Full premium theme for CMS
মাজেদ রানা: জন্ম যদিও উত্তরবঙ্গে তুমি নট বাংলার
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
সব সময়ই মনে হতো তিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। কিন্তু হিসাব করে দেখছি তিনি আমার সমানই, ৬৮ পেরিয়ে ৬৯ এ পা দিয়েছেন। কিন্তু আরেক হিসাবে শান্ত, স্থিতধী, কল্পনায় ডুবে থাকা স্বল্পভাষী মানুষটি সত্যিই আমাদের চেয়ে বড়। অভিনয় দিয়ে তিনি উত্তরবঙ্গ থেকে সারা দেশে একটা ঝড় তুলেছিলেন। চলচ্চিত্র, টেলিভিশনের মায়ামৃগতে কখনো আকৃষ্ট হননি। মাটি আঁকড়ে পড়ে থেকেছেন দিনাজপুরে। ছোটখাটো একটা চাকরি করে ছুটে যেতেন ‘নবরূপী’র মহড়ায় বা আড্ডায়।
হঠাৎ জানতে পারি তিনি স্ট্রোক করেছেন। দিনাজপুরে যাচ্ছিলাম নাটকের কাজেই। সেখানে গিয়ে ছুটে গেলাম তাঁর বাড়িতে। বাকহারা তিনি তখন। চোখে অশ্রুধারা, ভীষণ ব্যাকুলতা নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে। ক’দিন আগেই চমৎকার বাকভঙ্গি নিয়ে যে দাপটে তিনি অভিনয় করতেন, তিনি যখন বাকহারা হন তাঁর বেদনা যে কেউ অনুমান করতে পারবেন।
ষাটের দশকের একজন মঞ্চাভিনেতা আনিস ভাইকে দেখেছি, বহুদিন তিনি এই কষ্ট নিয়ে জীবন যাপন করেছেন। এ এক প্রকৃতির অকারণ কষ্টকর নির্যাতন। যিনি অভিনয় করতেন ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’ নাটকে, চমৎকার বুলন্দ আওয়াজ তাঁর কণ্ঠে, সেই সাথে আছে বাচনভঙ্গি। দিনাজপুরের লোকদের উচ্চারণ ভঙ্গি অনেকটা প্রমিত। বিশাল মাপের এই অভিনেতা বহু বছর ধরে কাঁপিয়েছেন দিনাজপুরের নাট্য সমিতির মঞ্চ, যেখানে অবিভক্ত ভারতের খ্যাতিমান অভিনেতারা এসেছেন। কী সব অসাধারণ নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন! ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’, ‘ক্যাপ্টেন হুররা’, ‘রক্তকরবী’, ‘টিপু সুলতান’, ‘ইডিপাস’সহ অনেক নাটক। কখনো নিজেকে জড়াননি সুবিধাবাদে, রাজনীতিতে বা থিয়েটারের জন্যে যেটুকু রাজনীতি তাতেও না। দিনাজপুরের নাট্যকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন স্যার, স্যারের সামনে সবাই শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে মাথা নুয়ে থাকতো। সফল সার্থক সব নাটক। পরিচালক এবং অভিনেতা হিসেবে পদক পেয়েছেন, সম্মাননাও পেয়েছেন অনেক।
অদ্ভুত আমাদের নাট্য সংস্কৃতি। অন্যদেশে এরকম হয় না। ঢাকায় না থাকলেই তিনি অপাঙক্তেয়। যত বড় পরিচালক, নাট্যকার আর অভিনেতা, আবৃত্তিকার, চারুশিল্পী বা সঙ্গীত শিল্পী হন না কেনো, তিনি থাকেন কোথায় এটাই বড় কথা! নিজের শহরের মহত্তম শিল্পীটির কদর করেন না কিন্তু ঢাকার সাধারণ বা মাঝারি মেধার শিল্পীকে নিয়ে মেতে ওঠেন। এই প্রবণতাই আমাদের নাট্য সংস্কৃতির একটা বড় সমস্যা। সীমান্তের ওপারেই বালুর ঘাটের অথবা মণিপুরের একজন নাট্যকার বা পরিচালক হয়ে ওঠেন ভারতের জাতীয় পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব, এখানে তা যেনো অসম্ভব। অথচ আমরা প্রায় সবাই এসেছি গ্রাম অথবা ঢাকার বাইরের ছোট শহর থেকে।
সারাজীবন মঞ্চ কাঁপিয়ে শেষ বয়সে এসে সময় পার করলেন রোগ ভোগে, অভিনয়ের নিষ্ক্রীয়তায়। সবাইকে ছেড়ে হয়তো অভিমান নিয়েই ১৬ জুলাই, ২০১৬ তারিখে না ফেরার দেশে চলে গেলেন মাজেদ রানা। তবুও বাংলার নাট্য সংস্কৃতিতে তিনি এক কিংবদন্তী।
টিনের তলোয়ার নিয়ে আমরা যারা লড়াই করি তাদের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি জানাই প্রণতি।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব