Full premium theme for CMS
গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটার : ঢাকার থিয়েটারের পালাবদল-পালা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

হাসান শাহরিয়ার সম্পাদিত ‘থিয়েটারওয়ালা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি বের হয় ৪ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে, প্রায় দুই দশক আগে। ঐ সময় পর্যন্ত মূলত আমাদের ঢাকার নাট্যচর্চা ছিল বেইলি রোডকেন্দ্রিক এবং তার চালকের আসনে ছিলেন আমাদের অগ্রজ পথিকৃৎ ৮/১০ নাট্যজন আর তাঁদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ৪/৫টি নাট্যদল। তাঁরাই বাংলাদেশের নাট্যচর্চাকে মেঠো আলপথ থেকে রাজপথে পরিণত করেছেন এবং এ কথাও স্বীকার করতে হবে, আমরা তাঁদের তৈরি পথেই পথ চলছি। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে তাঁরা এখন আর চালকের আসনে নেই। গত শতকের নব্বই দশক এবং তার পরে আসা নাট্যজন এবং তাদের সৃষ্ট নাট্যদলগুলোই এখন চালক। কীভাবে, কেমন করে, কোন প্রক্রিয়ায় বিগত ২/৩ দশকের ব্যবধানে চালকের আসন বদলে গেল, সে প্রত্রিয়াটির অনুসন্ধানই এই লেখার অভিপ্রায়।
‘থিয়েটারওয়ালা’ থেকে অনুরোধ ছিল গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটারে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার কথা লিখতে। আমার ভাবনায় এলো আমাদের থিয়েটারের পালাবদলের-পালা নিয়ে কিছু লিখবো। কিন্তু এ বিষয়ে লিখতে গেলে অবধারিতভাবেই গত ২০ বছর থেকেও পেছনে গিয়ে গত শতকের নব্বই দশকের শুরু থেকে শুরু করতে হচ্ছে। তাই, আমার লেখার বিষয়কাল গত ৩ দশক।
আমি বা আমরা অথবা আমাদের প্রজন্মের যারা বিভিন্ন জেলা এবং ঢাকা থেকেও বেইলি রোডকেন্দ্রিক নাট্যচর্চায় যুক্ত হলাম, তারা সত্যিকার অর্থেই আমাদের অগ্রজ পথিকৃৎ আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, মামুনুর রশীদ, আবদুল্লাহ আল-মামুন, আতাউর রহমান, ফেরদৌসি মজুমদার, সারা যাকের, শিমূল ইউসুফ, এস এম সোলায়মান, প্রত্যেকের সৃজনশীলতার সুবর্ণসময় এবং তাঁদের দলগুলোরও ক্ষমতার দোর্দ- প্রতাপ লক্ষ করেছিলাম।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে আমরা ঢাকার নাট্যচর্চায় যুক্ত নবাগতরা এমনও শুনতাম, যেসব অগ্রজদের নাম উল্লেখ করেছি তাঁদের সৃজনশীলতার স্বর্ণসময় নাকি ছিল গত শতকের ৭২ থেকে শুরু করে আশির দশক পর্যন্ত। নব্বইয়ের দশকে এসে নাকি তাঁদের সৃজনশীলতার পারদ নামতে শুরু করেছিল। এমন একটা আলোচনা ছিল বটে। কিন্তু আমি যাঁদের নাম উল্লেখ করেছি তাঁদের অধিকাংশই নব্বইয়ের দশক থেকে ব্যবসা, রাজনীতিসহ অন্যান্য সামাজিক কর্মকা-ে যুক্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে নাট্যাঙ্গন থেকে দূরে সরে গেলেও তাঁদের দু’একজনকে নব্বইয়ের দশকের পরেও আমাদের চম্কে দিতে দেখেছি। হয়তোবা ধারাবাহিকভাবে নয়। নব্বইয়ের দশকে ঢাকার নাটকে যুক্ত হওয়া আমাদের প্রজন্মের সকলেরই মনে পড়বে মহিলা সমিতি মঞ্চ তখন পথিকৃৎ নাট্যদল ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’, ‘ঢাকা থিয়েটার’, ‘আরণ্যক নাট্যদল’, ‘থিয়েটার’- এসব দলের জন্য ন্যূনতম ৩/৪দিন, কখনো কখনো ৫দিনও বরাদ্দ থাকতো।
নব্বইয়ের দশকেই ‘থিয়েটার’ থেকে নিজেদের বিযুক্ত করে তারিক আনাম খান, ঝুনা চৌধুরী, তৌকীর আহমেদ ও নাহিদ ফেরদৌস মেঘনা ১৯৯০ সালের ১১ অক্টোবর ‘নাট্যকেন্দ্র’ গড়ার ঘোষণা দেন। বিচ্ছু, ‘তুঘলক’, ‘ক্রুসিবল’ করে উল্লিখিত চার/পাঁচজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি নতুন দল হিসেবে ‘নাট্যকেন্দ্র’ সকলকে চম্কে দেনও বলা যায়।
দলটির প্রথম এবং আলোচিত নাটক তারিক আনাম খান নির্দেশিত-রূপান্তরিত-অভিনীত ‘বিচ্ছু’ মঞ্চে আসে ৮ জানুয়ারি ১৯৯১ সালে। নাটকটি খুবই জনপ্রিয় হয়। নাটকটিতে আরও অভিনয় করেন নাহিদ ফেরদৌস মেঘনা, ঝুনা চৌধুরী, জাহিদ হাসান, তৌকীর আহমেদ, মোশাররফ করিম, ম. ম. মোর্শেদ, শফিক সাদেকী ও মুবিনা আহমেদ জলি। নাটকটির ১৭৮টি প্রদর্শনী হয়েছিল। ‘বিচ্ছু’ নাটকের তুমুল জনপ্রিয়তার মধ্যেই ‘নাট্যকেন্দ্র’ তাদের দ্বিতীয় প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে আনে গিরিশ কারনাড রচিত ও চিত্তরঞ্জন ঘোষ-স্বপন মজুমদার অনূদিত ‘তুঘলক’। ১০ মে ১৯৯২ সালে। মোট প্রদর্শনী হয় ৪৫টি। নির্দেশক ছিলেন তারিক আনাম খান। গিরিশ কারনাডের নাটক থেকে শঙ্খ ঘোষের বাংলায় অনুবাদ ‘হয়বদন’ তৌকীর আহমেদের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ১৯৯৪ সালের মে মাসে। নাটকটির ৬৪টি প্রদর্শনী হয়। এরপর আর্থার মিলারের ‘ক্রুসিবল’ মঞ্চে আসে ১৪ জুলাই ১৯৯৪ সালে। প্রদর্শনী সংখ্যা ২৭টি। মাসুম রেজা রচিত ও তারিক আনাম খান নির্দেশিত ‘আরজ চরিতামৃত’ মঞ্চে আসে ১০ অক্টোবর ২০০০ সালে। প্রদর্শনী সংখ্যা ৫০টি। নাটকটি কায়রো ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভেল ফর এক্সপেরিমেন্টাল-এ অংশগ্রহণ করে ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে। ‘আরজ চারতামৃত’ নিয়ে দলটি ভারত রঙ মহোৎসব ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-র আয়োজনে দিল্লিতে প্রদর্শনী করে ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে।
‘আরজ চরিতামৃত’ নাটকটির পরই দলটি আলস্যে আক্রান্ত হয় মূলত দলপ্রধান তারিক আনাম খানসহ উল্লেখযোগ্য অভিনেতা-অভিনেত্রী প্রায় সকলেই টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়ায়। এবং তাঁদেরই অমনোযোগিতায় দলটি নতুন প্রযোজনা আর নিয়মিত প্রদর্শনী করার সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। একটা লম্বা বিরতির পর ২০১৩ সালে ‘নাট্যকেন্দ্র’ মঞ্চে আনে ‘দুই যে ছিল এক চাকর’। ইতালিয় নাট্যকার কার্লো গোল্ডনি’র ‘অ্যা সার্ভেন্ট অব টু মাস্টার্স’-এর রূপান্তর ও নির্দেশনা দেন তারিক আনাম খান। নাটকটির ৫০টি প্রদর্শনী হয়। এই নাটকটি জাপান সফর করে ২০১৩ সালে। টোকিয়োর ছাইতামায় নাটকটির প্রদর্শনী হয় মার্চ মাসে।
২১ জানুয়ারি ১৯৭৮ সালে জন্ম ‘পদাতিক নাট্য সংসদ’। ১৯৯০ সালে ওয়াইন্ডার অনটনের মূল গল্প থেকে গোলাম সারোয়ার হারুনের রূপান্তর ও সৈয়দ আজিজের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ‘চক্কর’। প্রদর্শনী সংখ্যা ২৪টি। ২০০১ সালে এস এম সোলায়মানের রূপান্তর ও নির্দেশনায় পুনঃমঞ্চায়ন হয় পল্লী কবি জসিমউদদীনের ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’। নাটকটির ৩৫টি প্রদর্শনী হয়েছিল। লু স্যান-এর গল্প থেকে গোলাম সারোয়ারের নাট্যরূপ ও নির্দেশনার মঞ্চে আনে ‘খেতমজুর খইমুদ্দিন’, ২০০৩ সালে। নাটকটির প্রদর্শনী হয় ৩০টি। মাসুম রেজা’র রচনা ও শামসুল আলম বকুলের নির্দেশনায় ‘জলবালিকা’ মঞ্চে আসে ২০০৫ সালে। প্রদর্শনী হয় ৫০টি। দেবাশীষ ঘোষের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় ‘সে’ নাটকটি মঞ্চে আসে ২০১১ সালে। প্রদর্শনী হয় ২৫টি। এছাড়াও দলটি ১৯৯৮ সাল থেকে ‘পদাতিক একুশে আন্তর্জাতিক সম্মিলন’ আয়োজন করে আসছে।
১ জুলাই ১৯৮৭ সালে ‘দেশ নাটক’ গঠিত হলেও নব্বইয়ের দশকেই দেখি ‘আরণ্যক নাট্যদল’ ছেড়ে আসা ইশরাত নিশাত, সালাউদ্দিন লাভলু ও শামসুল আলম বকুল প্রমূখ নাট্যজন ‘বিরসা কাব্য’, ‘ঘরলোপাট’ আর ‘লোহা’ ইত্যাদি নাটকের মাধ্যমে তুমুল ডানা ঝাপটাচ্ছেন নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে। এবং সে ডানা ঝাপটানোর একটা পরিণতিও আমরা লক্ষ করি পরবর্তী সময়ে মঞ্চে আসা ‘দেশ নাটক’-এর আলোচিক নাটক ‘নিত্যপুরাণ’ প্রযোজনার মধ্য দিয়ে। এরপর ঐ দলের সালাউদ্দিন লাভলুসহ আরো অনেকেই মিডিয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দলের নাট্যকার মাসুম রেজাও দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করার কারণে ‘দেশ নাটক’কে আলস্য ও ঝিমুনিতে আক্রান্ত হতে দেখি। তথাপি দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থানের পর দেশে ফিরে মাসুম রেজা, ইশরাত নিশাতসহ পুরনো অনেকেই ‘দেশ নাটক’কে পুনরায় সক্রিয় করার প্রয়াস চালান। দলটি মঞ্চে আনে ইশরাত নিশাত নির্দেশিত ‘অরক্ষিতা’ ও মাসুম রেজা রচিত ও নির্দেশিত নাটক ‘সুরগাঁও’। সম্প্রতি ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকটির পুনঃমঞ্চায়ন শুরু হয়েছে এবং ইতোমধ্যে শততম মঞ্চায়ন পূর্ণ করেছে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ‘আরণ্যক নাট্যদল’ ছেড়ে বাবুল বিশ্বাস, অলোক বসু ও মাসুদ পারভেজ মিজু প্রমূখ প্রয়াত খালেদ খানের দেয়া নামে ‘নাট্যধারা’ গড়েন ২৪ জুন ১৯৯৩ সালে। যদিও প্রথম প্রযোজনা মঞ্চে আনার আগেই ঐ দল থেকে ছিটকে পড়েন বাবুল বিশ্বাস। ‘হ্যামলেট ওহ্ হ্যামলেট’, ‘মেঘ’, ‘চাঁদের অমাবশ্যা’, ‘অগ্নিজল’, ‘ঘরামী’ ইত্যাদি প্রযোজনা করে ‘নাট্যধারা’। ‘হ্যামলেট ওহ্ হ্যামলেট’, ‘অগ্নিজল’, ‘ঘরামী’ দর্শক-নাট্যজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
প্রয়াত নাট্যজন এস এস সোলায়মানের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ২২ অক্টোবর গঠিত হয় ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’। ঐ গঠন প্রক্রিয়ার অন্যতম ছিলেন রোকেয়া রফিক বেবী ও মোহাম্মদ বারী। প্রথম প্রযোজনা এস এম সোলায়মানের রূপান্তর-নির্দেশনা আর অভিনয় সমৃদ্ধ ‘কোর্ট মার্শাল’ মঞ্চে এনে ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’ শুধু নিজেদের অস্তিত্বের পুনঃজানান দিলেন তাই নয়, বলা যায় পুরো নাট্যাঙ্গনকেই চম্কে দিলেন। দুই শতাধিক প্রদর্শনীর পরও নাটকটি এখনও চলমান এবং দর্শকপ্রিয়। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’ একে একে মঞ্চে এনেছে ‘দুই যোগ দুই’, ‘গোলাপজান’, ‘বার্থ ফ্যান্টাসী’, ‘স্বপ্ন দ্যাখো মানুষ’, ‘কাল সকালে’, ‘সময়ের প্রয়োজনে’ ও ‘না-মানুষি জমিন’। জন্মের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় নাট্যদলগুলোর অন্যতম ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’।
ভারতে নাট্যপ্রদর্শনী করতে গিয়ে দলীয় শৃংঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত এবং বহিষ্কৃত হয়ে প্রদর্শনী না করেই দেশে ফিরতে হয় ‘আরণ্যক নাট্যদলে’র আজাদ আবুল কালামসহ কয়েকজনকে। দেশে ফিরে ‘আরণ্যক’ থেকে বহিষ্কৃত আর তখন নিষ্ক্রিয়প্রায় নাট্যদল ‘থিয়েটার সেন্টার’ থেকে আসা কয়েকজন মিলে গঠন করেন ‘প্রাচ্যনাট’। ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ সালে। ‘প্রাচ্যনাট’ গড়ার প্রক্রিয়ায় আজাদ আবুল কালামের অংশীজন ছিলেন সাইফুল ইসলাম, বৃন্দাবন দাস, শাহানাজ ফেরদৌস খুশী, মুরাদ আহমেদ, রোকেয়া প্রাচী, শিরীন সুলতানা, তৌফিকুল ইসলাম ইমন, রাহুল আনন্দ, শতাব্দী ওয়াদুদ ও জাহাঙ্গীর আলম। দল গঠনের পর আজাদ আবুল কালামের রচনা ও নির্দেশনায় প্রথম মঞ্চে আসে ‘সার্কাস সার্কাস’। এর আগে দলটি কয়েকটি পথনাটক প্রযোজনা করেছিল। প্রথম প্রযোজনাতেই ‘প্রাচ্যনাট’ দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে মঞ্চে আনে ‘এ ম্যান ফর অল সিজনস্’, আজাদ আবুল কালামের নির্দেশনায়। তারপর মুরাদ আহমেদের রচনা ও আজাদ আবুল কালামের নির্দেশনায় ‘কইন্যা’ এবং তৌফিকুল ইসলাম ইমনের নির্দেশনায় ‘গণ্ডার’, ‘কিনু কাহারের থেটার’। এরপর মঞ্চে আনে আজাদ আবুল কালামের নির্দেশনায় ‘রাজা এবং অন্যান্য...’ ও ‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি’। এই দলটাও জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে নাট্যচর্চার পাশাপাশি ‘প্রাচনাট স্কুল অফ অ্যাকটিং এন্ড ডিজাইন’ নামে একটি নাট্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছে দুই দশকের বেশি সময় ধরে।
তবে এ কথাও বলা জরুরি যে, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো জন্মের পর থেকে প্রথম দশকটি যে সক্ষমতা নিয়ে কাজ করেছিল ‘প্রাচ্যনাট’, পরবর্তী দশকে এসেই যেনো সেই সক্ষমতা ধীরে ধীরে ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে এবং পড়ছে। ‘প্রাচ্যনাট’-এর কাজের এবং সৃজনশীলতার সেই তেজ অনেকদিন যাবৎই আর আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না। কমে যাচ্ছে নতুন প্রযোজনা ও প্রদর্শনীর সংখ্যাও।২০০২ সালের ১৪ এপ্রিল, সেই মোতাবেক পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষে পথচলা শুরু করে নাট্যদল ‘পালাকার’। আমিনুর রহমান মুকুল, অনিকেত পাল, আলী আহমেদ মুকুলসহ নাট্যমনস্ক সতেরো যুবক একমনস্ক হয়ে দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। ‘পালাকার’-এর ভাষ্য অনুযায়ী একটি উন্মুক্ত নাটক ও ৪টি ক্লাসরুমপ্রযোজনাসহ অল্প সময়েই ‘পালাকার’ ২৬টি প্রযোজনা মঞ্চে আনে। ‘পালাকার’-এর আলোচিত প্রযোজনা সৈয়দ শামসুল হক রচিত ও আতাউর রহমান নির্দেশিত ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ মঞ্চে আসে ৭ নভেম্বর ২০১০ সালে। নাটকটির মুখ্য চরিত্র যুবক রবীন্দ্রনাথের ভূমিকায় শামীম সাগরের অভিনয় দর্শক-নাট্যজনকে মুগ্ধ করে। শামীম সাগরের নির্দেশনায় ২০১১ সালের ১৫ জুন ‘পালাকার’ মঞ্চে আনে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’। প্রদর্শনী হয় ১২টি। ১ অক্টোবর ২০১২ ‘পালাকার’ সৈয়দ শামসুল হক রচিত ও আতাউর রহমান নির্দেশিত ‘নারীগণ’ নাটকটি মঞ্চে আনে। প্রদর্শনী হয় ২০টি। আমিনুর রহমান মুকুল ১২ জানুয়ারি ২০১৩ সালে মঞ্চে আনে সাঈদ আহমদের অ্যাবসার্ড নাটক ‘কালবেলা’। প্রদর্শনী হয় মাত্র ১২টি। এর আগেও আমিনুর রহমান মুকুল ‘চার দেয়াল’, ‘বাহান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি’, ‘বিবিসাব’, ‘নোরার তিন কন্যা’ মঞ্চে আনলেও কোনো প্রযোজনারই খুব বেশি প্রদর্শনী করতে সক্ষম হয় নি। এরপরই যেন তারুণ্যে উজ্জ্বল এই দলটিকেও আলস্যে আক্রান্ত হতে দেখি। দলটি সংগঠিত হবার পর প্রথম দশকে কর্মব্যস্ততায় ও সৃজনশীলতায় যে ছন্দে পথ চলছিল, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যেন সেই ছন্দে ছেদ পড়ে। অবশেষে ২০১৮ সালের ১৬ মার্চ শামীম সাগরের নির্দেশনায় ‘পালাকার’ মঞ্চে আনে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র ‘উজানে মৃত্যু’। নাটকটি মঞ্চে আনার মধ্য দিয়ে আমরা দলটিকে আবারও উজ্জীবিত হতে দেখি। এরপর ২৮ জুন ২০১৯ দলটি আমিনুর রহমান মুকুলের নির্দেশনায় মঞ্চে এনেছে ‘রঙ লেগেছে’।
ষোল বছর নিয়মিত ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এ কাজ করা বক্ষ্যমান নিবন্ধের লেখক ‘নাগরিক’ থেকে আতাউর রহমান কর্তৃক বহিষ্কার হয়ে এবং নূনা আফরোজ ‘নাগরিক’ থেকে পদত্যাগ করে ২০০৩ সালে ৬ মে ‘প্রাঙ্গণেমোর’ নাট্যদলটি করার ঘোষণা দেন। দল গড়ার প্রক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে যুক্ত হন শিশির রহমান। নতুন দল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ‘প্রাঙ্গণেমোর’ এই ভাবনারও জানান দেয় যে, দলটি বাংলাদেশে রবীন্দ্র নাট্যচর্চাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে। দলটি এ পর্যন্ত ১৩টি প্রযোজানা মঞ্চে এনেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য অবলম্বনে ২০০৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনন্ত হিরা’র নির্দেশায় ‘প্রাঙ্গণেমোর’ মঞ্চে আনে ‘শ্যামা প্রেম’। নাটকটির দেশে-বিদেশে ৫৬টি প্রদর্শনী হয়েছে। ঐ একই বছর ২ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস থেকে নূনা আফরোজের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ‘স্বদেশী’। দেশে-বিদেশে নাটকটির ৩১টি প্রদর্শনী হয়েছে।
অনন্ত হিরা’র রচনা ও পরিচালনায় ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে মঞ্চে আসে ‘লোকনায়ক’। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ মঞ্চে আসে ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সালে। নির্দেশনা ও ‘নন্দিনী’ চরিত্রে অভিনয় করেন নূনা আফরোজ। নাটকটির প্রদর্শনী হয় ৫৬টি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘আলেয়া’ গীতিনাট্য অবলম্বনে মঞ্চে আসে ‘দ্রোহ প্রেম নারী’। প্রথম মঞ্চায়ন ২০১০ সালের ১৭ জুন। দলের হয়ে প্রথম নির্দেশনা দেন রামিজ রাজু। নাটকটির সর্বমোট প্রদর্শনী হয়েছে ১৭টি। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাস থেকে অনন্ত হিরা’র নাট্যরূপ ও নূনা আফরোজের নির্দেশনায় ২৬ অগাস্ট ২০১১ সালে ‘প্রাঙ্গণেমোর’ মঞ্চে আনে ‘শেষের কবিতা’। প্রদর্শনী হয়েছে ৩৪টি। নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় পশ্চিমবঙ্গের মধুসূদন মঞ্চে, পূর্ব পশ্চিম আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে। ২০১২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মোহিত চট্টপাধ্যায়ের রচনা ও অনন্ত হিরা’র নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ঐতিহাসিক নাটক ‘আওরঙ্গজেব’। প্রদর্শনী হয়েছে ৪৬টি। এছাড়াও ‘প্রাঙ্গণেমোর’ মঞ্চে আনে সৈয়দ শামসুল হকের নিরীক্ষাধর্মী কাব্যনাটক ‘ঈর্ষা’। অনন্ত হিরা’র নির্দেশনায় নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয় ২৬ এপ্রিল ২০১৩। তিন চরিত্রের এই নাটকটিতে অভিনয় করেন অনন্ত হিরা, নূনা আফরোজ ও রামিজ রাজু। প্রদর্শনী হয়েছে ৩৭টি।
২০১৪ ও ২০১৫ সালে কোনো নতুন প্রযোজনা না আনলেও ২০১৬ সালে ‘প্রাঙ্গণেমোর’ তিনটি নাটক মঞ্চে আনে। ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নূনা আফরোজের রচনা ও নির্দেশনায় ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ (প্রদর্শনী ৩৫টি), ১ এপ্রিল অনন্ত হিরা’র রচনা ও আউয়াল রেজা’র নির্দেশনায় ‘কনডেমড সেল’ (প্রদর্শনী ২৬টি) এবং ২৪ মে শিশির রহমানের রচনা ও নির্দেশনায় ‘বিবাদী সারগাম’ (প্রদর্শনী ৮টি)। ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি ‘প্রাঙ্গণেমোর’ মঞ্চে আনে অপূর্ব কুমার কু-ু’র রচনা ও অনন্ত হিরা’র নির্দেশনায় ‘মাইকেল মধুসূদন’। নাটকটির প্রদর্শনী হয়েছে ৮টি। ২০ এপ্রিল ২০১৮ সালে শাকুর মজিদের রচনা ও অনন্ত হিরা’র নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ‘হাছনজানের রাজা’। উল্লেখ্য, দলের ১৩টি প্রযোজনাই চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো প্রযোজনারই দেশে-বিদেশে মঞ্চস্থ হচ্ছে।
এছাড়াও মাত্র ১৬ বছরের পথ চলায় দলটি নাট্য উৎসব করেছে নয়টি। প্রথম ‘দুই বাংলার নাট্যমেলা ২০০৯’ আয়োজন করা হয় ১ থেকে ৮ মে জাতীয় নাট্যশালায়। উদ্বোধন করেন সৈয়দ শামসুল হক ও মামুনুর রশীদ। উৎসবের মূল ভাবনা ছিল ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া/বুকের মাঝে বিশ্ব লোকের পাবি সাড়া’। ঐ উৎসবে বাংলাদেশ থেকে ৫টি ও ভারত থেকে ৩টি রবীন্দ্রনাট্য প্রযোজনা যুক্ত হয়েছিল। উৎসবে রবীন্দ্রনাথের ‘শোধবোধ’ নাটক নিয়ে যুক্ত হয়েছিলেন ভারতবিখ্যাত নাট্যনির্দেশক বিভাস চক্রবর্তী।
২০১০ সালে দ্বিতীয়বার নাট্য উৎসব আয়োজন করে দলটি। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে ‘প্রাঙ্গণেমোর কর্ণফুলী নাট্যোৎসব’ অনুষ্ঠিত হয় ১ থেকে ৪ এপ্রিল, চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। উৎসবে একটি সেমিনারেরও আয়োজন করা হয়। তৃতীয় নাট্য উৎসব ‘দুই বাংলার নাট্যমেলা ২০১১’ আয়োজন করা হয় ১২ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলে একসঙ্গে মঞ্চস্থ হয় উৎসবের নাটক। ঐ নাট্য মেলায় ঢাকা, ঢাকার বাইরের ও দেশের বাইরের ১৮টি রবীন্দ্রনাট্য প্রযোজনাকে যুক্ত করা হয়। নাট্য উৎসবটি উদ্বোধন করেন একঝাঁক তরুণপ্রাণ নাট্যনির্দেশক, যাঁদের মধ্যে ছিলেন গাজী রাকায়েত, মোসলেম উদ্দিন সিকদার, সাইদুর রহমান লিপন, আরিফ হায়দার, আইরিন পারভীন লোপা, আকতারুজ্জামান, দেবাশীষ ঘোষ, অলোক বসু, জাহিদ রিপন, তৌফিকুল ইসলাম ইমন, মোহাম্মদ জসিম উদ্দীন, ইউসুফ হাসান অর্ক, তপন হাফিজ, শামীম সাগর, সাইফ সুমন ও আসাদুজ্জামান আসাদ। একটি সেমিনার আয়োজন করা হয়। বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের নাটকের চর্চা, সম্ভাবনা ও সংকট’ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আফসার আহামেদ। আলোচনায় ছিলেন ঊষা গাঙ্গুলী, আজাদ আবুল কালাম, ফয়েজ জহির ও হাসান শাহরিয়ার।চতুর্থ নাট্য উৎসব ২০১৩ সালে। সৈয়দ শামসুল হকের জীবনকালে তাঁরই সাতটি নাটক নিয়ে ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায় সৈয়দ শামসুল হক নাট্যোৎসব’ শিরোনামে। উৎসব চলেছিল ১৯ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। এছাড়াও আয়োজন করা হয়েছিল ‘নাট্যকার সান্নিধ্যে’ শিরোনামে বিশেষ অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠানে সৈয়দ শামসুল হকের নাটকে অভিনয় করেছেন এমন সকল প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রী ও নির্দেশকদের নিয়ে মিলনমেলা হয়ে উঠেছিল। ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই নাট্যকারের লেখা নাট্যাংশ অভিনয় ও পাঠ-অভিনয় করে শোনান তাঁদের প্রিয় নাট্যকারকে। ঐ অনুষ্ঠানেই নাট্যকারের উপর ‘প্রাঙ্গণেমোর’ নাট্যদলের নির্মিত ‘মোহর ঝরা, সোনার কলমওয়ালা একজন’ শিরোনামের তথ্যচিত্রের প্রথম প্রদর্শনী করা হয়।
একই বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালেই দলটির দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে করা হয় ‘প্রাঙ্গণেমোর ১০বছর পূর্তি নাট্যায়োজন’। শুধুমাত্র দলের নিজস্ব ৮টি প্রযোজনা নিয়ে ঐ উৎসব আয়োজন করা হয় ২২ থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত। ঐ উৎসবের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের নেপথ্য-কুশীলবরা যাঁরা ‘প্রাঙ্গণেমোর’ নাট্যদলের বিভিন্ন প্রযোজনায় ডিজাইনের কাজে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা হলেন ঠাণ্ডু রায়হান, ফয়েজ জহির, শাহীনুর রহমান, জিল্লুর রহমান, মজুমদার বিপ্লব, ইভান শাহরিয়ার সোহাগ, জাকির হোসেন শিপলু ও তৌফিক আজিম রবিন। উৎসবে অতিথি ছিলেন লিয়াকত আলী লাকী ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ। ২০১৫ সালে ‘দুই বাংলার নাট্যমেলায় রবীন্দ্রনাট্য ও অন্যান্য’ আয়োজন করা হয় ৬ থেকে ১২ মার্চ। উদ্বোধন করেন নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূর, আতাউর রহমান, রণজিৎ কুমান বিশ্বাস, সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় ও লিয়াকত আলী লাকী। ঐ উৎসবটি প্রয়াত অভিনেতা ও নির্দেশক খালেদ খানকে নিবেদন করা হয়।
৭ম আয়োজন ২০১৭ সালে ‘দুই বাংলার নাট্যমেলা ২০১৭’ শিরোনামে ১০ থেকে ১৮ মার্চ। মূল ভাবনা বা উৎসব স্লোগান ছিল ‘তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও, আমি এই বাংলার পাড়ে রয়ে যাব।’ ‘প্রাঙ্গণেমোর দুই বাংলার নাট্যমেলা ২০১৭’-এর শেষ দিন ‘খালেদ খান যুবরাজ বছরের সেরা নাটক ২০১৭’ প্রদান করা হয়। পদকটি অর্জন করে ‘বিবর্তন যশোর’, তাদের সাধনা আহমেদ রচিত এবং ইউসুফ হাসান অর্ক পরিচালিত ‘মাতব্রিং’ প্রযোজনার জন্য।
২০১৭ সালেই ১২ থেকে ১৮ অক্টোবর ‘প্রাঙ্গণেমোর নাট্যসপ্তাহ ২০১৭’ আয়োজন করা হয় ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে। যেখানে পরপর সাত দিন ‘প্রাঙ্গণেমোর’-এর ৭টি নাটকের প্রদর্শনী করা হয়। নাট্যসপ্তাহ উদ্বোধন করেন অভিনেত্রী, নাট্যনির্দেশক সারা যাকের।
২০১৭ সালেই ভারতের কলকাতায় হো চি মিন সরণির সত্যজিৎ রায় মিলনায়তনে ‘প্রাঙ্গণেমোর’ আয়োজন করে ‘বাংলাদেশ নাট্যোৎসব ২০১৭’। ৩ থেকে ৮ নভেম্বর। যেখানে পর পর সাতদিন শুধুমাত্র ‘প্রাঙ্গণেমোর’-এর ৭টি দর্শকনন্দিত প্রযোজনার প্রদর্শনী হয়। উৎসব উদ্বোধন করেন বিভাস চক্রবর্তী, অর্পিতা ঘোষ ও গৌতম দে। ঐ আয়োজনের সহযোগিতায় ছিল কলকাতার প্রথমসারির দু’টি নাট্যদল ‘অন্য থিয়েটার’ ও ‘পূর্ব পশ্চিম’। উৎসবে একটি সেমিনারও যুক্ত করা হয়, বিষয় ‘কেমন ছিলো, কেমন আছে, কেমন দেখতে চাই, দুই বাংলার নাট্য-সংস্কৃতির আদান-প্রদান’। সেমিনারে অংশ গ্রহণ করেন বিভাস চক্রবর্তী, গোলাম কুদ্দুস, প্রকাশ ভট্টাচার্য, দিলীপ দত্ত, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, আশিষ গোস্বামী, মোহিত বন্ধু অধিকারী, কিশোর সেনগুপ্ত, অভীক ভট্টাচার্য ও অংশুমান ভৌমিক। সেমিনারে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন অনন্ত হিরা।
নবম ও সর্বশেষ আয়োজন ২০১৮ সালে ২ থেকে ৬ নভেম্বর ‘রবীন্দ্রনাথে পাঁচ দিন প্রাঙ্গণেমোর’ শিরোনামে। এই আয়োজনে ‘প্রাঙ্গণেমোর’ প্রযোজনা শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের ৪টি নাটক ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি নাটকের প্রদর্শনী করা হয়। পরপর পাঁচ দিন চলে এই উৎসব। উৎসব উদ্বোধন করেন সৈয়দ জামিল আহামেদ ও প্রধান অতিথি ছিলেন ‘আইডিএলসি’ বাংলাদেশের সিইও আরিফ খান। উৎসবটি আয়োজন করা হয় মহিলা সমিতি মিলনায়তনে।
১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ‘লোক নাট্যদল’ (সিদ্ধেশ্বরী) আর তার ১৯৮৭ সালের প্রযোজনা ‘কঞ্জুস’ শব্দ দু’টি যেন একে অপরের সম্পূরক হয়ে গেছে। মলিয়ের-এর ‘মাইজার’ থেকে তারিক আনাম খানের রূপান্তর ও লিয়াকত আলী লাকী’র নির্দেশনায় ‘কঞ্জুস’ নাটকটি পুরো নব্বই দশক থেকে এখন পর্যন্ত হলে দর্শক টানার ক্ষেত্রে নতুন নতুন রেকর্ড গড়ে যাচ্ছে। রেকর্ড ভাঙা-গড়া নিয়ে এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। এই প্রযোজনা বাংলাদেশের মঞ্চে প্রথম তিনশত, চারশত, পাঁচশত, ছয়শত, সাতশত প্রদর্শনীর মাইল ফলক ছুঁয়েছে। প্রযোজনাটি এখনও চলমান এবং সমান জনপ্রিয়। এখন পর্যন্ত ‘কঞ্জুস’ নাটকের ৭১৬টি প্রদর্শনী হয়েছে।
১৯৯১ সালে মঞ্চে আসা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প থেকে লিয়াকত আলী লাকী’র রূপান্তর ও নির্দেশনায় ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ থেকে ২০০৪ সালে আসা ‘বাংলার মুখ’ পর্যন্ত দলটি একে একে ২৪টি প্রযোজনা মঞ্চে আনে। দলটির দর্শক-নাট্যজনের কাছে নন্দিত ও আলোচিত প্রযোজনাগুলো হচ্ছে ‘সোনাই মাধব’ (১৯৯৩) ও বুদ্ধদেব বসু রচিত ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’ (১৯৯৫)। দু’টি প্রযোজনারই নির্দেশক লিয়াকত আলী লাকী। ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’র নান্দনিক উপস্থাপনা দর্শক-নাট্যজনের মুগ্ধ করে। ঐ প্রযোজনায় তরঙ্গিনী চরিত্রে সাবিনা বারী লাকী’র অভিনয় সকলের কাছেই প্রশংসিত হয়। অন্যান্য প্রযোজনাগুলো তেমনভাবে দর্শক-নাট্যজনের মনে দাগ রেখে যেতে পারে নি এবং ঐ প্রযোজনাগুলোর খুব বেশি প্রদর্শনীও হয় নি। ‘মাঝরাতের মানুষেরা’ ৫৩টি ও ‘সিদ্ধিদাতা’ নাটকের ৩৫টি প্রদর্শনী হয়েছে। ‘সোনাই মাধব’ ২০১৫ সালে পুনরায় মঞ্চে আনা হয়। নাটকটির পূর্বের ৭৬টি সহ মোট ১২২টি প্রদর্শনী হয়েছে।
লিয়াকত আলী লাকী’র পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন-কর্মভিত্তিক গীতি আলেখ্য ‘মুজিব মানে মুক্তি’ মঞ্চে আনে দলটি। প্রযোজনাটি সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। এ পর্যন্ত নাটকটির ১২৩টি প্রদর্শনী হয়েছে। ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল দলটি বুদ্ধদেব বসু’র গল্প থেকে লিয়াকত আলী লাকী’র নাট্যরূপ, নির্দেশনা ও অভিনয়ে মঞ্চে আনে ‘আমরা তিনজন’। অনেকদিন পর আবারও গল্প-সংগীত-প্রয়োগ ও নির্দেশনার সৃজনশীলতা, সব মিলিয়ে ‘লোক নাট্যদল’ ও লিয়াকত আলী লাকী দর্শক-নাট্যজনকে মুগ্ধ করেছেন।
‘মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়’ দলটির পথ চলা শুরু আশির দশকে ১৪ জুলাই ১৯৮৩ থেকে। নব্বইয়ের দশকে দলটি মঞ্চে আনে সালাম সাকলাইন রচিত ও রশীদ হারুন নির্দেশিত ‘কথা কীর্ত্তন’ (১৯৯২ সালে)। নাটকটির প্রদর্শনী হয় মাত্র ৮টি। নাসির উদ্দিন ইউসুফের গল্প থেকে জন মার্টিনের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় ‘ঘুম নেই’ মঞ্চে আনে ১৯৯৪ সালে। প্রদর্শনী সংখ্যা ১০৬টি। ১৯৯৬ সালে চন্দন সেনের রচনা ও মাহবুবুর রহমানের নির্দেশনায় মঞ্চে আনে ‘আয়না’। প্রদর্শনী সংখ্যা ২২টি। সালাম সাকলাইনের রচনা ও দেবাশীষ ঘোষ নির্দেশিত ‘শিবানী সুন্দরী’ মঞ্চে আসে ২০০১ সালে। প্রদর্শনী ১৫টি। ২০০২ সালে দলটি মঞ্চে আনে আনন জামান রচিত ও রশীদ হারুন নির্দেশিত ‘শিখ-ী কথা’। নাটকটি হিজড়া সম্প্রদায়ের যাপিত জীবনসংগ্রামের উপর রচিত। নাটকটি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়। মে ২০১৯-এ নাটকটির ১৭৫ তম প্রদর্শনী এবং আনন জামান রচিত ও ইউসুফ হাসান অর্ক নির্দেশিত নন্দিত প্রযোজনা ‘নীলাখ্যান’ (২০১৫)-এর ৫০তম প্রদর্শনী হয় পরপর দুইদিন। এই নাট্যদলের নব্বইয়ের দশকের আরো একটি প্রযোজনা ময়মনসিংহ গীতিকা ‘দেওয়ান ভাবনা’ অবলম্বনে এস এম সোলায়মানের নাট্যরূপ ও হুমায়ুন কবীর হিমু’র নির্দেশনায় ‘সুনাই কন্যার পালা’ দর্শকপ্রিয় হয়। নাটকটির ১০৫টি প্রদর্শনী হয়েছে। ২০০৮ সালে মঞ্চে আসে আনন জামান রচিত ‘অহম তমশায়’, নির্দেশনায় ছিলেন আজাদ আবুল কালাম। প্রদর্শনী সংখ্যা ৩৫টি। এরপর আনন জামানের রচনা ও আশিকুর রহমান লিয়নের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ‘নিশিমন বিসর্জন’, যেটির প্রদর্শনী হয়েছে ৫৮টি। আনন জামানের রচনা ও মুস্তাফিজুর নূর ইমরানের নির্দেশনায় ‘প্রমিথিউস’ মঞ্চে আসে ২০১৩ সালে। এ পর্যন্ত প্রদর্শনী সংখ্যা ১৭টি। ১৪ অগাস্ট ২০১৮ সালে ‘মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়’ মঞ্চে আনে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও তাঁর হত্যাকা-ের উপর নাটক ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’। রচনা: আনন জামান ও নির্দেশনা: আশিকুর রহমান লিয়ন। নাটকটির এ পর্যন্ত ১৩টি প্রদর্শনী হয়েছে।
এছাড়াও ‘মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়’ ২০০০ সাল থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়কালে ৭টি বড় নাট্য উৎসব আয়োজন করে ঢাকায়। ২০০০ সালে ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে আয়োজন করে ১০ দিন ব্যাপী লোকজ নাট্য উৎসব, যে উৎসবে ঢাকার বাইরের কয়েকটি দল এবং ভারতের ‘ষড়ভুজ’ নামের একটি নাট্যদল অংশ নেয়।
২০০৩ সালে দলের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১০ দিন ব্যাপী নাট্য উৎসব আয়োজন করা হয় মহিলা সমিতির মঞ্চে। ২০০৭ সালে দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে আয়োজন করা হয় ১২ দিন ব্যাপী উৎসব শিল্পকলা একাডেমিতে। যে উৎসবে পশ্চিমবঙ্গের দু’টি এবং ত্রিপুরার একটি দলকে যুক্ত করা হয়। ২৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৯ সালে ৮ দিন ব্যাপী নাট্য উৎসব আয়োজন করা হয় শিল্পকলা একাডেমির দু’টি হলে। ঐ উৎসবে ৬টি বিভাগীয় শহর থেকে ৬টি নাট্যদলকে যুক্ত করা হয়। ২০১১ সালে বিজয়ের ৪০ বছর উপলক্ষে ৮ দিন ব্যাপী উৎসব হয় জাতীয় নাট্যশালার ৩টি হলে। দলের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৩ সালে ১৩ দিন ব্যাপী বিশ্বনাটকের যৌথ উৎসব হয়। ঐ উৎসবে ৩৭টি দলের ৩৯টি নাটকের প্রদর্শনী হয়, যার মধ্যে ভারতের ছিল ৭টি নাটক। উৎসবটির আয়োজন করা হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমির ৩টি হল ও ছায়ানট মিলনায়তনে। ২০১৪ সালে ‘শিখ-ী কথা জাতীয় নাট্য উৎসব’-এর আয়োজন করা হয়, যেখানে প্রতি বিভাগের একটি করে দল ঐ একই নাটক ‘শিখ-ী কথা’ নাটকের প্রদর্শনী করে। মোট অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিল ৯টি। বিগত ৩ দশক ধরেই ঢাকার সক্রিয় নাট্যদলগুলোর অন্যতম ‘মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়’।
বাংলাদেশের অনন্য আবৃত্তি সংগঠন ‘কণ্ঠশীলন’। দীর্ঘদিন যাবৎ দলটি শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তিশিল্পের চর্চা ও বিকাশে নিবেদিত। ওয়াহিদুল হকের আশীর্বাদধন্য এই সংগঠনটি নাটকের চর্চায় যুক্ত হয় প্রয়াত অভিনেতা ও নির্দেশক খালেদ খানের অনুপ্রেরনায় এবং পরামর্শে। ১৯৯৩ সালে। আর তাই দলটির পর পর তিনটি প্রযোজনারই নির্দেশক খালেদ খান। প্রথম প্রযোজনা হেনরিক ইবসেনের শম্ভু মিত্র’র নাট্যরূপ ‘পুতুল খেলা’। মঞ্চে আসে ১৭ জানুয়ারি ১৯৯৩ সালে। প্রদর্শনী হয়েছিল ২৫টি। বলা যায়, ‘কণ্ঠশীলন’ প্রযোজিত ৮টি প্রযোজনার মধ্যে ‘পুতুল খেলা’ সবচেয়ে সু-নির্দেশিত, সু-অভিনীত ও আলোচিত নাটক। দু’টি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন গোলাম সারোয়ার ও নায়লা কাকলী।
হেনরিক ইবসেনের ‘দ্য মাস্টার বিল্ডার’ অবলম্বনে আবদুল হকের অনুবাদ ‘কারিগর’। মঞ্চে আসে ৮ অগাস্ট ২০০৪ সালে। প্রদর্শনী হয় ১০টি। এরপর মীর বরকতের নির্দেশনায় দলটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রাজা-রানী’ মঞ্চে আনে ১৩ অক্টোবর ২০০৫ সালে। প্রদর্শনী হয় ১২টি। ১৩ অগাস্ট ২০১২ সালে সৈয়দ শামসুল হকের ‘উত্তরবংশ’ মঞ্চে আসে গোলাম সারোয়ারের নির্দেশনায়। প্রদর্শনী হয় মাত্র ৮টি। মনোজ মিত্রের নাটক ‘যা নেই ভারতে’ মীর বরকতের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ৪ মে ২০১৪ সালে। প্রদর্শনী হয় ২০টি এবং ‘যাদুর লাটিম’ নাগির মাহফুজের মূল গল্প থেকে রাফিক হারিরি’র রূপান্তর ও মীর বরকতের নির্দেশনায় ২৫ অগাস্ট ২০১৭ সালে মঞ্চে আসে। প্রদর্শনী হয় ১৫টি। দলটির এখনও ভালো নাটক প্রযোজনার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
‘দৃশ্যপট’ নাট্যদলের যাত্রা ১৯৯৩ সালের ৬ জানুয়ারি। শুরুতে দলের নাম ছিল ‘জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার-ঢাকা। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে ঢাকায় চলে আসে নেহাল আহমেদ, হাসান শাহরিয়ার, শফিকুর রহমান স্বপন, আলী মাহমুদসহ আরও কয়েকজন। সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকার কোনো নাট্যদলে যোগ না দিয়ে নিজেরাই দল গঠন করে স্বাধীনভাবে নাটকের কাজ চালিয়ে যাবেন। অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে সভাপতি করে তাঁরা গঠন করলেন ‘জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার-ঢাকা’। দলে তখন প্রায় সকল সদস্যই ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন বা তৎকালীন নিয়মিত শিক্ষার্থী। প্রথম প্রযোজনা ছিল মনোজ মিত্র রচিত ও নেহাল আহমেদ নির্দেশিত ‘নরক গুলজার’। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে এসেছিল মামুনুর রশীদ রচিত ও নির্দেশিত ‘পাবলিক’ ও গিরিশ কার্নাড রচিত ও আলী মাহমুদ নির্দেশিত ‘নাটম-ল’।
এরপর কিছুদিন বিরতি দিয়ে ‘জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার-ঢাকা’র চতুর্থ প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে আসে শিশিরকুমার দাশ রচিত ও রাজু আহমেদ নির্দেশিত ‘সক্রেটিসের জবানবন্দী’। আনুমানিক ২০টি প্রদর্শনীর পর এর মঞ্চায়ন বন্ধ হয়ে যায়। ২০০০ সালের পর দ্বিতীয় দফায় দলীয় নির্দেশক-দলের মাধ্যমে এবং ২০০৮ সালে তৃতীয় দফায় আলী মাহমুদের নির্দেশনায় নাটকটি পুনরায় মঞ্চে আসে। এখন পর্যন্ত নাটকটির ১৪০টি প্রদর্শনী হয়েছে। এরই মধ্যে ১৯৯৮ দলটির নাম পরিবর্তন করে ‘দৃশ্যপট’ রাখা হয়।
UNESCO ঘোষিত ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’টি নিয়মিতভাবে উদ্যাপন করছে ‘দৃশ্যপট’। বিগত ২০১৪ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’-এ দেশের নিবেদিত শিক্ষকগণকে সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষকের মিলন মেলা ও নাট্যপ্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছে ‘দৃশ্যপট’। এ পর্যন্ত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বরেণ্য অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রবীণ শিক্ষিকা শ্রীমতি দেবিকা গুহ, জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, অধ্যাপক ড. এম. এ মাননান, প্রবীণ শিক্ষিকা মাহফুজা খাতুন, জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক সত্যজিৎ বিশ্বাস ও মফিজ উদ্দিনকে শিক্ষক সম্মাননা প্রদান করেছে ‘দৃশ্যপট’। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের তথা নতুন প্রজন্মকে নাটক ও মঞ্চমুখি করার কাজে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে ‘দৃশ্যপট’।৭ জানুয়ারি ১৯৭৭ সালে তৈরি হয় ‘সুবচন নাট্য সংসদ’। নব্বইয়ের দশকের ‘খানদানী কিস্সা’ ও ‘রাষ্ট্র বনাম’ খুবই আলোচিত ও দর্শকনন্দিত প্রযোজনা। এস এম সোলায়মানের রচনা ও নির্দেশনায় ‘খানদানী কিস্সা’ মঞ্চে আসে ২৮ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে। মোট প্রদর্শনী হয় ১১০টি। মামুনুর রশীদের রচনা ও নির্দেশায় ‘রাষ্ট্র বনাম’ মঞ্চে আসে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সালে। প্রদর্শনী হয় ৬৭টি। শেক্সপীয়রের ‘টুয়েলভথ্ নাইট’ মঞ্চে আনে ইসরাফিল শাহীনের নির্দেশনায় ১৯৯৮ সালে। মোট প্রদর্শনী ১৫টি। সামিনা লুৎফা নিত্রা’র রচনা ও ফয়েজ জহিরের নির্দেশনায় ‘তীর্থঙ্কর’ মঞ্চে আসে ২৩ অগাস্ট ২০০১ সালে। নাট্যরচনাশৈলী, বিষয় নির্বাচন এবং নির্দেশকের সৃজনশীলতায় নাটকটি বেশ আলোচিত হয়। নাটকটির মঞ্চ, আলো এবং পোশাক পরিকল্পনার কাজটিও করেন ফয়েজ জহির। নাটকটির মোট প্রদর্শনী হয় ৫৩টি।
রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে খালেদ খানের নির্দেশনায় ১ সেপ্টেম্বর ২০০৫ সারে মঞ্চে আসে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’। প্রদর্শনী হয় ৩২টি। নাসরিন জাহান রচিত ‘রূপবতী’ও (২০০৬) মঞ্চে আসে খালেদ খানের নির্দেশনায়। এর প্রদর্শনী হয় ৫০টি। সামিনা লুৎফা নিত্রা রচিত ‘খনা’ মঞ্চে আসে মোহাম্মদ আলী হায়দারের নির্দেশনায়। ২০০৮ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি। ঐ প্রযোজনার মাত্র ১১টি প্রদর্শনী হবার পর মতভিন্নতার কারণে দলটি বিভক্তির দিকে পা বাড়ায়। মিজানুর রহমান, মোহাম্মদ আলী হায়দার, সামিনা লুৎফা নিত্রাসহ অনেকেই দল থেকে চলে গিয়ে ‘বটতলা’ নামে নাট্যদল গড়ে থিয়েটারচর্চা অব্যাহত রাখে। এবং পরে ‘বটতলা’র ব্যানারে ‘খনা’ নাটকটির নিয়মিত মঞ্চায়ন হতে থাকে। প্রযোজনাটির ‘সুবচন’ এ আর প্রদর্শনী সংখ্যা বাড়েনি।
২০১০ সালের ১৮ জুন দলটি মঞ্চে আনে শাকুর মজিদ রচিত ও সুদীপ চক্রবতী নির্দেশিত ‘মহাজনের নাও’। ভাটি অঞ্চলের সাধক বাউল শাহ্ আবদুল করিমের কর্ম ও জীবন আশ্রিত এই নাটকটি খুবই জনপ্রিয় হয়। দেশে বিদেশে এখন পর্যন্ত নাটকটির ১২৪টি প্রদর্শনী হয়েছে। লন্ডন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভুটান, কলকাতা, ৮ম থিয়েটার অলিম্পিক্স-এ ঊড়িষ্যা ও দিল্লীসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ‘মহাজনের নাও’ মঞ্চস্থ করেছে দলটি। ‘সুবচন নাট্য সংসদ’ ঢাকার একটি অন্যতম সক্রিয় দল।২০০৪ সালের ১ ডিসেম্বর তপন হাফিজ ও রিয়া মাহমুদের যৌথ প্রয়াসে সংগঠিত হয় ‘নাট্যতীর্থ’। দলটি তার প্রথম প্রযোজনা নিয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হয় ২৯ এপ্রিল ২০০৫ সালে। নাটকের নাম ‘কমলা সুন্দরী’। মূল পালা দ্বিজ ঈশান থেকে নাট্যরূপ ও গীত রচনা করেন আব্দুল হালিম আজিজ। নির্দেশনা দেন তপন হাফিজ। পর্যায়ক্রমে দলটি কয়েকটি (৫টি) পথনাটকসহ ৭টি প্রযোজনা মঞ্চে আনলেও দলের সর্বাধিক মঞ্চায়িত নাটক ‘কমলা সুন্দরী’ ও ‘দ্বীপ’। উৎপল দত্ত রচিত ‘দ্বীপ’ নাটকটিও নির্দেশনা দেন তপন হাফিজ। এরপর প্রদর্শনীর সংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে তপন হাফিজ নির্দেশিত ‘ঋষিকাব্য’ ও ‘কঙ্কাল’। এ পর্যন্ত আবদুল হালিম রচিত ‘ঋষিকাব্য’র ৩৬টি প্রদর্শনী হয়েছে আর রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প থেকে ‘কঙ্কাল’ নাটকের নাট্যরূপ দেন রবিউল আলম, এ নাটকের প্রদর্শনী হয়েছে ৩৪টি। এছাড়াও ‘নাট্যতীর্থ’ ৪টি নাট্য উৎসব আয়োজন করে। রজত যোগ রজত সমান সুবর্ণ জয়ন্তী নাট্যোৎসব আয়োজন করা হয় ২০১০ সালে। পঞ্চদশের পঞ্চদিন ২০১৩ সালে। ‘সুন্দরী নাট্যমেলা ২০১৬’ এবং ‘শতরজনী নাট্যমেলা ২০১৯’ নামেও দু’টি নাট্য উৎসবের আয়োজন করে সময়ের অন্যতম সক্রিয় দল ‘নাট্যতীর্থ’।
‘ঢাকা পদাতিক’-এর এক সময়কার তুখোর অভিনেতা ও ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-উত্তীর্ণ আশীষ খন্দকারের ভাবনা ও প্রচেষ্টায় ১৯৯১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় ‘স্পেস এ্যান্ড এ্যাকটিং রিসার্চ সেন্টার’। সূচনালগ্নেই তিনি একটি অন্যরকম নাট্যভাবনার সঙ্গে পরিচয় করান ঢাকার দর্শক-নাট্যজনকে। নবভাবনাটি তখন ‘পরিবেশ থিয়েটার’ নামে পরিচিতি পায়। প্রথম কাজটি বর্তমান ঢাকা শিল্পকলা একাডেমি চত্ত্বরে পুরনো লম্বা হল-কর্মচারীদের ক্যান্টিন- বর্তমান ডিজি ভবন-চিত্রশালা প্লাজা এলাকায় ১৯৯১ সালের। নাম ‘প্রত্ন’। আশীষ খন্দকারের পরিকল্পনা ও পরিচালানায় ‘প্রত্ন’ সৃষ্টির বিষয় ছিল মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে রাতের অন্ধকারে রাজাকার দ্বারা বুদ্ধিজীবী হত্যা। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ক্যাম্পাসের গোল পানিবিহীন পুকুরটিকে ঘিরে আরেকটি কাজ করেন- নাম ‘মোহাম্মদ আমিন’। শুকনো পুকুরের তলদেশ থেকে শুরু করে পাড় এবং চারদিকের পুরো এলাকাটি আলোক পরিকল্পনায় আলোকিত করে অভিনয় অঞ্চল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পুকুরের ঢালু পাড় কেটে কেটে করা হয় দর্শকগ্যালারি। আশীষ খন্দকারের ‘পরিবেশ থিয়েটার’ ভাবনা ও প্রথম দিককার সকল কাজের এমনকি ‘স্পেস এ্যান্ড এ্যাকটিং রিসার্চ সেন্টার’ গঠন প্রক্রিয়ার অংশীজন ছিলেন মোহাম্মদ আমিন ও ওয়াহেদ মুরাদসহ আরো অনেকে। ঐ একই প্রক্রিয়ার অর্থাৎ ‘পরিবেশ থিয়েটার’ ভাবনা থেকে তাঁরা ঢাকায় একে একে আরও কয়েকটি প্রযোজনা করেন। ‘চন্দ্রবিন্দু’- বর্তমান বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজকে ‘বৃত্ত’ করে অভিনীত হয়েছিল ঐ থিয়েটার। ‘চন্দ্রবিন্দু’ রচনা করেন ওয়াহেদ মুরাদ। এরপর আয়োজন করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ’৭১-এর শহীদ মধুদা’র স্মৃতি মুখরিত মধুর কেন্টিনকে কেন্দ্র করে। ‘কারখানা’ নামের আরেকটি প্রযোজনা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)-কে কেন্দ্র করে এবং শেষ প্রযোজনাটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই জগন্নাথ হলকে কেন্দ্র করে ‘ডেট লাইন জগন্নাথ হল’ শিরোনামে। সবগুলো প্রযোজনারই পরিকল্পনা ও নির্দেশনার কাজটি করেন আশীষ খন্দকার। ১৯৯৬ সালে জ্যাঁ জিরাদু থেকে ‘ব্যোম’ নামে একটি মঞ্চনাটক করা হয় আশীষ খন্দকারের রূপান্তর ও নির্দেশনায়। প্রদর্শনী হয় মাত্র ৬টি। তাঁরই রচনা ও নির্দেশনায় ‘একটি শিরোনামহীন নাটক’ মঞ্চে আনা হয় ১৯৯৮ সালে, প্রদর্শনী হয় ১৫টি। অসবর্ন-এর মূল নাটক থেকে আশীষ খন্দকারের অনুবাদ ও নির্দেশনায় ‘লুক ব্যাক ইন এ্যাঙ্গার’ মঞ্চে আনা হয়। এরপর ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় উদীচী’র নাটক বিভাগ থেকে থেকে আশীষ খন্দকার মঞ্চে আনেন মলিয়েরের ‘বউদের পাঠশালা’। এই নাটক দু’টির খুব বেশি প্রদর্শনী হয় নি। এরপর থেকে দীর্ঘ সময় মঞ্চে কাজ করার ক্ষেত্রে এই গুণী নাট্যনির্দেশককে আর সক্রিয় পাওয়া যায় নি। কারণটি অজ্ঞাত। একটা লম্বা বিরতির পর ২০১৯ সালে তিনি একটি ৪০ মিনিট ব্যাপ্তিকালের ছোট নাটক মঞ্চে আনেন। নাটকটির নাম ‘দুই আগন্তুক বনাম করবী ফুল’। ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই নাটকটির একটি প্রদর্শনী হয় স্টুডিও থিয়েটার হলে।
‘শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র’ ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামে সংগঠিত হলেও দলটি ঢাকায় নিয়মিত নাট্যচর্চার সূচনা করে মহিলা সমিতি মঞ্চে ২০০৭ সালে, বিজয় ভট্টাচার্য্য রচিত ও খোরশেদুল আলম নির্দেশিত ‘ছায়াবৃত্তা’ নাটকের প্রদর্শনী দিয়ে। সেই থেকে দলটি ‘দর্পণ সাক্ষী’ নাটকের ১৭টি, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে’ নাটকের ১৫টি, ‘রাজা সাহিত্য কারখানা’ নাটকের ৯৯টি, ‘তৃতীয় একজন’ নাটকের ২১টি, ‘ইনফরমার’ নাটকের ৪৭টি, ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’ নাটকের ৬৩টি ও ‘চম্পাবতী’ নাটকের ২৫টি প্রদর্শনী করেছে।
২০১৩ সালে দলটি ১১, ১২ ও ১৩ অক্টোবর ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে ‘শব্দ নাট্য আসর’ শিরোনামে ৩ দিনের একটি উৎসব করে। একইভাবে ২০১৪ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ আবারও শিল্পকলা একাডেমিতে ৩ দিনের একটি নাট্য উৎসব আয়োজন করে। ২০১২ সাল থেকে দলটি এই লেখার কাল পর্যন্ত ভারতের দিল্লি, আসাম, এলাহাবাদ, ত্রিপুরাসহ পশ্চিমবঙ্গের ১৮টি জেলায় ১০টি প্রযোজনার ১৪৮টি প্রদর্শনী করেছে।
‘সীমানা পেরিয়ে শততম মঞ্চায়নে শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র’ শিরোনামে তারা ২০১৬ সালের ১৭ ও ১৮ জুন কলকাতার ‘তপন থিয়েটার’-এ দুইদিনে নিজস্ব প্রযোজনার ৬টি প্রদর্শনী করে। সেই সঙ্গে ‘বাংলা নাটকের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে একটি সেমিনারেরও আয়োজন করে। এছাড়াও উল্লেখিত সময়কালে ঢাকায় এবং কলকাতায় একাধিকবার ‘থিয়েটার ক্যাম্প’ ও ‘থিয়েটার আড্ডা’র আয়োজন করেছে ‘শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র’।
আব্দুল হালিম আজিজ তাঁর অন্য তিন বন্ধু কামরুজ্জামান কামাল, আনোয়ার হোসেন ও শফিক রহমানকে নিয়ে ১৯৮৪ সালের ১১ নভেম্বর গড়ে তোলেন ‘দৃষ্টিপাত নাট্য সম্প্রদায়’। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা আব্দুল হালিম আজিজ রচিত ও নির্দেশিত ‘হানাদার’, ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে মাসুম আজিজ নির্দেশিত ‘রূপবতী’ ও আব্দুল হালিম আজিজ রচিত ও নির্দেশিত ‘তিনপুরুষের মাথায়’। ১৯৯৮ সালে মতভিন্নতার কারণে স. আ. আলমের নেতৃত্বে কিছু সদস্য আলাদাভাবে ‘দৃষ্টিপাত নাট্য সংসদ’ নামে কাজ শুরু করে আর আব্দুল হালিম আজিজ ‘দৃষ্টিপাত নাট্যদল’ নামে নাট্যচর্চা অব্যাহত রাখেন।
একটি বিদেশি গল্প থেকে আব্দুল হালিম আজিজের রূপান্তরে সফোক্লিসের জগৎ বিখ্যাত নাটক ‘ওয়াদিপাউস’ মঞ্চে আনে ‘রাজা হিমাদ্রী’ নামে। ২০১২ সালে তাজমিনুর রহমানের নির্দেশনায় ‘দৃষ্টিপাত নাট্যদল’-এর ‘রাজা হিমাদ্রী’ মঞ্চে আসে। নাটকটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন নির্দেশক স্বয়ং। ২০১৬ সালে দলটি ঋত্বিক ঘটকের ‘জ্বালা’ নাটকটি মঞ্চে আনে অভিজিৎ সেনগুপ্ত’র নির্দেশনায়।
ম. আ. সালামসহ কাজী আনিস, স্বপন দাস, সালাম বাদল, সাঈদ হাসান, এনামুল হক নিউটন, সবুজ মল্লিক, আকাশ আহমেদ, আফরোজ বেগম শিউলি, শুক্লা হালদার, এস এ হক অলিক প্রমূখের সৃষ্ট ‘দৃষ্টিপাত নাট্য সংসদ’ ১৯৯৮ সালে ‘দৃষ্টিপাত নাট্য সম্প্রদায়ে’র ব্যানারে মঞ্চে আসা (১৯৯৩) ম. আ. সালাম রচিত ও নির্দেশিত ‘নাগর আলীর কিসসা’ পুনরায় মঞ্চে আনে। নাটকটির ১৪২টি প্রদর্শনী হয়েছে। ২০০৭ সালে দলটি মান্নান হীরা’র রচনা ও নির্দেশনায় মঞ্চে আনে ‘বিচারপতি ঘুমিয়ে গ্যাছেন’। নাটকটির প্রদর্শনী হয় ১৮টি। ২০১৫ সালে পরপর দু’টি প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে মঞ্চে আসে ম. আ. সালাম রচিত ও নির্দেশিত ‘কয়লা রঙের চাদর’। প্রদর্শনী হয়েছে ১৫টি। এছাড়াও দলটি ২০০৯ সালে ৫ দিন ব্যাপী একটি নাট্য উৎসবের আয়োজন করে।
‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ থেকে মতভিন্নতার কারণে আলাদা হয়ে দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাসদস্য ড. ইনামুল হক, লাকী ইনাম, জামালউদ্দিন হোসেন, রওশন আরা হোসেন ও আবুল কাশেম প্রমূখ নাট্যজন ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’ নামে নতুন দল গঠন করেন ১ জানুয়ারি ১৯৯৫ সালে। ড. ইনামুল হকের নির্দেশনায় দলটি প্রথম মঞ্চে আনে ‘খোলস’। লাকী ইনামের রূপান্তরিত নাটকটি মঞ্চে আসে ৩ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে। এরপর দলটি একে একে আরও ৪টি প্রযোজনা মঞ্চে আনলেও, দর্শক-নাট্যজনের প্রথম আলোচনায় আসে ‘জনতার রঙ্গশালা’। ব্রেখটের এই নাটকের রূপান্তর করেন মুজিবুর রহমান দিলু ও নির্দেশনা দেন জামালউদ্দিন হোসেন।
দু’বছর কাজ করার পর দলটি একটি নাট্য উৎসবের আয়োজন করে ১৯৯৭ সালে। ঐ নাট্য উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল গ্রুপ থিয়েটার চর্চার পথিকৃৎ নাট্যদল ‘বহুরূপী নাট্য সম্প্রদায়’। ঐ নাট্য উৎসবকে কেন্দ্র করে মতবিরোধের কারণে দলটি আবারও বিভক্ত হয়। ড. ইনামুল হক ও লাকী ইনামসহ একটি অংশ মূল নাম ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’ নিয়ে কাজ করতে থাকে এবং জামালউদ্দিন হোসেন, রওশন আরা হোসেন, আবুল কাশেম প্রমূখ ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল’ নামে কাজ করতে শুরু করে। বিভক্তির পর ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল’ যে কাজগুলো করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শম্ভু মিত্র রচিত ও জামালউদ্দিন হোসেন নির্দেশিত ‘চাঁদ বনিকের পালা’। পরবর্তী সময়ে জামালউদ্দিন হোসেন ও রওশন আরা হোসেন আমেরিকা প্রবাসী হলে ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল’-এর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা বা কর্মকা- লক্ষ করা যায় না।
অপরদিকে ড. ইনামুল হকের নেতৃত্বাধীন ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’ পর্যায়ক্রমে নিয়মিত কাজ করে যেতে থাকে। ‘জনতার রঙ্গশালা’ নাটকটি তারা ড. ইনামুল হকের পুনঃনির্দেশনায় প্রদর্শনী চালিয়ে যেতে থাকে এবং শতাধিক প্রদর্শনীও করে। এছাড়াও দলটি পর্যায়ক্রমে ২২টি প্রযোজনা করলেও উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা হলো- দীপক সেন রচিত ও লাকী ইনাম রূপান্তরিত ও নির্দেশিত ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি নিজেই। দর্শক-নাট্যজনের পর্যবেক্ষণে ড. ইনামুল হক ও লাকী ইনামের কন্যা হৃদি হক, মাহমুদুল ইসলাম সেলিমসহ নতুন প্রজন্মের কর্মে ও সৃজনশীলতায় যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প থেকে মাহমুদুল ইসলাম সেলিমের নাট্যরূপ ও লাকী ইনামের নির্দেশনায় দলটি মঞ্চে আনে ‘প্রাগৈতিহাসিক’। মুখ্য দু’টি চরিত্রে অভিনয় করেন হৃদি হক ও মাহমুদুল ইসলাম সেলিম। এই প্রযোজনাটি দর্শক-নাট্যজনে আলেচিত হয় এবং নাটকটির শতাধিক প্রদর্শনীও সম্পন্ন হয়। দলটির আরও একটি দর্শকনন্দিত-আলোচিত প্রযোজনা ‘গওহর বাদশা ও বানেছাপরী’। বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোককাহিনি থেকে নাটকটির পুনঃকথন ও নির্দেশনার কাজটি করেন হৃদি হক। তিনি বানেছাপরী চরিত্রে অভিনয়ও করেন। এ লেখা পর্যন্ত নাটকটির প্রদর্শনী হয়েছে ৪৫টি।
এরপর দলটি ইনামুল হক রচিত ও লাকী ইনাম নির্দেশিত ‘গৃহবাসী’ মঞ্চে আনে। তারপর মঞ্চে আনা বের্টল্ট ব্রেখট থেকে ইসরাফিল শাহীন রূপান্তরিত ও নির্দেশিত ‘গোল মাথা চোখা মাথা’ও সমাদৃত হয়। নাটকটির এ পর্যন্ত ৬০টি প্রদর্শনী হয়। ‘পুশি বিড়াল ও একজন প্রকৃত মানুষ’ নির্দেশনা দেন লাকী ইনাম। আর্থার মিলারের নাটক থেকে অনুবাদ করেন প্রীতি হক। এছাড়াও দলটি ড. ইনামুল হকের সম্পাদনায় ‘শুধু নাটক’ নামে একটি থিয়েটারবিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ করছে অনিয়মিতভাবে। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা বের হয় ১৯৯৫ সালে। এখন পর্যন্ত এর ১২টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকার অন্যতম সক্রিয় দল এই ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’।
‘ঢাকা পদাতিক’ ‘বিষাদ সিন্ধু’ (এক) মঞ্চে আনে ৮ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে। এবং ‘বিষাদ সিন্ধু (দুই) মঞ্চে আনে ২১ জুন ১৯৯২ সালে। দু’টি প্রযোজনাই ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। এরপর পর্যায়ক্রমে দলটি ‘ফেরা’, ‘রূপকুমার’, ‘একটি যুদ্ধ’, ‘আলাল দুলালের পালা’, ‘যাত্রী’ ইত্যাদি নাটকগুলো মঞ্চে আনলেও কোনো প্রযোজনাই তেমন আলোচিত বা দর্শকনন্দিত হয় নি। বরং ১৯৯৩ সাল থেকে শুরু করে পুরো একটা দশক দলটিতে ভালো মানের প্রযোজনা ও সৃজনশীলতার সংকট লক্ষ করা গেছে। ২০০৫ সালে দলটি কুমার প্রীতীশ বল রচিত এবং দেবাশীষ ঘোষ নির্দেশিত ‘কথা’৭১’ নাটকটি মঞ্চে আনে। বলা যায় ‘বিষাদ সিন্ধু’র পর পুনরায় ‘ঢাকা পদাতিক’-এর ‘কথা’৭১’ নাটকটি দর্শক-নাট্যজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। অনেক বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৯ সাল থেকে পুনরায় নাটকটির প্রদর্শনী শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রদর্শনী সংখ্যা ৫৩টি। নাটকটি এখনও চলমান। ২০১৮ সালে ‘ঢাকা পদাতিক’ মঞ্চে আনে মাসুম আজিজ রচিত ও নির্দেশিত ‘ট্রায়াল অব সূর্যসেন’। এই নাটকটিও চলমান প্রযোজনা।
পুরনো দল হলেও নব্বইয়ের দশকে এবং তার পরেও কয়েকটি প্রযোজনার জন্য আলোচনায় আসে নাট্যদল ‘সময়’। ঐ সমকালে দলটির উল্লেখযোগ্য আলোচিত ও দর্শকনন্দিত প্রযোজনা সাদাত হোসেন মান্টোর গল্প থেকে মান্নান হীরা রচিত ও আলী যাকের নির্দেশিত ‘ভাগের মানুষ’। নাটকটি ১৯৯৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর মঞ্চে আসে। এখন পর্যন্ত ঢাকা, ঢাকার বাইরে ও দেশের বাইরে নাটকটির ১৭৯টি প্রদর্শনী হয়েছে। আলোচ্য সময়কালে মঞ্চে আসা ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’ও আলোচিত হয়। নাটকটি রচনা করেন মান্নান হীরা এবং নির্দেশনা দেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। নাটকটির ৪৫টি প্রদর্শনী হয়েছিল। এছাড়াও ‘সময়’ মঞ্চে আনে ‘বাবা তার্তুফ’, ‘সাদা ঘোড়া’, ‘শেষ সংলাপ’, ‘যযাতি’। উক্ত নাটকগুলোর মধ্যে ‘শেষ সংলাপ’ (৮৯টি প্রদর্শনী) ও ‘যযাতি’ (১০টি প্রদর্শনী) প্রশংসিত হয়। দু’টি নাটকই নির্দেশনা দেন আকতারুজ্জামান।
এবার একটু পুরনো পথিকৃৎ নাট্যদলগুলোর দিকে আলো ফেলা যাক। ‘থিয়েটারওয়ালা’র সমসময়ে এবং তার আগের নব্বই দশক জুড়ে তাঁরা কী করেছেন? বাংলাদেশে দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চার পথিকৃৎ নাট্যদল ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ ১৯৯১ সালে শেক্সপীয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটক অবলম্বনে ‘দর্পণ’ মঞ্চে আনে। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন আলী যাকের। নাটকটি দর্শকনন্দিত হয়, বিশেষ করে ‘দর্পণ’ চরিত্রে খালেদ খান ও কুলসুম চরিত্রে শর্মিষ্ঠা রহমানের অভিনয় সে সময় আলোচনায় আসে। কোনো এক নাট্যসমালোচক শর্মিষ্ঠা রহমানকে মঞ্চের অবাক সুন্দরী লিখলেও ঐ ‘অবাক সুন্দরী’কে পরবর্তী সময়ে আর মঞ্চে পাওয়া যায় নি। ‘দর্পণ’ নাটকের ৫২টি প্রদর্শনী হয়েছিল।
১৯৯১ সালেই ‘নাগরিক’ আতাউর রহমানের নির্দেশনায় মঞ্চে আনে সৈয়দ শামসুল হকের নিরীক্ষাধর্মী কাব্যনাটক ‘ঈর্ষা’। মাত্র ৩টি চরিত্র ও ৭টি সংলাপের দুই ঘন্টার অধিক ব্যাপ্তিকালের ঐ নাটকে তখন অভিনয় করেন জামালউদ্দিন হোসেন, সারা যাকের ও খালেদ খান। নাটকটি ঐ সময়ে বিজ্ঞমহলে ব্যাপক আলোচিত হয়। কলকাতার একাডেমী মঞ্চে নাটকটি দেখে নাট্যাচার্য শম্ভু মিত্র মহাশয় নিজে গ্রিনরুমে গিয়ে নির্দেশক ও অভিনেতা খালেদ খানের সঙ্গে কথা বলেন, নাটকটির বিশ্লেষণ ও প্রশংসা করেন। বর্তমান লেখক ঐ প্রযোজনাটির মঞ্চ ব্যবস্থাপক থাকায় সেটি দেখার সুযোগ ঘটেছিল। ‘ঈর্ষা’ নাটকের ৫২টি প্রদর্শনী হয়। এরপর ‘নাগরিক’ জামালউদ্দিন হোসেনের নির্দেশনায় ‘বনফুল’-এর ‘শ্রী মধুসূদন’ মঞ্চে আনে। ১৯৯৩ সালে সারা যাকের মঞ্চে আনে এরিয়েল উর্ফম্যানের সৈয়দ শামসুল হকের রূপান্তরিত নাটক ‘মুখোশ’। নাটকটিতে আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত ও নীমা রহমান অভিনয় করেন। নাটকটি দর্শকনন্দিত হয়ে ৪৮টি প্রদর্শনী হয়েছিল।
১৯৯৪ সালে আবুল হায়াত রবীন্দ্রনাথের ‘রথের রশি’ নাটকটি মঞ্চে আনেন। নাটকটিতে তখনকার ‘নাগরিক’-এর শুধুমাত্র তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করে যাদের অনেকে তখনই তারকা ছিল। বাকিরা পরবর্তী সময়ে তারকাখ্যাতি বা ভালো অভিনেতা, অভিনেত্রী ও নাট্যকার, নির্দেশক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। ঐ নাটকে যারা অভিনয় করে তাদের মধ্যে অন্যতম নূনা আফরোজ, বিপাশা হায়াত, নাতাশা হায়াত, শর্মিষ্ঠা রহমান, আফসানা মিমি, লাইসা আহমেদ লিসা, ঝন্টু বায়েন, হারুনুর রশীদ, মেজবাহ্ উর রহমান আর্থার, লুৎফর রহমান জর্জ, সুব্রত চন্দ ও বর্তমান লেখক। ঐ প্রযোজনাটি খুবই জৌলুশপূর্ণ ও মানসম্মত হওয়া সত্ত্বেও মাত্র ৬টি প্রদর্শনী হবার পর আর প্রদর্শনী হয় নি অথবা হতে দেয়া হয় নি। কারণটি তরুণ হিসেবে তখন যতটুকু আঁচ করেছিলাম সেটা হচ্ছে, দলের ভেতরে অগ্রজদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত।
১৯৯৬ সালে ব্রেখটের বিখ্যাত নাটক ‘মাদার কারেজ’ অবলম্বনে আবদুস সেলিমের অনুবাদ থেকে আতাউর রহমান মঞ্চে আনেন ‘হিম্মতি মা’। নাটকটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন নীমা রহমান। নাটকটির মাত্র ১৪টি প্রদর্শনী হয়েছিল। মূলত অভিনেত্রী নীমা রহমানের অসহযোগিতার কারণেই নাটকটি বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৯৭ সালে আন্তন চেকভ্-এর ‘সি গাল’ থেকে আলী যাকেরকৃত রূপান্তর ‘শঙ্খচিল’ মঞ্চে আনেন সারা যাকের। এই নাটকটিরও মাত্র ৬টি প্রদর্শনী হয়েছিল। কথা সাহিত্যিক নাসরিন জাহানের প্রথম নাটক ‘স্বপ্নবাজ’, ১৯৯৯ সালে খালেদ খানের নির্দেশনায় মঞ্চে আনে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’। নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘নিশি’র ভূমিকার অভিনয় করেন নূনা আফরোজ এবং আরও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন আতাউর রহমান ও খালেদ খান। মাত্র ২৪টি প্রদর্শনী হলেও নাটকটি দেশে-বিদেশে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ মঞ্চে আনেন আতাউর রহমান ২০০১ সালে। নাটকটির ‘রাজা’ চরিত্রে আলী যাকের দীর্ঘদিন মহড়া করলেও মঞ্চে যাবার মাত্র ছয়দিন পূর্বে নির্দেশক আতাউর রহমানের সঙ্গে অভিনয় পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নিয়ে মতবিরোধের কারণে নিজেকে প্রযোজনা থেকে বিযুক্ত করেন আলী যাকের। পরে ‘রাজা’ চরিত্রে স্বয়ং নির্দেশক অভিনয় করেন। নাটকটি দর্শকনন্দিত হয় এবং শতাধিক প্রদর্শনী হয়। নাটকটিতে ‘নন্দিনী’ চরিত্রে অপি করিম, বিশু চরিত্রে খালেদ খান, চন্দ্রা চরিত্রে শিরীন বকুল, ফাগুলাল চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জ অভিনয় করেন। উল্লেখ্য, অধ্যাপক চরিত্রে এই লেখক ‘বহুরূপী’র আমন্ত্রণে কলকাতার একাডেমীতে ৩৬ তম প্রদর্শনী পর্যন্ত অভিনয় করে।
২০০২ সালে বুদ্ধদেব বসু’র কাব্যনাটক ‘কালসন্ধ্যা’ মঞ্চে আনেন খালেদ খান। মাত্র ১৪টি প্রদর্শনী হলেও এরপর ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এর কাছ থেকে আর কোনো উল্লেখ করার মতো প্রযোজনা আমরা পাই নি। একটা নিষ্ক্রিয়তা বা ঝিমিয়ে পড়ার কাল দেখতে পাই দীর্ঘ সময় ধরে। এই লেখক দীর্ঘদিন ঐ দলে যুক্ত থাকার সুবাদে এর কারণ হিসেবে চারটি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। প্রথম কারণটি হচ্ছে মুলত ‘নাগরিক’-এর ভেতরের প্রধানতম সংগঠক অভিনেতা, নির্দেশক আসাদুজ্জামান নূরের রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়া। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, দীর্ঘদিন যাবত দলের অভ্যন্তরে চলে আসা আলী যাকের বনাম আতাউর রহমানের ব্যক্তিত্বেও সংঘাত। তৃতীয়ত; আলী যাকের, সারা যাকের উভয়ের ব্যবসায়িক ব্যস্ততা ও শেষের দিকে আলী যাকেরের শারীরিক অসুস্থতা। চতুর্থ কারণ, সর্বোপরি নতুন প্রজন্মকে সুযোগ না-দেয়ার মানসিকতা।
২০১৭ সালে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ ব্যাপক আড়ম্বর-আয়োজনে ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রী ও নির্দেশক ঊষা গাঙ্গুলীকে এনে সাদাত হোসেন মান্টোর গল্প থেকে ‘নাম গোত্রহীন মান্টোর মেয়েরা’ নামে একটি প্রযোজনা মঞ্চে আনলেও নিয়মিত প্রদর্শনী চালিয়ে যেতে পারে নি। প্রযোজনাটির মাত্র ৬টি প্রদর্শনী হয়েছে।
‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ প্রযোজিত আবদুস সেলিম অনূদিত এবং আতাউর রহমান নির্দেশিত ‘গ্যালিলিও’ নব্বইয়ের দশকের একটি অন্যতম সৃজনশীল ও সু-অভিনয়সমৃদ্ধ আলোচিত নাটক। নাটকটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আলী যাকের। এছাড়াও ঐ নাটকে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর, জামালউদ্দিন হোসেন, রওশন আরা হোসেন, লাকী ইনাম, খালেদ খান, সালেক খান, ফারুক আহমেদ, গোলাম সারোয়ার, কাওসার চৌধুরী, মাসুদুর রহমান, ঝন্টু বায়েনসহ অনেক গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রী। নাটকটি করতে সহযোগিতা করেছিল গ্যেটে ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ। ধানম-ি ২ নং রোডের তৎকালীন গ্যেটে ইনস্টিটিউট হল রুমে নাটকটির নিয়মিত প্রদর্শনী হতো। পরে অবশ্য মহিলা সমিতি মঞ্চেও নাটকটির প্রদর্শনী হয়।
দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৯ সালে নাটকটি পুনরায় মঞ্চে আনে পান্থ শাহরিয়ারের নির্দেশনায়। এবারও নাম ভূমিকায় আলী যাকেরই অভিনয় করেন। বলা যায় তাঁর উদ্যোগেই নাটকটি পুনঃমঞ্চায়ন হয়। এই পুনঃমঞ্চায়নে আসাদুজ্জামান নূর, কাওসার চৌধুরী ও ফারুক আহমেদ ছাড়া প্রায় সকল চরিত্রেই নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করেন। ফলে প্রযোজনাটিতে পুরনো অভিনেতাদের অভিনয়েই শুধু যেন তেজ আর জৌলুশ ফিরে পাওয়া গেছে। আতাউর রহমানের জীবনকালেই ‘নাগরিক’ থেকেই তাঁর নাটকের নব-নির্দেশকের উপস্থিতির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে নাট্যজনেরা।
১৯৯৫ সালে মূলত আমেরিকায় নাট্যসফর উপলক্ষ্য করে আলী যাকেরের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে সৈয়দ শামসুল হক রচিত ‘খাট্টা তামাশা’। ঐ সময় নাটকটির আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে ৯টি প্রদর্শনী হয়। নাটকটিতে অভিনয় করেন আলী যাকের, সারা যাকের, বিপাশা হায়াত, আফসানা মিমি, আসাদুজ্জামান নূর, খালেদ খান, বেলায়েত হোসেন মিরু, জাফর রহমান ও বর্তমান লেখক। আমেরিকার নাট্যভ্রমণ শেষ করে দেশে ফিরেও নাটকটির প্রদর্শনী অব্যাহত থাকে। নাটকটি জনপ্রিয় হয় এবং সর্বমোট ৫৯টি প্রদর্শনী হয়।
পথিকৃৎ নাট্যদলগুলোর অন্যতম ‘ঢাকা থিয়েটার’। দলটির নব্বইয়ের দশকের আলোচিত নাটক সেলিম আল দীন রচিত ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত ‘হাত হদাই’, যদিও নাটকটি মঞ্চে আসে ১৯৮৯ সালে। রচনা ও নির্দেশনার মুন্সিয়ানাসহ অভিনয়সমৃদ্ধ টিমওয়ার্কের কারণে নাটকটি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়। নাটকটির ৭৯টি প্রদর্শনী হয়েছিল। নাটকটির দু’টি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন রাইসুল ইসলাম আসাদ ও শিমূল ইউসুফ। এছাড়াও অভিনয় করেন শহীদুজ্জামান সেলিম, কামাল বায়োজিদ, ফারুক আহমেদ, শতদল বড়–য়া, শুভাশিস ভৌমিক, কৌশিক সাহা, সাইফুদ্দিন দুলাল, সাবেরী আলম, শমী কায়সার, রোজী সিদ্দিকী, নাসরিন নাহার, খাইরুল ইসলাম পাখী, ইব্রাহিম বিদ্যুৎ প্রমূখ।
১৯৯১ সালে ‘ঢাকা থিয়েটার’ মঞ্চে আনে সেলিম আল দীন রচিত ‘চাকা’। নির্দেশনায় নাসির উদ্দিন ইউসুফ। নাটকটির ৩৭টি প্রদর্শনী হয়। এই নাটকেরও কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন রাইসুল ইসলাম আসাদ ও শিমূল ইউসুফ। একই বছর হুমায়ুন ফরিদী মঞ্চে আনেন ‘ভূত’ নামে একটি নাটক। একটি মাড়াঠি গল্প থেকে নাট্যরূপ দেন তারিক আনাম খান। নাটকটির ৪১টি প্রদর্শনী হয়। সকল চরিত্রের মুখে মুখোশের ব্যবহার সম্ভবত ঢাকার মঞ্চে ঐ নাটকেই প্রথম। নাটকটি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায় নি কিন্তু নাট্যজন ও নাট্যকর্মীদের মধ্যে আলোচিত হয়।
‘এবার শেখার পালা’ নামে একটি নাটক মঞ্চে আসে হুমায়ুন কবীর হিমু’র নির্দেশনায়। এর ৫৬টি প্রদর্শনী হয়। ‘একটি মারমা রূপকথা’ সেলিম আল দীনের রচনা ও নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ১৯৯৩ সালে। নাটকটির ১৯টি প্রদর্শনী হয়। নাসির উদ্দিন ইউসুফের রচনা ও নির্দেশনায় ‘একাত্তরের পালা’ নাটকটি মঞ্চে আসে ১৯৯৩ সালেই। ঐ নাটকটির ৭৪টি প্রদর্শনী হয়। সেলিম আল দীনের রচনা ও নাসির উদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনায় নব্বইয়ের দশকের আরও একটি আলোচিত নাটক ‘যৈবতী কন্যার মন’ মঞ্চে আসে ১৯৯৩ সালেই। ঐ একই বছর পরপর তিনটি নাটক মঞ্চে এলেও সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে ‘যৈবতী কন্যার মন’, মূলত রচনারীতি, অভিনয় ও প্রয়োগকৌশলের কারণে। নাটকটির ৪০টি প্রদর্শনী হয়।
১৯৯৩ তে একই বছর তিনটি প্রযোজনা এবং তারপরই তিন বছরের নীরবতা বা আলস্য লক্ষ করা যায়। ১৯৯৭ সালে ‘ঢাকা থিয়েটার’ মঞ্চে আনলো শেক্সপীয়রের নাটক ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’। সুবর্ণা মুস্তাফার অনুবাদ ও নির্দেশনায় নাটকটির প্রদর্শনী হয়েছিল ৩৬টি। ১৯৯৮ সালে ‘ঢাকা থিয়েটার’ যেন আবার স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল হলো সেলিম আল দীন রচিত ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত ‘বনপাংশুল’ নাটকটি মঞ্চে আনার মধ্য দিয়ে। মাত্র ৪৮টি প্রদর্শনী হলেও নাটকটি বেশ দর্শকনন্দিত হয়েছিল। ঐ প্রযোজনার পর ‘ঢাকা থিয়েটার’ যে আবারও আলস্যে আক্রান্ত হয় তা তাদের কাজের খতিয়ানই বলে দেবে। এই সময় থেকেই আলস্য, ধীরগতি বা সৃজনশীলতার সংকট, যাই বলি না কেনো, ‘ঢাকা থিয়েটার’কে পেয়ে বসে। ‘বনপাংশুল’-এর পর ‘ঢাকা থিয়েটার’ পর্যায়ক্রমে মঞ্চে আনে প্রবীর গুহ রচিত ও নির্দেশিত ‘মৃত্যু সংবাদ’। প্রদর্শনী হয় ৬টি। সেলিম আল দীন রচিত ও হুমায়ুন কবীর হিমু নির্দেশিত ‘হরগজ’। প্রদর্শনী হয় ৩টি। নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত ও সেলিম আল দীন রচিত ‘প্রাচ্য’ (২০০০)। প্রদর্শনী হয় ১৮টি। সাইমন জাকারিয়া রচিত ও সাইদুর রহমান লিপন নির্দেশিত ‘ন-নৈরামণি’ (২০০২)। প্রদর্শনী হয় মাত্র ১টি।
শিমূল ইউসুফ নির্দেশিত, সেলিম আল দীন রচিত ‘ধাবমান’ নাটকটি মঞ্চে আসে ২০০৯ সালের ২০ জুলাই। এ পর্যন্ত নাটকটির ৫৮টি প্রদর্শনী হয়েছে। নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত শেক্সপীয়রের ‘টেম্পেস্ট’ নাটকটি মঞ্চে আসে ২০১২ সালের ২৭ এপ্রিল। নাটকটির ১৪টি প্রদর্শনী হয়েছে।
‘থিয়েটার’ (নাটক সরণি) চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা আবদুল্লাহ আল-মামুনের নেতৃত্বে সব সময়ই সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক নানা সমস্যা, সংকট ও মূল্যবোধ নিয়ে নাটক করেছে। তাঁদেরও বেশ কিছু নাটক নব্বইয়ের দশক ও পরবর্তী সময়ে দর্শকপ্রিয় হয়েছিল। ‘থিয়েটার’-এর ৫টি প্রযোজনা শতাধিক প্রদর্শনী করে। নাটকগুলো হচ্ছে- ‘দুইবোন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘তোমরাই’, ‘এখনও ক্রীতদাস’ ও ‘মেরাজ ফকিরের মা’। ১৯৯১ সালে দলটি মঞ্চে আনে আবদুল্লাহ আল-মামুন রচিত ও নির্দেশিত ‘দ্যাশের মানুষ’। প্রদর্শনী হয় ৩২টি। এরপর থেকে ‘থিয়েটার’ যতগুলো নাটক মঞ্চে আনে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ‘আন্তেগোনে’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’ ও ‘মুক্তি’। জাঁ আনুই-এর মূল নাটক থেকে ‘আন্তেগোনে’ নাটকের অনুবাদ ও নির্দেশনা দেন খায়রুল আলম সবুজ। প্রদর্শনী হয় ১৩টি। তারপরই ‘থিয়েটার’ দলটি বিভক্তির মধ্যে পড়ে যায়। নাটকটির কেন্দ্রীয় দু’টি চরিত্রে অভিনয় করে ত্রপা মজুমদার ও খায়রুল আলম সবুজ। মাত্র ১৩টি প্রদর্শনী হলেও ঐ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমেই ত্রপা মজুমদার নাট্যজন, নাট্যকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। প্রযোজনাটি দর্শক-নাট্যজনের কাছে ‘থিয়েটার ঘরানার’ বাইরের ভিন্ন স্বাদের একটি প্রযোজনা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এছাড়াও আবদুল্লাহ আল-মামুন রচিত নির্দেশিত ‘স্পর্ধা’ মঞ্চে আনে ১৯৯৩ সালে। প্রদর্শনী হয় ৫০টি। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস নিয়ে আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাট্যরূপ ও ফেরদৌসী মজুমদারের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’। ১৯৯৪ সালে। প্রদর্শনী হয় ১৫টি। ফেরদৌসী মজুমদারের নির্দেশনায় অগ্রজ মুনীর চৌধুরীর ‘চিঠি’ মঞ্চে আসে ১৯৯৫ সালে। আবদুল্লাহ আল-মামুন রচিত ও ফেরদৌসী মজুমদার নির্দেশিত ‘মেহেরজান আরেকবার’ মঞ্চে আসে ১৯৯৭ সালে। প্রদর্শনী হয় ২৯টি। এরপর ‘থিয়েটার’ জগলুল আলম রচিত ‘ছয় বেহাবার পালকি’ মঞ্চে আনে মারুফ কবীরের নির্দেশনায়, ২০০০ সালে। প্রদর্শনী হয় ১৯টি। তারপর রামেন্দু মজুমদারের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ‘মাধবী। প্রদর্শনী হয় ১৮টি। ভীষ্ম সাহনীর মূল নাটক থেকে ‘মাধবী’ নাটকের অনুবাদ করেন আশিষ গোস্বামী।
‘থিয়েটার’ (নাটক সরণি)-এর প্রযোজনাক্রমপর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে যে ‘আন্তেগোনে’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’, ‘মুক্তি’ ছাড়া অন্যান্য প্রযোজনাগুলো দর্শক-সমালোচক-নাট্যজনের তেমনভাবে দাগ কাটতে পারে নি এবং সেকারণেই তেমনভাবে আলোচনায়ও আসে নি। ‘মুক্তি’ নাটকের পরও দলটি রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ (নির্দেশনা: নায়লা আজাদ নুপুর), পান্থ শাহরিয়ারের ‘বারামখানা’ (নির্দেশনা: ত্রপা মজুমদার) ও মারুফ কবীরের রচনা-নির্দেশনায় ‘মায়া নদী’সহ আরো কিছু নাটক মঞ্চে আনলেও সেই নাটকগুলোও তেমন একটা আলোচনায় আসে নি।
পুরনো দলগুলোর মধ্যে ‘নাট্যচক্র’ আশির দশকের (১৯৮৩) ‘ভদ্দরনোক’ এবং ‘চক সার্কেল’ (১৯৮৬)-এর পর নব্বইয়ের দশকে কোনো প্রযোজনাই তেমন আলোচনায় উঠে আসে নি। ১৯৯৩ সালে গোলাম সারোয়ার নির্দেশিত ‘কমেডি অন ট্রায়াল’ থেকে শুরু করে ২০০৪ সালে জুনায়েদ ইউসুফের নির্দেশনায় রবীন্দ্রনাথের ‘ব্যঙ্গ কৌতুক’ ও ‘হাস্য কৌতুক’ মঞ্চে আনা পর্যন্ত সর্বমোট ১১টি প্রযোজনা মঞ্চে এলেও কোনো প্রযোজনাই দর্শক-সমালোচকের আলোচনায় উঠে আসে নি। এবং তারপর এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দলটিকে প্রায় নিষ্ক্রিয়ই দেখা গেছে বলা যায়। অতিসম্প্রতি ২০১৯ সালে তনিমা হামিদের একক অভিনীত ‘একা এক নারী’ মঞ্চে এনেছে দেবপ্রসাদ দেবনাথের নির্দেশনায়।
ঢাকার নাট্যচচর্চায় পুরনো পথিকৃৎ নাট্যদলগুলোর মধ্যে ‘আরণ্যক নাট্যদল’ অন্যতম। ১৯৯১ সালে ‘আরণ্যক’ তখনকার বিশ্বরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে মান্নান হীরা রচিত ‘খেলা খেলা’ নাটকটি মঞ্চে আনে শাহ্ আলম দুলালের নির্দেশনায়। এরপর পর্যায়ক্রমে মামুনুর রশীদের রচনা ও আজিজুল হাকিমের নির্দেশনায় ‘পাথর’ (১৯৯২), মান্নান হীরা রচিত ও আজাদ আবুল কালাম নির্দেশিত ‘আগুনমুখা’ (১৯৯৪), মামুনুর রশীদ রচিত ও নির্দেশিত ‘জয়জয়ন্তী’ (১৯৯৫), আব্দুল্লাহেল মাহমুদ রচিত ও মামুনুর রশীদ নির্দেশিত ‘প্রাকৃতজন কথা’ (১৯৯৭), মান্নান হীরা রচিত ও শাহ্ আলম দুলাল নির্দেশিত ‘ময়ূর সিংহাসন’ (১৯৯৯) এবং মামুনুর রশীদ রচিত ও নির্দেশিত ‘সঙক্রান্তি’ (২০০১) ও ‘রাঢ়াঙ’ (২০০৪) নাটক মঞ্চে আনে।
উপরে ‘আরণ্যক নাট্যদলে’র যে প্রযোজনা-তালিকা উল্লেখ করেছি তার মধ্যে ‘জয়জয়ন্তী’, ‘ময়ূর সিংহাসন’, ‘সঙক্রান্তি’ ও ‘রাঢ়াঙ’ এই চারটি প্রযোজনা সবচেয়ে বেশি প্রদর্শিত, দর্শকনন্দিত এবং আলোচিত। গত তিন দশকে অন্যান্য পুরনো দলগুলোর মতো না-হলেও ‘আরণ্যক’কেও যেন কখনো কখনো সৃজনশীলতার সংকটে ভুগতে দেখা যায়। আমরা লক্ষ করবো ‘রাঢ়াঙ’ নাটকের পর একটা দীর্ঘ সময়, বলা যায় বর্তমান সময় পর্যন্ত ‘আরণ্যক’ যেন খানিকটা আলস্য ও মন্থর গতিতেই চলছে। অনেকদিন ধরে দলটির কাছে আলোচ্য চারটি নাটকের মতো প্রযোজনা পাই নি। এমনকি মান্নান হীরা রচিত ও মামুনুর রশীদ নির্দেশিত ও নাম ভূমিকায় অভিনীত ‘এবং বিদ্যাসাগর’ নাটকটি দর্শক-নাট্যজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও নাটটির বেশি প্রদর্শনী হয় নি।
থিয়েটারে পেশাদারিত্বের ভাবনা থেকে ঢাকায় রেপাটরি থিয়েটারের সূচনা করেন মামুনুর রশীদ। তাঁর ‘বাঙলা থিয়েটার’ তৈরির মধ্য দিয়ে, ১৯৯১ সালে। ‘বাঙলা থিয়েটার’-এর প্রথম প্রযোজনা মামুনুর রশীদ রচিত ‘মানুষ’। মঞ্চ-আলো-নির্দেশনা ফয়েজ জহির। ঐ নাটকে অভিনয় করেন আজিজুল হাকিম, ফজলুর রহমান বাবু, মামুনুর রশীদ, আজাদ আবুল কালাম, ডলি জহুর, মান্নান হীরা ও সৈয়দ মোশাররফ। নাটকটি দর্শকপ্রিয়তা পায় এবং দেড়শতাধিক প্রদর্শনী হয়।
‘বাঙলা থিয়েটার’ আরেকটি প্রযোজনা ‘লেবেদেফ’। রচনা ও নির্দেশনার কাজটি করেন মামুনুর রশীদ। অভিনয় করেন হারুন অর রশীদ, মলয় ভৌমিক, আজাদ আবুল কালাম, ফয়েজ জহির, শিরীন বকুলসহ আরো অনেকেই। নাটকটির ২৬টি প্রদর্শনী হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ‘বাঙলা থিয়েটার’ নব্বইয়ের দশকে প্রযোজনা করে ‘আদিম’, রচনা মামুনুর রশীদ, নির্দেশনা আজাদ আবুল কালাম। অভিনয় করেন বিপাশা হায়াত, আজিজুল হাকিম, ফজলুর রহমান বাবু, তৌকীর আহমেদ, মামুনুর রশীদ ও আজাদ আবুল কালাম। এ নাটকের প্রদর্শনী হয় ২৭টি।
২০০৪ সালে ‘বাঙলা থিয়েটার’ মঞ্চে আনে মামুনুর রশীদ রচিত ‘চে’র সাইকেল’। অভিনয় করেন মামুনুর রশীদ, চঞ্চল চৌধুরী ও রুবলী চৌধুরী। নাটকটির মঞ্চ, পোশাক, আলো এবং নির্দেশনার কাজটি করেন ফয়েজ জহির। ‘চে’র সাইকেল’ নাটকটি দর্শকনন্দিত হয় এবং শতাধিক প্রদর্শনী হয়। ‘বাঙলা থিয়েটার’-এর সর্বশেষ এবং চলতি প্রযোজনা মামুনুর রশীদ রচিত ও নির্দেশিত ‘অমানুষ’।
গাজী রাকায়েত, আফসানা মিমি’র উদ্যোগে নব্বইয়ের দশকে গঠিত হয় রেপাটরি দল ‘নন্দন’। ১৯৯৪ সালে গাজী রাকায়েতের নির্দেশনায় ‘নন্দন’ মঞ্চে আনে বিজয় টেণ্ডুলকারের নাটক ‘কন্যাদান’। ঐ প্রযোজনায় অভিনয় করেন- গাজী রাকায়েত, আফসানা মিমি, আশীষ খন্দকার, আজাদ আবুল কালাম, এজাজ মুন্না, শিরীন বকুল ও টুটুল আহমেদ। নাটকটির মঞ্চ পরিকল্পনা করেন তৌকীর আহমেদ ও আলোর কাজ করেন নাসিরুল হক খোকন। ১২টি প্রদর্শনীর পর আশীষ খন্দকারের চরিত্রটিতে তৌকীর আহমেদ অভিনয় করেন। নাটকটির মোট ২৬টি প্রদর্শনী হয়। প্রযোজনাটি নব্বইয়ের দশকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশেষ করে ঐ প্রযোজনাটিতে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা সকলেই তখন ঢাকার উল্লেখযোগ্য দলগুলোর সাথে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন দলে যুক্ত থেকেও একত্রিত হয়ে আলাদাভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে ঐ প্রযোজনাটি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বলতে হবে।
‘থিয়েটারওয়ালা’ পত্রিকার সম্পাদকম-লী ‘থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’ নামে একটি রেপাটরি থিয়েটার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন ২০০৯ সালে। ২০১০ সালে দলটি মঞ্চে আনে শাহ্যাদ ফিরদাউস-এর উপন্যাস থেকে হাসান শাহরিয়ারকৃত নাটক ‘শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস’। নাটকটি নির্দেশনা দেন আজাদ আবুল কালাম। মঞ্চ: শাহীনুর রহমান, আলো: ফয়েজ জহির, সংগীত: অসিত কুমার, পোশাক: তৌফিকুল ইসলাম ইমন এবং নাটকটিতে অভিনয় করেন: আজাদ আবুল কালাম, হাসান শাহরিয়ার, তৌফিকুল ইসলাম ইমন, ঋতু সাত্তার (/তমালিকা কর্মকার) ও দীপক সুমন (/মোহাম্মদ বারী/তপন মজুমদার)। নাটকটির মোট ৫৪টি প্রদর্শনী হয়। এরপর একটা দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ‘থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’ ২০১৭ সালে আন্তন চেকভের ‘দ্য বিয়ার’ অবলম্বনে সাইফ সুমনের রূপান্তর ও নির্দেশনায় মঞ্চে আনে ‘জবর আজব ভালোবাসা’। মঞ্চ করেন আরিফ শাকিল, আলোর কাজ করেন অম্লান বিশ্বাস, সংগীত ও মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন রামিজ রাজু। এছাড়াও অভিনয় করেন সংগীতা চৌধুরী, রিয়াজ আহমেদ প্রথমে ও পরে একই চরিত্রে সাইফ সুমন। মোট প্রদর্শনী হয় ২৬টি।
২০১০ সালে ‘নাট্যম রেপার্টরী’ নামে আরও একটি দল সংগঠিত হয়। মুখ্য ভূমিকায় যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন আইরিন পারভীন লোপা, জুনায়েদ ইউসুফ, শিশির রহমান, সাইদুর রহমান লিপন ও উপদেশক ছিলেন গোলাম সারোয়ার। ২০১০ সালে ‘নাট্যম রেপার্টরী’ মঞ্চে আনে সাধনা আহমেদের রচনা ও আইরিন পারভীন লোপা নির্দেশিত ‘দমের মাদার’। নাট্যম রেপার্টরী ২০১০ থেকে পর্যায়ক্রমে ‘সাইকেলওয়ালা’, ‘প্রলম্বিত প্রহর’ ও ‘ডিয়ার লায়ার’ নাটকের পাঠ-অভিনয় করলেও মূলত ‘দমের মাদার’ নাটকটিই দর্শকপ্রিয়তা পায় এবং ৫১টি প্রদর্শনী হয়। এই নাটকে মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা করেন জুনায়েদ ইউসুফ এবং সংগীত পরিকল্পনা ও প্রয়োগের কাজটি করেন শিশির রহমান।
‘আরণ্যক নাট্যদলে’র অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরীর পরিকল্পনায় ও নেতৃত্বে ২০১১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা দিবসে পথ চলা শুরু করে ‘শূন্যন’। এবং ঐ বছরেই ১৯ মে মান্নান হীরা’র রচনা ও সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় মঞ্চে আনে ‘লাল জমিন’। নাটকটি জনপ্রিয় হয় এবং ২০১৯-এর এপ্রিল পর্যন্ত ২০৫টি প্রদর্শনী করেছে। এ পর্যন্ত রেপাটরি প্রক্রিয়ায় যত প্রযোজনা হয়েছে তার মধ্যে ‘শূন্যন’ প্রযোজিত ‘লাল জমিন’ সর্বাধিক প্রদর্শিত নাটক। ‘লাল জমিন’ দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কোরিয়া, কানাডা ও ভারতে প্রদর্শনী করেছে। এছাড়াও নাটকটি দেশের ভেতরে ৪৮টি জেলা, ২৫টি উপজেলা এবং ২২টি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শনী করেছে। এই প্রযোজনাটি একটি বড় সরকারি অনুদান লাভ করে এবং নাটকটির ২০৫ তম প্রদর্শনীটি হয় বঙ্গভবনে।নাট্যনির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ ষোল বছর নির্দেশনার কাজ থেকে দূরে থাকার পর ২০১৭ সালে ‘নাটবাঙলা’ (রেপাটরি) দল থেকে ‘রিজওয়ান’ নাটকের নির্দেশনা দেন। শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হলে ঈদের দিনসহ পর পর ১০ দিনে ১৯টি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। এর পর নাটকটির আর কোনো প্রদর্শনী করা হবে না, এমন একটি ঘোষণা ‘নাটবাঙলা’র পক্ষ থেকে আগাম দেয়া হয়েছিল। নাটকটি দর্শক আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ‘নাটবাঙলা’র উদ্যোগ গ্রহণ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেলিম মোজাহার।
একবছর বিরতির পর সৈয়দ জামিল আহমেদ মঞ্চে আনেন শহীদুল জহিরের উপন্যাস নিয়ে নাটক ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’। এটি ‘স্পর্ধা’ নামের একটি রেপাটরি থিয়েটার প্রযোজনা। ‘স্পর্ধা’ একটি ‘স্থায়ী বীজ দল’ দ্বারা পরিচালিত। উপদেষ্টা: সৈয়দ জামিল আহমেদ, সদস্য: মহসিনা আক্তার, মো. সাইফুল ইসলাম মণ্ডল, মোঃ সোহেল রানা এবং মোঃ আব্দুর রাহীম খান। নাটকটি জাতীয় নাট্যশালায় পর পর সাতদিন দু’টো করে প্রদর্শনী হয়। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এরপর আর প্রদর্শনী করার কথা না থাকলেও আরও তিন দিনে প্রতিদিন দু’টি করে ছয়টি অতিরিক্ত প্রদর্শনী করা হয়। ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নাটকটি ‘রিজওয়ান’ নাটকটির মতো দর্শকপ্রিয়তা পায় নি। তার কারণ হতে পারে প্রথম প্রদর্শনীর পর নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার ও নাট্যজন আতাউর রহমানের নেতিবাচক বক্তব্যে নাটকটিতে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রচার হলে নাট্যজন ও দর্শকের মধ্যে বিতর্কের জন্ম নেয়। এছাড়াও টিকিটের উচ্চমূল্যের (একহাজার, পাঁচশত ও তিনশত) কারণেও অনেক নাট্যজন নাটকটি দেখতে পারেন নি।
২০১৩ সালের ৩০ চৈত্র পান্থ শাহরিয়ার, ঝন্টু বায়েন, ফারুকুজ্জামান, ত্রপা মজুমদার, সাজু খাদেম, তাহনিনা ইসলাম ঝুমু ও অস্লান বিশ্বাসের ভাবনা ও পরিকল্পনায় গঠিত হয় ‘আগন্তুক’ (রেপাটরি)। অন্য সবগুলো রেপাটরি গঠিত হবার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের সঙ্গে ‘আগন্তুক’-এর সংগঠিত হবার প্রক্রিয়ায় ভাবনার দৃষ্টিকোণ থেকে একটি স্বাতন্ত্র্য লক্ষ করা যায়। অন্য রেপাটরিগুলো তৈরি হয়েছে থিয়েটারে পেশাদারিত্ব আনার লক্ষ্য নিয়ে, আর ‘আগন্তুক’ গঠিত হয় বিভিন্ন দলের মানুষ যাতে একসঙ্গে একটি ব্যানারে কাজ করতে পারে সেই লক্ষ্য নিয়ে। থিয়েটার করে টাকা নেয়া নয়- প্রয়োজনে থিয়েটারের জন্য সবাই যার যার মতো করে অর্থ দেবে, এই মনোভাব নিয়ে সংগঠিত হয় ‘আগন্তুক’। যদিও তাঁরা এটাকে রেপাটরি দলই আখ্যা দিচ্ছে। প্রথম প্রযোজনা হিসেবে দলটি মঞ্চে আনে পান্থ শাহরিয়ারের রচনা ও নির্দেশনায় ‘অন্ধকারের মিথেন’। নাটকটির ৩০টি প্রদর্শনী হয়। নাটকটিতে অভিনয় করেন ত্রপা মজুমদার, পান্থ শাহরিয়ার, ফয়েজ জহির, ফারুকুজ্জামান ও জাহাঙ্গীর আলম।
দ্বিতীয় প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে আসে ‘ম্যাকবেথ’ অবলম্বনে পান্থ শাহরিয়ার রচিত ও নির্দেশিত নাটক ‘ধলেশ্বরী অপেরা’। এই লেখা পর্যন্ত নাটকটির ১০টি প্রদর্শনী হয়েছে। নাটকটিতে অভিনয় করেন পান্থ শাহরিয়ার, ত্রপা মজুমদার, শতাব্দী ওয়াদুদ, জাহাঙ্গীর আলম প্রমূখ। ‘আগন্তুক’-এর দু’টি প্রযোজনারই মঞ্চ পরিকল্পনা করেন ফয়েজ জহির।
রেজা আরিফের ভাবনা-পরিকল্পনার সাথে পার্থ প্রতিম, তানভীর আহমেদ সিডনি, খোরশেদ আলম এবং মৃন্ময়ীর প্রচেষ্টায় তৈরি হয় ‘আরশীনগর’। থিয়েটারে পেশাদারিত্বের মতো বড় বড় কথা নয়, মূলত থিয়েটারের জন্য কাজ করবে এমন লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে ‘আরশীনগর’ সংগঠিত হয় ২ নভেম্বর ২০১২ সালে। রেপাটরির চেয়ে গ্রুপ থিয়েটারের কর্মপ্রক্রিয়া বা আদর্শকেই তাঁরা অধিক গ্রহণযোগ্য এবং অনুসরণীয় মনে করেন। ২০১৩ সালের ৫ জুলাই ‘আরশীনগর’ শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘সেই রাতে পূর্ণিমা ছিল’ মঞ্চে আনে। নাটকটি দর্শক-নাট্যজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নাটকটির ৩৭ তম প্রদর্শনীকে এককালীন শেষ প্রদর্শনী ঘোষণা করে দলটি। দ্বিতীয় প্রযোজনা হিসেবে অভিজিৎ সেনের উপন্যাস ‘রহু চ-ালের হাড়’ মঞ্চে আনে ২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর। দু’টি প্রযোজনারই নির্দেশনা দেন রেজা আরিফ। ‘রহু চ-ালের হাড়’ নাটকের ১১টি প্রদর্শনী হয় এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত।
বাংলাদেশের নাট্যজনেরা ও নাট্যশিক্ষার্থীরা ভারতের দিল্লিতে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা (এনএসডি)তে এবং কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকের উপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশের থিয়েটারে নির্দেশনা ও থিয়েটার ডিজাইনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সৈয়দ জামিল আহমেদ, কামালউদ্দিন নীলু, তারিক আনাম খান, অসীম দাশ। নব্বইয়ের দশকে এসেই আমরা লক্ষ করি নাটকের স্বল্প মেয়াদী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা আবদুল্লাহ আল-মামুনের পরিকল্পনায় ও উদ্যোগে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘থিয়েটার স্কুল’। তিনি এনএসডি এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস পর্যালোচনা করে ‘থিয়েটার স্কুল’-এর শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করেন। বর্তমানে ঐ প্রতিষ্ঠানের নাম ‘আবদুল্লাহ আল-মামুন থিয়েটার স্কুল’। তারপর তৈরি হয় ‘প্রাচ্যনাট স্কুল অফ অ্যাকটিং অ্যান্ড ডিজাইন’, যেখানে ছয়মাস মেয়াদী কোর্স করানো হয়। ‘প্রাচ্যনাট’ এই প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে আসছে বিগত ১৮ বছর যাবত। প্রতিষ্ঠানটি ২০০১ সালে যাত্রা শুরু করে এখন পর্যন্ত ৩৬টি ব্যাচের কোর্স সমাপ্ত করেছে।
২০০৫ সাল থেকে নাগরিক নাট্যাঙ্গন ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন ইনস্টিটিউট এন্ড ড্রামা’ (NNID) নামে একটি নাট্যশিক্ষার প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছে। সেখান ছ’মাসের নাট্যবিষয়ক কোর্স করানো হয়। আলোচিত সময়কালে ২৪টি ব্যাচের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হয়েছে এবং ২৪টি নাট্যপ্রযোজনা তৈরি হয়েছে।
‘বটতলা অ্যাক্টর’স স্টুডিও’তে ছয় মাসের কোর্স করানো হয়। এখন পর্যন্ত তারা ৫টি ব্যাচের কোর্সের কার্যক্রম শেষ করেছে। নতুন অভিনয় শিল্পী বা নাট্যকর্মী বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু প্রশিক্ষণই দিচ্ছে না প্রযোজনাও করেছে বেশ কিছু ভালো নাটক। প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন নাট্যদলে নাট্যকর্মী যোগানও দিচ্ছে।
গত শতকের নব্বই দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অনেক নাট্যদলের এত এত কাজের বিবরণ এই লেখায় যুক্ত করলাম, তার কারণ, গত তিন দশকের এই বিবরণের মধ্যেই পরিষ্কার যে আমাদের ঢাকার থিয়েটার চর্চায় নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যাঁরা বা যেসব দল চালকের আসনে ছিলেন, সেই অবস্থাটি এখন আর নেই। গাড়ি চলছে কিন্তু চালক বদলে গেছে। ধীরে ধীরে, সংগতকারণেই, সবার অজান্তেই। একথা এখন দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায় যে, ঢাকার থিয়েটারে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে যুক্ত হওয়া প্রজন্মই এখন কর্মব্যস্ততা, দক্ষতা আর সৃজনশীলতায় ঢাকার থিয়েটারকে ঋদ্ধ করে চলেছে। তারাই সবার শীর্ষে, তারাই এখন ঢাকার থিয়েটারে চালকের আসনে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে নাটকের প্রদর্শনী হতো শুধুমাত্র বেইলি রোডের সর্বোচ্চ তিন’শ আসনের মহিলা সমিতি ও গাইড হাউজ মঞ্চে।এখন প্রতি সন্ধ্যায় শুধুমাত্র শিল্পকলা একাডেমিতেই ৭৫০ আসন বিশিষ্ট জাতীয় নাট্যশালাসহ আরও দু’টি হলে এবং নতুন করে গড়ে ওঠা পুরাতন মহিলা সমিতি মঞ্চে নাটকের প্রদর্শনী হয়ে থাকে। নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় নাট্যচর্চায় যুক্ত ছিল পথিকৃৎ ৫/৬টি দল ও ছোট-বড় মিলিয়ে ২০ থেকে ২২টি দল। এখন ঢাকায় নাট্যচর্চায় যুক্ত আছে শতাধিক দল, যার মধ্যে শুধুমাত্র গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনভুক্ত দলের সংখ্যাই ৭০টি। এখন ৪টি হলে নাটক মঞ্চায়ন সত্বেও বছর জুড়েই আছে হলের জন্য হাহাকার। অনেক দলের জন্য একটি হল বরাদ্দ পাওয়া যেন আকাশের চাঁদ পাওয়া। নব্বইয়ের দশকে, আগেই উল্লেখ করেছি, নিয়মিত নাটক করে এমন পথিকৃৎ অনেক দলই মহিলা সমিতি ও গাইড হাউজে ৩/৪টি বা চাইলে তারও বেশি হল বরাদ্দ নিয়ে প্রদর্শনী করতে পারতো। বর্তমান চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখন যত সক্রিয় বা সক্ষম দলই হোক না কেনো, হল বরাদ্দ মাসে একটি বা খুব ব্যতিক্রম হলে দু’টি। তার মানে হচ্ছে সক্ষমতা থাকলেও সক্ষম দলগুলোর প্রদর্শনী সংখ্যা বাড়াবার কোনো সুযোগ নেই। এখন ঢাকায় এমন বেশ কয়েটি সক্রিয় ও সক্ষম দল আছে যেগুলোর ৪টি, ৫টি বা ৬টি এমনকি কোনো কোনো দলের ১০/১২টি প্রযোজনা চলমান, অথচ প্রদর্শনী বাড়াবার সুযোগ একেবারেই নেই। সক্ষম দলগুলোর জন্য যেটা একটা বড় সংকট।
আরও একটি বিষয় একটু বিশ্লেষণ দরকার। ঢাকায় এখন ৪টি হলে, প্রতি সন্ধ্যায় প্রদর্শনী হ’লে প্রতি মাসে মোট প্রদর্শনীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২০টি। যেহেতু মহিলা সমিতি মঞ্চে এখনও মাসে ৩০ দিন প্রদর্শনী হয় না, আবার শিল্পকলা একাডেমিতেও বরাদ্দ পাওয়া দলগুলো নানান কারণে একেবারে শেষ মুহূর্তে হল ছেড়ে দেয়, তাই আমরা যদি মোটের উপর ধরে নিই প্রতি মাসে ঢাকায় ন্যূনতম ১০০টি প্রদর্শনী হয়, তাহলে সেটা নব্বইয়ের দশকের তুলনায় কতগুণ বেশি? ভেবে দেখা দরকার।
এখন খুঁজে দেখা যাক, প্রতি মাসে যে ১০০টি করে নাটক হচ্ছে তার মধ্যে পথিকৃৎ নাট্যদলগুলোর নাটক কয়টি। খুব বেশি হলে ৫টি কী ৬টি। হল বরাদ্দের নীতির কারণেই এর বেশি হবার সুযোগ নেই। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, প্রতি মাসের বাকি ৯৫টি নাটকই গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এবং এর পরে ঢাকার থিয়েটারে সৃষ্টি হওয়া নাট্যদলগুলোর। আরও সত্য এই, নব্বইয়ের দশকে এবং তার পরে থিয়েটারে যুক্ত হওয়া নাট্যনির্দেশক ও নাট্যদলগুলোর নাটকেই এখন মিলনায়তনপূর্ণ দর্শক হচ্ছে। দর্শক টিকিট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। ঢাকার থিয়েটারে যুক্ত হওয়া ১০০ দলের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়তো ঘটছে না কিন্তু যে সব দল বা নাট্যনির্দেশকের ক্ষেত্রে ঘটছে তার সংখ্যাও কম নয়। তাই আমি যুক্তিযুক্তভাবেই মনে করি, প্রকৃত অর্থেই ‘থিয়েটারওয়ালা’র সমসময়ে ঢাকার থিয়েটারের চালকের আসনে বসেছে তাঁরাই, যাঁরা নব্বইয়ের দশকে ও তার পরে থিয়েটারে যুক্ত হয়েছে। অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্বেও যাঁরা আমাদের থিয়েটারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং যাবেই।
গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটারের দিকে তাকালে দেখা যাবে পুরনো দলগুলোর অধিকাংশই চরমভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। বিপরীতে নতুন দলগুলো তুমুলভাবে তাদের সৃজনশীল ধারা বইয়ে দিচ্ছে। সেই তালিকার নাট্যদলগুলোর মধ্যে অন্যতম- ‘প্রাঙ্গণেমোর’, ‘প্রাচ্যনাট’, ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’, ‘দেশ নাটক’, ‘সুবচন নাট্য সংসদ’, ‘পালাকার’ ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’ অন্যতম।
লেখাটি শেষ করবার আগে বিনীতভাবে জানাতে চাই আমি শুধু ‘ঢাকার থিয়েটারে’র পালাবদল নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছি। সারা দেশের থিয়েটার নয়। আরেকটি কথাও বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি, এই লেখায় অনেক দলের কথা উল্লেখ করা হয় নি বা অনেক দলেরই অনেক প্রযোজনার কথাও উল্লেখ করা হয় নি। সেই সব দল বা দলকর্তাদের কাছে আমার জানাবার অভিপ্রায় এই, এই লেখায় শুধুমাত্র যে দলগুলো বা প্রযোজনাগুলো গত তিন দশকের থিয়েটার চর্চায় নাট্যজন-নাট্যকর্মী-দর্শকের মনে দাগ কাটতে পেরেছে, সেগুলোর কথাই উল্লেখ করতে চেয়েছি। তথাপি এ লেখাও কোনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন নয়। নিতান্তই এক নাট্যজনের ‘থিয়েটারওয়ালা’র সমসময়ের ঢাকার থিয়েটারের পালাবদল-পর্যবেক্ষণ।
বি.দ্র: অনেক দলের সঙ্গেই বারবার যোগাযোগ করার সত্বেও তথ্য না দেয়ায় এ লেখায় তা যুক্ত করা সম্ভব হয় নি। অনিচ্ছা সত্বেও কোনো ভুল তথ্য থেকে যেতে পারে। সেজন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
অনন্ত হিরা (
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
): নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা। সদস্য- প্রাঙ্গণেমোর।