Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

রাস্তার নাটক: নাটক করিয়েরা কি রাস্তায় যেতে চান?

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

এ নিয়ে কাউকে হা-হুতাশ করতে দেখিনি

রাস্তার নাটক, মানে ঢাকাই মধ্যবিত্ত (সেই অংশই যাদের ‘কালচার’ নিয়ে ভাবানা আছে, ভাবা লাগে) যাকে পথনাটক বলে জানতেন, ইদানিং আর তেমন হচ্ছে না। আগে হ’ত। আগে শুধু হ’ত না, এটার গুরুত্ব নিয়ে কিংবা হাতিয়ার হিসেবে এটা যে কত বড় তা নিয়ে অনেক বক্তৃতা-আলোচনাও হ’ত। আগে বলতে, সকলেই জানেন, তেমন আগে নয়। এরশাদ যখন মসনদে তখন পথনাটক ধুন্ধুমার চলছিলো। যদিও ইতিহাসের বইতে তেমন খোঁজখবর চোখে পড়েনি, তবুও এটা বলা বোধহয় খুব সমস্যাজনক নয় যে, বাস্তবিকভাবে এরশাদের শাসনামলেই এই নাগরিক নাট্যধারাটি একভাবে শুরু হয়েছিলো। অনেকগুলো পথনাটক তখন ঢাকায় হয়েছে। সেগুলোর অন্তর্গত বক্তব্য মূলত সামরিক অগণতান্ত্রিক স্বৈরব্যবস্থাকে সমালোচনা করে, তার সম্পর্কজালকে চিহ্নিত করে, এবং  সেটাকে প্রত্যাখান করে রুখে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে।

শুধু ঢাকায় নয়, এই ধারার নাটক ছোট শহরগুলোতে, মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ঢাকা থিয়েটারের সাহচর্যে গড়ে ওঠা গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন এবং আরণ্যক নাট্যদলের সাহচর্যে গড়ে ওঠা মুক্তনাটক আন্দোলন- দু’টোই এই ধারাকে রূপদান করার ক্ষেত্রে নিজেদের ভূমিকা ঠিক করতে পেরেছিলো। তাদের কাজে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়। এরশাদের বিরুদ্ধে যে বিরাট আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো সেখানেও পথনাটক অংশ নিয়েছিলো। ভেবে দেখলে মনে পড়ে, অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য কাজ সে সময়ে হয়েছিলো যেগুলো স্পষ্টতই এরশাদের শাসনকে কটাক্ষ করেই গড়ে উঠেছে। এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হবার পর পথনাটকের একটা নিশ্চুপ মৃত্যু আমাদের দেখতে হ’ল। এই নিশ্চুপ মৃত্যুকে দুইভাবে দেখা যেতে পারে। একটা হ’ল: যেহেতু দেশে, লোকজন বলে, গণতন্ত্র বলে একটা কিছু এসে গেছে, তাই আর কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা নেয়ার, কোনো সমালোচনামূলক অনুশীলনের প্রয়োজন নেই। পরেরটা হচ্ছে: যেহেতু রাস্তার নাটক করিয়েরা, বিশেষভাবে ঢাকার রাস্তার কথাই বলছি, মূলত চারকোনা বন্ধ-কাঠামোর প্রসেনিয়াম ঘরানা হতেই বেরিয়েছিলেন, এরশাদ আড়ালে (নিভৃতে) চলে যাবার পর তাঁরাও আর প্রকাশ্যে বেনাকাব নাঙ্গা থিয়েটার করতে চাইলেন না, বা প্রয়োজনীয় মনে করলেন না। দু’টো পরস্পর সম্পর্কিত বটে। চিন্তাশীল বেশ কিছু বান্ধব একটা বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছেন; এখন পথনাটক করিয়েরা আর ‘প্রসঙ্গ’ পাচ্ছে না। হ্যাঁ সেটাও হতে পারে। ‘হতে পারে’ গোছের একটা দ্বিধাগ্রস্ত স্বর এখানে শোনাচ্ছে ঠিকই, তবে সেটা এ কারণে নয় যে আমি নিশ্চিত নই রাস্তার সম্ভাব্য নাটক করিয়েদের প্রসঙ্গ বিভ্রাট নিয়ে। আমি বরং এ ব্যাপারে সত্যাসত্য বোধেই আটকে থাকতে চাইছি না।

(উল্লেখযোগ্যভাবে) রাস্তার নাটক না হবার ক্ষেত্রে উপরে উল্লেখ করা পর্যবেক্ষণ/ বিশ্লেষণগুলোকে কারণ হিসেবে ভাবলে যে ভুল হবে- সেটাই মনে করিয়ে দিতে চাইছি আমি। সেগুলো একই সঙ্গে অন্য কোনো কারণের ফলাফল/ প্রতিক্রিয়া এবং একটা প্রক্রিয়া। রাস্তার নাটকের বিষয়বস্তু না পাওয়া একটা ফলাফল। রাজনৈতিক ভূমিকা না নিতে চাওয়া একটা ফলাফল, আর চারকোনা মঞ্চেই শুধু কাজ করতে চাওয়াও একটা প্রতিক্রয়া, একটা ফলাফল। এ সকল ফলাফলের পেছনের কারণগুলোকে শনাক্ত করতে না পারলে কিংবা প্রক্রিয়াটাকে বুঝতে না পারলে আমরা একটা আন্ধা গলিতেই ঘুরঘুর করতে থাকব। এক্ষেত্রে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। রাস্তার নাটক না হবার আক্ষেপটা এত বড় হওয়া ঠিক হবে না যে নাটক করিয়েদের রাস্তাায় যেতে না চাইবার এবং রাস্তায় যাবার প্রয়োজন না পড়াটা বুঝতে গুলিয়ে ফেলতে হবে।

পরিসর (space) আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রূপান্তর: রাস্তার ইদানিংকার বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে

ঢাকার রাস্তাা ইদনিং বেশ চওড়া আর বর্ণাঢ্য। ঢাকার অধিকাংশ রাস্তাাতেই এখন চলাফেরা করলে বড় মেট্রোপলিটন নগরে চলবার যাবতীয় পুলক অর্জন করা সম্ভব। ভৌত দিক বিচারে শুধু রাস্তার মাপ আর চেহারাকে বিযুক্ত করা যাবে না রাস্তার পাশে হু হু করে বেড়ে ওঠা বিপণন কেন্দ্রগুলো হতে, কিংবা মধ্যবিত্ত দেহের আবাসস্থল হিসেবে গড়ে ওঠা বহুতল বাড়িগুলো হতে। কারণ এগুলোর প্রত্যক্ষ আছর রাস্তার উপর পড়েছে। রাস্তায় এখন বহুতল বাড়ি আর বিপণন কেন্দ্র (সুপার মার্কেট/শপিংমল) দীর্ঘ ছায়া ফেলে রাখে। সে ছায়া গভীর শীতে রাস্তাবাসী (সরকারী ভাষায় ছিন্নমূল কিংবা ভাসমান) মানুষজনের দিবাসূর্য পাবার ব্যবস্থাটুকুও আত্মসাৎ করেছে। তাছাড়া বড় এই ভবনসমূহের স্থাপত্য, সজ্জা, আর এর সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের থেকে রাস্তাবাসী মানুষজনের ফারাকের নাঙ্গা বাস্তবতাও এই মুহূর্তে রাস্তাকে বুঝবার জন্য জরুরি। এর মানে এই নয় যে, রাস্তার সাথে মানুষজনের সম্পর্ক নতুন একটা বিষয়। স্পষ্ট হওয়া দরকার, এটা হালে নতুন মাত্রা পেয়েছে মাত্র। এই নতুন মাত্রাকে পুঁজিবাদের নয়া ধরন-ধারণ অর্জনের সাথে সম্পর্কিত করে দেখতে হবে।

রাস্তার সৌন্দর্য নিয়ে মহানগরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী যার পর নেই চিন্তিতও বটে। ভালোভাবে হাত-পা মেলে রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে পারার মতো জায়গা থাকা এবং রাস্তায় চলতে নিরাপত্তাবোধের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে এই সৌন্দর্যবোধ। ফলে প্রায় নিয়মিতভাবেই রাস্তায় গজিয়ে ওঠা বিকল্পহীন নিম্নশ্রেণীর জীবিকা-উপায় দোকানপাটগুলো উচ্ছেদ করতে হয় পুলিশকে। দিনে দিনে রাস্তায় চলাফেরা করা হাড়-হাভাতে চেহারার মানুষজনকে ঢাকা হতে খেদাবার ব্যবস্থাও করতে হচ্ছে। সেটা কোনোভাবেই কম ঝামেলার নয়। এই ধরুন গে রিকশা। আপনি একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক মানুষ। আপনার দিব্যি মনে হচ্ছে ঢাকার যানজটের জন্য রিকশাই দায়ী (যদিও কিছুদিন আগেও আপনার তা মনে হয়নি। খুব কম বটে, তারপরেও যে ক’টা পাবলিক বাস সার্ভিস আছে- সেগুলোতে চড়ে বেড়ানো ‘ছোটলোক’দের সংস্পর্শ থেকে আপনার শরীর বাঁচানোর জন্য কেবল রিকশাই ছিলো যানবাহন। এখন স্কুটার, ট্যাক্সি, প্রিমিয়াম বাস আপনার দেহের চলাফেরার জায়গা দেয়। অর্থনীতির ভাষায় বললে: এ সকল সেবা পণ্যাকারে বিপণন হচ্ছে এবং তা উপযোগাকারে কিনবার সমর্থ গজিয়েছে আপনার। অথবা ঢাকাতে প্রতিদিন নতুন নতুন আসা প্রাইভেট কারের একটা এখন আপনার)। ফলে রিকশা ভাঙবার একটা উদ্যোগ নিতে হয়েছে কর্তৃপক্ষের। কিন্তু আপনার বা আমাদের কারোরই ভাবার সুযোগ মেলেনি এই রিকশাগুলো চালাবার জন্য এতগুলো লোক আসছে কোত্থেকে এবং কিভাবে।

এটা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না, প্রধানমন্ত্রী (বা এরকম কেউ) তাদেরকে মাঝে মধ্যেই উপদেশ দিচ্ছেন গ্রামেই থেকে যাবার। তাতে করে আমদের মনে হতে পারে এই লোকগুলো নিতান্ত ইচ্ছে করে আমাদের নাগরিক জ্বালা-যন্ত্রণা বাড়াবার জন্যই ঢাকা এসে ভিড় করছে। একদম শয়তানি! তারা অন্য কোনো পেশা বেছে নিলেই তো পারে! কিন্তু এটাও তো সত্যি রিকশা চালানো ঠিক স্বাধীনভাবে(?) বেছে নেবার পেশা নয়। অন্তত আপনি বা আমি গবেষণা, মাস্টারী, গায়কী, অভিনয়, সম্পাদনা, সাংবাদিকতা, বায়িং হাউজ, ডায়িং হাউজ ছেড়ে এই পেশা স্বেচ্ছায় নেবার কথা ভাবছি না। তো যা হোক, এভাবে রিকশা সরিয়ে, বস্তি উচ্ছেদ করে (নিন্দুকেরা বলে বস্তিতে আগুন ধরানোটাও নাকি এই কার্যক্রমের অংশ) এত কষ্টসাধ্য ব্রত পালনটা রাষ্ট্র এবং পুলিশ বাহিনী করছে আমাদের শহরটাকে সুন্দর সাফ-সুতরো রাখার জন্যই তো? আর আমরাও কত ঠোঁট চেপে ধরে, চোখ বুঁজে থেকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি ‘হ্যাঁ, অন্যায় আবার কী! উন্নয়ন হতে গেলে এরকম একটু আধটু হয়।’ আর মনে মনে নিজেদের জন্য ঢ্যাবসা ধরনের যুক্তি সাজিয়েছি: বহুতল চটকদার বাড়িগুলো এরাই বানায় বটে, তবে ওদের উচিত ছিলো কাজটা সেরেই (নিতান্ত শহরের সৌন্দর্যের স্বার্থে) আবার গ্রামে ফিরে যাওয়া। সেই গ্রামে, যে গ্রামে ওদের কোনো জমি নেই, আগেই গেছে। সেই গ্রামে, যে গ্রামে পানির দরে গতর-খাটানো কাজও এখন আর অবশিষ্ট নেই। সেই গ্রামে, যে গ্রামে মুরগীর আণ্ডা পাড়াবার জন্য কর্জ (ক্ষুদ্র ঋণ) নিতে চাইলেও স্থাবর কিছু থাকতে হয়।

একটা ব্যাপার এখানে পরিষ্কার করা দরকার। এটা ভাবা একেবারেই ঠিক হবে না, থিয়েটার প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা কইবার একটা জায়গা ও সুযোগ পেয়ে নাহক কথা তুলছি কিংবা প্রসঙ্গ উপস্থাপন করতে পারার সূত্র আমি আউলাইয়া ফেলেছি। বরং আমি বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দিই, রাস্তার গড়ন ঠিকমতো বুঝতে না পারলে আমরা রাস্তার নাটকের প্রাসঙ্গিকতা, অবলোপের প্রেক্ষাপট, ফের শুরু করার সম্ভাবনা, এই উদ্দিষ্ট দর্শক-চৈতন্যের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া- ইত্যাদি বুঝতে পারবো না। আর রাস্তাগুলো খুবই জটিল প্রকৃতির, যদ্দুর জানা যায় আগেও প্রায় তাই-ই ছিলো, এ কারণে যে এটা একটা বারোয়ারী/ এজমালি বস্তু। আর আমরা এমন একটা অবস্থানে নিজেদের উন্নীত(!) করেছি যে, বারোয়ারী জিনিসপত্র এবং বিনি পয়সার ব্যাপার-স্যাপার বিচ্ছিরি লাগে। শিল্প ব্যাপারটাকে সর্ববিযুক্ত হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে যার সাথে এই প্রক্রিয়াকে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে দেখতে হবে! ফলত, আমরা রাস্তাঘাট ছেড়ে প্রায় বলতে গেলে সর্বাত্মকভাবে প্রাইভেট স্পেসে গিয়ে উঠেছি। আমাদের দেহের জন্য একটা ভাল প্লাষ্টিকের (প্রায় ওইরকম তো দেখায়) বাসা-বাড়ি, আর মান-মর্যাদার জন্য একটা গদিঅলা আপিস। আর ‘ছোটলোক’দের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখবার জন্য আমাদের ব্যস্ততা তো আছেই।

ইঁদুর দৌঁড়টা কিন্তু আগেই টের পাওয়া গেছে

স্মৃতি হতে কিছু বিষয় টানতে চাই। ১৯৯০ সালের কোনো একটা সময়ে কৌতূহল বশে টেলিভিশনের নাটকে অভিনয় করবার জন্য আবেদন করে পাঠিয়েছিলাম। সকলেরই মনে পড়বার কথা তখন ব্যক্তিমালিকানাধীন স্যাটেলাইট টিভি গজায়নি। প্রায় ভুলতে বসেছি যখন, তখন ১৯৯১ সালে আবেদন পত্রের সাড়া এলো, মানে অডিশনের ডাক। সব ধাপ- টাপ ডিঙ্গিয়ে তৃতীয় শ্রেণীর অভিনেতা (‘সি’ গ্রেড) হিসেবে নথিযুক্ত হবার একটা সনদপত্রও পেলাম। এই সময়টাতে আমার পরিচিত অনেক মানুষই মাড় দেয়া পাঞ্জাবী পরে পাঠবিবর্জিত গলায় কবিতা পড়েন, অল্প কিছুকাল ওই কাতারে আমিও সামিল ছিলাম। অন্য কিছু পরিচিত মানুষ মঞ্চনাটক করেন, আমার নিজেরও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দুর্বল ধরনের অংশগ্রহণ ছিলো। এর আগে একই ধরনের দুর্বল অভিনয় সমেত এবং অনেক খাটাখাটিসহ গ্রাম থিয়েটারে কাজ করেছি কিছুদিন, মফস্বলে। মোটামুটি এ-ই। ‘সি’ গ্রেডের কাগজটা হাতে পেয়ে এটার দুর্লভতা মালুম হতে সময় লাগেনি। খানিকটা উত্তেজনা বশে, খানিকটা টিভিতে চেহারা দেখানোর লোভে, খানিকটা নিজের ছাত্রজীবনে সামান্য কিছু আয় করতে পারার আগ্রহে টিভি ভবন পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। দৌঁড় তো ওই ভবনের দরজা পর্যন্তই। এর-তার কাছে বুদ্ধি নিয়ে জানলাম কিভাবে ভিতরে ঢুকব। ঢুকে এদিক সেদিক ঘুরছি। কোনো প্রযোজকের ঘরে গিয়ে কথা বলার ইচ্ছে আমার। এভাবে প্রথম যাঁর কাছে গিয়ে আমার অর্জন সম্পর্কে বললাম তিনি ভীষণ রকম অবাক হলেন আমার কথ শুনে। প্রথমে তিনি জিজ্ঞেস করলেন টেলিভিশনের ‘অমুক তমুক’ কে চিনি কিনা। আমি ‘না’ বলাতে, এরপর তিনি মঞ্চ ও টিভি পর্দার ‘অমুক তমুক’ এর কথা জানতে চাইলেন। এবারও আমি ‘না’ বলাতে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বসলেন এবং জানতে চাইলেন আমার তাহলে হ’ল কিভাবে। সব মিলে একটু ভ্যাবদা মেরে গিয়েছিলাম আমি। যা হোক, এবারে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন টিভি’র ‘অমুক-তমুক’ এর সাথে ভাল যোগাযোগ না ঘটলে আমার কাজ পাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আমার বিরাট একটা উপকার তিনি করেছিলেন। ওই চত্বরে আর ঘুরঘুর না করবার ব্যাপারে পষ্টাপষ্টি একটা সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলাম একদিনেই।

কিন্তু আসল প্রসঙ্গটা ওখানে নয়। বেশ কিছু পরিচিত মানুষজন আমার এই সিদ্ধান্ত নেয়াতে হতভম্ব হয়েছিলেন, সেটাই আসল কাহিনী। তাদের এই হতভম্ব হওয়াটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিলো আমার, আর বুঝতে পেরে রাজনৈতিক সংহতির প্রশ্নে এক নিঃঙ্গতার মুখোমুখি হয়েছিলাম তখন। চারপাশের অনেক শিল্প-সংস্কৃতি চর্চাকারী মানুষজন তখন হতভম্ব হয়েছিলেন এ কারণে যে টিভিতে কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিবেচিত। বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করছেন এমন বহু মানুষের চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা বা লক্ষ্য ছিলো এই মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হওয়া। সেই লক্ষ্য পূরণে তাঁদের কর্মকাণ্ডের পরিধি সম্পর্কে এই মুহূর্তে আলোচনা করাটা জরুরি নয়। কিন্তু এই প্রশ্নটা অবশ্যই জরুরি যে, এই অন্তর্ভুক্তির মানে কী কী দাঁড়ায়? অর্থাৎ টিভিতে ‘নিজ’কে প্রদর্শিত করতে পারলে অন্যদের কাছে পরিচিত হওয়া ছাড়া আর কী সুবিধা পাওয়া সম্ভব! প্রশ্নটার জরুরিত্ব আকাঙ্ক্ষা পোষণকারী মানুষজনের তৎপরতার মধ্য দিয়ে বোঝা দরকার। তাঁদের তৎপরতা স্পষ্টতই প্রচার মাধ্যমে মুরুব্বী-তাবেদার নেটওয়ার্ক তৈরিতে মদদ দিয়েছে। এই বাস্তবতা হচ্ছে তখনকার যখন সরকারী নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন ছিলো নিয়মিত প্রচারের একমাত্র দৃশ্যমাধ্যম। এতগুলো ব্যক্তি-মালিকানাধীন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল চালু হবার পর নেটওয়ার্কটার শক্তিমত্তা বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং আরও শক্তিশালীভাব আরও ভিন্ন পরিসরে আকাঙ্ক্ষা আর আকাঙ্ক্ষাজনিত নেটওয়ার্ক বিস্মৃত হয়েছে। এখন, এভাবে, আমরা যদি ঐ আকাঙ্ক্ষা/বাসনা এবং তার নেটওয়ার্ককে বিশ্লেষণ করতে পারি তাহলে প্রশ্নটার জবাব পাওয়া যাবে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশ, বিশেষভাবে মহানগরের কথা হচ্ছে, মিডিয়ায় প্রায় সবকিছু পণ্য। যে তথ্যচিত্র কিছুকাল আগেও কাউকে দেখনো মুশকিল হতো (কোনো কোনোটার নির্মাণশৈলীর যে হাল তাতে দেখা এমনিতেই একটু কঠিন), তারও এখন পৃষ্ঠপোষক আছে- বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থা। মিডিয়াতে যে পণ্যকারে বিজ্ঞাপিত হতে পারে প্রায় সব কিছু- সেটা আরও পুরোনো ব্যাপার। একটা ব্যাপার কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না যে, টিভিতে ‘নিজ’ প্রদর্শিত হওয়া আর সাবান-শ্যাম্পু বিক্রি হবার গভীর যোগসুত্র আছে। টিভিতে প্রতিষ্ঠিত প্রায় সকল খ্যাতিমানেরাই সাবান-শ্যাম্পু-সিগারেট থেকে শুরু করে তৈরি বাড়ি বিক্রির কাজ ধারাবাহিকভাবে করে যাচ্ছেন। আর অনুষ্ঠানসমূহের পৃষ্ঠপোষক বা স্পন্সর হওয়া তো আছেই। চিন্তাশীল নাটক-অনুষ্ঠান খারিজ করার কোনো আগ্রহই আমাদের নেই। এমনকি আমরা এ-ও বলতে চাইছি না যে, সবকিছু বিক্রি বাট্টা বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা শুধু বলবার চেষ্ট করছি: ক. টিভি বা বৃহত্তর অর্থে দৃশ্যমান মাধ্যমে খ্যাতিমান মানুষ (তার মানেই খ্যাতিমান হওয়ার দৌঁড়ে আরও কিছু মানুষ) হওয়া আপনার বা আমার যতটা প্রয়োজন, সাবান-শ্যাম্পু বানিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন খ্যাতিমান মানুষ বানানো; খ. এই প্রক্রিয়াটা বছর দশেক আগেও ছিলো আরও সংক্ষিপ্ত পরিসরে; গ. কাকতালীয় নয় যে প্রচার মাধ্যমে, বিশেষত নাটকে, কর্তৃত্ব তাঁদেরই হাতে যাঁরা নাটকে পণ্য বিক্রী করে দেবার ঠিকাদারী নিয়েছেন; এবং ঘ. আমাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসার সাথে (রাস্তা-নাটক সংক্রান্ত) এই বিষয়টা সম্পর্কিত।

ইদানিংকালে দ্রুত অনেক কিছুই বদলাচ্ছে, সেগুলোও যত্নের সাথে বিবেচনা করা দরকার। যেমন: অ’রুচির কারণে যা বর্জনযোগ্য ছিলো মধ্যবিত্ত শহুরে মানুষের কাছে তা আর মোটেই বর্জ্য নয়, উল্টো সেটাই প্রত্যাশিত হয়ে উঠেছে, যেমন; মডেলিং, বিশেষত নারীদের বেলায় কিংবা ফ্যাশন শো’তে অংশগ্রহণ ইত্যাদি। আবার ক্রমবর্ধমান টিভি চ্যানেলের নয়া নয়া পরিসরে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করবার পুঁজি-পাট্টা এবং প্রয়োজন দেখা দিয়েছে পণ্য নির্মাতাদের। সেই সঙ্গে প্রচার মাধ্যমের ভোক্তা হবার অবসরভোগী মানুষজন বাড়ছে দিন দিন। নানা রকম প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্বে নানা রকম মিডিয়া তৎপরতার জন্ম হচ্ছে। এগুলোকে অবশ্যই সমন্বিত করে ভাবা লাগবে। এগুলো কোনো না কোনো প্রক্রিয়ার ফলাফল। আবার পরস্পর পরস্পরের কারণ। এই প্রক্রিয়ায় রাস্তার নাটকের জায়গা থাকে কিভাবে?

ছোট একটা উপসংহার

২৯ এপ্রিলের খবরের কাগজে (প্রথম আলো) মেরিল প্রথম আলো তারকা জরিপ ও সমালোচনা পুরস্কার ১৯৯৯ এর উপর বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এন্ড্রু কিশোর নির্বাচিত হয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, ‘তিনি ফুটপাত থেকে ড্রইং রুমের শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন।’ মধ্যবিত্ত ‘শিল্প চর্চাকারী’দের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এই একটা বক্তব্যে স্পষ্ট। পষ্টাপষ্টি ব্যাপার হলো রাস্তার নাটক হওয়া না হওয়া একেবারেই সংশ্লিষ্টদের এজেন্ডার উপর নির্ভর করছে। একটা পর্যায়ে বিষয়টা কেবল রাস্তার নাটকে আর পরিসীমিত থাকে না। এটা হচ্ছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পেটি-মধ্যবিত্তের এবং তাদের স্বার্থের দখলদারিত্বের প্রশ্ন।

মানস চৌধুরী- নাট্যকার, অভিনেতা। শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়