Full premium theme for CMS
জপেন দা’র প্রত্যাবর্তন
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
জপেন দা উৎপল দত্তের একটি রম্যরচনার চরিত্র। তাকে নিয়ে উৎপল দত্ত সত্তরের দশকে একটি বইও লিখেছিলেন। সেই জপেন দা’ই কি আমার সামনে আবার ফিরে এলো! আই.টি.আই উৎসব শেষে জাতীয় নাট্যশালার মূল ফটক পেরোতেই দেখি আজাদ আবুল কালামের অর্থাৎ পাভেলের পাশে প্রায় চেনা একটা মুখ অনর্গল বকে যাচ্ছেন আর পান খেয়ে চলেছেন। চিনতে একেবারেই অসুবিধা হোল না। বুঝলাম এ-তো জপেন দা। উৎপল দত্ত মারা গেছেন, অথচ জপেন দা বেঁচে আছেন!
প্রবল উৎসাহে কাছে যাই, পাভেলের শুকনো মুখ দেখেই বুঝতে পারি, একহাত হয়ে গেছে। পাভেল স্পেকট্রাম ফ্যাক্টরির ভবন-ধ্বস নিয়ে দুর্ধর্ষ এক নাটক করেছে- ‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি'। জপেন দা সে নাটক দেখেছেনও। জপেন দা’র বয়ান- ‘হ্যাঁ দেখলাম তো, ভাবলাম আমার ডায়বেটিস হচ্ছে, চোখে কম দেখছি, আরে তোদের চেহারাই তো বোঝা যায় না। লাইট কোথায়? আবার হঠাৎ করে কেঁপে কেঁপে ওঠে। আমিতো জানিস, উৎপলও আমাকে তার নাটক কখনোই পুরোটা দেখাতে পারেনি। তোদের তিনটে হলেই একই অবস্থা। তা, আলো ছাড়া নাটক হয়? একবার দেখলাম তোর ঐ যুদ্ধের নাটক, আবার মিউজিক্যাল করার চেষ্টা...।’ দেখলাম জপেন দা নাটকটার নাম মনে করার চেষ্টা করছেন, আমি প্রবল উৎসাহে বললাম- ‘টার্গেট প্লাটুন’। জপেন দা বলে উঠেন- হ্যাঁ সেই প্রথম রাত্তিরে দেখলাম। বেশ আলো ঝলমল। তারপর যখন দশ নম্বরটায় গেলাম, ম্যাড়মেড়ে। আলো নেই। একটা বাল্ব কিনতে ক’টাকা লাগেরে?
পাভেল বোঝাতে চেষ্টা করলো- এ বাল্ব তো বাড়ির বাথরুমের বাল্ব না, বিদেশী বাল্ব। জপেন দা একেবারে তেড়ে আসলেন যেনো- তুই আমাকে বাল্ব চেনাবি? তাপসের সাথে ফিলিপসের অফিসে কতবার গেছি। একাডেমীর বাল্ব আছে ঠিক ঠিক, কিন্তু রবীন্দ্রসদনে নেই, মধুসূদনে নেই। সরকার যেখানে আছে সেখানে কিছুই থাকে না।
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো ঠাণ্ডু, সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠলো- ডিমারের ঝামেলাডাই তো বড় ঝামেলা। ওডো ঠিক হয় আবার নষ্ট হয়। নতুন একটা আইনবার কথাতো কত আগে থিক্যা কইতাছি। হয় না।
-এই যে, মেজাজটাই খারাপ করে দিলি, তুই তাপসের সাথে কাজ করিসনি?- তাপস হোলে এই ডিমারে কাজ করতো? ছুঁড়ে ফেলে দিতো। শো বন্ধ হয়েছে না কত? তোরা জোড়াতালিতে কাজ করে যাস- এ তোদের স্বভাব, স্বভাবটা ঠিক কর। তিনটে হল করে দিয়েছে তাতেই তোরা মহাখুশি। লাকী তোদের লোক, মন্ত্রী নূর তোদের লোক, পুরো নামটা যেনো কী? পাভেল বলে উঠলো- নূরভাই। জপেন দা যেনো ধমক দিয়ে বললো- সেই তো নিক নেইমই বললি- অসাধারণ ঐ অভিনেতার পুরো নামটা কী?- আমি বললাম- আসাদুজ্জামান নূর- জপেন দা বললেন- হু- তারপরও আবার বলিস ডিমার নষ্ট, বাতি নেই- লজ্জা করে না?
সর্বস্বান্ত রেপাটরির মালিক থিয়েটারওয়ালার হাসান শাহরিয়ার মৃদু কণ্ঠে বলে ওঠে- ‘বলা হচ্ছে কিন্তু হচ্ছে না।’ এবার প্রায় ব্যঙ্গ করেই বলে ওঠে জপেন দা- বলা হচ্ছে? তা কেমন করে বলছিস? শান্তিনিকেতনী ভঙ্গীতে নাকি ‘এই নারু সরে যা নইলে কিন্তু নুড়ি উড়িয়ে মারবো’- এ-ভঙ্গীতে? এই জন্যেই এই অবস্থা। কিছু জিনিস তো থাকতেই হবে। কম আলোর নাটক দেখলে যে fatigue হয়। রেটিনায় ক্লান্তি আসে যাতে মাথা ধরে যায়, ভালো জিনিসও ভালো লাগে না। এসব আমার মতো একটা অর্ধ-শিক্ষিতকে বলতে হবে? তোরা বুঝিস না?
পাভেল হঠাৎই ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে- দর্শকই হচ্ছে না। এ্যাতো জান লড়িয়ে নাটক করছি।
হুঁ, দর্শক আসতে দিচ্ছে না। কারা দিচ্ছে না? তোদের পার্টির লোকরা ঝগড়া-ঝাটি করবে- ক্ষমতার লড়াই চলবে শুধু- তারপর এমন পার্টি কোথায় খুঁজে পাবি বল, যাদের টার্গেট শুধু জনগণ। পুড়িয়ে মারছে, প্রেট্রোল বোমা ছুঁড়ছে। আজব তোদের আন্দোলন। এ নিয়ে নাটক হচ্ছে?
বীরদর্পে মান্নান হীরা বলে ওঠে- ‘হচ্ছে’।
- কোথায় হচ্ছে?
- পথে হচ্ছে , আমি নাটক করেছি।
মাথা নাড়িয়ে, পূর্ব-ধূমপানজনিত দুটো কাঁশি দিয়ে জপেন দা বলে ওঠে- দেখেছি, তোর নাটক দেখেছি। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ব্যাখা কোথায়? সমস্যা তুলে ধরবি, ছুঁয়ে যাবি কিন্তু গভীরে যাবি কবে? মঞ্চে ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’র মতো একটা নাটকও তো করতে পারছিস না। আমি বলে উঠি- জপেন দা দেখুন, আমাদের নাটক একেকটা ঐতিহাসিক দলিল। স্পেকট্রাম ফ্যাক্টরির ভবন-ধ্বস নিয়ে আমরা নাটক করেছি, সদ্য নামিয়েছে পাভেল। সেখানে তো শিল্প আছে ব্যাখ্যাও আছে কিন্তু দর্শক তো ভেঙ্গে পড়ছে না। জপেন দা ক্ষুব্ধ হয়ে বলে ওঠে- সিগারেটটা ছেড়েই দিয়েছিলাম এবার একটা টান আমাকে দিতেই হবে, দে’- বলে শূন্যে টানতে থাকে। পাভেল সিগারেটটা এগিয়ে দিতেই বলে- ধরিয়ে দে। ধরিয়ে দেবার পর টান দিতেই কাঁশি শুরু হোল। সিগারেটটা পাভেলকে ফিরিয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করে।
-তোরা দর্শকের জন্য কী করেছিস?
প্রশ্নটা বুঝতে পারে না কেউ। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে জপেন দা।
সাহস করে বলে উঠি- কেনো নাটক করছি, আন্দোলন করে হল পেয়েছি।
যাকগে প্রশ্নটা তুলে রাখি, পরে হবে। এখন বলতো নিজেদের জন্যে কী করেছিস? একটা নাটক নামাতে হলে যে টাকাটা লাগে সেটা কে দেয়? মান্নান হীরা বুক ভেঙ্গে জবাব দেয়- সে যে কী কষ্ট! ধার দেনা করে-
-সে ধার দেনা কীভাবে শোধ করিস? টিকেটের টাকা দিয়ে?
-সে-ও তো সব সময় হয় না। আগে কল-শো ছিলো- দুটো পয়সা বাঁচতো। এখন তো তাও নেই।
-কিন্তু ওপারে আছে। প্রত্যেকটা জেলায় মহকুমায়, ছোট শহরে থিয়েটার আছে। উৎসব আছে, প্রচুর কল-শো হচ্ছে। কলকাতার দল সেখানে যাচ্ছে।
আমি এবার একটু উত্তেজিত হয়েই বলে উঠি- ওখানে তো কেন্দ্রীয় সরকার অনুদান দিচ্ছে। প্রায় সর্বস্বান্ত থিয়েটারওয়ালার সম্পাদক বলে ওঠে- সংগীত নাটক একাডেমী তো নাট্যপত্রিকার জন্যও টাকা দিচ্ছে, নাহলে ‘আননায়ূধ’ মফস্বল থেকে বের হচ্ছে কী করে নিয়মিত?
-তোরা সবাই মিলে ঢাকার বাইরের নাট্যচর্চাকে ছোট করেছিস। সেখানে কোনো অনুদান নেই, পৃষ্ঠপোষকতা নেই। নিজেরাও যে সেখানে গিয়ে সময় দিবি তাও করছিস না। সরকার তো প্রাণপনে উদাসীন। সব কিছু নিয়ে এসেছিস ঢাকায়। এবার আমার দিকে তাকিয়ে সরোষে বলে উঠলেন- ‘আর তুইতো তো কলকাতায়, বহরমপুরে, শিলিগুড়িতে, পুরুলিয়ায় গিয়ে নাট্যোৎসব উদ্বোধন করে বেড়াচ্ছো, কিছু শিখেছিস সেখান থেকে?’
জবাবটা প্রায় ঠোঁটের আগায় এসে গিয়েছিলো কিন্তু সে সুযোগ দিলো না জপেন দা- তোদের প্রশংসা না করে পারি না। এর মধ্যেই কত কত উৎসব হচ্ছে! উৎসবের বাহার দেখে বাঁচি না। কিন্তু নিজেরা বসে কি একটা আলোচনা করেছিস, একটা ইশতেহার বানিয়েছিস- What is to be done?
তোরা একেক গুরুর কত শিষ্য, একটা আন্দোলন রচনা করেছিস? সরকারের টাকার কত অপচয় হচ্ছে, সেখান থেকে দাবী করে কিছু বের করে আন। লাইট ভাড়ার টাকা দিচ্ছিস, মেক-আপ ম্যানকে পারিশ্রমিক দিচ্ছিস, পর্দাওয়ারাকে ভাড়া দিবি, হল ভাড়া দিবি, বিজ্ঞাপনের টাকা দিবি, আর মাগনা খেটে চলেছিস তেতাল্লিশ বছর! সামনে কোনো আশার আলোও জ্বালিয়ে রাখিসনি। সরকারের কাছে ধর্ণা দে। বোঝা তাদের। (জপেন দা উত্তেজিত, কাঁপতে থাকে) গণতন্ত্রের লড়াইয়ে অগ্রপথিকরা কী পেলো? আশির দশকটাতো- ঐ যে তোদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনটা করলি, তখন তো, পথে-মঞ্চে সর্বত্র দাপিয়ে বেড়ালি। পৃথিবীর কোথাও নাটকের লোকরা এসব করেছে?
এতক্ষণ একদমে কথা বলে একটু থামলেন। দ্রুত শ্বাস ওঠা-নামা করছে। হঠাৎই বলে উঠলেন- একটা রিকশা ডাক-
পাভেলই একটা রিকশা ডাকলো। জপেন দা রিকশায় উঠলেন। পাভেলও ...
[চলবে]
মামুনুর রশীদ : নাট্যব্যক্তিত্ব