Full premium theme for CMS
সেলিম আল দীনের গবেষকসত্তা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮) গবেষণা করে যা পেয়েছেন তার প্রয়োগ করেছেন নাট্যকর্মে। প্রচলিত অর্থে তিনি মননশীল গবেষক ছিলেন না। কিংবা বলা যায় গবেষক হিসেবে তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতি চান নি। আমরা জানি যে, যে-কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির শর্তপূরণ কিংবা পদোন্নতির প্রয়োজনে গবেষণা করতে হয় সকল শিক্ষককে। সেলিম আল দীন-ও তাঁর ব্যতিক্রম নন। প্রথাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার অংশ হিসেবে তিনি আর্টিকেল রচনা করেছেন, স্বীকৃত জার্নালে তা প্রকাশও করেছেন। এমনকি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্রতিষ্ঠিত নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের জার্নাল ‘থিয়েটার স্টাডিজ’ সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছেন। এমফিল-পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণার তত্ত্বাবধান করেছেন। এছাড়া বেসরকারি সাহায্য সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘নাট্যকোষ’ প্রণয়ন করেছেন। নিজের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্যে প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ আবদুল কাইউমের তত্ত্বাবধানে ‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্যরীতি’ নামে গবেষণা করেছেন। তাঁর সেই গবেষণার ফসল মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে সেলিম আল দীন সৃজনশীলতার বাইরে স্বতন্ত্র এক গবেষকসত্তার প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ডিগ্রিলাভের জন্য গবেষণা আর নিজের কৌতূহল পূরণের বা জ্ঞান অর্জনের জন্য গবেষণার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। নিজের কৌতূহল পূরণের জন্য যে গবেষণা, তাতে প্রাণপ্রবাহ সচকিত থাকে। সেলিম আল দীন যেহেতু নাট্যকার ও নাট্য-অধ্যাপক হিসেবে জাতীয় নাট্যরীতি অনুসন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন, তাই তার গবেষণা ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে।
সেলিম আল দীনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা ছিল না। তিনি নাট্যকার আমি দর্শক, তিনি লেখক আমি পাঠক, তিনি অগ্রজ লেখক আমি অনুজ লেখক- এই মাত্র সম্পর্ক। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না বলেই তাঁর কাজ নিয়ে নিরপেক্ষ ও নির্মোহ মন্তব্য করতে কোনো বাধা নেই। সেলিম আল দীন নিজের সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না বলে বাজারে একটি কথা চালু রয়েছে। এই জন্য তাঁকে নিয়ে যতটুকু লেখা হয়েছে, সবটুকুই প্রশংসা ও স্তুতি। সমালোচনার কথা ভাবলেও কেউ তেমনভাবে এগিয়ে আসেন নি। নাট্যকার ও নাট্যগবেষক ডক্টর রাহমান চৌধুরী তাঁর নাট্যকর্মের কিছুটা সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তা-ও তাঁর ভক্তমহল কতটা মেনে নিতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাঁর অকালপ্রয়াণ কেউ-ই মেনে নিতে পারেন নি। পরিচিত-অপরিচিত সকলেই শোকাকুল। শোক থিতিয়ে এলে নির্মোহ সমালোচনার মাধ্যমে নাট্যকার ও গবেষক সেলিম আল দীনের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন সহজতর হবে। আমরা আপাতত তাঁর গবেষকসত্তার স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করব।
বাংলা নাটকের উদ্ভবকাল নিয়ে নানান মত প্রচলিত রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বাংলা নাটকের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে- এরকম কথা বলা হয়েছে আমাদের নাটকের ইতিহাস ও সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে। হেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ (১৭৪৯-১৮১৭) প্রথম বাংলা নাটক মঞ্চায়নের (১৭৯৫) কৃতিত্ব লাভ করেছেন। পাশ্চাত্য প্রভাবে বাংলা নাটকের জন্ম- এমন বক্তব্যই প্রচার করেছেন নাট্যইতিহাসবেত্তাগণ। বাংলা মৌলিক নাটক রচনার কৃতিত্ব দেয়া হয় রামনারায়ণ তর্করতœ (১৮২২-১৮৮৬)-কে। তাঁর কুলীনকুলসর্ব্বস্ব (১৮৫৪) প্রথম মৌলিক নাটক হিসেবে স্বীকৃত। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক ১৮৭২ সালে বাঙালির প্রথম সাধারণ রঙ্গালয় ন্যাশনাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হলে নাটকের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। এর আগে বেলগাছিয়া থিয়েটারে (১৮৫৮-৬১) মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯) মঞ্চায়নের ইতহাসও আমরা জানি। সেলিম আল দীন এই সত্যের বিপরীতে না দাঁড়িয়েও রচনা করলেন বাংলা নাটকের নতুন ইতিহাস। যারা বলতেন, পৃথিবীর সকল দেশের জাতীয় নাট্যআঙ্গিক সৃষ্টি হয়েছে স্ব-স্ব দেশের লোকনাট্য থেকে কিংবা বাংলা নাটকের সৃষ্টি হয়েছে পাশ্চাত্য থিয়েটার থেকে, সেলিম আল দীন তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে বলতে চাইলেন যে, বাংলা নাটকের সৃষ্টিও বাংলা লোকনাট্য থেকে। আর এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছুটে গেলেন মধ্যযুগের কাছে। তিনি যথার্থই বলে উঠলেন-
বাঙলা নাটকের প্রাচীন ও মধ্যযুগে ‘নাটক’ কথাটা প্রায় দুর্লভ। ‘বুদ্ধনাটক’কে নাটক বলা হলেও তা নৃত্যগীতেরই আঙ্গিক। আমাদের নাটক পাশ্চাত্যের মতো ‘ন্যারেটিভ’ ও ‘রিচুয়্যাল’ থেকে পৃথকীকৃত সুনির্দিষ্ট চরিত্রাভিনয় রীতির সীমায় আবদ্ধ নয়। তা গান, পাঁচালি, লীলা, গীত, গীতনাট, পালা, পাট, যাত্রা, গম্ভীরা, আলকাপ, ঘাটু, হাস্তর, মঙ্গলনাট, গাজীর গান ইত্যাদি বিষয় ও রীতিকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে।১
আমরা দেখেছি যে মধ্যযুগের নাট্যআঙ্গিক অনুসন্ধানের অন্বেষায় সেলিম আল দীন ধর্মপূজা, শূন্যপূরাণ, গীতগোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পাঁচালি, চণ্ডীমঙ্গল, রামায়ণ, মহাভারত, চৈতন্যভাগবত, ধর্মমঙ্গল, পদ্মপুরাণ, পদ্মাবতী, পীরপাঁচালি, ময়মনসিংহগীতিকা এমনকি প্রতিবেশী প্রাদেশিক ভাষার নাট্যআঙ্গিকের দ্বারস্থ হয়েছেন। সেলিম আল দীনের এই অনুসন্ধিৎসা বাংলা নাটকের ইতিহাসকেই নতুন করে সাজাতে বাধ্য করেছে। এভাবেই নাট্যকার সেলিম আল দীন তাঁর অধ্যাপকসত্তা এবং গবেষকসত্তার পরিচয় প্রদান করেন। সেলিম আল দীনের এই উদ্যোগ সকল মহলে স্বীকৃত ও নন্দিত। উনিশ শতকে বাংলা নাটকের যে আকস্মিক উদ্ভাবনার কথা আমরা জেনে এসেছি, তার বাইরে এসে তিনি হাজার বছর ধরে প্রবহমাণ অভিনয়রীতি বিচার-বিশ্লেষণ করে বাংলা নাটকের ইতিহাস খুঁজতে মধ্যযুগে বিহার করেছেন। লুপ্ত উপকরণ থেকেই তিনি নির্মাণ করেছেন ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। এখানেই সেলিম আল দীনের কৃতিত্ব। কিন্তু সেলিম আল দীনের আগেও কেউ কেউ এই চেষ্টা করেছেন। যেমন কবি শ্রীরায়বিনোদের পদ্মাপুরাণ থেকে নাট্যসম্ভাবনা আবিষ্কার করেছেন অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া। তারও আগে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর আহমদ শরীফ প্রমুখ পণ্ডিতের মধ্যযুগ-অন্বেষায় নাট্যসম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে। তবে যুক্তি সহযোগে ধারাবাহিক বিবরণ ও ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে ইতিহাস রচনার কৃতিত্ব সেলিম আল দীনের।
সেলিম আল দীন নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এতটাই মরীয়া যে, অন্যের মত ও যুক্তি অনেক সময় এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। নিজের সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রেও তিনি এতটাই সরাসরি বাক্য প্রয়োগ করেন যে, তাঁর বিকল্প ভাবার সুযোগ দেন না। যেমন তিনি বলেছেন, ‘মধ্যযুগে অষ্টাদশ শতকের পূর্বে নাটক অর্থে যাত্রা কোথাও দেখা যায় না।’ এই উক্তির পরে আমাদের দেশে যে দু-একজন ব্যক্তি যাত্রা নিয়ে লেখালেখির চর্চা করছেন, তারাও বিনা-বাক্যব্যয়ে তা মেনে নিলেন। এই উক্তি মেনে নেয়ার আগে দুটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়। সেলিম আল দীনের বক্তব্য মোতাবেক, ‘মধ্যযুগে অষ্টাদশ শতকের পূর্বে যাত্রা দেখা যায় না’২। আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে যে, সেলিম আল দীন কি আদিযুগে বা প্রাচীনযুগে যাত্রার উপস্থিতিকে স্বীকার করতেন? বিশ্বকোষপ্রণেতা নগেন্দ্রনাথ বসু, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, ড. গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, ড. অজিতকুমার ঘোষ, ড. নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়, গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ, ড. হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, প্রবোধবন্ধু অধিকারী, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, মমতাজউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব যাত্রার উদ্ভবকাল হিসেবে প্রাচীনকালের কথাই প্রচার করেছেন। যেমন নগেন্দ্রনাথ বসুর (১৮৬৬-১৯৩৮) বক্তব্য থেকে যাত্রার প্রাচীনতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়-
অতি প্রাচীনকাল হইতে ভারতবর্ষের সকল স্থানেই প্রকাশ্য রঙ্গভূমে বেশভূষায় ভূষিত ও নানা সাজে সুসজ্জিত নরনারী লইয়া গীতবাদ্যাদি সহকারে কৃষ্ণপ্রসঙ্গ অভিনয় করিবার রীতি প্রচলিত। পুরাণাদি শাস্ত্রগ্রন্থে বর্ণিত ভগবদবতারের লীলা ও চরিত্র ব্যাখ্যান করা এই অভিনয়ের উদ্দেশ্য। ধর্মপ্রাণ হিন্দুগণ সেই দেবচরিত্রের অলৌকিক ঘটনা পরম্পরা স্মরণ রাখিবার জন্য এক একটি উৎসবের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। গীতবাদ্যাদিযোগে ঐ সকল লীলোৎসব-প্রসঙ্গে যে অভিনয়ক্রম প্রদর্শিত হইয়া থাকে, তাহাই প্রকৃত যাত্রা বলিয়া অভিহিত।৩
সেলিম আল দীনের কথার সূত্র ধরে যাত্রার উদ্ভবকাল প্রাচীনকাল ধরে নেয়া গেলেও তিনি আসলে তা বলতে চান নি। তিনি মধ্যযুগে এবং মধ্যযুগের অষ্টাদশ শতকের পরে যাত্রার উদ্ভব বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, ‘নাটক অর্থে যাত্রা কোথাও দেখা যায় নি’ মানে কি অন্য কোনো অর্থে যাত্রা দেখা গিয়েছিল? তিনি আসলে বলতে চেয়েছেন, ‘অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ‘যাত্রা’ কথাটার অর্থ সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই মূলত ‘যাত্রা’ নাট্যাদি অর্থে পরিচিতি লাভ করে’।৪ তাহলে যাত্রা এর আগেও ছিল। তা ‘নাট্যাদি’ অর্থে নয়- উৎসব অর্থে, নাটগীত অর্থে, তারপরে অভিনয় অর্থে, সর্বোপরি ‘যাত্রা’ অর্থে। যাত্রাকে নাট্যাদি অর্থে থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা কি আছে? লোকনাট্য থেকে যে নাটকের উদ্ভব, তা পশ্চিমি থিয়েটারি ধারায় মিশে নতুন নাট্যধারা হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু এই বাংলা ভূখণ্ডের সাংস্কৃতিক ঐহিত্য ‘যাত্রা’, যাত্রা নামেই বিকশিত, অপেরা কিংবা থিয়েট্রিক্যাল অপেরা দ্বারা প্রভাবিত এবং বিবর্তিত হয়েও যাত্রা নামেই টিকে আছে। নাট্যাদি অর্থে পরিচিতি করার সময় ধরে তার উদ্ভবকাল বিবেচনা করার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। সেলিম আল দীনের ধারণার বাইরে গিয়ে তাই আমাকেও বলতে হয়েছে-
শ্রীচৈতন্যদেবের অভিনয়কে যথার্থ অর্থে যাত্রাভিনয় বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। উৎসব অর্থে যাত্রা বা শোভাযাত্রার উন্মেষ হয়ত মানবসভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু অভিনয়কলা অর্থে যাত্রার উন্মেষ ষোড়শ শতকে। এসময়ে যাত্রা ছিল আসরে বা চাঁতালে। আর অষ্টাদশ শতকে যাত্রা চাঁতাল বা আসর থেকে উঠে আসে মঞ্চে। যাত্রার মঞ্চকে এখনও আসর বলা হয়ে থাকে। অষ্টাদশ শতকের পর থেকে যাত্রা উৎসব কিংবা গীতাভিনয়ের আবরণ ঝেড়ে পরিণত হয় স্বতন্ত্র এক অভিনয়কলায়।’৫
সেলিম আল দীন গবেষক হিসেবে মৌলিক চিন্তার সন্ধান করেছেন। মধ্যযুগের যত রকমের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐহিত্য রয়েছে, তার মাঝ থেকে বাঙলা নাটকের স্বরূপ সন্ধান করেছেন। মধ্যযুগেও যেমন গীতরূপে কিংবা কথারূপে নাট্যআঙ্গিক ছিল, আধুনিক যুগে সেলিম আল দীন তার প্রয়োগ করেছেন নিজের নাট্যসৃষ্টিতে। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে দ্বৈতাদ্বৈত শিল্পতত্ত্ব প্রচলিত থাকলেও সেলিম আল দীন নিজের মতো করে তা প্রচার করেছেন। কিন্তু অনেকে ভেবে নিয়েছি, এটি সেলিম আল দীনের নিজের তত্ত্ব। সেলিম আল দীনের আগে এই সমাজে প্রচলিত রয়েছে।
‘সেলিম আল দীন পাঠশালা’র প্রথম অনুষ্ঠানের প্রচারপত্রে বলা হয়েছে তিনি গদ্য-পদ্য বিভাজন মানতেন না। শিল্পের আঙ্গিকের রূপভিন্নতাও মানতেন না বলে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু এটি কতটুকু সত্যি তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকে। তিনি ভিন্নতা মানতেন বলেই তার সৃষ্টিকে কেবল নাট্যমঞ্চে দেখতে চাইতেন। অর্থাৎ তিনি যে আঙ্গিকেই সৃষ্টি করুন, লোকে তাকে নাটক বলুক, তা কি তিনি চাইতেন না? ভেদ যদি না-ই মানতেন তবে, বাংলা বিভাগ থেকে অর্থাৎ সাহিত্য বিভাগ থেকে ‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব’ বিভাগ নামে আলাদা বিভাগ সৃষ্টির প্রয়োজন হতো না। নিজেকে আলাদা করতে চাইতেন বলেই তিনি ক্রমশ ‘সেলিম আল দীন’ হয়ে উঠতে চেয়েছেন।
প্রচার করা হচ্ছে, সেলিম নিজের লেখাকে কখনো নাটক বলেন নি। এত কি তাঁর আলাদা কৃতিত্ব ঘোষিত হয়? একজন নাসির উদ্দীন ইউসুফের হাতে পড়লে একটি সাধারণ আখ্যান মঞ্চে উপস্থাপিত হতে পারে। বলা যেতে পারে, মঞ্চায়নের উপযোগী করে সেলিম আল দীন সংলাপকে আলাদা করেন নি। একজন বাচ্চু আছেন বলেই হয়তো তা করতে হয় নি। সেলিম আল দীনের শেষ দিকের রচনার মাহাত্যকে স্বীকার করেই বলা যায়, নতুন করে এর মঞ্চায়ন করলে তো ‘নাট্যরূপান্তরের’ কাজটি তাকে করে নিতে হবে। যেমন কিনা সেলিম আল দীন নিজেও করেছেন কাঁদো নদী কাঁদো-র বেলায়। এছাড়াও গল্প থেকে বা কবিতা থেকে বা জীবন কথা থেকে তো নাটক অহরহ হচ্ছেই, রূপান্তর ঘটিয়ে। সেলিমের ক্ষেত্রে এই কাজটি নাট্যনির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফ নিজেই এই রূপান্তরের কাজটি করছেন। বিনোদিনীর আত্মজীবনকথা নিয়ে নাটক হচ্ছে কিন্তু নাট্যকার হিসেবে বিনোদিনীর নাম নিচ্ছি না, নিচ্ছি সাইমন জাকারিয়ার নাম। কারণ সাইমন জাকারিয়া এর নাট্যসম্ভাবনাকে উপলব্ধি করে মঞ্চায়নযোগ্য রূপান্তর ঘটিয়েছেন।
সংস্কৃত নাটককে এখনও দৃশ্যকাব্য বলা হয়। নাট্যকারকে ‘কবি’ বলা হয়। এজন্যই নাট্যকার কালিদাস পরিচিতি মহাকবি হিসেবে। সেখানে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নাটক ও কাব্যকে আলাদা করা হয় নি। সেলিম আল দীন হয়তো সেরকমই চেয়েছিলেন। আদিতে সাহিত্য-সঙ্গীত যা-ই বলি একই-রকম ছিল। ক্রমে তা শতধারায় বিকশিত হয়েছে। সেলিম আল দীন তাকে আবার আদিরূপে দেখতে চেয়েছেন। সুশীল সমাজ যাকে বলে ‘শেকড়ের সন্ধান’। শেকড়ের সন্ধানে সেলিম আল দীন সফল পর্যটক। গবেষকসত্তা তাঁকে ওই আসনে বসাতে পেরেছে, আমার অন্তত তাই মনে হয়। কিন্তু অতিভক্তির আতিশয্যে অন্ধভক্তরা তাঁকে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছেন, বুঝতে পারছি না। সেলিম আল দীন নাট্যকার হিসেবে মহান, সেই নিরিখেই তাঁকে বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্য রচনা ও গবেষণায় তাঁর প্রভাববিস্তারী ভূমিকাকে অস্বীকার করার সুযোগ কারো নেই।
টীকা ও তথ্য-নির্দেশ :
১. সেলিম আল দীন, মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃ. ৪
২. সেলিম আল দীন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮৫
৩. নগেন্দ্রনাথ বসু, বাংলা বিশ্বকোষ, পঞ্চদশ ভাগ, বিআর পাবলিশিং কর্পোরেশন, দিল্লী, (প্র-প্র. ১৮৮৬-১৯১১), পুনর্মুদ্রণ ১৯৮৮, পৃ. ৬৯৭
৪. সেলিম আল দীন, ‘যাত্রার উদ্ভব বিষয়ে’, জাতীয় যাত্রা উৎসব স্মরণিকা ১৯৯৪-৯৫
৫. তপন বাগচী, বাংলাদেশের যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৭
ড. তপন বাগচী : সহাকারী সম্পাদক, ‘সাপ্তাহিক ২০০০’, ঢাকা।