Full premium theme for CMS
নতুন সহস্রাব্দে দেশজ নাটক
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[গত ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিট্যুট, বাংলাদেশ কেন্দ্র আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসব ও সেমিনার’। ‘শিকড়ের হোক ডানা’ স্লোগান নিয়ে উৎসবের সেমিনারে দু’দিনে মোট তিনটি বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। বিষয়গুলো ছিলো- ‘দেশজ নাটকের অস্তিত্বের সংকট’, ‘দেশজ নাটক: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’, এবং ‘নতুন সহস্রাব্দে দেশজ নাটক’। ‘নতুন সহস্রাব্দে দেশজ নাটক’ বিষয়ে জাহিদ রিপনের প্রবন্ধ ছাপা হলো থিয়েটারওয়ালা’র পাঠকদের জন্য]
নব্যকালের নাট্যগবেষকগণের সাম্প্রতিক গবেষণায় এ বিষয়টি অদ্য সুপ্রমাণিত যে, বাঙলার থিয়েটার চেতনা ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ভিনদেশী গেরাসিম লেবেদেফ (Gerasim Lebedefe, 1749-1817) কৃত আকস্মিক উদভাবনার ফসল নয়, বরং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের অনুরূপ আদিম সমাজ থেকে সহস্র বৎসরের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রায় বাঙলার নিজস্ব নাট্য বা ‘বাঙলা লোকনাট্য’ সৃজিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে লোকনাট্য ধরণীর অঞ্চলমাত্রেরই নাট্যধারাবাহিকতার একটি অবশ্যম্ভাবী স্তর এবং দীর্ঘ সময়ের প্রবাহমানতায়, সমাজ বিবর্তনের সমান্তরালে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের লোকনাট্যের পরিশীলনের মাধ্যমেই উক্ত অঞ্চলের আধুনিক নাট্যরীতি বিকশিত হয়, বা সুনির্দিষ্ট আঙ্গিকে মূর্ত হয় (উদাহরণ- গ্রীক, চিনা বা জাপানি নাট্য প্রভৃতি)। উল্লিখিত ক্ষেত্রে, সম্ভবত, একমাত্র ব্যতিক্রম বাঙলানাট্য বিষয়েই লক্ষণীয়। কেননা, আদিম সমাজ হতে উপর্যুক্ত ক্রমবিবর্তনের পান্থ বাঙলা লোকনাট্যের চূড়ান্ত বিকাশের গন্তব্যাভিমুখী সম্মুখ যাত্রাপথে অপ্রত্যাশিত মধ্যখণ্ডন ঘটেছে দেশ-কাল-প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সম্পর্করহিত পাশ্চাত্যের বিজাতীয় শিল্পরীতিরূপী উপপ্লব দ্বারা, খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্তে। সে হঠাৎ বজ্রশিখার ঝলকানিতে সাময়িক অন্ধত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন পাশ্চাত্যপ্রেমী বাঙালিগণ এবং তৎসঙ্গে বাঙলা লোকনাট্যও সম্মুখ অগ্রসরমানতার অবলম্বনবিহীনতায় পথিমধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
দীর্ঘদিনের পরাধীনতার শিকল ছিন্নান্তে বাঙালি বর্তমানে ভৌগলিকভাবে স্বাধীন। অদ্য তাই উপযুক্ত সময়, আত্মানুসন্ধান এবং নিজস্ব শিল্প-সম্পদের প্রতি সানুরাগ আগ্রহ ও অন্বয়ের মাধ্যমে মানসিক স্বাধীনতা অর্জনের। সম্মুখযাত্রার প্রয়াসী যে বাঙলা লোকনাট্য শুধুমাত্র বাঙালির ভ্রমঘটিত অবহেলায় পথিমধ্যে স্থবির হয়ে বিস্মৃতির নিভৃতকোণে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল, এখন কর্তব্য সে ‘দুয়োরানী’কে তার পর্ণকুটির হতে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাজপুরীতে স্থান প্রদান। কিন্তু লোকনাট্যসমূহ, বর্তমানকালে, আধুনিক দর্শক-শ্রোতাদের নাট্যরুচির সমান্তরালে সংস্থাপন করতে হলে এ আধুনিক সময়ের বিবেচনায় লোকনাট্যের উদ্ভূত পরিস্থিতিজনিত পশ্চাদাবস্থানও সগুরুত্বে বিবেচনা করা প্রয়োজন। তদনুযায়ী, লোকনাট্যের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ অক্ষুণ্ন রেখে তাকে আধুনিক রুচির সমমাত্রায় আনয়নের সম্ভাবনাসমূহ অর্থাৎ আধুনিককালের শিল্পভাবানায় ঐতিহ্যের নবরূপায়ণের নিমিত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষাকরণ আবশ্যক। একথা সর্বজনজ্ঞাত যে, কালগত প্রবাহমানতায় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিবর্তনের সমতালে শিল্পরুচিরও ক্রমপরিবর্তন একটি স্বাভাবিক সংঘটন। তাই প্রাচীন ও মধ্যযুগস্থিত বাঙালির শিল্পরুচির বিবেচনায় আধুনিককালের কম্পিউটার-স্যাটেলাইট-ইন্টারনেট আবর্তিত বাঙালির শিল্পরুচি নিঃসন্দেহে ভিন্নতর। সুতরাং ইতোপূর্বে অর্থাৎ প্রাচীন ও মধ্যযুগে উপস্থাপিত বাঙলা লোকনাট্যের অনুরূপ উপস্থাপনার অনুবর্তন বর্তমানকালের শিল্পতৃষ্ণা নিবৃত্তকরণে সক্ষম হবে না, এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান-দর্শক পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য নাট্যকীর্তিনিচয়ের প্রামাণ্যরূপের সঙ্গে পরিচিত- স্তানিস্লাভস্কি-ব্রেখট-গ্রোটওস্কি-পিটার ব্রুক-বাদল সরকার কিছুই তাঁর অজ্ঞাত নয়। সুতরাং সঙ্গত কারণেই, বাঙলা লোকনাট্যের আধুনিক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে উপস্থাপনাকে আধুনিককাল ও শিল্পরুচির সমান্তরালে হালনাগাদ (আপ টু ডেট) শিল্প-সমসাময়িক বা আধুনিকীকরণ আবশ্যক। এক্ষেত্রে, শিল্পযুক্তি ও প্রয়োজনানুযায়ী বহির্বিশ্বের যেকোনো নাট্যরীতির সাফল্যের অনুষঙ্গসমূহকে বাঙলা লোকনাট্যের সঙ্গে এর উপযোগী করে সংযুক্ত করার বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় স্থান প্রদান করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে, চলমান বা গতিশীল সংস্কৃতি নানা সংস্কৃতির নির্যাসকে আত্মীকরণের মাধ্যমেই তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে এবং বিপরীতে বিচ্ছিন্ন শিল্প বা সংস্কৃতি পরিণতির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়; উপরন্তু, লোকনাট্য পাশ্চাত্যনাট্যের ন্যায় অনড় শিল্প-শাসনের সীমায় গণ্ডিবদ্ধ নয় এবং প্রতি যুগেই তা নব নব মাত্রায় আত্মীকরণের মাধ্যমে জনরুচির সমান্তরালে অবস্থান গ্রহণের বিষয়ে শৈল্পিক-প্রতিবন্ধকতাহীন। তাই অনুরূপ ম্রক্ষণ বা গ্রহণ-বর্জন অযৌক্তিক হবে না। তবে এক্ষেত্রে অপরিহার্যভাবে স্মরণ রাখা উচিত যে, আধুনিককালের শিল্পীরীতিসমূহ থেকে বাঙলা লোকনাট্যের আধুনিকীকরণে সর্বোচ্চ সে মাত্রা অবধি গ্রহণ সঙ্গত হবে, যতটুকু গ্রহণে লোকনাট্যের ক্রমাগ্রসরমানতার প্রেরণা- নবগতি-সুবিকাশ অর্জন এবং তৎসঙ্গে তার স্বকীয়তাও পূর্ণমাত্রায় রক্ষিত হয়।
বর্তমানে আধুনিক জ্ঞান-বুদ্ধি সমন্বয়ে এ বিষয়টি উপলব্ধিকরণ সম্ভবপর হয়েছে যে, লোকনাট্যের মধ্যেই সুনিহিত থাকে আধুনিক নাট্যের বীজ। সুতরাং এ অর্বাচীনকালে, স্বকীয় নাট্যরীতি সন্ধানে অবশ্যম্ভাবীভাবে মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে অবজ্ঞাত লোকনাট্যের। ভ্রান্তিউদ্ভূত তুচ্ছ জ্ঞানে যাকে বর্জন করা হয়েছিল একদা, অদ্য সে বাঙলা লোকনাট্যকে সাদরে সন্নিকটে এনে আধুনিক জ্ঞান-বুদ্ধি বিবেচনা সহযোগে ও নিবিড় সংযোগের মাধ্যমে আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র বাঙালির তথা বাঙলার নিজস্ব নাট্যরীতি অর্থাৎ ‘বাঙলা নাট্যরীতি’র সন্ধান লাভ সম্ভব। আর পূর্বোক্ত কারণে বর্তমান সময়ে উল্লিখিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে লোকনাট্যের আধুনিক উপস্থাপনরীতি উদভাবন একান্তই জরুরি।
উল্লেখ প্রয়োজন, উপর্যুক্ত প্রয়াসের ক্ষেত্রের এখনো প্রত্যুষকাল মাত্র। তথাপি লোকনাট্যের আধুনিকীকরণের কতিপয় সুচেষ্টার মধ্য দিয়ে লোকনাট্যের সুবর্ণ-সম্ভাবনার যে ঝিলিক প্রত্যক্ষ করা গেছে তাতে সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাঙলা লোকনাট্যের আধুনিকীকরণকৃত রূপ তথা বাঙলার নিজস্ব নাট্যরীতি অর্থাৎ ‘বাঙলা নাট্যরীতি’ বিশ্বনাট্যধারার যেকোনো রীতির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা উত্তমরূপে ধারণ করে। সুতরাং বর্তমানে অত্যাবশ্যক, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নাট্যজন তথা সংস্কৃতিবান সকলের লোকনাট্য বিষয়ে সহৃদয় দৃষ্টিক্ষেপন ও ব্যবহারিক সংযুক্তি।
জাহিদ রিপন- নাট্যকর্মী।