Full premium theme for CMS
বটতলা’র ‘ক্রাচের কর্নেল’ : লিবারাল মূহ্যমান সময়ে ইতিহাসের র্যাডিকাল পরিবেশনা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
প্রথম কৈফিয়ত
‘বটতলা’ ঢাকা শহরে দলবদ্ধভাবে সচল নাট্যচর্চার সর্বশেষ ফেনোমেনন। সেদিন এক বৃষ্টিহীন সন্ধ্যায় বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনের মঞ্চে, দলটির নতুন প্রোডাকশন ‘ক্রাচের কর্নেল’ দেখে মনে হয়েছে, ঘন্টা দুয়েক ইতিহাসের বটতলায় বিচরণ করেছি। বিচরণ করতে করতে এবং প্রযোজনার পরিবেশনা শেষে নিজের ডেরায় ফিরতে ফিরতে আমার অসংলগ্ন ভাবনাগুলোর উদগার ঠেকিয়ে রাখতে না পারার অপারগতা থেকে এই লেখা-
পরিপার্শ্ব উদঘাটন
উপন্যাসের নাট্যভ্রমণ নামে সেলিম আল দীন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে তাঁর মহাপ্রয়াণেরও বেশ ক’বছর আগে একবার করেছিলেন। এরপর, দু-এক বছর ধরে ‘আরশীনগর’ দলের মাধ্যমে রেজা আরিফ আবার মঞ্চে বুনেন আমাদের জাদুকরী কথক [লেখক] শহীদুল জহিরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’। এমন কী এখানে বলা বাহুল্য হবে না দেবেশ রায়ের মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত’ সুমন মুখোপাধ্যায় কলকাতার মঞ্চে পুনরায় সৃষ্টি করে বেশ একটা কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন বলে আমাদের কাছে যথেষ্ট খোঁজ-খবর আছে। আমাদেরও অনেক দর্শকের জাতীয় জাদুঘর মঞ্চে নাটকটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এ রকম একটা ছিমছিমে পটভূমিতে রেখে বটতলা’র ‘ক্রাচের কর্নেল’কে দেখার কী সুবিধা, তা এখানে ভেঙে বলতে অপারগ হলেও, যে শব্দগুলোর নিচে আমি আন্ডারলাইন করতে চাই তা হলো, প্রযোজনাটি এই অঞ্চলের উপন্যাসকে মঞ্চে পুনরায় ঘটিয়ে তুলবার একটি সৃষ্টিশীল ধারার সর্বশেষ চিহ্ন। তবে এ যদি ‘উপন্যাসের নাট্যভ্রমণ’ হিসেবে শুধু সর্বশেষ চিহ্ন হতো তাহলে আমার আর কোনো বলবার কথা থাকতো না। প্রযোজনাটি এই ধারায় স্বতন্ত্রও বটে। এবং স্বতন্ত্র বলেই এর একটি শক্তিমত্তাও আছে। কেনো স্বতন্ত্র? আর কীইবা সেই শক্তিমত্তা? নাট্য বয়নের এবং পরিবেশনের দ্বান্দ্বিক মূল্য নিরূপণ করতে পারলে এর উত্তর কিছুটা মিলতে পারে।
প্রথম দ্বন্দ্ব: ইতিহাসাশ্রয়ী পরিবেশনার বদলে ইতিহাস বনাম পরিবেশনা
বটতলা’র কাছে ‘ক্রাচের কর্নেল’ প্রথমত কেবল একটি আড়াল হয়তো। এই আড়াল তুলে অর্থাৎ আখ্যানতাত্ত্বিক একটি নাট্যভাষার অন্তরালে বর্তী হয়ে ‘বটতলা’ পরিবেশনা করেছে ইতিহাস। মনে পড়ছে ‘হিস্টরি ইজ পারফরম্যান্স’ এই লাইনটি একবার মগজে গেঁথেছিল, আমার শিক্ষক সৈয়দ জামিল আহমেদের একটি লেখা অনুবাদের সময়। তিনি এই লাইনটি তাঁর লেখায় কোথাও থেকে কোট করেছিলেন, এই মুহূর্তে তা আমার মনে পড়ছে না। আজ ‘ক্রাচের কর্নেল’ দেখার পর আবার আমার মাথায় হানা দিয়েছে- ইতিহাস নিজেই একটা পরিবেশনা। স্থান-কালের (স্পেশিও-টেম্পোরালিটি) বিক্রিয়ায় পাত্র-পাত্রীর ক্রিয়া-কর্মকেইতো আমরা পরিবেশনা বলি, ইতিহাসওতো প্রায় তা-ই। পার্থক্যের মধ্যে ইতিহাসের ঘটনা ঘটে অতীতে আর পারফরম্যান্স বা পরিবেশনা হলো বর্তমানে- দেয়ার অ্যান্ড দেন বনাম হেয়ার অ্যান্ড নাউ। আবার অদ্ভুত হলেও সত্য এই- ইতিহাসকে তো বর্তমান ছাড়া পাওয়া যায় না। ইতিহাসতাত্ত্বিক ই এইচ কার যেমন তাঁর ছোট্ট পুস্তিকা ‘হোয়াট ইজ হিস্টরি’ বইয়ে বিচিত্র কথার মধ্যে এটাও বিশেষভাবে বলেছেন, ঐতিহাসিক যা লিখেন তাই ইতিহাস। এর মানে অতীতের ঘটনাকে বর্তমানে ব্যাখ্যার সূত্রেই ইতিহাস গড়ে ওঠে। ইতিহাসও একটি নির্মাণ মাত্র। লুই আলথুসার ‘অন আইডিওলজি’ বইয়ে শিল্পের স্বতঃস্ফূর্ত ভাষা নিয়ে যে ধারালো কথাবার্তা বলেছেন তা থেকে আলোকপ্রাপ্ত হয়ে বলতে চাইছি, নির্মাণমাত্রই ভাবাদর্শিক। নাট্য অর্থাৎ দর্শকের সামনে এর উপস্থাপনজনিত যে পরিবেশনা হয় তাও ভাবাদর্শিক নির্মাণ। ‘বটতলা’ ‘ক্রাচের কর্নেল’কে অর্থাৎ কর্নেল তাহেরের জীবনেতিহাসকে পরিবেশন করেছে স্পষ্টতই এক ভাবাদর্শিক প্রেষণা থেকে। এর ফলে আমাদের অনিবার্যভাবেই মনে পড়ে যায় বার্টল্ট ব্রেখটকে। ব্রেখট (বা ব্রেশট যাই উচ্চারণ করুন না কেনো) যেমন তাঁর মার্কসবাদী কাব্যতত্ত্বে (দুঃখিত! অগাস্তো বোয়ালের অনুসরণে আমিও সমস্যাজনক পরিভাষা ‘এপিক থিয়েটার’ বলা থেকে বিরত থাকলাম) হিস্টরিফিকেশনকে একটি সবল উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন দর্শককে কাহিনির মধ্যে, নাট্যপরিবেশনার বর্তমান মুহূর্তে নিমজ্জিত না করে, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের বাস্তবতা সম্পর্কে দর্শককে সচকিত করতে, দর্শক যাতে নাট্য থেকে সমাজের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে, সমাজ রূপান্তরের রাজনৈতিক লড়াইয়ে ব্রতী হয়ে দুনিয়াটাকে বদলাতে অনুঘটকের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। বটতলা’ও শাহাদুজ্জামানের ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাসকে একটি বুদ্ধিবাদী অ্যাপ্রোচে ইতিহাস ও পরিবেশনার দ্বন্দ্বমুখরতায় অন্যমাত্রায় মঞ্চে ঘটিয়ে তুলেছে। ওদের ‘ক্রাচের কর্নেল’ দেখে বিক্ষিপ্তভাবে হলেও আমার মনে পড়েছে, ইতিহাস কেবল মৃতদের সংলাপ নয়, ইতিহাস মঞ্চে পরিবেশিত হতে পারে মৃতের সাথে জীবিতের সংলাপ আয়োজনের এক মধ্যবর্তী পরিমণ্ডল সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। নাট্য পরিবেশনার মধ্যে তৈরি হওয়া কাল্পনিক পরিম-লে পরিবেশিত ওই নির্দিষ্ট ইতিহাসের উত্তরাধিকারী জনগণ নিজেদের আশু ভবিতব্য গড়ে তোলার জন্য সম্ভাব্য রূপরেখাটি, নাটক দেখতে দেখতে বিনোদিত হবার প্রত্যেকটি মুহূর্তের আড়ালে খুঁজে নেবে- বটতলা’র এই বাসনা এবং প্রচেষ্টার ভেতরেই ইতিহাস ও পরিবেশনার দ্বান্দ্বিক মোহনা তৈরি হয়েছে। সম্ভবত এমন শর্ত উৎপন্ন হলেই আখ্যানের সৌন্দর্য এবং সৌন্দর্যের রাজনীতি উদ্দিষ্ট জনপরিসরে নিজস্ব মূল্য অর্জন করে।
দ্বিতীয় দ্বন্দ্ব: উপন্যাস ও নাটলিপির যোগ-বিয়োগ
এটা আমাদের সবারই জানা ডায়ালেকটিক্স একটি বিরোধকেই কেবল প্রস্তাব করে না। পরস্পর বিরোধী বস্তুনিচয়ের মধ্যে একটা সম্পর্কসূত্রও নিহিত থাকে- ওটাই সংশ্লেষণের মর্মবস্তু, [প্র]গতির সবচে পটেনশিয়াল সূত্র। ঠিক এ ব্যাপারটিই লক্ষ্য করা যাবে ‘ক্রাচের কর্নেল’-এও। শাহাদুজ্জামানের উপন্যাসের সাথে সৌম্য সরকার ও সামিনা লুৎফা নিত্রার নাট্যরূপ- এই প্রযোজনার প্রথম দ্বান্দ্বিক ক্ষেত্রটি নির্মাণ করেছে। এ তো জানা কথা, উপন্যাস একটি বর্ণনাত্মক শিল্পরূপ। একেই আবার বর্ণনামূলক নাট্যপরিবেশনার আধেয় করবার ক্ষেত্রে সুবিধা গ্রহণ না করে, দুই নাট্যকার উপন্যাসকে বরং মোকাবিলা করেছেন। উপন্যাস থেকে সংলাপ ছেঁকে নেন নি শুধু, এমনকি সর্বাংশে উপন্যাসের মধ্যে নির্যাসরূপে থাকা এর ক্রিয়াত্মক ঘটনাবলীর খোঁজাখুঁজিতেই সর্বস্ব ন্যস্ত করে আমাদের দুই নাট্যকার নিজেদের খুঁইয়ে ফেলেন নি। বরং সৌম্য ও সামিনা, আমার যতটা মনে পড়ছে, উপন্যাস ও নাটলিপি (যেহেতু বাংলাদেশে উপনিবেশোত্তর সাংস্কৃতিক আয়তনের বর্ণনামূলক নাট্যধারার ডিসকোর্সের একটি সতেজ উপাদান এই প্রযোজনা, তাই অ্যারিস্টটলীয় ধারণামাফিক ‘নাটক’ বলতে গিয়েও না বলে এড়িয়ে গেলাম)- এই দুয়ের আঙ্গিকগত যে মিল এই প্রযোজনায় সহজেই পরিপাক হতে পারতো, সে সংশ্লেষণের নীতিমালা তাঁরা দ’ুজন সজ্ঞানে বর্জন করেছেন। বর্জনের কারণ, অনুমান করি, দুটো। প্রথমত, নান্দনিক কারণে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কারণে- নান্দনিকতা যে রাজনীতির জন্ম দেয় সেই রাজনৈতিক কারণকে আত্মস্থ করার নান্দনিক প্রয়োজনে। একটি শিল্পভাষাকে আরেকটি শিল্পভাষায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে একটি সংক্রান্তি থাকে, ফাটল ও সন্ধির সময়ের এ যাত্রাটুকু অনায়াস সহজ ও রূপান্তরিতব্য শিল্পভাষার জৈবিক উপাদানে পরিণত করতে যে হয়, এই দায় ও সংরাগ দুজন ভুলে যান নি বলেই উপন্যাসের সাথে নাট্যের মোকাবিলা ঘটেছে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার সামরিক বাহিনীর আদর্শকে নাকচকারী কর্নেল তাহেরের জীবনকে এই নাটক আশ্রয় করেছে বলে, উপন্যাসকে নাট্যরূপ দিতে কনসেপচুয়াল ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে নেবার প্রয়োজনে বুর্জোয়া নাট্যতত্ত্বের বিপরীত অক্ষ থেকে রসদ জোগাড় করতে হয়েছে। অর্থাৎ ভাবাবেগ নয়, বরং ভাবাদর্শিক প্রতিশ্রুতি ও স্বতঃস্ফূর্ততার রসায়নে নাট্যকারদের খুঁজতে হয়েছে একটি যুক্তির ভাষা। তর্ক ও বাহাসের পাটাতন তৈরি করবার তাগিদ এই নাট্যরূপে জীবিত রূপে ধরা যায়। এর ফলে নিদের্শক মোহাম্মদ আলী হায়দার এবং কাজী রোকসানা রুমা, সামিনা লুৎফা নিত্রা ও অন্যান্য সকল অভিনেতা এই প্রযোজনার বিভিন্ন তলে যুক্তি-প্রতিযুক্তির জাল বুনে পুরো প্রযোজনাটিকে দর্শকের চৈতন্যে রাজনৈতিক সাড়া তুলবার কাজে সংলিপ্ত হতে পেরেছেন।
দ্বিতীয় কৈফিয়ত
এই প্রস্তাবের সূত্রে আমি একের পর এক কিছু সিদ্ধান্ত হাজির করতে চাইব। অন্য অবসরে বা কেউ ব্যাখ্যা দাবি করলে সেটা দেওয়া যাবে বৈকি। আর আমি কমপক্ষে এই মুহূর্তে মনে করছি, একটি নাট্য পরিবেশনার কোনো ব্যাখ্যা সম্ভবে না। নিরেট ইন্টারপ্রিটেশনের এগেইনস্টে গিয়ে আমি বটতলা’র কর্নেল সাব নিয়ে কথা বলছি। এই সব কথায় যদি কেউ ব্যাখ্যা খুঁজে পান তবে তা বড়জোড় সেন্সরিয়াল ইন্টারপ্রিটেশন বা ইন্দ্রিয়জ অনুভবের বিস্তারমাত্র।
প্রথম সিদ্ধান্ত: বাঙালি জাতীয়তাবাদের একরৈখিকতা বনাম শ্রেণীর অমীমাংসিত প্রশ্ন
কর্নেল তাহেরের জীবনেতিহাস পরিবেশনার মাধ্যমে ‘বটতলা’ বাঙালিত্বের ভিত্তিতে গঠিত অধিপতিশীল জাতীয়তাবাদের ফাঁদে নিপতিত এক বাংলাদেশ উন্মোচন করেছে। কর্নেল তাহেরের জীবনকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে ‘বটতলা’ সামরিক ব্যবস্থাকে নমুনা হিসেবে নিয়ে দেখিয়েছে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অব্যবহিত পরিগঠনে শ্রেণীর প্রশ্নটি অমীমাংসিত থাকার ফলে অসমতা আর অন্যায় কীভাবে রাষ্ট্র শাসনের নিয়ামক হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত: জাতীয়তাবাদের একরৈখিকতা বনাম শ্রেণীর অমীমাংসিত প্রশ্নজনিত সংকট থেকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান
সেকুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের একরৈখিকতা বনাম শ্রেণীর অমীমাংসিত প্রশ্ন, মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নানে অর্জিত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যে সংকট ঘনিয়ে তুলেছিল, সেই সংকটকে সেকুলার জাতীয়তাবাদের মুখোশ পরে থাকা ধর্মভিত্তিক শক্তি মওকা পেয়ে পরিণত করেছে শূন্যস্থানে। এই শূন্যতায় উত্থান ঘটেছে ইসলাম ধর্মভিত্তিক বাংলাদেশি জাতীয়বাদের বা বলা যায় পুনরুত্থান ঘটেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নির্মূল হওয়া পাকিস্তানি ভাবাদর্শের।
তৃতীয় সিদ্ধান্ত: ব্যক্তিগত ও কল্পনাসাধ্য এই দুই শরীরের দ্বান্দ্বিক রূপায়ণের প্রক্রিয়া কাহিনিকেন্দ্রিকতার দ্বান্দ্বিক রূপায়ণে সংকুচিত হয়েছে
বর্ণনাত্মক অভিনয়ে অভিনেতা এবং চরিত্রের সহাবস্থান ও সংঘর্ষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ভাষিক কনটেন্টের তলে চাপা পড়েছে। ইতিহাসের ভাষ্য নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার ভাবাদর্শিক চাপ অনুভবের কারণে ইতিহাসকে শরীরায়িত করা এবং এই শরীরায়নে, ক্ষেত্রবিশেষে, একই সঙ্গে উত্তম পুরুষের (ব্যাকরণগতভাবে অশুদ্ধ হলেও পলিটিক্যালি কারেকট থাকার জন্য কেউ ব্যক্তিও বলতে পারেন) শরীর এবং তৃতীয় পুরুষের শরীরের পৃথক পৃথক প্রকাশ যে অন্যতর চিহ্ন বহন করার মাধ্যমে ভাষিক টেক্সটের সাথে শারীরিক টেক্সটের বিরোধ ঘনিয়ে তোলা যেতে পারতো, তা অনুভব করা যায়। আর এতে ব্যক্তিগত শরীরের সাথে কাল্পনিক চরিত্রের শরীরের সহাবস্থান এবং মুহূর্তের মধ্যে কল্পনায় নির্মাণাধীন শরীরে প্রবেশের মাধ্যমে কাহিনির বয়নকে বাঁকা করে দিয়ে দর্শকের মগ্নচৈতন্যে আরো বিশেষ করে শিস বাজিয়ে দেয়া যেতে পারতো। এতে নাট্যিক কনটেক্সটি আরো সংহত হয়ে ইতিহাসের কনটেক্সটের সাথে মিলে-অমিলে লিপ্ত হতে পারতো।
চতুর্থ সিদ্ধান্ত: আত্মচিন্তার মাধ্যমে পরিবেশনা ও ইতিহাসের দোলনা স্থাপন
‘ক্রাচের কর্নেল’ একটি সেল্ফ রিফ্লেক্সিব প্রযোজনা। কাহিনির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহকে অভিনেতারা প্রশ্নবিদ্ধ করে সামনে আনেন নাট্য নির্মাণপ্রক্রিয়ার নিহিত দোলাচল এবং ইতিহাসের প্রক্রিয়াও যে একরৈখিক নয় সেই প্রস্তাবকে। এর ফলে আমরা অনুভব করি ইতিহাসের সত্য আস্ত বা শুদ্ধ কিছু নয়। বরং ইতিহাস ব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে দোলনা চালে চলে এবং অভিনেতারাও একটি পরিবেশনা নির্মাণের মাধ্যমে একটি আত্মদ্বন্দ্বেই সংলিপ্ত থাকে। অবশেষে তারা একটি নাট্যপ্রবাহে সিঞ্চিত করেন নিজেদের। এভাবে যেন একটি রূপক হয়ে ওঠে এ প্রযোজনা। থিয়েটারের নির্মাণপ্রক্রিয়ায় শিল্পীরা যেমন একটি বিচারিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করেন, সেই সূত্রে প্রযোজনাটিও দর্শককে ইতিহাস গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ওই একই বিচারিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে সঞ্জীবিত করে। আর তাহেরের মৃত্যুদণ্ড আয়োজনের জন্য বিচার নামক প্রহসনকে ব্যঙ্গ করতে সক্ষম এমন একটি রূপকায়ণ এই প্রযোজনার মর্মমূলকে আরো গভীরে প্রোথিত করেছে।
পঞ্চম সিদ্ধান্ত: বুর্জোয়া থিয়েটারের মায়াবাদী ফাঁদ
আলোকসজ্জার অন্ধকারে দর্শক থাকার ফলে, সংগীত ও বিষয়ের নৈমিত্তিক মিতালীর কারণে, মায়াবাদী (ইলিউশনিস্ট) নাট্য প্রযোজনার এই সব বৈশিষ্ট্যের অনুপ্রবেশের কারণে, ‘ক্রাচের কর্নেল’ কি বুর্জোয়া নাট্য-নন্দনতত্ত্বের খানিক ফাঁদে পড়ে যায় নি? অথচ প্রযোজনাটি বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরোধিতার এক ‘নায়কোচিত’ আখ্যানকেই পরিবেশন করে। মুক্তিযুদ্ধের ‘নায়কোচিত’ লিবারাল বয়ানের মোকাবিলা হিসেবে ‘বটতলা’ জনগণের অধিনায়কোচিত কাউন্টার বয়ান নির্মাণ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আরেকটি ‘নায়কোচিত’ বয়ানেই আটক করেছেন নিজেদের। বার্টল্ট ব্রেখটের থিসিস যদি তারা মান্য করেন তবে ইতিহাসের পুনর্ব্যাখ্যা উৎপাদন করতে গিয়ে এই ব্রেখটীয় টিপ্পনীটি কপালের তিলক হতে পারে: দুর্ভাগা নয় সেই দেশ [বা নাট্যদল] যার নায়ক নেই। বরং দুর্ভাগা সেই দেশ [বা নাট্যদল] যার নায়কের প্রয়োজন আছে। জনগণের শূন্যস্থান একা নায়কের পক্ষে পূরণ করা কি সম্ভব?
ষষ্ঠ সিদ্ধান্ত: আবেগের বা তীব্র অনুরাগের রাজনীতির ভিতরে হারানো নায়কের প্রতœ-প্রতিমা নির্মাণ করেছে ‘বটতলা’
তথাপি, ‘দুর্ভাগা বাংলাদেশে’ ‘বটতলা’ তাদের প্রতিস্পর্ধী প্রযোজনা ‘ক্রাচের কর্নেল’-এর শেষ দৃশ্যে কর্নেল তাহেরের ওপরে আলোকসম্পাত করে, মঞ্চের প্রায় মধ্যভাগে সেই চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতাকে কম্পোজ করে, আবেগদীপ্ত সংগীত যোজনায় ফাঁসির আদেশে নিঃসংকোচ তাহেরের বীরগাথাকে আরো তীব্র করে নায়কোচিত আখ্যানের সমাপ্তি টেনে ‘আদর্শ রাষ্ট্র’ নয়, বরং ধুলিধূসর বাস্তবের এক প্রত্নপ্রতিমাতুল্য নায়ক সম্পর্কে আমাদের মনে করুণা জাগিয়ে তোলে, স্মৃতি সঞ্চারিত করে এবং তাঁকে খুঁজে পেতে আন্দোলিত করে। এই নায়কের মর্মার্থ আরো কিছু নয়, কেবল নিপীড়িতের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় তার মুখে পড়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সূর্যরশ্মির আলোকছটা। মুক্তিযুদ্ধের এক নিখোঁজ আদর্শ সমাজতন্ত্রের খোঁজ করে এই প্রযোজনাটি প্রতাপশালী ডিসকোর্সকে প্রায় একা নাজুক করে তুলেছে। যেখানে ক্ষমতা থাকে সেখানে যেমন প্রতিরোধও থাকে, ঠিক তেমনি শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যের রন্ধ্রেও থাকে দুর্বলতা ও প্রথা- ‘ক্রাচের কর্নেল’ও এর থেকে দূরে নয়।
তবুও এই মুহ্যমান সময়ে তাকেই অভিবাদন।
শাহমান মৈশান: নাট্যকার, নির্দেশক ও প্রাবন্ধিক। সহকারী অধ্যাপক, থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।