Full premium theme for CMS
‘ক্রুসিবল’ নাটকের সমকালীনতা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে নাট্যকার আর্থার মিলারের সাথে অল্প বিস্তর পরিচয় হয়েছিল ছাত্র জীবনেই। অবশ্য পরিচয় পর্বটা সীমিত ছিল পড়া পর্যন্ত। আর্থার মিলারের নাট্য চরিত্রসমূহের মঞ্চে চলাফেরা, তাদের আবেগ-উচ্ছ্বাস, দুঃখ-বিষাদ প্রকাশের জীবন্তরূপটি দেখার দুর্লভ সৌভাগ্যটি করে দেয়ায় নাট্যকেন্দ্রকে ধন্যবাদ। নাট্যকেন্দ্রকে ধন্যবাদের ডালি আরেকটু বাড়িয়ে দিতে হয় এই কারণে যে, আমাদের দেশে আর্থার মিলার যে সকল নাটক দিয়ে সাধারণ জগতে পরিচিতি লাভ করেছেন, নাট্যকেন্দ্র সেই সকল পরিচিত নাটকগুলোকে তার প্রযোজনা হিসেবে বেছে না নিয়ে বরং অল্প পরিচিত একটি নাটক The Crucible কে বেছে নিয়েছেন। যার মধ্য দিয়ে আমরা আর্থার মিলারকে ভিন্নরূপে আবিষ্কার করি, নতুন স্বাদ আস্বাদে পুলকিত হই।
আধুনিক বিশ্বনাট্য জগতে আর্থার মিলার বিশেষ একটি নাম। আর্থার মিলারের নিজস্ব জীবনবোধ, চিন্তা চেতনা, সামাজিক দায়বদ্ধতার পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিজীবনও আধুনিক মনষ্ক মানুষের ভাবনাকে তাড়িত করে। তিনি নাটককে শুধুমাত্র বিনোদনের গতানুগতিক মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা না করে এটিকে ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। সমাজের প্রতি এই বিশেষ অঙ্গীকার তাঁকে মানবতাবাদী কমিটেড নাট্যকার পরিচয়ে পরিচিত করেছে। অবশ্য এই কমিটমেন্ট পালন করতে গিয়ে শাসককুলের অপ্রিয়ভাজন হতেও তাঁর বেশি সময় লাগে নি। যার কারণে আর্থার মিলারকে কম্যুনিষ্ট ঘেঁষা ও আমেরিকা বিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ১৯৫০ সালে সেনেটের ম্যাকার্থির কোর্টে হাজিরা দিতে হয়েছিল। এ যেন বিংশ শতাব্দির সক্রেটিস। খ্রীঃ পূঃ প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে এথেন্সের সক্রেটিস যেমন সত্য প্রকাশের নিমিত্তে নিঃশঙ্কচিত্তে হেমলক পান করেছিলেন, তেমনি আর্থার মিলারও তাঁর পারিপার্শ্বিক ভোগবাদী সমাজের সুবিধাবাদিতা, কদর্যতা, মৌলবাদী চিন্তাধারা, মিথ্যাচার, সমসাময়িক লেখকদের জীবন বিমুখ লেখার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সত্যের জয়গান গেয়েছেন। আর একারণেই আর্থার মিলার তাঁর সমকালীন সমাজ ও কালকে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছেন সর্বজনীন ও সর্বকালের।
১৬৯২ সালের ডাইনী নিধনের এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে ঘিরে ‘ক্রুসিবল’ নাটকের কাহিনীর অবতারনা করা হলেও, অনেকেই এই নাটকটিকে ১৯৫০ সালে আমেরিকার কম্যুনিষ্ট বিরোধী অভিযান ম্যাকার্থিজমের বিরুদ্ধে একটি রূপক নাটক হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। আমারও তাই ধারণা। যদিও নাট্যকার নিজে এটিকে রূপক নাটক হিসেবে অস্বীকার করেছেন। অবশ্য এতে তেমন কিছুই যায় আসে না। কেননা ‘ক্রুসিবল’ নিজগুনেই একটি অনন্য সাধারণ কালোত্তীর্ণ নাটক। এর বিষয়বস্তু আজও বিশ্বের বহু জায়গায় বিশেষ করে আমাদের দেশের মত তৃতীয় বিশ্বে খুবই প্রাসঙ্গিক। হীনস্বার্থে একশ্রেণীর মানুষ ধর্মকে তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে যুগে যুগে ব্যবহার করার প্রয়াস চালিয়ে এসেছে এবং অনেক নিরীহ মানুষকে এর শিকার হতে হয়েছে। প্রাচীন যুগে, মধ্যযুগে, এমনকি আমাদের আধুনিক যুগেও এই চিরকালীন কুপ্রথা বর্তমান। ‘ক্রুসিবল’ নাটকের বিষয়বস্তুও এই চিরকালীন কুপ্রথাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে বলে এই নাটক আমাদের ভাবনার জগতকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়।
‘ক্রুসিবল’ নাটকের কাহিনী গড়ে উঠেছে ১৬৯২ সালের ম্যাসাচুসেটস এর সালেম শহরকে ঘিরে। কয়েকজন বালিকা, বালিকাসুলভ চপলতায় জঙ্গঁলে নাচছিল- যা তৎকালীন ধর্মব্যাখ্যাকারীদের দৃষ্টিতে একটি পাপ কাজ। হঠাৎ করেই সেই বালিকাদের মধ্যে রেভারেন্ড প্যারিসের কন্যা বেটি প্যারিস অসুস্থ হয়ে পড়ে। তৎকালীর ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস থেকে রেভারেন্ড প্যরিসের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, এটি ডাইনীদের কাজ। তিনি ডাইনী বিষয়ে পারদর্শী রেভারেন্ড হেইলকে খবর দেন। সালেমবাসীর মনেও এই ডাইনী বিষয়ক ভাবনা গভীর প্রভাব ফেলে। এদিকে নাটকের প্রধান চরিত্র জন প্রক্টরের সাথে এবিগেলের স্বল্পস্থায়ী অবৈধ সম্পর্কের এক পর্যায়ে এবিগেল স্বীকার করে জঙ্গলে তারা দুষ্টুমি করেই নাচছিল। বেটি প্যারিসের অসুস্থতার সাথে ডাইনীর কোনো সম্পর্কই নেই। এবিগেল জন প্রক্টরকে পুরোপুরি নিজের করে পেতে চায়। তাই রেভারেন্ড হেইলের প্রশ্নবান থেকে নিজেকে রক্ষা করা ও জন প্রক্টরকে নিজের করে পাওয়ার জন্য এবিগেল জন প্রক্টরের সতী সাধ্বী স্ত্রী এলিজাবেথ প্রক্টরের উপর ডাইনীর অপবাদ চাপিয়ে দেয়। এবিগেলের সাথে পূর্ব কথন, অবৈধ প্রণয়, চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদির স্বীকার করেও জন প্রক্টর আপ্রাণ চেষ্টা করে তার স্ত্রীকে রক্ষা করতে। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। উপরন্তু নিজেও শয়তানের দোসর হিসেবে বিচারক ডেপুটি গভর্নর ড্যানফর্থের আদালতে প্রহসনমূলক বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। ধার্মিক রেবেকা নার্সের মত মানুষও এই কুচক্রীদের হাত থেকে রেহাই পায় না। সঙ্কটময় বন্দীদশায় জন প্রক্টর ও এলিজাবেথ প্রক্টর নিজেদের ভেতরের সত্যিকারর স্বরূপটি আবিষ্কারে রত হয় এবং মূলত এর মধ্য দিয়েই নাটকটি তার উৎকর্ষতার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছায়। জন প্রক্টর নিজের জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এই সত্যে স্থির থাকে যে, হীনস্বার্থে চক্রান্তকারীরা অন্তত ধর্মের নামে তার নামকে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যবহার করে কলুষিত করতে পারবে না । সাদামাটাভাবে ‘ক্রুসিবল’ নাটকের গল্পের অবয়ব অনেকটা এরকম হলেও এই নাটকের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ধর্মান্ধতা, ব্যক্তি সম্পর্কের টানাপোড়েন, নিজের সত্যিকারের স্বরূপ আবিষ্কারের সাধনা ও এর সাহসী প্রকাশ। সর্বোপরি জীবনকে তুচ্ছ করে সত্য ও মানবিকতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার নিরন্তর সাধনায় নিমগ্ন হয়ে সাধারণ থেকে অসাধারণ মানুষ হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা!
অনুবাদ কর্মটি সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা, এর প্রধান ভয় থাকে মূল থেকে সরে যাবার। এটা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, তাহমিনা আহমেদ ‘ক্রুসিবল’ নাটকের মূল সুরটির ব্যত্যয় না ঘটিয়ে অনুবাদের ঝুঁকিপূণর্ কাজটি সার্থকভাবেই সম্পন্ন করেছেন। নির্দেশক তারিক আনাম খান ও তাঁর কথনে নাটকটির ধ্রুপদী মান রক্ষার্থে রূপান্তরে না গিয়ে ভাষান্তর গ্রহণ করার কথা বলেছেন। মনে হয় এই কারণেই মিলনায়তনে বসে যখন নাটকটি দেখছিলাম, তখন কীভাবে যেন নিজেও সেই সালেম শহরের একজন হয়ে গিয়েছিলাম। জন অজয়ের আবহ সংগীত, তৌকীর আহমেদের মঞ্চ পরিকল্পনা, পংকজের আলোর পরিমিত ব্যবহার সর্বোপরি নাট্যকেন্দ্রের কুশীলবদের টিমওয়ার্ক আর্থার মিলারের ‘ক্রুসিবলকে’ পুরোপুরি জীবন্ত করে তুলেছে দর্শকের সামনে। শেষ দৃশ্যে জন প্রক্টরের মৃত্যুকালীন সময়ে পেছনের পর্দা জুড়ে লাল আলোর ব্যবহার নিঃসন্দেহে নাটকটিতে একটি আলাদা ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে।
কুশীলবদের অভিনয় পারঙ্গমতার দিক বিবেচনায় কয়েকজন যেমন অসাধারণ করেছেন, তেমনি দুয়েকজন হতাশও করেছেন। একজন মোটা দাগের মানুষ থেকে ধীরে ধীরে সত্যিকারের একজন মানুষ হয়ে ওঠার বিবর্তন প্রক্রিয়ায় তারিক আনাম খান নিজেকে যথার্থভাবেই প্রকাশ করতে পেরেছেন। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে অত্যাচারিত, বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে মানসিক শক্তিতে ভরপুর একজন পরিবর্তিত মানুষের পরিবর্তনে তিনি অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। এলিজাবেথ প্রক্টর চরিত্রে জয়শ্রী কর জয়াকে মনেই হয় নি তিনি অভিনয় করছেন। অভিনন্দন তাঁর প্রাপ্য। নিয়াজ তারেক, গোলাম মোস্তফা, মুবিনা আহমেদ জলি, রুনা সিকদার স্ব স্ব চরিত্রে অনবদ্য। তবে ইকবাল বাবুর কাছে আমাদের প্রত্যাশা আরো খানিকটা বেশি ছিল। একজনের কথা একটু বিশেষভাবেই বলতে হয়- তিনি হলেন তৌকীর আহমেদ। ডেপুটি গভর্নর ড্যানফর্থের ভূমিকায় সাধারণ দর্শকের ধিক্কার তিনি অর্জন করতে পেরেছেন যা এই চরিত্রের সত্যিকারের প্রাপ্য। সে কারণেই তিনি সফল। পাশাপাশি হতাশ হয়েছি রেভারেন্ড হেইল চরিত্রে তানভীর হাসানের চরিত্রায়নে। ‘ক্রুসিবল’ নাটকে রেভারেন্ড হেইল একটি অন্যতম চরিত্র। নাটকের শুরুতে যার আবির্ভাব একজন অন্ধকার জগতের মানুষ হিসেবে। কিন্তু ঘটনার পরম্পরায় রেভারেন্ড হেইল একজন আলোকিত মানুষে পরিণত হন। এই পথ পরিক্রমায় চরিত্রটি অন্তর্গত দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও অপরাধ বোধে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে দৃশ্য থেকে দৃশ্যে। কিন্তু চরিত্রের এই বাঁক পরিবর্তনে তানভীর হাসান নিজেকে তুলে ধরতে পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছেন। সবশেষে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় নির্দেশক তারিক আনাম খান ‘তুঘলকের’ পরে আরেকটি স্মরণযোগ্য প্রযোজনা দর্শকদের উপহার দিতে পেরেছেন। তাঁর কাছে আরো ভালো নাটক পাওয়ার আকাক্সক্ষা আমাদের বেড়ে গেল।
‘ক্রুসিবল’ নাটকটি মঞ্চে দেখার পর যখন বাসায় ফিরছিলাম তখন আমার মাথায় একটা ভাবনাই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। মানুষ যান্ত্রিকভাবে বিজ্ঞানের চরম শিখরে উঠেছে সত্য, কিন্তু মানসিকভাবে সমগ্র মানব সমাজ কতটুকু এগুতে পেরেছে? ধর্ম পৃথিবীতে এসেছিল মানুষের কল্যাণে। কিন্তু মানবিকতাবিরোধী, অকল্যাণকর কর্মকা-ে ধর্মের অপব্যবহার আমরা কতটুকু রোধ করতে পেরেছি? বক ধার্মিকদের রোষানলে পড়ে সক্রেটিসকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, গ্যালিলিও বাধ্য হয়েছিল সত্যকে চেপে যেতে, পঞ্চদশ শতকে ফ্রান্সের অমিত তেজীকৃষক কন্যা জোয়ান অব আর্ককেও ‘ক্রুসিবল’ নাটকের পাত্রপাত্রীদের মত ডাইনী অপবাদ নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। আমাদের নিকট অতীত ও বর্তমানের দিকে তাকালেও দেখতে পাই দেশে দেশে ধর্মকে কতভাবেইনা অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের মাধ্যমে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৯৭১ সালেও বিশেষ এক শ্রেণী ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে। আজও আফগানিস্তানে তালেবানরা ধর্মের দোহাই দিয়ে মানবিকতাকে পদদলিত করছে। আমাদের দেশের গ্রামে গঞ্জে ফতোয়াবাজদের শিকার হচ্ছে নূরজাহানের মত অনেকেই। কবে অবসান হবে এই অসুস্থ পরিবেশের? কবে আমরা নির্মল বায়ুর মুক্ত পরিবেশে মুক্তির গান গাবো? সেই সময় কি খুব দূরে?
নেহাল আহমেদ : নাট্যজন, সদস্য- জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার-ঢাকা