Full premium theme for CMS
অদ্ভুত আঁধার
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
মানুষকে আশাবাদী হতে হয়। এ না হলে মানুষ বাঁচতে পারে না। কিন্তু সেই আশার পেছনে কিছু বাস্তব কারণ থাকা দরকার। তেমনি কিছু বাস্তব কারণ ঘটেছিল আমাদের জীবনে ষাটের দশকের শেষ থেকে সত্তুর দশকের শুরুতে। দেশটা স্বাধীন হয়ে যাবার পর কত যে আশা পল্লবিত হল আমাদের জীবনে। তার মধ্যে নাটক হয়ে দাঁড়ালো আমাদের একটা বড় আশার জায়গা।
একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেও ব্যাপারটা অনেকদূর এগিয়ে গেলো। প্রচুর মানুষ পাওয়া গেলো। যারা লিখেন, অভিনয় করেন, মঞ্চের পেছনে কাজ করেন। আবার পাওয়া গেলো দর্শকও। সারা দেশে একটা জোয়ার বয়ে গেলো। খুব অল্প সময়ে এ ঘটনাটা ঘটলো।
কিন্তু ওসবে সবচাইতে নিশ্চল পাথরের ভূমিকা পালন করলো সরকার। সরকার শুধুই প্রতিশ্রুতি দিল, আশ্বাস দিল, কিন্তু করলো না কিছুই। অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনটা ওঠালো না, একটা অভিনয়োপযোগী মঞ্চও করে দিলো না। অভিনেতারা অভিনয় করে যেতে যেতে কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়লো আবার টেলিভিশনের হাতছানিটা বড় হয়ে দাঁড়ালো। মঞ্চ ও টেলিভিশনের টানাপোড়েন হতে হতে এসে পড়লো ‘প্যাকেজ’। নাটক পাড়ায় মাথায় আকাশ ভাঙার মতো। রাতারাতি কপাল খুলে গেলো কারো কারো। সেই পদাঙ্ক অনুসরন করে ঝাঁপিয়ে পড়লো আরো কিছু শিল্পী। এই প্রবনতা আজ এক মুখ্য প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এদেশে আরো কিছু বেসরকারি চ্যানেল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন তো বাঁধ ভাঙা জোয়ার আসবে। সে জোয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। তারপরেও মঞ্চে নাটক হচ্ছে।
কালক্রমে মঞ্চে নাটক করাটা অনেকটা ধর্মীয় কাজের মাধ্যমে পূণ্য অর্জনের মতো দাঁড়িয়ে যাবে। কিছু লোক থিয়েটার করবে সত্যিকারের নিষ্ঠা নিয়েই। কেউ হয়তো অক্ষমতা ও ব্যর্থতা থেকে করে যাবে, আবার কেউ কেউ পর্দায় যাবার সোপান হিসেবে ব্যবহার করবে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পর্দা হচ্ছে আমাদের মঞ্চ। ত্রিমাত্রিক এই বিশাল জায়গাটার আকর্ষণে খুব কম সংখ্যক লোক হয়তো কাজ করবে। কারণ এখানে প্রস্তুতির ব্যাপারটাই যে আসল। মহড়া কক্ষের শৃঙ্খলা রক্ষা করতে এ জাতি মোটেই প্রস্তুত নয়। শর্টকার্ট বা শুরুতেই যে জাতি অনেক কিছু পেতে অভ্যস্ত, সে জাতি কঠোর অনুশীলনের মধ্যে যেতেই চায় না। কিছুদিন কাজ করেই সে সিনিয়র হয়ে পড়ে। এই সিনিয়রিটির সাথে তার দক্ষতা হয়তো একেবারেই যায় না। তারপর এ দেশের গ্রুপ থিয়েটারের সাংগঠনিক বিষয়টা এসেছে অত্যন্ত বিকৃতভাবে। সৃজনশীলতাহীন শুধু সাংগঠনিক কাজ করা লোকদের খবরদারি সর্বক্ষেত্রেই আমরা সহ্য করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষেই অসৃজনশীল লোকেরা নেতৃত্ব দিচ্ছে। জাতি বিনা প্রশ্নে এসব মেনে নিচ্ছে। তারপর আছে টাকার জোর। টাকার জোরেও একটা কিছু সেজে বসা যায়। যার টাকার জোর নেই সে এদেশে কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবার অধিকার হারিয়েছে। সর্বোপরি একটা হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নাট্যকর্মে যেকোনো নবাগতই একটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যেতে বাধ্য।
‘মঞ্চ’ নাটকে নাট্যকর্মী, টেলিভিশনে তারকা, বিলাসবহুল জীবন, উচ্চবিত্ত সংস্কৃতি, গাড়িতে সুমন কিংবা জাগজিতের গজলের ক্যাসেট, প্রায়শই বিশাল বিশাল হোটেলে পার্টিতে যাওয়া, এই স্বপ্নের ঘোরে ডুবে আছে একশ্রেণীর নবাগত। এই স্বপ্নের ঘোরটা এমনিতেই তৈরি হয় নি। গত ছাব্বিশ বছরে এ ঘরানার শিল্পীরা সফলতাও পেয়েছে। কারো কারো জীবনে নাটক তাদেরকে একেবারেই অলীক জগতে স্থাপন করেছে। তার জন্যে খুব একটা শ্রম, খুব পড়াশোনার প্রয়োজন হয় নি। ত্যাগ তিতিক্ষার প্রয়োজন তো হয়ইনি। তাই আজকের নাট্যাভিনেতাকে কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প পড়তে হয় না। সঙ্গীতের জগতের সাথে পরিচিত হতে হয় না। অধিকাংশই শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত। সারা পৃথিবী কোথায় আর বাংলাদেশ কোথায় তা জানারও প্রয়োজন হয় না। অ-শ্রম শিল্পচর্চাও একটা মুখ্য প্রবণতা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। জনপ্রিয়তার নিরীখেই এরা সব কিছু দেখতে অভ্যস্ত। কোন কাজটা ভালো হল বা খারাপ হল তার মূল্যায়নের চাইতে কয়টাকা বিক্রি হল তাই নিয়েই এদের মাথা ব্যথা।
মলিয়েঁর সারা নাটক পাড়ায় হই-হুল্লোড় লাগিয়ে দিলো। সবাই মলিয়েঁরের নাটক নামাতে শুরু করল। কারণ, নাটকে হাসি আছে। টিকেট বিক্রি হবে। এখন আবার স্তিমিত হয়ে এসেছে। বিনোদনের উপাচার হিসেবে ব্রেখটও একবার এসেছিলো। সেই ব্রেখট এখন প্রায় নির্বাসিত।
অনুকরণপ্রিয়তা এ জাতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য। মৌলিক সৃজনের চাইতে তাদের কাছে অনুকরণই ভালো লাগে। একধরনের ‘ভাব’ ধরা অভিনয়, ‘ভাবধরা’ জীবন ভালো লাগতে শুরু করলো অনেক নবাগতদের। কিছুদিন পর তাও হয়ে গেলো স্যাঁতস্যাঁতে। শিল্পের কঠিন শ্রমের পথে কেউ পা বাড়াতে চাইলো না। এসবের আবার নিয়ামক হল টেলিভিশন। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক একজন ভিড়ে গেলেন এই লঙ্কাকা-ে। তার প্রভাব পড়লো অভিনেতা অভিনেত্রীদের মধ্যে। তুমুল একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো টেলিভিশন ধারাবাহিককে কেন্দ্র করে। মঞ্চ হয়ে গেল গৌণ। সকল সাফল্যের মাপকাঠি হল টেলিভিশন। উচ্চ মধ্যবিত্ত ইতোমধ্যে স্যাটেলাইটের মজা পেতে শুরু করেছে। দৃষ্টি ফেরাচ্ছে মঞ্চ থেকে, সিনেমা থেকে আগেই ফিরিয়েছিলো।
এ দেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্যে টেলিভিশন ছাড়া আর কোনো বিনোদন নেই। মঞ্চ নাটকের টিকিট, যাতায়াত খরচা ইত্যাদি দিয়ে কুলোয় না তাদের। অথচ পৃথিবীর সব জায়গায়ই এসব দেখে মধ্যবিত্তরা। মধ্যবিত্তদের জায়গায় উচ্চবিত্তদের জন্যেই সবকিছুকে সমর্পন করা হলো।
এই অদ্ভুত আঁধারে একজন সৃজনশীল মানুষ একাকী পথ পরিক্রমা করবে কীভাবে? কে তার মিত্র, কে তার শত্রু?
সত্তুরের দশকে যারা এদেশে নাট্যচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং এখনো করছেন তাদের শোণিত প্রবাহে একটা ব্যাপার আছে। সেই ব্যাপারটা তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। মঞ্চের প্রতি গভীর একটা আকর্ষণ তারা বোধ করেন। তাঁদের মধ্যে দ্বৈতসত্ত্বা, ভাবনাগত অসম্পূর্ণতা, মানুষ হিসেবে অপূর্ণতা এসব থাকলেও মঞ্চে একটা কিছু ঘটাবার জন্যে তাগিদ তাঁরা বোধ করেন।
তারই ধারাবাহিকতায় আশির দশকেও একটা জোয়ার এসেছিল। সম্ভাবনাময় অভিনেতা অভিনেত্রীদের তথা মঞ্চকর্মীদের একটা সমাবেশ হয়েছিল। সামনে ছিল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। পুরো দশক জুড়েই নাট্যচর্চায় মূল প্রবণতা ছিল স্বৈরাচার বিরোধিতা। মঞ্চ নাটকের পাশাপাশি এ সময় পথনাটক, মুক্তনাটক ও গ্রামথিয়োটার বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কিন্তু সমস্যাও হয়। মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে শিল্পের দাবী যতটা থাকে, পথনাটকের জন্য ততটা প্রয়োজন হয় না। কিছু নাট্যদল এ ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা করলেও অধিকাংশ নাট্যদল বিষয়টিকে শুধুমাত্র শ্লোগানধর্মী করে ফেলে।
৯০ এর গণআন্দোলনের ফলে স্বৈরাচারের পতন হলে মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুগত একটা শূন্যতা দেখা দেয়। গণতন্ত্র ভিন্ন চেহারা নেয়। কিন্তু মৌলবাদের একটা উত্থান দেখা দেয়। এখন নাট্যকর্মীদের সামনে এসে দাঁড়ায় মৌলবাদ। তাকে সামনে নিয়ে নাট্যচর্চা বেশ বেগবান একটা চেহারা পায়। ইতোমধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের একটা ঘটনা ঘটে। তা হলো সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়। পৃথিবীতে ক্ষমতায় ভারসাম্যটা ভেঙে পড়ে। তার প্রভাবও নাট্যচর্চায় পড়তে থাকে।
বাংলাদেশের নাট্যচর্চার মুখ্য প্রবণতা রাজনীতি। তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব কমবেশি পড়বেই। কারো কাছে যদিওবা রাজনীতি একটা বিনোদন। ব্রেখট, মলিঁয়ের এবং রাজনীতি কখনো সমার্থক বটে। এই ধরনের চর্চায় সংকট হচ্ছে অনুশীলনহীনতা। মঞ্চে নাটকের বিষয়বস্তু যেমন জরুরি তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এর নন্দনতাত্ত্বিক দিক। ভালো পরিবেশনা ও অভিনয় চাই। এখানে সাধনা লাগে, আজীবন একটা কঠোর শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সস্তা জনপ্রিয়তা এখানে টেকে না। শর্টকোচিং এর কোনো সুযোগ নেই এখানে।
এই অদ্ভুত আঁধারেও আমরা দেখতে পাই আশির দশক ও নব্বই দশকে বেশ কিছু নাটক নেমেছে যার পেছনে শ্রম আছে, নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনা আছে। দর্শক এসেছে সেসব সিরিয়াস নাটকে। দর্শক ভাবনা পেয়েছে, প্রেরণা পেয়েছে। যাঁরা এসব নাটকের পেছনে কাজ করেছেন তাঁরা এখনো সক্রিয়। কতটা সক্রিয়, কতটা আন্তরিক তা অবশ্যই বিবেচনার বিষয়। আবার একশ্রেণীর নাট্যকর্মীদের কাছে বিষয়টা মন্দিরের ঘন্টা বাজানোর মতো প্রাত্যহিকতায় পরিণত হয়েছে। নাটকের মতো যৌথ সৃজনশীল কাজ প্রাত্যহিকতার মাধ্যমে সেরে ফেলা কি কখনো সম্ভব? মহড়া কক্ষকে প্রাণবন্ত করা সত্যিই তো কঠিন কাজ।
গ্রুপ থিয়েটার এক্ষেত্রে সত্যিই সংকটে নিপতিত। দীর্ঘদিন ধরে একই দলে কাজ করতে করতে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটা একঘেঁয়েমি এসে যায়। ক্লিশে হয়ে যায় ব্যাপারটা কখনো কখনো। সেই থেকে একটা ক্লান্তিকর অবসাদ নেমে আসে। আবার কেউ কেউ গুনগতমানের চাইতে কূটবুদ্ধিকে অবলম্বন করে সামনের দিকে দাঁড়াতে চায়। তারা সফলও হয়। সম্ভবত বাংলাদেশের নাট্যচর্চার এ এক প্রধান দুর্বলতা। শুধু কাজ করে, কাজের মাধ্যমে নিজের জায়গা করে নেয়ার সংগ্রামে বহু কর্মী আর নিয়োজিত থাকতে পারছে না। একটা দুটো ভালো কাজ করেই নানা মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যার আড়ালে সহজে আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ খোঁজে। অবশ্য একথাও সত্যি এদেশে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একটা সংকট তো আছেই। এও যেন এক অদ্ভুত আঁধার। মূল্যায়নটাও নিরপেক্ষ হবার কোনো উপায়ই যেন অবশেষ নেই। তরুণ নাট্যকর্মীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও অনেক সংকট ঘটে গেছে। ফলে তাদের অনুসরণের ক্ষেত্রে একটা মানসিক বিপর্যয় হতে বাধ্য। আকাঙ্ক্ষার এবং স্বপ্নের চোরাবালিতে কেউ প্রদক্ষিণ করে এক সময় হয়তো ক্লান্তি এসে যাবে। অথবা ছোট পর্দায় স্থাপিত হয়ে এক ধরনের ভাগ্যের দুয়ার খুলে যাবে।
তবু লক্ষ্য করি অদ্ভুত আঁধারে কেউ কেউ প্রেরণা যোগায়। কোনো কোনো তরুণের অভিনয় অন্ধকারের মধ্যে আশার প্রদীপটিকে দেখায়। আর এই দেখবার মতো হাজারো চোখ থাকা দরকার।
মামুনুর রশীদ : নাট্য ব্যক্তিত্ব