Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

স্মৃতি. পত্র, তত্ত্ব, নাট্য ও জিয়া হায়দার

Written by শান্তনু কায়সার.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

১৯৮৭-তে বাংলা একাডেমী আমার বিদ্রোহী নাট্যতত্ত্ব: ত্রয়ী নাট্যকার প্রকাশ করে। বইটি রবার্ট ব্রাস্টেইনের দ্য থিযেটার অব রিভোল্ট-র বাংলা অনুবাদ হিসেবে বিবেচিত হলেও এটি আসলে তার ও তাঁর উপর ভিত্তি করে স্বচ্ছন্দ অনুবাদের এক স্বাধীন বই। দ্য থিয়েটার অব রিভোল্ট-এ হেনরিক ইবসেন, অগাস্ট স্ট্রীন্ডবার্গ, আন্তন চেকভ, বার্ণাড ’শ, বার্টল্ট ব্রেখট, লুইজি পিরান্দেল্লো, ইউজিন ও নীল, আন্তনি আর্টড ও জাঁ জেনে অন্তর্ভুক্ত হলেও আমি বেছে নিয়েছিলাম তিনজন নাট্যকারকে- বার্টল্ট ব্রেখট, লুইজি পিরান্দেল্লো ও জাঁ জেনে। মূলকে বিকৃত না করেও অনুবাদে যেমন আমি স্বাধীনতা নিয়েছিলাম তেমনি মূল টীকার সঙ্গে অনুবাদকের টীকাও জুড়ে দিয়েছিলাম। আর পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্যে লিখেছিলাম এর একটি দীর্ঘ ভূমিকা। ঐ ভূমিকাটিই বাংলা একাডেমীর ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র উত্তরাধিকার-এ স্বতন্ত্র প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি জিয়া হায়দারের ভালো লেগেছিল বলে তিনি আমাকে একটি পোস্টকার্ডে তাঁর অনুভূতি লিখে পাঠান।

বাংলা একাডেমীর বইটি সম্পর্কে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্তরঞ্জন ঘোষ তাঁর মতামত জানাবার আগে ১৯৮৭-র ২০ ফেব্রুয়ারিতে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, ঢাকার দুই থিয়েটার (‘থিয়েটার’ নাট্যদলটি বিভক্ত হয়ে যে দুটি নতুন দল হয়েছে) ও ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনা তিনি কলকাতায় দেখেছেন এবং এঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন ও আড্ডা দিয়েছেন। ‘থিয়েটার’ পত্রিকাটিও তিনি দেখে থাকেন বলে জানান। তিনি লিখেছিলেন, ‘এখানে বসে যতদূর সম্ভব খোঁজ-খবর রাখবার চেষ্টা করি। আপনার বই সেদিক থেকেও উপকার করবে আমার।’ কিন্তু এরপরই তিনি বলেছেন, ‘আপনার ভূমিকার অংশে আপনি ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়েই আলোচনা করেছেন। তবে পিরান্দেল্লো বা জাঁ জেনের সঙ্গে আমাদের দুই বঙ্গের নাটকেরই যোগ বা সাদৃশ্য খুবই কম। তাই না? এই বইটা অনুবাদে আপনি এতটা আগ্রহী হলেন কেন তা খুব স্পষ্ট নয় ভূমিকায়।’

কিন্তু ১৯৯০-র ২০ অক্টোবর সংখ্যা ‘দেশ’-এর ‘গ্রন্থলোক’-এ বইটির আলোচনা করতে গিয়ে দিলীপকুমার মিত্র লিখেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থটি নাট্যকারদের বিদ্রোহী নাট্যতত্ত্বের ও শিল্পভাবনার এক সুন্দর বিশ্লেষণ।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘শান্তনু কায়সার চমৎকার রূপায়িত করেছেন ব্রাস্টেইনের বক্তব্যকে যা তিনজন ‘বিদ্রোহী’ নাট্যকারকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে এবং সমকালীন বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের নাটকের পটভূমিকায় এসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বিদেশী নাটকের মঞ্চায়নের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব বিচার করেছেন। তিনি মনে করেন প্রগতিশীল নাট্যান্দোলন গড়ে তোলার স্বার্থেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ও লেনদেন হওয়া দরকার, যদিও দেশজ উপাদান, শিল্পরীতি ও জীবনবোধকে কোনোমতেই অবহেলা বা অস্বীকার করা যাবে না।’

জিয়া হায়দারের ঐ চিঠিটি এখন আর খুঁজে পাওয়া না গেলেও এর পরবর্তী পোস্টকার্ডটি পেয়েছি। ১৯৮৪-র ১৪ জুন চট্টগ্রাম থেকে তিনি লিখেছেন, ‘উত্তরাধিকারে আপনার লেখাটি ভালো লেগেছিলো- এ কথাটা জানিয়ে একটা কার্ড পাঠিয়েছিলাম, আশা করি পেয়েছিলেন।’ তারপর জানাচ্ছেন, ‘আমি ঈদের সময় ঢাকা থাকবো। ঈদের ২/১ দিন পর চট্টগ্রাম ফিরবো। যদি ভরসা দেন, তাহলে ফেরার পথে ২/১ দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে কাটানো যায়। পুতুলনাচের লোকজনদের সঙ্গে কিছু আলাপ করার আছে এবং আপনার সঙ্গেও।’

১৯৮১-র মে মাসে প্রকাশিত ‘নাট্যবিষয়ক নিবন্ধ’র শেষ প্রবন্ধ ‘পুতুল নাচের কথা’য় জিয়া হায়দার লিখেছেন, ‘আমাদের পাপেট্রির প্রধান কেন্দ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এখানের পাপেট্রিই আমাদের পাপেট্রি। প্রধানত স্ট্রিং পাপেটই এর বৈশিষ্ট্য।’ সুতো দিয়ে নাচানো এই পুতুলনাচে সাবলীলতা ও স্বাচ্ছন্দ্য এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রবন্ধের শেষে এর পাদটীকায় লেখক জানাচ্ছেন যে, ১৯৮০ সালে রাশিয়ার তাসখন্দে অনুষ্ঠিত পুতুলনাচ প্রদর্শনীতে বাংলাদেশ দলে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার কয়েকজন পুতুলনাচ শিল্পী, পাপেটিয়ার অংশ নিয়েছিলেন। এঁদের প্রধান ছিলেন ধন মিয়া। জিয়া হায়দার যখন ১৯৮৪ সালে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় আসেন তখন ধন মিয়ার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় এবং তিনি তাঁদের শিল্প, এর আঙ্গিক এবং তাসখন্দের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তাঁকে
বিস্তারিতভাবে বলেন।

পরে ধন মিয়ার সঙ্গে আমারও একাধিকবার দেখা ও মতামত বিনিময় হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি পূর্বোক্ত ভূমিকায় লিখি, ‘‘বাংলাদেশের পাপেট্রির প্রধান কেন্দ্র’ পুতুলনাচের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত ধন মিয়া বর্তমান লেখককে বলেন, পুতুলনাচে দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, যেমন আপনি পুতুলনাচ চলার সময় উপস্থিত হলেন, পুতুল আপনাকে সালাম দেবে, অত্যন্ত তমিজের সঙ্গে জিজ্ঞেস করবে, প্রফেসর সাহেব, কেমন আছেন? পুতুল আর কাদের এরকম সম্ভাষণ করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেখানে প্রদর্শনী হয় সেখানকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের। যেমন মেলা কমিটির সেক্রেটারি, এস.ডি.ও সাহেব, ম্যাজিট্রেট সাহেব, ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, মেম্বার সাহেব বা স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এ থেকে বোঝা যায়, এঁরা সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধকেই লালন করে চলেছেন। অবশ্য এজন্যে সামাজিক মূল্যবোধ ও সমাজে পুতুলনাচিয়েদের সামাজিক অবস্থানই প্রধানত দায়ী। তবে এই আঙ্গিকটি যদি প্রগতিশীল ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যুক্ত হতো ও স্বাধীনভাবে শিল্পমাধ্যমটিকে ব্যবহার করা যেত তাহলে তা ব্রেখটীয় ও পিরান্দেল্লীয় দক্ষতা ও পরিণতির সঙ্গে দর্শকদের যোগাযোগ ঘটাতে সক্ষম হতো।” এরপর আমি জিয়া হায়দারের ১৯৭৫-এ লেখা প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাই কীভাবে পাশ্চাত্যে তা ঐ ভূমিকা পালন করেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে অধ্যাপনা করলেও জিয়া হায়দার থাকতেন শহরের ইস্পাহানী বিল্ডিং-এ। সেখানেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ও আড্ডা। এরপর বহুবার সেখানে ও শহরের বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে তাঁর সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছে। ঘনিষ্ট হওয়ার পর তিনি নানা বিষয়ে আমার সাহায্য চাইতেন। তাঁর কাজে লাগতে পারলে আমারও ভালো লাগতো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোস্তায়ীন বিল্লাহ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সতীর্থ। স্বভাবে অনেকটা অর্ন্তমুখী হলেও বিল্লাহর সঙ্গে জিয়া হায়দারের ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক। বলা যায়, তাঁর মাধ্যমেই আমরা পরস্পরের খোঁজ ও খবর পেতাম।

১৯৯০-র ১০ মার্চ তিনি চিঠিতে লেখেন, ‘২ তারিখে কুমিল্লা গিয়েছিলাম। আপনার বাসায় যেয়ে জানতে পেলাম, আপনি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া গিয়েছিলেন। অর্থাৎ দেখাটা হলো না।’ তারপর বলেছেন কাজের কথা। ‘অনেক পত্রপত্রিকা তো আপনার সংগ্রহে আছে। কয়েক বছর আগে বিচিত্রায় নাটক সেন্সর বিষয়ে আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। (ক বছর আগে, কোন মাসে এসব কিছুই মনে নেই) ঐ সংখ্যাটা যদি আপনার কাছে থাকে, তাহলে লেখাটার একটা ফটোকপি কি আমাকে পাঠানো সম্ভব?’

কিন্তু অনেক খুঁজে ও পত্রপত্রিকা ঘেঁটেও উল্লিখিত সংখ্যাটি পাই নি এবং স্বভাবতই এক্ষেত্রে তাঁর কোনো কাজে লাগতে পারি নি। কিন্তু এখন দেখছি ‘নাট্যবিষয়ক নিবন্ধ’ বইয়ে শেষের আগের প্রবন্ধটির শিরোনাম, ‘নাটক সেন্সর বিষয়ক আলোচনা।’ প্রবন্ধটি মোটামুটি দীর্ঘ এবং তা শুরু হয়েছে ১৯৭৪-এর ডিসেম্বরে ঢাকার মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চায়িত নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের বহিপীর নাটক সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা দিয়ে। মনে হয়, এটি সেই প্রবন্ধ যা তিনি খুঁজে ফিরছিলেন, হয়তো এর অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত রূপ ঐ সাপ্তাহিকে মুদ্রিত হয়েছিল।

তাহলে কি বইটিতে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধটির কথা জিয়া হায়দার বিস্মৃত হয়েছিলেন? হয়তো। কিন্তু তার কারণটি আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। ১৯৯০-র ঐ সময়ে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে বটে, কিন্তু শৃঙ্খলমুক্তির বিষয়ে তাঁর মতো আমাদের অনেকের মনেই সংশয় থেকে গেছে। নাট্যকার হওয়া ও নাট্য বিষয়ে পেশাগত ও ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণেই শুধু নয়, দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবেও সেন্সর আরোপ তথা বাক-স্বাধীনতা রুদ্ধ হওয়ার বিষয়টি তাঁকে ক্ষুব্ধ করেছিল। পরিস্থিতির প্রতি তাঁর অতি সংবেদনশীলতার কারণেই হয়তো তিনি তাঁর নিজের লেখাটির বিষয়ে স্মৃতি বিভ্রান্তির শিকার হয়েছিলেন। এই স্বদেশপ্রেম তাঁর চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

দুই
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে নাট্যকলা পড়ানো হতো। জিয়া হায়দার মূলত এ বিষয়েই অধ্যাপনা করতেন। নাট্যকলার শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য তিনি প্রথমে আমাকে লুইজি পিরান্দেল্লোর নাটক সিক্স ক্যারেক্টারস ইন সার্চ অব এ্যান অথর অনুবাদ করতে অনুরোধ জানান। আমি সে কাজে হাত দেয়ার আগেই ১৯৯৩-র ২৫ জুলাই তিনি আমাকে লেখেন, ‘ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ এদিক ওদিক হয়ে গেছে। আমার সিক্স ক্যারেক্টারস ইন সার্চ অব এ্যান অথর বইটা এখনো খুঁজে পাই নি। এদিকে ২/৩ দিন আগে আপনার সহপাঠী কাজী মোস্তায়ীন বিল্লাহ আমাকে জানালো যে, তার মামা সৈয়দ মাহীদুল ইসলামের নির্দেশে (বা অনুরোধে) সে সিক্স ক্যারেক্টারস ইন সার্চ অব এ্যান অথর-এর অনুবাদে হাত দিয়েছে। মাহীদুল তাকে বইটি দিয়েছে।’ ‘অতঃপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম- তাহলে আপনাকে Lope de Vega-এর Fuente Ovejuna (ফুয়েন্তে অভিজুনা) নাটকটি দেয়া যাক। এটি আমাদের অনার্সে তৃতীয় বর্ষে পাঠ্য। আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে আগে আলাপ করে নেয়া উচিত ছিল। নিই নি যখন, কি আর করা যাবে। Vega-র কোনো নাটক বাংলা ভাষায় (এমন কি কোনো ভারতীয় ভাষায়ই) অনূদিত হয় নি। আশা করি আপনি এ নাটকটি অনুবাদ করবেন।’ এ চিঠিতে তিনি ভূমিকাটি অনুবাদের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। চুরান্নব্বইয়ের ২১ অগাস্ট লেখা চিঠিতে তিনি জানান, আমি যে নাটকটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রূপান্তর করতে চেয়েছি তা-ই চট্টগ্রামের অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায় কলকাতার নাট্যোৎসবে নিয়ে যেতে চায়। আমি যেন তাই দ্রুত পাণ্ডুলিপি দেয়ার চেষ্টা করি।

পরে অবশ্য আমি ফুয়েন্তে অভিজুনা-র অনুবাদই করি এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বতন্ত্র মৌলিক নাটক লিখি। সে প্রসঙ্গ পরে।

১৯৯৭-র নভেম্বরে বাংলা একাডেমী ফুয়েন্তে অভিজুনা বই আকারে প্রকাশ করে। ‘অনুবাদকের কথা’য় শুরুতেই আমি লিখি- ‘উইলিয়াম শেক্সপীয়রের সমকালীন স্পেনের নাট্যকার লোপে দে ভেগা ইংরেজি অনুবাদকদ্বয়ের ভাষায় ‘কুয়োর মতো গভীর’ না হয়েও ‘গীর্জার তোরণের মতো প্রশস্ত’ এবং চরিত্র সৃষ্টিতে বিস্তৃত ও গভীর হওয়ার পরিবর্তে স্বচ্ছ ছিলেন। সাহিত্য ও নাট্যরচনায় তাঁর ব্যাপকতা ও পরিমানগত বিস্তৃতি কিংবা নানা আঙ্গিকে তাঁর রচনা অথবা লোপের জীবনের বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যের চেয়ে আমাদের জন্যে প্রাসঙ্গিক তাঁর কৃষকনাট্য এবং ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবধান সত্বেও এর সঙ্গে আমাদের জীবন এবং তার মৌল সূত্র ও তা যাপনের সাদৃশ্য।’

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র জাতি যেমন ঐক্যবদ্ধ হয় তেমনি ফুয়েন্তে অভিজুনা গ্রাম শত্রুর বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা অর্জন করে। সবাইকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় ফারনানকে কে হত্যা করেছে, তখন প্রত্যেকে বলে, ফুয়েন্তে অভিজুনা। ‘কে তাকে হত্যা করেছে?’ ‘মহোদয়, ফুয়েন্তে অভিজুনা।’ ব্যক্তি নয়, পুরো গ্রাম। এ দায় সকলের, এ দায় সমষ্টির দায়।

নাটকটি অনুবাদ করতে গিয়ে আমি সৃজনশীল রচনার আনন্দ পেয়েছি। ২০০৩-এর শুরুর দিকে প্রাচ্যনাট থিয়েটার স্কুল অব এ্যাকটিং তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যাচের শিক্ষার্থীদের প্রযোজনা হিসেবে যখন নাটকটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মঞ্চস্থ করে তখন আমি এর মঞ্চ-সম্ভাবনা বিষয়ে নিশ্চিত হই।

জিয়া হায়দারের কাছে আমি এজন্য কৃতজ্ঞ।

তিন
ফুয়েন্তে অভিজুনা-র পরেই আমার মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমি করে একটি মৌলিক নাটক লেখা আমার জন্যে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তারই ফল সাজনমেঘ।

১৯৯৫-এর ২ মে জিয়া হায়দার জানান, ‘আমি দুদিন ক্লিনিকে ছিলাম। রশীদ (হায়দার) চিটাগাং থেকে আমাকে ঢাকা নিয়ে এসে গৃহবন্দী করে রেখেছে। পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। এতটাই অসুস্থ যে, লিখতে গেলে হাত কাঁপে। ফলে রশীদের মেয়েকে ডিকটেশন দিতে হচ্ছে।’ চিঠির শেষাংশে তিনি জানিয়েছেন, ‘অরিন্দম ধীরে সুস্থে সাজনমেঘ-র কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।’

অতঃপর নাটকটি পঁচানব্বইয়ের ৪ অগাস্ট চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চে অভিনীত হয়। পরদিন চট্টগ্রামের দৈনিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা’য় এজাজ ইউসুফী লেখেন- ‘এত ভালো একটি নাটক অনেকদিন পর দেখলাম চট্টগ্রামের মঞ্চে। সাম্প্রতিককালে  ব্যয়বহুল নাটক মঞ্চায়নের যে একটি প্রবণতা দেখা গিয়েছিল এবং সকলের মনে হচ্ছিল দর্শক হৃদয় ছুঁতে বিশাল সেটের নাটক প্রয়োজন, অরিন্দমের বর্তমান প্রযোজনা এ মানসিকতায় অনেকটাই চিড় ধরাতে সক্ষম হবে।’

নাটকটির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে ইউসুফী লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বিদেশী নাটকের অক্ষম অনুবাদ ও তার প্রদর্শনী দেখতে দেখতে এখন মনে হচ্ছিল এবার কাহিনী-নাটকের দিকে তথা আমাদের ঐতিহ্যিক গল্প বলার ধারার দিকে ফিরবে নাটক তখন শান্তনু কায়সার আমাদের সেদিকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন।’ সমালোচক বলেন, ‘নাট্যকারের বিশ্বাস অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা এখনও ক্রিয়াশীল।’ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের তথাকথিত পতনের পরও শোষণ থেকে মুক্তি মানুষের ন্যায্য অধিকার। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নাটক হয়েও এটি তাই ‘সাধারণ মানুষের বৃহত্তর মুক্তিযুদ্ধের’ ইঙ্গিতবহ। সমালোচক মনে করেন, ‘সর্বক্ষণই নাটকটির গায়ে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ পাওয়া যায়।’

জিয়া হায়দার যদিও পরে আমাকে বলেছিলেন এর উপসংহারটি তাঁর বিবেচনায় অন্যরকম হতে পারতো, তবুও আমি মনে করি, নির্দেশক শিশির দত্ত প্রযোজনার ক্ষেত্রে তাঁর স্বাধীনতার ভুল ব্যবহার করেন নি।

চার
নাট্যকলার অধ্যাপক হিসেবে জিয়া হায়দার নাট্যতত্ত্বের বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। এসবের একটি ‘নাট্যকলায় বিভিন্ন ইজম ও এপিক থিয়েটার।’ মূলত শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে লেখা হলেও এতে তাঁর নিজস্ব শিল্প ও নাট্যচর্চা বিষয়ে অবহিত ও উপকৃত হয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্ম ‘থিয়েটারের কথা’র পাঁচটি খণ্ড। পূর্বোক্ত একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি ‘থিয়েটারের কথা’র ৪র্থ খণ্ড নিয়ে ব্যস্ত।’

তত্ত্ব ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তিনি তথ্য ও যুক্তির ওপর নির্ভর করতেন। একটি প্রসঙ্গ থেকে তাঁর দৃষ্টিকোণটি বোঝা যেতে পারে। সংস্কৃত নাট্যের বিলুপ্তির জন্যে মুসলিম শাসনকে দায়ী করে কীথ, হেমেন্দ্র দাশগুপ্ত, আদ্য রঙ্গাচার্য ও শঙ্কর ভট্টাচার্য প্রমুখের মতকে তিনি যেভাবে খণ্ডন করেছেন তাতে তাঁর ঐ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, সব পণ্ডিতই একমত যে, দশম-একাদশ শতাব্দিতেই সংস্কৃত সাহিত্যের যেমন তেমনি নাটকেরও স্বর্ণ যুগের অবসান ঘটেছে। অথচ আমরা জানি যে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হতে থাকে। সমগ্র ভারতবর্ষ এক সঙ্গে মুসলিম শাসনের অধীনে আসে নি- আসতে সময় লেগেছিল প্রায় পাঁচ’শ বছর। তথ্যের এই ভিত্তির উপর নির্ভর করে তাঁর যুক্তি, ‘যদি দশম-একাদশ শতাব্দীতে সংস্কৃত নাট্যের অবসান ঘটে থাকে এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকে মুসলিম শাসন শুরু হয়, তাহলে দেখা যাবে, মুসলিম শাসনের দুশ আড়াইশ বছর আগেই সংস্কৃত নাট্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে। অতএব সংস্কৃত নাট্যকে ধ্বংস করার অভিযোগে মুসলিম শাসনকে অভিযুক্ত করা সম্পূর্ণ অর্থহীন।’

ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে ঈশপের গল্পের মতো। ওপরে পানি খাওয়া নেকড়ের নিচে অবস্থানরত মেষশাবককে তার পানি ঘোলা করার অভিযোগের মতো হাস্যকর, কিন্তু নেকড়ের দিক থেকে সম্পূর্ণ অর্থহীন নয়।

অতএব যুক্তি দেখিয়ে জিয়া হায়দার আরো বলেছেন, ‘সমাজে যদি সংস্কৃত নাট্য প্রচলিত থাকতো তাহলে মুসলিম শাসকবর্গ তা বন্ধ বা নিষিদ্ধ করে দিতেন এ ধারণা বাতুলতা মাত্র। যদি মুসলমান শাসকগণ ধর্মান্ধতার কারণে প্রাচীন ভারতের নাট্য বা সংস্কৃতি-ধারাকে ধ্বংস করতে উদ্যোগী হতেন তাহলে তো ওদিকে গুরু নানকের আর এদিকে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবই ঘটতে পারতো না এবং শ্রীচৈতন্যের দ্বারা বাংলার আদি নাট্যযাত্রার উদ্বোধন ও প্রচলন ঘটতো না। কীর্তন পালারও প্রসার হতো না। সুলতান হোসেন শাহের দরবারে শ্রীচৈতন্যের অনুসারী রূপ ও সনাতন গোস্বামী যে সম্মানিত আসন পেয়েছিলেন- শুধু হোসেন শাহেরই নয়, পাঠান আমল থেকে শেষ মোগল সম্রাট পর্যন্ত দিল্লীর ও আঞ্চলিক নবাব সুলতানদের দরবারে হিন্দু পণ্ডিত ও শিল্পীদের যে ব্যাপক সমাদর ছিল, তা আর যাই হোক ঢালাওভাবে মুসলিম শাসকদের ধর্মান্ধতার পরিচয় দান করে না (ব্যতিক্রম দু‘একজন ছিলেন না তা নয়, তবে তা ব্যতিক্রমই)।’

উপসংহারে সত্যানুসন্ধানে তাঁর মনোভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায়- ‘সংস্কৃত নাট্যধারার অবলুপ্তির সঠিক কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সংস্কৃত ভাষার সার্বিক গণবিচ্ছিন্নতা, .... ব্রাহ্মণ্যধর্মের জাতি ও বর্ণভেদ প্রথা এবং মানবিক ঐক্যবিরোধী ভূমিকারই নির্মোহ ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন’ (সাহিত্যপত্র, ২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, ঢাকা)।

পাঁচ
জিয়া হায়দারের নাটক শুভ্রা সুন্দর কল্যানী আনন্দ এখন আর পাওয়া যায় না। কিন্তু ঐ নাটকের এবং নাট্যকারের অন্বিষ্টের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে তাঁর কবিতা ‘কৌটোর ইচ্ছেগুলো’র এই অংশ থেকে:

    জানিস, তখন আমি বারো বছরের
    সংসারের বড়ো বউ, নিজ হাতে লাগিয়েছিলাম,
    কিন্তু ফুল দেয়নি কোনো সকালেই;
    তা সেই বিষ্টির পর ভোরে ফুল ফুটলে তুই
    আমার করবে রেখে আসবি, শিয়রের দিকে;
    সে সময় খুব ফসল উঠবে, ইচ্ছে মতো গান করিস, দোহারে
    ধুয়ো ধরিস, বাঁশির গান,
    আর সে সময়ই কিন্তু আমার ছোটকাকুর বিয়ে দিবি,
    নতুন বউমাকে বলবি নিজ হাতে উঠোনটা নিকোতে,
    তারপর উঠোনের দাওয়ায় আলপনা কাটতে,
    তাতে যেন অবশ্যই ধানশীষ আর পায়রা থাকে।
    ওই যে বললাম, কোরাণশরীফ, পানবাটা
    এগুলো বউমাকে দিবি।
    ...............................................
    ...............................................
    আর শোন, এতক্ষণ বলাই হয়নি,
    আমার মাথার নিচে একটা কৌটো আছে,
    সেটাও বউমাকে দিবি
    জানিস ওতে কী আছে,
    আমার কয়েক টুকরো ইচ্ছে-
    ফুল, বিষ্টি, পায়রা, ধানশীষ, গান;

নানা সময় তিনি নানা নাটিকা লিখেছেন। সেগুলো হয়তো বিভিন্ন বিদেশী নাট্যের অনুস্মৃতি। যেমন উন্মাদ সাক্ষাৎকার তিনি এডগার এলান পো-র গল্প অবলম্বনে লিখেছেন। মুক্তি মুক্তি আমেরিকান নিগ্রো নাট্যকার লিরয় জোনসের Great Goodness of God- এর ভাবনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। কালো মানুষের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা যেমন এই নাট্যে বিধৃত তেমনি জিয়া হায়দার তাঁর নাটকটি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। নাটকের মূল চরিত্র প্রতিপক্ষের ভাষায়, ‘বিদ্রোহী, দেশ কা দুশমন- মুক্তিবাহিনী।’

চৌর্যপদ-এ তিনি একটু ভিন্নভাবে বাংলাদেশের কঠিন বাস্তবতার উন্মোচন করেছেন। এই নাটকের সূত্রধর ‘শুভসন্ধ্যা’ বলে যে দেশের কথা বলে সে দেশকে চিনতে আমাদের অসুবিধা হয় না। ‘আয়তনে ছোট হলেও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর’ এ দেশটি যেমন আমাদের দেশ হতে পারে তেমনি হতে পারে তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশ। তবু যখন জানা যায় ‘তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে একজন জেনারেল যেভাবে প্রেসিডেন্ট হয়ে যান’ তখন তা আর আমাদের অচেনা ঠেকে না। আগের প্রেসিডেন্টকে ‘নিকেশ’ করে দিয়ে যে ক্ষমতার লড়াই চলে তাকে সূত্রধর বলছে ‘ছল্লি কু।’ ক্যু অবশ্যই ক্যু। তার প্রমাণ পাওয়া যায় সে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্টই যখন চোরাকারবারিকে প্রত্যক্ষ মদদ দিতে স্বয়ং এয়ারপোর্টে গিয়ে হাজির হয় এবং তাকে নিরাপদে নিয়ে চলে যায়। শর্ষের এই শক্তিশালী ভূত আমাদেরও বাস্তবতা, যার শিকার সাধারণ জনগণ, যাদের সম্পদ লুণ্ঠন করতে ভূতের ঐ নৃত্য।

দ্বন্দ্বের এই বাস্তবতার উপলব্ধিকেই জিয়া হায়দার তাঁর উত্তরসূরিদের কাছে গচ্ছিত রেখে গেছেন যাতে তারাও নিজেদের লড়াইটা আবার চালিয়ে যেতে পারে।

শান্তনু কায়সার : অধ্যাপক, লেখক