Full premium theme for CMS
থিয়েটারের আঁধার কাটাবার ইচ্ছাটাতো চাই- তাই না?
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
শুভেচ্ছা।
নতুন বর্ষ, নতুন শতক, সর্বোপরি নতুন সহস্রাব্দিতে শুভেচ্ছা সবাইকে।
সবাই যখন নতুন সহস্রাব্দিবরণে উৎসবমুখর, তখন থিয়েটারওয়ালা-ও দ্বিতীয় বর্ষে পা দিয়ে আনন্দে আত্মহারা। আত্মহারা হবেই না-বা কেনো? এতটুকু ছোট্ট যে জীবন, সেই জীবনকে বিরামহীনভাবে এগিয়ে নেবে, নতুন নতুন বর্ষে পা রাখবে- এই প্রত্যাশাতেই তার জমি চষা।
এমন আত্মহারার মাঝেও বেদনার ছোপও যেনো লেগেই আছে। থিয়েটারওয়ালার এটুকুন জীবনে এমন একটা সংখ্যা বের করা গেলো না, যে সংখ্যাতে শোকহীন সম্পাদকীয় লেখা গেলো। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটলো না। এ গাথা বড় কষ্টে গাঁথা।
আমরা হারিয়েছি জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে, আমরা হারিয়েছি ‘প্রবীণ শিশু’ দাদাভাইকে। তাঁদের আসন পূরণ করবে কে!
আমরা আমাদের দুই স্বজনকে হারিয়েছি। নাট্যচক্রের সদস্য পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা সার্জেন্ট আহাদ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। নিজ দায়িত্ব পালনকালে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন তিনি নির্মমভাবে। তার মৃত্যু আমাদেরকে নিরাপত্তাহীনতার ‘নতুন পথ’ দেখালো। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বিশিষ্ট নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা-সংগঠক এস এম সোলায়মান-এর জননী। আমরা আমাদের মা-কে হারিয়ে ব্যথিত।
বড় একটা শূন্যতা তৈরি করে চলে গেলেন আমাদের অভিভাবক। তিনি আছেন, এটাই যেনো বড় শক্তি ছিলো আমাদের। সহস্রাব্দির শেষ মাথায় এসে দেশে যখন বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর ঐক্য ঘটলো, তখন আমাদের অসহায় করে চলে গেলেন অভিভাবক সুফিয়া কামাল। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠটি যেনো নিভে গেলো।
বর্তমান রাজনৈতিক আবহাওয়াটা নিয়ে বিশেষভাবে ভাববার কারণ আছে। শিল্পী মাত্রেরই একটি ধারণা আছে যে- সে আনন্দ দেবে আর তাকে সবাই শ্রদ্ধা করবে, সে থাকবে দেশ, রাজনীতি, এসব কিছুর ঊর্ধে। এবং এসব নিয়ে ভাববার প্রয়োজনীয়তার ঊর্ধেও সে অবস্থান করবে। অন্যান্য শিল্পীদের কথা বাদ দিয়ে থিয়েটারওয়ালাদের কথাই যদি ধরি, তবে এ ধারণা করা যেতে পারে যে, বর্তমানে সবচেয়ে সুযোগ সন্ধানী এবং সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণী হলো এই শিল্পী সমাজ তথা থিয়েটারওয়ালারা। তাঁরা খাচ্ছেন, ঘুমুচ্ছেন, ঘুমের সাথে নাকও ডাকছেন। আরেকটি কাজও অবশ্য করছেন, কাজটি হলো বর্তমান থিয়েটার চর্চার ২৭-২৮ বছর পূর্তিতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। তৃপ্তি এ কারণে যে, তাদের ধারণা, স্বাধীনতার পর ‘নাট্যচর্চা’ এই দেশকে যা দিতে পারলো, এই ‘দেয়াটা’ আর কেউ দিতে পারেনি।
থিয়েটার চর্চা যখন বাংলাদেশে শুরু হয়, তখন সবাই এই ব’লে নাটক করতো যে- নাটক হলো মুক্তিযুদ্ধের ফসল। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে শুরু হলো থিয়েটার চর্চা। যারা এই থিয়েটার চর্চার পুরোধা, তাদের অনেকেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং কেউ কেউ আবার জড়িত ছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গেও। ফলে থিয়েটার চর্চাটা কেবল শিল্প চর্চায় সীমাবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা দিয়েছিলো। মঞ্চে উচ্চারিত হতে থাকলো দেশের কথা-মানুষের কথা। ষাট দশকে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা সম্পন্ন মেধাবী নাট্যকর্মীরা বানাতে থাকলো একের পর এক মঞ্চগাথা। জনগণ থিয়েটার দেখতে শুরু করলো। কোনো ব্যক্তি বিশেষের কারিশমা নয়, জনগণ নিজেদেরকেই শিল্পীতরূপে মঞ্চে উপভোগ করতে লাগলো।পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশের টানাপোড়েনে রাজনীতির জায়গাটা যখন কলুষিত হতে থাকলো, তখন থিয়েটারওয়ালাদের মধ্যেও নতুন ভাবধারার জন্ম হলো। তারা মানুষ+শিল্প থেকে মানুষটাকে বাদ দিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু যেহেতু মানুষকে বাদ দেয়া সম্ভব নয়, তাই মঞ্চে মানুষের কথা বললেও মঞ্চের বাইরে মানুষকে নিয়ে আর এগিয়ে যেতে চাইলেন না। যারা জীবন তুচ্ছ করে স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো, তারাই আবার এক সময়ে ইউনিয়ন (ছাত্র ইউনিয়ন) করতো বলে নিজেদের বোকা ভাবা শুরু করলো। একদিকে রাজনৈতিক বক্তব্য সম্পন্ন ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ আর ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ আর ‘কেরামতমঙ্গল’ আর কিত্তনখোলা’ আর ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসী’ আর ‘ইবলিশ’ আর ওরা কদম আলী’ আর সাতপুরুষের ঋণ আর ‘নানকার পালা’ আর ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ আর ‘ইংগিত’ ইত্যাদির দাপটে মঞ্চ কাঁপতে লাগলো, অন্যদিকে থিয়েটারওয়ালারা কাঁপতে লাগলো রাজনীতি মুক্ত ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়। সারা জাতি ভুগতে লাগলো অপরাজনীতির ব্যমোয় আর নাট্যজনরা কুলীন হিসেবে বাঁচতে চাইলো রাজনীতিহীনতায়। রাজনীতি তাদের ছোঁবে না, তারাও রাজনীতিকে ধরবে না। কিন্তু মানুষ স্বাধীন হলেও তার ছায়াতো পরাধীন। ছায়ার কী সাধ্য সে মানুষকে এড়িয়ে যাবে? ঠিক তেমনি থিয়েটারওয়ালারা যতই চাইলেন রাজনীতির সাথে যাবেন না, কিন্তু রাজনীতি তাদের ছাড়লো না। ফলে রাজনৈতিকভাবে অসচেতন থিয়েটারওয়ালাদের শেকড়ে আস্তে আস্তে ঘুণ ধরলো এবং ক্রমান্বয়ে ঘুণেধরা মঞ্চ আজ বিরান মরুভূমিতে পরিণত হলো। ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। দর্শক নেই, মঞ্চ নেই, নাটক কেবল একা চিৎকার করে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে আছে। তাকে বাঁচাবে কে? শিল্প যদি তার সঠিক রাজনীতির আশ্রয়ে যেতে না পারে তবে রাজনীতি তাকে কিনে নেবে, কিনে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। সেই চর্বিত থিয়েটারই আজ ঢাকার মঞ্চে হাহাকার করছে। এই হাহাকারের কারণ খুঁজতে হবে।
কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য একটাই। বিএনপি, জাতীয় পার্টি আর জামায়াতের ঐক্য ঘটেছে। ঐ ঐক্যে তেল ঢালছে সরকার। যে থিয়েটারওয়ালারা ভাবছে ঐ তেল নাকে দিলে আরামের ঘুম হবে এবং ঐ ঘুম থেকে উঠে মঞ্চে দাপাদাপি শুরু করবে, তারা যেনো এটা বুঝতে চেষ্টা করে যে, রাজনীতির এই আবহাওয়াটা সংস্কৃতি চর্চার জন্য মোটেও অনুকূল নয়। রাজনীতির এই আবহাওয়ায় ছিনতাই চলে আর সন্ত্রাস চলে আর বেকারত্ব চলে আর নেশা চলে আর এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নারী লঞ্ছনাও চলে কিন্তু শিল্পচর্চা চলে না, থিয়েটারচর্চা চলে না।
ইতোমধ্যে আমরা বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নতুন পরিষদ পেয়েছি। তারা তাদের কাজ শুরু করেছে। স্থবির নাট্যপাড়ায় প্রাণ সঞ্চার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, তাদের এই কাজ যেনো পুরোনো দালানে নতুন করে চুনকাম করার মতো না হয়। চুনকামে কেবল সৌন্দর্য বাড়ে, ঘুণেধরা ভিত মজবুত হয় না। বর্তমানে প্রয়োজন থিয়েটারের ভিত তৈরি করা। তাতে সময় বেশি লাগবে কিন্তু কাজটা স্থায়ী হবে। নতুন পরিষদের কাছে থিয়েটারওয়ালার মিনতি, তারা যেনো মুক্তিযুদ্ধের থিয়েটার চর্চাটায় ফিরে যেতে পারে। যে থিয়েটার চর্চা গ্রাম থিয়েটার করেছে, মুক্তনাটক করেছে, এমনকি পরবর্তী সময়ে পথনাটক করেছে, তথা গণমানুষের থিয়েটার করেছে অর্থাৎ নিজেদের থিয়েটার করেছে।
থিয়েটার চর্চার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। সেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরিতে আমাদের অবহেলা বা অসচেতনতার জন্য বড় বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে আজ, দিতে হবে আগামীতে। অবহেলা দূর হোক। সচেতনতা ফিরে আসুক। সবাইকে ধন্যবাদ।
ইতি
হাসান শাহরিয়ার
সেন্ট্রাল রোড, মার্চ ২০০০, ঢাকা