Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

চন্দ্রালোকে মনময়ূরী

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..


চন্দ্রালোকে মনময়ূরী- কাব্যনাট্য এই বলে শুরু হলো-

খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দিব কিসে ...

একটা করুণ সুরের মূর্ছনায় সকলে আচ্ছন্ন। এই জনপদ, যা গতরাতেও ছিল আনন্দমুখর/ আজ তার বাঁশিতে আসে ফাটল ধরার খবর। এখনো সকল কৃষকের গোলা ভর্তি, সোনালি ধানে/ তবুও তাদের খুশি যেন বেসুরো বাজে কানে। বর্তমানের স্বাচ্ছন্দ্য যখন ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার দোলায় দোল খায়/ বর্তমান সুরটি তখন আপনিতেই বড় বেসুরো হয়ে যায়।
 
বড় একটা ঝড় বইয়া যায় এই জনপদে- তখন তারা ভাবনায় পইড়া যায়।

ঝড়ে সবাই কাইত হইয়া পড়ে- ভাবে, কী আছে উপায়।

অসুর শক্তি যখন তাণ্ডব করে- মাথায় তখন রক্ত চইড়া যায়।

এই যে এত ঘটনা ঘটে- সাধ্য কী কেউ তাদের মাথা নোয়ায়?

আমাদের মাথা নোয়াবে/ এই দৃশ্য কে দেখছে কবে? আমি ভাবি অন্যকথা, এই যে এত পরিশ্রম, আপনাদের এত কষ্ট, বিনিময়ে এই পরিণতি শেষে/ খালি কান্না আর হাহাকার ভাসে আকাশে!

তোমরাই যদি ভাইঙা পড় তাইলে আমরা করমু কী/ তোমরা না থাকলে আমরা তো মরার আগেই তিনবার মরি। যে ঘটনা ঘইটা গেল কাইল রাইতে/ গলা শুকায়া যায় তবুও পারি না এক ফোঁটা পানি খাইতে। ঘটনা যা ঘটছে তাতো ঘটছেই। এখন চিন্তা কর কী করা যায়/ সবই করতে হইবো ঠাণ্ডা মাথায়।

ঠাণ্ডা রাখুম মাথা? বারে বারে আমরাই ঠাণ্ডা রাখুম মাথা/ পীর দরবেশের মানায় এক  গালে চড় মারলে আরেক গাল পাতা। আমরা পীর দরবেশ না, সাধারণ মানুষ/ অদৃষ্টের কাছে সব ছাইড়া থাকি না বেহুঁশ। যখন যেখানে দেখি ঘটছে এমন কিছু, যা অন্যায়/ তারই একটা বিহিত করতে মনটা ছুটতে চায়/ তখন কার সাধ্য সেই মনকে দাবায়? কেউ দাবাইতে পারে না। সুতরাং যা ঘটলো কাইল রাইতে/ আগে এর বিহিত, তারপর যামু বাড়িতে।

বিহিতের আছে মাত্র দুইটা পথ। একটা হইলো আইনের আশ্রয়ে যাওয়া/ আরেকটা, আইনটারে নিজের হাতে তুইলা নেওয়া। আমি দেখি এই দুইটাই পথ/ আপনাদের কী মত?

এখন যদি পারি আইন হাতে তুলতে/ তাইলে তো অবশ্যই ভুল করছি অতীতে। সেদিন যদি হাতে তুলতাম আইন, তাইলে কি আর মরতাম এত কষ্ট আর জ্বালায়/ লেখাপড়া শেষ না কইরা গ্রামে দিতাম সমবায়?

অতীত নিয়া চিন্তা কইরা কিছুই হয় না আফসোস ছাড়া/ কিছু করতে না পারলেও ভালো হইতো কি, অন্যায় সহ্য করা?

যখন গ্রামে ফিরলা লেখাপড়া শেষ না কইরা/ কত কান্নাকাটি করছি তোমাদের হাত ধইরা। তোমার আমাদের বুঝাইলা, ইম্বারসিটিতে একটা অন্যায় ঘটনা ঘটছে/ কোন এক ছাত্র নাকি আরেক ছাত্র মারছে। অনেক প্রতিবাদেও যখন কাজ হইলো না/ তোমরা তখন ঠিক করছো আর পড়বাই না। পড়বা না ভালো কথা, কিন্তু গ্রামে ফিরা কী হইবো? গ্রাম তো না য্যান কবরখানা/ এইখানে না খাইয়া মরা ছাড়া উপায় দেখি না। তোমরা তবুও গো ধইরা বইসা থাকলা, বললা- চাচা, কুত্তার সাথে এক পাতে ভাত খাওয়া/ এর চাইতে অনেক ভালো না খাইয়া মইরা যাওয়া। তোমাদের যে জিদ তার সাথে কি আমরা কুলাইয়া উঠতে পারি/ হঠাৎ বললা, চলেন চাচা. একটা সমবায় গড়ি। ক্যামনে ক্যামনে দিন রাইত খাইটা, এই গ্রাম ঐ গ্রামের সবাইরে নিয়া সমবায় করলা, গরুর বিরাট ফার্ম দিলা/ সব আল্লাহর ইচ্ছা, আমরা খালি উসিলা।
 
জিদের কথা কন চাচা। এই গ্রামে কী না ঘটছে/ পোয়াতি বউরাও দিনের পর দিন না খাইয়া রইছে। কাইল রাইতের ঘটনা আবার ঠেইলা দিল না খাওয়া দিনে/ কোনো সমস্যার কি সমাধান পামু না- এ জীবনে?

আমি যাই।

কই?

তারে যেখানে পাই/ ধইরা আনাই/ তারপর জিগাই, ক্যান ঘটাইলো এমন ঘটনা।

যদি কয় যা করছি ঠিক করছি।

তাইলে  হয় সে মরবো নইলে আমি মরছি।

মাথা গরম কইরা কিছু হয় না তা নিজেও জানস/ তবু ক্যান খামাখা নিজের বিপদ ডাইকা আনস?

বিপদ? সে যে বিপদে ফেলছে, এর চাইতে বেশি বিপদ কী হইবো তারে মারলে/ ভবিষ্যতে জানে মারবো, এইবার ছাড়লে।

কান্নার শব্দ শোনা যায় বাতাসে। মায়ের কান্না, বোনের কান্না প্রকম্পিত করে আকাশকে। একজনের কান্নায় সংক্রমিত হয় অন্যজন/ শব্দে আর নিঃশব্দে কেঁদে চলে আর দশজন।
 
খালি কান্দে, কান্দন ছাড়া বোধ হয় নাই আর কিছু। সুখের মুখ দেখতে না দেখতেই আবার আসে চোখের পানি/ কবে শেষ হইবো পরাণের এই ছটফটানি?

কী জানি!

নিজেরা যদি এর বিহিত করি/ পরে যদি আবার মসিবতে পড়ি। আমার মনে হয় আইনের হাতেই তুইলা দেই তারে/ দেখি আইন তার কী করে। কী হইলো কান্না থামে না এখনো?

ক্যামনে থামবো? কেয়ামতের আগুনের কথা শুনছি মৌলভীসাবের মুখে/ সেই আগুন কাইল দেখলাম আমাগো নিজ চোখে। ক্যামনে থামবো কান্দন/ আপনিই কন।
 
বুকের মধ্যে কি আমারও কান্না জমা নাই/ কিন্তু কান্না চাপা দেওয়া ছাড়া তো কোনো উপায় নাই। কাইল রাইতে যে দিকে যাই/ কান্নার শব্দ শুনতে পাই/ আগুনের পর আগুন দেখতে পাই/ এই বুকের কষ্ট ক্যামনে দেখাই?

মা কান্দে বইনে কান্দে
বুকে কষ্ট লাগে
পরাণ ফাইটা কষ্ট আসে
শকুন খালি হাসে ...

সুধী দর্শকমণ্ডলী, এই জনপদে এক করুণ ঘটনার অবতারণা হয়েছে গতরাতে/ সান্ত্বনা পায় না গ্রামবাসী কোনোমতে। এত বড় দুর্ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না/ সারারাত তারা কিছু করে নি আনন্দ স্ফূর্তিবিনা/ কিন্তু ভোররাতেই ঘটে নিদারুণ ঘটনা। এই ঘটনার শুরু অনেকদিন আগে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন ছাত্র- চলে আসে গ্রামে/ চূড়ান্ত পরীক্ষা না দিয়ে। অনেক জোরাজোরিতেও ফেরার আসল কারণ তারা বলে না/ শুধু বলে এমন অন্যায় সহ্য করা সম্ভব না। তারপরও মাঝে মধ্যে একটু আধটু কারণ বলে/ তার কিয়দংশ নিশ্চয় শুনেছেন সকলে/ একটু আগে/ তাদেরই কথোপকথনে। যাক্, গতরাতে যে ঘটনা ঘটে/ তার শুরুটা ছিল অনেকদিন আগে। সমবায়ের মাধ্যমে গরুর যে ফার্ম দিল/ সেটাই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এই জনপদের কৃষক ফসল ফলায় সেই গরু দিয়া/ চলেন দর্শকমণ্ডলী, পৌঁছাই অতীতের সেই ঘটনায় গিয়া-

এই লোকালয়ে মৃত্তিকায় কৃষক চাষ করে/ হুর...র...র হাট্ হাট্ ধ্বনি মুখে আনে কৃষকে। ক্ষেতে গরুর পাল কৃষকের সম্মুখে ধাবিত হয়। মৃত্তিকা কর্ষিত হয়/ তারে ফসলের প্রস্তুতি পর্ব কয়। বাউল আর কৃষক সবাই একাকার/ গানের ধরন শুনে বোঝা যায় না মূল সুরটি কার। হউক তা বাউলের কিংবা গাইতে থাকুক কৃষক/ গরু, চাষী বিশ্রামে যায় শেষতক। বিশ্রাম নেয় তারা কর্ষিত জমির কিনারায়/ মন দেয় বউ-কন্যার হাতে আনা দুপুরের খানায়। খানা শেষে হুকু টানে একজন আরেকজনের পরে/ আনন্দের উচ্ছ্বাস ছড়ায় তারা পরষ্পরে।

ফসল যদি হইয়া যায় সবুজ, মনের মধ্যে আসবো স্ফূর্তি। সোনালি হওয়ার অপেক্ষায় করুম ছট্ ফট্/ মাতব্বরের চোখ তখন করবো কট্ মট্।

গরুর জন্য জমিগুলা কাঁদতো দিন রাত/ গরুর অভাব মিটে যায়, জমি আমার হাসে, হাসে য্যান পূর্ণিমার চাঁদ।

ফার্মের গাইয়ের দুধ চলে যায় ঐ-ঐ গ্যারাম। আমার বাচ্চা দুধ খায়, তোমার বাচ্চা দুধ খায়। দেখছি যেমন আমার দাদার শরীর/ তেমন শক্ত শরীর হবে আমার নাতির। এ কার পূণ্য?

পূণ্য যদি হয় তাইলে তা তাদের/ যারা আল্লাহর উপর জায়গা দেয় আমাদের/ আমাদের জন্য খোদা, খোদার জন্য আমরা না, এমন বিশ্বাস আছে যাদের।

কতদিন ঘটছে কত কী/ মনে পড়ে নাকি?

কী?

মনে কি কিছুই পড়ে না?

মনে তো পড়ে অনেক কিছু। একবার বন্যায় ভাসায়া নিল আমার সোনার ধনেরে/ দুইদিন পর মনার লাশ পাই উজানপুরের ঘাটে/ দেখি দুই কুত্তা তার লাশটা চাটে।

বন্যা হয় প্রতিবার/ হাত নাই কারো ঐ পানি ঠেকাবার/ কিন্তু কিছুই কি মনে পড়ে না আর?
 
কী?

কী এমন মনে পড়ার আছে? কন দেখি/ মনে পড়ে নাকি।

মনে পড়ে না, হিংসা কইরা বিষ দেয় পুকুরে, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ/ পানির মধ্যে ছটফটায় মাছ, য্যান বাঁশঝাড়ে ছটফটায় জাউল্যা বাড়ির বউ?

হ্যাঁ, মনে পড়ে। মনে পড়ে আমাদের মধ্যে কেউ, আসতো আমার ক্ষেতে/ সোনার ফসল একভাগ আমার, দুইভাগ তার পেটে।

আল্লাহর কি পড়ছে গজব তাদের উপর? যদি পড়তো গজব, বিশ্বাস লয় আছেন আল্লাহ। কিন্তু এখনো তারা গ্যারামের মাথা, মাতব্বর/ সব মাফ যদি চুরির টাকায়ও দেয়া যায় মসজিদ ঘর।
 
আরে ও চাচারা, ও ভাইয়েরা/ আছ ক্যামন সকলে তোমরা?

ভালো।

হাসি মুখটা যখন দেখি তোমাদের/ খুব শান্তি হয় পরাণের। কিন্তু এমন শান্তির মধ্যে যখন দেখি পোকার উৎপাত/ এই পরাণেই তখন পাই নিদারুণ আঘাত।
 
কিছু কি ঘটছে এরই মধ্যে?

কিছু কি ঘটছে? খারাপ কিছু, য্যান শুকায়া গেছে খাল/ আবার দেখতে পামু ফসলের আকাল?

চুপ কইরা আছ ক্যান? কি এমন ঘটছে যা পোকার উৎপাত মনে হয়/ তোমাদের মতো মানুষের মনে জায়গায় কঠিন ভয়?

কও, চুপ কইরা আছ ক্যান?

কন্, কথা কন্ না ক্যান? কন্ কী ঘটছে।

অথবা এমন কিছু কি ঘটছে, যখন দিন রাইত শকুন করে দোয়া/ চক্ষের সামনে য্যান দেখতে পায় আস্তা গরু মরা?

এর চাইতে বড় কিছুও হইতে পারে/ তোমাদের মুখে থাকুক ভাত কয়জনে তা সইতে পারে?

খোলাসা কর।

খোলাসা করেন ভাই।

সকাল সকাল গেলাম, যেমন যাই প্রতিদিন, ক্যামন আছে দেখতে গরুগুলান/ গিয়া দেখি মইরা আছে গরু দুইখান/ কে য্যান করাইছে বিষ পান।

শহর থিকা চইলা আসলাম গ্রামে/ একটা দুইটা না, ৭১টা গাভী-গরু আমাদের ফার্মে। এই দেখে চোখ কপালে তোলে মাতব্বর/ দেখতে ঠিক মনে হয় মানুষখোর। কয়েকদিন আগে, তার উঠানে ডাক দিল আমাদের/ সেই রাত্রে পুরা আলো ছিল চান্দের। উঠানে বসায়, চেয়ার পাতে, নাস্তা আসে/ মাতব্বর শালায় কী য্যান কওয়ার জন্য খামাখা কাশে-

তোমরা শিক্ষিত পোলাপান/ গ্যারাম না, শহরের দিকে থাকার কথা তোমাদের মনের টান। তবুও আছো গ্যারামে, শিক্ষিত যুবক, মনে ভরসা পাই/ কিন্তু এগুলা কী দেখতে পাই?

কী, কী এমন দেখতে পান্, কন চাচা আমাদের/ অবশ্যই করুম না সেই কাজ, যদি ইজ্জত যায় গ্যারামের।

ছিঃ ছিঃ ইজ্জত কিছুই যায় নাই বাবা’রা/ কিন্তু গরু, ছাগল পালা, এগুলা তোমাদের কাজ না, এগুলা করব ছোটলোক যারা।

ঐ ছোটলোক কারা?

ঐ যে তারা, ছোটলোকের পাল/ যারা এখন কিনে নেয় জোড়া জোড়া হাল।

ওরা করে চাষ, ফসল বেচে বাজারে/ সেই ফসলে আমরা জুড়াই পেটটারে। ক্ষতি কী, যদি নিয়া আমাদের হাল/ তাদের ঘরে ওঠে দু’মুঠো চাল?

ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুক/ ভগবানের আশির্বাদ তোমাদের উপর পড়ুক। মণ-এ মণ-এ দুধ হয় তোমাদের ফার্মে/ সেই দুধ খায় গ্যারামের সব পরিবারে। এমন সস্তা তোমাদের দুধ/ খাইতে পায় তারাও, যারা পাইতো না আগে চাউলের খুদ।

ক্ষতি কী তাতে চাচা?

ক্ষতি তো কিছু আছেই। সারাজীবন ঘুরলো যারা, আমাদের পিছু পিছু/ এখন দেখা হইলে ছোট্ট একটা সালাম ছাড়া দেয় না বেশি কিছু।

তা, এখন আমরা করতে পারি কী?

ফার্মের চিন্তা বাদ দাও/ গরু গাভী বিক্রি কইরা যা পাও/ দোকান দেওয়ার উদ্দেশ্যে শহরে চইলা যাও।

দোকান। কিসের দোকান?

দোকান! কিসের দোকান! দোকানের আছে নাকি অভাব? মুদির দোকান, জুতার দোকান, দোকানের আছে নাকি অভাব/ সব কিছুতে চমকে ওঠা তোমাদের স্বভাব।

গরু বিক্রি করলে বন্ধ হইবো চাষ/ কৃষকের ঘরে দুঃখ থাকবো, থাকবো বারোমাস। ফসল যদি না-ই হয় দোকান দিয়া হবেটা কী?

আমরা কী জানি?

আমরা কী জানি! আপনারা জানেন না তো জানবে কে/ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষ করে যে সে?

বড় ভুল করতাছ বাপজান/ এই জগতে নিচুজাত, উঁচুজাত, সব লিখেছেন ভগবান/ এ-ই তিনি চান।

নামাজ ঘরে মুয়াজ্জিন দেন আযান/ মোল্লা-মাতব্বর-কৃষক-চাষি নামাজ পড়তে যান। আল্লাহ তা’য়ালার মর্মবাণী সব মানুষই সমান/ এই বিশ্বাসেই তখন সবাই এক কাতারে দাঁড়ান/ নামাজ শেষে বাইরে এসেই সেইটা ভুইলা যান?

আরে কিসের মধ্যে কী/ পান্তা ভাতে ঘি/ বুড়া মানুষের দাঁড়িরে কও শনপাপড়ি। এত কথার প্রয়োজন তো দেখি না/ ফার্ম বিক্রি করবা আমার কাছে, এ কথার নড়চড় হবে না। যাও, যাও তোমরা সবাই/ আমরা যা পারি, তা আমরা দেখাই।
 
        মাটি কান্দে কান্দে মাটি
        ফসল ফলার লাগি
        গরু আসে কৃষক আসে
        মইয়ের উপর বসি।
        মই ভাইঙা দেয়, হাত কাইটা দেয়
        এমন দুঃখ দুঃখ এমন
        ক্যামনে সইতে পারি।

যা দেখাতে পারেন, তারা তা দেখান/ তার-ই কি ফল গরু দুইটার বিষপান?

চিন্তার কিছু নাই, যদি ঠিক মতো ফসল ফলাই আমরা হবো স্বনির্ভর/ মোল্লা-মাতব্বর, বামুন-পৈতা এসবেরে কিসের ডর?

আপনারা যদি না ডরান তবে আমাদের কিসের ডর? ঠিক আছে, ফসল ফলান সবাই/ আমরা আপাতত যাই।
 
ফসল ফলে, এই মাটিতে ফসল ফলে/ কৃষকের ঘামে। ফসলেরে জড়ায়ে ধরে/ যেমন শিশু চলে যায় মায়ের বুকে। এই জনপদে, ফসল তোলার উৎসবে মেতেছে সবাই/ ননদের সাথে নেচে চলে বোনের জামাই। বিয়ে হয় নি এক যুবতীর বাপের মেয়ের/ তার সাথেই বিয়ে হচ্ছে পাশের-বাড়ির ছেলের। ধান এসেছে উঠানে, ধান ভরছে গোলায়/ সেই ধানের পিঠা খায় উত্তর-বাড়ির খালায়/ একলা ঘরে মোড়লসাব কেবল ছট্ফটায়। সবার ডাক পড়ে আজ মোড়ল বাড়ির উঠানে/ কী ফন্দি আঁটে মোড়ল, তা শুধু সে-ই জানে।

আরে খাও, খাও। সবার গোলায় ধান, ভবিষ্যতে থাকবো মাছ পুকুরে/ আল্লাহর ইচ্ছা সব, সবই সে করে।

ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুক/ ভগবানের আশির্বাদ তোমাদের উপর পড়ুক। কৃষক ভায়েরা, বলো দেখি তোমরা এখন/ এত যে আনন্দ, লাগতাছে কিসের মতন?

কী যে কন, এত আনন্দ, এত সুখ, এর ভাব কি যায় খোলাসা করা/ চোখের সামনে দেখতাছি য্যান আস্তা শকুন মরা।

যাক্, যাক্, সবই আল্লাহর ইচ্ছা, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি বিনা বান্দার আয়ু এক নিঃশ্বাস/ এখন নিশ্চয়ই ফিরা পাইছ আল্লাহর উপর বিশ্বাস।

যা হারায় নাই তারে কি ফিরা পাওয়া যায়? এত কষ্ট, এত অভাব, তবুও বন্ধ ছিল না মসজিদে যাওয়া, বন্ধ ছিল না মূর্তিপূজা/ খোদা ভগবানের উপর থিকা বিশ্বাস যাওয়া কি এতই সোজা?  

অবশ্যই, অবশ্যই। তবুও, অভাব কিছু কিছু ধর্মকর্ম থেকে মানুুষেরে করে বঞ্চিত, সেটা আমরা সবাই জানি/ এই ধর, বিগত বছরগুলোতে দিতে পার নাই কেউ কোরবানি।
 
আল্লাহ তুমি মাফ কর আল্লাহ।
আল্লাহ রাহমানুর রাহিম, তুমি ক্ষমা কর মা’বুদ।

হে আল্লাহ, বুজের বয়স হওয়ার পর, মনে পড়ে না ইচ্ছা কইরা করছি কোনো পাপ/ অভাবের জন্য কোরবানি দেই নাই, তবুও কি হবে দোজখের আজাব? পেটে ভাত নাই, চুলাতে আগুন নাই, দিতে পারি নাই কোরবানি/ এটা কি পাপ, কী জানি!

অবশ্যই, অবশ্যই। তবে তিনিই পরম করুণাময়, তিনিই রাহমানুর রাহিম। ক্ষমা যদি করতে হয় করবেন তিনিই। সামর্থ ছিল না দেও নাই কোরবানি, সেটা ভিন্ন কথা/ পাপ সকল মাফ হয়, যদি পাপী মনে পায় ব্যথা। এবার তোমরা সচ্ছল, গোলায় ভরা ধান/ যদি ঈমানটারে ফেরৎ চাও, আল্লাহর পথে কইরো কিছু দান।

কী যে কন। যে উৎসব নিয়া এখন সকলেই নাচি/ আল্লাহর পথে করব দান, যদি বাইচা থাকি।
 
অবশ্যই, অবশ্যই। তাইলে কথা দেও এখন/ কয়েকদিন পর, কোরবানির ঈদ আসব যখন/ কোরবানি দিবা তোমরা নিজের সাধ্য-মতন।
 
অবশ্যই, অবশ্যই।
 
তোমরা গরীব চাষী। গরীব হইলেও ঈমান তোমাদের শক্ত সেটা জানি/ তোমাদের মা-বইনেরা পর্দানশীল সেটাও মানি। কিন্তু কথা হইল, এই গ্যারাম সেই গ্যারাম, সব গ্যারামের মানুষ যখন দিবা কোরবানি/ ভাইবা দেখছ একবার, এত গরু ক্যামনে হইব আমদানি?

ক্যান, উত্তরের গঞ্জে, দক্ষিণের গঞ্জে, যে গঞ্জেই হোক, বসবো গরুর হাট। কিনে আনবো সবাই/ কোনো চিন্তা নাই।

চিন্তা আছে, চিন্তা আছে, চিন্তা আছে রে ভাই/ য্যান ত্যান গরু দিয়া কোরবানি দেওন নাই। বিজাতি দেশের গরু দিয়া কোরবানি দেওন নাই/ (রাগ করলেন নাকি ভাই/ আপনি যে পাশে আছেন সেইটা মনে নাই। যাক্, ফতোয়া যখন শুরু করছি, ফতোয়া দিয়া যাই/ বান্দির বাচ্চারা চইলা গেলে হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই)। কী য্যান বলতেছিলাম? ও, য্যান ত্যান গরু দিয়া কোরবানি দেওন নাই/ এমন কোরবানি দিতে হবে য্যান মনে কষ্ট পাই। তার মানে, সব চেয়ে খাঁটি হয়/ নিজের পালিত গরু নিশ্চয়।

আমাদের যে গরু নাই/ এখন তাইলে উপায়?

হায়রে, সেই দুঃখের কথাই আবার তুললেন? গরু যদি থাকতো নিজের/ তাইলে কী দরকার ছিল ফার্মের!

হায়রে আকাল, নিজের যদি গরু থাকতো/ তাইলে কি আর গোয়াল ঘরে বেড়া দিয়া রান্ধন লাগতো?

আমাদের যে গরু নাই/ এখন গরু কই পাই?

এইটাই তো ভাবনার বিষয়/ গরুর উপর মায়া না পড়লে কি কোরবানি হয়? আচ্ছা, তোমরা চাষ কর যে গরু দিয়া/ এখনো কি পড়ে নাই তাদের উপর মায়া?

কী যে কন। মায়ার কথা কী শেষ করন যায়? একদিন চাষ করতে গিয়া/ দুপুরে ভাত খাইতেছিলাম লবণ মরিচ দিয়া। হঠাৎ দেখি, লালা পড়ে একটা গরুর মুখ দিয়া/ চিকন তির য্যান বিনল আমার বুকের মধ্যে গিয়া। খাওয়া দাওয়া বন্ধ দিয়া, নিয়া গেলাম ফার্মে। জিরাইতে দিলাম, ভূষি দিলাম, ফ্যান দিলাম, দিলাম খাইতে ঘাস/ সেদিনের মত বন্ধ রাখলাম আমার জমির চাষ। আপনিই কন, ভালো যদি না-ই বাসতাম/ সামান্য গরুর জন্য কি চাষ বন্ধ রাখতাম?

কয়েকদিন আগে খবর আসল, কারা য্যান মারছে আমাদের দুই গরু। বিষের জ্বালায় মরণ! ইস্, ইসসিরে বুক ফাইটা যায়। অনেকদিন আগে, এক গভীর রাইতে/ ঘরের বাইর হইছিলাম পেশাব সারতে। পূর্ণিমার সেই রাইতে বাঁশের মাচার উপর বসলাম/ ঠিক তখন, বাঁশঝাড় থাইকা কারে য্যান দৌড় দিতে দেখলাম। সেই রাইতে, সেই রাইতে বাঁশঝাড় থাইকা ছাড়া পাইলো জাউল্যা বাড়ির বউ/ ঘরে গিয়া বিষ খাইলো, আসল খবর জানলো না কেউ। সেই ছবি এখনো পষ্ট/ তারপরও গরুর মরণ দিল য্যান দ্বিগুণ কষ্ট। মানুষের মরণ আর গরুর মরণ এক হইয়া যায়/ এইডারে ভালোবাসা ছাড়া কী বলা যায়?

অবশ্যই, অবশ্যই। আল্লাহ তা’য়ালা তাই চান/ সবাই জান তবুও করি কিছু বয়ান। স্বপ্নে হযরত ইব্রাহিম দেখতে পেলেন, আল্লাহ তা’য়ালা দিতেছেন নির্দেশ/ প্রিয় পাত্রটিকে কোরবানির মাধ্যমে করতে হবে শেষ/ ঘুম থেকে উঠে ঠিক করেন, নিজের পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দিবেন শেষমেশ। পারছিল কি দিতে ইসমাইলেরে কোরবানি?

আপন পুত্রের বদলে কোরবানি হইল দুম্বা।

ইব্রাহিমের ইচ্ছার কোনো ত্রুটি ছিল না। সুতরাং ত্রুটি করবা না তোমরাও/ সবচেয়ে প্রিয় গরু দিবা কোরবানি, কথা দিয়া যাও।

তার মানে হইল কী?

মানে হইল এই, কোরবানি দিবা তোমরা তোমাদের ফার্মের গরু। এই কথার য্যান না হয় নড়চড়/ মনের মধ্যে থাকে যদি আল্লাহ খোদার ডর।

আগামীতে তাইলে চাষের হইব কী?

যেই জন্য এই গরু, সেই গরু দিলে কোরবানি/ আগামীতে ফসল ফলবো ক্যামনে শুনি?

না’উজুবিল্লাহ। আইজ বাঁচলে কাইল ভবিষ্যত/ এর মধ্যে হইতে পারে তোমার আমার মউত।
 
ফার্মের গরুতে দেওয়া যাবে না হাত/ এই গরু কৃষকদের দিছে দু’চারটা ভাত। ওরা কৃষক, দিন আনে দিন খায়/ আপনি কী জানবেন, ওদের দিন ক্যামনে যায়? বহুদিন যখন অনাহারে ওরা ঘুরছে আপনাদের দ্বারে দ্বারে/ লাত্থি মাইরা খেদাইছেন তখন কোন ঈমানের জোরে? কন চুপ কইরা আছেন ক্যান, কন? যে গরু ফসল ফলায়, যে গরু সোনালি ধানে ভইরা তোলে ক্ষেত, যে গরু ছেলে মেয়েরে দেয় জামা-কাপড়, বউরে দেয় শাড়ি/ সেই গরু ধ্বংস করতে চান, বাটপারী?

বেশি কথা বাড়াইও না। কোনো লাভ হবে না। তোমরা শিক্ষিত মানুষ, বিদ্যা বুদ্ধি সব নিয়া যাইবা কবরে/ এই অশিক্ষিত চাষাদের যাইতে হবে ঈমানের জোরে। হযরত ইব্রাহিমের যে ত্যাগ, সমপরিমান ত্যাগ চাই তাদের থিকা। ক্ষেতের ধান, ফসল, এই সবের চেয়ে বড় হইল আল্লাহ খোদার মান/ পুত্রের মত যে গরু আছে তাদের, তাই দিব তারা কোরবান।
 
ইব্রাহিম কি পুত্র কোরবানি দিতে পারছিল শেষমেশ?

সবই আল্লাহর ইচ্ছা। মনের পরীক্ষায় পাশ করলো ইব্রাহিম। ইসমাইলকে কোরবানি দিতে ছিলেন তিনি রাজি। ছুরি চালানোর আগে ইসমাইলের গলায় তিনি দিলেন শেষ চুম্বা/ আল্লাহর কী লীলা, ইসমাইল রইলেন জীবিত জবাই হইল দুম্বা/ বলেন সোবহান আল্লাহ।

দুম্বা কি ইব্রাহিমের প্রিয় পাত্র ছিল?

অবশ্যই না, অবশ্যই না।

তাইলে ভাইবা দেখেন। এই যে গরীব কৃষক, তাদের সন্তান হইল ফার্মের গরু যত/ ঐ সন্তানের কোরবানি হবে না আপনার ফতোয়া মত।

না’উজুবিল্লাহ্। আগে তো খাস নিয়তে জবাই করতে যাক/ তারপর দেখা যাক ...
 
না, না, না,  কথা দিয়া যান/ হে আল্লাহ খোদা ভগবান/ কৃষক যখন দিবে গরু কোরবান/ ছুরির নিচে গরুর বদলে য্যান আপনারে দেখতে পান।

ক্যান, ক্যান, ওনারে ক্যান?

ক্যান? বুঝেন না ক্যান? গরুগুলা যদি হয় তাদের সন্তান/ মায়ার দিক দিয়া তারা ইসমাইলের সমান। ইসমাইলের বদলে যদি আমরা শোয়াই আমাদের গরু/ দুম্বার বদলে কোরবানি হউক ওনারে দিয়া শুরু। কী কন, জানোয়ার কোরবানি দিলেই তো হয়, তাই না? যদি জানোয়ার কোরবানি দিলেই হয়/ তাইলে সেই জানোয়ার আপনি নিশ্চয়।

জানোয়ার? দ্যাখ তাইলে কী করে জানোয়ারে/ শেষ হইয়া গেছে এই দুই চোখ একবার দেখছে যারে।

রাখে যদি আল্লাহ কে তারে মারে?

যার আঙ্গুল বাঁকা সে ভালো জানে ঘি ক্যামনে ওঠে/ আমিও দেইখা নিমু ঐ বান্দির বাচ্চাগো পেটে ক্যামনে ভাত জোটে।

চলে যায় মাতব্বর/ নবান্নের উৎসব চলে, নেচে ওঠে ঘর। আবার জমবে মেলা, বটতলা হাটখোলা/ ভরে ওঠে সবার ধানের গোলা। তাই উৎসব চলে। উৎসব চলে সারারাত ধরে/ এমন সময় আযান পড়ে মসজিদ ঘরে। মুয়াজ্জিন জানান দেয় ঘুম হইতে নামাজ উত্তম/ ততক্ষণে ফার্মে পৌঁছে যায় মাতব্বর যম।

হুমকি দিয়ে সরে পড়েছিল মাতব্বর/ ঈশান-কালো আভাস দেয় হইব এক ঝড়। সেই রাতেই মাতব্বর তার খেলা দেখায়/ আল্লাহর নাম নিয়া ফার্মে আগুন লাগায়। গরু চিৎকার করে হাম্বা রবে, মানুষ ডাক দেয় জোরে আল্লাহ-ভগবান/ শুকরিয়া ক’রে মাতব্বর লাল শিখার দিকে তাকান। শস্যহীনা ছিল একদিন এই জনপদ/ জমি-গরু-কৃষক হলো এক পরিষদ। এই পরিষদে ভাঙন দিল আগুনের শিখা/ গরীবের নিঃস্ব হওয়া য্যান কপালের লিখা। গরুর লাল আর মানুষের লালে হয় ঐ রক্তক্ষরণ/ এভাবেই উৎপাদিকা শক্তির হয় অকাল মরণ।

সুধি দর্শকমণ্ডলী, এই করুণ ঘটনাটি ঘটে গেছে কালরাতে। এই জনপদের, এই সকল জনগণ, সুখের চেয়ে বেশি অভ্যস্ত দুঃখ দেখতে/ তবুও যেন গতরাতের ধ্বংস তারা পারছে না সইতে। সে কি ভোলা যায়/ বোবা পশুর পোড়া গন্ধ, আকাশমুখি লেলিহান শিখা/ যায় কি ভোলা? তাই এরাও ভুলতে পারে না, ওরাও চায় কিছু একটা করতে হবে এবার।
 
কী হইলো সবাই আবার চুপ মাইরা গেলা ক্যান/ বোবা পশুর মরণে, তোমাদেরও বোবায় ধরছে য্যান? কিছু একটা তো করতে হইবো নাকি/ চলো যাই, তুলি বিচারের দাবি।
 
কিন্তু কী করতে পারমু আমরা, বড় শক্ত ঐ মাতব্বর/ যদি আমাদের খুন করে, ঐ বোবা পশু খুনের পর?

আমাদের খুন করবো? আরে খুনের রাখছে কী বাকি/ গরু মরার পর না খাইয়া মরা ছাড়া উপায় আছে নাকি? দিনের পর দিন না খাইয়া মরমুই যখন/ মাতব্বররে সঙ্গে নিয়াই হউক না মরণ।

ঠিক আছে তাই হউক।

ঠিক  আছে তাই হউক।

হ. হ. ঠিক আছে তাই হউক।

দাঁড়াও। আমাদের তোমরা অকর্মা ভাবো/ একবার কথা দিছি না, যত বিপদ একসাথে সামলাবো? আমাদের একজনের কষ্ট যদি আরেকজন না বুঝতে পারি/ মাতব্বরের হাতই কেবল হইবো ভারী। আমরা নিজেরাও জানি, বড় বেশি দরকার এই ঘটনার বিহিত করা/ সৎ মানুষের কাজ না অপরাধ নীরবে সহ্য করা। ঠিক আছে, সময় নষ্ট কইরা আর লাভ নাই কোনো/ তার আগে আমার কথা মনযোগ দিয়া শোনো। আমরা এখন যাব উপজেলা সদরে/ এই ঘটনার ভার দেব আইনের লোকেরে। আইন নিজের হাতে তুলবেন না- এ কথা সবাই বলেন/ আমরাও আইনের হাতেই তুইলা দেই সব, চলেন, সবাই চলেন-
 
যায় রে ওরা যায় রে
বিচার চাইতে যায়
যায় রে ওরা যায়
(সু)বিচারের আশায়
পশু হত্যার নিষ্ঠুরতার
বিচার ওরা চায়
সব হারানোর বেদনাতে
বুক যে ফাইটা যায়
যায় যায় যায়
হায় হায় হায়
ওরা চায় চায় চায়
চায় রে ওরা চায় রে
সঠিক বিচার চায়
বিচার চাইতে গিয়া ওরা
যার দেখা হায় পায়
কণ্ঠ শুনেই তাদের মাথায়
রক্ত চইড়া যায়,
কণ্ঠ শুনেই তাদের মাথায়
রক্ত চইড়া যায়
কণ্ঠ শুনেই তাদের মাথায়
রক্ত চইড়া যায়।

আরে আসো, আসো। বসো, বসো তোমরা সকলে।

কে, কার কণ্ঠ!

কণ্ঠ অপরিচিত লাগে ক্যান?

কে, কার কণ্ঠ?

এত বিস্মিত হও ক্যান তোমরা?

কে, কার কণ্ঠস্বর?

হাঃ হাঃ হাঃ আমার, আমার কণ্ঠস্বর রে ভাই।

তুমি। এখানে কীভাবে/ কেমন করে এখানে?

আপনি। এখানে কীভাবে/ কেমন করে এখানে?

যার থাকার কথা যেখানে/ সে-ই তো থাকে সেখানে।

আমরা কি সঠিক জায়গায় এসেছি?

তা-ই তো দেখছি।

তবে, নেই কেন সঠিক লোক, এই সঠিক জায়গায়?

কেন, আমার কাছে আসা যায় না, বিচারের আশায়?
 
অনেক কিছুই তো হয়/ কিন্তু হওয়ার তো কথা নয়। হওয়ার কথা যেমন/ কেনো দেখতে পাই না তেমন? তবে কি ওরা আমাদের আগেই পৌঁছে গেছে শিখরে/ ফেলেছে কি আমাদের ঘিরে? তবে কি সামান্য অসতর্কতা, যা কেউ ভেবেছিল, এ আর এমন কী/ সেই অসতর্কতার ফলেই আমরা আজ তার মুখোমুখি? হ্যাঁ, হতে পারে, তা-ও হতে পারে। যে কাঁটা তোলা সহজ সময় থাকতে/ শরীরে পচন ধরায় তা নিজের অজান্তে। কী দেখি, কী দেখি আমরা এই চোখের সামনে/ লাল রঙ ধরে ঐ নীল আসমানে/ নীল রঙ ধরে পূর্ণিমার চাঁদে/ শকুনরা সব খেলায় মাতে। দর্শকমণ্ডলী চলেন একবার, কয়েক বছর আগের সেই বিভৎস রাতে/ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে-

আল্লাহু-আল্লাহু-আল্লা-আ-হু
আল্লাহু-আল্লাহু-আল্লা-আ-হু
আল্লাহু-আল্লাহু-আল্লা-আ-হু

আল্লাহু-আল্লাহু জিকির হয় মসজিদে। বিশ্ববিদ্যালয়/ মুক্তচিন্তার পীঠস্থান যার প্রতিশব্দ হয়- ঘটনার উৎসস্থল ছিল তা। জাতিসত্তাকে ভিন্ন স্রোতে বাহিত করার আকাঙ্ক্ষা ছিল যাদের, ধর্মীয় বিশ্বাস পুঁজি করে, বিশ্বাসকে অবিশ্বাস্য খাতে রূপান্তরের স্বপ্ন ছিল যাদের/ আজীবন দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে প্রভূর বন্দেগি করার বাসনা ছিল তাদের। সেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্মীরা ছিল উৎসস্থলের উৎসবিন্দু। যাই থাকুক উদ্দেশ্য/ বিন্দুটি ছিল না প্রকৃত কেন্দ্র। কেন্দ্র থেকে যখন নির্দেশ হয়/ বিভিন্ন কণিকায় তখন বিন্দুটি বিভক্ত হয়। বড় বেশি সুশৃঙ্খলিত এই বিভক্তি। এই সুশৃঙ্খল পদক্ষেপের শুরুটা ছিল এবাদতখানায়/ এমন কাজের জন্য উত্তম স্থান এবাদতখানাই মানায়। এবাদতের পর মোনাজাত হয়। নিঃশব্দে উঠে যায় কেউ কেউ এবাদত শেষে/ সবাই তো আসে না এবাদতখানায়, একই নিয়তে। তারপরও অবশিষ্ট এবাদতকারীগণকেও নিজেদের কণিকা মনে হয় না। সম্ভবত তাই/ তারা ভাবে, শেষবারের মত একবার চোখটা বুলাই/ কথাই তো আছে সাবধানের মার নাই। তারপরও অতি সতর্কতার জন্য দু’টি কণা পাহারা দেয় দু’টি দরজায়/ ভয় হয় পাছে তাদের শব্দ বাইরে চলে যায়। আজকের ইমাম সাহেব একজন শিক্ষার্থী, এই বিন্দুর প্রোটনের কাজ করে সে/ কাজ করে যায় শান্ত মনে। সে কথা বলে মৃদুস্বরে/ কণিকাগুলো সে কথা কীভাবে যেন বোঝে-
 
সম্ভবত এটা আপনাদের জীবনে প্রথম। জানি না আসলেই আমীর সাহেবরা কী চায়/ যা-ই চাওয়া হোক, সফল করা চাই আল্লাহর ভরসায়।

ঠিক এইটুকু বলেই দু’তিনটা কণিকা নিয়ে সে উঠে যায়/ এবং দরজা দিয়ে বাইরে পা বাড়ায়।

কখন? কোথায় প্রথম হবে শুরু?

এমন একটি প্রশ্ন তাদের থামায়/ তাই তারা একবার ফিরে তাকায়।
 
প্রস্তুত থাকেন/ ক্রমেই সব জানবেন। বলেই তারা চলে যায়।

আল্লাহু-আল্লাহু-আল্লা-আ-হু
আল্লাহু-আল্লাহু-আল্লা-আ-হু
আল্লাহু-আল্লাহু-আল্লা-আ-হু

তারা চলে যায়। তারা চলে যায় এক শিক্ষকের আস্তানায়/ শিক্ষক অনেক্ষণ ধরেই আছেন নিজের বাসায়। তিনি আজ বড় বেশি চিন্তিত/ অপারেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত হতে পারছে না নিশ্চিন্ত। দর্শনের শিক্ষক হিসেবে সবাই তাকে চেনে/ নিজেকে বিজ্ঞ দার্শনিকও ভাবেন মনে মনে/ আজ তাই সব কিছু মিলাতে চাচ্ছেন প্রাণপণে।

আসছো, আসো, আসো।

খুব কি চিন্তিত? সিদ্ধান্ত কি হয়েছে পরিবর্তন/ আজ না কাল করলে ভালো হয় এমন?

না, তোমরা যাও, যখন যেভাবে পারি/ দেখা করব আমি। কাজ করে যাও যার যার/ প্রয়োজন নাই ফের দেখা করার।
 
হুকুমের দাস ওরা, অপারেশন হচ্ছে আজ রাতে/ তাদের মন আনন্দে নাচে/ চোখেতে খুনের ঝিলিক মারে।

শিক্ষকের গোপন আস্তানা থেকে মসল্লা নিয়ে যায়/ কাছে এসে বিদায়ী সালাম জানায়। সবার হাতে রূপালি ইলিশ চিক্ চিক্।

যায় রে ওরা যায়
রক্তের নেশায়
কার মায়ের বুকটা যেন
খালি করতে যায়
হায় হায় হায় হায়
হায় হায় হায় হায়

ওরা যায় রক্তের নেশায়। কিন্তু অন্যদিকে ক্যাম্পাসে চলে আনন্দ নৃত্য। এই আনন্দ সৃষ্টির, এই আনন্দ ধ্বংসের বিরুদ্ধে/ যেন শপথ হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাবে ওরা যুুদ্ধে। সবুজ বনভূমিতে রাত্রিকালীন চলাচল ও গান একতালে চলে/ গানের মাতন ক্রমান্বয়ে চলে যায় উচ্চতালে।

কিন্তু-

কিন্তু হঠাৎ করেই গান থামে।

চিৎকার শোনা যায় নারা’য়ে তকবির।

থেমে যায় সমস্ত চলাচল।

গান থামে কিন্তু উত্তেজনা বাড়ে। বুঝতে পারে না কী ঘটেছে/ ঠিক তখনই জানতে পারে এই সবুজ ক্যাম্পাস রঞ্জিত হয়েছে। একজন এবং কেবলমাত্র একজন শিক্ষার্থী/ উত্তেজনার সময় চিৎকার দেয় নি, পায় নি মুক্তি।

কেন এমন হলো?

কারণ হওয়ার কথা নয়/ এমন অনেক কিছু এদেশে হয়।

হয় বলেই হতে থাকবে? বার বার ভাঙবে আমাদের আশা?

কার প্রতি এই জিজ্ঞাসা?

তোমার প্রতি, আমার প্রতি/ যদি সবাইকে প্রশ্ন করি তাতেই বা কী ক্ষতি?

ক্ষতি আছে, কারণ উত্তর জানা নাই।
 
উত্তর বের করা ছাড়াও তো উপায় নাই।

ভুল করে না শোধরানো/ মানে দাঁড়ায় তাকে জট পাকানো।
 
কী ছিল ভুল?

শত্রুর কাজ সহজতর করেছিল যে শত্রু, পরাজিত করেও তাদের ক্ষমা করা/ ভুল কি নয়, সেই ভুলের মাসুল দিচ্ছে কারা?

তুললে অনেক পুরনো কথা। তারপরও বলি, যদি ভুল থাকে ক্ষমার ব্যাখ্যায়/ প্রকৃত ভুলটারে অন্যরকম দেখায়। মা-বোনদের ধর্ষণকারীরা নয়, ক্ষমা পাবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগহীন কয়েকজন/ এর ব্যাখ্যায় ভুল করে সবাইকে ক্ষমা করলেন পরেরজন/ এ সিদ্ধান্ত কেমন?

সিদ্ধান্ত ভুল হোক কিংবা ব্যাখ্যাই ভুল হোক, সত্য যা এখন/ জাতির পতাকা খামছে ধরেছে পুরনো শকুন।

যেকোনো কাজ শুরু করা যায় যেকোনো সময়ে/ এখন কি নামা যায় না শকুন নিধনে?

অবশ্যই যায়/ তবে, আগে বের করতে হবে নিধনের উপায়।

ঠিক আছে, আইন যেনো না যায় ভিন্ন কোনো খাতে/ মিলিত হবো আমরা শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সাথে। অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে অভিভাবক যারা/ জাতির বিবেক হিসেবে বুদ্ধিজীবী তারা-

যায় রে ওরা যায় রে
বিহিত করতে যায়
ছাত্র শিক্ষক সবাই মিলে
খুঁজিবে উপায়
পাশবিক আচরণ
তাদেরকে ভাবায়
হত্যাকাণ্ডের সমাধান
তারা এখন চায়
যায় যায় যায়
যায় যায় যায়
ছাত্র শিক্ষক বন্দি হয়
ভাবনার খাঁচায়
ছাত্র শিক্ষক বন্দি হয়
ভাবনার খাঁচায়
ছাত্র শিক্ষক বন্দি হয়
ভাবনার খাঁচায়।

আমার চিন্তার যা পরিধি/ এমন নৃশংস কাণ্ড ঘটাবে তারা, এটা কীভাবে বিশ্বাস করি?

চিন্তাশক্তির পরিধি নিয়ে নিশ্চয়ই নতুনভাবে ভাববেন/ এখন বরং ভাবুন এই পরিস্থিতি কীভাবে সামলাবেন।

এজন্য এতটা, একেবারে হত্যা- কী জঘন্য!

কেন, এই কাজ কি তাদের পূর্বসূরীর চেয়ে নৃশংস?

তাদের পূর্বসূরী কারা?

যাদের উত্তরসূরী তারা।

বড় একটা বিস্ফোরণের প্রয়োজন ছিল/ সেই সুযোগটাই ওরা আমাদের দিল। মৌলিক কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে আজ, এখন/ হয় ওরা মরবে নয় তো আমাদের মরণ।

বড় বিস্ফোরণ? একাত্তরের বিস্ফোরণের চেয়েও কি এটা ভয়ংকর/ ক্যান্সারের চেয়ে ভয়াবহ কি সামান্য একটু জ্বর?

একাত্তর ছিল আপনাদের প্রজন্মের ঘটনা। আপনাদের ব্যর্থতা, বোঝা, আমাদের কাঁধে/ সেই ব্যর্থতার শব্দ নাই আপনাদের বিবেকে।

শস্য বোনার সময় আগাছা পরিষ্কার করতে হয়, বোনার পরেও জমিন রাখতে হয় আগাছামুক্ত/ প্রথমটাই শুধু করেছিলেন, তারপর করেছেন কিছু যুক্ত?

তা কী করতে চাও?

এই শিক্ষাপীঠ হবে তাদের পদচিহ্নহীন।

তা কি সম্ভব, পর্যাপ্ত শক্তিবিহীন?

শক্তি নিয়ে সংশয় কেন?

সংশয় নয়, অনেক কিছু করা সম্ভব সবুজের পক্ষে। যদি জানতে পারতাম তোমাদের শক্তি কত/ যদি আমাদেরও থাকে কিছু করার মতো।

এই ক্যাম্পাস হবে তাদের পদচিহ্নহীন/ এর জন্য আমরাই যথেষ্ট আপনারাবিহীন। কিন্তু যদি পুরো জনপদকে করতে চাই কেবল আমাদের সবার/ তবে আপনাদেরই করার আছে, যা কিছু করার।

বল কী করতে পারি আমরা/ অবশ্যই আমাদের সাহায্য পাবে তোমরা।

আমি চিন্তা করতে পারি না/ এমন সাংঘাতিক একটা কাজ করতে পারে ওরা। কী করতে হবে বলো, যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করবো কানায় কানায়-

অভিভাবককে উপদেশ দেয়া কি সন্তানের মানায়? শিক্ষককে শিক্ষা দেয়া শিক্ষার্থীর সাজে? কী করবেন করুন আপনারা/ চিন্তা করব কী করণীয় আছে আমাদের, কী করতে পারি আমরা।
 
যায় রে ওরা যায়
দুর্বার গতিতে যায়
নিয়ম কানুন শৃঙ্খল
ভেঙে ওরা যায়

দর্শকমণ্ডলী, সে রাতে সিদ্ধান্ত হলো ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবে না তারা/ তারপরও আজ, এত উচ্চাসনে ওদের বসালো কারা?

নাও, একটু টানো, ঠিক আছে না টানলে থাক/ এবার তবে আসল কথায় আসা যাক। বলো, কোন মসিবতে পড়ছো তোমরা, কেন আমার কাছে আসা/ আমার যতটুকু সম্ভব করবো চেষ্টা/ ইনশাল্লাহ। খোদা আমাকে কিছু ক্ষমতা দিয়েছে তোমাদের দোয়ায়/ আসলে সবই করবেন তিনি আমার উসিলায়। বলো, বলো ভাই/ কী সাহায্য তোমাদের চাই।

কী সাহায্য চাইবো আমরা তার কাছে/ মানুষের রক্ত যে নিজ হাতে চাটে?

কিরে ভাই এখনো এত চুপ কেনো? সেই রাতের পর আজই প্রথম তোমাদের সাথে দেখা/ কেমন আছি জানতেও চাইলা না?

কেমন আছেন তিনি/ সে-তো ভালো করেই জানি। তিনি যে ভালো আছেন, এ ব্যাপারে না সন্দেহ হয়/ এভাবেই কি হবে তবে সত্যের পরাজয়? কিন্তু কেনো এই পরাজয়? ওদের কি তবে অনেক শক্তি/ যার ফলে খুনী হয়েও পায় মুক্তি? নাকি এমন কিছু ঘটনা ঘটে/ যখন দেখি দৃশ্যপটে/ আমাদেরই কারো না কারো ভুলের সুযোগে/ মুক্তি পায় তারা অকপটে?

ভাইরে বুঝতে পারছি রে ভাই, এখনো ভুলো নাই যা ঘটছে সেই রাতে/ কেনো বুঝতে পারো না সবকিছুর সমাধান হয় না আবেগ দিয়ে? আমিও কি ভুলতে পারি সেই রাতের কথা/ আমারে কষ্ট দিলা তোমরা অযথা। রাতে যখন অপারেশন শুরু করি, অঘটন কিছু ঘটবে তাতো আগেরই জানা/ কিন্তু একেবারে খুনই যখন করলাম, তখন বুঝতে পারলাম তোমরাও ছাড়বা না। আমি তখন ছুটলাম ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে/ মরার পরও কৈ মাছ যেমন তেলের মধ্যে নাচে। যেদিকে যাই, যে ঝোপেই লুকাই/ মনে হয় তোমাদের ছায়া দেখতে পাই/ বুঝলাম, একবার ধরা পড়লে আর মাফ নাই। এক ঝোপের মধ্যে নিজেকে আড়াল করলাম। চারদিক থেকে কেবল ঐক্যজোটের মিছিলের শব্দ শুনি/ আল্লাহ খোদার নাম ভুলে কেবল নিজের নিঃশ্বাস গুনি। হঠাৎ টের পাই, আছে, নিঃশ্বাস আছে, এখনো মরি নাই/ তখন, এক দৌড়ে ক্যাম্পাসের পেছন দিয়ে পালাই/ আর আমি ফিরে যাই নাই। কিন্তু ফিরে না গেলেই কি আর শান্তিতে থাকা যায়/ আজরাইলরে যে একবার দেখে সে চামচিকারেও ডরায়। আমিও বারে বারে ঘুমে কিংবা সজাগে কেবল দুঃস্বপ্ন দেখি। দুঃস্বপ্নে যখন বাহির হয় আমার শরীরের ঘাম/ ঠিক তখনই আমার কানে আসে সুসংবাদের পয়গাম-

হ্যালো, কতদূর করলেন, আর কতদিন?

বড়জোর হাতে গোনা যায় সেই কয়দিন।

কীভাবে সম্ভব?

যেভাবে হয় সব। আমি এখন শিক্ষক যেভাবে/ তোমারটাও হবে সেভাবে।

বড় অসহায় বোধ করি নিজেকে। একটা খুনকে কি মিথ্যে করা যাবে/ কোনোভাবে?

ত্রিশ লক্ষ খুন করলো নয় মাসে যারা/ বিচার দূরে থাক পুরস্কার পায় তারা। তোমার নামে তো খুন কেবল একটা/ বিচারটা হবে আরও সাদামাটা।

বুঝলাম না।

দুইটা বাচ্চা যখন দুধ খায়/ তিন নম্বরটা তখন খামাখা-ই লাফায়/ লাফাইয়া লাফাইয়া কি পেট ভরা যায়?

আরেকটু পরিষ্কার করেন।

প্রথম প্রথম তারা চাইতো সবার বিচার/ তাদের কয়েকজন এখন গন্ধ পায় আমাদের টাকার। তাদের এখন যুক্তি, খুনটা ছিল দৈবাৎ ঘটনা/ দুর্ঘটনার জন্য শাস্তি, মারাত্মক হবে না। ওদের পকেট ছাড়াও, নিহতের পরিবারকে দেব ক্ষতিপূরণ/ শপথ হবে আর যেনো না হয় ক্যাম্পাসে কোনো ছাত্রের মরণ/ বুঝলা, তাদের আন্দোলনের এমনই ধরন। যাক্, যাদের মাথা এখনো নামানো যায় নাই, আগামীকাল আবার বসবে তারা/ দেখবে পজেটিভ কিছু যায় কিনা আদায় করা/ সব আনকোরা, বুঝলা, সব আনকোরা।
 
একটা করুণ সুরকে ধারণ করে আবার ছাত্র-শিক্ষক সভা হয়/ সভার কথার ধরনেই বোঝা যায়, হয়ে গেছে মিথ্যার জয়/ তবুও তারা কথা কয়।

এমন একটা খুন, মিথ্যা হয়ে গেল, হাওয়া হয়ে গেল সমস্ত আয়োজন/ একবারও ভাবলাম না, ভবিষ্যতের খুন বন্ধ করতে এর বিচার প্রয়োজন? কিছুই কি করা হবে না নিহতের জন্য?

কেনো, শোন নি/ নিহতের নামে হবে একটি সরণী?

একটি রাস্তার নাম ওর নামে দিলেই কি হয়ে গেল সব কিছুর বিচার/ আমাদের কি আর আছে অধিকার/ এই ক্যাম্পাসে থাকার? একি দেখি, একি দেখি চারিদিকে, ছাত্রের রক্তে রঞ্জিত হলো যে পবিত্র ক্যাম্পাস/ সেই ক্যাম্পাসেই দেখি খুনিদের উচ্ছ্বাস। এ কীভাবে সম্ভব, সম্ভব না/ এভাবে চলতে পারে না।
 
গো ধরে বসে থাকে অবোধ শিশু যারা/ নিজের পাওনাটা বোঝে শুধু, বোঝে না অন্যের থাকতে পারে অসুবিধা। বিকল্প যা-ই দাও না কেন, যত মূল্যবান-ই হোক না তা/ অবোধ শিশু কিছুই নিবে না, নিবে প্রথম সে চেয়েছিল যা। তোমরাও সেই অবোধ শিশু, বুঝতে পার না বাস্তবতাকে/ গো ধরে বসে আছ, শেষ করতে হবে প্রাণসংহারীকে। তোমরা কি জানো না হত্যাকারীর হাত কত প্রসারিত/ উপর থেকে টেলিফোন আসে, বলে, পরিস্থিতি শান্ত করুন, অর্থ লাগে দিব, লাগবে যত। আমারইবা করার ছিল কী/ এই সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া শান্ত হতো কি পরিস্থিতি?

এ কেমন সিদ্ধান্ত? কেমন সিদ্ধান্ত নিলেন, কীভাবে মনকে মানাই/ মায়ের কান্নাকে অর্থহীন বলে ধিক্কার দিবে সবাই। পুরো ক্যাম্পাসকে, পুরো মানবতাকে নিরাপত্তাহীন করে/ প্রাণসংহারীকে মুক্তি দিলেন শুধুই অর্থের জোরে?

অর্থ? অর্থ দিয়েছে যা, তা তো করুণা করে। অর্থ যদি নাই-বা দিত, তাতেও করতে পারতাম কী/ আমাদের দুর্বল করতে যথেষ্ট কেবল একটা হুমকি। কতজনের কাছেই তো ধরণা দিলাম। যুক্তি দিলাম, প্রমাণ দিলাম, বললাম এ হত্যাকারী নয় কোনো আর-দশজন/ এদের বাপ-দাদারা নষ্ট করেছে আমার মা-বোন। কে শোনে কার কথা/ শুধু বলে আমাদের মাথা নাকি মোটা। আমরা নাকি কেবল বই পড়ি, বই পড়াই। ছাত্র-ছাত্রী আমাদের সব নির্বোধের পাল/ ওরাই কেবল বোঝে রাজনীতি, রাজনীতির চাল!

এমন সামান্য পরিস্থিতিতে হার মানলো যারা/ আগামী প্রজন্মের কাছে অপরাধী হবে না তারা? ভুুল তো হয়ে গেছে অনেক আগেই। লক্ষ লক্ষ খুনের দায়ে অপরাধী ছিল যারা/ সেই সব খুনীদের ক্ষমা করলো কারা? সেই ভুলের মাসুল দিতে হয় এখন আমাদের/ আবারও বুক খালি হয় তোমার-আমার মায়ের। কি দুঃসহ যন্ত্রণা!

কান্না শোভা পায় দুর্বলের চোখে/ অন্যের দোষ চোখে পড়ে নিজের কাছে। যে ভুলের জন্য দোষী আজ পূর্বসূরী/ আমরাও ঘৃণিত নই, যদি একই ভুল করি? শুধু একই কথা- ভুল, ভুল হয়েছে আগেই, ভুল হয়েছিল লক্ষ লক্ষ খুনের খুনীদের ক্ষমা করা/ আমরা কেমন মানুষ, আমাদের কি যুক্তি আছে সেই ভুলকে লালন করা?

যুক্তি, যুক্তি, যুক্তি। তোমাদের উঠতি বয়স, সবার উপরে স্থান দাও যুক্তিটারে/ আমরা প্রবীণ, মায়া পড়ে থাকে পরিবারে। আমরা আর কতদিন, কিছুদিন পর নেবো বিদায়/ তারপর তোমাদের যুগ, ক’রো  ইচ্ছে মতো, যুক্তি যা চায়।
 
প্রবীণ! প্রবীণ হয়ে তো জন্মান নি, সবুজ একদিন ছিলেন আপনারা/ সুন্দর চিনতেন না, সৌরভ চিনতেন না, চিনতেন না কিছুই ক্ষমতা অর্জন ছাড়া। বিদায় নেবেন ভালো কথা, কিন্তু আমাদের মত সন্তান আছে যতো/ তাদের জীবনটা করে গেলেন কুকুরের মতো। আপনারা যারা আমাদের পিতা, যদি থাকতেন আমাদের সাথে/ শত্রুকে শেষ করার দায়িত্বটা নিয়ে নিতাম কাঁধে। যাক্, সেই সৌভাগ্য আমাদের নাই। তবে শুনুন। এই বিশ্বাস আমাদের আছে, কাউকে ক্ষমা করলে হয়ত-বা মুক্তি পায় অভিশাপ/ কিন্তু অন্যের হননকারীকে ক্ষমা করলে হয় তা মহাপাপ। আমরা, যারা আছি, থাকবো অতন্দ্রপ্রহরীর মতো/ এ বিদ্যাপীঠে থাকবে না তাদের ছায়া, ভাসুক, ভাসুক রক্ত যত।

মা কাঁন্দে বাবা কাঁন্দে
আমার খোকা কোথায়
খোকার রক্ত শুকিয়ে গেছে
মুকুট খুনীর মাথায়
মা কাঁন্দে বাবা কাঁন্দে
আমার খোকা কোথায়
খোকার রক্ত শুকিয়ে গেছে
মুকুট খুনীর মাথায়

কিরে ভাই। নিশ্চুপ হইয়া গেলা ক্যান? যা হবার হয়ে গেছে বহুদিন আগে/ ঘটনা হয়ে গেছে অতীত, তবুও কেন মনে কষ্ট লাগে? শুভবুদ্ধির উদয় হয় না কেন রে ভাই? যা ছিলাম আগে হয়ত-বা থাকবোও তা বহুকাল পরে/ তাতে কিছু কী যায় আসে? একসাথে এই দেশটাতে মিলেমিশে থাকতে চাই আমরা/ তা-না, অতীত নিয়ে শুধুই ঘাঁটাঘাঁটি কর তোমরা। ওঠো, ওঠোরে ভাই/ আমার হাতে সময় বেশি নাই। এখনও তো বললাই না, কোন মসিবতে পড়ছো, কেনো আসছো আমার কাছে/ দাঁড়াও এইটা গিলতে থাকো, নামাজটা সাইরা আসি, ঠিক আছে?

দর্শকমণ্ডলী, নামাজ পড়তে গেছেন তিনি/ একাধারে যিনি বিচারক এবং খুনী। ঘটনা ঘটেছিল যা/ আপনারা দেখছিলেন তা। যে গরু ফসল ফলায়, রাজি হই নাই সেই গরু কোরবানি দিবার/ শুধু এই কারণেই মাতব্বর সমবায় করলো ছারখার। প্রথম থেকেই সমবায় ধ্বংস করা ছিল তার উদ্দেশ্য। সমবায় ছিল তার বিষের পাত্র/ কোরবানি ছিল ধর্মের উছিলা মাত্র। সেই পশু হত্যার বিচার চেয়ে আজ এখানে আসা। কিন্তু এখানে কি বিচার চাওয়া যায়? যে বিচারকের অভিজ্ঞতা আছে মানুষ খুন করার/ সে কি বিচার করবে সামান্য গরু মারার? বোতল রেখে উনি গেছেন নামাজ শেষ করতে/ এসেই আবার জিজ্ঞাসা করবেন পড়ছি কোন মসিবতে? আমি কী বলবো তাকে আমার মসিবতের কথা/ যেখানে আমি নিশ্চিত, এ কথা বলা বৃথা? এত জেনে আমি চাইতে পারি না বিচার তার কাছে/ প্রয়োজনে এক সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিব কী করার আছে। কিন্তু যে পশু হত্যা হয়ে গেল এই ছোট জনপদে/ এমন ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতি পদে পদে। আমরা চলে যাব। চাইবো না বিচার তার কাছে। কারণ আমরা জানি রক্তলাল হাত তার/ কিন্তু অপরিচিত জনগণ কি পাবে সঠিক বিচার? এমন ঘটনা যদি অন্য জনপদে ঘটে, আমাদের মতোই কেউ যদি তার কাছে আসে/ তবে কি সঠিক বিচার সে পাবে?

এমন প্রশ্ন যখন হয়েই গেল, তবে চলেন দেখি কী হয় ঘটনা তখন।
 
ঘটনা যদি এমন ঘটে থাকে অন্য জনপদে, তবে চলেন দেখি কী হয় বিচার তখন।
 
খুনের বিচারের ক্ষমতা যদি থাকে অন্য কোনো খুনির, তবে চলেন দেখি কী চলে খেলা তখন।
 
আপনার অভিযোগ?

সমবায় করেছিলাম আমাদের গ্রামে। ফার্মের গরু দিয়া কৃষক পেত চারটা দানাপানি/ ঐ গরুগুলোকে পুড়িয়ে মেরেছেন তিনি।

সঠিক কি অভিযোগ যা করলেন উনি?

হ্যাঁ, সবই সঠিক ঘটনা/ কিন্তু আপনি তো জানেন কিছুই ঘটে না কারণ-বিনা।

ঠিক আছে, দেন ঘটনার বিবরণ।

বিবরণ দেওয়ার মতো তেমন কিছুই নাই/ যে জন্য ঘটনাটা ঘটছে সেটা বইলা যাই। আল্লাহর রহমতে সমবায় দিয়া সচ্ছল হইছিল কৃষকেরা/ তাই বলছিলাম ফরজ আদায় কর ভালো কইরা। না, কিসের কী/ বুড়া আঙ্গুল দেখাইয়া কয়, এইডা দিমু কোরবানি।

কী এত বড় সাহস? কোন জাত/ ধর্মীয় অনুভূতিতে দেয় আঘাত?

বিজাত।

মানে, হিন্দু?

আরে, না।

তবে কি মুসলমান? এই আপনি কি মুসলমান?

তাই তো জানতাম।

তাই তো জানতেন! তারপরও নিষেধ করেন করতে ফরজ আদায়/ এমন নাফরমানী সহ্য করবে কোন হারামজাদায়?

আপনি কি ওনার কথাই শুনবেন/ নাকি আমাকেও কিছু বলার অনুমতি দিবেন?

বলেন।

সচ্ছল হইছিল কৃষক, একথা ঠিক/ এটা এই ঘটনার একটা দিক। এমন সচ্ছল তারা আগে ছিল না/ তাই তাদের সচ্ছলতা ওনাদের সহ্য হতো না। অনেকবার আমাদের ডেকে হুমকি দিতেন, যেন বন্ধ করি সমবায়/ তাহলে আবার হয় শোষণের উপায়। আমরা এ কথার পরোয়া করি নি/ আমাদের পথেই আমরা চলতে থাকি। তখন থেকেই ফন্দি আঁটে, কীভাবে ধ্বংস করবে সমবায়/ শেষমেশ গরুর ফার্মে আগুন লাগায়।

কিন্তু ঐ যে বলল, কোরবানির বিষয়, সেটা তো গেলেন এড়িয়ে/ সব ঘটনা তো ঐটাকে ঘিরে। কোরবানি দেয়ার জন্য তিনি দিয়েছিলেন নির্দেশ/ আপনারা অমান্য করেছেন আদেশ। ঠিক?

একদম বেঠিক। কোরবানি দিতে আমরাও ছিলাম রাজি/ কিন্তু ফার্মের গরু আমাদের একমাত্র পুঁজি। তাই বললাম সবাই মিলে গঞ্জে যাই/ গরু কিনে এনে করি জবাই। তা-না

না, না, নিজের থাকতে কিনে দিবেন গরু জবাই/ এমন বেশরিয়তি কথা তো কোনো কিতাবে লিখা নাই।

কিতাবে না থাকলে কিছুই করার নাই। আমরা করবো যা চায় আমাদের মন/ আপনি বিচার করুন কেন তিনি লাগালেন গরুতে আগুন।
 
ওনাকে কোনো প্রশ্ন করতে চাই না আমি। আমি বুঝেছি ওনার উদ্দেশ্য ছিল সৎ/ দ্বীনের পথে ডেকেছিলেন আপনাদের, আপনারা ধরেছিলেন ভিন্ন পথ। উনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন, ডেকেছিলেন ওনার কাছে। বুঝিয়েছিলেন সবার উপরে মানতে হবে তোমার ধর্ম/ আপনাদের প্ররোচনায় কৃষকেরা শোনে নি তার কথা, করে গেছে যার যার কু-কর্ম। এমন আদেশ উপরওয়ালার আছে, শোনাও তোমার ধর্মের কথা- তারপরও যদি করে তারা বিবাদ/ তাদেরই বিরুদ্ধে করবা জেহাদ। ঘটনায় মনে হয় ওনার উদ্দেশ্য ছিল জেহাদ করার/ শাস্তি হবে না তার/ পাবেন পুরস্কার।

আইন কি তাই বলে/ সুবিচারের দাবি কি যাবে বিফলে?

সুবিচার? সুবিচার তো এই, পাবে তা সাচ্চা ঈমানদার/ গরীব ধুকে মরবে, কারণ নিয়তিতে এ-ই লেখা আছে তার। আগামীতে খেতে পারবো কি পারবো না এটা নয় ভাবনার বিষয়/ সবার আগে তাই ফরজ আদায় করতে হয়। আজই যদি সে মারা যায়/ তবে ফরজ আদায় করবে কোন শালায়/ আপনার বাবায়?

হায়রে মানুষ, হায়রে মানুষ অবোধ/ ধর্মের কবলে নিঃস্ব হয় মানবতাবোধ।
 
জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি
দু’টি যদি জোটে
অর্ধেকে তার, ফুল কিনে নিও
হে অনুরাগী।

প্রথমে খাদ্য। যদি আরো থাকে সামর্থ/ কিনতে হবে সৌন্দর্য। আল্লাহ-ভগবান-ঈশ্বর/ তাদের অবস্থান তো আরও অনেক পর।

সুধি দর্শকমণ্ডলী, হয় না বিচার, পায় না বিচার। সঠিক বিচার পাওয়ার কথা নয়/ সঠিক বিচার আশা করা আমাদের ভুল, তাদের নয়। আমরাই তাদের একে একে বসিয়ে দিচ্ছি উচ্চাসনে/ আমরা ওদের ভুলে যাই কিন্তু ওদের থাকে স্মরণে। আমাদের কাঁধে আছে যুক্তি, মানবতা আর সভ্যতার দায়/ কিন্তু ওরা তো প্রাচীন বিশ্বাসেই বড় বেশি তৃপ্তি পায়।

সুধি দর্শকমণ্ডলী, যে দিকে যায়, চারিদিকে কেবল শক্র দেখতে পায়/ বারে বারে আমাদের আকাঙ্ক্ষা তাই শূন্যে মিলায়। ক্ষমা নয়, এখনো যদি করতে চাই পুরনো নতুন সবার বিচার/ আমাদের দাবায় এই সাধ্য কার?

কতোই বলার থাকে সব কি বলা যায়? কতো কিছু দেখাতে চাই দৃশ্যপটে/ সব কি পারি দেখাতে? ভাবনার হউক উদয়/ সত্য-মিথ্যা চিহ্নিত করার হোক বোধদয়। সময় যায়, সময় বহিয়া যায়/ একবার যে সময় যায়, সাধ্য কী কেউ তারে ফিরায়?

সময় যায়, যায় সময়, কিন্তু কোনো কিছুরই যায় না একেবারে সময়। সবার হাতেই শেষ সম্বল ‘সময়’ থেকে যায়/ সার্থক হবে এই দৃশ্যকাব্য, যদি আপনাদের মাথায় ভাবনা জাগায়।

চন্দ্রলোকে মনময়ূরী- কাব্যনাট্যের এই হলো শেষ কথা।

হাসান শাহরিয়ার  
১৯৯৪-’৯৫ ইং, শুক্রাবাদ, ঢাকা