Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

অলীক সুনাট্য রঙ্গে

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

।। এক ।।

অ্যালজেব্রা ও বাংলানাটকের কোনো পাঠক নেই। গণিতের বই যেমন অঙ্ক কষার জন্যে খোলা হয়, নাটকের বইও তেমন অভিনয়ের পার্ট কষার জন্যে খোলা হয়ে আসছে। পড়ার জন্যে কেউ কেনেন না, হাতে গুঁজে দিলেও পড়েন না। সাহিত্যেরই একটি শাখা বটে, কিন্তু অতি বড় সাহিত্য পিপাসুরও টেবিলে কী আলমারিতে বাংলানাটক বড় একটা দেখা যাবে না। পাবলিক লাইব্রেরিতে সৌজন্য বসে মাইকেল, দীনবন্ধু, গিরিশচন্দ্রকে বসিয়ে রাখা হয়, বাল্মীকির মতো বসে তাঁরা ঘুমান, কেউ ডাকাডাকি করে না, তাঁদেরও চোখের পাতা উঁচু করতে হয় না। ফ্যামিলি-সাইজের উপন্যাসের গাদাগাদি মিছিল ভ্রুকুটি করে, আপনি শুতে জায়গা পাই না, শংকরাকে ডাকি! স্কুল কলেজের গ্রন্থাগার সিলেবাস-বর্হিভূত ক্ষমতার উৎস স্বীকার করে না। ডি.এল রায়ই সেখানে সর্বাধুনিক নাট্যকার। সাহিত্য পত্রিকায় রান্নাবান্না, দাবাখেলা, কবরীবন্ধনের নিয়মাবলী... সবই স্থান পায়, নাটক পায় না। দু-পাঁচ-দশ বছর বাদে বাদে এক আধটির আবির্ভাব ঘটে বটে, কিন্তু তা নাট্যানুরাগবশত, না বিশেষ রচয়িতার প্রতি কৃতজ্ঞতাপ্রসূত কে তার জবাব দেবে? প্রকাশনী জগতে নাট্যপ্রকাশনগুলির অবস্থা ঠিক চিকিৎসা জগতের চাঁদসীর ঔষধালয়গুলির মত, বেচাকেনার ধার দিয়েও যায় না, ধারেও বিকোয় না। বাজারে পাঁশুটে রঙের এক রকমের খিসখিসে কাগজ পাওয়া যায়। সেল-এ শাড়ি বিক্রির বিজ্ঞপ্তি আর নাটক ছাপার কাজে ওটা ব্যবহার করা হয়। নাটকের বইয়ের একটা সনাতন চেহারা আছে। বামনাকার পকেটবুক সাইজ। কার পকেট? প্রমপটারের পকেট। লম্বা ডিমাই সাইজ আর হার্ডবোর্ড বাঁধাই হলে প্রমপটারের পকেটে ধরবে না। মুদ্রণে বানান শুদ্ধিরও প্রয়োজন পড়ে না। যা চোখ দিয়ে পড়া হয় তার জন্যেই না বানান, যা কানে শোনা হয় তার বানান নিয়ে খুঁতখুঁতি ভালো দেখায় না। ব্রাকেটে ‘অট্টহাস্য’ যদি ভুল ক্রমে ‘অট্রহাস্য’ ছাপা হয়, তাতে অভিনেতাদের হা হা হা হা বাড়ে বই কমে না। সুঠাম চিত্তাকর্ষী কাব্য উপন্যাসের পাশে অশুদ্ধ বানানে ভাঙা টাইপে ছাপা বামনাকার নাটক চিরদিনই কমিক রিলিফ। সুশিক্ষিত বাঙালি বাংলানাটক পড়েছেন সেই ছাত্রাবস্থায়। ‘ভীষ্ম’, ‘জনা’, ‘শ্রীমধুসূদন’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’,... নামগুলি উল্লেখমাত্র তাঁদের সুপ্ত স্মৃতি সপ্রতিভ হয়- “পড়া আছে, পড়া আছে। ডিগরিতে ছিল।” সুদূর যৌবন আজও অপরাজিত, কেননা ডিগরি লাভের পর আর বাংলানাটক পড়া হয়নি, এবং পুত্রকলত্র আজও ডিগরি কোর্সে ওইগুলিই পড়ে চলেছে। তা ব’লে এদেশে পড়ুয়ার কিছু অভাব নেই। গল্প উপন্যাস চিত্রতারকাদের বায়োগ্রাফি অটোবায়োগ্রাফি সংসারে সবাই সারাদিন কিছু না কিছু পড়ছেনই। অথর্ব দাদুও ছানিপড়া চোখে পঞ্জিকা পড়ছেন, নিরক্ষর বউটি হপ্তায় একদিন পাঁচালি পড়ছেন, কেবল কক্ষণো ভুলেও কেউ বাংলানাটক পড়েন না। বড় বড় পুরস্কার পেলে সবার বই-ই রাতারাতি হাওয়া হয়, বাদল সরকারও পেয়েছিলেন, জানি না তাঁর ক’টা নাটকের ক’টা সংরক্ষণ বেরিয়েছে! বাঙালি নাট্যকারদের প্রতি এদেশের নাট্যানুরাগীদেরই বা মনোভাব কীরকম? এক কৃতী নাট্যনির্দেশক বড় সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন- বিদেশি নাটক প্রযোজনার সবচেয়ে বড় সুবিধে হলো, গোড়াতেই দর্শকদের মুখ বন্ধ করা যায়। টেক্সটের গুণাগুণ নিয়ে মুখ খুলতে সাহস করে না। শুরুতেই পঞ্চাশটে নম্বর ঘরে তোলা যায়। দেশি নাটকের বেলায় গোড়াতেই পঞ্চাশ নম্বরের হ্যান্ডিক্যাপ।- এই সার্বিক পরিস্থিতি নিবেদনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র এই কথাটা ধরিয়ে দেওয়া যে, এদেশে নাট্যরচনায় ব্রতী হওয়া মানে এই সর্বব্যাপী ঔদাসীন্য নিস্পৃহতা অনাদর অশ্রদ্ধা উপেক্ষা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রা শুরু করা।

নাট্যজগতের খোঁজ যাঁরা রাখেন এবং যাঁরা রাখেন না, সবাই জানেন, বাংলাভাষায় নাটক জিনিসটা সাহিত্য পদবাচ্যই নয়। প্রকৃত সাহিত্যগুণসম্পন্ন পাঠযোগ্য নাটক বাংলায় বড় একটা লেখা হয়নি। ভালো নাটকের সংখ্যা গুণতে দু’হাতের দশ আঙ্গুলের সবকটা কর লাগবে না। ভালো নাটক কই, ভালো নাটক কেনো লেখা হয় না, নাট্যকাররা করছে কী... এমন সহস্র ক্ষেপণাস্ত্র সবাই অহরহ নিক্ষেপ করছেন। সত্যিই সোয়া’শো বছরে একখানাও ভালো নাটক লেখা হয়েছে কি না, লেখা হলে ক’খানা হয়েছে, লেখা না হলো তাবৎ যুগন্ধর অভিনেতা অভিনেত্রী মঞ্চের ওপর কেবল প্যান্টোমাইম দেখিয়েই বড় অভিনেতা বড় অভিনেত্রী হলেন কি না, এসব কূটতর্কের নিষ্পত্তি করুন যোগ্য মীমাংসকেরা। আপাতত এটাই স্মরণীয়, এখানে নাটক লিখতে যাওয়া মানে কী অদ্ভুত পরিস্থিতির মধে জড়িয়ে পড়া। প্রায় হাতছাড়া একটি রণাঙ্গনে প্রবেশ করা। এখুনি ভালো ভালো নাটক লিখে নিমজ্জিত জাহাজটাকে টেনে তুলতে হবে। যাবতীয় ক্ষেপণাস্ত্রের মোকাবিলা করতে হবে। ভাবুন গোড়াতেই কী জাতীয় মানসিক চাপে ভুগতে ভুগতে একজন নাট্যকারকে কলম ধরতে হয়। প্রযোজকের পঞ্চাশ নম্বরের হ্যান্ডিক্যাপ, নাটকের হ্যান্ডিক্যাপ শতকরা একশো নম্বরের। বাংলাসাহিত্যের কবি গল্পকার ঔপন্যাসিকের অবস্থাটা সে তুলনায় কতোখানি মজবুত সেটাও ভাবুন। প্রচুর ভালো সৃষ্টি রয়েছে, রাজার ভা-ার রয়েছে। আগামী পঞ্চাশ বছর যা খুশি লিখে গেলেও ঐশ্বর্যে ঘাটতি দেখা দেবে না। শুধু নাট্যকারের স্কন্ধেই এক আশু উদ্ধারকার্যের সুবিশাল দায়! ভালো নাটক লেখা হবে কী, অর্ধেক দম যে শুরুতেই হারিয়ে যায়!

।। দুই ।।

ভালো নাটক লেখা হচ্ছে না। কে লিখবে? যিনি লিখতে জানেন তিনি নাটক লিখতে যাবেন কোন দুঃখে? যে পাগলটা একমনে পথের কাঁচের টুকরো কুড়োয়... পথচারীদের কাছ থেকে সে যে দক্ষিণা পায়, এদেশে নাটক লিখে বুঝি তার বেশি কেউ পায় না। গ্রুপ থিয়েটারের জন্য যাঁরা লেখেন তাঁদের কথাই ধরা যাক। নিরানব্বুইভাগ নাট্যগোষ্ঠীর এমনই দীনদশা, নাট্যকারের পারিশ্রমিক আশা করাটা নিষ্ঠুর অভদ্রতা। হলভাড়া-লাইট-সেট, মিউজিক-মেকআপ, কর্পোরেশন বিজ্ঞাপন সব মিলিয়ে সন্ধ্যায় একটি শো করতে একটা ছোট দলেরও যা ব্যয়, হিসাব করলে দেখা যাবে, মাত্র বারোটি শো-এর খরচ যোগ করলে, ঐ টাকায় শহরের ওপর একটা বাড়ি কেনা যায় এবং সেই বাড়িতে দলের কর্মীরা শুয়ে বসে বাকি জীবনটা কাটাতে পারেন। শো-এর টাকা আসে কোথেকে? বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের ধরে বেঁধে থিয়েটারের দর্শক বানাতে পারলে খরচের এক পঞ্চমাংশ ওঠে, তার বেশি নয়। বাকিটা কে যোগায়? বিশ্বাস করুন না করুন, কেউ যোগায় না। সরকারি বেসরকারি আন্তর্জাতিক কোনো চক্রই নেই যে এই থিয়েটারে টাকা ঢালে। কর্মীরাও কেউ পৈতৃক উত্তরাধিকারসূত্রে দু-দশটা তেলকলের মালিক হয়ে থিয়েটার করতে আসেননি। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান। কবজির ঘাম ঠোঁটে মুছে দশ হাজার টাকার পরিশ্রম করে এক হাজারটি টাকা তোলেন তাঁরা, এবং এক সন্ধ্যায় অভিনয় করেন। এই শহরে ভালো নাটক তাঁরাই করেন, কেবল তাঁদের নিয়েই বাংলা থিয়েটারের যতো গর্ব। অথচ তাঁরা ফকির। শো-এর শেষে নিঃস্ব হয়ে খালিপেটে মালপত্র ঘাড়ে করে যান সেই গর্বিত গন্ধর্বেরা গৃহমুখী হন, তখন তাঁদের কাছে রয়ালটি চাওয়া বোধহয় শাইলকেরও কম্মো না। বাইরে এমন ধারণা আছে, নাট্যকাররা সব রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের মনে রাখা উচিত, এটা সিনেমা না, যাত্রা না, মালিকী থিয়েটার না। এটা গ্রুপ থিয়েটার! লিখলেই এখানে টাকা পাওয়া  যায় না। যিনি লেখেন তিনিও নিজেকে এই বিত্তহীন লড়িয়ে থিয়েটারের একজন শরিক ছাড়া আর কিছু ভাবেন না।

মফস্বলের দলগুলির অবস্থা আরো করুণ। ত্রিপল দিয়ে মাঠ ঢাকতেই পকেট গড়ের মাঠ। একটু থিয়েটার করার জন্য মুখিয়ে থাকতে হয়, কবে দূর্গাঠাকুর বিসর্জনে যাবেন, আর পূজাম-পটি দখল করা যাবে। কলকাতায় তবু টিকিট গছানো যায়, মফস্বলে টিকিট কেটে কেউ পাড়ার ছেলেদের অভিনয় দেখে না। গাঁটের পয়সা উড়িয়ে তাঁরা হিল্লি-দিল্লি-সিন্ধ্রি-ভিলাই ঘুরে ঘুরে বেড়ান, সে কি নাট্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কারের আশায়, না একটা বাঁধামঞ্চ আর কিছু গুণগ্রাহী দর্শকের লোভে, কে তার খোঁজ রাখছে? রয়ালটি দিতে হবে এই ভয়ে তাঁরা নাট্যকারকে অভিনয়ের খবরটিও বন্ধ করেছেন। ফলে তাঁদের লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে নাটকের সঙ্গে একথাটাও ছাপাতে হয়, ‘গা ঢাকা দেবেন না। দক্ষিণার প্রশ্নই ওঠে না।’ পাঠক নেই ক্রেতা নেই বাংলানাটকের গ্রাহক ধারক বাহক সব নাটুকে দল। তাদের রয়ালটির ভয় দেখালে, বিদেশি নাট্যকারদের অনুকরণে কঠোর আইনের ভয় দেখালে, নাটক যাবে কার কাছে? আবার দক্ষিণা দিতে যারা সক্ষম... অফিসের প্রমোদসংস্থাগুলি, তাদের আবার এমনই যজ্ঞিবাড়ির ব্যাপার ওসব ছোটো কথা সময়কালে মনেও থাকে না।

 মড়ার খাট নিয়ে একটা বীভৎস রসিকতা আছে। মড়ার খাট যে বানায়, সে তাতে চড়ে না... যে কিনে নিয়ে যায়, সে কাঁধই দেয় কিন্তু চড়ে না... আর যে চড়ে সে কোনোরকম কৃতজ্ঞতাবোধ করে না। গ্রুপ থিয়েটারের নাটাকও তাই। যে লেখে সে কিছু পায় না, যারা ঘাম ঝরিয়ে নিয়ে বয়ে বেড়ায়, তারাও কিছু পায় না, আর যারা পায়, দর্শকেরা, তাঁরা অধিকাংশই সব কৃতজ্ঞতাবোধের ঊর্ধ্বে।

এমতাবস্তায় নাটক ছেপে প্রকাশকরাই বা কি দিতে পারেন? হিসাবটা মোটামুটি এই রকম-

জীবনের প্রথম নাটকের বেলায় প্রকাশক কিছু দিবেন না। নাট্যকারকেই ছাপা, কাগজ, বাঁধাই ও বিজ্ঞাপনের যাবতীয় খরচ যোগাতে হবে।


দ্বিতীয় ও তৃতীয় নাটকের প্রকাশ নির্ভর করছে প্রথমটির শর্ত পালনের উপর।


চতুর্থ ও পঞ্চমের বেলায় কোনো তরফই কারুর কাছে কিছু দাবি করবেন না।


ষষ্ঠের বেলায় ভাবুন একটা লোক যে কোনো জিনিস লিখে কতো কম টাকা পেতে পারেন। এবার তা থেকে একশো পঁচাত্তর টাকা বাদ দিয়ে দুই দিয়ে ভাগ দিন। ভাগফলকে আঠারো দিয়ে ভাগ দিন। মানে আঠারো কিস্তিতে ঐ টাকা একজন নাট্যকার পেতেও পারেন আবার নাও পারেন।

এবার বলুন একটা ‘ভালো নাটক’ লিখতে ন্যূনপক্ষে কতো সময় আর পরিশ্রম দরকার হতে পারে? এরপরও কি একথা ভেবে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত নয়, অন্তত বিদগ্ধজনের হাতে গোনার মতো কয়েকখানি ভালো নাটক বাংলাভাষায় লেখা হয়েছে! এর চেয়ে বেশি লেখা হলো খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে যেত না কি?

অবশ্যই এসব তুচ্ছ কথা। হিসাবের কথা, সুদখোরের কথা। লেখকের কথা নয়, শিল্পীর কথা নয়। লেখক যিনি তিনি লিখবেনই, দেনা-পাওনার গাওনা জুড়ে লিখতে না পারার সাফাই গাইবেন না! ঠিক কথা। তবু বলুন, আর্থিক নিশ্চয়তা থাকলে অনেক অধিকতর শক্তিধর কলম আমরা নাট্য-রচনায় পেতাম না কি? প্রতিদিন একজন না একজন শক্তিমান নাট্যকর্মী আমাদের গ্রুপ থিয়েটার ছেড়ে চলে যাচ্ছে- যাত্রায় নয় সিনেমায় নয় মালিকী থিয়েটারে। কেন এই ভাঙন? তাঁরা যখন বলেন, ওটা আমার রুজির জন্যে, আমার আত্মা পড়ে আছে গ্রুপ থিয়েটারে, শুনলে চালাকি মনে হয় ঠিকই কিন্তু জ্বালাও কি ধরা পড়ে না?

আর্থিক প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাবার উপায় কোথায়?

নাট্যগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থা যে নাট্য রচনাকে কতোখানি প্রভাবিত করে তা-ও কি অবহেলার? বেশির ভাগ দলের হাল নেই হাতিয়ার নেই... চড়াই পাখির সংসার। ইট নেই কাঠ নেই সিমেন্ট নেই... খড়কুটো দিয়ে গড়া। সংগ্রহে একটির বেশি দুটি অভিনেত্রী নেই... একটির বেশি দুটি সেট বহন করার ক্ষমতা নেই। সংগ্রহে একটির বেশি দুটি অভিনেত্রী নেই... একটির বেশি দুটি সেট বহন করার ক্ষমতা নেই। এটা নেই... ওটা হবে না... সেটা করতে পারবো না। সব হলো তো হল নেই, নাটক ঘরে নিয়ে বসে থাকো। এই বেশির ভাগ দলের ক্ষমতা অক্ষমতা মাথায় নিয়ে একটি নাটকের খসড়া করতে হয়। মুষ্টিমেয় বড় দল বাদ দিলে, এই বেশির ভাগ ছোটো ছোট দলের সঙ্গতির কথা মনে রেখে লিখতে হয়। লেখাটা ভালো কি মন্দ হলো দেখার ফুরসত কোথায়। বাংলা নাটক তার জন্ম থেকেই রঙ্গমঞ্চ নির্ভর। রঙ্গমঞ্চের মুখ চেয়ে আগেও লেখা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। মঞ্চের বাইরে তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কোথায়? মঞ্চেরই বা প্রযোজক গোষ্ঠীর ক্ষমতার পরিধির উপর, আগ্রহ অনীহার উপর, নাটকের ভালো হওয়া, না হওয়া অনেক অনেকখানি নির্ভর করছে। বেশি কথা কী, এই মুহূর্তে যদি একটি মহত্তম নাটক কেউ লিখে ফেলেন, এবং সেটাতে যদি ছয়টি স্ত্রী চরিত্র থাকে, নিশ্চিত বলা যায়, ক্যাপসুল বানিয়ে লালকেল্লায় পুঁতে রাখা ছাড়া, তাকে নিয়ে আর কিছু করা যাবে না।

।। তিন ।।

তবু এসব সমস্যা ভালো নাটক লেখা হওয়ার পথে ততখানি দুরতিক্রম্য বাধা নয়, যতখানি অন্তরায় শিল্পের সমস্যা!

প্রয়াত সাহিত্য-বিচারক প্রণম্য ডঃ সাধনকুমার ভট্টাচার্য একদা জানিয়ে ছিলেন, যখনই তিনি শিল্প সাহিত্য বিচারে অগ্রসর হয়েছেন, অগ্রিম পঞ্চাশটি নম্বর বাংলানাটকের পক্ষে ধার্য করেছেন, শুধুমাত্র তার বিষয়-কৌলীন্যের জন্যে। ইহজীবনের জরুরি সমস্যা আমাদের নাটক যেমন তুলে ধরেছে, এমন আর কেউ ধরেনি। উৎপীড়ন অনাচার ভ-ামি চারপাশের যতো শয়তানির মুখোশ ছিঁড়েছে আমাদের নাটক, অক্লান্তভাবে, নির্মমভাবে এবং ব্যাতিক্রমহীনভাবে। আমাদের নাটকের অন্য নাম প্রতিবাদ, আক্রমণ। সাহিত্যের অন্য শাখার মতো সে মাঝে মাঝেও এই কর্তব্য ভুলে ছুটির বাতাসে আন্দোলিত হয়নি, বিগত চল্লিশ বছরের মধ্যে হয়নি। উৎপল দত্তের মানুষের অধিকারে, বিজন ভট্টাচার্যের ‘দেবী গর্জন’, কী মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাজরক্ত’ যখন মঞ্চের উপর বিস্ফোরণ ঘটায় তখন সিনেমার পর্দায় কী চলে ভাবুন। মঞ্চের বাইরে এসে বাদল সরকার যখন সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস লেখেন, তখন লাখ লাখ টাকার লেনদেনে অন্যত্র কী হয়? আর ‘দেবী গর্জন’ কি একখানা? পশ্চিমবঙ্গে যেখানে যে নাটকটা লেখা হয়, করা হয়, যতই কাঁচা আর অপটু হাতে হোক না কেন, সে-ই প্রতিবাদ করে, আক্রমণ করে, শত্রুকে চিনিয়ে দেয় এবং সংহার করে। কোনো শাসন তাকে রুখতে পারেনি, জরুরি অবস্থাও পারেনি। অন্ধকারকে ধিক্কার দিয়েছে সে, একমাত্র সে-ই। হামলা জুলুম সবার কণ্ঠ রোধ করেছে, পারেনি শুধু তার।

দর্শকরাও তা জানেন। জানেন বলেই যেটুকু যা দাবি, সে শুধু নাটকের কাছেই। পর্দার লাভ স্টোরি দেখে যিনি মুগ্ধ হন, মঞ্চে লাভ স্টোরি দেখলে তিনিই আঁতকে ওঠেন। নিছক হাসির গল্পে যিনি খুশি, নিছক হাসির নাটকে তিনিই ক্রুদ্ধ- একী একী... এসব কী হচ্ছে? নিছক হাসুনি কাঁদুনি শোনাতে কেন ডেকে আনলে আমায়? দিলেটা কী... পেলামটা কী? চারদিকে এতো ভোগ থাকতে তোমরা কিনা মজার নাটক করছ!’ শিল্প সাহিত্যের এই বিশেষ শাখাটি, মাধ্যমের কোন অমোঘ শর্তে, সংসারের কাছে এভাবে দায়গ্রস্ত সে সব না বুঝেও গ্রুপ থিয়েটারের কর্মীরা এই জেনে পরিতৃপ্ত হতে পারেন যে, রসিকজনের দাবিদাওয়া, মান অভিমান, সব নাটকেরই কাছে।

অন্যদিকে, এই দাবি যতো বেড়েছে, বাংলানাটকের তত রূপের দৈন্য প্রকট হয়ে পড়েছে। নাট্যকাররা হয়েছেন বক্তব্য কৈবল্যবাদী। মানুষকে নিয়ে সাহিত্য, সেই মানুষই নাটক থেকে হারিয়ে গেছে। আলোছায়ায় ঘেরা গভীর গোপন মানুষ, অন্তর্লোকের বাসিন্দা মানুষ আমাদের ছেড়ে গেছে। আছে শুধু রূপহীন নিরাকার বক্তব্যের আদিম বস্তুপিণ্ড। চরিত্র নামক কয়েকটি মাউথপিসের মুখে সেই পিণ্ড ভাগ করে দিয়েই নাট্যকাররা কাজ সারতে পারেন। নাটক লেখার সহজ সরল একটা  ছক তৈরি হয়েছে, কিন্তু উত্তাপ আর কিছু অভিশাপ দিয়ে বোনা এক হাততালি পাওয়া ছক।

স্বীকার করতেই হবে এই বক্তব্য-সর্বস্বতা, অহর্নিশি দায়িত্ব পালন বাংলানাটককে ক্রমশ ক্লান্ত, বৈচিত্র্যহীন, অস্বাভাবিক করে তুলেছে। যে বিষয়ে কৌলীন্য ছিলো গর্বের, তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘাড়ের বোঝা। ভয়ানক শ্বাসকষ্ট। আজ একটা রহস্য নাটক লিখতে নাট্যকারের হাত ঠক ঠক করে কাঁপে। রহস্য নাটকেও লোকে আশা করবে সমসাময়িক কিছু জরুরি প্রসঙ্গ এবং সমস্যা সমাধানের পথনির্দেশ। অন্তত শেষ পাঁচ মিনিট সোচ্চার গলায় সেটা শোনাতে হবে। নইলে কেউ বলবে না, নাটকটা ভালো। ভবিষ্যতে ভালো নাটক পেতে হলে এখুনি নতুন নাট্যকারদের এই দায়িত্ব পালন থেকে মুক্ত করে বাধ্যতামূলকভাবে হাত খুলে লিখতে হবে। কেননা, একটা বাজে নাটক লেখা যেমন সোজা, একটা ভালো নাটক লেখা তেমনি কঠিন। আজ অবস্থা এমনি ঘুলিয়ে উটেছে মহাভারতের দুর্যোধনকে নিয়ে লিখতে গেলে, পরিষ্কার দেখিয়ে দিতে হবে, সারা পৃথিবী জুড়ে এখন কতগুলি দুর্যোধন কোথায় কোথায় আস্ফালন করছে এবং নিকটবর্তী থানার দারোগাবাবুটি একজন কতো বড় দুর্যোধন। এবং এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে, কোনো রকম কার্পণ্য বরদাস্ত করা হবে না। যদি কোনো নাট্যকার বলেন, ‘আমি তো এই সময়েরই মানুষ। আমার মগজের ধূসর পদার্থে এই সময়েরই আলো বাতাস ঢুকেছে। আমি যে দুর্যোধনকে দেখাচ্ছি... তার গায়ে কোটপ্যান্ট না চাপালেও, সে নিশ্চয়ই এই সমাজেরই একজন হবে। প্রকাশ্যে দারোগাবাবুর নামটি আর নাই করলাম’। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসে, ‘নাটক দেখতে এসেছি, শিল্পকর্ম দেখতে আসিনি। ওসব ঠারে ঠোরে চলবে না... চেঁচিয়ে নামটি বলে দাও।’ জানি, যে রচনা নিজেরই সময়-কাল ধরতে পারে না, সে কখনো কালোত্তীর্ণ হতে পারবে না। কিন্তু এ-ও তো ঠিক, নিজের কাল যদি তাকে মোটা দড়ি দিয়ে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রাখে, তার যে পা নাড়ারই যো থাকবে না। দর্শকের দাবি মেটাতে অতএব পুরাণের প্রাণবায়ু নিষ্কাশিত করে তাকে সমকালীনতার বিবরে ঢোকাতে হয়। পঞ্চপা-বকে গাল পাড়তেই হয়। মহাভারতকার তাদের যতো গুণই দেখিয়ে যান, তারা যে রাজার কুমার। প্রশংসা করলে রাজতন্ত্রের পৃষ্টপোষকতা করা হয়। (শিশুদের রাজপুত্তুরের গল্প শোনালেও তাই হবে?)

অনেক হিসাব করে তবে একটা নাটক লিখতে হয়। কোনো নাটকে দেখা গেল একটা অসৎ পুলিশকে। অমনি হুংকার উঠলো, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সমগ্র পুলিশ সমাজ, তথা রাষ্ট্রকে ছোট করে দেখানো হচ্ছে। কিছুতে বোঝানো যাবে না, সব পুলিশের কথা বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে একজনের কথা। বোঝানো যাবে না, এর সঙ্গে পুলিশ ইউনিয়নের কোনো যোগ নেই। শেষ পর্যন্ত সারা নাটক জুড়ে অন্তত দশবার কামান গর্জনে ঘোষণা করতে হবে, জগতের পুলিশ ভালো, বুঝলেন দর্শক, ভয়ানক ভালো! নাট্যকারদের ভাষায়, একে বলে কাটান দেওয়া বা গঙ্গাজল ছিটানো। সাধে কি নাটক মোটা দাগের হয়?

’প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির ’নার্স’ নিয়ে এইরকম একটা ঝামেলা হয়েছিল বোধহয়। ভালো নাটকে, তাই বুঝেছি, চরিত্রের পেশার উল্লেখ থাকবে না।

পেশা এবং ধর্ম। রহিম নামের কোনো চরিত্র যদি শয়তান হলো, সঙ্গে সঙ্গে করিমকে মহসীন বানিয়ে খাড়া করতে হবে এবং রহিমের মুণ্ডুপাত অবশ্যই ঐ করিমের হতেই করতে হবে। বাদশা নবাবদের নিয়ে লেখা ঐতিহাসিক নাটকগুলিতে তাই দেখা যায়, থেকে থেকে এক একজন স্বীয় ধর্মের গুণাবলী গাইছে। কাটান দিচ্ছে।

এই জাত পাত নেশা মান অভিমান সব সামলে... কার গায়ে আঁচড় লাগছে, কার গায়ে বাতাস লাগছে সব দেখে নিয়ে... তারপর কে কে ধরে মারবে, মারলে কে কে ঠেকতে আসবে, এসব ঠিকঠাক করে তাতে একটা সৎ বলিষ্ঠ নাটকের খসড়া করতে হয়।

নাটক ছাড়া সাহিত্যের আর কোনো শাখাকে এতোটা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করতে হয়? এতো ফ্যাসাদ আর কার আছে? তাই সুখ্যাত কথা সাহিত্যকদের যখন আহ্বান করা হয়, আসুন, আপনারা এগিয়ে এসে নাটকের দুর্দশা ঘোচান... সন্দেহ হয়, কে আসবেন সাধ করে এতোগুলি হাতকড়া পড়তে! স্রষ্টার যে স্বাধীনতা তাঁরা ভোগ করতে অভ্যস্ত, নাটকে তার সুযোগ কোথায়?

গ্রুপ থিয়েটারের পাশাপাশি কলকাতায় আরো একটা থিয়েটার আছে, একশো বছরের পুরানো মালিকী থিয়েটার। এই ব্যবসায়িক মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত বাজার মাৎ করা নাট্যকাররা প্রায়ই গোপনে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে থাকেন, ওখানে ভালো নাটকের কথা ভাবাই যায় না। নাটক লেখা মানেই তো প্রযোজকের হাজার রকমের ফাই ফরমাস খাটা। এখন এই থিয়েটারের প্রযোজকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাটোয়ারি বুদ্ধির ব্যবসায়ী ব্যক্তি-ইট লোহা মশলার কারবার ছেড়ে থিয়েটারের কারবার ধরেছেন। এঁদের নির্দেশমতই নাট্যকারকে কলমনবিশি করতে হচ্ছে। তারপর আছে পেশাদার অভিনেতা- অভিনেত্রীদের ইমেজ রক্ষা করা। সুন্দরী বলে যাঁর হাঁকডাক, যে নাটকই হোক, তাঁকে অন্তত একটি দৃশ্যে বিউটি গার্ল সাজার সুবন্দোবস্ত করে দিতেই হবে। এ অভিনেতা ইংরেজি বলতে পারেন না, উনি যুক্তাক্ষরে মাটো... সবার জন্যে নাট্যকারকে ‘সুবন্দোবস্ত’ করতে হয়। এর মধ্যে ভালো নাটকের কথা ভাবতে পারে কে?

অবশ্য এটাই ব্যবসায়িক থিয়েটারের একমাত্র চেহারা নয়, ভদ্রমার্জিত আরো একটা চেহারা আছে এবং ছিলো। বিগত যুগের আদর্শবান দরদী নটনটী, দক্ষ এবং রুচিশীল নাট্যশিক্ষক এই থিয়েটারের মানুষ। ব্যবসায় নামে উৎকট কা-কারখানা এঁরা প্রশ্রয় দেননি। আজো ব্যবসায়িক থিয়েটারের দু’একটা কেন্দ্রে মোটামুটি ভদ্র চেহারার নাটক হয়। জগতের সব ঘাত-প্রতিঘাত থেকে দূরে সরে এঁরা ভদ্রভাবে পুরনো বিশ্বাসকে পুরনো আচার আচরণের মাধ্যমে তুলে ধরেন। ভালো নাটক এঁরা বিচার করেন পুরনো ছকে। শাস্ত্রবিরোধী নাটক এঁদের পছন্দ নয়। ফলে এসব থিয়েটারে নতুন কিছু হয় না। নাটকগুলি হয় ঠাণ্ডা ম্যাড়মেড়ে দিদিমার ছেঁড়া বেনারসীর মতো !

মালিকী থিয়েটারের দু’নম্বরী কারবারের জনক ওই অর্থ লিন্সু প্রযোজক এবং শিল্পীগোষ্ঠী মজ্জায় মজ্জায় অশিক্ষা আদর্শহীনতা অদক্ষতা ব্যভিচার এবং লোচ্চামি। সার্থক পরিণতি পেয়েছে আজকের ক্যাবারে নাচে। বিকৃত রুচির মালিকানায় এই থিয়েটার হয়ে উঠেছে বিভীষিকার রাজ্য। কিছুদিন আগে এমনি এক থিয়েটারে এমনি এক নাটকের প্রথমাংকের দ্বিতীয় দৃশ্যে ছিল এক মিস অমুকের এমনি এক উদ্দাম ক্যাবারে। তা নাট্যামোদিরা কিনা এমনই আমুদে, দ্বিতীয় দৃশ্য শেষ হতেই মনে করল পয়সা উঠে গেছে, সদবলবলে হল ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়ল, বাকি উনিশটা দৃশ্য মাঠে মারা যায়! কী করে দর্শকের ধরে রাখা যায়! মালিক ভেবেচিন্তে শেষ দৃশ্যেও দুখানা ক্যাবারে জুড়ে দিলেন এবং সময়সীমা ঠিক রাখতে গদ্য-অংশ পরিমাণ মতো ছেঁটে উড়িয়ে দিলেন। এমন নাটক লেখা সত্যিই কঠিন যার বুক পিঠ খুবলে খুবলে চোর গর্ত বানানো যায়, তবু নাটকের কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না, যেমন বেণী তেমনি রয়ে যায়। একেই বুঝি বলে ল’ অব দ্য কনজারভেশান অব ম্যাটার অ্যান্ড এনার্জি।

অফুরন্ত এনার্জি দেখা গিয়েছিল বছর খানেক আগের আরো একটি নাটকে। শুধু ক্যাবারে দেখিয়ে তৃপ্তি হয়নি, সেই সঙ্গে একটি বামন পুরুষকে শ্রীকৃষ্ণ সাজিয়ে নর্তকীর হাত ধরিয়ে বিচিত্র সব খেলা দেখানো হয়েছিল। মজা হচ্ছে এদেশের সংস্কৃতির অভিভাবকেরা এইসব অন্ধ কূপের ঝাঁপতাল খেলাকেই বড় বড় সার্টিফিকেট লিখে দেন এবং তারপর বক্তৃতা মঞ্চে উঠে বুক চাপড়ান, হায় হায়, ভালো নাটক একটাও নেই।

এই কা-জ্ঞানহীন হাহাকারের জবাবে চেনা ছড়াটাই তাই উল্টেপাল্টে নিয়ে বলতে হয়-

অলীক সুনাট্য রঙ্গে
ভজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে
নিরখিয়া ঠাট্টা মনে হয়।

।। পাঁচ ।।

এতদ্সত্বেও ‘ভালো নাটক’টি এই মুহূর্তে লেখা দরকার। কেননা এখনি বাংলা থিয়েটার স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল দিনগুলির মধ্যে দিয়ে চলেছে। নিষ্ঠায়, অধ্যবসায়ে নিরলস সৃজনে গ্রুপ থিয়েটার মানুষের মনে বিশ্বাস ও আকাক্সক্ষা জাগাতে সক্ষম হয়েছে। রয়েছে ‘বহুরূপী’, ‘পি.এল.টি’, ‘নান্দীকার’, ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’, ‘চেতনা থিয়েটার ইউনিট’, ‘থিয়েটার কমিউন’, ‘শৌভনিক’, ‘সুন্দরম্’, ‘গন্ধর্ব’, ‘ত্রিতীর্থ, ‘রূপকার’, ‘রূপদক্ষ’, ‘প্রতিকৃতি’, ‘চার্বাক’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘নাট্যায়ণ’, ‘চেনামুখ’, ‘সায়ক’, ‘শূদ্রক’ নামের অদ্ভুত শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলি, যারা বিস্ময়কর আবিষ্কারের আকাক্সক্ষায় উদ্বেল। এই থিয়েটারে কাজ করে গেছেন বিজন ভট্টাচার্য, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়। রয়েছেন শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, বিভাস চক্রবর্তী, অরুণ মুখোপাধ্যায়, কুমার রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত, সবিতাব্রত দত্ত, দেবকুমার ভট্টাচার্য, শাঁওলি মিত্রর মতো যাদুকর শিল্পীরা, যাঁরা নাটক কেনো, খবরের কাগজের ছেঁড়া টুকরোও বুঝি মুঠোয় ঘুরিয়ে এক তোড়া ফুল দেখাতে পারেন। রয়েছেন অত্যার্শ্চয সংবেদনশীল অভিনেতা-অভিনেত্রী, যাঁরা চরিত্র কেনো, নিরেট পাথরের মূর্তিতেও অনায়াসে সঞ্চারিত হতে পারেন। রয়েছেন কল্পনাশীল কলাকুশলী যাঁরা মঞ্চ জুড়ে অভাবিত রূপের উন্মেষ ঘটাতে পারেন। রয়েছেন এই ‘অন্য থিয়েটারের’ ’অন্য ভাষ্যকারেরা’- ‘সাংবাদিক বন্ধুরা। যাঁরা এই অন্য থিয়েটারের অন্য ভাষার সঙ্গে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পরিচয় ঘটাচ্ছেন। যাঁরা এর পতনে বিমর্ষ হন, উত্থানে উল্লসিত হন। এই এঁদের সবার আকণ্ঠ তৃষ্ণার প্রতি সশ্রদ্ধ হয়ে, যাবতীয় অশান্তি বিরক্তি সংশয় প্রলোভন হাতছানিকে দরজার বাইরে হাত-দেখিয়ে শুদ্ধ চৈতন্যে এই মুহূর্তে ভালো লেখায় প্রাণ সংযোগ করা উচিত।

বি. দ্র. লেখাটি লেখকের ’অলীক সুনাট্য রঙ্গে’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত- সম্পাদক

মনোজ মিত্র- অধ্যাপক, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ভারত