Full premium theme for CMS
তাঁর মৃত্যু জানান দিলো, সে বেঁচেছিলো
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
একজন অভিমানী শিল্পী বিদায় নিলেন। যাবার সময় বলে যাননি, কেননা আগাম জানিয়ে চলে যাবার জন্য কেউ অভিমান করে না। অভিমান আর ক্ষোভ সমার্থক নয়। ক্ষোভে প্রতিশোধস্পৃহা জাগে, কিন্তু অভিমানে কেবল নিজেকে সরিয়ে নেবার প্রবণতা জেঁকে বসে। সেই জেঁকে বসা প্রবণতা নিয়ে বাংলাদেশের নিখাদ সব্যসাচী নাট্যজন এস. এম. সোলায়মান সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। অভিমান করে চলে গেলেন, যেন কেউ তাঁকে ধরতে না পারে, ছুঁতে না পারে। কিন্তু ‘বেচারা’ জানতেন না, অভিমান করে দেহটা নিয়ে পালানো যায় কিন্তু সৃজনশীলকর্ম নিয়ে পালানো যায় না। সৃজনশীলকর্ম জমা থাকে জীবিত প্রজন্মের একাউন্টে। জীবিত প্রজন্ম সেই একাউন্ট হয় সমৃদ্ধ করবে নতুবা ভেঙে ভেঙে মূলধন শেষ করবে।
যেহেতু আমাদের মঞ্চ এখনো প্রফেশনাল রূপ নেয়নি (নেয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না), তাই এই মঞ্চে একজন শিল্পীর সমৃদ্ধ হওয়ার পেছনে বড় বাধা কাজ করে সাংগঠনিক তৎপরতা। অর্থাৎ আমাদের মঞ্চে যেকোনো শিল্পী গায়ে-গতরে একজন সংগঠকও বটে। তার দুই সত্তা, এক: সৃজনশীল শিল্পীসত্তা, আর দুই: অশৈল্পীক সাংগঠনিক তথা দাপ্তরিকসত্তা। অ্যামেচার থিয়েটারে অ্যামেচারী নাট্যকর্মীদের ভীড় থাকে বেশি, যারা কম মাত্রায় ভাবুক আর বেশি মাত্রায় ‘নেতা’। যখন একজন শিল্পীকে এ সবকিছু সামলিয়ে চলতে হয়, তখন তার শিল্পীসত্তার ঘটে অধঃপতন, বেড়ে চলে বিরক্তিকর সাংগঠনিক দায়দায়িত্ব। সেই বিরক্তিকর সাংগঠনিক দায়দায়িত্ব পালনের এক পর্যায়ে অধিকতর কৌশলী সংগঠকদের তৎপরতায় কখনো কখনো শিল্পীর ত্যাগ করতে হয় নিজের হাতে গড়া সংগঠন। ফলস্বরূপ, শিল্পীকে তাঁর সৃজনশীল শিল্পীসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য গড়তে হয় নতুন সংগঠন। অর্থাৎ শিল্পীসত্তার বিকাশের জন্য প্রয়োজন সাংগঠনিকসত্তার বিকাশ, যা কিনা আবার শিল্পীসত্তা বিকাশের অন্তরায়! একারণেই দেখা যায়, আমাদের মঞ্চে একজন শিল্পী নিজের সৃজনশীলতার উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হন। ঠিক এমনি এক ঘোর-প্যাঁচের মধ্যে ‘সময় কাটিয়ে’ গেলেন এস. এম. সোলায়মান।
মনন ও মেধা ব্যতিরেকে শিল্পী হওয়া যায় না। কিন্তু এই মনন ও মেধার বিকাশের জন্য চাই ঊর্বর ক্ষেত্র। কোনো মেধাবী মানুষই প্রয়োজনীয় পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। এই পরিপ্রেক্ষিতকে বলে অবকাঠামো আর উপরিকাঠামো, যা শিল্পী নিজে তৈরি করে না, তৈরি করে রাষ্ট্র বা সমাজ। এ জন্যই অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী মানুষও উন্নত বিশ্বে বসবাসের সুযোগের ফলে নিজের সৃজনশীলতাকে যেভাবে প্রকাশ করতে পারে, তারচেয়ে ঢের বেশি মেধা নিয়েও অনুন্নত বিশ্বের মানুষ তা পারে না। এস. এম. সোলায়মানের মেধা ছিলো, কিন্তু মেধা বিকাশের মতো নাট্যদল ছিলো না। সে কারণেই নিজের হাতে গড়া ঢাকা পদাতিকে যে মানের নাটক তিনি সৃজন করেছেন আশির দশকে, পুরো নব্বইয়ের দশকে নতুন আনকোরা নাট্যদলে সেই মানের নাটক খুঁজে পাওয়া যায় না (ব্যতিক্রম কোর্ট মার্শাল, গোলাপজান)। তাঁর মেধাকে ধারণ করবার মতো নাট্যদল তিনি পাননি। পাননি বলেই, তাঁর সৃষ্ট নাটকগুলোই কেবল আমাদের বিবেচনায় আসছে, কিন্তু কত বড় মাপের নাটক তিনি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলেন সেগুলো বিবেচনায় আনতে আমরা অপারগ। তাঁর মেধার প্রকৃত স্ফূরণ আমাদের অদেখাই রয়ে গেলো। এই ক্ষতি এস. এম. সোলায়মানের নয়, এই ক্ষতি আমাদের মঞ্চনাটকের। তাঁর মৃত্যুতে, তাঁর নিজের না হয় মুক্তি হলো, কিন্তু মঞ্চনাটকের মুক্তি খুঁজি কোনখানে?
এস. এম. সোলায়মান নিঃসঙ্গ ছিলেন। এমন নিঃসঙ্গ আমরা প্রায় সবাই। যার যার কর্মক্ষেত্রে আমরা সবাই নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে যাচ্ছি। আমরা প্রত্যেকে একেকজন জীবনানন্দ দাশ! কোথাও কোনো ঐক্য নেই, বন্ধুত্বের হাত নেই। এস. এম সোলায়মানের নিঃসঙ্গতা নিজের সৃজনশীলতায়। প্রকৃত শিল্পীর সমালোচক তিনি নিজেই। সেই শিল্পী যখন নিজেকে অতিক্রম করতে ব্যর্থ হন, তখন নিজেকে বড় একা বোধ করেন, বড় নিঃসঙ্গ বোধ করেন। জীবনের শেষের দিকে শিল্পী এস. এম. সোলায়মান নিজেকে ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেটা তাঁর সৃজনশীলতার অভাবে নয়, সৃজনশীল হওয়ার প্রকৃত প্লাটফর্মের অভাবে। সেই প্লাটফর্ম আমরা তৈরি করে দিতে পারিনি। এ আামদের এক বড় গ্লানি।
আমাদের দেশের সবচেয়ে গ্লানিকর ব্যাপারটি হলো, এখানকার শিল্পীরা রাজনীতি বুঝতে চায় না আর রাজনীতিবিদরা শিল্প বুঝতে চায় না। কী অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা! সেদিক থেকে এস. এম. সোলায়মানের অবস্থান বড় পরিষ্কার। তিনি রাজনীতি বুঝতেন, মুক্তিযুদ্ধ বুঝতেন, স্বৈরাচার বুঝতেন, আর পরিষ্কারভাবে যেটা সবচেয়ে বেশি বুঝতেন সেটি হলো মৌলবাদের থাবা। এই বোঝাটার ফলে হয়েছে কী, কোনটি গ্রহণ করতে হবে আর কোনটি বর্জন করতে হবে তা তাঁর কাছে পরিষ্কার ছিলো। ভাসা ভাসা জ্ঞান দিয়ে আবছা আবছা চিত্র তিনি তাঁর নাটকে আঁকেননি। ফলে স্বাধীনতা বিরোধীদের লম্ফ জম্ফের কারণ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে তিনি বুঝেছিলেন, সেখানে প্রথিত আছে ধর্মান্ধতা। আর এই ধর্মান্ধতার প্রকৃত থাবা বুঝতে গিয়ে নিজেকে রেখেছেন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে। এটা আমার চাপিয়ে দেয়া নিজস্ব মতামত নয়, তাঁর সহযাত্রী যেকোনো ব্যক্তিই এটা স্বীকার করবেন। কিন্তু জীবিত এস. এম. সোলায়মানের উপর যে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান প্রভাব ফেলতে পারেনি, সেই প্রভাবটা চেপে বসলো মৃত এস. এম. সোলায়মানের উপর। ঠিক এমন কাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি আমরা কিছুদিন আগে, আহমদ ছফার মৃত্যুর পর (পণ্ডিত আহমদ শরীফ অবশ্য এধরনের কাণ্ড থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন)। মনে করা সঙ্গত হবে যে, মৃত মানুষের উপর এরূপ প্রভাব বিস্তার করার অর্থ দাঁড়ায়, জীবিত মানুষটির বিশ্বাস ও দর্শনকে হেয় করে দেখা।
হাসান শাহরিয়ার- সম্পাদক, থিয়েটারওয়ালা