Full premium theme for CMS
দেশজ নাটকের অস্তিত্বের সংকট
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[গত ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিট্যুট, বাংলাদেশ কেন্দ্র আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসব ও সেমিনার’। ‘শিকড়ের হোক ডানা’ এই স্লোগানের উৎসবের সেমিনারে দু’দিনে মোট তিনটি বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। বিষয়গুলো ছিলো- ‘দেশজ নাটকের অস্তিত্বের সংকট’, ‘দেশজ নাটক: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ এবং ‘নতুন সহস্রাব্দে দেশজ নাটক’। ‘দেশজ নাটকের অস্তিত্বের সংকট’ বিষয়ে আতাউর রহমানের বক্তব্য প্রকাশ করা হলো থিয়েটারওয়ালা’র পাঠকদের জন্য]
অস্তিত্বের সংকট একেবারে পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে দেখা গেছে। প্রতিটি আর্ট ফর্ম বারবার এর মুখোমুখি হয়েছে। অস্তিত্বের সংকটের একেবারে আদিতে গেলে, গুহাবাসী মানুষ নিজেই এই অস্তিত্বের সংকটে পড়েছিল। গুহাবাসী মানুষ, আমরা জানি, যদি ডারউইনের থিওরি না-ও মানি, তবুও জানি যে, তারা আমাদের মতো ছিল না। কাপড়-চোপর পড়তো না, গায়ে বড় বড় লোম ছিলো- শীত থেকে বাঁচার জন্য, প্রকৃতির কর্কশ হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের এসবের প্রয়োজন ছিল। তারা অনেক দীর্ঘাঙ্গী ছিল। তারপর বিবর্তনে বিবর্তনে ছোট হয়ে গেল। ডায়নোসর আজ নেই। হাতি আছে। হয়তো হাতিও আজ থেকে হাজার বছর পর ইঁদুর হবে কিংবা বিলুপ্ত হবে। কাজেই অস্তিত্বের সংকট- এই বিষয়টির মধ্যেই এক ধরনের যৌগিকতা আছে বলে আমার ধারণা। এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, যদি এটমিক এক্সপ্লোশন হয়, তাহলে মানুষের যা কিছু কীর্তিকলাপ সবই ধ্বংস হয়ে যাবে, প্রাণী সকল ধ্বংস হবে- বৃক্ষ ধ্বংস হবে। তাঁরা বলেন, বেঁচে থাকবে কেবল ছাড়পোকা। খুব ছোট। আসলে টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করছে এক বিশেষ ভৌগলিক স্থানের মানুষ কীভাবে তার ঐতিহ্যকে ধরে রাখবে তার উপর।
ভৌগলিক স্থান বললাম এ জন্য যে, দেশ বা রাষ্ট্রতো ভাগ হয়। এক সময় ভারতবর্ষ ছিল এখন বাংলাদেশ। কিন্তু বাঙালিতো বাঙালিই থাকে। সে জন্যই বলছি নির্দিষ্ট ভৌগলিক স্থানের মানুষটি তার ঐতিহ্যের প্রতি কতটুকু টান অনুভব করে, কতটুকু ভাবে- কালের আবর্তে ঐতিহ্য হয়তো হারিয়ে যায় কিন্তু আবার পুরোনোকে টেনে এনে আধুনিকতা রোপন করে কিনা সেটা দেখতে হবে। এবং এক্সপেরিমেন্ট যখন টিকে যায় তখন কিন্তু তা ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যায়। এ্যাবসার্ড নাটকের একটা মুভমেন্ট হয়েছিল, টেকেনি কিন্তু স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’ টিকে গেল। তারমানে তা ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেল। আবার ঐতিহ্যে এনে আমরা এক্সপেরিমেন্টে গ্রথিত করি সুতরাং সমস্ত ব্যাপারটিই একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর উপরই নির্ভর করে যে আমরা ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখবো কিনা। আবার টিকিয়ে রাখলে পুরাতনের মতো টিকিয়ে রাখবো কিনা কিংবা পুরাতন নতুনে সংমিশ্রণে টিকিয়ে রাখবো কিনা। এটা একটা দেখার দৃষ্টিভঙ্গী বলে আমি মনে করি।
যদি আমি এটাকে সম্পূর্ণ অবয়বে টিকিয়ে রাখি, যেমন, আজকে যদি আদি মানুষকে আমি গুহা থেকে টেনে আনি, তবে কিন্তু তা মিউজিয়াম পিস হয়ে যাবে। যেমন জাপানের ‘নো’, ‘কাবুকি’ থিয়েটার। ষোড়শ ও চতুর্দশ শতকের এই দু’টি ফর্মকে তারা ধরে রেখেছে। তারা সেই ঐতিহ্য নিয়েই এই থিয়েটার করে, তেমন কোনো মডিফিকেশন ছাড়াই। জাপানের মতো এমন ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড সিভিলাইজেশন, যারা ব্যবসা ছাড়া পারতপক্ষে কিছুই বুঝতে চায় না- আমি তাদের হেয় করছি না, তাদের প্রচ- সৌন্দর্যবোধ আছে এবং সেই সৌন্দর্যবোধ থেকেই তারা ‘নো’, ‘কাবুকি’ থিয়েটারে যায়, আমি শুনেছি এই থিয়েটার বেশ একঘেঁয়ে। তারপরও যারা বোঝে তারা এর থেকে একটা সৌন্দর্য বের করে আনে। হয়তো আমি বুঝবো না। ঐতিহ্য হিসেবেই ওরা এটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আবার আরেক রকমের বাঁচানোও আছে। যেমন তিজেন বাঈ। ভারতের পদ্মশ্রী তিজেন বাঈ বলেছেন যে, মহাভারতের কাহিনি তিনি হুবহু একই ফর্মে তুলে ধরেন না। ঐতিহ্য হচ্ছে, মহাভারতের কহিনি, বংশ পরম্পরায় বলা হতো যে, হাঁটু গেঁড়ে বসে হাত জোর করে পড়া হতো। গান গেয়ে, কথা বলে ঘন্টার পর ঘন্ট পড়া হতো। কিন্তু তিজেন বাঈ এটাকে মডিফাই করলেন। তিনি দাঁড়ালেন, ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং শুরু করলেন। এটাকে আমি বলবো পজেটিভ মডিফিকেশন। আমি দু’টো উপমাই দিলাম। ‘নো’, ‘কাবুকি’ আর তিজেন বাঈ। এখন আমি আমাদের ‘যাত্রা’র কথা বলবো। আদিতে যে ‘যাত্রা’ ছিল এখন তা নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু ‘যাত্রা’কে প্রসেনিয়াম ঘরের মধ্যে নিয়ে এসেছে। অনেক মডিফাই করেছে। ‘যাত্রা’কে আমরাও কিন্তু মডিফাই করেছি। আবার বিকৃতিও করেছি। এখন আমার প্রশ্ন হলো ‘যাত্রা’কে আদি ফর্মে রাখলে কি ‘যাত্রা’ টিকতো? আমার মনে হয় না। আদিতে চিৎকার করতো, এখন মাইক্রোফোন ব্যবহার করা হচ্ছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি সুযোগ সুবিধা এগুলোর ব্যবহার হবেই। তাই কোনো কিছুই আদি ফর্মে রাখবার প্রয়োজন নেই। বরং যদি ‘যাত্রা’র ভালো দিকগুলো নিয়ে, নির্যাস নিয়ে ন্যারেটিভ ফর্মটা নিয়ে, মেক বিলিভ- একটি চেয়ার বসিয়ে আমরা সিংহাসন বোঝাচ্ছি, একটা রাজ্যসভার আবহ তৈরি করছি- এগুলো কিন্তু ‘যাত্রা’ ফর্মের ভালো দিক। তো এগুলোকে অবিকৃত রেখে, তার সঙ্গে ‘যাত্রা’র যে একটা মেলোড্রামাটিক ফর্ম আছে সেটাকে মডিফাই করে একটা মিক্সচার আমি অবশ্যই করতে পারি। তা না হলে আধুনিক দর্শক তা গ্রহণ করবে কেনো? কাজের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে, ভৌগলিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষ কিন্তু এডাপ্ট করে। এটা মানুষের একটা প্রবণতা। চিরকালীন প্রবণতা। মানুষ প্রকৃতির সাথে এডাপ্ট করে, মানুষ জনগোষ্ঠীর পরিবর্তনের সাথে এডাপ্ট করে, মানুষ সভ্যতার উত্তরণের সাথে এডাপ্ট করে- খাপ খাইয়ে নেয়, মিলিয়ে নেয়। কাজেই সংকট, যে সংকটের কথা বলা হচ্ছে, এই সংকটটাকে কিন্তু আমি বড় করে দেখি না। কারণ মানুষ সহজ প্রবণতা থেকেই কিন্তু এটাকে বাঁচিয়ে রাখবে। কারণ মানুষতো হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা কোনো জিনিস নয়। তার একটা অতীত আছে, বর্তমান আছে, ভবিষ্যতও থাকবে। কাজেই অতীতের ভিত্তি প্রস্তরের উপরই কিন্তু বর্তমান স্থাপিত। সুতরাং আমি যদি মেনে নিই যে, আমার একটি অতীত ছিল, আমি ভূঁইফোঁড় কেউ নই- তাহলে আমাকে আমার ফর্মগুলোকে মানতেই হবে। বিশেষ করে ন্যারেটিভ ফর্ম, এই ভূখ-ের ফর্মগুলোকে মানতেই হবে। আজকে আমি যতই মডার্ন থিয়েটার নিয়ে কাজ করি না কেনো, আমি পশ্চিম থেকে এডাপ্ট করি না কেনো, আমি যদি ওটাকে প্রথিত করি আমার ঐতিহ্যের সাথে, তাহলে আমি সংকটের কিছু দেখি না। আমি মনে করি আধুনিক মানুষের জন্য এটা লাভজনক হবে।
সবাইকে ধন্যবাদ।
[প্রবন্ধটি বক্তৃতা থেকে অনুলিখিত- সম্পাদক]
আতাউর রহমান: নাট্যব্যক্তিত্ব। সদস্য, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়।