধীনতাকে একটা কাল স্তম্ভ ধরে নিলে অনেক দলের হাফ সেঞ্চুরি হতে যাচ্ছে। সেই হিসেবে অনেক ব্যক্তিরও। মামুনুর রশীদ, আতাউর রহমান, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, আলী যাকের, নাসির উদ্দিন ইউসুফ প্রমূখ এখনও টুকটুক করে ব্যাটিং করে চলেছেন। জামিল আহমেদ বছরে একবার করে গর্জে উঠছেন। আবদুল্লাহ আল-মামুন, সৈয়দ শামসুল হক পরিণত বয়সে কিন্তু এস এম সোলায়মান এবং সেলিম আল দীন সময়ের আগেই ইনিংস শেষ করেছেন। কিন্তু তারা আমৃত্যু কাজের মধ্যে ছিলেন। এন.এস.ডি এবং বিশ্বভারতীফেরৎ কিছু তারুণ্যকে আমরা পেয়েছিলাম। সৈয়দ জামিল আহমেদ, কামরুজ্জামান রুনু, আশিষ খন্দকার, ইসরাফিল শাহীন, সৈয়দ মহিদুল ইসলাম, তারিক আনাম খান, কামালউদ্দিন নীলু, গোলাম সারোয়ার প্রমূখ। যৌবনের স্পর্ধায় কিছুদিন এরা টগবগ করে ফুটে পরিবেশ, জলাভূমি, স্থাপত্য কাঁপিয়ে তুলে দম শেষ করে ঝিমিয়ে পড়ল। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগ খোলা হলো। সেখান থেকে বেরিয়ে কেউ কেউ চমৎকার কাজ দেখালেন। কামালউদ্দিন কবির, সুদীপ্ত চক্রবর্তী, ইউসুফ হাসান অর্ক, সাইদুর রহমান লিপন, জাহিদ রিপন প্রমুখ কাজ করে চলেছেন। তবে তাদের উপর একাডেমিক সেলিম আল দীন এমনভাবে ভর করে আছে যে, তা তাদের কাজে জলছাপ হয়ে ফুটে ওঠে। থিয়েটার বিষয়ক আলোচনা নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডির মধ্যে করা যায় না। আগে পিছে হবে। থিয়েটারে নাটক প্রাথমিক পূর্বশর্ত।

নাট্যকার হিসেবে সম্মানিত স্থানে রয়েছেন আবদুল্লাহ আল-মামুন, মামুনুর রশীদ, মমতাজউদদীন আহমদ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল দীন, এস এম সোলায়মান, আব্দুল্লাহেল মাহমুদ, মান্নান হীরা। এই ধারায় পরবর্তী সময়ে সংযুক্ত হন মলয় ভৌমিক, মাসুম রেজা প্রমূখ।

এ প্রসঙ্গে বলতে চাই স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ২৩ বছরে নাটক প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৫০০। স্বাধীন দেশে নাট্যচর্চার ব্যাপক ব্যাপ্তি ঘটলেও নাট্যকারের সংখ্যা কমে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর পর মুক্তিযুদ্ধের গৌরব নিয়ে নাটক হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। ১৯৭৫ পর্যন্ত নাটকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথার বদলে দেখি হতাশা, কালোবাজারি, দুর্বৃত্তায়ন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে পঁচাত্তরের নৃশংস হত্যাকা- এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতন এড়িয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ হয়। আশির দশকের শুরুতে নাটকের প্রধান সুর ছিল রাজাকার দালালদের প্রতি ঘৃণা। কিন্তু আশির শেষের দিকে স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান উঠে আসে নাটকের বিষয়বস্তুতে। স্বৈরাচারবিরোধীতার পথ ধরে নতুন করে জাগ্রত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে শেকড়ের সন্ধান এসময় খুব গুরুত্ব পায়। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম এবং দ্বিতীয় দশকে আমরা বহু ধারার মঞ্চায়ন দেখি। অনেক নবীন মঞ্চের জন্য পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন সেগুলো মঞ্চস্থও হচ্ছে, কিন্তু ঠিক যেন নাট্যকার হয়ে উঠছেন না। বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনে মঞ্চস্থ করছেন ইউরোপ, আফ্রিকা, ল্যাটিন, স্পেন- কিছুই বাদ রাখছেন না। নাটকের বিষয়বস্তু বা গল্পের সঙ্গে আমাদের কোনো মিল থাক বা না থাক স্মার্টলি উপস্থাপন করাই যেন থিয়েটার। গত ২০ বছরে দলগুলোর দিকে তাকালে দেখি এখনও অনেক দল অন্য দেশের নাট্যকারে উপর নির্ভরশীল। অনুবাদ নাটক হচ্ছে প্রচুর। এক কামালউদ্দিন নিলু ইবসেনকে এমন বিক্রি দিয়েছেন যে আর কেউ নিকট সময়ে ইবসেন ধরছে না।

১৯৮২ পর্যন্ত ঢাকায় গ্রুপ থিয়েটারভুক্ত দল ছিল ৩২ টি। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ৫৯ টি। আর বর্তমান ২০১৯ সালে দলের সংখ্যা ৬২ টি। এর মধ্যে অর্ধেক দল নামসর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে। সত্তরের দশকে যে ১০ -১২ টি দল যাত্রা শুরু করেছিল। সেই সব দল থেকেই পরবর্তী সময়ে নতুন নতুন দল গঠিত হয়। এক থিয়েটার থেকে পাঁচটি ভাগ হয়। বর্তমানে সকলেরই জরা অবস্থা। ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ থেকেও কমপক্ষে পাঁচটি দল সৃষ্টি হয়। এভাবে পূর্বের দল থেকেই আরেকটা দল তৈরি হয়। আবার অনেক দল চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যেমন ‘থিয়েটার আর্ট নাট্যদল’, ‘চক্রবাক’, ‘অবলোকন’, ‘অন্যদল’, ‘মুনমুন থিয়েটার’, ‘ঢাকা নাট্যম’ একসময় বেশ সক্রিয় ছিল কিন্তু বর্তমানে নিষ্ক্রিয়।

নাট্যকারের পর আসি নির্দেশনায়। মামুনুর রশীদ, আবদুল্লাহ আল-মামুন, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, আতাউর রহমান, আলী যাকের প্রমূখ। পরবর্তী সময়ে নির্দেশক হিসেবে পাই তারিক আনাম খান, সৈয়দ জামিল আহমেদ, এস এম সোলায়মান, কামালউদ্দিন নীলু, খালেদ খান, আজাদ আবুল কালাম প্রমূখ। নাট্যকারের আকাল রয়েছে সেটা মেনে নেয়াই ভালো। কিন্তু নাট্যকারের তুলনায় নির্দেশক এবং অভিনেতার সৃজনশীলতা বেশ উজ্জ্বল। প্রতিটি দলে রয়েছে শক্তিমান অভিনেতা। গ্রুপ থিয়েটারের বাইরে রয়েছে কিছু রেপাটরি দল। এরা ভালো স্ক্রিপ্ট নিয়ে বিভিন্ন দলের ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রী বাছাই করে ভালো নাটক করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সীমাবদ্ধতা তাদেরও কম নয়। তাদেরকে সীমিত সংখ্যক পাত্র-পাত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়।

গত দুই দশকে বেশ কিছু নাটকের পত্রিকা বের হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, নাটকের প্রথম বাংলা পত্রিকা বের করেন অমরেন্দ্রনাথ দত্ত- ১৯০২ সালে, সাপ্তাহিক পত্রিকা। ৬ বছর টিকে ছিল। খরচ হতো ৬ পয়সা বিক্রি করতো ২ পয়সায়। ৪ পয়সা গচ্চা। ছাপা, লেখা, কাগজ ছিল উৎকৃষ্ট মানের। তারপর অনেক অনেক নাট্যপত্র বের হলো। এরমধ্যে ‘বহুরূপী’, ‘অভিনয় দর্পণ’, ‘থিয়েটার’, ‘গ্রুপ থিয়েটার’, ‘এপিক থিয়েটার’, ‘গণনাট্য’, ‘স্যাস’, ‘নাট্যকথা’, ‘নাট্যচিন্তা’,‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘আকাদেমি পত্রিকা’, ‘সায়ক’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয় রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ যা এখনো নিয়মিত বের হচ্ছে। ‘থিয়েটার’ পত্রিকা আমাদের দীর্ঘায়ু পত্রিকা। অন্যগুলো স্বল্পায়ু। ১০-১২ আয়ু পেয়েছিল বেশ কিছু পত্রিকা। এর মধ্যে হাসান শাহরিয়ার সম্পাদিত ‘থিয়েটারওয়ালা’ পত্রিকা ২৭ টি সংখ্যা ছাপা হয়েছিল। বর্তমানে থিয়েটারওয়ালা অনলাইন প্রকাশনা হিসেবে সক্রিয় রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য পত্রিকাগুলো হলো- রবিউল আলম সম্পাদিত ‘তির্যক’, মান্নান হীরা সম্পাদিত ‘সমকালীন নাটক’, সেলিম রেজা সেন্টু সম্পাদিত ‘দুই বাংলার থিয়েটার এবং নাট্য’, প্রথম পর্যায়ে মোসাদ্দেক মিল্লাত এবং পরে রুবাইয়াৎ আহমেদ সম্পাদিত ‘গ্রাম থিয়েটার’, সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক সম্পাদিত ‘থিয়েটার ফ্রন্ট’, অভিজিৎ সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘ফ্রন্টলাইন থিয়েটার’, ইউসুফ ইকবাল দীপু সম্মাদিত ‘নাটক কথা’, ইনামুল হক সম্পাদিত ‘শুধু নাটক’, রাহমান চৌধুরী সম্পাদিত ‘বিষয় নাটক’, সেলিম আল দীন সম্পাদিত ‘থিয়েটার স্টাডিজ’, প্রথমে খালেদ খান ও পরে অনন্ত হিরা সম্পাদিত ‘মঞ্চপত্র’, পাভেল রহমান সম্পাদিত ‘ক্ষ্যাপা’, শাহ আলম নিপু সম্পাদিত ‘মঞ্চ’, গণায়ন, প্রসেনিয়ম, মঞ্চসন্ত প্রভৃতি। ইতিমধ্যেই কিছু পত্রিকা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

একটা ব্যাপার বেশ লক্ষণীয়- গত ২০ বছর ধরে যেসব নাট্যদল বা নাট্যজন বাংলাদেশের থিয়েটারকে ঋদ্ধ করে চলেছেন, তাদের অধিকাংশের শেকড় প্রোথিত স্বাধীনতাউত্তর নাট্যচর্চার আতুঁড় ঘরে। অর্থাৎ গত শতকের সত্তরের দশকের দলগুলো থেকেই মূলত নব্বই দশক-পরবর্তী নতুন দলগুলোর সৃষ্টি হয়। একজন এস এম সোলায়মানের হাত ধরেই তৈরি হয়েছে অনেক দল। ‘পদাতিক নাট্য সংসদ’ থেকে ‘ঢাকা পদাতিক’। সেখান থেকে ‘অন্যদল’। ‘অন্যদল’ ছেড়ে এসে ‘থিয়েটার আর্ট’। সেখান থেকে ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’ গঠন করা কেবল সোলায়মানের পক্ষেই সম্ভব। এই ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’ থেকে ২৭ বছরের অভিজ্ঞতাস¤পন্ন কয়েকজন নাট্যকর্মী অতিসম্প্রতি গঠন করলেন ‘অনুস্বর’। নাট্যদল ‘থিয়েটার’ আশির দশকের শুরুতেই দু'ভাগ হয়ে ব্র্যাকেট ধারণ করে ‘তোপখানা’ আর ‘আরামবাগ’। একদিকে আবদুল্লাহ আল-মামুন, রামেন্দু মজুমদার অপরদিকে মমতাজউদদীন আহমদ, তবিবুল ইসলাম, কেরামত মাওলা-রা। ‘তোপখানা’ ভেঙে আবার নাম নেয় ব্রাকেটবন্দি ‘তোপখানা’ আর ‘বেইলি রোড’। এবার খায়রুল আলম সবুজ আর হাফিজুর রহমান সুরুজরা ‘তোপখানা’ আর রামেন্দু মজুমদার, আবদুল্লাহ আল-মামুন, ফেরদৌসী মজুমদাররা ‘বেইলি রোড়’। ‘আরামবাগ’ থেকেও হয় দুটি দল। এরা সবাই একই নাম ব্যাবহার করে শুধু তাই না, একই লোগোও ব্যবহার করে। এর থেকে ব্যতিক্রম ‘তোপখানা’ থেকে বেরিয়ে ১৯৯০ সালে তারিক আনাম খান, ঝুনা চৌধুরী, মেঘনা, তৌকীর আহমেদরা গঠন করেন ‘নাট্যকেন্দ্র’। ‘আরামবাগ’ থেকে ১৯৯৭ সালে বেরিয়ে তবিবুল ইসলাম, চিত্রলেখা গুহ প্রমূখ মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাট্যজন’। ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ থেকে বেরিয়ে ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’ নামে দল করেন ইনামুল হক, জামালউদ্দিন হোসেন প্রমূখ নাট্যজন। ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’ থেকে ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল’। ‘অনসাম্বল’ থেকে ‘নাট্যতীর্থ’। সেখান থেকে দলছুট একঝাঁক তরুণের ‘এথিক’। আজকের ‘প্রাঙ্গণেমোর’ও ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ থেকে বেরিয়ে আসাদের নাট্যদল। যেমন কিনা আজকের ‘দেশনাটক’ বা ‘নাট্যধারা’ কিংবা ‘প্রাচ্যনাট’-এর শিকড় ‘আরণ্যক নাট্যদলে’ই প্রোথিত। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ের দলগুলোর বেশিরভাগই এখনও দোকান খোলা রেখে টিমটিম করে আলো দিচ্ছে। কিন্তু শেকড় ভেদ করে উঠে আসা দলগুলোর কাজ চোখে পড়ার মতো।

একসময় থিয়েটারের দর্শক বিটিভির অভিনেতা দেখতে মিলনায়তনে আসলেও বর্তমানে তৃতীয় প্রজন্মের মঞ্চায়ন দর্শকনন্দিত হচ্ছে। প্রথম থেকেই আমাদের মঞ্চে মৌলিক নাটকের পাশাপাশি আমরা পৃথিবীর বিখ্যাত সব নাট্যকারের নাটক করে আসছি। সফোক্লিস, শেক্সপীয়র, ইবসেন, আর্থার মিলার, ব্রেখট, মলিয়ের, চেকভ, গোর্কি, সাঁত্রে, স্ট্রিন্ডবার্গ, গোগোল, দারিও ফো, হ্যারল্ড পিন্টার, মনোজ মিত্র, উৎপল দত্ত, মোহিত চট্টোপাধ্যায় কে নেই এই তালিকায়। অনুবাদক হিসেবে আমরা পাই আব্দুল হক, মুনীর চৌধুরী, কবির চৌধুরী, আবু শাহরিয়ার, আব্দুস সেলিম, সাঈদ আহমদ, সৈয়দ শামসুল হক, মফিজ চৌধুরী, খায়রুল আলম সবুজ, খন্দকার আশরাফ হোসেন, মোবাশ্বের আলী প্রমূখ।

এই ইতিহাস পেরিয়ে থিয়েটারের চালচিত্রে গত ২০ বছরে দেখি বেশ কয়েকটি দল দাপটের সাথে অভিনয় করে যাচ্ছে। দর্শক খরার মধ্যেও তারা নিয়মিত প্রযোজনা করে যাচ্ছে। নাট্যকর্মী এবং দলগুলো যে পরিশ্রম আর ব্যয় করে একেকটা নিরীক্ষা করে যাচ্ছে সে তুলনায় দর্শক আনুকূল্য যথেষ্ট নয়। তবে আশার কথা নতুন শতকের দর্শক থিয়েটার দেখতে আসে পর্দার মুখ দেখার জন্য নয়। আগে একেকটা নাটক বছরের পর বছর প্রদর্শিত হতো। এখন ৫০ তম প্রদর্শনী অনেক সাফল্য হিসেবে দেখা হয়। কেউ কেউ আবার টানা ১০ দিন ’শো করে সেই প্রযোজনা বন্ধ করার রেওয়াজ চালু করতে চাচ্ছেন।

এই শতকে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্ট থেকে থিয়েটারকর্মীরা বেরিয়ে আসতে চাইছে। গত শতকের নব্বই দশকে আমরা দেখেছি কিছু কিছু দল বা ব্যক্তি বিদেশি ফান্ড যোগাড় করে সেই দেশের নাট্যকারের নাটক উপস্থাপন করতেন। বর্তমানে বিভিন্ন উপলক্ষে নাট্য উৎসবের ‘মহামারী’। অনেকগুলো নাট্য উৎসব ইতোমধ্যেই গুরুত্ব হারিয়ে বসে আছে। থিয়েটার করতে হলে অবশ্যই নাটক দরকার। বিশেষ করে মৌলিক নাটক, যা সব সময়ের আকাল। এখনও তার ব্যতিক্রম নয়। এখনও সমান সৃজনশীল রয়েছেন মামুনুর রশীদ, মান্নান হীরা, মাসুম রেজা, মলয় ভৌমিকরা। নিজেদের দলের জন্যেই তারা নাটক লিখে থাকেন। যদিও অন্যান্য দলও তাদের নাটক করছে। নতুনদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে আজাদ আবুল কালাম, অনন্ত হিরা, নূনা আফরোজ, গোলাম শফিক, বদরুজ্জামান আলমগীর, সাইমন জাকারিয়া, সামিনা লুৎফা নিত্রা, অলোক বসু, শুভাশিস সিনহা, শাহমান মৈশান প্রমূখ। নির্দেশক হিসেবে অগ্রজদের পাশাপাশি গত ২০ বছরে দাপটের সঙ্গে নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন পরের প্রজন্মের আজাদ আবুল কালাম, ফয়েজ জহির, মোহাম্মদ বারী, সুদীপ্ত চক্রবর্তী, শুভাশিস সিনহা, আমিনুর রহমান মুকুল, অনন্ত হিরা, নূনা আফরোজ প্রমূখ। নতুন প্রজন্মের সাইফ সুমন, তৌফিকুল ইসলাম ইমন, দেবাশীষ ঘোষ, শামীম সাগর, বাকার বকুল -পুরস্কার ও সম্মানে ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি পেয়েছেন। এখনও বোঝা যাচ্ছে না এরা হাঁটবে কতদূর। তবে নতুন প্রজন্মের নাট্যকার এবং নির্দেশকের কাজ বিষয়-বৈচিত্র্যে এবং নিরীক্ষায় বিচিত্র। দর্শকের দৃষ্টি রয়েছে এদের দিকে। আগের প্রজন্মে প্রায় দুর্লভ হলেও এই শতাব্দীতে এসে নারী নাট্যকার এবং নির্দেশকের হাতেগোনা দেখা অন্তত পাওয়া যাচ্ছে।

নাট্যপত্রগুলোতে নাট্যসমালোচনা থাকলেও লিটলম্যাগ এবং দৈনিক পত্রিকায় প্রায়ই নাট্যসমালোচনা ছাপা হয়। নাট্যসমালোচক এবং প্রবন্ধকার হিসেবে মফিদুল হক, শান্তনু কায়সার, বিপ্লব বালা, অলোক বসু, রাহমান চৌধুরী, আফসার আহমেদরা লিখছেন ।

এতক্ষণ ধরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সেলিব্রালে যা যা ধরা পড়ল একটা সালতামামি করে নিলাম।

দর্শক বিষয়ে সামান্য কিছু বলি। শেক্সপীয়রের সময় অভিজাত এবং সাধারণ দর্শক একসঙ্গে থিয়েটার দেখতো। দর্শকরা গালগল্প করতো। অভিনয় পছন্দ না হলে এটা ওটা ছুঁড়ে মারতো। সিটি বাজাতো। আপত্তিকর আচরণ করতো। পরে যখন পাবলিক থিয়েটার হলো, তখনও, যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নাটক হতো তাদের পছন্দের অভিনেতৃ অভিনয় করতে দিতে হতো। এলিজাবেথীয় সময়ে মঞ্চের দুপাশে বড়লোকদের বসার স্থান থাকতো। এখনও আমাদের প্রসেনিয়াম থিয়েটারে টাকার অনুপাতে দর্শকসারি বিন্যাস করা হয়। মঞ্চ থেকে অনুরোধ করা হয় মোবাইল ফোনটি বন্ধ রাখুন, কথা বললে পাশেরজনের নাটক উপভোগ করতে অসুবিধা হবে- দয়া করে ছবি তুলবেন না- ভিডিও করবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। তবু কিছু কিছু দর্শক তা অমান্য করেই যায়। এইসব নিয়েই আমাদের থিয়েটার।

থিয়েটার সব সময় জীবনের কথা বলে। থিয়েটারের হয়ে এই কথা যারা বলে অর্থাৎ নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা -তাদের জীবনের কথা কে বলবে? একেবারে আক্ষরিক অর্থে জীবনের কথা বলছি- ক্ষুধা-তৃষ্ণা-পোশাক-বাসগৃহ-চিকিৎসা এসবের সমাধান কীভাবে হবে? আমাদের প্রজন্মের বহু নিবেদিত নাট্যকর্মীকে দেখেছি থিয়েটার করে করে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অসহায়ের মতো কেউ কেউ বিজ্ঞাপন, সিনেমা এবং মিডিয়ায় ঢুকে পড়েছে। অনেকটা পরাজিত সৈনিকের মতো পালিয়ে গেল। এরমধ্যে সামান্য কয়েকজন অধ্যাপনায় ঢুকে গিয়ে বেশ ছড়ি ঘুরাতে লাগলেন। অধিকদৃষ্টি বা দূরদৃষ্টিসম্পন্নরা নিজেরাই বিজ্ঞাপনি সংস্থা দিয়ে গুছিয়ে বসলেন। নিজেদের আইডেন্টিটি তৈরি করে নিলেন। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মধ্যবিত্ত এবং মধ্যমেধার কিছু নাট্যকর্মী জোগাড় করে তাদের উপর ভর করে কেউ কেউ থিয়েটারের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখলেন। এ যেন- গাছেরটাও খেলেন আবার তলারটাও কুড়িয়ে নিলেন। অর্থাৎ গ্রুপ থিয়েটার নামে যে চর্চাটা হচ্ছে সেখানে জীবিকার প্রশ্নটি অমীমাংসিত রয়ে গেল। সেমিনার, উৎসব, নাট্যদিবস পালিত হয় বটে কিন্তু এই মূল প্রশ্ন অবান্তরই থেকে যায়। যাদের যত বিজ্ঞাপন জোগাড় করার যোগ্যতা অথবা সরকারের গুণকীর্তন বা কাছাকাছি থেকে কিছু বরাদ্দ আদায় করার ক্ষমতা রয়েছে তারা সেই অর্থ এনে থিয়েটার করে। বছর না ঘুরতেই ভর্তুকি দিতে দিতে সেই বরাদ্দ যায় ফুরিয়ে। কেননা দর্শকধন্য নাটক আমাদের মঞ্চে একেবারেই অঙ্গুলিগণনা করা যায়। ঘুরেফিরে কিছু দর্শকই থিয়েটার দেখে। দর্শক তৈরিতে নেই কোনো সমন্বিত উদ্যোগ। দর্শক সৃষ্টিতে শুধু ব্যর্থ তাই নয়, গণজন বা জনগণ বলতে যা বুঝায় তার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগই নেই। কিছু কিছু দল আত্মীয়-স্বজন, স্কুল কলেজ, অফিস বা সমিতির লোক দাওয়াত করে হল ভর্তি করার চেষ্টা করে। তাও আবার ঐ দুই-একটা প্রদর্শনীতেই। এরা মূলত দর্শক নয়। আমাদের বিরাট জাতীয় নাট্যশালায় যেখানে সাতশতাধিক দর্শক আসন, সেখানে পঞ্চাশজন দর্শক হওয়াই সপ্তাহের ছুটির দিন বাদে অন্যদিনগুলোতে দুষ্কর।

এভাবে কতদিন চলবে। থিয়েটারের রাঘববোয়ালরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার স্বপ্ন দেখান। তাঁদের পিঠ বাঁচানোর জন্য সরকারের কাছাকাছি থাকা দরকার হতে পারে। কিন্তু থিয়েটারের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চিরকালের। ইতিহাস তাই বলে। আর ক্ষমতার তোষামোদ বিনা সরকার কেনো অনুদান দেবে! আর তোষামোদকারীকে দিয়ে থিয়েটার হয় না- এও আমাদের জানা। সারাদিন অন্য চাকরি করে সন্ধ্যাবেলা ফিরে আদর্শ কপচানো দিয়েও থিয়েটার হয় না। আমলা, মিডিয়া, ড্রাইভার, ধোপা, নাপিত সবাই যখন যার যার কাজ করে জীবন নির্বাহ করবে, তখন থিয়েটারের অভিনেতারা ‘পুওর বাট অনেস্ট’ থেকে বাড়ির গুরুত্বহীন বেকার ছেলে হয়ে থিয়েটারের শাহজাদা সেজে গোঁফে তা’ দেবে এ বড় নির্দয় বৈষম্য। যারা নিজের বৈষম্য মেলাতে পারে না, তারা কী করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বৈষম্যের দিকে ইঙ্গিত দেবে? আসুন থিয়েটারের দিকে তাকাই। যে কোনোও দলের দিকে তাকাই। এরকম কয়েক’শ দল অস্তিত্বের সংকটে আজ। অস্তিত্বের সংকটের সঙ্গে লড়াই। এই অপমৃত্যুর ট্র্যাজেডি থেকে রক্ষা করবে কে? কারও কিছু যায় আসে? আজকের বৃদ্ধদের অনেকেই যারা তাদের সময় আগুন ধরিয়েছিল, স্বপ্ন দেখেছিল, স্বপ্ন দেখিয়েছিল আদর্শ সমাজ গঠনের- তারা আজ স্বপ্নহীন। তারা আজ আদর্শচ্যুত আবেগ বর্জিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছে। তাই বলে লড়াইটা থেমে থাকবে না। যাদের এখন রক্তক্ষরণ হচ্ছে তারা চিহ্নিত করবে সামাজিক প্রজাপতিদের। আর সামাজিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বোধগুলো ফুঁসে উঠবেই।

এতক্ষণ ধরে যত বকবক করলাম তা নিশ্চয়ই থিয়েটার সংশ্লিষ্ট সকলেরই জানা। তবু প্রেক্ষিতটা স্মরণ করলাম- বাস্তবতার একটা স্কেচ নিজেই নিজের জন্য তৈরি করা আরকি। মানুষের বিবর্তন বলে ধীরে ধীরে সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাবার কথা। সব সময় কি তা-ই ঘটে? মাঝে মাঝে গোল বাধে। সভ্যতার অগ্রগতির পরিচয় তার বাইরের অর্থাৎ বাইরের বস্তু জগতে ভেসে ওঠে। আবার আরেকভাবেও পাই বস্তুর অন্তর্গত অনুভবে যা তার সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে ধরা পড়ে। পশুরা শিল্পচর্চা করে না। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে ভাবে, ভাবতে ভাবতে চার পায়া থেকে দুই পায়া হয়ে উঠে, দুই পায়ে ভর দিয়ে ভাবনাকে রূপ দিতে চায় এবং সচেতনভাবে শিল্পচর্চা করে মানবধর্ম বা মানবসংস্কৃতি নির্মাণ করে।

মানুষের সংস্কৃতি একদিনে বা একক প্রচেষ্টায় নির্মাণ হয় নি। এরজন্যে প্রয়োজন হয়েছে সমষ্ঠির। সমষ্ঠির অনুপ্রেরণাতেই সমাজ। আবার সমাজের কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা দল যদি ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তার করে তবে ব্যাক্তির স্বাতন্ত্র্যে ব্যাঘাত ঘটে। এবং সমাজে যখন অনৈতিকতা প্রকট আকার ধারণ করে তখন বিপন্ন হয়ে ওঠে সংস্কৃতি।

সারা পৃথিবীতেই আজ মানবসংস্কৃতির সংকট চলছে। সেখানে বঙ্গসংস্কৃতি আলাদা কিছু নয়। সংস্কৃতির অংশ হিসেবে থিয়েটারও আলাদা কিছু নয়। বরং থিয়েটার এক আন্তর্জাতিক মাধ্যম। পৃথিবীর যেখানেই থিয়েটারের যে-ভাষা নির্মাণ হচ্ছে- সে-ই ভাষাটা বুঝে ওঠা চাই। বোধগম্যতায় নেয়া চাই। রক্তমাংসে আত্মস্থ করা চাই। অনুভবে জারিত করে নিলে তবেই নিজের সংস্কৃতিতে থিয়েটার নির্মাণের ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে।

যেই মুখগুলো দেখে আমরা থিয়েটারে প্রবেশ করেছিলাম তারা আজ পরাজিত। পলাতক। মুমূর্ষু। সেই মুখের প্রতি আমরা আস্থা হারিয়েছি। আমরা দেখেছি গত শতাব্দীর শেষ তিন দশক আর এই শতাব্দীর দুই দশকে বহমান যে রাজনীতি, তা বিভৎস। সেখানে ব্যক্তির কোনো ব্যক্তিত্ব না থাকাটাই তো স্বাভাবিক। সদ্য স্বাধীন দেশেই আমরা মুখোমুখি হই অরাজকতার। তারপর ইতিহাসের জঘন্য হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের উত্থান ঘটে। অতঃপর দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসনের ইতিহাস- একে একে জাতীয় বীরদের বিক্রি হয়ে যাওয়ার ইতিহাস। মুখোশ উন্মোচনপর্বে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম। গত শতকের নব্বইয়ের আপাতত বিজয়কে আমরা একাত্তরের পরের সবচেয়ে বড় বিজয় বলে ঘোষণা করেছিলাম। একদা বাইশ পরিবারের শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিল তেইশ বছরের মাথায়। আজ পঞ্চাশ বছরের মাথায় এসেও পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাঙালি জাতান্তর ঘটানো শোষকের বিরুদ্ধে চিহি চিহি রব তুলতেও সাহস করে না। যে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একদা লাল ঝাণ্ডা উড়েছিল, সেই সব দেশে পা ফেলতে পারলে আজ গর্বে বুক ফুলে যায়। যে ভাষার জন্যে একদা রক্ত ঝড়েছিল, সে ভাষা আজ হিন্দি-ইংরেজির কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে- আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। জাতীয় এতসব অহংকার শিল্পে ধরা পড়বে এটা ছিল স্বাভাবিক। রাষ্ট্র যখন কেবল ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে তখন তার অঙ্গসংগঠনগুলোও একই ধারায় চলতে থাকে। তখন যথেচ্ছাচারের প্রকাশ শিল্প সংস্কৃতিতে পড়ে। একটি দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি যে পরিমান মধ্যাকর্ষণের প্রয়োগ দেখায় সেই দেশের শিল্প সংস্কৃতি সেই আকার পায়। তো রাজনীতি-অর্থনীতি বা ভোগবাদ সবকিছু মিলিয়েই আমাদের শিল্প সাহিত্য থিয়েটার আজ বিপন্ন।

পুঁজিবাদ এবং ভোগবাদের কারসাজিতে শিল্প এখন আর নান্দনিক ক্ষুধার বিষয় নয়। নিছক বাজারি পণ্যের সঙ্গে তাকে বিবেচনায় নেয়া হয়। এই পণ্য উৎপাদনে যে যত চোখ ঝলসানো উপাদান হাজির করতে পারবে সে তত সফল। এই দুর্দিনে যারা ভূমিকা রাখতে পারতেন সেই বুদ্ধিজীবীরা আজ সামান্য স্বার্থে আত্মবিক্রয় করে বসে আছেন।

যারা জাবর কাটছেন কাটুন। শাসনযন্ত্রের অথর্বদের দিয়েও হবে না। রাজনীতির ব্যবসাদার দিয়েও হচ্ছে না। বিশ্বাসঘাতক সামাজিক কাঠামোতে লড়াইটা জটিল থেকে জটিলতর হওয়ারই কথা। গত ২০ বছরে স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে যে প্রজন্ম দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে- আমরা দেখেছি তাদের অবজ্ঞায় উপহাসের পাত্র করা হয়েছে। তবু জড়তা আর নিষ্ক্রিয়তা ঝেড়ে পরের প্রজন্মকেই দাঁড়াতে হবে। বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া ছাড়া মানুষের শিল্পের থিয়েটারের জাগরণ ঘটবে না।

অপু শহীদ ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যকার, নির্দেশক। সদস্য- এথিক।