Full premium theme for CMS
উন্নয়ন নাট্যের প্রকৃত ইতিহাস অনুসন্ধান এবং একটি তত্ত্বগত ধারণা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
অস্বীকার্য নয় লোকশিক্ষা ও বিনোদনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম নাটক। এই মাধ্যমটি প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত বিভিন্নভাবে চর্চা হয়ে আসছে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে বহুদিকে বাঁক নিয়েছে নাট্যকলা। উদ্ভব হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ধারার থিয়েটার। তার মধ্যে বর্তমান যুগের উন্নয়ন নাট্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যাপকহারে চর্চিত। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ্য- ব্রাজিল, ঘানা, মালয়েশিয়া, ভারত, জ্যামাইকা, মেক্সিকো, কিউবা, জিম্বাবুয়ে, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, আফ্রিকাসহ প্রভৃতি দেশ মানব উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যবহার করছে উন্নয়ন নাট্য। এসব দেশে উন্নয়ন নাট্যচর্চার রীতি বা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে অঞ্চল ভিত্তিক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও অভিপ্রায়ের ক্ষেত্র অভিন্ন। ফলে প্রয়োগগত সফলতার অভিপ্রায়ে উন্নয়ন নাট্যের বহুবিচিত্র ধারা লক্ষণীয়।
বিশ্বনাটকে উন্নয়নধর্মিতা
প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিশ্ব নাট্যাঙ্গন বা বিশ্বনাটক মানব উন্নয়নে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। নাট্যকলার সূচনা লগ্নে বিশ্বনাটকে উন্নধর্মিতা থাকলেও তাকে উন্নয়ন নাট্য হিসেবে চিহ্নিত বা নামকরণ করা হয়নি। সময়ের প্রয়োজনে স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন পাত্রের দ্বারা নাট্যকলা উন্নয়নের চাহিদা অনুযায়ী বহু অভিধায় অভিধিত হয়েছে। প্রাচীন কাল থেকে বিশ্বনাটক মানবিক উন্নয়নে যে ধরনের ভূমিকা রেখেছে তাই আলোচনার বিচার্য বিষয়।
প্রথমেই মিশর প্রসঙ্গ। খ্রিষ্টপূর্ব ৩ থেকে ৫ হাজার বছর পূর্বে মিশরে পিরামিড টেক্সট নাট্য কাহিনীতে অভিজাত ব্যক্তির স্বর্গারোহণ ও পুনর্জীবন লাভ, Coronation Festival Play-তে রাজ্যাভিষেক, সুভাগমন নাট্যানুষ্ঠানে রোগ সারানো এবং অ্যাবিডাস প্যাশন প্লে-তে শস্যদেবতা বা জীবনের প্রতীককে জয় করার প্রসঙ্গটি লক্ষণীয়।১
মানুষের আত্মিক উন্নয়ন এবং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে গ্রিক নাটক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নাট্যকার ইক্সিলাস (৫২৫ খ্রিঃ পূঃ-৪৫৬ খ্রিঃ পূঃ) ও সফোক্লিস (৪৯৫ খ্রিঃ পূঃ-৪০৫ খ্রিঃ পূঃ) তাঁদের রচিত গ্রিক ট্রাজেডিগুলোতে তৎকালীন গ্রিসের জীবন-দর্শন এবং নিয়তি নির্ভরতার সমান্তরালে নিয়তিকে জয় করার অনমনীয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রাণ শক্তির চরম বিকাশ ঘটানোর প্রয়াস নিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে অধিকতর প্রাগ্রসর ছিলেন নাট্যকার ইউরিপিডিস (৪৮৪ খ্রিঃ পূঃ-৪০৬ খ্রিঃপূঃ)। কারণ তিনিই প্রথম মিডিয়া নাটকে স্বামীর ভালোবাসা বঞ্চিত নারী মিডিয়ার প্রতিবাদ উচ্চকিত করেন, যা তৎকালীন গ্রিসের অবহেলিত নারীদের অব্যক্ত প্রতিবাদ। তৎকালীন সমাজ বাস্তবতার শ্রেণি বৈষম্য এবং শ্রেণি-দ্বন্দ্বের দ্বান্দ্বিক উপস্থাপনাসহ ইউরিপিডিস তাঁর নাট্যকর্মে প্রথম উল্লেখ করেন মানুষ নিজেই তার নিজের ভাগ্য নিয়ন্তা।২ এছাড়াও গ্রিক কমেডিগুলোতে হাস্যরসের অন্তরালে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি, ত্রুটি-বিচ্যুতি ইত্যাদি দেখানো হত। যা দেখে দর্শকগণ সচেতন হয়ে উঠতেন প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও দৈনন্দিন জীবনাচরণ সম্পর্কে। এভাবে উন্নয়ন-নাট্য ধারণায় উল্লিখিত বিষয়গুলি বর্তমানের মানব উন্নয়নের প্রধানতম পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত।
দশম শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপে যাজক কর্তৃক নিষিদ্ধ নাটক ধর্ম প্রচারের প্রয়োজনেই গির্জা আভ্যন্তরে আবির্ভূত হয়। লিটার্জিক্যাল প্লে, মিস্ট্রি প্লে, মিরাকল প্লে এবং মরালিটি প্লে এই নাটকগুলি ঈশ্বর, যীশু খ্রিস্ট ও সাধুসন্তুদের জীবন কাহিনী এবং মানুষের নৈতিক গুণাবলীর সমন্বয়ে গির্জার অনুকূলে দর্শক সম্মুখে উপস্থাপিত হত।৩ এই নাটকগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান। অনুরূপভাবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদ্মাপুরাণ, গম্ভীরা, আলকাপ, কবিগান মধ্যযুগের বাংলা নাট্যাভিনয়ে সমাজ ব্যবস্থার বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার মাধ্যমে লোক সমাজের উন্নয়ন সাধন করেছে।৪
শেক্সপিয়র (১৫৬৪-১৬১৬) এর ট্রাজেডি নাটকগুলোতে ম্যাকবেথ, ওথেলো, কিংলিয়র প্রভৃতি চরিত্রগুলোর মাধ্যমে বিশ্বমানবকে আত্মশুদ্ধি বা জীবন দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। অন্যত্র কমেডি অব এরারস-এ আন্দ্রিয়ানার কণ্ঠে উচ্চকিত হয় পুরুষের পাশাপাশি নারী অধিকারের বিষয়টি।৫ সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মলিয়েরের কমেডিগুলো শুধু তৎকালীন সমাজ সমালোচনারূপে আবির্ভূত হয়নি বর্তমান সময়েও বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের মানুষকে সচেতন করে তোলে।৬ এরপর উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬) এ ডলস হাউস নাটকের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের জাগরণে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। যা বর্তমানে উন্নয়ন নাট্যের একটি প্রধান ইস্যু হিসেবে বিবেচিত।৭
এছাড়া বাংলা নাট্যচর্চায় মুকুন্দদাসের স্বদেশি যাত্রা, দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) এর নীল দর্পন এবং মীর মর্শারফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) এর জমিদার দর্পন এ সকল নাটকের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।৮ এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বিশেষত ভারতে গণনাট্য৯ বঞ্চিত, শেষিত ও নিপীড়িতদের অধিকার আদায়ে যেভাবে মানুষের দ্বার গোড়ায় পৌঁছেছিল তা কারো অজানা নয়।
উপরিউক্ত আলোচনায় তৎকালীন নাটকগুলোর বিষয়বস্তুতে এবং নাট্যাঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছে মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা, যা মানবিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্য।
উন্নয়ন নাট্যে তাত্ত্বিকগণের আঙ্গিকসমূহ
মানব উন্নয়নে নাট্যের ব্যাপকতা যুগে যুগে যেভাবে মোড় নিয়েছে তাতে প্রমুখ প্রথিতযশা তাত্ত্বিক তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত মতামত ও ধারণার মাধ্যমে বিশ্বের নাট্যকলার ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে উন্নয়ন নাট্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাঁদের উন্নয়ন নাট্য সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রতিষ্ঠিত নাট্য আঙ্গিক সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
রম্যাঁ রলাঁর পিপলস থিয়েটার
বিংশ শতব্দীর গোড়ার দিকে রম্যাঁ রলাঁর (১৮৬৬-১৯৪৪) পিপলস থিয়েটার বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সচেতনতার প্রতি প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার আগে পিপলস থিয়েটার ধারণার প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় জ্যঁ জ্যাঁক রুশোর ভাবনায়। তিনি পারফর্মির আর্টের মূল অভিপ্রায় হিসেবে তুলে ধরেছেন জনগণের সম্পৃক্ততার বিষয়কে।১০ কারণ উনিশ শতকের সূচনা থেকেই থিয়েটার জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে সমাজ বিবর্জিত এক ধরনের থিয়েটারে পরিণত হয়েছিল। মূলত পিপলস থিয়েটার আন্দোলন গড়ে ওঠার পেছনে এই মতাদর্শ চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
১৮৯৯ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত পিপলস থিয়েটার এর বিশ্ব মহাসভায় ঘোষণা করা হলো, থিয়েটারকে বাঁচাতে হলে সমস্ত মানুষের কাছে থিয়েটারের দরজা খুলে দিতে হবে। থিয়েটারের সঙ্গে সমস্ত মানুষকে সংযুক্ত করতে হবে। সমস্ত শ্রেণির মানুষের কণ্ঠস্বরকে থিয়েটারে ধ্বনিত করতে হবে।১১ অবশেষে উনিশ শতকের প্রায়শ শেষের দিকে পিপলস থিয়েটার জনগণের সঙ্গে থিয়েটারের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে আবির্ভূত হয়। এই থিয়েটারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল জনগণ, এই কারণেই পিপলস থিয়েটার নামকরণ করা হয়েছে। এখানে জনগণ শব্দ দ্বারা একসময় এক সংগঠিত ও সংযুক্ত জাতিকে বুঝানো হয়েছে। আবার অন্য সময় সেই শব্দ দ্বারা শোষিত ও অত্যাচারিত Proletariat শ্রেণিকে চিহ্নিত করেছে।
১৯৩৯ সালে রম্যাঁ রলাঁ তাঁর ল্য থিয়েটার দু পুপল গ্রন্থে পিপলস থিয়েটার এর স্বপক্ষে জোর প্রচার চালালেন। এই বইটিতে তিনি লিখলেন, থিয়েটারকে বিকশিত করার একটি মাত্র পথই আছে, সেটি হলো এমন একটি থিয়েটার তৈরি করা যেখানে সাধারণ জনগণকে নিয়ে যাওয়া যাবে এবং তাদের সুখ-দুঃখের কথা বলা যাবে।১২ পিপলস থিয়েটার গড়ে উঠবে দেশের রাজধানীতে, প্রতিটি শহরে, লক্ষ লক্ষ গ্রামে। এতে জনগণ শুধু বিষয়ই হবে না, জনগণ তাতে অংশগ্রহণও করবে। পিপলস থিয়েটার হবে জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য।
রম্যাঁ রলাঁর মতে, পিপলস থিয়েটারের তিনটি প্রাথমিক শর্ত বিদ্যমান। প্রতমত, এই থিয়টারকে অবশ্যই বিনোদন বা রিক্রিয়েশন হতে হবে, অবশ্যই দিতে হবে আনন্দ, প্রতিদিনের কঠোর পরিশ্রমে নুব্জ হয়ে পড়া শ্রমজীবী মানুষকে দিতে হবে দৈহিক ও মানসিক প্রফুল্লতা, বিশ্রাম। দ্বিতীয়ত, আশাব্যঞ্চক নয় বা হতাশাজনক এমন সবকিছুকে এড়িয়ে চলাটাও একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এক্ষেত্রে এমন একটা প্রতিষেধক চাই যা আত্মাকে মহিমান্বিত করবে, তাকে সমর্থন করবে সব কিছু প্রতিকূলতার উর্ধ্বে তুলে ধরবে এই থিয়েটার। এবং তৃতীয়ত, জনগণকে নাট্যকারের শিখিয়ে দিতে হবে নানা অভিজ্ঞতা, চিনিয়ে দিতে হবে নানা পরিস্থিতি।১৩
পিপলস থিয়েটারের নাট্য কাহিনী হবে অতি পরিচিত, ভাবনা থাকবে মাত্র একটি, উপস্থাপিত হবে সংক্ষিপ্ত ভাষায়, সহজ-সরল নৃত্যগীতের মাধ্যমে, যা শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের প্রাত্যাহিক জীবন চিত্র। এই অভিপ্রায়ে রলাঁ তার থিয়েটারের উপযুক্ত নাটক লিখতে কবি-নাট্যকারদের নিকট উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, আমি আপনাদের কাছে ভিক্ষা চাওয়ার মতো করে বলছি-আপনারা আসুন। জনগণের থিয়েটারের জন্য নাটক লিখুন। থিয়েটারকে বাঁচান।১৪ তাঁর মতে, সংলাপ হতে হবে ঝরঝরে পরিষ্কার। কিছু কিছু শব্দ অবশ্যই থাকবে এবং কিছু ভঙ্গিমা, যা ভাব প্রকাশে সাহায্য করবে। কিন্তু ভীষণভাবে দরকার এই সব কিছুরই অত্যন্ত সুসংহত অভিব্যক্তি, অ্যাকশন, প্যাশন এবং স্টাইল। অতিশায়িত দৃশ্যসজ্জা, ভারী পোশাক ইত্যাদি অনুসঙ্গ রলাঁ বর্জন করে থিয়েটারের প্রয়োজনীয় উপাদান ব্যবহার করতে চান। মঞ্চ এবং হল ঘরের ক্ষেত্রে পিপলস থিয়েটারের থাকবে শুধু বিরাট একটা হল, ঢালু মেঝে, প্রত্যেক দর্শকই যাতে মঞ্চের পুরোটা দেখতে পায় এবং মঞ্চের শেষে অবশ্যই একটি উঁচু প্লাটফর্ম থাকা দরকার।১৫ যাতে জনগণ শ্রেণি বিভেদকে ভুলে, অভিনেতা-দর্শকাসনের পার্থক্যকে ভুলে নিজের মতো করে গড়ে তোলে নিজস্ব নাট্যভূমি। কারণ রলাঁ মনে করেন পিপলস থিয়েটার হবে জনগণের দ্বারা এবং জনগণের হাতে সৃষ্ট, তাহলেই বুদ্ধিগত দিক থেকে জনগণের মানসিক উন্নয়ন এবং শত্রু মিত্রকে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রশিক্ষণ হবে।
পিসকাটরের প্রোলেটারিয়ান এবং পলিটিক্যাল থিয়েটার
এরউইন পিসকাটর (Erwin Picator, ১৮৯৩-১৯৬৬) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে ১৯১৯ সালে কোনিসবার্গে গঠন করে তাঁর প্রথম থিয়েটার ট্রাইবুনাল (Theatre is Tribunal)।১৬ বৈপ্লবিক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং নির্যাতিত জনগণের স্বপক্ষে বিচার সভা হিসবে এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ১৯২০ সালে ফেব্র“য়ারিতে ট্রাইবুনাল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পিসকাটর বার্লিনে এসে হেরম্যান শুলারের সঙ্গে ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে গঠন করেন প্রোলেটারিয়ান থিয়েটার (Proletarian Theatre)।১৭ এই থিয়েটার ছিল সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের বাহন। তাঁর সরব লক্ষ্য ছিল Less art, more politics: proletarian culture and agitation rooted in the principles of all the proletariate.১৮ প্রোলেটারিয়েট থিয়েটার ছিল সদস্য নির্ভর এবং সবাই শ্রমিক। এই শ্রমিক অভিনেতারা ছিল পার্টটাইম নাট্যকর্মী। তারা তাদের অবসরকে বিসর্জন দিয়েছিল নাটকের মধ্যে দিয়ে সহকর্মীদের সচেতন করে তোলার জন্য। তারা বিশ্বাস করত থিয়েটারের মাধ্যমে শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রেণিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এ হলো শ্রেণি-সংগ্রামের থিয়েটার-শ্রমিকদের দ্বারা, শ্রমিকদের জন্য, শ্রমিকদের থিয়েটার।১৯ এরা খুব সাধারণ উপকরণ নিয়ে স্বেচ্ছায় শ্রমিক সভাগুলোতে নাটক উপস্থাপন করত তাদের শ্রেণি সচেতন করে তোলার অভিপ্রায়ে। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের কারণে ১৯২১ সালে প্রোলেটারিয়ান থিয়েটার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
অন্যদিকে পিসকাটরের সমসাময়িক সময়ে বার্লিনে কার্লহাইনজ মার্টিনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে দি ট্রিউবিউন থিয়েটার।২০ এই থিয়েটারও মূলত প্রোলেটারিয়ানদের থিয়েটার। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ জার্মান ওয়াকার্স লীগ তাদের আন্দোলনের ও বিক্ষোভে প্রদর্শনের জন্য নাট্যকে করে প্রচারের মাধ্যম এজন্য তারা জার্মানীর বিভিন্ন অঞ্চলে নাট্যদল পাঠায়, যাকে Agitprop২১ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। Agitprop অর্থাৎ agitation (আন্দোলন) এবং propaganda (প্রচারণা) দুটি বিষয়ই রয়েছে তাতে। বেশিরভাগ অ্যাজিটপ্রপই স্লোগান সর্বস্ব সংলাপ ও গণবিক্ষোভের সংমিশ্রণ। এই নাট্যের বৈশিষ্ট্য হলো সংক্ষিপ্ত স্কেচধর্মী নাটিকা, পরিচিত টাইপ চরিত্র, সহজ ঘটনাবলী ও সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বক্তব্য ও আদর্শ সরাসরি দর্শকের হৃদয়ে প্রবিষ্ট করা যায়।
ট্রাইবুনাল থিয়েটার, প্রোলেতারিয়ান থিয়েটার, অ্যাজিটপ্রপ থিয়েটার, ডুকমেন্টারি থিয়েটার শেষ অবধি পলিটিক্যাল থিয়েটারের নামান্তর। নাট্য নির্দেশক পিসকাটর The Political Theatre নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু পলিটিক্যাল থিয়েটারের প্রবক্তা ও কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হলেন পিসকাটর এবং ব্রেখট উভয়ই। রাজনৈতিক থিয়েটারের উদ্দেশ্যই ছিল শ্রেণি-সত্যের উপস্থাপনা। শাসনের যন্ত্র যখন শোষণে পরিণত হয় তখন দেখা দেয় বিপত্তি, দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম এবং রাজনীতি। রাজনীতি যেমন জীবন বিবর্জিত নয় তেমনি নাটক ও রাজনীতি বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। তাই সাধারণ মানুষ যখন নাটকের পাত্র-পাত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল নাটক তখন সত্যিকার অর্থে হয়ে ওঠে পলিটিক্যাল।২২ পিসকাটর শুরু থেকেই থিয়েটারকে রাজনৈতিক সংগ্রামের হাতিয়ার রূপে চিন্তা করেছিলেন যেন এতে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বক্তব্য প্রকাশ করা যায়।
পলিটিক্যাল থিয়েটারের বৈশিষ্ট্য মূলত পিসকাটরের সামগ্রিক নাট্য প্রচেষ্টা নিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছ। তবে তিনি নাট্য আঙ্গিক প্রতিষ্ঠা ও নাট্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন অনেক বেশি। একটিমাত্র আঙ্গিকের উপর নির্ভরশীল হননি। Political meaning স্পষ্ট করার জন্য তিনি মঞ্চরীতির ভিন্নতর ব্যবহারের কথা বলেন, was no longer purely ‘decor’, but also sketched in the social, politico geographical economic implications... It obtruded in to events on the stage and came to be an active dramatic etement.২৩ নাট্য উপস্থাপনে তিনি যান্ত্রিক কলাকৌশলের উপর অতিমত্রায় গুরুত্ব দিতেন। প্রয়োজনে তিনি ফিল্ম, স্লাইড, কার্টুন ইত্যাদির ব্যবহার, দর্শকের সামনেই দৃশ্যসজ্জার পরিবর্তন, পর্দার বিভিন্ন রকম ব্যবহার প্রভৃতি নাট্য উপস্থাপনায় পরিকল্পনা করতেন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে হাসিল করার জন্য প্রচলিত উপস্থাপনারীতিকে পিসকাটর নির্মমভাবে ভেঙেছেন, ব্যবহার করেছেন নতুন নতুন উপাদান ও উপকরণ। যার মধ্যে ধষরবহধঃরড়হ তত্ত্বের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে।
ব্রেখটের পলিটিক্যাল ও এপিক থিয়েটার
বের্টোল্ড ব্রেখট (Bertold Brecht, ১৮৯৮-১৯৫৬) থিয়েটার চর্চায় মার্কসবাদের বৈপ্লবিক চেতনার প্রসার ঘটিয়ে সেই দর্শনকে আরও যুক্তিবোধের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি মার্কস ছাড়াও পিসকাটর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে ব্রেখটের নিজস্বতা ছিল পুরোপুরি। তিনি বলেন, ...Piscator’s theatre was the most radical... I took part in all his experiments.২৪ পিসকাটর এবং ব্রেখট উভয়েই রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে ছিলেন মার্কসবাদের অনুসারী। পিসকাটর মূলত অ্যারিসস্টটলের নাট্যচিন্তার আলোকে তাঁর রাজনৈতিক থিয়েটার চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন।২৫ কিন্তু ব্রেখট অ্যারিস্টটলের এমপ্যাথি ও ক্যাথারসিস পরিহার করে নাট্যাভিনয়ে এলিয়েনেশন তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। তিনি বিবেচনা করেন একই সঙ্গে থিয়েটার চর্চা এবং তা হবে শিক্ষা প্রদানের মাধ্যম। যে মাধ্যমে শিক্ষার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে। পরিবর্তন হবে বুর্জোয়া রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক অবস্থার। কারণ শ্রেণি-সংগ্রাম এবং শ্রেণি দ্বন্দ্বের মাধ্যমে মানবিক সকল বিষয়ের উন্নতি সাধন করা যায়। কাজেই ব্রেখটের থিয়েটার সমাজ বিশ্লেষণের হাতিয়ার। ব্রেখট দ্বান্দ্বিক বাস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নাট্যব্যক্তিত্ব। তাই তিনি থিয়েটারকে এপিক অভিধায় অভিধিত করলেন। কোনো প্রথাগত প্লট, কাল, স্থান ইত্যাদির বাধ্যবাধকতা ব্যতিরেকে এপিক থিয়েটারে পরিস্থিতি বা ঘটনা অনুক্রমের বর্ণনা থাকবে, থাকবে বর্ণনাধর্মিতাÑনাটকের চরিত্রগুলো একই সঙ্গে কথক ও অভিনেতা। ব্রেখট বুঝেছিলেন করুণা ও ভয়ের পরিবর্তে মানুষকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে হবে, আবেগায়িত না করে চিন্তা ও বিশ্লেষণের অবকাশের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মূলত এই ভাবনা থেকেই তিনি তাঁর থিয়েটারে এলিয়েনেশন তত্ত্বের ব্যবহার করলেন। দর্শক এখানে একজন পর্যবেক্ষক। দর্শক ঘটনাকে লক্ষ্য করছেন, কিন্তু সেই ঘটনার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন না। ঘটনার সাথে একাত্মতার পরিবর্তে দর্শকের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয় এই থিয়েটারে। বর্ণনাধর্মিতা ছাড়াও এপিক থিয়েটারে বিভিন্নভাবে এলিয়েনেশন হতে পারে। যেমন : সঙ্গীত মঞ্চ, ডিজাইন, আলো, প্রভৃতিকে পৃথকভাবে উপস্থাপিত করা। বাণী ও সুরের বৈপরিত্য সৃষ্টির ফলে দর্শকগণের গুরুত্ব অনুধাবন করতে বাধ্য হবে। মঞ্চে illusion সৃষ্টির পরিবর্তে fragmentary setpieces এর প্রতি প্রাধান্য দেওয়া, স্থান নির্দেশে প্রোজেকশন, প্লাকার্ড বা ব্যানার প্রভৃতির ব্যবহর এবং আলো প্রক্ষেপণে সমস্ত আলোই দর্শকের দৃষ্টিগ্রাহ্য থাকবে। তাহলে এসমস্তই এলিয়েনেশন সৃষ্টি করবে। ব্রেখট চেয়েছিলেন দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণ এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে সৃষ্ট বৈজ্ঞানিক চিন্তার থিয়েটার। তিনি তাঁর বিভিন্ন প্রযোজনায়, শ্রেণি সংগ্রাম, বিশ্লেষণ, অনুসন্ধান, শিক্ষা প্রভৃতির প্রমাণও রেখেছেন।
ব্রাজিলের বিপ্লবী নাট্য পরিচালক অগাস্তো বোয়াল এর মতে, র্রেখটের থিয়েটারের নাম হওয়া উচিৎ ছিল মার্কসবাদী থিয়েটার, এপিক থিয়েটার নয়। কারণ এপিক ও থিয়েটার কথা দুটি পরস্পর বিরোধী এবং ব্রেখটের বিষয়বস্তু, আকর্ষণ, বিশ্লেষণ, আঙ্গিক অভিনয় ধারায় এবং দর্শকের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে মার্কসবাদের প্রয়োগও সর্বব্যাপী।২৬ তিনি আরও বলেন যে ব্রেখট মাঝ পথে থেমে গেছেন। কারণ এতে দর্শকের ক্রিয়াশীলতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তার মতে, ব্রেখটের থিয়েটারও বিশোধক, কারণ তা দর্শককে যথেষ্টভাবে ভাবায় না; তাকে অবশ্যই সক্রিয় হতে হবে বিশ্লেষণী ভাবনায় এবং প্রয়োগে। বোয়াল উল্লেখ করেছেন, অভিভাজ্য প্রকৃতিকে বুঝতে না পারার মধ্যেই ছিল ব্রেখটের বিভ্রান্তি; তিনি দর্শকের ভাবনাকে চরিত্রের ভাবনা থেকে পৃথক করতে চেয়েছেন, এমন কি একটিকে অপরটির বিপরীতে স্থাপন করেছেন।২৭
রসকিডের পপুলার থিয়েটার
বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে পিপলস থিয়েটার ও পলিটিক্যাল থিয়েটার এর সমান্তরালে অবির্ভূত পপুলার থিয়েটার। আমেরিকান নাট্যবিদ ইউজিন ও’নীল এবং কানাডার অধ্যাপক রসকিড পপুলার থিয়েটার ধারণাটির প্রধান প্রবক্তা। বিশ শতকের সাতের দশকে রসকিড তৃতীয় বিশ্বের উৎপীড়িত, বঞ্চিত ও শোষিত গ্রামীণ জনগণের মুক্তির সহায়ক থিয়েটারকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য পপুলার থিয়েটার, কনসিয়েনটাইজেশন এন্ড পপুলার অর্গানাইজেশন বইটিতে প্রথম পপুলার থিয়েটার শব্দটি ব্যবহার করেন।২৮ আফ্রিকায় উগান্ডা মাকারের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচর্চার সূত্রবদ্ধ অবস্থাকে রসকিড পপুলার থিয়েটার নামে অভিহিত করেন।২৯
আফ্রিকায় বোৎসোয়ানায় রসকিডের পপুলার থিয়েটার অনুশীলন থেকে পপুলার থিয়েটারের একটি সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়। তাহলে Popular theatre is By the people, For the people and Of the people.৩০ আলোচ্য সংজ্ঞাটিকে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত পপুলার থিয়েটারের উপর এক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় নতুনভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। পপুলার থিয়েটার হলো জনগণেরর নিজস্ব থিয়েটার, যে থিয়েটার জনগণেরই ভাবনা, সমস্যা ও বিশ্লেষণকে প্রতিফলিত করে, যে থিয়েটারের বিষয়বস্তুতে জোর দেওয়া হয় স্থানীয় বিশেষ বিশেষ সমস্যা, যে থিয়েটার ব্যাপকভাবে প্রচারিত অন্যান্য বৈদ্যুতিক মিডিয়ার প্রচারকে প্রতিরোধ করে, যে থিয়েটার জনগণের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ইতিহাসের পুনরুজ্জীবন এবং ঋদ্ধিসাধন করে, তাদের অগ্রগতির পথে এগিয়ে দেয়, যে থিয়েটার লোকশিক্ষা দেশ ও জনগণের মধ্যে সংহতি আনে, যে থিয়েটারে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়, যে থিয়েটার বিনোদন হিসেবে ও জনগণের আগ্রহকে ধরে রাখে।৩১ অর্থাৎ পপুলার থিয়েটার হলো একধরনের শিল্প, যার সৃষ্টি হবে জনগণের জীবনের প্রকৃত প্রয়োজনে, জনগনই তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, উপস্থাপন করা হবে স্থানীয় আঙ্গিকে কিন্তু বিষয় হবে সার্বজনীন ও সর্বসাধারণের। পপুলার থিয়েটার খোলা জায়গায়, মাঠে, গাছতলায়, হাট-বাজারে, কৃষকের আঙ্গিনায় যে কোনো স্থানে উপস্থাপন করা যায়। এর জন্য সুনির্দিষ্ট মিলনায়তন বা বাঁধা রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজন নেই। কারণ যেন শোষিত শ্রেণি তার অধিকার হরণের প্রক্রিয়া চিহ্নিত করার মাধ্যমে ঘৃণা করে শোষককে, তাই এটা সবার জন্যই উম্মুক্ত। স্থানভেদে পপুলার থিয়েটারের আঙ্গিক ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কারণ তৃতীয় বিশ্বের থিয়েটার শুধুমাত্র পাশ্চাত্য থিয়েটারের অনুকরণ হবে না। দেশজ আঙ্গিকের উদ্ভাবন, ব্যবহার ও বিকাশ ঘটবে সেখানে। অর্থাৎ পপুলার থিয়েটারের আঙ্গিক হলো- যে সকল আঙ্গিকের উপর জনগণের মালিকানা রয়েছে তার সবগুলোই। মোদ্দাকথা, স্থানভেদে নাট্য আঙ্গিকের পার্থক্য থাকবে। উদাহরনস্বরূপ জিম্বাবুয়ের গ্রামবাসীদের প্রিয় উৎসব পুংওয়ে এর কথা বলা যায়। সেখানে গ্রামবাসীদের আয়োজনে সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গান, নাচ ও নাটকীয় দৃশ্যের মাধ্যমে তাদের প্রধান সমস্যগুলো তুলে ধরা হয়। এরপর বৃত্তাকারে বসে তা পর্যালোচনা করা হয়। বৃত্তের কেন্দ্রে তাৎক্ষণিক নাট্যাভিনয় শুরু হয়। উপস্থাপিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য গ্রামবাসীদের, আহবান করা হয়। আভিনয়ে তাদের দৃশ্য, চরিত্র, ঘটনা পরিবর্তনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়। অভিনয় শেষে আবার আলোচনা হয়। এভাবেই চলতে থাকে লাগাতার প্রক্রিয়া।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে পিপলস থিয়েটার, পলিটিক্যাল থিয়েটার এবং পপুলার থিয়েটার এই তিনটি নাট্যধারা একই পথের বিভিন্ন উপপথ ও শাখাপথ।৩২ অর্থাৎ রাজনৈতিক থিয়েটারের প্রথম পর্বের পরিভাষা রম্যাঁ রলাঁর পিপলস থিয়েটার, দ্বিতীয় পর্বে এসে তা প্রলেতারিয়ান, পলিটিক্যাল ও এপিক থিয়েটার এবং তৃতীয় পর্বে তা পপুলার থিয়েটার অভিধায় ভূষিত।
প্রসঙ্গ অনুযায়ী এ পর্যায়ে আলোচনার বিষয় অগাস্তো বোয়াল। তাঁর মতে, থিয়েটারে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা থাকবে দর্শকের। আর দর্শক হিসেবে প্রাধান্য দেওয়া হয় শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে। বোয়ালের এই নাট্যচিন্তা পাওলো ফ্রেইরের শিক্ষা দর্শনের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। তাই বোয়ালের নাট্যচিন্তার পরিচয় দেওয়ার পূর্বে ফ্রেইরের শিক্ষা দর্শন আলোচনা করা আবশ্যক।
পাওলো ফ্রেইরের অত্যাচারিতের শিক্ষা
পাওলো ফ্রেইরে (Paulo Freire, ব্রাজিল, ১৯২১-) ১৯৫৯ সালে শিক্ষা গবেষণাকর্ম শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি সাক্ষরতা অভিযানের জন্য বস্তি এলাকায় আত্মনিয়োগ করেন। সচেতনায়ন (conscientization) নামে খ্যাত নিরীক্ষার্কমে মানুষ শুধু সাক্ষরতাই শিখল না, মানুষ পৃথিবীটাকে স্বচ্ছভাবে দেখতে পেল এবং বুঝতে পারল সুখী জীবন গড়ার জন্য পৃথিবীটাকে পরিবর্তন করা যায়।
ফ্রেইরে মনে করেন, নৈতিক, নান্দনিক ও ধর্মীয় সকল দৃষ্টিকোণ (axiological) থেকেই মানুষের মূল সমস্যা হলো মানবিকীকরণ৩৩ (humanization) এর সমস্যা, যার মূল নিয়ামক অবিচার, অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন এবং অত্যাচারীর সহিংসতা। উল্লেখ্য যে মানবিকীকরণ ও বিমানবিকীকরণ পরস্পরের যথার্থ বিকল্প, কিন্তু মানবিকীকরণই মানুষের করণীয়। কারণ বিমানবিকীকরণ নিয়তি নির্ধারিত নয় বলে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব।৩৪ এর প্রাথমিক শর্ত হলো অত্যাচারিতদেরকেও কর্তা (subject) হয়ে উঠতে হবে। অত্যাচারীরা কখনোই তাদের অনৈতিক ক্ষমতা দ্বারা অত্যাচারিতদের মুক্ত করতে পারে না, এমন কি নিজেকেও না। একমাত্র অত্যাচারিতের ভিতরে জমাট বাঁধা শক্তি অত্যাচারী ও অত্যাচারিত উভয়কে মুক্ত করতে সক্ষম। তাই ফ্রেইরে প্রত্যাশা করেন সমমনা অত্যাচারিতরা ঐক্যবদ্ধভাবে অবতীর্ণ হোক মুক্তির সংগ্রামে পরিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবীকে মানবিকীকরণের৩৫ প্রবল ইচ্ছায়। এখানে প্রয়োজন একজন নতুন মানবের৩৬ যে অত্যাচারী বা অত্যাচারিত কোনো শ্রেণির নয় অথবা অত্যাচারিত শ্রেণির কিন্তু স্বাধীনতার প্রক্রিয়ায় এদের সবার অবস্থান অবশ্যই থাকতে হবে।
ফ্রেইরে মনে করেন অত্যাচারিতরা মনে মনে এক ধরনের উভয় সঙ্কটের শিকার।৩৭ কারণ তারা জানে স্বাধীনতা ছাড়া নিজেদের সত্যিকার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না আবার তাকে গ্রহণ করার দায় ও ঝুঁকি নিতে তারা ভয় পায়। অর্থাৎ মুক্তির ভীতি৩৮ তাদের সর্বদা আচ্ছন্ন করে রাখে। কারণ অত্যাচারিতরা সবসময় আচ্ছন্ন থাকে প্রভূদের চিন্তা চেতনায়। ফলে প্রভুত্ত ধারণা থেকে অত্যাচারিতরা বিশ্বাস করে তারা নিষ্কর্মা, অলস, অসুস্থ, অজ্ঞ এবং অনুৎপাদনশীল৩৯ তারা প্রতিনিয়ত আবদ্ধ হয় পরনির্ভরতার শৃঙ্খলে।
অন্যদিকে অধীনস্থ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির উপর দোষ চাপানো মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা এবং সাধারণ মানুষও তা মেনে নেয়। তারা মনে করে যে তাদের দ্বারা কিছু হবে না, তারা নতুন কিছু চিন্তা করতে পারবে না। তারা ভুলে যায় যে তারাও পৃথিবী সম্পর্কে জানে এবং শ্রমের মাধ্যমে সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এটা মূলত নীরবতার সংস্কৃতির৪০ প্রতিফলন। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ এবং পিতৃতান্ত্রিকতার প্রত্যক্ষ প্রভাবই তাদের বিশ্লেষণী সচেতনতাকে ব্যাহত করে। আবার সুবিধাভোগী কিছু কিছু মানুষ অত্যাচারীকে রক্ষাকর্তা হিসেবে ধরে নেয়, যেহেতু তারা নিজেদেরকে অন্যের ক্রীড়ানক ভাবে। নিজেদের আত্মকেন্দ্রীকতার কারণে বিশাল পৃথিবী তাদের কাছে ক্ষুদ্রাকারে ধরা পড়ে। অত্যাচারীর সবকিছুই মেনে নেয় নীরবে। এর কারণ তাদের কাছে স্বাধীনতার ভীতি, নিজেদের অবমূল্যায়ন এবং নিয়তি নির্ভরতা।
ফ্রেইরে বিশ্বাস করেন, মানুষ তখনই নিয়তিবাদী মনোভাব পোষণ করে যখন সে তার অত্যাচারীর স্বরূপ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয় কিংবা নিজের চেতনাকে আবিষ্কারে অপরাগ হয়।৪১ তারা সমস্ত কিছুই নিয়তির উপর ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। ফ্রেইরের মতে, এই অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের প্রধান ধাপ হলো অত্যাচারের প্রকৃত কারণসমূহ উদঘাটন করা। যাকে তিনি সচেতনতায়ন (conscientization) নামে অভিহিত করেছেন।
ফ্রেইরে বলেছেন যে, সচেতনতায়নের প্রক্রিয়া বাইরে থেকে চাপিয়ে দিলে চলবে না বরং সংলাপমূলক সংযোগের মাধ্যমে তাকে অবশ্যই অত্যাচারিতের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে৪২ মুক্তির সংগ্রামে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিশ্লেষণী ও মুক্তিকামী সংলাপ। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সংলাপের বিষয় বিভিন্ন রকমের হতে পারে। কিন্তু সংলাপের বিকল্প ভাষণ, শ্লোগান ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। কারণ এগুলোর মাধ্যমে পোষ মানিয়ে অত্যাচারিতদের মুক্ত করা- সত্যিকারের মুক্তি নয়। সংলাপের প্রাথমিক শর্ত হলো পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, বিণয়, বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন। যেমন, মানুষের সৃষ্টি, পুনঃসৃষ্টির ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস, পূর্ণমানবিক হওয়ার লক্ষ্যে মানুষের অভিযাত্রার পতি বিশ্বাস স্থাপন প্রতৃতি। উল্লেখ্য যে অত্যাচারিতদের আবেগজাত নির্ভরতার উপর স্থাপন- এগুলোকে স্বাধীনরূপে রূপান্তর করা খুব জরুরি। কারণ মুক্তির বিশ্বাস একজন দ্বারা অন্যজনের মধ্যে প্রোথিত হতে পারে না আস্থা স্থাপন করতে হবে- মুক্তি কোনো দান হতে পারে না- নিজের মুক্তির জন্য নিজেকেই লড়তে হবে।৪৩ সংলাপে অতীব গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা ও বিশ্লেষণী চিন্তা-ভাবনা, যে ভাবনার ভিত্তি হবে কর্ম, কর্মাভিমুখীনতা।
আবার মুক্তির প্রকৃত স্বরূপ চিন্তা করে পাওলো ফ্রেইরে বলেছেন যে, সংলাপ ছাড়া কোন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, আর যোগাযোগ ছাড়া সত্যিকারের কোনো শিক্ষাও সম্ভব নয়।৪৪ তাই সংলাপের প্রকৃত বিষযবস্তু অনুধাবনের জন্য প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাওলো ফ্রেইরের শিক্ষা চিন্তা আলোচনা করা প্রয়োজন।
ফ্রেইরে মনে করেন, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের মধ্যে বর্ণনাধর্মিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন, এই ব্যবস্থায় বর্ণনাকারী বক্তা (শিক্ষক) তার ধৈর্যশীল ও মনোযোগের সাথে শ্রবণকারী শ্রোতাকে (ছাত্র) তার বর্ণনা দিয়ে ভরে দেন। শিক্ষকের কাজ হচ্ছে কিছু বর্ণনা করে ছাত্রদের মগজ পুরো করে দেয়া।৪৫ সেই বর্ণনা ও বিষয়বস্তু বাস্তব হতে বিচ্ছিন্ন, সমগ্রতার সহিত সম্পর্করহিত, ফাঁপা, খাপছাড়া বকবকানীতে পরিণত হয়। আর এই বর্ণিত বিষয় ছাত্ররা ভালোভাবে না বুঝে, কোনো চিন্তা ভাবনা না করে যান্ত্রিকভাবে মুখস্ত করতে উদ্বুদ্ধ হয়। এই ধরণের শিক্ষা ছাত্রদেরকে বাক্সে পরিণত করে। সেই বাক্স পুরো করার দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষকের। তিনিই যোগ্য শিক্ষক যিনি যত সুষ্ঠুভাবে সেই বাক্স পূরণ করতে পারেন। অন্যদিকে সেই ভালো ছাত্র যে ছাত্র নিরীহভাবে সেই বাক্স পূরণ করার ব্যাপারে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে। এতে শিক্ষা হয়ে উঠে জমা করার বিষয়। যেখানে শিক্ষক জমাকারী এবং ছাত্র জমা রাখার পাত্র, যেখান থেকে প্রয়োজনে ছাত্র তা পুণরাবৃত্তি করতে পারে। এটা হচেছ শিক্ষার ব্যাংকিং লেনদেনের ধারণা।৪৬ যা সঞ্চয়কারী, শিক্ষা পদ্ধতি বা Banking concept of Education নামে অধিক পরিচিতি। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা সৃজনকারী হয়ে উঠতে পারে না। ফলে এ ধারার শিক্ষা অত্যাচারীদের স্বার্থকেই রক্ষা করে। ব্যাংকিং শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে অত্যাচারী সমাজের চরিত্রলক্ষণ-নিম্নবর্ণিত শিক্ষক ছাত্রের বৈশিষ্ট্যের ভিতর দিয়ে প্রতিভাত হয়।
১. শিক্ষক শিক্ষা দেন এবং ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করে।
২. শিক্ষক সবকিছু জানেন এবং ছাত্ররা কিছুই জানে না।
৩. শিক্ষক ভাবনা চিন্তা করেন, আর ছাত্ররা হচেছ তার ভাবনা-চিন্তার বিষয়।
৪. শিক্ষক কথা বলেন, ছাত্ররা চুপচাপ শুনে।
৫. শিক্ষক শৃঙ্খলা আনয়ন করেন এবং ছাত্ররা শৃঙ্খলা মেনে চলে।
৬. শিক্ষক নির্বাচন করেন এবং তাঁর পছন্দ প্রতিষ্ঠা করেন, ছাত্ররা তা মেনে চলে।
৭. শিক্ষক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন; শিক্ষকের কর্মের মধ্য দিয়ে ছাত্ররা কাজ করার স্বাদ লাভ করে।
৮. শিক্ষক কর্মসুচীর বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন, ছাত্ররা তা অনুসরণ করে (তাদের সাথে এ ব্যাপারে কোন আলোচনাই করা হয় না)।
৯. শিক্ষক জ্ঞানের কর্তৃত্বকে তার নিজের পেশাগত কর্তৃত্ব বলে ভুল করেন।
১০. শিক্ষক হচ্ছেন শিক্ষণ প্রক্রিয়ার বিষয়ী, ছাত্ররা হচ্ছে শুধুমাত্র বিষয়।৪৭
উল্লিখিত শিক্ষার এই নির্ভরতা প্রবণ ধারাকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করে ফ্রেইরে মুক্তি দায়ী শিক্ষা সমস্যা চিহ্নায়ন (Problem Posing Education) পদ্ধতির বিষয় তুলে ধরলেন। পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে। সমস্যা চিহ্নায়ন শিক্ষণ, সচেতনতার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপনের মাধ্যমে, আর তা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিবরণীকে প্রত্যাখ্যান করে এবং যোগাযোগকে মূর্ত করে তোলে।৪৮ এ পদ্ধতিতে ছাত্র-শিক্ষক উভয়েই সমন্বয় সাধনে বর্ণনাকারী ও শ্রবণকারী ভূমিকার পরিবর্তে সৃজনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অর্থাৎ যৌথ অংশদারিত্ব মূলক সংলাপধর্মী সম্পর্ক স্থাপন পূর্বক উভয়েই একসাথে ছাত্র-শিক্ষক হয়ে উঠেন।৪৯ ফলে ব্যাংকিং পদ্ধতির বস্তুতে পরিগণিত শ্রবণকারী শিক্ষার্থী ফিরে পায় কথা বলার অধিকার। সচেতনতার স্তর অতিক্রম করে সে প্রতিস্থাপিত হয় সমাজ বাস্তবতার মুখোমুখি, যার উন্মোচন ঘটে তার বোধ ও ভাবনায়।
ব্যাংকিং শিক্ষা পদ্ধতি ও সমস্যা চিহ্নায়ন শিক্ষা পদ্ধতি দুটির ধ্যান ধারণা ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী। ব্যাংকির পদ্ধতিতে শিক্ষক তার পঠন প্রস্তুত করেন, এককভাবে জ্ঞাত বস্তুকে চিহ্নিত করেন। তারপর নিজের সংগৃহিত তথ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবিষ্ট করান।৫০ কিন্তু সমস্যা চিহ্নায়ন শিক্ষায় শিক্ষক ছাত্রের অংশদারিত্বমূলক যৌথ অনুবোধন ঘটে। প্রথমোক্ত শিক্ষা সৃজনী ক্ষমতাকে অসার, বাধাগ্রস্ত করে, চেতনাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। পক্ষান্তরে সমস্যা চিহ্নায়ন শিক্ষায় প্রতিনিয়ত বাস্তবতার ও চেতনার উদ্ভব ঘটায়। ব্যাংকিং পদ্ধতির শিক্ষা সঙ্গত কারণেই বাস্তবতার মধ্যে এক কল্পলোকের সৃষ্টি করে; সমস্যা শনাক্তকারী শিক্ষা এই বিভ্রান্তির অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হয়।৫১ প্রথমোক্ত পদ্ধতি সংলাপের বিরোধিতা করে, কিন্তু দ্বিতীয়োক্ত পদ্ধতি সংলাপকে অপরিহার্য বলে মনে করে। ব্যাংকিং তত্ত্ব ও তার প্রয়োগ নিশ্চল ও স্থির শক্তি হিসাবে মানুষকে ঐতিহাসিক ও সত্তায় স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়; সমস্যা শনাক্তকারী তত্ত্ব ও তার প্রয়োগ মানুষের ঐতিহাসিকতাকে যাত্রা পথের দ্বার বলে গ্রহণ করে। ব্যাংকিং শিক্ষাপদ্ধতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের অবস্থা সম্পর্কে নিয়তিবাদী ধ্যান-ধারণার প্রতিষ্ঠা ঘটায় কিন্তু সমস্যা চিহ্নায়ন পদ্ধতি এই একই অবস্থাকে সমস্যা হিসেবে দেখতে শেখায়, বিদ্যমান অবস্থা হয়ে ওঠে শিক্ষার সামগ্রী। সমস্যা চিহ্নায়ন শিক্ষা সর্বদাই অত্যাচারীর স্বার্থ বিরোধী ছিল এবং থাকবে।৫২ কারণ এ পদ্ধতি হচ্ছে বিপ্লবী ভবিষ্যত, যা নতুন সম্ভবনার দ্বার খুলে দেয়।
সমস্যা চিহ্নায়ন শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে ঘটাতে হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংলাপে অংশগ্রহণ অবশ্যই প্রয়োজন। ফ্রেইরের মতে সংলাপ হচ্ছে এমন একটি অবস্থান যেখানে মানুষ পরস্পরের মুখোমুখি হয় এবং সম্মিলিতভাবে পৃথিবীকে অভিধিত করে।৫৩
পৃথিবীকে অভিহিত বা নামাঙ্কিত করে মানুষ যদি নিজের শব্দে কথা বলে পৃথিবীকে বদলে দেয়, তবেই মানুষ হিসেবে নিজের সত্তাকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সংলাপ একটি পন্থা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। নামকরণ হয়ে গেলে পৃথিবী নামকরণকারীদের কাছে পুনরাবিভূর্ত হয় এবং তাদের কাছ থেকে নতুন নামকরণ দাবি করে।৫৪ আবার পৃথিবীর নামকরণের জন্য শব্দের প্রয়োজন যা সংলাপের মর্মবস্তু। ফ্রেইরে শব্দের দুটি মাত্রার কথা উল্লেখ করেছেন চিন্তা (Reflection) ও অ্যাকশন (Action)৫৫, মাত্রা দুটি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর মধ্যে একটিকে যদি আংশিকভাবে ত্যাগ করা যায় তবে অন্যটি তৎক্ষাণাৎ প্রভাবিত হয়। আসলে এমন কোনো শব্দ নেই যা একই সাথে প্র্যাক্সিস (Praxis) নয়। বিষয়টাকে পরিষ্কারভাবে অনুধাবনের জন্য ফ্রেইরে তা নিম্নলিখিতভাবে উপস্থাপন করেছেন।
(Action) + (Reflection) = Word=Word=(Praxis)৫৬
এভাবে সমস্যা চিহ্নায়ন পদ্ধতিতে সংলাপের মাধ্যমে পৃথিবীকে নতুনরূপে নামকরণ করতে পারে। আবার একটি যথার্থ শব্দ বলা মানেই পৃথিবীর পরিবর্তন সাধন করা। কিন্তু একটি শব্দের মাত্রায় যদি অ্যাকশনের ঘাটতি ঘটে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তারা চিন্তা চেতনা মাত্রা ও প্রভাবিত হয়। কারণ বাস্তবে অ্যকশন ছাড়া কোনোরকম পরিবর্তন সাধিত হয় না। অন্যদিকে যদি চিন্তা চেতনাকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু অ্যাকশনের উপর জোর দেওয়া হয় তাহলে শব্দ দিকশূন্য ক্রিয়াবাদ (Activism) এ রূপান্তিত হয়। ফ্রেইরে বিষয়টাকে দেখছেন এভাবে নিুরূপ-
Sacrifice of action= Verbalism
Sacrifice of reflection= (Activism)৫৭
অর্থাৎ উভয় মাত্রার ক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়ের অবতারণা ঘটলে প্র্যাক্সিস নস্যাৎ হয়ে সংলাপ অসম্ভবের দিকে অগ্রসর হয়। অতএব, মানুষ নৈশব্দে গড়ে উঠতে পারে না বরং সম্মিলিতভাবে শব্দ, কাজ, অ্যাকশন ও চিন্তা-চেতনায় গড়ে উঠে।
থিম সম্পর্কে ফ্রেইরে মনে করেন, মানুষ বাস্তবতাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে যৌথভাবে যে চিন্তা ভাবনা করে তাই হচ্ছে থিম।৫৮ থিমকে উপস্থাপন করতে হলে সমস্যা চিহ্নায়ন করতে হবে এবং মাধ্যম হিসাবে নিতে হবে নাট্য প্রযোজনা, ছায়াছবি, পোস্টার, পাঠ্যবই প্রভৃতি এবং স্থান হিসেবে ব্যবহার করতে হবে এলাকাবাসীদের সাংস্কৃতিক গ্রুপ। আর এই পর্ব থেকেই সূত্রপাত ঘটবে সমস্যা চিহ্নায়ন শিক্ষার।
সংলাপের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। তিনি মনে করেন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ভাষা যেন অধিক গুরুত্ব পায়। ফ্রেইরের মতে, সংলাপ ব্যতীত মুক্তি সম্ভব নয়। কারণ একমাত্র সংলাপের মাধ্যমে এই মানুষ পারস্পারিক ক্ষেত্রে সত্যিকার বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়। এরপর শেখে পৃথিবীর বাস্তবতা সম্পর্কে।
অগাস্তো বোয়ালের অত্যাচারিতের থিয়েটার
পূর্বোক্ত আলোচনায় পাওলো ফ্রেইরের মুক্তির শিক্ষা চূড়ান্তভাবে রূপ পেয়েছে অগাস্তো বোয়ালের নাট্যকার্যক্রমে। বোয়াল এবং ফ্রেইরের মতে, সমাজে একদল লোক বলে, অন্যদল লোক শুনতে বাধ্য হয়। একদল যা দেখায় অন্য দল তা দেখতে বাধ্য হয়। একদল হুকুম করে, অন্যদল থাকে হুকুমের অপেক্ষায়। এই অন্যদলভুক্ত মানুষেরাই নিপীড়িত বা oppressed.৫৯ এই নিপীড়িতদের যে থিয়েটার তাকেই বোয়াল অত্যাচারিতের থিয়েটার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে থিয়েটার বিষয়ে অধ্যয়ন শেষে পঞ্চাশ দশকের মধ্যবর্তী সময়ে বোয়াল নিজ দেশ অর্থাৎ ব্রাজিলে নাট্যকার্যক্রমে নিয়োজিত হন এরিনা থিয়েটারের নির্দেশক হিসেবে। তিনি সেই দেশে প্রচলিত ইউরোপীয় রীতি ভেঙ্গে জাতীয় নাট্যরীতির প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে তিনি তার বিপ্লবী প্রযোজনাগুলো নিয়ে কৃষকের মাঠে, শ্রমিকের কারখানায়, কখনো কখনো রাস্তার মোড়ে মোড়ে উপস্থিত হয়েছেন।৬০ এরপর তাঁর নাটক ফোরাম থিয়েটার ধারণাতে পরিবর্তিত হয়। যাতে রয়েছে, সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে দর্শকদের বিশ্লেষণী করে তোলা, যেন দর্শকরা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারে।
ব্রাজিলে ১৯৬৮ সালে সামরিক শাসনের উত্থানে রাজনৈতিক নাট্য নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আসলে বোয়াল নতুন নাট্যরীতি সংবাদপত্র নাট্য৬১ প্রবর্তন করেন। এ নাট্যে বিভিন্ন প্রামাণ্য উৎস থেকে সংগৃহিত বিবিধ ঘটনার প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর প্রকৃত তাৎপর্য উপস্থাপিত হত। কিন্তু তাঁর এই নাট্য তিনি বেশিদিন স্থায়ী করেননি কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই নাট্যের মাধ্যমে দর্শকের কাছে সমস্যা বাতলে দেওয়া পাওলো ফ্রেইরের সঞ্চয়কারী পদ্ধতির মতো, তাই এটা ব্যর্থ প্রয়াস। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে অত্যাারিতদের নিকট নাট্য প্রযোজনার পন্থাসমূহ হস্তান্তর করলে বেশি কার্যকরী হতে পারে।
বোয়াল ১৯৭১ সালে দেশ ত্যাগ করে চলে যান আর্জেন্টিনায় এবং পুনরায় বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এড়াতে তার সহকর্মীদের নিয়ে অদৃশ্য নাট্য৬২ প্রবর্তন করেন। এই নাট্যে সমাজে ঘটে যাওয়া বাস্তব সমস্যাকে নিয়ে নাট্যকর্মীরা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মহড়া করে দৃশ্যগুলোকে সাজাত এবং বিশেষ কৌশল অবলম্বন করত যেন দর্শক বা উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ এই নাট্যকে নাট্য হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। দর্শকদের সম্পূর্ণরূপে অনবহিত করে বাজার, রেস্তোরাঁ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রভৃতি স্থানে গুপ্ত পদ্ধতিতে নাটকগুলো উপস্থাপিত হত। প্রদর্শনীগুলোর মূল অভিপ্রায় ছিল বিভিন্ন অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদে দর্শকদের উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু এই নাট্য প্রক্রিয়াও এক সময় কড়া সামরিক শাসনে নিষিদ্ধ হলো।৬৩
বোয়াল পেরুতে ১৯৭৩ সালে আলফিন সাক্ষরতা কার্যক্রম পরিচালনার সময় ফ্রেইরের পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এ সময় তিনি নির্যাতিতের নাট্য নামে যুগপৎ নাট্যচর্চা প্রতিবিম্ব নাট্য এবং ফোরাম থিয়েটার প্রণয়ন করেন। এই নাট্যের উদ্দেশ্য হলো অত্যাচারিতদের প্রয়োজনে তাদের রাজনৈতিক সচেতনতাকে শাণিত করা এবং নাট্যক্রিয়ার সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে তাদের নিপীড়িত অবস্থার পরিবর্তনে পথ আবিষ্কার করা।
ব্রেখটের চিন্তা সম্পর্কে বোয়াল বলেন যে, শুধুমাত্র বিশ্লেষণী ভাবনার মাধ্যেই মুক্তি নিহিত নয়, মুক্তির অস্তিত্ব প্রয়োগের সাথে সম্পর্কযুক্ত।৬৪ বোয়ালের এই ধারণা ফ্রেইরের সমস্যা চিহ্নায়ন শিক্ষা পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। তবে বোয়াল শ্রমজীবী সাধারণ মানুষদের থিয়েটারের কারিগরি কলা কৌশল শেখানোর পক্ষপাতি নন। তিনি বিভিন্ন অঞ্চল ভিত্তিক অধিক পরিচিত কোনো বিষয়কে অবলম্বন করে নাট্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদেরকে যুক্ত করতে আগ্রহী। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর থিয়েটার অব দ্য ওপ্রেসড গ্রন্থে চারটি পর্বের উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো: (ক) শরীরকে জানা, (খ) শরীরকে প্রকাশ করতে সক্ষম করে তোলা, (গ) নাট্য ভাষা এবং (ঘ) নাট্য আলোচনা।
(ক) বোয়াল শরীরকে জানা পর্বে শরীরের শিথিলতা অর্জনের পাশাপাশি নিজের শরীর সম্পর্কে অবহিত হয়ে ওঠার কথা উল্লেখ করেছেন। এ পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন অনুশীলনের নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন: (১) ধীর গতিতে দৌড়ানো, (২) জড়ানো পায়ে দৌড়ানো, (৩) দৈত্যের মতো দৌড়ানো, (৪) কৃত্রিম নিদ্রা দৌড়, (৫) মুষ্টিযুদ্ধ।৬৫
(খ) শরীরকে প্রকাশ করতে সক্ষম করে তোলা এই পর্বে বোয়াল শরীরের প্রকাশ ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অনেকগুলো খেলা ব্যবহার করেন, যাতে কথার উপর নির্ভরতা অনেকটা কমানো যায় এবং যাতে সৃজনশীল শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণকারীরা শুধুই নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা হয়ে থাকবে না, তারাও নতুন খেলা উদ্ভাবন করবে।
(গ) বোয়াল তৃতীয় পর্বে অর্থাৎ নাট্যভাষা পর্বে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতা সম্বন্ধে বিশ্লেষণী ভাবনা তৈরি করেন। এতে অংশগ্রহণকারী এবং দর্শক উভয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে দর্শকও কর্তার ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হন। ফলে নাট্যক্রিয়া হয়ে উঠে একটি বিপ্লবের মহড়া। তিনটি অনুশীলনের মাধ্যমে এই পর্ব সংগঠিত হয়। অনুশীলনী তিনটি হলো: (১) যুগপৎ নাট্যচর্চা, (২) বিম্বিত নাট্যচর্চা এবং (৩) ফোরাম থিয়েটার।৬৬
যুগপৎ নাট্যচর্চা : যুগপৎ নাট্যচর্চায় দর্শক এবং অংশগ্রহণকারীদের অভিমতের ভিত্তিতে অভিনয় দল কর্তৃক একটি ক্ষুদ্রাকৃতির নাটক উপস্থাপিত হয়। নাট্য ঘটনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের মুহূর্তে, অভিনয় ক্রিয়া থামিয়ে উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতির সমাধান সম্পর্কে দর্শকদের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করা হয়। দর্শকের মতামত ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে পুনরায় শুরু হয় নাট্যাভিনয়। এভাবে দর্শকরা নাটকের গতির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখছে, প্রয়োজনে নাট্যলিপি সৃষ্টি করছে আবার দর্শক হিসেবেও উপস্থিত থাকছেন। ফলে দর্শকরা উপলদ্ধি করে কাহিনী কখনই আনিবার্য বা নিয়তি নির্ভর নয়, তারা চাইলে তা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে পারে। এভাবে দর্শকদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে যে পৃথিবীর কোনো কিছু অপরিবর্তনীয়, অনিবার্য, নিয়তি নির্ভর নয়।৬৭ তারা চাইলে যে কোনো পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য হস্তক্ষেপ করতে পারেন এবং সফলও করতে পারেন।
বিম্বিত নাট্য: কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, মেক্সিকোতে স্থানীয় অধিবাসী এবং স্পেনীয় ডিসেন্টড্যান্টদের মধ্যে কথোপকথনের প্রয়োজনে থিয়েটারকে ব্যবহার করতে গিয়ে বোয়াল তৈরি করেন ইমেজ থিয়েটার। এই নাট্যে অংশগ্রহণকারী অভিনেতা ও দর্শকবৃন্দ ঐক্যমতের ভিত্তিতে সমস্যামূলক একটি বিষয় নির্বাচন করেন। নির্বাচিত বিষয়ে তাদেরই শরীর দ্বারা ভাষ্কর্য রূপ তৈরি করা হয়।৬৮ থিয়েটার সঞ্চালক বা জোকার ইমেজকে বাস্তব ও বিষয় উপযোগী করে তোলার জন্য দর্শকদের মতামত গ্রহণ করেন। দর্শকদের মধ্যে অনেকেই শোষণকে আরও পরিষ্কার করে তুলে ধরার জন্য ভাষ্কর্যের চরিত্রগুলিকে পরিবর্তন করেন। সমবেত দর্শকদের এইসব পরিবর্তনের ফলে একটা ঐক্যমতে পৌঁছে যান, যেখানে ভাষ্কর্যের প্রকৃত রূপটা দেখা যায়। একে রিয়াল ইমেজ বলা হয়। এবার জোকার দর্শকদের অনুরোধ করেন শোষণ ব্যতিরেকে একটি আইডিয়াল ইমেজ তৈরিতে সহযোগিতা করার জন্য। একে বোয়াল বলেছেন আইডিয়াল বা আদর্শ ইমেজ। দর্শকরা এক এক করে বাস্তব ইমেজকে পরিবর্তন করেন আদর্শ ইমেজে। পরবর্তী পর্যায়ে অভিনেতারা বাস্তব থেকে আদর্শ ইমেজে পৌঁছানেরর একটি প্রক্রিয়া তুলে ধরেন এক নির্বাক ও সচল দৃশ্যের মাধ্যমে। এই পরিবর্তন প্রক্রিয়াতেও দর্শকদের মতামত নেওয়া হয়। এভাবে অভিনীত হয় বিম্বিত নাট্য। ফলে এতে দর্শক সম্পৃক্ততা ঘটে অধিক কার্যকরভাবে। এই প্রক্রিয়ার প্রধান অর্থবহ বিষয় হলো দর্শকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং বিমূর্ত ভাবনাকে দৃশ্যমান আকার প্রদান করা।
ফোরাম থিয়েটার: ফোরাম নাট্যে অংশগ্রহণকারী অভিনেতা এবং দর্শক সমভাগী অত্যাচারের বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছান। সেই বিষয়টির ওপর অভিনেতারা একটি তাৎক্ষণিক নাট্যাভিনয় সম্পন্ন করেন। অভিনয় শেষে দর্শকদের সাথে সংলাপ বিনিময় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপের মাধ্যমে নাট্য কাহিনী ও বিষয় সম্বন্ধে মতামত চাওয়া হয় এবং সমস্যা আলোচনা করা হয়। সংলাপ বিনিময় শেষে পুনরায় নাটকটি অভিনয় করা হয়।৬৯ এই সময় সঞ্চালক বা জোকার দর্শকদের যে কোনো সময় অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতে আহবান জানায়। তারা যতক্ষণ খুশি অভিনেতাদের বিকল্প হিসেবে অংশগ্রহণ করতে পারেন। অভিনয়ের মাধ্যমে সমস্যা সম্পর্কিত তাদের ধারণা এবং তা থেকে উত্তরণের নিজস্ব চিন্তা উপস্থাপন করতে পারেন। নাট্যাঙ্গনের এই মহড়াই দর্শক কলাকুশলীরেদ প্রেরণা হয়ে ওঠে, বাস্তব জীবনে শোষণ-মুক্তি ঘটানোর প্রক্রিয়ায় শামিল হতে উদ্দীপিত করে। ফোরাম নাট্যের Acting বাস্তব জীবনে Action হয়ে দেখা দেয়। বোয়াল বলেন, ...The practice of these theatrical forms creates a sort of uneasy sense of incompleteness that seeks fulfilment through real action.৭০ অর্থাৎ দর্শক অভিনেতার মধ্যে বিশ্লেষণী ভাবনা প্রয়োগে পরিণতি লাভ করে। ফোরামের নিয়মগুলো কোনো অবস্থাতেই স্থিতিশীল নয়। চরিত্র, অভিনেতা, সঞ্চালক প্রত্যেকের ভূমিকা অস্থায়ী। সম্ভবত এই কারণেই বোয়াল দাবী করেন ফোরাম, নাট্য শিল্প অপেক্ষা অধিক বিপ্লবী।৭১
(ঘ) চতুর্থ পর্বে নাট্য আলোচনায় এসে উল্লেখ করা যায় যে উপরে আলোচিত তিনটি ধাপ অতিক্রমের পর অংশগ্রহণকারীবৃন্দ নিজেরাই নাট্যপ্রযোজনা পদ্ধতি ব্যবহার করতে যথেষ্ট- এ আত্মবিশ্বাস অর্জন করবেন। এই পর্বে এসে অংশগ্রহণকারীবৃন্দ নাট্য সম্পর্কিত বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করতে শুরু করেন। যেমন: নিজেদের নির্যাতিত অবস্থা সম্বন্ধে বিশ্লেষণী সচেতনতা সৃষ্টি, সরল দৃশ্যাবলী তৈরি করে অবস্থা পরিবর্তনের জন্য মহড়া আরম্ভ করেন।
জোকার প্রক্রিয়া
বোয়াল ব্রাজিলে নাট্যচর্চার প্রথম পর্বে নাট্য নির্মাণে জোকার প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছিলেন। সাধারণত জোকার নাট্যের প্রযোজনা কাঠামো গঠিত হয় একজন জোকার, একজন প্রবক্তা, প্রতিবক্তা ও দ্বিবক্তা চরিত্রের দুটি কোরাস দল এবং গায়ক বাদক দলের সমন্বয়ে। এই পদ্ধতিতে বোয়াল জোকারকে সমাজ বাস্তবতার ব্যাখ্যাকাররূপে উপস্থাপন করেন। এখানে দ্বিবক্তা কোরাস ভালো চরিত্র, তারা সবসময় সমর্থন করে প্রবক্তাকে। প্রতিবক্তা কোরাস খারাপ চরিত্র, এরা প্রবক্তার কাজের বিরোধিতা করে। কোরাস চরিত্রগুলো নির্দিষ্ট না থাকার কারণে তারা গানের মাধ্যমে যে কোন চরিত্রে অভিনয় করতে পারে। নাটক শেষে দর্শকদের উদ্দেশ্যে উপদেশবানী পরিবেশিত হয়। মূলত সাধারণ মানুষকে বিপ্লবের মহড়া প্রদানের নিমিত্তে আলোচ্য নাট্যরীতি নির্মাণ করেছেন।
THEATRE OF THE OPPRESSED গ্রন্থে বোয়াল আলোচনা করেছেন যে, থিয়েটার তৈরির যাবতীয় উপকরণ পৌছে দিতে হবে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে। নিপীড়িত জনতা তৈরি করে নেবে নিজেদের থিয়েটার, নিজেদের নাটক। দর্শক এবং অভিনেতারা সবাই একটি space এর মধ্যে থাকবে। এখানে মৌন দর্শকের অস্থিত্ব নেই। বোয়ালের থিয়েটারে কোনো সমাধান সূত্র থাকে না, থাকে শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব। নাটকে অভিনীত কোনো একটি নিপীড়নের ঘটনায় নিপীড়িত কিভাবে নিজেকে মুক্ত করবে, সেই প্রশ্নে দর্শক ও অভিনেতাদের জমে ওঠে বিতর্ক, আলোচনা। দর্শক একই সাথে দর্শক এবং অভিনেতা। অর্থাৎ Spectator + Actor = spectactor (দর্শকাভিনেতা)। এছাড়া বোয়াল মনে করেন, থিয়েটারে দর্শক ও কলাকুশলীরা প্রতেকেই নিজে নিজের দর্শক হয়ে নিজেকে বোঝার মধ্য দিয়ে উপলদ্ধি করেন নিজের মধ্যে অবস্থিত শোষক এবং মানবিক সত্তার দ্বন্দ্ব, যে দ্বন্দ্বের অবসানের ফলে ঘটে যায় মানবিকীকরণ বা Humanisation.
উপরিউক্ত আলোচনায় বর্তমান উন্নয়ন-নাট্যের যে স্বরূপ তার তত্ত্বগত ধারণার পেছনে যে সব বিষয় লুকিয়ে আছে সেই বিষয়গুলি ধারাবাহিকভাবে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। উন্নয়ন-নাট্য ধারণাটি সাম্প্রতিককালের, কিন্তু নাটকে উন্নয়ন বিষয়টি প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্য করা যায়। যুগের চাহিদা অনুযায়ী নাটকে তত্ত্ব ও আঙ্গিক পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার কারণে পিপলস থিয়েটার, পলিটিক্যাল থিয়েটার, পপুলার থিয়েটার, ফোরাম থিয়েটার এই নামগুলো চলে আসছে। আর এই সকল থিয়েটারেই উন্নয়ন-নাট্যের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। পর্যায়ক্রমিক আলোচনায় এবার আলোচনার বিষয় উন্নয়ন ও উন্নয়ন-নাট্য।
উন্নয়ন - Development
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সমাজতন্ত্রের বিপরীতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকর্তৃক আধুনিকায়নের নামে উন্নয়ন ধারণাটির উদ্ভব ঘটে।৭২ উন্নয়নকে সাধারণত ব্যাখ্যা করা হয় দুধরনের দৃষ্টিকোন থেকে। যেমন: প্রথমটি ব্যক্তিগত উন্নয়নের দৃষ্টিকোন ও দ্বিতীয়টি সামাজিক উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
বোর্দেনাভ উন্নয়ন সম্পর্কিত দু-ধরনের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, প্রথমত অদক্ষদের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর করা, যাতে তারা আরো উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয়ত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা জাগ্রত করা, যাতে তারা নিজেরাই সমাজের কাঠামোকে বদলে ফেলতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে বঞ্চনার উন্নয়ন অর্থাৎ দারিদ্র্য আসে ব্যক্তির স্বারোপিত কারণ ও অন্তঃস্থিত ঘাটতিসমূহ থেকে এবং পুরোনোর পরিবর্তে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মাধ্যমে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। দ্বিতীয়টি হচ্ছে নির্ভরতার মুক্তি অর্থাৎ প্রচলিত সমাজ কাঠামোর কারণে ক্ষমতাশালীদের চাপে নির্যাতিতরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই অসম সমাজ ব্যবস্থার মূল কারণ দূর করার মাধ্যমে উন্নয়ন করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞের মতে উন্নয়নের প্রথম ধারণাটি অত্যাচারী শ্রেণির স্বার্থকে সংরক্ষণ করে এবং দ্বিতীয়টি অত্যাচারিতদের স্বার্থকে সমর্থন করে, যা মূলত ফ্রেইরিয়ান বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।৭৩
উল্লিখিত দুটি ধারণায় প্রথম অংশ ব্যক্তিগত উন্নয়নের পর্যায়ে এবং দ্বিতীয় অংশ সামাজিক উন্নয়নের পর্যায়ে বিবেচনা করা হয়েছে। আমাদের দেশের উন্নয়ন-নাট্য দুটি ধারণায় ক্রিয়াশীল। ব্যক্তি উন্নয়ন বলতে সাধারণত বোঝায় সমাজে একজন ব্যক্তির অবস্থা কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে। আর সামাজিক উন্নয়ন নির্ভর করে সমাজ কাঠামো, রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তির সমাজে অবস্থানগত কী কী পরিবর্তন হয়েছে তার উপর। উন্নয়নের উপর প্রদত্ত ধারণাগুলির একটি জায়গায় মিল রয়েছে তা হলো পরিবর্তন। কিন্তু পরিবর্তন উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত হলেও পাওলো ফ্রেইরে মনে করেন সমস্ত উন্নয়ন যদিও পরিবর্তন কিন্তু সমস্ত পরিবর্তনই উন্নয়ন নয়। তাঁর মতে, উন্নয়ন হচ্ছে স্ব-সত্তায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা।৭৪ এক্ষেত্রে সাধারণত অদৃশ্যমান ও অবস্তুগত উন্নয়নকে স্কিল ডেভেলপমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অনেকের মতে ব্যক্তিগত উন্নয়ন একটি অস্থায়ী প্রক্রিয়া। কেননা এ প্রক্রিয়ায় উদ্বুদ্ধ সমস্যার আপাত সমাধান সম্ভব হলেও সমস্যাকে একবারে নির্মূল করা যায় না। সমস্যা তার কেন্দ্র বিন্দুতেই থেকে যায়। ফলে সৃষ্টি হয় পরমুখাপেক্ষীতা বা পরনির্ভরশীলতা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- ডায়রিয়ায় আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে ওরস্যালাইন খাইয়ে সুস্থ করে তোলা হলো। কিন্তু ডায়রিয়া হওয়ার কারণ উদ্ঘাটন করা হলো না এবং তা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জনসাধারণের মধ্যে কোনো সচেতনতা সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো না। এতে ডায়রিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিটি হয়ত উপকৃত হলো ওরস্যালাইন ফ্রি পাওয়ার কারণে, কিন্তু যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য সমাজ থেকে ডায়রিয়া নির্মূল হলো না। ফলে অন্যদেরও ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থেকে গেল। পরবর্তীকালে যদি অন্য কেউ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় তাহলে তাকেও ওরস্যালাইনের আশায় বসে থাকতে হবে। এভাবে দাতা ও গ্রহীতা নামে উদ্ভব ঘটে দুটি শ্রেণির, যা পরনির্ভরশীলতার সংখ্যাকে ক্রমাগত বৃদ্ধি করেই চলে। এজন্য ব্যক্তিগত উন্নয়নকে সত্যিকার উন্নয়ন বলা যায় না। বোর্দেনাভের মতে এই উন্নয়ন বঞ্চনার উন্নয়ন। বিশেষজ্ঞের মতে তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ সরকারি, বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ তাদের উন্নয়ন কার্যক্রমকে পরিচালিত করছে বঞ্চনার উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।৭৫ উক্ত আলোচনা থেকে এ কথা বলা যায় যে, উন্নয়ন সম্পর্কিত দ্বিতীয় ধারণাটি অধিক যৌক্তিক। কারণ উক্ত ধারণায় বস্তুর পরিবর্তে অধিক প্রাধান্য পেয়েছে মানুষ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই ধারণাটি ডঃ অমর্ত্যসেনের মানব-কেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তার প্রভাবযুক্ত। উন্নয়ন-সম্পর্কিত সমুদয় আলোচনা থেকে বলা যায়, উন্নয়ন হচ্ছে উন্নয়ন বঞ্চিত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বা স্ব উদ্যোগে বিদ্যমান নেতিবাচক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন। আর উন্নয়নের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয় মানব এবং মানবের সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয়। তবে এই বিষয়টি স্থান, কাল, পাত্রভেদে ভিন্ন।
উন্নয়ন নাট্য - Theatre for Development
সাধারণত সুনির্দিষ্টভাবে মানব উন্নয়নের লক্ষ্যে সাধারণ দর্শকের উপস্থিতিতে, সুবিধামত কোনো স্থানে, একেবারে সাধারন আয়োজনে, স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট বা বিদ্যমান সমস্যার সমন্বয়ে উপস্থাপিত নাট্য ক্রিয়াকে উন্নয়ন-নাট্য বা থিয়েটার ফর ডেভেলমেন্ট বলা যায়। তবে বিষয়টি এত সহজভাবে দেখলে চলবে না। কারণ প্রকৃত পক্ষে উন্নয়ন-নাট্য বিষয়টি আরও ব্যাপক বিস্তৃত এবং পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ায় সন্নিবেশিত। বিশেষজ্ঞের মতে, যে নাট্যে বিশেষ জনগাষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নের প্রসঙ্গ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয় তাই উন্নয়ন নাট্য।৭৬ মূল ধারার নাট্য এবং উন্নয়ন-নাট্যের মধ্যে পার্থক্য হলো মানব উন্নয়নের দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে এবং এর নির্মাণ রীতি, পরিবেশনা রীতি ও প্রদর্শনী পরবর্তী অন্যান্য আনুষাঙ্গিক রীতির পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে। আসলে উন্নয়ন নাট্য মূলত একটি পদ্ধতি, এতে উন্নয়ন কার্যক্রমে জনগণের মালিকানা সৃষ্টি করাই মূল লক্ষ্য।
নেপালে অনুষ্ঠিত উন্নয়ন নাট্য কর্মশালায় এথারটন বেশি জোর দিলেন প্রক্রিয়া বা প্রসেস এর উপর। তাঁর মতে, এই প্রসেস বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থায় বিরোধ সৃষ্টির পরিবর্তে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করে। ফলে উভয় পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। তবে এথারটন উন্নয়ন-নাট্যে শিল্পমানের প্রতি মোটেও জোর দিলেন না। কারণ তিনি মনে করেন এতে শৈল্পিক দিকটি প্রাধান্য পেলে জনগণের দৃষ্টি উন্নয়ন থেকে সরে গিয়ে থিয়েটারের প্রতি মোহবিষ্ট হবে। ফলে উন্নয়ন প্রসেস ব্যাহত হবে। এক্ষেত্রে তিনি জনগণের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কারণ স্বাধীনতা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা বাড়িয়ে দেয় এবং স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ শিল্প সৃষ্টির সহায়করূপে ক্রিয়াশীল। তবে উন্নয়ন নাট্যে যদি শৈল্পিক দিকটি একেবারেই অনুপস্থিত থাকে তাহলে এর প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাজেই এখানে স্বতঃস্ফূর্ততা যেমন প্রয়োজন তেমনি শৈল্পিক দিকটি বিবেচ্য বিষয়। কারণ নাট্য প্রদর্শনীতে উপস্থিত দর্শকদের শ্রবণ ইন্দ্রিয় অপেক্ষা দর্শন ইন্দ্রিয় বেশি কার্যকর থাকে।
টিম প্রেন্টকি উন্নয়ন নাট্য বিবেচনায় অধিক গুরুত্ব দিলেন আত্ম-উন্নয়নের প্রতি।৭৭ উন্নয়ন-নাট্যের মাধ্যমে প্রচলিত প্রথায় বিশ্বাসী বা অগ্রসর মানুষের চিন্তা-চেতনায় এবং বিশ্বাসের পরিবর্তনকেই তিনি আত্ম-উন্নয়ন হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর এই আত্ম উন্নয়ন ঘটবে উন্নয়ন-নাট্যের সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন নাট্য প্রক্রিয়ায় প্রধান দুটি বিষয় হলো থিয়েটার এবং প্রদর্শনী পরবর্তী সংলাপ। এছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে থিয়েটারের মাধ্যমে জনগণ দেখবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের কক্সিক্ষত ছবি, সংলাপের মাধ্যমে উপস্থাপিত ছবিকে বিশ্লেষণ করবে এবং পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের কাক্সিক্ষত কার্যক্রমকে বাস্তবায়িত করবে। উন্নয়ন নাট্য প্রক্রিয়ায় থিয়েটার, সংলাপ, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চক্রাকারে আবর্তিত হয়।৭৮ নিম্নে চিত্রের সাহায্যে দেখানো হলো।
সংলাপ (Dialogue)= থিয়েটার (Theatre)= পদক্ষেপ (Action)= সংলাপ (Dialogue)
উন্নয়ন নাট্য নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম মেনে চলে না। কারণ উন্নয়ন সাধনের জন্য এর কৌশল এবং আঙ্গিক প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। তবে নির্দিষ্ট কতগুলো ক্রমধাপ এতে রয়েছে। ২০০১ সালে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত কতগুলো ধাপের সমন্বয়ে উন্নয়ন নাট্যের সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি রেখা চিত্রের সাহায্যে তুলে ধরা হয়। যে ধাপগুলো অতিক্রম পূর্বক উন্নয়ন নাট্য প্রক্রিয়া আবর্তিত।৭৯
FOLLOW UP = RESEARCH = IDENTIFYING PROBLEMS/CONCERNS = SHARING = STORY MAKING = STORIES INTO DRAMA = TESTING THE DRAMA = DISSCUSS = EVENT = PARTICIPATORY = FOLLOW UP
[THROUGH THEATRE GAMES & VARIOUS CREATIVE FORMS]
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে উন্নয়ন নাট্যের একটি সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করা হলো। উন্নয়ন নাট্য একটি চলমান প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্টভাবে উন্নয়নের দায়বদ্ধতায় স্থানীয় বিভিন্ন সমস্যার সমন্বয়ে ইস্যুভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণকে সচেতায়নের জন্য সাধারণ অভিনেতা-অভিনেত্রী দ্বারা নিরাভরণ মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় ও সাজসজ্জায় সুবিধা মতো কোনো স্থানে সাধারণ দর্শকের উপস্থিতিতে শিল্প সম্মতভাবে অর্থপূর্ণ কোনো কিছু উপস্থাপন করাকে উন্নয়ন নাট্য হিসেবে অভিহিত করা যায়। মূলধারার থিয়েটার থেকে উন্নয়ন নাট্যকে পৃথক করা যায়- উদ্দেশ্যগত দায়বদ্ধতা, নিরাভরণ পরিবেশনারীতি ও নির্মাণ রীতি এবং নাট্যের লক্ষিত জনগোষ্ঠী- এই বৈশিষ্ট্যগুলো দ্বারা।
টীকাসমূহ
১. গীতা সেনগুপ্ত, বিশ্বরঙ্গালয় ও নাটক, জিজ্ঞাসা, কলিকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৫, পৃষ্ঠা : ১৮,১৯।
২. আফসার আহমদ, ওরেস্তেস (অনুবাদ), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: মে ২০০১, পৃষ্ঠা : ২০-২১ (ভূমিকা অংশ)।
৩. এক সময় চার্চ ও খ্রিস্টান ধর্মযাজকগণের নাট্য বিরূপতা যেমন- থিয়েটারের অবলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তেমনি পরবর্তীকালে এঁদেরই আনুকূল্যে থিয়েটারের পুনরুজ্জীবন একটি লক্ষণীয় ঘটনা। দশম শতাব্দীর শেষভাগে(আনুমানিক ৯৭০ খ্রিস্টাব্দে) চার্চের আনুকূল্যে জনসাধারণের মধ্যে ধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে পুনরায় নাট্য প্রযোজনার সূত্রপাত হয়। খ্রিস্টান যাজকগণ উপলব্ধি করেন যে নাট্যের মাধ্যমে খ্রিস্টের জীবন ও মহিমা প্রচার করা অনেক সুবিধাজনক। এরদ্বারা সব কিছুকে জনগণের কাছে প্রত্যক্ষগোচর করে তোলা যায়। তাঁরা জনমনে থিয়েটারের প্রভাব সম্পর্কেও উপলব্ধি করেন। ডক্টর রঞ্জিত কুমার মিত্র, থিয়েটারের দৃশ্যবিকাশ ও সমীক্ষা বেস্টবুকস, কলিকাতা, প্রথম প্রকাশ: জুলাই ১৯৯২, পৃষ্ঠা : ৯৩-৯৪।
৪. সেলিম আল দীন, মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ:জুন, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা : ১৩২।
৫. শেকস্পীয়ার, কমেডি অব এরারস্ (দ্বিতীয় অঙ্ক), শেকস্পীয়ার রচনাবলী, অনুবাদ- সুধাংশু রঞ্জন ঘোষ, তুলিকলম, কলকাতা, চতুর্থ প্রকাশ: এপ্রিল ১৯৮৭, পৃষ্ঠা : ১৮৪-১৮৫।
৬. গীতা সেনগুপ্ত, বিশ্ব রঙ্গালয় ও নাটক, জিজ্ঞাসা, কলিকাতা, প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৫, পৃষ্ঠা : ৪৪৬।
৭. সুনীল কুমার ঘোষ, ইবসেন নাট্যসম্ভার (১ম খণ্ড, ভূমিকা অংশ), কলকাতা, প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৮০।
৮. কুন্তল মুখোপাধ্যায়, থিয়েটার ও রাজনীতি (একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশে¬ষণ), নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ: বইমেলা, জানুয়ারি ২০০২, পৃষ্ঠা : ৩২।
৯. ড. দুর্গাশংকর মুখোপাধ্যায়, নাট্যতত্ত্ব বিচার, কলকাতা, বইমেলা- ২০০৩, পৃষ্ঠা : ২৮২-২৮৬।
১০. রঁম্যা রলাঁ, পিপলস থিয়েটার, অনুবাদ- রথীন চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ:বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬, পৃষ্ঠা : ৫।
১১. অন্জন্ দাশগুপ্ত, থিয়েটার, প্রথম খন্ড, নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, বইমেলা- জানুয়ারি ২০০৬, পৃষ্ঠা : ১১২।
১২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ১১৩।
১৩. রঁম্যা রলাঁ, পিপলস থিয়েটার, অনুবাদ- রথীন চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ:বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬, পৃষ্ঠা : ১১৮-১২০।
১৪. অন্জন্ দাশগুপ্ত, থিয়েটার, প্রথম খ-, নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, বইমেলা, জানুয়ারি ২০০৬, পৃষ্ঠা : ১১৩।
১৫. রঁম্যা রলাঁ, পিপলস থিয়েটার, অনুবাদ- রথীন চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ:বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬, পৃষ্ঠা : ১২৪।
১৬. জিয়া হায়দার, থিয়েটারের কথা (৪র্থ খ-), বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, মার্চ-১৯৯৬, পৃষ্ঠা:১০৫।
১৭. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ১০৬।
১৮. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ১০৬।
১৯. ম্যালকম গোল্ডস্টেইন, অনুবাদ: আলমগীর খান, তিরিশের প্রথম ভাগে আমেরিকায় প্রোলেটারিয়ান থিয়েটার, থিয়েটার, মে- ২০০২, সম্পাদনা: রামেন্দু মজুমদার, পৃষ্ঠা : ৮৮।
২০. জিয়া হায়দার, থিয়েটারের কথা (৪র্থ খন্ড), বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, মার্চ-১৯৯৬, পৃষ্ঠা:১০৪।
২১. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ১০৫।
২২. আতাউর রহমান, নাট্য প্রবন্ধ বিচিত্রা, বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, এপ্রিল- ১৯৯৫, পৃষ্ঠা : ৩৯।
২৩. জিয়া হায়দার, থিয়েটারের কথা (৪র্থ খন্ড), বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, মার্চ-১৯৯৬, পৃষ্ঠা:১০৯।
২৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ১১৪।
২৫. রঁম্যা রলাঁ, পিপলস থিয়েটার, অনুবাদ- রথীন চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ:বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬, পৃষ্ঠা : ১২।
২৬. ওয়াহীদা মল্লিক, ব্রেখটের থিয়েটার: উপাদান ও উদ্দেশ্য, থিয়েটার স্টাডিজ, জুন-২০০২, সংখ্যা- ৯, সম্পাদনা: সেলিম আল দীন, পৃষ্ঠা : ১২৫।
২৭. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা, উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ৪১।
২৮. অন্জন্ দাশগুপ্ত, থিয়েটার, প্রথম খ-, নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, বইমেলা, জানুয়ারি ২০০৬, পৃষ্ঠা : ১০।
২৯. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ৫৭।
৩০. শামসুল আলম বকুল, উন্নয়ন থিয়েটার ও আমাদের চর্চা, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি- ২০০১, পৃষ্ঠা : ১৪।
৩১. অন্জন্ দাশগুপ্ত, থিয়েটার, প্রথম খ-, নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, বইমেলা, জানুয়ারি ২০০৬, পৃষ্ঠা : ১০।
৩২. রঁম্যা রলাঁ, পিপলস থিয়েটার, অনুবাদ- রথীন চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ:বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬, পৃষ্ঠা : ১২।
৩৩. Paulo Freire, Pedagogy of the Oppressed (Translated by Myra Bergman Ramos), Published by Penguin Books, Great Britain, Re printed 1982, Page : 20.
৩৪. Ibid; Page : 20.
৩৫. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ২৯।
৩৬. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ৩০।
৩৭. Paulo Freire, Pedagogy of the Oppressed (Translated by Myra Bergman Ramos), Published by Penguin Books, Great Britain, Re printed 1982, Page : 24.
৩৮. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ৩০।
৩৯. Paulo Freire, Pedagogy of the Oppressed (Translated by Myra Bergman Ramos), Published by Penguin Books, Great Britain, Re printed 1982, Page : 32.
৪০. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ২৯।
৪১. Paulo Freire, Pedagogy of the Oppressed (Translated by Myra Bergman Ramos), Published by Penguin Books, Great Britain, Re printed 1982, Page : 33.
৪২. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ৩১।
৪৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ৩২।
৪৪. Paulo Freire, Pedagogy of the Oppressed (Translated by Myra Bergman Ramos), Published by Penguin Books, Great Britain, Re printed 1982, Page : 65.
৪৫. Ibid; Page : 45.
৪৬. Ibid; Page : 46.
৪৭. Ibid; Page : 46, 47.
৪৮. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ৩৩।
৪৯. Paulo Freire, Pedagogy of the Oppressed (Translated by Myra Bergman Ramos), Published by Penguin Books, Great Britain, Re printed 1982, Page : 50.
৫০. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ৩৩।
৫১. Paulo Freire, Pedagogy of the Oppressed (Translated by Myra Bergman Ramos), Published by Penguin Books, Great Britain, Re printed 1982, Page : 56.
৫২. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ৩৪।
৫৩. Paulo Freire, Pedagogy of the Oppressed (Translated by Myra Bergman Ramos), Published by Penguin Books, Great Britain, Re printed 1982, p. 61.
৫৪. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ৩৪।
৫৫. Paulo Freire, Pedagogy of the Oppressed (Translated by Myra Bergman Ramos), Published by Penguin Books, Great Britain, Re printed 1982, Page : 60.
৫৬. Ibid; Page : 60.
৫৭. Ibid; Page : 60.
৫৮. Ibid; Page : 75.
৫৯. সঞ্জয় গঙেগাপাধ্যায়, আউগুস্তো বোআলের থিয়েটার, নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন, প্রথম প্রকাশ, বইমেলা, জানুয়ারি- ২০০৬, পৃষ্ঠা- ৯৯।
৬০. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা, উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ৩৮।
৬১. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ৩৯।
৬২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ৩৯।
৬৩. অগস্তো বোয়াল, অনুবাদ: সুশান্ত সরকার, প্লেয়িং বোয়াল, সমাবেশ, ঢাকা, ২০০৪, পৃষ্ঠা : ১৭।
৬৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ৪১।
৬৫. Augusto Boal, THEATRE OF THE OPPRESSED, (Translated from the Spanish by Charles A. & Mariaodilia leal Mc Bride), Reprinted as a Pluto Classic in 1998, London, Page : 128.
৬৬. Ibid; Page : 134-142.
৬৭. Ibid; Page : 132.
৬৮. Ibid; Page : 135.
৬৯. ওনরফ; চধমব : ১৩৯.
৭০. সঞ্জয় গঙেগাপাধ্যায়, আউগুস্তো বোআলের থিয়েটার, নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন, প্রথম প্রকাশ, বইমেলা, জানুয়ারি- ২০০৬, পৃষ্ঠা : ৮।
৭১. অগস্তো বোয়াল, অনুবাদ: সুশান্ত সরকার, প্লেয়িং বোয়াল, সমাবেশ, ঢাকা, ২০০৪, পৃষ্ঠা : ৪২।
৭২. এজাজুল হক চৌধুরী, মানবিক উন্নয়ন, জাতীয় গ্রন্থবিতান, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল ১৯৯৯, পৃষ্ঠা : ১০।
৭৩. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ৫০।
৭৪. Augusto Boal, THEATRE OF THE OPPRESSED, (Translated from the Spanish by Charles A. & Mariadilia leal Mc Bride), Reprinted as a Pluto Classic in 1998, London, Page : 129-130.
৭৫. সৈয়দ জামিল আহমেদ, তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা, উন্নয়ন নাট্য: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা : ৫০।
৭৬. খবরের কাগজ, বর্ষপুর্তি স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা, ২৩ বর্ষ ১২ সংখ্যা ২৩ মার্চ ২০০৪, পৃষ্ঠা : ৯৪।
৭৭. At its simplest Theatre for Development (TFD) is what it says: theatre used in the service of development aims; a tool available to development agencis which pursue the goals of self development and an improved quality of life of all people whose material conditions leave them vulnerable to hostile predatory forces, both natural and human. In other words, it is an instruement in the struggle to help such people become the subjects and cease to be the objects, of their own historics. Tim prentki, What is Theatre For Developement, Development in practice, volume 8, November 4, 1998, Page : 419.
৭৮. শামসুল আলম বকুল, উন্নয়ন থিয়েটার ও আমাদের চর্চা, সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি- ২০০১, পৃষ্ঠা : ২৭।
৭৯. ড.এস.এম. ফারুক হোসাইন, উন্নয়ন নাট্যের বিষয়বস্তু, আঙ্গিক ও শিল্পভাবনার গণমুখী প্রয়োগ: পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পি.এইচ.ডি অভিসন্দর্ভ (অপ্রকাশিত), পৃষ্ঠা : ১৬।
কামাল উদ্দীন মণ্ডল : এম.ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়