Full premium theme for CMS
নৃপেন দা’: দুইবাংলার নাট্যসাঁকো
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নৃপেন্দ্র সাহা শুধু আমার কছে নয়, আমার মতোই সমভাবে ও সমহারে সারা বাংলাদেশের হাজার হাজার নাটকের মানুষ এবং তাদের পরিবারের ছোট-বড় সবার কাছেই ছিলেন সমান প্রিয়, সবারই তিনি ছিলেন ‘নৃপেন দা’। আমার বাসাতেই আমি এবং নূনা (নূনা আফরোজ) তাঁকে ‘নৃপেন দা’ ডাকতাম, আমাদের ছেলে দিগন্তও তাঁকে ‘নৃপেন দা’ ডাকতো। আমাদের বাসায় অবস্থানকালে নৃপেন দা’র যে দিকটা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করতো আমার ছেলেকে, তা হলো, রোজ সকালে উঠে তাঁর পাখিদের খাবার দেবার দায়বোধ। ঢাকার বনানী এলাকার দোকান-পাট তাঁর চেনা নাই, তবু বাসায় উঠেই তাঁর সবচেয়ে জরুরি এবং অবশ্যকর্তব্য ছিল পাখির জন্য সকালের খাবার কেনা। আহারে! এমন থিয়েটার দরদী মানুষ হয়তো আরো পাবো কিন্তু একই সাথে থিয়েটার ও প্রাণী দরদী মানুষ আর কি পাবো?
তাঁর সাথে প্রথম আলাপের সূত্রপাত হয় ২০০৬ সালে ঢাকার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। আমাদের দলের প্রথম প্রযোজনা ‘শ্যামাপ্রেম’ নাটক দেখে দর্শকসারি থেকে উঠে এসে নিজ উদ্যোগে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন আমাদের সবার সাথে। সেবার ঢাকায় উঠেছিলেন ঢাকা থিয়েটারের হিমুভাইয়ের (হুমায়ূন কবীর হিমু) বাসায়। বাংলাদেশের জল, মাটি, হাওয়া আর থিয়েটারের মানুষদের প্রতি এক দুর্নিবার ভালোবাসা আর আকর্ষণে তিনি বারবার ফিরে ফিরে এসেছেন বাংলাদেশে এবং ঘুরে বেড়িয়েছেন সারাদেশে, নাটক দেখেছেন বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই। নাটক শেষে আলোচনা-সমালোচনা করেছেন, ভুল সুধরে দিয়েছেন, সর্বোপরি আরো বেশি বেশি ভালো নাটক করতে সবাইকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, দিয়েছেন উৎসাহ। সাহস জুগিয়েছেন, মনোবল বাড়িয়েছেন। বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায়, আমার ধারণা, তিনি সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন পল্টনে হিমুভাইয়ের বাসায়। ইস্কাটনে রাহমান চৌধুরীভাইয়ের বাসায় এবং বনানীতে আমার বাসায়।
প্রথম পরিচয়ের পর নৃপেন দা কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমাদের জানালেন যে, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে ‘ঋত্বিক’ নামে একটি নাট্যদল ‘দেশ বিদেশের নাট্যমেলা’ নামে বড় নাট্যোৎসবের আয়োজন করে থাকে। অনেক বছর ধরেই এই নাট্যমেলার নিয়মিত আয়োজন চলছে। তো সেখানে আমাদের নাটক ‘শ্যামাপ্রেম’ নিয়ে যেতে হবে। নৃপেন দা সব আলোচনা চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। আমাকে বললেন, আয়োজকদের পক্ষ থেকে ফোন করলে আমি যেনো সম্মতি দেই। এই মুর্শিদাবাদ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার মুর্শিদাবাদ, হাজারদুয়ারী খ্যাত বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের বংশধররা এখনো যেখানে বসত করে, সেই মুর্শিদাবাদ এবং যেই পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন সূর্য্য অস্তমিত হয়েছিল আর নবাব সিরাজউদ্দৌলার ঘাতক মুহাম্মদি বেগ-এর কবর যেই শহরে, এ সেই মুর্শিদাবাদ। সেই শহর থেকে নাটক করতে যাবার আমন্ত্রণ আসবে! ভাবা যায়! আমরা আরও আনন্দে উদ্বেলিত ছিলাম এ কারণে যে, ‘প্রাঙ্গণেমোর’ নাট্যদলটি গঠিত হবার পর, তার প্রথম প্রযোজনার প্রথম বিদেশে নাটক করতে যাবার এটাই ছিল প্রথম আমন্ত্রণ। সাঁকোটি ছিলেন নৃপেন দা।
ঐ আমন্ত্রণে মুর্শিদাবাদ গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম নৃপেন দা ঢাকার মতোই মুর্শিদাবাদেও সব দলের ছোটবড় সবার প্রিয় এবং নমস্য একজন মানুষ। আরো পরে জেনেছি, কলকাতাসহ পুরো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য জুড়ে, যেখানেই থিয়েটার আর থিয়েটারের মানুষ সেখানেই নৃপেন দা’র জনপ্রিয়তার জয় জয়কার। কারণটা আর কিছুই না, নৃপেন দা তাঁর হৃদয়ের সমুদ্রসম সারল্য দিয়ে থিয়েটারপাগল মানুষগুলোকে ভালোবাসতেন।
ঐ যাত্রায় তিনি আমাদের আরো একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন কলকাতার হাওড়ায়। এই একই প্রক্রিয়ায় তিনি বাংলাদেশের অনেক দলেরই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে নাটক নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে সেতুবন্ধনের কাজটি করেছেন অনেকদিন ধরে। কারণ, তিনি খুবই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, একই ভাষা-সংস্কৃতির এই দুই বাংলার নাটকের আদান প্রদান দুই দেশেরই নাট্যসংস্কৃতিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।
কলকাতায় দাদার সল্টলেকের বাড়িতে অনেকবার গিয়েছি এবং দেখেছি যে, তাঁর থাকার ঘরটি যেনো নাট্যবিষয়ক বই, পত্র-পত্রিকার একটি গুহা। এবং সেখানে একটি অংশ শুধু বাংলাদেশের নাট্যবিষয়ক বই পত্র-পত্রিকা আর স্মরণিকার জন্য নির্ধারিত। বাংলাদেশে দেখে যাওয়া কোনো একটি নাটকের টিকেট বা কোনো অনুষ্ঠানে পাওয়া একটি উত্তরীয় কতো যত্নে রেখে দিতেন তিনি!
ঢাকায় ও কলকাতায় একই সঙ্গে অনেক নাটক দেখা এবং পরবর্তী সময়ে সেই নাটকগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সময় আমি বুঝতে পারলাম এবং কিছুটা বিরক্তও হলাম এই ভেবে যে, দাদা সব নাটককে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেন এবং বিচার বিশ্লেষণ করেন। সোজা কথা, মোটা দাগে বললে সব নাটকেই তিনি একটি রাজনৈতিক বক্তব্য খোঁজেন। শ্রেণি বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন, অসাম্য এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বক্তব্য খোঁজেন সব নাটকে। কারণটি অনুসন্ধান করে পেতেও সময় লাগে নি। ছাত্রাবস্থা থেকে নৃপেন দা ছিলেন বিশ্বাসে ও কর্মে বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং সক্রিয়। অর্থাৎ নৃপেন দা’ ছিলেন একজন রাজনীতি সচেতন শিল্পী বা থিয়েটারকর্মী। আর তাই একজন রাজনীতি সচেতন শিল্পী তার দেখা সবকিছু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার বিশ্লেষণ করবেন, এটাই স্বাভাবিক কিনা সেটা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ, বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু নৃপেন দা ছিলেন ঐসব বিচার বিশ্লেষণ এবং বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা একজন মানুষ। যাঁকে বিচার বা বিশ্লেষণ করলে চলবে না, তাঁকে বুঝতে হবে, অনুভব করতে হবে রাজনীতি নয় হৃদয় দিয়ে।
পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে যে বছর তৃণমূল ক্ষমতায় এলো, সে বছর নির্বাচনের পরের দিন আমি কলকাতায় ছিলাম। সকালবেলা আমি আর কলকাতার এক পাড়-বামপন্থী থিয়েটারকর্মী সৌরভ চট্টোপাধ্যায় মারকুইজ স্ট্রিটের প্রিন্স হোটেলে নাস্তার টেবিলে ডিম-পরোটা-মিক্সড ভেজিটেলের সঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানকেও বরণ করতে বাধ্য হয়েছিলাম ‘আনন্দ বাজার’, ‘বর্তমান’ আর ‘আজকাল’-এর পাতায় পাতায়। সঙ্গে এ খবরও পেলাম যে, অনেক অনেক নাট্যজন, গানের শিল্পী, চলচ্চিত্রজনও জয়ের মালা পেয়েছে দিদির টিকেটে। এঁদের প্রত্যেকেই এক সময় পৈতৃকসূত্রে বা পারিবারিক ঐতিহ্যে বামপন্থী ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের নৃপেন দা’র পার্থক্য চিহ্নিত করেই স্মৃতিকাতর এ লেখার যবনিকা টানা অপরিহার্য মনে করছি।
সেবার দেখা করতে গিয়ে নৃপেন দা’কে ভীষণ বিষণ্ন বিপন্ন এবং বিধ্বস্ত দেখেছিলাম। যেনো কোনো আইলা বা সিডর এলোমেলো লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে তাঁর বিশ্বাসের বাগান।
চারমাস পর আবার কলকাতায় গেলাম শো করতে। সৌমিত্র মিত্র মহোদয়ের আমন্ত্রণে একাডেমিতে আমাদের ‘রক্তকরবী’ করবো। নৃপেন দা’কে সেই খবর আমরা ঢাকায় থাকতেই জানিয়েছি। প্রদর্শনীর দিন সকাল ১১ টার দিকে একাডেমিতে দাঁড়িয়ে নৃপেন দা’কে ফোন করে বলি- দাদা আজ তো আমাদের শো, কখন আসছেন? অপর প্রান্ত থেকে নৃপেন দা’র উত্তর আমার উচ্ছ্বাসকে বজ্রাহত করলো।- হিরা দিদির জামানায় আমার বোধহয় আর একাডেমিতে যাওয়া হবে না। শুভ কামনা রইলো।- বলেই ফোনটা কেটে দিলেন।
সেদিন অন্যভাবে আঁচ করলাম, নৃপেন দা কেনো সব নাটক তাঁর রাজনৈতিক চোখে দেখতেন। আমৃত্যু তিনি আর একাডেমিতে পা ফেলেন নি। এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শুধুমাত্র বাংলাদেশে আসা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের সকল নাট্য আয়োজন থেকে নিজেকে বিযুক্ত রেখেছিলেন। এই বিযুক্তি এক মৌনধ্যানী মানুষের, তাঁর বিশ্বাস-ভালোবাসা-প্রেমের, হোক না তা রাজনৈতিক। এমন রাজনীতি সচেতন, কমিটেড মানুষ ক’জন পাবো থিয়েটার আঙ্গিনায়! সবাই তো বিনোদনকর্মী, নৃপেন দা’র মতো শিল্পী কোথায়? মানুষ কোথায়?
অন্য মিডিয়ার অর্থ প্রতিপত্তির দৌড় আর স্যালারি গ্রান্টের রেস-এ ক্লান্ত হলে, নৃপেন দা’র মতো মানুষেরাই ছায়া দেবে মহিরূহ হয়ে।
অনন্ত হিরা: অভিনেতা-নির্দেশক-নাট্যকার। প্রতিষ্ঠাতা, ‘প্রাঙ্গণেমোর’।