Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

সৈয়দ জামিল আহমেদ ও তাঁর গ্রন্থিক ডিসকোর্স

Written by শাহমান মৈশান.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

এ হলো, পরিবেশনাকলার (পারফরমেন্স) রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যাওয়ার এক উদ্যোগ। এ হলো, বর্তমান বিশ্বের পেষণশীল কাঠামো যা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বৈচিত্র্যময়তাকেও ক্রমাগত নিষ্পেষণে একমেরুকৃত পৃথিবীর স্বতঃসিদ্ধতায় রূপান্তরিত করতে অধিপতিশীল, তার সাথে মোকাবিলার পন্থা আবিষ্কারের জন্য হৃদয়ের উত্তাপমাখা আমার এক অভিযান। তত্ত্বায়নের এই দলিল ...হলো ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক সংগ্রাম। ...এই সংগ্রামে বিধৃত হয় আমাদের পৃথিবীর নিত্য বাস্তবতাবোধ। এই পৃথিবীর নয়া-ঔপনিবেশিক বিপন্নতা একাধিপত্যকেন্দ্রিক বিশ্বায়নবাদী ক্ষমতা-সম্পর্কসমূহের অদৃশ্য হিংস্রতার পরিণতি আমি তো এক নিম্নবর্গ-মানুষ।- Syed Jamil Ahmed, Reading Against the Orientalist Grain: Performance and Politics Entwined With A Buddist Strain, P-10.

অহং একটি ভাষা। ভাষা একটি অহং। দুটোকেই নাকচ করার ভাষা সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার যৌথ আবহমানতার পটভূমিতে অর্থ ও যোগাযোগসংক্রান্ত ভাষার একচ্ছত্র স্বতঃসিদ্ধতার প্রতি সন্দেহ জারি করে অবতারণা করছি এই ভাষাপ্রকল্প। ভাষাকে নাকচ করে ভাষার ভিতর দিয়েই ডিসকোর্স গড়ে তোলার নিরূপায় অনিবার্যতাকে দ্যোতিত করা যায় লেখক ও অডিয়েন্স- এই দুই মেরুবর্তী এক পারস্পরিক মুক্ত দোলাচল হিসেবে। তাই অর্থ ও যোগাযোগের ট্রাম্পকার্ড দন্তবিহীন মাড়িতে বিদ্ধ (!) করে আমি সেই লেখকের মতো শিশুর দোলনায় দোদুল্যমান, যে শিশুর মতোই নির্বোধ কিন্তু সংবেদনশীলতা সংক্রান্ত তাৎপর্যের এক দ্বিধাগ্রস্ত রূপক। কিন্তু লেখকের দ্বিধা হলো অনিবার্য কপটতা। এই কপটতা গড়ে ওঠে সত্য ও সত্যের বিরোধিতায়। কেননা মুক্ত বলে প্রতীয়মান লেখকীয় সত্যের নির্মাণ ঘটে লেখকের সাবজেক্টিভ পৃথিবীর ফ্রেমে। আর লেখকীয় সত্যের বিনির্মাণ ঘটে ভাষাভিত্তিক সমাজ বলে অভিহিত আদিগন্ত অবজেক্টিভ পৃথিবীর বহুমুখী দ্বন্দ্বের সহিংসতায়। তাই লেখক ও পাঠকের সত্যের পথ-পরিক্রমা হলো নিজ ও অপরভিত্তিক সত্যের দ্বান্দ্বিক কুণ্ডলী। সুতরাং লেখক হিসেবে আমি নিজেকে নাকচ করছি পাঠকের সাথে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হওয়ার ভীতি কিংবা প্রেম থেকে নয়। নিজেকে নিজে নাকচ করার সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে অনুধাবিত হয় যে, পাঠক নিজের পাঠ-কেও নাচক করছে। এই দ্বিমুখী নাকচতা হলো দ্য গ্রেটেস্ট ‘নো’। প্রকৃতপক্ষে এই বিপুল ও পারস্পরিক প্যারাডক্সিক্যাল ‘না’-র ভেতর দিয়ে অর্থ নয়, পরিশেষে অহংকেই অস্বীকারের তীর্থযাত্রায় নির্মিত হয় লেখকের তাঁবু। তাই লেখকের অর্থগত সত্যসংক্রান্ত এ কোনো নির্বাণ প্রকল্প নয়। তাই শূন্যতার মধ্যে সম্ভাব্য হয়ে ওঠে লেখকের বর্জিত অহং। এই শূন্যতার মধ্যে চূড়ান্তভাবে দ্যোতিত হয় নিজ ও অপরের সংমিশ্রিত সত্যের প্যারাডাইম। তাই বর্তমান ভাষাপ্রকল্প হলো অর্থ ও সত্যের যৌথ এক সামাজিক কৃষিখামার। তাই রচনার কর্তৃপক্ষ লেখক নয়, জনতা। নাট্যকলাবিদ সৈয়দ জামিল আহমেদের গ্রন্থায়িত ডিসকোর্স ঘিরে যখন আলোচনায় অবতীর্ণ হচ্ছি তখন আমাদের ছাত্র-শিক্ষকভিত্তিক আধুনিকতাবাদী প্যারাডাইম কখনোই বিস্মৃত হই না। ছাত্রের এই ভাষাপ্রকল্পের উদ্দেশ্য অপরিসীম শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞতার শ্রদ্ধার্ঘ প্রদান নয়।

সৈয়দ জামিল আহমেদের দ্বারা উৎপাদিত নাট্যকলা সংক্রান্ত জ্ঞানপ্রকল্পে অংশগ্রহণই এই রচনার অভীপ্সা। তাঁর ডিসকোর্সে পার্টিসিপেট করার মধ্য দিয়ে নাট্যকলায় সন্ধিৎসু বাংলাদেশের বাংলাভাষী জনগণের সাথে সংলাপে অবতীর্ণ হওয়ার গন্তব্যে পৌঁছার উদ্দেশ্যই হয়ে ওঠে প্রধান। কেননা দক্ষিণ এশিয়ার পারফরমেন্স-পিপাসু মানুষের মহিমা থেকে জামিল আহমেদ যে ডিসকোর্স গড়ে তোলেন ইংরেজি ভাষায়- বাংলা ভাষায় সেই ডিসকোর্স ঘিরে একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ প্রয়োজনীয়। জামিল আহমেদের গ্রন্থিক অভিব্যক্তি সামুদ্রিক। আর সেই গ্রন্থ ঘিরে আমার বিচরণ প্রকৃতপক্ষে অপরিপক্কতায় আক্রান্ত। তাই তাঁর গ্রন্থিক প্রজ্ঞাকে আমি মোকাবিলা করি সজ্ঞান দিয়ে। এই আলোচনা মূলত কাঁপতে থাকা ভাষার এক ইনটুইশন কিংবা রেটোরিকস।

খণ্ড ও সমগ্রতার আত্মনিষ্ট ও বস্তুনিষ্ট বিপরীতধর্মী একটি সংমিশ্রণের ফেনোমেনা হলো গ্রন্থ। গ্রন্থের সন্ধানে

‘অচিনপাখি ইনফিনিটি : ইনডিজেনাস থিয়েটার অব বাংলাদেশ’, ‘ইন প্রেইজ অব নিরঞ্জন: ইসলাম, থিয়েটার অ্যা- বাংলাদেশ’ এবং বাংলা ভাষায় অপর দুটি গ্রন্থ-উত্তর ভারতীয় মুদ্রণ সংস্থা এণ্ডারসন কৃর্তক প্রকাশিত ‘রিডিং এগেইনস্ট দ্য অরিয়েন্টালিস্ট গ্রেইন: পারফরমেন্স অ্যা- পলিটিক্স এনটুইনড উইথ অ্যা বুদ্ধিস্ট স্টেইন’- শীর্ষক সর্বশেষ বইটির মধ্য দিয়ে সৈয়দ জামিল আহমেদ নাট্যকলার দেশজ অনুসন্ধান থেকে নিজেকে ক্রমাগত এশিয়া নাট্যকলা কিংবা পারফরমেন্স অধ্যয়নের এক বৃহত্তর বলয়ে নিয়ে গেছেন। লেখক হিসেবে জামিল আহমেদ দ্বিভাষিক হলেও মূলত ইংরেজি ভাষার মধ্য দিয়েই তাঁর তুঙ্গস্পর্শী আন্তর্জাতিক অভিব্যক্তি নির্মিত হয়েছে।

নাট্যকলা তথা পারফরমেন্স বিষয়ক পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিদ্যায়তনিক লেখালেখির মূলসূত্রে জামিল আহমেদ শুধু একজন ট্রাডিশনাল লেখক নন। তাঁর লেখকীয় সত্ত্বা গঠিত হয়েছে মূলত নাট্যকলা বিষয়ক নিজস্ব অনুশীলনের পাটাতনে। নাট্যনির্দেশক হিসেবে তিনি বাংলাদেশের নাট্যশিল্পে স্পষ্টতই নিজস্ব একটি স্কুলিং সৃষ্টি করেছেন। তাই জামিল আহমেদ এদেশের থিয়েটারে ব্যক্তি-ঐতিহ্যের রূপক। নাট্যকলার মধ্য দিয়ে উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতিসত্তার আত্মপরিচয় নির্মাণের পটভূমিতেই তাঁর নাট্যনুশীলন বিবেচনাযোগ্য। নিজের অনুশীলনের মধ্যে জাতির অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের জটিল সামষ্টিক আবহমানতাকে বিধৃত করার রাজনৈতিক লক্ষ্যেই তিনি দেশজ নাট্যকলা সংক্রান্ত নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। তাই নিজের সময়-চেতনা-ভিত্তিক নির্মাণকে জাতির প্রত্নতাত্ত্বিক আদলে জাস্টিফাই করার ঐতিহাসিক ও শৈল্পিক দায়বদ্ধতায় জামিল আহমেদ একজন নাট্যনির্মাতা থেকে নাট্যবিষয়ক গবেষক ও লেখকের বন্ধুর পথে গমন করেন। আর এই প্রক্রিয়ায় তিনি নাট্যকলা বিষয়ক একজন জৈবিক লেখকে রূপান্তরিত হন। নিজের প্র্যাক্টিসকে একটি সত্যিকারের দার্শনিক পটভূমিতে স্থাপনের লক্ষ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন লেখক। অর্থাৎ স্পষ্টভাবে নাট্যকলার প্রয়োগিক সূত্রে তাঁর মাধ্যমে সৃষ্টি হয় নাট্যকলা বিষয়ক জ্ঞানকাণ্ডের একটি ক্রম-নির্মীয়মান ধারা। আর তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক জামিল আহমেদের এই পেশাগত পরিচয়, অর্জন করে একটি অন্য তাৎপর্য। তাই নাট্যকলা বিষয়ক প্রথমত একজন কর্মী বা অনুশীলক, দ্বিতীয়ত একজন পণ্ডিত বা একাডেমিশিয়ান- এই ধারবাহিকতায় অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ আক্ষরিক অর্থেই রূপান্তরিত হন আন্তোনিও গ্রামসি কথিত যৌগিক বুদ্ধিজীবীতার স্তরে। নাট্যকলা বিষয়ক নিজস্ব অনুশীলনমূলক মোকাবিলা এবং জ্ঞানের প্রায়োগিকতার একটি পরস্পর নির্ভরশীল উভমুখীতার পরিপ্রেক্ষিতেই জামিল আহমেদের Reading Against the Orientalist Grain: Performance and Politics Entwined With A Buddist Strain- শীর্ষক গ্রন্থটি বিচার্য।

তাঁর এই বইটি মূলত এশিয়ার ৮টি পারফরমেন্স ঘিরে নির্মিত হয়েছে। নেপালের ‘চর্যানৃত্য’  ও ‘ইন্দ্রযাত্রা’, সিকিমের ‘পাঙতো ছাম’, তিব্বতের ‘ল্হামো’, ভুটানের ‘পারো সেচু', শ্রীলঙ্কার ‘দেবল মাড়ুয়া’, বার্মার (মিয়ানমার) ‘ইয়ক থে’ এবং বাংলাদেশের ‘বুদ্ধ কীর্তন’। এই ৮টি পারফরমেন্সের কেন্দ্রীয়-ভিত্তিসংশ্লিষ্টতা হলো বৌদ্ধ ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্রীয় প্রত্যয় অনিত্যতা সংক্রান্ত লেখকের অভিজ্ঞতার রূপায়ণ হলো এই গ্রন্থ। বৌদ্ধ ধর্মীয় এই পরফরমেন্সগুলো হচ্ছে চিহ্নের একটি জাল-ব্যবস্থা বা নেটওয়ার্ক। যেখানে চিহ্নের মাধ্যমে দ্যোতিত অর্থ ক্রমাহত অনিঃশোষিতভাবে প্রলম্বিত হয়, নির্মিত হয়। পারফরমেন্সের মধ্য দিয়ে সূচিত চিহ্নব্যবস্থার দ্যোতক (Signifier) এবং দ্যোতিত (Signified) অর্থ প্রকৃতপক্ষে নিয়ত প্রবহমান। ভূমিকায় জামিল আহমেদ ৮টি পারফরমেন্সের বিশ্লেষণাত্মক সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেন। Deciphering Bathesian Myths in the Nepalese Festival of `Indra Jatra’ শীর্ষক প্রথম রচনাটি মূলত হিন্দুরাষ্ট্র নেপালের হেজিমনির প্রেক্ষাপটে কাঠমণ্ডু উপত্যকায় বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতিসত্তাগত  সূত্র থেকে প্রাপ্ত/উৎসারিত চিহ্ন-ব্যবস্থার একটি বিশ্লেষণ। এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে লেখক ইন্দ্রযাত্রাকে একটি সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে এর মিথিক মূল্য উদ্ভাবন করেন এবং রোঁলা বার্থের মিথ সংক্রান্ত বিশ্লেষণকে পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে নতুন আকৃতি প্রদান করেন। মিথের মধ্য দিয়ে উদঘাটিত চিহ্ন-ব্যবস্থা আর অর্থ শৃংখলার সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে যুক্ত হয়ে অর্থ-শৃঙ্খলাকে যে বহুমুখী উৎসবের সাথে যুক্ত করে এবং অর্থ যে চূড়ান্ত অর্থেই বহুস্তরায়িত- সেটি এই রচনায় বিশ্লেষিত হয়। Carya Nrtya in Nepal: When `Becoming the Charater’ in Asian Performance is Nonduality in `Quintessence of Void’ শীর্ষক দ্বিতীয় রচনার লেখক চর্যানৃত্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ  করেন যে, নৃত্যের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় এমন একটি অভিজ্ঞতাবাদী উপলব্ধি যে, এই পৃথিবীর সব কিছুই ‘চিন্তা মাত্র’। লেখক তর্কমুখর হয়ে উঠেন। তাঁর মতে, ‘চরিত্রের উত্তরণে’র (বিকামিং দ্য কারেক্টর) পরিবর্তে ‘শূন্য হিসেবে সত্তায় রূপান্তরিত’ (বিকামিং সেল্ফ অ্যাজ ভয়ড) হওয়ার একটি বিরোধী অভিব্যক্তি চর্যানৃত্যে পরিদৃষ্ট হয়। ল্হামো নামে খ্যাত Tibetan Folk Opera: (De/Re) Articulations in Cultural Politics শীর্ষক রচনায় লেখক চীনা গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার/রাষ্ট্রের চীনায়নের বিপরীত বর্গ হিসেবে ‘তিব্বতীয় আত্মপরিচয়ের’ পটভূমিতে সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ করেন। ক্ষমতা ও রাজনীতির মধ্যবর্তী জটিল ক্রিয়াশীলতায় ল্হামো শীর্ষক পাফরমেন্সের মাধ্যমে এই চিহ্নায়ন ঘটে। When a People Do Not Need to Remember: Witnessing the Death of Pang toed Cham in Sikkim শীর্ষক চতুর্থ রচনার লেখক ক্ষুদ্রজাতিসত্ত্বাগত কৃত্যের বিলুপ্তি ও আত্মপরিচয়ের বহুমুখী শর্তাধীন ইতিহাস ও রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেন। The Interface of `Standing For’ and Acting For in Bhutan: Power Struggle, Myths and Strands of History Embedded in the Paro Tsechu শিরোনামের রচনায় বিবৃত হয় এক সংগ্রামের আখ্যান। যেখানে চিহ্নবিজ্ঞানগত ও রাজনৈতিক প্রতিরূপায়ণ (Representation) একটি ক্রম-নির্মীয়মান অর্থের বৃত্তের অভিমুখে সমস্যাগ্রস্ত প্রতিরূপায়ণ  হিসেবে আবার পুনর্দৃষ্ট হয়। The Ritual of Devol Maduva: Problematizing Dharma in the Ethnic Conflict of Sri Lanka নামাঙ্কিত রচনায় উপস্থাপিত হয় শান্তি ও সন্ত্রাসের এক দ্বান্দ্বিক ব্যাকরণ। এখানে সামাজিক নির্মাণ ও বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধধর্মের একটি সমস্যাবিহীন ধারণা হিসেবে চর্চিত না হওয়ার বিশ্লেষণী অভিজ্ঞতার বয়ান তৈরি হয়। Yoke Thay in Burma : The Dance of an Ontological Paradox as a Trope of the Human Condition নামক রচনায় হিমালয়ের অরণ্যদৃশ্য উপস্থাপিত হয় অতিক্রমণের কৃত্যে। আর এখানে পুতুল হয়ে ওঠে মানবিক পরিস্থিতির একমুখী, উভমুখী, ত্রিমুখী এবং পরিশেষে বহুমুখী অভিজ্ঞান। জামিল আহমেদের গ্রন্থভুক্ত বুদ্ধকীর্তন শীর্ষক অষ্টম পারফরমেন্সটি বিশ্লেষিত হয়েছে। Halfway `Becoming’ on the Interface of Trsna and Desire : Examining Bauddha Kirtan as a Minor Performance in Bangladesh এই প্রবন্ধে বৌদ্ধ কীর্তনের সূত্রে বাংলাভাষী বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দেল্যুজ ও গত্তারি কথিক ‘ক্রমাগত অস্তিত্বের রাজনীতি’ (Polotics of Becoming) নিরীক্ষিত হয় সংখ্যাগুরু অধিপতিশীল পেষক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে। অধিপতিশীল পেষক কাঠামো বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অস্তিত্বগত বৈচিত্র্যকে গুঁড়িয়ে দিয়ে একটি সমজাতীয় পরিচয় নির্মাণের ত্রাস সৃষ্টি করে। অস্তিত্বের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে ক্রামাগত অস্তিত্বশীলতার সংখ্যাগুরু রাজনীতি এবং ক্রমাগত নিরস্তিত্বশীলতার সংখ্যালঘু সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় শূন্যতাকে লেখক একটি জটিল পটভূমিতে বিশ্লেষণ করেন।

প্রাচ্যতত্ত্বের বিপ্রতীপ পাঠ : গ্রন্থি দৃষ্টান্ত

প্রাচ্যতত্ত্ব মূলত পাশ্চাত্যের একটি জ্ঞান প্রকল্প। আর জ্ঞান উৎপাদন করে ক্ষমতা ও হেজিমনি। তাই জ্ঞান ও ক্ষমতার সরাসরি সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিতের বহির্ভূত নয়। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত এডওয়ার্ড সাঈদের ‘অরিয়েন্টালিজম’ গ্রন্থটি প্রাচ্য সংক্রান্ত পাশ্চাত্যের অপর বিবেচনায় উৎপাদিত জ্ঞানের তত্ত্বায়ন। সাঈদের ‘অরিয়েন্টালিজম’ বাস্তবতার সমালোচনা ও তত্ত্বের নির্মাণ মাত্র। এনলাইটেনমেন্ট পরবর্তী পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী আধুনিতাবাদ ও পাশ্চাত্য-ব্যতিত অবশিষ্ট পৃথিবীকে অপর ও বর্বর হিসেবে চিহ্নায়নের প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় প্রাচ্যতত্ত্বের বাস্তবতা। উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য জ্ঞানকা-ীয় বর্বরতা হলো প্রাচ্যতত্ত্ব। কেননা উপনিবেশগ্রস্ত করার লক্ষ্যে লুণ্ঠনের জন্য প্রয়োজন হয় ‘টার্গেট’ জাতিসংক্রান্ত জ্ঞান। সাঈদের দৃষ্টিতে পাশ্চাত্যের ‘অপর টার্গেট’ হচ্ছে প্রাচ্য। যেমন উপনিবেশবাদী ইতিহাসের সূত্রে দেখা যায়; ১৭৯৮ সালে স্যার উইলিয়ম জোন্সের নেতৃত্বে এশিয়াটিক সোসাইট অব বেঙ্গল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানের দৌলতে বঙ্গীয় অঞ্চলে প্রাচ্যতাত্ত্বিক জ্ঞান প্রকল্পের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা ঘটে। প্রাচ্য সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ক্রমাগত ঔপনিবেশিক এইসব নির্মাণ ও বিশ্লেষণের বিপরীতে একটি নতুন অধ্যয়ন নির্মাণ করেন সাঈদ। সাঈদের তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে জামিল আহমেদ পাফরমেন্সকে অবলম্বন করেন প্রাচ্যতত্ত্বের বিপরীত পাঠ নির্মাণের লক্ষ্যে। এডওয়ার্ড সাঈদ ‘অরিয়েন্টালিজম’ রচনা করেন পাশ্চাত্যের সাহিত্য নথিপত্র ইত্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে। আর সৈয়দ জামিল আহমেদ পাশ্চাত্য কর্তৃক চর্চিত আধুনিকতাবাদী-উপনিবেশবাদী জ্ঞানপ্রকল্পে প্রাচ্যতত্ত্বেরই বিপ্রতীপ পাঠ নির্মাণ করেন নাট্যকলা এবং সম্প্রসারিত অর্থে পরিবেশনকলা বা পাফরমেন্স বিশ্লেষণের মাধ্যমে। যেমন, চর্যানৃত্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যতাত্ত্বিক একটি ডিসকোর্সকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। প্রাচ্যতত্ত্বের ধারায় দক্ষিণ-এশীয় আত্মপরিচয়ের সীমানা অচিহ্নিত থাকে। প্রাচ্যতাত্ত্বিক দক্ষিণ-এশীয় পরিচয় মাত্রই গড়ে ওঠে ভারতীয় ধারণায়। ভারতীয় পরিচয়মাত্র হিন্দুধর্মীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী দার্শনিকতা। অথচ এর বিপ্রতীপে কমপক্ষে বৌদ্ধ ধর্মীয় দর্শনের পাঠ কে গ্রহণ করা যায়। ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শনের কেন্দ্রীয় কথা হলো- বাস্তব হচ্ছে গঠিত সত্ত্বা। এর প্রধান প্রত্যয় হলো আত্মাবাদ। আর বৌদ্ধ ধর্মীয় দর্শনের কেন্দ্রীয় কথা হচ্ছে ক্রমাগত গঠনশীলতা। এর প্রধান প্রত্যয় হলো অনাত্মা। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু দর্শনমতে, বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বজনীন, অস্তিত্বশীল ও স্থিরীকৃত। আর বৌদ্ধধর্মীয় দর্শনমতে, বাস্তবতা হচ্ছে ব্যক্তিক, পর্যায়ক্রমিক প্রবহমানতা যা নিরন্তর পরবর্তনশীল।

এই প্রক্রিয়ায়, লেখক প্রাচ্যতত্ত্বের বিপরীতে প্রশ্ন উত্থাপন করেন : ভারতীয় মাত্রই হিন্দু পরিচয় নয়; তাহলে বৌদ্ধ, মুসলিম ও খ্রিষ্টান আত্মপরিচয়ের বাস্তবতার কী হবে? প্রাচ্যতত্ত্ব একটি সর্বগ্রাসী হেজিমনিক ধারণায় মুছে ফেলে, আর জামিল আহমেদের বিপ্রতীপ পাঠ মুছে ফেলার বিপরীতে বৈচিত্র্যময় অস্তিত্বের নির্মাণকে বিধৃত করে।

পদ্ধতি ও পদ্ধতির সমস্যাসংক্রান্ত দর্শন

পারফরমেন্স বা পরিবেশনাকলা বিশ্লেষণে জামিল আহমেদের পদ্ধতিটি কী? প্রথমত তিনি নিজেকে নাট্যকলা/পরিবেশনকলায় পণ্ডিত নয়, প্র্যাকটিশনার বিবেচনা করেন। ফলে পরিবেশনাকে তিনি চাক্ষুস করেন (witnessing) এবং পরিবেশনাকে তিনি দর্শন করেন (spectating)। সাধারণ ও সরাসরি দেখা, অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি দর্শনে পৌঁছার মাধ্যমে জামিল আহমেদের পদ্ধতির সূত্র গড়ে ওঠে। আর তাঁর পদ্ধতির মৌলভিত্তি হলো জ্ঞান। এই জ্ঞান দ্বিপাক্ষিক কিন্তু পরস্পর অভিচ্ছেদ্য। একটি হলো, একাউন্টিং- পরিবেশনাকলার অনপুঙ্খ ও বিশদ বিবরণ। অপরটি হলো লোগোস- পরিবেশনাকলার প্রথমোক্ত প্রামাণিক বিবরণভিত্তিক দার্শনিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিদ্যমান অধিপতিশীল জ্ঞানের বিপরীতে বিকল্প জ্ঞানের প্যারাডাইম সৃষ্টি করা। উল্লেখ্য যে, হেরাক্লিটাসের জ্ঞানকাণ্ডে একাউন্টিং ও লোগোস সমার্থক। কিন্তু উত্তর-কাঠামোবাদী প্রেরণায় জামিল আহমেদ নিজের পদ্ধতিতে নির্মাণকেও সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে এক পর্যায়ে প্রামাণিত করেন। কেননা যেকোনো পদ্ধতির গঠনের মধ্যেই এর বিরোধিতা ও সীমাবদ্ধতার সূত্র নিহিত থাকে। ফলে, বাস্তব ও সত্যে পৌঁছার লক্ষ্যে অনুসৃত যেকোনো পদ্ধতিই খণ্ডিত। তিনি তাই পরিবেশনাকলা-সংক্রান্ত দার্শনিক জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্রমাগত বিনির্মাণবাদী ধারায় যুক্তি-তর্ক এবং অজস্র উদ্ধৃতিকে অনুপ্রাসময় ভাষায় বিন্যাস করতে থাকেন। জামিল আহমেদ অভিনবমাত্রার আর্গুমেন্টাটি প্রকৌশলে তার বিন্যাসকে এমনভাবে নির্মাণ করেন যাতে পরিশেষে যেকোনো নির্মাণকেই মনে হয় সমস্যাগ্রস্ত এবং ক্রমাগত বিনির্মাণময়। এভাবে তাঁর পদ্ধতি গড়ে ওঠে একটি মাত্র অনুসৃত পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা ও সমস্যাগ্রস্ততার চিহ্নায়নভিত্তিক দর্শন অবলম্বনের মাধ্যমে। আর জামিল আহমেদ যখন এই যৌগিক পদ্ধতির দর্শনে উপনীত হতে থাকেন- লেখকের নৈরাজ্যবাদী একটি পদ্ধতিকেই কি তিনি তখন গঠন করতে থাকেন?

প্রকৃতপক্ষে পদ্ধতি- এই শব্দ ও শব্দের নেপথ্যে নিহিত জ্ঞানপ্রবাহের ব্যাপক ধারণাটি জামিল আহমেদের লেখনীয় পদ্ধতি দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। স্বয়ং পদ্ধতির ধারণার বিরুদ্ধেই তাই তাঁর পদ্ধতি গড়ে ওঠে। এ হলো তাঁর পদ্ধতির যৌক্তিকতা। এই যৌক্তিকতা গড়ে ওঠে প্রচলিত ব্যাখ্যার বিরোধিতার মাধ্যমে। বিরোধিতার ভেতর দিয়ে তিনি ব্যাখ্যাই উৎপাদন করেন। কিন্তু তাঁর উৎপাদিত ব্যাখ্যাও শেষ পর্যন্ত যেকোনো প্রকার ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এভাবে ব্যাখ্যার ধারণাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, অসারতায় পর্যবসিত হয়। জামিল আহমেদের এই অ্যনার্কিস্ট কিংবা যৌগিক পদ্ধতি মূলত বাস্তবসংক্রান্ত উৎপাদিত জ্ঞানের ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতিসমূহের সমস্যাগ্রস্ততা উত্থাপন করার ভেতর দিয়ে বিভিন্নমুখী সত্যের বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হয় ক্রমাগত। পদ্ধতির প্রতি জামিল আহমেদের অনাস্থার পদ্ধতির মধ্যেই গড়ে ওঠে আন্তঃজ্ঞানকাণ্ডীয় (ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি) বিশ্লেষণের ধারা। এর ফলে, বাংলাদেশে নাট্যকলা/পরিবেশনাকলা-সংক্রান্ত বিদ্যায়তনিক অধ্যয়ন, এমনকি গ্রুপ থিয়েটারভিত্তিক কিংবা অন্য যেকোনো বৈচিত্র্যময় অনুশীলনেও এই জ্ঞানকাণ্ডীয় সংশ্লিষ্টতার অভিজ্ঞতায় নতুন দিগন্ত সৃষ্টি হয়। নাট্যকলা/পরিবেশনাকলা বিচ্ছিন্ন কোনো জ্ঞানকাণ্ড বা শিল্পশাখা নয়। রাজনীতি/রাষ্ট্রবিজ্ঞান, চিহ্নবিজ্ঞান/ভাষাতত্ত্ব/নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, সংস্কৃতি অধ্যয়ন, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, ইতিহাস ও পুরাণের জটিল সংশ্লেষিত আন্তঃকা-ীয় পটভূমিতে নাট্যকলা/পরিবেশনাকলা বিশ্লেষণের ভেতর দিয়েই জামিল আহমেদের পদ্ধতির দর্শনকে বিশ্লেষণ ও বিনির্মাণ করতে হয়। তবে অবশ্যই তা আধুনিকতাবাদী চিন্তা-কাঠামো দিয়ে নয়।

উপসংহার নয়, ভাষাসংহার

বাস্তবের যখন প্রতিরূপায়ণ হয়, তখন এটি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাস্তব প্রকৃতপক্ষে জটিল, বহুস্তরায়িত ও অনিঃশেষিত- ক্রমাগত নির্মীয়মান। আর বাস্তবের গ্রন্থিক প্রতিরূপায়ণ একটি আকৃতিগত সীমাবদ্ধতা মাত্র। জামিল আহমেদ তাই Reading Against the Orientalist Grain: Performance and Politics Entwined With A Buddist Strain গ্রন্থটির কোনো উপসংহার রচনা করেন নি। বাস্তব ও সত্যসংক্রান্ত কোনো পরিশিষ্ট সৃজিত হতে পারে না। বাস্তব ও সত্যের বিশ্লেষণ শুধু সম্ভব। চূড়ান্ত অর্থ বাস্তবের মধ্যেই আছে, ব্যক্তি প্রতিভায় একমাত্র বিবেচনায় গ্রন্থে তুলে আনা সেটি সম্ভব নয়। জামিল আহমেদ যেমন ৮টি পরিবেশনার বিশ্লেষণে শুধু ‘দেখে’ যান, তেমনি তাঁর গ্রন্থলোচনায় আমিও মনে করি কোনো উপংহার নয়, বর্তমান আলোচনার একটি ভাষাগত সংহার বা সমাপ্তি শুধু সম্ভব। কেননা গ্রন্থবাহিত অর্থের বাস্তবতার মোকাবিলার জন্য গ্রন্থপাঠই আবশ্যক। এক্ষেত্রে সৈয়দ জামিল আহমেদ রচিত Reading Against the Orientalist Grain: Performance and Politics Entwined With A Buddist Strain শীর্ষক গ্রন্থটি এক নির্বিকল্প গন্তব্য।

শাহমান মৈশান : লেখক ও নাট্যশিক্ষার্থী