Full premium theme for CMS
অভিনয় যখন পেশা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
...“যখন অভিনয়ে অপেশাদার ছিলুম, গ্রুপ থিয়েটারে ছিলুম, তখনি অভিনয় করে আমি সত্যিকার আনন্দ পেতুম। আজ পেশাদার অভিনেতা হয়ে আমি অভিনয়-সুখসম্ভোগের ক্ষমতাটি হারিয়েছি। আনন্দ হারালে, আপনার সৃজনকর্মের মিষ্টস্বাদ গ্রহণের বৃত্তিটি বিনষ্ট হয়ে গেলে, শিল্পীর অবস্থা হয় সেই পৌারাণিক নাগটির মতো, যে সর্বদাই আপনার মুখস্থিত বিষকে অমৃত বলে ভুল করত।”-গভীর দীর্ঘশ্বাসের সংগে 'ও চুপ করল।
সামনে সমুদ্র। জলের কোলাহল। ওর কথার তোড়ে এতোক্ষণ হারিয়ে গিয়েছিল। এবার এই নীরবতার ফাঁকে ঊর্মিমালা সহস্রকণ্ঠ হয়ে উঠল। খেয়াল করি নি কখন বেলা পড়ে এসেছে। গতায়ু আলো ঢেউ-এর চূড়ায় নানা রঙের মুক্তোছড়া গড়ছে- লাল-নীল-সোনালী-রূপালী-কমলা-বাদামী। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার সুনামধন্য সর্বজনপ্রিয় অভিনেতা বন্ধুর মুখখানা কালো হয়ে উঠল-
“আনন্দ হারিয়ে অফিস আদালতে কলম পেশা যায় হয়ত, কলকারখানা ক্ষেত খামারে ঘাম ঝরানো যেতেও পারে, সংসার বা জীবিকা নির্বাহও করা যেতে পারে- করতে হয়- কিন্তু শিল্পী বা স্রষ্টা হওয়া যায় না কদাপি। শিল্পকর্ম আর যাই হোক্, বিরস বদনে নীরস কর্তব্য সম্পাদনের ব্যাপার নয় কখনো। যখন অপেশাদার ছিলুম, অভিনয় থেকে স্রেফ আনন্দটুকু নিষ্কাষিত করে দর্শকের সংগে ভাগাভাগি করে নিতেই অভিনয় করতুম। আর কোনো কারণে নয়। অভিনেতা হিসেবে আমি যে সেদিন বড়মাপের কেউ ছিলুম তা নয়, তবে আমি কৌতূহলী ছিলুম, পরিশ্রমী ছিলুম, নিষ্ঠাবান ছিলুম। নিজের কাজে আমার ভালবাসা ছিল, শ্রদ্ধা ছিল। আমি বিশ্বাস করতুম, সকল শিল্পের শিরোমণি এই নাট্যকলায় কিঞ্চিৎমাত্র দক্ষতা লাভের জন্যে দরকার নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম, নিষ্কাম অভিনিবেশ, নিশিদিন অনুশীলন। শিল্পমাত্রই আকাশ পাহাড় কিংবা সমুদ্রের মতো ব্যাপ্ত, উচ্চ এবং গভীর। অগাধ রহস্যে ঘেরা। নতুন নতুন আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষায় আমি সেদিন সর্বদাই ছটফট করতুম। এক অজানা রহস্যময় দেশে প্রবেশের নেশায় উন্মত্ত ছিলুম। কিছু জানার- কিছু করার- নতুন কিছু- বড় কিছু- অর্থপূর্ণ কিছু করার একটা তাগিদ একটা দায় অনুভব করতুম। শিল্প সাহিত্য নিছক রং তামাশার ব্যাপার নয়- সমাজ সংসারের রূপান্তরকারী সে এক বৈপ্লবিক হাতিয়ার- এমন পবিত্র এক বিশ্বাসের মন্দিরে আমি প্রতিদিন মাথা ঠেকাতাম। অভিনেতা হিসেবে আমি সেদিন যত ছোটই থাকি না কেন, শিল্পী হিসেবে আমি ছিলুম মহৎ।”- ক্ষণেক বিরতি দিয়ে ও যেন হাহাকার করে উঠল- “পেশাদার হয়ে অভিনেতা হিসেবে আমি সুদক্ষই হয়েছি কেবল, আমার শিল্পী-আমি শেষ হয়ে গেছে, মরে গেছে।”
এসব কী বলছে ও? কেন বলছে? বন্ধু আমার আজ অভিনয় জগতে শীর্ষস্থানীয়। খ্যাতি প্রতিপত্তি বিত্ত সবটাই তার উপচে পড়ছে। সিনেমা, কমার্শিয়াল থিয়েটার, রেডিয়ো, রেডিয়ো কমার্শিয়াল, টি.ভি, যাত্রা।- একালের সব ক’টি অভিনয়-মাধ্যমে উড়ছে তার বিজয় পতাকা-তবু সে কেনো এমন নৈরাশ্যেদ্গার করে? এ কি বিলাস, না মতিভ্রম, নাকি দক্ষ কুশীলবের আর এক অভিনয়?
ওকে জানি সেই কৈশোর থেকে। আমরা সতীর্থ। ত্রিশ বছর আগে ঝিমিয়ে পড়া গণনাট্য সংঘ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা এক আদর্শবাদী প্রবীণ কর্মীর কাছে আমরা একত্রে নাটকের প্রথম পাঠ নিয়েছিলুম। তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল আমাদের নাটকের দল- গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের অপেশাদার কর্মী ছিলুম আমরা। আমাদের মধ্যে ও-ই ছিল সবচেয়ে প্রতিভাবান, সবচেয়ে সক্রিয়। কাজে ও চিন্তায়। দশ বছর অপেশাদার থিয়েটার নিয়ে হৈ চৈ করে, ও-ই কিন্তু প্রথম আমাদের বলেছিল-পেশাদার হতে হবে। অপেশাদার থিয়েটারটা ‘বিয়ে না করে সংসার’ করার মতো ব্যাাপার। সজোরে টেবিল চাপড়ে ছিপছিপে দীর্ঘ দেহটায় অদ্ভুত ঝাঁকুনি দিয়ে ও পেশাদার হবার পক্ষে ওর যুক্তিগুলো এক-দুই-তিন করে সাজাতো সেদিন।
১.
গ্রুপ থিয়েটারের পরিসর খুব ছোট। তার দর্শকের সংখ্যা বেশি নয়। মানুষের কাছে পৌঁছুবার যতবড় অঙ্গীকারই সে করে থাকুক না কেন, খুব বেশি লোকের সামনে সে হাজির হতে পারে নি, পারবে না। অন্য অভিনয়-মাধ্যমগুলির সংগে তুলনা করলে, তার সীমাবদ্ধতা আরো প্রকট হয়ে উঠবে। কমার্শিয়াল থিয়েটার-ষ্টার রঙমহল বিশ্বরূপা মিনার্ভা সারকারিনা-র থিয়েটারের কথাই ধরা যাক। বৃহস্পতি শনি রবি ছুটির দিনের এই নিয়মিত থিয়েটার গড়ে মাসে ত্রিশ প’য়ত্রিশ হাজার দর্শক পায়। আবার চিৎপুরের যাত্রা ঐ প’য়ত্রিশ হাজার দর্শক পায় একরাত্রির এক আসরে। আর একটা ছায়াছবি-যার দশটা প্রিন্ট দশটা চিত্রগৃহতে একই সময়ে চলছে- ৩টা ৬টা ৯টায় চলছে- একদিনে লক্ষ দর্শকের সম্মুখীন হয়। এই এক লক্ষ দর্শকের কাছে পৌঁছুতে একটি নাট্য গোষ্ঠীর কতোকাল লাগবে? আর্থিক সঙ্কট অপেশাদার থিয়েটারের সহোদর যমজ ভাই। এর পক্ষে বহুদূর গমন করা সম্ভব নয়। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটা দল কিছুদূর যেতে পারে মাত্র, অনেকে পারে না। অনেক দূর পারে না। একটা ছোট্ট গ-ীর মধ্যে ঘুরছি আমরা। বেশি সংখ্যক দর্শকের আকর্ষণে এই গ্রুপ থিয়েটার ছাড়তে হবে। লেখক চিত্রকর গায়ক অভিনেতা-শিল্পীমাত্রই চায়, চাইবেন, তাদের কাজকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে। অপেশাদার জীবন এই সুযোগ দেয় না, কোনো দেশেই দেয় না। কাজেই আমি পেশাদার হব।
২.
যে থিয়েটার টাকা দেয় না, দিতে পারে না, সে থিয়েটারে সত্যিকার প্রতিভাবান দক্ষ শিল্পী কলাকুশলী কোনোদিনই আসবেন না। যাঁরা আসবেন তাঁরা নিছক শখে আসবেন। এইসব সাব-স্টান্ডার্ড অভিনেতা কলাকুশলীর সংগে কতদিন জড়িয়ে থাকা যায়? বসে বসে ক্ষয় হতে হবে শুধু। কাজেই আমি পেশাদার হতে চাই।
৩.
পেশাদার হব-কারণ এখুনি একটা পেশার, একটা বৃত্তিগ্রহণের দরকার আমার। নিজের জীবন ধারণের প্রয়াজনে। মা-বাপ ভাইবোনদের ভাত-কাপড় যোগাবার প্রয়োজনে। অভিনয়টাকে বৃত্তি-হিসেবে না নিলে আমাকে এখুনি কোনো-না-কোনো চাকরিতে ঢুকতে হবে। ফল কী হবে? মন দিয়ে না করতে পারব চাকরি, না করতে পারব অভিনয়। অভিনয়টাকে পেশা করে নিলেই কেবল আমার দুকূল রক্ষে হয়। ভালবাসার বস্তুকে যদি প্রাণধারণের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সংগে এক করে নেওয়া যায়, সে আমাকে না মেরে আমাকে ছেড়ে পালাতে পারবে না- আমিও বেঁচে থাকতে তাকে ভুলতে পারব না। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবেই আমি পেশাদার অভিনেতা হব।
৪.
একটি আদর্শগত সংগ্রামের কৌশল হিসেবেই এই মুহূর্তে আমাদের বাণিজ্যিক অভিনয় জগতে প্রবেশ করতে হবে। একথা আর লুকোছাপির কোনো মানে হয় না যে, কিছু নষ্টরুচির দুষ্টবুদ্ধির পয়সাঅলা মানুষ আজ তাদের নোংরা হাত বাড়িয়েছে শিল্প সাহিত্যের দিকে। টাকা খাটাচ্ছে সিনেমা-থিয়েটার-যাত্রার ব্যবসায়। ব্যবসাটাকে তারা বীভৎস বানিয়ে তুলছে মুনাফার লোভে। এই বিকৃত রুচির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে, এদের শিবিরে ঢুকেই লড়তে হবে। আমি ওদের ব্যবসায় সূঁচ হয়ে ঢুকব, তলোয়ার হয়ে লড়ব।
ওর যুক্তি খণ্ডাবে কে? সেদিন আমরাও বুঝতে পারছিলুম ওর কথাই ঠিক। থিয়েটারে অপেশাদার হয়ে শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছু করে যেতে পারব কিনা তা নিয়ে আমাদের মনে ঘোর সংশয় দেখা দিয়েছিল। তবু ওর মতো ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি নি। ঝুঁকি তো বটেই। বাঁধা সরকারি চাকুরির নিশ্চিত মাসোহারাটি ছেড়ে অনিশ্চিত পেশাদার অভিনেতার জীবন আমরা কেউ বরণ করে নিতে পারি নি। ’ও নিয়েছিল। আমাদের সবার গোপন মনোবাসনাটি ওর মধ্যে দিয়ে পূরণ হয়েছিল। হঠাৎ আজ কেন ’ও এমন অভিশপ্ত গন্ধর্বের মতো হা হুতাশ করছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইলুম। আর হঠাৎ-ই আজ খেয়াল করলুম, ওর বয়েস হয়েছে। ওর ছিপছিপে দীর্ঘদেহটা ভারী হয়েছে। আর সে টানটান ভাবটা নেই। মাথাটা হাল্কা হয়ে এসেছে, প্রশস্ততর কপালে পাঁকাল মাছের মতো অজস্র বলিরেখা, দু’চোখের অববাহিকায় বাড়তি মেদ দুটি উঁইঢিপি বানিয়েছে।
“আজ আমি শেষ”- ’ও থেমে থেমে বলে চলেছে- যেদিন গ্রুপ থিয়েটার ছেড়ে কমার্শিয়াল থিয়েটারে-সিনেমা-যাত্রার খাতায় নাম লিখিয়েছি, পেশাদার হয়েছি, সেদিনই পরিসমাপ্তি ঘটেছে আমার শিল্পবোধ, জীবনবোধ, আদর্শের। রুচি পছন্দ সব কিছুর। কী নাটক করছি, কী সিনেমা করছি, কেন করছি, কাদের জন্যে করছি- এ সব প্রশ্ন আজ আর আমাকে ভাবায় না, ক্ষেপায় না। আজ আমি একটা যন্ত্র, অর্থোপার্জনের যন্ত্র মাত্র। অভিনয় করাটা এখন আমার পেশা। আমি বিক্রেতা। অভিনয় বিক্রি করে খাই। বেশি দামে যদি বাজে মাল বিক্রি করতে পারি, সব ব্যবসায়ীর মতো আমিও হৃষ্ট এবং পুষ্ট হই। নাট্যকলা সম্পর্কে নাটক সম্পর্কে আজ সে কৌতূহলও নেই, অনুরাগও নেই। নিজের যোগ্যতা বাড়াবার স্পৃহাও নেই। একজন দোকানদার যেমন ভাবে, দোকান যখন ভালোই চলছে- আর ঘাঁটাঘাঁটি করব না- আমারো হয়েছে তাই। দেখছি যা করছি তাই চলে যাচ্ছে। কেন আর খামোখা অন্যরকম করতে যাওয়া, সাধ করে বিপদ ডেকে আনা? পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়দের কা- দেখেছ? নব্বই মিনিটে একটা গোল দিয়ে বেশিরভাগ সময় ওরা এলেবেলে খেলা চালিয়ে যায়- বলে, এক গোলেই যখন ট্রফি ঘরে আসছে- তখন দু’গোল দেবার জন্যে খাটতে যাবো কেন- এই জঘন্য পেশাদারী বাতাস আমার গায়েও লেগেছে। দেখছি অল্প আয়াসে টাকা ঘরে আসছে প্রশংসা ঘরে আসছে। অনর্থক খাটতে যাবো কেন? ব্যবসায়ীর মতো আমরাও আজ নতুন বোতলে পুরনো মদ বেচি। লোকে বলছে তারা নাকি আমাকে মঞ্চে এবং পর্দায় ভিলেন হিসেবে দেখতে ভালোবাসে- তবে আমি ভিলেনই থাকব। আমার পূর্বসূরী সফল অভিনেতারা ভিলেন-এর অভিনয়ের যে ছক দিয়ে গেছেন- সেই ছকেই নিজেকে বাঁধব। ব্যবসা- তা সে চালডাল তেল নুনের হোক- আর থিয়েটার সিনেমা নাচগান বাজনারই হোক- অনিবার্যভাবে কয়েকটি সহজাত ধর্মের শিকার। এক হল, যে মালটার চাহিদা বেশি, ব্যবসায়ী সেই মালের প্রোডাকশান বাড়িয়ে চলে। অভিনেতা হিসেবে আমিও এখন তাই করি। যে ধরনের চরিত্রে-অভিনয় করে সুখ্যাতি পেয়েছি, আমি এখন সেই ধরনের চরিত্র খুঁজে বেড়াই। যে ধরনের স্বরক্ষেপণ, মুখভঙ্গি, চোখ কাঁপানো, ভুরু নাচানো দিয়ে দর্শকের হৃদয় নাচিয়েছি- আমি এখন নিপুণভাবে সেইগুলিরই পুনরাবৃত্তি করি। নিজেই নিজেকে অনুকরণ করি। ইমেজ ভাই- একে বলে ইমেজ বা ভাবমূর্তি বজায় রাখা। প্রতিদিন ভাবমূর্তি নামক শালগ্রামশিলা ধুয়ে জল খাওয়া। লক্ষ্য করলে দেখবে আমাদের পেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সবারই এক একটা চরিত্রের ইমেজ আছে। কেউ ভিলেন, কেউ ভাঁড়, কেউ ভাবুক, কেউ পাগল, কেউ আপনভোলা বড়দা, কেউ স্নেহময়ী জা, কেউ অবহেলিতা সতী, কেউ কাঁদুনে, কেউ হাসকুট্টে। এক একটা চরিত্রে এক এক জনের খ্যাতি। ভালো অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি কিন্তু কম ব্যক্তির। এ সব খ্যাতি অভিশাপ। আমি ঝানু ব্যবসায়ীর মতো চাই ওজনে কম দিয়ে, লাভের অংকটা বাড়াতে। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবে, আমাদের পেশাদার মঞ্চ, সিনেমার নটনটীরা গিরিশচন্দ্র-দানীবাবু-দূর্গাদাসের থেকে এক পাও এগোন নি। অত্যন্ত চাতুর্যের সংগে এবং হাস্যকরভাবে তাঁদের অনুকরণ করে চলেছেন। কিন্তু যখন গ্রুপ থিয়েটারে ছিলুম, অপেশাদার ছিলুম, আমি দুঃসাহসী ছিলুম, ছক ভেঙে বেরিয়ে পড়তে চাইতুম। নতুন নতুন চরিত্র খুঁজতুম। নতুন কিছু গড়তে না পারলেও, ভাঙার আনন্দে ভেঙে চলতুম। আর সত্যি কথা বলতে কি, ভাঙাটাও এক রকমের গড়া। একটা কাঁচের গেলাস ভেঙে দ্যাখো, গেলাসের এক চেহারা ভেঙে তুমি আরেক চেহারা গড়েছ। আজ আমি ভাঙার কথা ভুলে গেছি। তাই গড়তেও পারি না। আজ আমি ছকের বাইরে যাবো না- রুজি রোজগারে অনিশ্চিতি ডেকে আনবো না। অচেনাকে বড় ভয় করি আজ। দারুণ ভীতু একটা লোক এখন আমার জামাকাপড়ের মধ্যে সিঁটিয়ে থাকে। ভীতুর ডিম। ডিম যেমন হাঁসের গরম পেটের নিচে থাকে আর তাপ খায়, আমিও তেমনি এখন অর্থ-জনপ্রিয়তা-প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিষ্ঠানের সোনার হাঁসের তলপেটের নিচে গা-ঢাকা দিয়ে উষ্ণ আরাম ভোগ করছি। আজ আমি অভিনেতা বটে, তবে কখনোই শিল্পী নই।”
আবার কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। বালির ওপর অলস আঙুলে আঁকিবুকি কাটাছে ’ও। তলোয়ার আঁকছে, ঢাল তলোয়ার মুকুট- ঐতিহাসিক পৌরাণিক নাটকের সাজসজ্জা। জল ছুটে এসে নিমেষে সব মুছে দিয়ে গেল। ’ও আবার শুরু করল-
“অপেশাদার গ্রুপ থিয়েটার ছেড়ে এসে আমি অনেক কিছু হারিয়েছি। আমাদের থিয়েটারে কোনো মালিক ছিল না। কারো ফিনান্সে চলত না। ফলে কোনোদিন কোনো মালিকের দাসত্ব করতে হয় নি। কোনো সত্ত্বাধিকারী ছিল না। কোনোদিন কারুর অন্যায্য নাট্যবিশ্লেষণে ঘাড় নেড়ে সায় দিতে হয় নি। আজ আমি স্বাধীনতা হারিয়েছি। আমাদের দরিদ্র গ্রুপ থিয়েটার ছিল একান্ত ভাবে আমাদেরই। আমরাই ছিলুম মাথা, আমরাই হাত-পা। নাটক নির্বাচন থেকে শুরু করে অভিনয়-শেষে মধ্যরাতে থিয়েটারের লটবহর বহন করা, মায় বাজারের ঋণশোধ পর্যন্ত সমস্ত দায় ছিল আমাদের প্রত্যেকের ঘাড়ে। আমি সেখানে শুধু অভিনেতা ছিলুম না, ছিলুম একজন নাট্যকর্মী। একটি প্রযোজনার সকল বিভাগে যে মাথা খাটাতো গা ঘামাতো। অনেক অনটন অনেক অস্বাচ্ছন্দ্যও আছে ঐ দিন-আনা দিন-খাওয়া নির্ধন থিয়েটারে- তবু একটা গর্ব ছিল আমাদের প্রত্যেকের যে, আমরা প্রত্যেকে একটা গোটা থিয়েটারকে বহন করছি- তার কোনো একটি বিভাগের দায়িত্ব নয়, সমগ্র থিয়েটারের সাফল্য-অসাফল্যের অংশীদার আমি। এখন, এই ব্যবসায়িক থিয়েটারে, সিনেমায়, যাত্রায়- আমি আর দশজন বেতনভুকদের মধ্যে একজন। এখানে আমার ভূমিকা বাড়ির ঠিকে-ঝির মতো। এসো, কাজ করো, মাইনে নাও, চলে যাবার আগে একবার মালিকের সঙ্গে দেখা করে যাও! বাসন মাজো, কুটনো কাটো, আঁচ ধরাও- তা বলে ভুলেও মনে করো না, তুমি এ সংসারের কেউ। হাঁড়িতে হাতা ডুবিয়ে ঘোঁটাঘুঁটি করো, তা বলে প্রশ্ন ক’রো না- কী রান্না হচ্ছে, কেন রান্না হচ্ছে, এ রান্নার পাচ্য না দুষ্পাচ্য! শ্রীরামকৃষ্ণ একেই কি বলেছেন সংসারে পাঁকাল মাছ হয়ে থাকা? এতে হয়তো মোক্ষ জুটবে কিন্তু নিরন্তর আপনার কৃতকর্ম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়- তা-কি ভোলাতে পারবে? পেশাদার জীবন গোটা থিয়েটারকে কাঁধে বয়ে বেড়াবার দায় থেকে আমাকে মুক্তি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে আমাকে করে দিয়েছে নিতান্তই ফালতু। আমার হাত পা অচল করে দিয়েছে। মগজটিকে করেছে ফাঁকা হালকা। এখন আর নাটক বা সিনেমা ভালো কি মন্দ হল তা বুঝি না। বুঝি- সেটা চলছে কি চলছে না। চললেই ভালো, না চললেই গেল। অন্যান্য পেশাদার শিল্পীদের কথা বলতে পারব না, তবে আমি দিনকে দিন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছি। নষ্ট হয়ে যাচ্ছি। বিশালকে হারিয়ে এখন আমি তুচ্ছকে নিয়ে মেতে থাকি। এখন গ্রীনরুমে বড় ইজি চেয়ার না পেলে মনে হয়, আমার মতো একজন অভিনেতাকে অসম্মান করা হচ্ছে। ড্রেসার এসে প্যান্ট ছাড়িয়ে পোশাক না পরিয়ে দিলে মনে হয়, কেন থিয়েটার করলুম সারাজীবন? ইনটারভ্যালে চিকেন না পেলে ভাবতে বসি, আমার কি বাজার দর কমে আসছে। পেশাদারের যাবতীয় নষ্টামি ঢুকেছে আমার মধ্যে- নাটক নিয়ে ভাবি কখন? উঁই, হ্যাঁ উঁই লেগেছে। উঁই আমাকে মাটি বানাচ্ছে। আমাকে দিয়ে কি লড়াই সম্ভব? ব্যবসায়ীর শিবিরে ঢুকে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো আদৌ সম্ভব কিনা এসব প্রশ্ন আজ আমাকে দ্বিধান্বিত করে। পেশা বজায় রাখতে গেলে বোধহয় আপোষ করতেই হয়। এই সময়ে, এই সমাজে অন্যরকম কিছু কি ঘটবে?
অন্ধকার হয়ে এসেছে। তীরভূমি ক্রমশ নির্জন হয়ে আসছে। আকাশ নক্ষত্রপূর্ণ। ’ও বলছিল, ‘আমি আর সেই অপেশাদার থিয়েটারে ফিরতে পারব না- আবার এই পেশাদার জীবনের দংশন থেকেও নিজেকে রক্ষা করতে পারি না। আমার মতো দুর্ভাগা কে, যে- না ঘরকা না ঘটকা’।
অন্ধকারে গর্জন করছে সমুদ্র। ঢেউ-এর মাথায় সাদা ফেনা। ঝকঝকে দাঁতের পাটির মতো ঝিকমিকেয়ে উঠছে। সেই দাঁত কসিয়ে অস্থির সমুদ্র তীরের মাটি আঁকড়ে ধরতে চাইছে। পারছে না। ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
আমি দেখছিলুম আমাদের সময়কার এক শিল্পীকে- অথবা সব শিল্পীকে- যাদের পেশাদার না হয়েও গতি নেই, আবার পেশাদার হয়ে যারা বিবেকবর্জন করতেও চায় না। পেশা আর ‘অ-পেশা’র টানাপোড়েনে আর্তনাদ করছে আমাদের সময়কার থিয়েটার- সময়ের ধারালো দাঁতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে নিরন্তর।
মনোজ মিত্র: দুই বাঙলার অন্যতম নাট্য-ব্যক্তিত্ব
[লেখকের ‘অলীক সুনাট্য রঙ্গে’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত]