Full premium theme for CMS
জপেন দা’র প্রত্যাবর্তন : শহীদ মিনার
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[জপেন দা’ উৎপল দত্তের লেখা ‘জপেন দা জপেন যা’ নামে এক রসিক আখ্যানের চরিত্র। জপেন দা’ শিল্প সাহিত্য থেকে রাজনীতি সব বিষয়েই এক নিষ্ঠুর সমালোচক। সেই চরিত্রটির আদলেই জপেন দা’-কে ফিরিয়ে আনা।- লেখক]
একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। এটা তাঁর স্বভাব। ভিড়ভাট্টা পছন্দ করেন না। ভিড়ের মধ্যে, লোকের মধ্যে নানান মানুষের নানান রকম আচরণের প্রতিক্রিয়ায় আমিও খেয়াল করতে পারি নি। কবির কফিনটি যখন শহীদ মিনার থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন খেয়াল করি দাঁড়িয়ে আছেন দূরে, জপেন দা’। জপেন দা’র সাথে অনেকদিন দেখা নেই। শুনেছিলাম তিনি ভারত গেছেন, বেঙ্গালুরু থেকে যাবেন হিমাচল, তারপর কন্যাকুমারী ঘুরে আসবেন। আমার মতোই এক ভক্ত, যিনি বিত্তবানও বটে, তিনিই পুরো ব্যবস্থাটা স্পন্সর করেছেন।
লাশবাহী গাড়িটি এখন যাবে বাংলা একাডেমিতে। আমি কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে জপেন দা’র কাছে আসি। জপেন দা’ অকপট গাম্ভীর্য নিয়ে উদাস। আমি সামনে দাঁড়াতেই বলে উঠলেন:
- একটা সিগারেট দে।
আমি বেশ অবাকই হলাম। কারণ আমি জানি জপেন দা’র ফুসফুসের সংকটের পর আর তিনি সিগারেট ধরেন নি। ফিসফিসিয়ে বলে উঠি:
- সিগারেট!
ইতোমধ্যে হাতের বিশাল থাবায় আঙ্গুলগুলো কাঁপছে। বলে উঠলেন আবারো:
- সিগারেট।
আমি আর স্বাস্থ্য বিষয়ক তর্ক না জুড়ে ভ্রাম্যমাণ দোকানীর কাছ থেকে একটা সিগারেট ও ম্যাচ নিয়ে সামনে ধরি। আবারো হুকুম জারি:
- ধরিয়ে দে।
আমি ধরাতে গিয়ে কাশতে শুরু করি। দ্রুত ধরিয়েই জপেন দা’র হাতে তুলে দিই। জোরে একটা টান দিয়েই কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে উঠলেন:
- জীবন চলে গেলোরে!
ভাবলাম জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ছেন ‘জীবন চলিয়া গেছে বহু বহু বছরের পাড়’। কিন্তু জপেন দা’ মাথা নাড়লেন।
- না ঐ যে জীবন চলিয়া গেলো। আমাদের জীবন।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। কে গেলো ওখানে? জবাব দিই দ্রুত:
- ওতো রফিক আজাদ।
- হ্যাঁ, তোদের রফিক আজাদ কিন্তু আমার জীবন। ওর এক নাম ‘জীবন’। কী জীবন নিয়েই না এসেছিল! ওর আরেকটা নাম হলে ভালো হতো।
প্রশ্ন করি:
- কী সেটা?
- ‘আনন্দ’। এবার সিগারেট মাঝপথে। সূর্য মাথার উপরে।
আমি বলে উঠি:
- বাংলা একাডেমি যাবেন?
- নাহ!
- তাহলে চলুন ঐ গাছের নিচে গিয়ে বসি।
এতক্ষণে জপেন দা’-ও রোদে তাঁতিয়ে উঠেছেন। কোনো কথা না বলে আমার সাথে হাঁটতে শুরু করলেন। গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়ালেন। কিছু কবি তখনও এদিকে ওদিকে দাঁড়িয়ে। জপেন দা’কে কবিরা একটু এড়িয়েই চলেন। কখন কী কথা বলে ফেলেন, সেই ভয়ে। তাই কেউ কাছে এলো না। এবারে হঠাৎ যেন রফিক আজাদ ভর করলো জপেন দা’র উপর। ভাঙা গলায় অশুদ্ধ উচ্চারণে পড়তে শুরু করলেন:
স্পর্শকাতরতাময় এই নাম
উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে,
অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃতি মহিমা,
চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে
খুব শক্তিশালী
মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব।
চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ,
চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ- স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি;
চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।
চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি।
চুনিয়া গুলির শব্দে আঁতকে ওঠে কি?
প্রতিটি গাছের পাতা মনুষ্যপশুর হিংস্রতা দেখে কে না করে ওঠে?
চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে।
বৃক্ষদের সাহচর্যে চুনিয়াবাসীরা প্রকৃত প্রস্তাবে খুব
সুখে আছে।
চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্যসমাজের
কারু-কারু মনে,
কেউ-কেউ এখনো তা পোষে
বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া।
চুনিয়া শুশ্রুষা জানে,
চুনিয়া ব্যান্ডেজ বাঁধে, চুনিয়া সান্ত্বনা শুধু-
চুনিয়া কখনো জানি কারুকেই আঘাত করে না;
চুনিয়া সবুজ খুব, শান্তিপ্রিয়- শান্তি ভালোবাসে,
কাঠুরের প্রতি তাই স্পষ্টতই তীব্র ঘৃণা হানে।
চুনিয়া চিৎকার খুব অপছন্দ করে,
চুনিয়া গুলির শব্দ পছন্দ করে না।
রক্তপাত, সিংহাসন প্রভৃতি বিষয়ে
চুনিয়া ভীষণ অজ্ঞ;
চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত
মারণাস্ত্রগুলো
ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে।
চুনিয়া তো চায় মানুষেরা তিনভাগ জলে
রক্তমাখা হাত ধুয়ে তার দীক্ষা নিক।
চুনিয়া সর্বদা বলে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রগুলি
সুগন্ধি ফুলের চাষে ভ’রে তোলা হোক।
চুনিয়ারও অভিমান আছে,
শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে;
শিশুহত্যা, নারীহত্যা দেখে-দেখে সেও
মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে
চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনেপ্রাণে
নিশিদিন আশার পিদ্দিম জ্বেলে রাখে।
চুনিয়া বিশ্বাস করে:
শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে
পরস্পর সৎপ্রতিবেশী হবে।
জপেন দা’র স্মৃতিশক্তির প্রতি আবারো আমার শ্রদ্ধা জাগে।
এবারে একটু কাশলেন, তারপর বসে পড়েন মাটিতেই। সবে কচি দুর্বা গজিয়েছে। একটা দুর্বা ছিঁড়ে নিয়ে দাঁত দিয়ে কামড়ালেন, তারপর আবার কী যেন ভাবলেন। এ সময়গুলোতে সাধারণত জপেন দা’কে ঘাটাই না। সহসা কপালের দু’দিকের শিরাগুলি ফুলতে থাকে। তারপর একটা বিস্ফোরণের মতো বলতে থাকেন:
লিজিনস্কি-
আমার ডাকেই আমি নিয়ত জাগিয়ে তুলি আমার দেহ
ব্যালে-নৃত্যে, নিপুণ মুদ্রায়, নিরন্তর বেদনায়
জেগে থাকি নীলকন্ঠ- নিবেদিত- জেগে থাকি, একা-
শরীর জাগিয়ে রেখে নিজে জেগে থাকি, জেগে থাকি-
কে এই লিজিনস্কি? আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন জপেন দা’।
ঘাড় নাড়ি। অকপটে স্বীকার করি- জানি না।
- এক বিশ্ববিখ্যাত নর্তকী, থাকেন তিনি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। ‘জীবন’, মানে রফিক আজাদ, এইমাত্র যে মানুষের কাঁধে শুয়ে চলে গেলো বাংলা একাডেমিতে, সে শুধু জেনেছিল এই ব্যালে-নর্তকী তার অপরূপ নৃত্য ভঙ্গিমা দিয়ে জগৎ জয় করেছেন। ব্যস, হয়ে গেলো। কেমন করে অদ্ভুত ধরনের দাঁড়ি, কমা, হাইফেন দিয়ে কবিতায় একটা নৃত্য ভঙ্গিমা নিয়ে এলো। পারে, রফিক আজাদ পারে। ওর পারার ইতিহাস ওর প্রতিটি কবিতায়- বলে একটু থামেন জপেন দা’।
এবার আমি একটু শব্দ করে উঠি।
- জপেন দা’, ঐযে ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতাটি নিয়ে কী যেন হলো?
- ওটা কি আসলেই একটা রাজনৈতিক কবিতা, কাউকে আঘাত করার জন্যে? নাকি মানুষের ক্ষুধার একটি বাহ্যিক রূপ? কবি নিজেই বলেছেন- সে সময় একটা সমস্যাতো হয়েই ছিল। তারপর উলঙ্গ দেহে বাসন্তীর গায়ে জাল- এসব ছবি ছাপা হয়েছিল। কবি তো অন্য গ্রহের প্রাণী নন। কোনো এক মুহূর্তে তিনি বিস্ফোরিত হতেই পারেন। তাই ঘটেছে।
- নিজনস্কি লিখছেন, আবার প্রেমের অসংখ্য কবিতাও লিখছেন, তারপর ‘ভাত দে...
‘হারামজাদা’ পর্যন্তও যেতে পারি নি, সিগারেটটা মাটির মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলে ওঠেন:
- অর্বাচীন কাকে বলে? তোকে আগে যে কবিতাটা শুনালাম ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ সেটা কী?
- সেটাওতো রোমান্টিক কবিতা।
- গাধা কোথাকার! ওটাতো আপাদমস্তক একটা রাজনৈতিক কবিতা। রফিক আজাদের এই যে কাব্যবৈচিত্র্য তার দিকে একবার তাকা। এরা ষাটের দশকের কবি। ষাটের দশকে পৃথিবীতে কতকিছু ঘটছে। জাঁ পল সার্ত তখন মধ্য গগণে, ফ্রান্সের কবিরা আমেকিান কবিরা... কী যেন নাম কবি’র, ঐ-যে মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরে এসে হাজির। ‘যশোর রোড’ যিনি লিখলেন- বল্ না, বল্ না।
আমার কাছে এতসব জানতে চাওয়াতে আমি বিব্রত অথচ আমার অসহায়ত্বে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন জপেন দা’। নিজেই আবার শান্ত হন। বিড়বিড় করতে থাকেন:
- মনে পড়বে, মনে পড়বে, একটু সময় দে।
হঠাৎ লাফিয়ে ওঠেন যেন:
- ও’ মনে পড়েছে।
আমেরিকা আবিষ্কারের মতোই বলে ওঠেন:
- এ্যালেন গিনসবার্গ।
তারপর বলতে থাকেন:
- র্যাবোঁ, ভার্লেন এসব কবিদের কবিতা পড়ে, কবিদের জেনে এবং সেই সাথে একদিকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু- পাবলো নেরুদা...
একটু দম নিয়ে বলেন:
- এইসব কবিদের ভাবনার সাথে মানিয়েও গেছে রফিক আজাদ। তোকে বুঝতে হবে- সে তখন কোথায়? সে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মন্থন করছে পৃথিবীর তাবৎ কাব্য। পরে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত কাগমারী কলেজের বাংলার প্রভাষক। ঐখানে চলছে সাহিত্যচর্চা আর টাঙ্গাইলের ‘আনন্দময়ী’ কেবিনে বসে আড্ডা।
- টাঙ্গাইলে তো দেখতে পাচ্ছি অনেক কবি!
- এইতো সোনামানিক এতক্ষণে একটা কাজের কথা বলেছিস। অনেক কবি- ওটা একটা কবিতার মাটি। তারাপদ রায়, আশরাফ সিদ্দিকী, আবুল খায়ের (অল্প বয়সে মারা যায়), সাযযাদ কাদির, মাহবুব সাদিক- আরেক সুকান্ত কবি, বুলবুল খান মাহবুব থেকে শুরু করে আজকের মাহমুদ কামাল। বছরে একবার কবিতা উৎসব হয় এখনো। তবে রফিক আজাদ এসবের মধ্যে নেই। একাকী নিভৃতচারী মানুষ।
- শুনেছি মুক্তিযুদ্ধে...
- হ্যাঁ! ওর মতো লোক এসময় নিভৃতচারী থাকতে পারে? টগবগ করে জ্বলছে রক্ত, তাই যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়টা নষ্ট করতে পারে?
- আচ্ছা, পুরুষ নির্যাতন কমিটি...
- হ্যাঁ, সে উদ্যোগও নিয়েছিল সে। তবে উদ্যোগটি সময়োপযোগী হয় নি। এখন কিন্তু কিছু কিছু শোনা যাচ্ছে ওধরনের উদ্যোগ হচ্ছে। ভবিষ্যতে যে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাও এক ধরনের ভাবনা-বৈচিত্র্য। কবির ভাবনা-বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা করতে শেখ্! শুনলি না ওর কবি-স্ত্রী কী বললেন?- ‘একজন ঋষির সাথে জীবন যাপন করেছি’।
- শুনেছি তিনি বেপরোয়া জীবন যাপন করতেন?
- আশ্চর্য! তোর কথা শুনলে না বিবমিষা হয়। কবি বেপরোয়া হবে না কি কেরানী বেপরোয়া হবে? বেপরোয়া হওয়াই তো কবির স্বভাব- কবির সৌন্দর্য।
এবারে একটু থামলেন, ভ্রাম্যমাণ একজন পানদোকানীকে ডাকলেন, তিনটি পান একসাথে মুখে পুড়লেন আর নির্দেশ দিলেন:
- পয়সা দিয়ে দে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো পয়সা দিয়ে দিলাম। প্রশ্ন না আক্ষেপ জানি না, বিড়বিড় করে বললাম:
- ষাটের দশকের কবি, তাঁর কাব্যগ্রন্থ বেড়োলো স্বাধীনতার পরে, ১৯৭৪ এ?
- তুই তো দুঃখ করে বলছিলি ১৯৭২ সালের আগে তোর নাকি কোনো ছবি নেই, মানে কোনো ফটোগ্রাফ নেই। তোর জন্ম তো ১৯৪৮ এ? তোর একটা ছবিই নেই, আর ওর কাব্যগ্রন্থ নেই। এটা কোনো প্রশ্ন হল? ওর স্বভাবেই কোনো আত্মপ্রচার নেই। ভেবে দ্যাখ্- ও তো কত পত্রিকায় কাজ করেছে, দেখেছিস্ ওর কোনো সাক্ষাৎকার বা নিজের আত্মপ্রচার?
আমার কিছুই মনে পড়লো না।
রোদ বেড়ে উঠছে। কোথায় যাবো ঠিক নেই। হঠাৎ উঠে পড়লেন জপেন দা’- তারপর বললেন:
মানুষ জন্মায় কেন?
জেগে থাকে সে যে মৃত্যুরই প্রতীক্ষায়!
তা হলে এতো যে কর্ম, এতো আয়ুক্ষয়,
এতো যে ব্যস্ততা তার, জীবন সাজাতে
কেন ব্যগ্র আয়োজন, এতো দৌড় ঝাপ?
মৃত্যু এসে নিয়ে যাবে সব কৃতি তার!
জপেন দা'র জিজ্ঞাসা। আমি বোবা। একটা নিঃশব্দ মুহূর্ত। হঠাৎ মনে পড়ে, এতো রফিক আজাদের সেই কবিতা- ‘মৃত্যু ও মানুষ’।
বিষণ্ন সময়। এসময়ই একটি কোকিল ডেকে ওঠে।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব