Full premium theme for CMS
গ্রন্থ সমালোচনা- ‘বাংলাদেশের নাগরিক থিয়েটার : অনেকান্ত অবলোকন'
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
‘বাংলাদেশের নাগরিক থিয়েটার : অনেকান্ত অবলোকন’- নাগরিক থিয়েটারের যন্ত্রণাভাষ্য
শহরের বিদগ্ধ এবং দগ্ধ নাগরিকেরা এখন ইন্টারনেটের দাস। তথ্য বিপ্লবের উল্লাসে সব খাবি-খাচ্ছে। মহাজগতের তাবৎ জ্ঞান তৃষ্ণা মেটাতে আর গ্রন্থাগার থেকে গ্রন্থাগারে ছুটতে হয় না। আঙুলের স্পর্শই যথেষ্ট। সব তথ্যই আমাদের নখদর্পণে। অথচ অগণিত, অপ্রয়োজনীয় এবং অপ্রাসঙ্গিক তথ্যের ভিড়ে চাপা পড়ে যাচ্ছে নিবিড় অবলোকন। বিপ্লব বালা দুই দশক ধরে বাংলাদেশের নাগরিক থিয়েটারের কর্মকা- সচেতনভাবে অবলোকন করেছেন। তাঁর এই পর্যবেক্ষণের ছাপ রেখেছেন দেশ-বিদেশের নানান পত্রপত্রিকায়।
সেখান থেকে নিজেরই বাছাইকৃত সতেরোটি পর্যবেক্ষণ নেয়া হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। গ্রন্থ শিরোনাম ‘বাংলাদেশের নাগরিক থিয়েটার : অনেকান্ত অবলোকন’। মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালের থিয়েটারচর্চার শুরু থেকে ২০০৫ সাল (বইয়ে ছাপানো শেষ লেখাটি ২০০৫ সালের) পর্যন্ত আলোচিত হয়েছে এখানে। ঢাকার বিভিন্ন নাটকের দলের গড়ে ওঠা থেকে তাদের ঘোষিত আদর্শ, রাজনৈতিক অবস্থান, নান্দনিকতার চর্চা, নাটকের প্রকৃতি, সাম্প্রতিক প্রবণতা, আদর্শচ্যুতি এসব ধরা পড়েছে এই পর্যবেক্ষকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। বিপ্লব বালা নাট্যসমালোচক, নাট্যনির্দেশক, নাট্যকার। তাঁর প্রতিভার অন্যতম দিক তিনি একজন নাট্যপ্রশিক্ষক। থিয়েটারের মানুষরা সুন্দর করে কথা বলতে পারেন। কিন্তু গুছিয়ে লিখেন খুব কমই। বিপ্লব বালা সেই কাজটি করে আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়ে রইলেন।
বইয়ের সমস্ত লেখাই থিয়েটারকে ঘিরে। এখানে নাটক বিষয়ে সমালোচনা রয়েছে কিন্তু সেই অর্থে কোনো নির্দিষ্ট নাটকের সমালোচনা নেই। সমস্ত পর্যবেক্ষণই থিয়েটারের ইতিহাস-রাজনীতি, শিল্পনন্দন-গতিপথ, হিসাব-নিকাশ সংক্রান্ত।
প্রথম তিনটি পর্যবেক্ষণে নাগরিক থিয়েটারের বেড়ে উঠা, রাজনীতি এবং শিল্পনন্দন তুলে ধরেছেন। তারপর চলে যান আমাদের থিয়েটারের শিকড় সন্ধানে এবং মহাকাব্য প্রাণিত নাট্যে। তারপর দুইবাংলার থিয়েটারের বিনিময়, লেনদেন হয়ে সন্ধান করেন সাম্প্রতিক প্রবণতাসমূহ। এরপর আবার শূন্য থেকে শুরু করে ২৫ বছরের হিসাব-নিকাশ করে ৩০ বছরের নাট্যে মনসা প্রবেশের ছিদ্র সন্ধান করেন। শেষ করেছেন নাট্যজন আর দর্শকসাধারণের মিলনের কথা বলে।
প্রথম পর্যবেক্ষণ ‘বাংলাদেশের নাগরিক থিয়েটার’ যা গ্রন্থের শিরোনাম। ঢাকা কেন্দ্রিক নাগরিক বা শহুরে থিয়েটারের আদল বোঝাতে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়, আরণ্যক নাট্যদল, ঢাকা থিয়েটার, সৈয়দ জামিল আহমেদ, এস এম সোলায়মানসহ প্রমুখের কাজের বিষয়-রীতি-প্রকরণের বর্ণনা করেন তিনি। এই প্রসঙ্গে তুলে ধরেন তাদের প্রযোজনার নির্দেশক, নাট্যকার এবং দলের সদস্যদের নাম-ধাম পর্যন্ত। পর্যবেক্ষণগুলো একটা ধারাবাহিক কালক্রমে বিন্যস্ত করেছেন: থিয়েটার ও রাজনীতি, নাট্যকর্মে শিল্পনন্দন, দেশজরীতির শিকড়, শূন্য থেকে শুরু, ২৫ বছরের হিসাব-নিকাশ, ৩০ বছরের নাট্য বাসর ঘরে মনসা প্রবেশের ছিদ্র, গোকুলে বাড়িছে নট-গোপালের দল প্রভৃতি।
নাতিদীর্ঘ পর্যবেক্ষণগুলো এক বৈঠকেই পড়ে ফেলা সম্ভব। লেখাগুলো ‘থিয়েটারওয়ালা’, ‘ফ্রন্ট লাইন থিয়েটার’ এবং ‘অনুষ্টুপ’সহ অন্যান্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। লেখার শেষে সেই সব পত্রিকার নাম এবং তারিখের উল্লেখ থাকলে ভালো হতো। কেননা এই পর্যবেক্ষণ একটি নির্দিষ্ট সময়কালে সীমাবদ্ধ। যারা দর্শকাসনে বসেন আবার নির্দিষ্ট দূরত্বে পাঠকের ভূমিকা নেন অথবা শিক্ষানবিশ তারা পর্যবেক্ষণগুলো সময়ের ফ্রেমে মিলিয়ে দেখতে পারতেন। বিভিন্ন পত্রিকায় ভিন্ন সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত পর্যবেক্ষণগুলো এক মলাটে বন্দি হয়েছে। পাঠকের কাছে একই প্রসঙ্গ বা একই তথ্য ঘুরে ফিরে আসে। পর্যবেক্ষক নিজেই যখন সম্পাদক তখন দায়িত্ব নিয়ে এই পৌনঃপুনিকতা এড়াতে পারতেন।
লেখকের কাছে পাঠোত্তর প্রত্যাশা বেড়ে যায়। কেননা, যখন লক্ষ্য করি একটি শব্দের ব্যবহারেও তিনি সচেতন। উল্লেখ্য থিয়েটারওয়ালা পত্রিকায় ২০০৬ জানু-জুন সংখ্যায় ‘ঢাকা ঢাকা ডাক পাড়ি’ ছাপা হয়। পর্যবেক্ষণটি গ্রন্থে গ্রহণ করার সময় শেষ লাইনের আগের লাইনে দুইটি শব্দের পরিবর্তন করেন। আবার থিয়েটারওয়ালা পত্রিকার ২০০৪ জানু-জুন সংখ্যায় ‘গোকুলে বাড়িছে নট-গোপালের দল’ পর্যবেক্ষণের শেষ লাইনটি গ্রন্থে পাল্টে যায়। এরকম ছোট ছোট পরিবর্তন গ্রন্থকারের খুঁতখুঁতে এবং সচেতনতার প্রকাশ।
বিপ্লব বালা ১৯৫৫ সালে ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পর্যবেক্ষণগুলো কতটুকু তার নিজের দৃষ্টিতে দেখা আর কতটুকু উপলব্ধি বা বই ঘেটে করা তা বোঝার উপায় নেই। তিনি নাট্যকলায় অনার্স, এম এ, পিএইচডি করেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কলকাতার ‘নান্দীকার’ নাট্যদলের সাথে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে যুক্ত ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। সেই সব পরিচিতি আমরা ব্লার্বের লেখা থেকে জানতে পারি। পর্যবেক্ষণগুলোর পরতে পরতে হীরক খণ্ডের মতো তীক্ষ্ণ শ্লেষ, বিষণ্ন বিদ্রুপ ছড়িয়ে রয়েছে। বুঝতে পারি কোথায় ছিল সেই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির পাঠশালা। দু-একটা উদ্ধৃতি দেই: ‘আত্মসমর্পণই আজকের বিশ্ববাস্তবতা-ন্যায়নীতি-আদর্শ’, ‘কণামাত্র মনুষ্যত্বের বালাই থাকলে তো আর খাঁটি ক্রেতা কী বিক্রেতা হওয়া সম্ভব নয় ভোগ্যপণ্য বাজারের’ ইত্যাদি। মুক্তবাজার মিডিয়ার আগ্রাসনে অংশগ্রহণকারী বিপ্লবী নাট্যকারদের উদ্দেশ করে বলেন: কারোরই বাঁধছে না এই খেলা খেলায় কোঁদাকুঁদি করতে।
বইটি বানানে একেবারে নির্ভুল নয়। তথ্যের বিভ্রাটও রয়েছে। যেমন ৫৪ পৃষ্ঠার শেষের দিকে আছে ‘সড়ক’ (নাট্যদল) এর ‘ভাগের মা’ (নাটক)। ‘সড়ক’ নয় এটা হবে ‘সময়’ (নাট্যদল) এবং ‘ভাগের মা’ নয় হবে ‘ভাগের মানুষ’ (নাটক)। আবার ‘গ্রুপ থিয়েটার : ২৫ বছরের হিসাব নিকাশ’ অথবা অন্যত্রও ষাটের দশকের নাট্য ইতিহাসে আসকার ইবনে শাইখের ‘সুতরাং’ সংগঠনের উল্লেখ পাই না। একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই সংগঠন সক্রিয় ছিল। পরবর্তিকালের উল্লেখযোগ্য নাট্যকর্মীদের কেউ কেউ সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। রাজনৈতিক মতভেদ থাকবেই কিন্তু ইতিহাস ইতিহাসই।
গ্রন্থে মোট ১২৮ পৃষ্ঠা। দাম ২০০ টাকা। প্রকাশ : ২০১৫। বিশ্বসাহিত্য ভবন। শুরুতেই এক পৃষ্ঠা সৈয়দ শামসুল হকের ‘সবিনয় নিবেদন’। ভেতরের পৃষ্ঠার বাম মার্জিনে আরেকটু জায়গা ছেড়ে দিলে কয়েকটা পাতা হয়তো বাড়ত কিন্তু দৃষ্টিনন্দন হত।
থিয়েটারে যারা নেতা হয়েছেন, যারা নাট্যকার, নির্দেশকের স্বীকৃতি পেয়েছেন তাদের কথা আলাদা। কিন্তু এর বাইরে যারা সব হারানোর দলে, যারা অন্ধ বিশ্বাসে নেতৃত্বের মুখপানে তাকিয়ে থেকে সময় নষ্ট করে ফেলেছেন, সেই সব বনের মোষ তাড়ানো রাখালের দল এই বইপাঠে মুগ্ধ হবেন- নিজেকে আবিষ্কার করবেন। বুকে জমে থাকা ক্রোধ, না বলা কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন বিপ্লব বালা। যা নীরবে খেটে যাওয়া থিয়েটারকর্মীদের বোবা চিৎকার।
আগামীদিনের নাট্যকর্মী বা গবেষকের কাছে গ্রন্থটি ব্যবহার্য হয়ে উঠবে। এবং থিয়েটারকর্মীদের কাছে ভিন্নমূল্যে গৃহিত হবে।
বাংলাদেশের নাগরিক থিয়েটার : অনেকান্ত অবলোকন
লেখক: ড. বিপ্লব বালা
প্রকাশক: বিশ্বসাহিত্য ভবন
প্রকাশকাল: ২০১৫ খ্রী. । পৃষ্ঠা: ১২৮। মূল্য: ২০০ টাকা
অপু শহীদ: নাট্যকার, গল্পকার। সদস্য- এথিক।