Full premium theme for CMS
মূকাভিনয় চর্চার সমস্যা ও সম্ভাবনা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
ভাষাহীন ‘ভাষা’-র অনুপম শিল্প মূকাভিনয়। সৃষ্টির আদিকালে মানুষ যখন কথা বলতে অক্ষম ছিল, ইশারা-ইঙ্গিত-অঙ্গভঙ্গিই ছিল ভাবপ্রকাশের অবলম্বন-প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই মূকাভিনয়ের সূচনা। অবশ্য ভাষার অভাব অনুপূরণের পাশাপাশি তৎকালীন জীবনাচরণের অঙ্গ পশুশিকার ও কৃষি উৎপাদন, মানবশত্রু-পশুশত্রু-প্রাকৃতিক শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা প্রভৃতিসহ নানাবিধ কৃত্যমূলক কর্মকাণ্ডের অভ্যন্তরে অঙ্গাভিনয়ের ব্যবহারও মূকাভিনয় উদ্ভবের অন্যতম কারণ। তবে শিল্প হিসেবে মূকাভিনয় চর্চিত হবার জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো অনেক দিন। উপরন্তু, পৃথিবীর সর্বত্র সমভাবে মূকাভিনয় চর্চার বিকাশ লক্ষ্য করা যায় না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মৌনমুখর শিল্পরীতি মূকাভিনয় চর্চার সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করতে হলে প্রথমেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চার সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করা আবশ্যক। কেননা, উল্লিখিত প্রেক্ষাপটেই মূকাভিনয় চর্চার সমস্যা ও সম্ভাবনাসমূহ বিবেচ্য।
বিশ্বসংস্কৃতি অঙ্গনে মূকাভিনয় শিল্পের উৎকর্ষ এবং বিকাশে রোমানদের ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তবে মূকাভিনয়-উৎসের বিচারে বাঙলা অঞ্চলেরও রয়েছে উল্লেখ করার মতো ইতিহাস। বাঙলার নানাবিধ কৃত্যমূলক অনুষ্ঠান, উপাচার, পালা-পার্বন, লোকাচার, মেলা-উৎসব, সঙ প্রভৃতিতে তথা লোক-আঙ্গিকগুলোর উপস্থাপনায় সুপ্রাচীনকাল থেকেই মূকাভিনয়-অনুরূপ অঙ্গাভিনয় মিশ্রিত রয়েছে। পঞ্চমবেদ ভরতকৃত ‘নাট্যশাস্ত্র’-এ আঙ্গিকাভিনয়ের প্রতি অসামান্য গুরুত্বপ্রদান অত্র অঞ্চলে উক্তরীতির পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে। প্রাচীন ভারতবর্ষে রামায়ণ-মহাভারতের মহাকাব্যিক উপস্থাপনায় ‘গ্রন্থিক’-এর পাশাপাশি ‘শৌভিক’ প্রয়োগের তথ্য পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত, তৎকালে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী আবৃত্তিকারদের অভিহিত করা হতো ‘গ্রন্থিক’ এবং এ আবৃত্তির সঙ্গে অঙ্গাভিনয়কারীদের ‘শৌভিক’। সম্ভাব্য খ্রিস্টিয় সপ্তম ও অষ্টম শতকে প্রচলিত ‘বুদ্ধনাটক’-এ বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বুদ্ধের রীতি-নীতি-আদর্শ-মাহাত্ম্য প্রভৃতি নানাবিধ মূক-আঙ্গিকের মাধ্যমে প্রচার করতেন বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। উল্লিখিত তথ্যসমূহ বাঙলা অঞ্চলের নিজস্ব মূকাভিনয়-ঐতিহ্যের প্রাচীনতারই সাক্ষ্য প্রদান করে। তবে শিল্পগত অনেক উত্তরাধিকারের মতো এক্ষেত্রেও বাঙলার প্রত্যাশিত ধারাবাহিকতা ও সমুন্নত বিকাশ অর্জিত না হওয়ার কারণ আজ গবেষণার বিষয় হতে পারে।
যা হোক, দীর্ঘ মধ্যখণ্ডন অন্তে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ১৯৭৪-এ বাংলাদেশে আধুনিক মূকাভিনয় চর্চার পুনঃসূচনার কৃতিত্ব পার্থপ্রতিম মজুমদার-এর। এ বছর তিনি রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমীর মঞ্চে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে মূকাভিনয়ের প্রদর্শনী করেন। পার্থপ্রতিম সমকালে মঞ্চ ও টেলিভিশনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রদর্শনীর মাধ্যমে এবং একক প্রচেষ্টায় মূকাভিনয় শিল্পের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। তবে ফরাসি সরকারের স্বল্পমেয়াদি বৃত্তিলাভ করে ১৯৮১-এ তিনি মূকাভিনয় প্রশিক্ষণে ফ্রান্সে গমন করেন। পার্থপ্রতিম সেখানে বিশ্বসেরা মূকাভিনেতা ‘মাস্টার অব মাইম’ মার্সেল মার্সো-র অধীনে নিবিড় শিক্ষা অর্জন করেন। উপরন্তু, তিনি প্রশিক্ষিত হন মার্সোর গুরু আধুনিক নিরীক্ষাধর্মী মূকাভিনয়ের দিকপাল এতিয়েন দুক্রু-র নিকটেও। পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে কয়েকটি কর্মশালা পরিচালনাসহ আন্তর্জাতিকভাবে মূকাভিনয় প্রশিক্ষণ প্রদান, দলগত ও একক মূকাভিনয় প্রদর্শনী ছাড়াও পার্থপ্রতিম মার্সোর দলের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মূকাভিনয় উপস্থাপন করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন।
বাংলাদেশের মঞ্চে বিদেশিদের মধ্যে প্রথম ১৯৭৫-এ মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন ব্রিটিশ শিল্পী এডাম ডেরিয়াস। নাট্যচক্র-র সদস্য কাজী মশহুরুল হুদা তাঁর উপস্থাপনা প্রত্যক্ষণে এ শিল্পে প্রবলভাবে উৎসাহিত হন এবং দীর্ঘ চর্চার শেষে ১৯৮২-এ তিনি শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চে প্রথম মূকাভিনয়ের প্রদর্শনী করেন। তবে মশহুরুল হুদাও পরবর্তীতে পূর্বসুরির ন্যায় মূকাভিনয় বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণে বৃত্তি অর্জন করে আমেরিকা প্রবাসী হন। মার্কিন স্ত্রী শ্যারনসহ তিনি লস এঞ্জেলস্-এ প্রতিষ্ঠা করেছেন মূকাভিনয় দল ‘ন্যু এজ মাইম থিয়েটার’। মূকাভিনয় প্রশিক্ষণ এবং মূকাভিনয় শিল্পের কলাকৌশলের সঙ্গে থিয়েটার-ধারণা, মুখোশ, চিত্রকলা, যান্ত্রিক কৌশল, আলোর কারসাজি প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ের প্রয়োগ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নবতর উপস্থাপনার জন্যে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত।
১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ বাংলাদেশের মূকাভিনয়ে একটি ‘বন্ধ্যা’ সময়। এদিকে, ১৯৮১ থেকে চর্চারত থাকলেও ১৯৮৯-এ মূকাভিনয়ে দীপ্তিমান হলেন জিল্লুর রহমান জন। এ বছর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের প্রথম মূকাভিনয় দল ‘ঢাকা প্যান্টোমাইম’। দলটির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রশংসিত প্রদর্শনীসহ জিল্লুর রহমান জন বেশ ক’টি সফল কর্মশালা পরিচালনার মাধ্যমে অনেক তরুণকে মূকাভিনয় শিল্পের সঙ্গে পরিচিত এবং এর চর্চায় উৎসাহিত করেন। শিল্পকলা একাডেমীর সহযোগিতায় দেশি-বিদেশি মূকাভিনয় দলের সমন্বয়ে বাংলাদেশে প্রথম মূকাভিনয় উৎসব এবং সেমিনার আয়োজনের কৃতিত্বও তাঁর নেতৃত্বে ‘ঢাকা প্যান্টোমাইম’-এর। এছাড়া জিল্লুর রহমান জন বিভিন্ন দেশে দলগত ও একক মূকাভিনয় প্রদর্শন এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করেও দেশের জন্যে প্রভূত সুনাম বয়ে এনেছেন। তবে বর্তমানে তিনিও কানাডা প্রবাসী।
বিশ্ব মূকাভিনয়ে এমন গৌরবময় আসন বাংলাদেশের তিন স্বনামখ্যাত মূকাভিনয় শিল্পী পার্থপ্রতিম মজুমদার, কাজী মশহুরুল হুদা আর জিল্লুর রহমান জন-এর অর্জন সত্ত্বেও বাংলাদেশের বর্তমান মূকাভিনয় চর্চাকে উক্ত সম্মানের যোগ্য উত্তরসূরি বলা সম্ভব নয়। কারণ মূকাভিনয় দল হিসেবে রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত ‘ঢাকা প্যান্টোমাইম’(১৯৮৯), মলয় কুমার পাল, নাজিম উদ্দিন, মাসুকা পারভীন রাকা ও সেহরা কবীর কুমু প্রতিষ্ঠিত ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম ব্রিগেড-ডাম্ব’(১৯৯২), ফরহাদ হাসান সিদ্দিকী প্রতিষ্ঠিত ‘নির্বাক’(১৯৯৩), জয়নাল আবেদীন জন ও দীপক ভৌমিক প্রতিষ্ঠিত ‘মাইম থিয়েটার’(১৯৯৭) প্রভৃতির কোনো কার্যক্রম দীর্ঘদিন দৃষ্ট হয় না। অবশ্য চট্টগ্রামে রিজোয়ান রাজন-এর নেতৃত্বে ‘প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট’(১৯৯৫) এবং দেবাংশু হোর-এর পরিচালনায় ‘নাটুয়া’(২০০১)-র প্রযোজনার সংবাদ প্রায়-নিয়মিত পাওয়া যায়। তবে বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত ‘প্যান্টোমাইম ইউনিট’, ‘অঙ্গন প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট’, ‘ডিএল প্যান্টোমাইম’, ‘ভিশন প্যান্টোমাইম’সহ আরো কয়েকটি মূকাভিনয় সংগঠন এককথায় বর্তমানে বিলুপ্ত। ‘ফরিদপুর থিয়েটার’ একসময় মূকাভিনয় চর্চার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য মূকাভিনয় প্রযোজনা মঞ্চে আনতে সক্ষম হলেও সম্প্রতি দলটির এমন কোনো প্রয়াস নেই। এছাড়া, বাংলাদেশে দলের বাইরে এককভাবে মূকাভিনয় চর্চাকারীদেরও (যেমন: ফরিদ আহমেদ রটি, শুভাশিষ ভৌমিক, ইস্রাফিল আহমেদ রঙ্গন, নাদেজদা ফারহানা মৌসুমি প্রমুখ) বর্তমান সময়ে মূকাভিনয় চর্চায় ব্যাপৃত থাকার তথ্য পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী একসময় নিয়মিতভাবে বেশ কয়েকটি মূকাভিনয় প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতিষ্ঠানটির মূকাভিনয় প্রশিক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। জিল্লুর রহমান জন-এর প্রবাসের কারণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মূকাভিনয় প্রশিক্ষণালয় ‘জন মাইম এন্ড প্যান্টোমাইম একাডেমী’ বর্তমানে বন্ধ। বর্তমান লেখক প্রতিষ্ঠিত ‘শৌভিক মূকাভিনয় বিদ্যালয়’ থেকে তিনটি ব্যাচ কোর্স সমাপন করে বের হলেও স্থানাভাবে এর কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। চট্টগ্রামে ‘প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট’ এবং দেবাংশু হোর পরিচালিত কর্মশালাসমূহও দীর্ঘদিন আয়োজিত হচ্ছে না বলে জানা যায়।
পাশ্চাত্যে মূকাভিনয়ে দক্ষতা অর্জন ব্যতীত নাট্যকর্মীর থিয়েটারজ্ঞান পূর্ণতা পায় না বলেই বিশ্বাস করা হয়। বিপরীতে বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা বিষয়টি সম্পর্কে যেমন অসচেতন তেমনি এখানে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ বিভাগ চালু থাকলেও কোনো পাঠ্যসূচিতেই মূকাভিনয় সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ কোর্স নেই। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা-শিক্ষায় মূকাভিনয়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে শত শত সংলাপনির্ভর প্রচলিতধারায় নাট্যপ্রযোজনা নির্মিত হলেও এ পর্যন্ত মাত্র সাত-আটটি ‘মাইমোড্রামা’ (মূকাভিনয়-আঙ্গিকে নির্মিত একক কাহিনী সম্বলিত পূর্ণাঙ্গ দৈর্ঘ্যরে প্রযোজনা) নির্মাণের তথ্য পাওয়া যায়। মূকাভিনয় প্রয়োগের দু’টি ক্ষেত্র ‘নকশা মূকাভিনয়’ (ক্ষুদ্র-কাহিনী নির্ভর মূকাভিনয়) এবং ‘মাইমোড্রামা’ যেমন হচ্ছে না, তেমনি তৃতীয় ক্ষেত্র ‘নাট্যে মূকাভিনয় প্রয়োগ’-এর বিষয়েও নাট্যদলগুলোর তেমন আগ্রহ ও উদ্যোগ লক্ষিত হয় না। অথচ অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে অভিনয়ের উপাদানগত ও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য নিরূপণ করে নির্দ্বিধায় বলা হয়- প্রাচীনকাল থেকে অভিনয় প্রধানত মানব-শরীরকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে।
উল্লিখিত চর্চাসমূহ ব্যতিরেকেও বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্ত ও অনিয়মিতভাবে কিছু মূকাভিনয় উপস্থাপনা লক্ষ করা যায়। তবে সে প্রযোজনা মূলত কোনো অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক এবং এর সঙ্গে প্রত্যাশিত শিল্পচেতনা বা শিল্পচর্চার সম্পর্ক অত্যন্ত দূরবর্তী।
এক্ষণে উপলব্ধি থেকে বলা যায়, বাংলাদেশে ঐতিহ্যময় মূকাভিনয় শিল্পের বর্তমান চর্চা মোটেও আশানুরূপ নয়। মূকাভিনয় শিল্প অনায়াসসাধ্য নয় বরং অত্যন্ত শ্রম ও মেধানির্ভর। সম্ভবত এ কারণেই বাংলাদেশে এ শিল্পে দুঃখজনক অনীহা লক্ষণীয়। পাশাপাশি নাট্যসহ পারফর্মিং শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্রের চর্চাকারীরাও স্ব-ক্ষেত্রে মূকাভিনয়ের ব্যবহারিক দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারেননি।
যা হোক, অতৃপ্তির মাঝেও এক্ষেত্রে দু’একটি ইতিবাচক তথ্যের উল্লেখ করা সম্ভব। সম্প্রতি রাজধানীতে নাট্যসংগঠন ‘স্বপ্নদল’ মঞ্চে এনেছে নকশা-মূকাভিনয় ‘সার্কাস’ এবং দেড়ঘণ্টার পূর্ণাঙ্গ মাইমোড্রামা ‘জাদুর প্রদীপ’- জানা মতে, যেটি বর্তমান সময়ে নিয়মিত মঞ্চায়নের উদ্দেশ্যে নির্মিত দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ মাইমোড্রামা। পাশাপাশি ‘পদাতিক নাট্য সংসদ’ মঞ্চে এনেছে নকশা-মূকাভিনয় ‘দিনলিপি’। আর শিশুনাট্যদল ‘নির্মাণ থিয়েটার’-এর ‘আফ্রিকা’ প্রযোজনায়ও লক্ষ করা গেছে মূকাভিনয়-প্রচেষ্টা।
উপরন্তু, সৃষ্টি ও আনন্দের চতুর্দশ বর্ষপদার্পন উপলক্ষে চট্টগ্রামের ‘প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট’-এর আয়োজনে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের দলের সমন্বয়ে ২০-২২ মার্চ, ২০০৯ চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘মূকাভিনয়ে আন্তর্জাতিকতা’ শীর্ষক তিনদিন ব্যাপী ‘প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট জাতীয় মূকাভিনয় উৎসব, ২০০৯’।
উল্লিখিত আলোচনায় বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চার পূর্বাপর সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এর মধ্য থেকে বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চার সমস্যাসমূহকে নিম্নরূপে চিহ্নিত করা সম্ভব:
ক. বাঙলার নিজস্ব মূকাভিনয়-আঙ্গিকের বিকাশ না হওয়া: চিরায়ত লোক-ঐতিহ্য, বুদ্ধনাটক, গ্রন্থিক-শৌভিকের ধারাবাহিকতায় বাঙলা অঞ্চলে নিজস্ব মূকাভিনয় আঙ্গিকের বিকাশ স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকলেও তা অদ্যাবধি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এর পশ্চাতের কারণসমূহের মধ্যে ঔপনিবেশিক অতীত অন্যতম বলে মনে করা যায়।
খ. মূকাভিনয়-মহারথীদের প্রবাস গমন: বাংলাদেশের তিন মূকাভিনয়-মহাযোদ্ধা পার্থপ্রতিম মজুমদার, কাজী মশহুরুল হুদা আর জিল্লুর রহমান জন-এর প্রবাস গমনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চা পরিচিত হলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ব্যবহারিক চর্চা নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কারণ তাঁরা প্রবাসী হওয়ায় বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চায় একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা এর ধারাবাহিকতাকে মধ্যখণ্ডিত করেছে। তাঁদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, প্রবাস গমণের কারণে তাঁদের যোগ্যতা সাপেক্ষে প্রত্যাশিত প্রাপ্তি থেকে স্বদেশ ভয়ানকভাবে বঞ্চিত হয়েছে।
গ. পর্যাপ্ত মূকাভিনয় সংগঠন গড়ে না ওঠা: বাংলাদেশে বর্তমানে হাজার খানেক নাট্যদল থাকলেও মূকাভিনয় সংগঠনের মোট সংখ্যা ছয়/সাতটির বেশি নয়। মূকাভিনয় যেহেতু ব্যাকরণসম্মতভাবে হাতে-কলমে শিক্ষণের বিষয় এবং মূকাভিনয় শিল্পীর একইসঙ্গে ‘অভিনেতা-নির্দেশক-নাটককার’ যোগ্যতার পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন কঠোর দৈহিক-মানসিক প্রস্তুতি ও অনুশীলন আবশ্যকীয়-সম্ভবত উল্লিখিত কারণেই মূকাভিনয় সম্পর্কিত ব্যবহারিকভাবে আগ্রহীর সংখ্যা অপ্রতুল।
ঘ. মূকাভিনয় প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠানের অভাব: বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক মূকাভিনয় প্রশিক্ষণের জন্যে কোনো নিয়মিত প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। একথা অনস্বীকার্য যে, প্রশিক্ষণ ব্যতীত মূকাভিনয়ে দক্ষতা অর্জন অসম্ভব, কিন্তু প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠানের অভাবে বাংলাদেশে মূকাভিনয়ে আগ্রহীর পক্ষে মূকাভিনয় বিষয়ক ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ শিল্পে নব নব প্রশিক্ষিত কর্মীর আগমন ঘটছে না।
ঙ. মূকাভিনয়ে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব: বাংলাদেশে অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রে কিছু পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও মূকাভিনয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পৃষ্ঠপোষকতা লক্ষ করা যায় না। অথচ পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে মূকাভিনয় উৎকর্ষের অন্যতম কারণ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং পাশাপাশি বেসরকারি গভীর শিল্পানুরাগ। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে মূকাভিনয় বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি আন্তরিক আগ্রহ ও মনোযোগ দুর্লভ। এমনকি দৈনিক পত্রিকায় সাপ্তাহিকভাবে বরাদ্দ থিয়েটার পাতায়ও মূকাভিনয় সম্পর্কিত সংবাদ বা লেখা প্রকাশে নিস্পৃহতা লক্ষণীয়।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ মূকাভিনয় শিল্পের প্রসারে নাট্যদলসমূহের মোর্চা সংগঠন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান বা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আইটিআই), বাংলাদেশ কেন্দ্র সম্ভাব্য সর্বরকম দায়িত্ব পালন করেছে এমন বলাও সম্ভব নয়।
চ. মূকাভিনয়ে মহিলা শিল্পীদের অনাগ্রহ: বাংলাদেশে মহিলা শিল্পীদের মূকাভিনয় বিষয়ে আগ্রহ অপ্রত্যাশিতভাবে স্বল্প। এভাবে এতদিনেও আদর্শ কোনো মহিলা মূকাভিনয় শিল্পী তৈরি না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও এ শিল্পে তেমন আগ্রহ সঞ্চারিত হয়নি।
ছ. নাট্যকর্মীদের মূকাভিনয় চর্চার গুরুত্ব অননুধাবন: বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা মূকাভিনয় চর্চার প্রকৃত গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি বিধায় মূকাভিনয়ে দক্ষতা অর্জন ব্যতীতই তাঁরা নাট্যকর্মে পূর্ণাঙ্গতা অর্জনে প্রত্যাশী, যা অসম্ভব। প্রসঙ্গত, মানববিজ্ঞানী Mehrabian ও Birdswhistell-এর গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তানুযায়ী বলা যায়- মানুষ প্রকৃতপক্ষে মুখনিঃসৃত কথার মাধ্যমে প্রকাশে সক্ষম ৭ থেকে ৩৫ ভাগ, আর বাকি ৬৫ থেকে ৯৩ ভাগ প্রকাশে নির্ভরশীল ‘অবাচনিক সূত্র’-এর ওপর। যার মধ্যে রয়েছে শরীরী ভাষা, অঙ্গভঙ্গি, অভিব্যক্তি, শিরভেদ, দৃষ্টিভেদ, গ্রীবাভেদ, ভ্রুভেদ, মুদ্রা (হস্তভঙ্গি), চারী (পদভঙ্গি), আচরণ, স্থান ব্যবহার, নীরবতা, ছন্দের অংশীদারিত্ব প্রভৃতি। সুতরাং অভিনয়ের ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তি’ থেকে ‘চরিত্র’-এ শারীরিক-মানসিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বাসযোগ্যভাবে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় মূকাভিনয় একান্তভাবে অপরিহার্য।
মূকাভিনয়ের জ্ঞান নাট্যপ্রযোজনায় কঙ্কালরূপ ‘পাণ্ডুলিপি’ থেকে জীবন্ত ‘থিয়েটার’-এ সৃজন যেমন স্বাচ্ছন্দময় করে তেমনি মূকাভিনয়ের প্রস্তুতিতে আবশ্যকীয় শারীরিক-আত্মিক বিনির্মাণের নিয়মিত প্রক্রিয়া নাট্যকর্মীকে উচ্চাঙ্গের সমৃদ্ধি প্রদান করতে পারে। পাশাপাশি মূকাভিনয় দক্ষতায় মঞ্চে আপাত-অসম্ভব দৃশ্য (যেমন: স্বপ্নদৃশ্য বা আকাশে উড়ে চলা কিংবা পানির ওপর দিয়ে সাঁতরানো ইত্যাদি) উপস্থাপনসহ মঞ্চসজ্জার বাহুল্য থেকে মুক্তিলাভ প্রভৃতি সহজসাধ্য হয়। বাঙলা নাট্যরীতির উপস্থাপন তথা বর্ণনাত্মক অভিনয়ের ক্ষেত্রেও মূকাভিনয় অত্যাবশ্যক। উপরন্তু, নাট্যে মূকাভিনয় ব্যবহারের মাধ্যমে প্রচলিত ক্লিশে নাট্য-উপস্থাপনার বিপরীতে নবনাট্যরসে পরিপূর্ণ এবং বাঙলার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপযোগী আকর্ষণীয় প্রযোজনা নির্মাণ সম্ভব।
জ. পারফর্মিং শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিল্পীদের মূকাভিনয় চর্চার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনে ব্যর্থতা: মূকাভিনয়ের ব্যবহারিক দক্ষতা নাট্যকর্মীর জন্যে যেমন অপরিহার্য তেমনি নৃত্য, মডেলিং, উপস্থাপনাসহ পারফর্মিং শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্রের চর্চাকারীদের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সমুন্নতি অর্জনের জন্যেই তা একান্তভাবে আবশ্যক। অথচ, এ বিষয়টি বাংলাদেশে সংশ্লিষ্টরা উপলব্ধি করতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মূকাভিনয়ে সঠিকমাত্রায় দখলের ঘাটতিতে পারফর্মিং শিল্পে আনন্দ, রাগ, ঘৃণা, উত্তেজনা, উল্লাস, ভয়, যন্ত্রণা প্রভৃতি প্রয়োজনীয় শারীরিক-মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সার্থকভাবে অভিব্যক্ত হয় না, ফলে শিল্পটিও সার্থকতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
ঝ. মূকাভিনেতার সামাজিক দায় অননুধাবন এবং মূকাভিনয়ে শৈল্পিকতা রক্ষার অসামর্থ্য: মূকাভিনয় একটি অসাধারণ ক্ষমতাধর শিল্প কিন্তু সঠিক শৈল্পিক চেতনার অভাব, অনায়াসলব্ধ সাফল্যের মোহ, নিছক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য এবং সামাজিক দায়হীনতায় বাংলাদেশে উপস্থাপিত মূকাভিনয়ে কিছু ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সস্তা হাস্যরস দৃষ্ট হয়, যা অনেক সময়ে ভাঁড়ামিতে পর্যবসিত হয়ে পড়ে। এভাবে ক্রমশ মূকাভিনয় উপস্থাপনা এবং এর বিষয়বস্তু তথা শিল্পটি সম্পর্কে সাধারণ্যে একটি হালকা ধারণা তৈরি হয়েছে। অথচ ইতিহাস থেকে এর বিপরীত তথ্য লভ্য। সেখানে দেশ-কাল-সমাজসচেতন শিল্পীদের দ্বারা শৈল্পিক উপস্থাপনার সমান্তরালে বৈপ্লবিক গণচেতনা জাগ্রতকরণেও মূকাভিনয়ের অনন্যসাধারণ ভূমিকার সুস্পষ্ট প্রমাণ লভ্য। যেমন: ফরাসি বিপ্লবের সময়ে জনগণের মুখের কথার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে মূকাভিনয় শিল্প দেশের বিক্ষোভকে জাগিয়ে তুলে বিপ্লবকে অবশ্যম্ভাবী সাফল্যের অভিমুখীকরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অনুরূপ পদক্ষেপ দৃষ্ট হয় আমেরিকার সুবিখ্যাত ‘সানফ্রান্সিসকো মাইম ট্রুপ’-এর প্রযোজনায়। যেখানে প্রধান বিষয়রূপে উপস্থাপিত হয়েছে- নাগরিক অধিকার, নারী স্বাধীনতা, যুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্য প্রভৃতি।
মূকাভিনয়গুরু মার্সেল মার্সো-র এতদ্বিষয়ক সিদ্ধান্তও এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। মার্সো কলকাতা সফরে এসে বলেছিলেন, “আজকের শিল্পক্ষেত্রে আমাদের দু’টি কর্তব্য আছে- ব্যাকরণসিদ্ধ রূপের দৃঢ় ভূমিতে দাঁড়ানো এবং আত্মিক জীবন ও কর্মময় জীবনের দৃঢ় মূল্যবোধের ভিত্তিতে কাজ করা। ...আমাদের শিল্পের মাধ্যমে সাধারণের কাছে চেতনা ও সন্দীপন পৌঁছে দিতে হবে। আমি জানি, এই ‘সন্দীপন’ কথাটা মাত্র একটা শব্দ; ‘চেতনা’ও একটি শব্দমাত্র। কিন্তু নিজের জীবন ও কর্মে চেতনা ও সন্দীপন কী করে আনতে হয় তা যদি আমরা বুঝতে পারি, তবে এদের গভীর মূল্য আমরা উপলব্ধি করতে পারব।”
প্রসঙ্গত, বর্তমান লেখকের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করা যায়। ‘শৌভিক মূকাভিনয় বিদ্যালয়’(২০০৬) প্রতিষ্ঠার পরে শিল্পগুরু সেলিম আল দীন-কে বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি প্রদর্শন করে তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি কেবল একটি বিষয়ের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন, তা হচ্ছে- ‘মূকাভিনেতার সামাজিক দায়বদ্ধতা’। দীর্ঘ আলোচনা শেষে তিনি আরো যুক্ত করেছিলেন,’ মূকাভিনয়ের ক্ষেত্রে এ বিষয়টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’।
ঞ. মূকাভিনয়ের প্রকৃত সমালোচকের অভাব: মূকাভিনয় কী বা কোনটি মূকাভিনয় পদবাচ্য নয় সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা তথা মূকাভিনয়ের ধারাবাহিকতা সম্পর্কিত স্বচ্ছ জ্ঞান না থাকায় বাংলাদেশে যথার্থ মূকাভিনয়-সমালোচকের অভাব প্রকট। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমালোচকেরা স্বীয় বিভ্রান্তির কারণে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে পাঠককেও বিভ্রমে ফেলেন এবং এরূপ সমালোচনা মূকাভিনয় শিল্পী বা শিল্পকে নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করতে ব্যর্থতো হয়ই এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়ায়। সম্ভবত, এ কারণেই প্রতিনিয়ত ‘নির্বাক অভিনয়’ (সংলাপ বর্জিত এবং বাস্তব উপকরণের উপস্থিতিতে সংঘটিত অভিনয়) এবং ‘মূকাভিনয়’ (সংলাপ বর্জিত এবং বাস্তব উপকরণ নয় বরং এর মায়া বা illusion সৃষ্টিসহ অভিনয়)-কে অভিন্ন মনে করার পাশাপাশি ‘নির্বাক প্রযোজনা’, ‘নকশা-মূকাভিনয়’ এবং ‘মাইমোড্রামা’-কে সমশিল্প বিবেচনা করে গুলিয়ে ফেলা হয়।
ট. মূকাভিনয় বিষয়ক গ্রন্থের অপ্রতুলতা এবং এ সংক্রান্ত নিয়মিত প্রকাশনা না থাকা: বাংলাদেশে বর্তমানে শিল্প-সংস্কৃতি বিষয়ক বেশ কিছু গ্রন্থ পাওয়া গেলেও এখানে মূকাভিনয় বিষয়ক গ্রন্থের একান্ত অভাব। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, বাংলা ভাষায় মূকাভিনয় বিষয়ক গ্রন্থের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৭/৮ টি এবং এর সবগুলো আবার সহজলভ্য নয়। এছাড়া, বাংলাদেশে মূকাভিনয় বিষয়ক কোনো নিয়মিত প্রকাশনা নেই এবং পত্র-পত্রিকায়ও নিয়মিতভাবে মূকাভিনয় বিষয়ক কোনো লেখালেখি দৃষ্ট হয় না। ফলে মূকাভিনয় বিষয়ে আগ্রহীর তৃষ্ণা নিবারণের সুযোগ ভীষণভাবে কম এবং ধারাবাহিকভাবে নতুন আগ্রহী তৈরি হচ্ছে না।
ঠ. মূকাভিনয় বিষয়ক গবেষণার উদ্যোগহীনতা: বাংলাদেশের মূকাভিনয় উপস্থাপনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিষয়বস্তু বা আঙ্গিকে পূর্বসুরিদের প্রায় হুবহু অনুকরণ লক্ষ করা যায়। ফলে তা সৃষ্টিশীল নয় বরং হয়ে উঠেছে বৃত্তাবদ্ধ। অন্যদিকে, বিশ্বমূকাভিনয়ের প্রেক্ষাপট মস্তিস্কে ধারণ করে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা তথা গবেষণার মাধ্যমে সমুন্নত বিষয়বস্তু এবং নবতর মূকাভিনয় আঙ্গিক নির্মাণের দুর্নিবার আগ্রহ লক্ষ করা যায় না। এককথায় বলা যায়, গবেষণার অবারিত সুযোগ বিদ্যমান সত্ত্বেও বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চা একটি অত্যন্ত অবহেলিত ক্ষেত্র।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চা বাস্তবিকই নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত এবং তৎকারণে বাংলাদেশের মূকাভিনয়ের যথাযথ বিকাশ ও প্রসার হয়েছে সুদূরপরাহত। প্রকৃতপক্ষে, বর্ণিত সমস্যাসমূহের পাশাপাশি বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চায় রয়েছে উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনারও ইঙ্গিত:
প্রথমত, পূর্বোল্লিখিত বাঙলার চিরায়ত লোক-ঐতিহ্য, বুদ্ধনাটক ও গ্রন্থিক-শৌভিকের ধারাবাহিকতায় বাঙলা অঞ্চলের নিজস্ব মূকাভিনয় শিল্প নির্মাণের সুবর্ণ সম্ভাবনা মূকাভিনয়ে আগ্রহীমাত্রেই আশান্বিত করে। এ ক্ষেত্রে উপনিবেশ-উত্তর গভীর ঐতিহ্যানুরাগ এবং আধুনিক শিল্পসচেতনতাসহ অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। ভরত-এর ‘নাট্যশাস্ত্র’, নন্দিকেশ্বর-এর ‘অভিনয় দর্পণ’ প্রভৃতি প্রাচ্যশাস্ত্রে বর্ণিত ভাব, রস, মুদ্রা, চারী, দৃষ্টিভেদ, শিরভেদ, গ্রীবাভেদ, ভ্রুভেদ তথা প্রাচ্য আঙ্গিক-উপকরণসমূহ প্রভৃতির সুচিন্তিত সংশ্লেষের মাধ্যমে গবেষণা-পদ্ধতিতে বাঙলার নিজস্ব ও স্বতন্ত্র মূকাভিনয়-আঙ্গিক নির্মাণ করা সম্ভব, যে সম্ভাবনা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের জন্যে হয়তো বিরল।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চায় অতি-সম্প্রতি নতুন গতি লক্ষণীয়। ‘প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট’, ‘নাটুয়া’ প্রভৃতি যথাক্রমে চৌদ্দ ও নয় বছরব্যাপী একান্তভাবে মূকাভিনয় চর্চাকারী দলের পাশপাশি রাজধানীতে ‘পদাতিক নাট্য সংসদ’ বা ‘স্বপ্নদল’ প্রভৃতি সংগঠনের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা এ সত্য প্রমাণ করে।
তৃতীয়ত, পার্থপ্রতিম মজুমদার, কাজী মশহুরুল হুদা এবং জিল্লুর রহমান জন-বাংলাদেশের মূকাভিনয়ের এ তিন প্রধান পুরোধার প্রবাসের কারণে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে তাঁদের সৃষ্টিশীলতা থেকে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে, তাঁরা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মূকাভিনয়ের পরিচিতি এবং একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরবর্তী প্রজন্মের মূকাভিনয় শিল্পীদের জন্যে এ প্রেক্ষাপটটি অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে।
চতুর্থত, সাম্প্রতিককালের নাট্যকর্মশালাসমূহে ‘মূকাভিনয়’ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে মূকাভিনয় বিষয়ক সচেতনতা থেকেই উল্লিখিত পদক্ষেপ এবং এতে মূকাভিনয়ের প্রতি নাট্যকর্মীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পঞ্চমত, অধুনা মূকাভিনয় বিষয়ে কিছু কিছু লেখালেখি দৃষ্ট হচ্ছে। উপরন্তু, পত্রিকার বিনোদন পাতারও মূকাভিনয় বিষয়ক আগ্রহ পূর্বাপেক্ষা কিঞ্চিদধিক হলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ষষ্ঠত, মূকাভিনয় বিষয়ে দর্শকের আগ্রহ ও অনুরাগ সাম্প্রতিক অতীতের সাপেক্ষে অনেকখানি উন্নত হয়েছে এবং তা ক্রমবর্ধমান। রাজধানীতে ‘স্বপ্নদল’-এর মাইমোড্রামা ‘জাদুর প্রদীপ’-এর নিয়মিত প্রদর্শনীতে দর্শকের ব্যগ্রতা এবং প্রদর্শনী-অন্তে তাঁদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ দর্শনে বর্তমান লেখকের এ বিশ্বাস জন্মেছে।
সপ্তমত, ‘প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট’ আয়োজিত ‘মূকাভিনয় চর্চার আন্তর্জাতিকতা’ শীর্ষক ‘প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট জাতীয় মূকাভিনয় উৎসব, ২০০৯’ এবং এর অংশ হিসেবে সেমিনারের আয়োজন নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সম্ভাবনার দিক। এ উৎসবের মাধ্যমে রাজধানী-রাজধানীর বাইরের মূকাভিনয় চর্চাকারীরা পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে যেমন নিজেদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ পাবেন তেমনি সেমিনারের আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে মূকাভিনয় বিষয়ে অনেক অস্পষ্টতা দূরীভূত এবং নবচিন্তা জাগ্রত হবে বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি এ আয়োজন নতুন প্রজন্মের মধ্যে মূকাভিনয় বিষয়ে আগ্রহীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর সবকিছু মিলে নতুন সম্ভাবনার অভিমুখে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চা, এমন প্রত্যাশা হয়তো অমূলক নয়।
আলোচনা থেকে সম্ভবত উপলব্ধিকরণ সম্ভব হয়েছে যে, বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চা বর্তমানে অনেক সমস্যাসঙ্কুল পথ অতিক্রম করলেও প্রকৃতপক্ষে এসব সমস্যার অভ্যন্তরেই রয়েছে সমাধানের বীজমন্ত্র এবং সে পদক্ষেপের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব অভীপ্সিত সাফল্য। বর্তমান আলোচনা যেহেতু বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চার সমস্যা এবং সম্ভাবনা নির্দিষ্টকরণে, সুতরাং এ উদ্যোগই প্রমাণ করে যে, মূকাভিনয়-সংশ্লিষ্টরা উল্লিখিত সমস্যা সম্পর্কিত সচেতনতার মাধ্যমে নেতিবাচক-বাস্তবতা থেকে ইতিবাচক উত্তরণে অভিলাষী। মূকাভিনয়ের প্রতি প্রকৃত অনুরাগ, ঐতিহ্য ও ঔচিত্যবোধ, স্বসংস্কৃতি-দেশ-কালের প্রতি দায়বদ্ধতা, আধুনিক শিল্পচেতনা আর গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যদি সৃষ্ট-আগ্রহকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় তবেই বাংলাদেশের মূকাভিনয় শিল্প প্রত্যাশিত সম্মুখপানে নবগতিতে অগ্রগামী হবে, যে ধারাবাহিকতা থেকে পুনর্বার ঘটবে না কোনো বিচ্যুতি। সর্বশেষে, সফোক্লেসের চিরায়ত ‘অয়দিপৌস’ নাটকের একটি সংলাপের মূলকথা উল্লেখ করে এ আলোচনা সমাপ্ত করা যায়, যেখানে উক্ত হয়েছে - যদি দুঃখের অন্তর্নিহিত কারণটাকে অন্বেষণ করে তাকে উন্মুল করা যায়, তবে সেই দুঃখের মধ্য দিয়েই প্রকৃতপক্ষে মঙ্গলের আশীর্বাদ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চার ক্ষেত্রে তাই দুঃখবোধ নয় বরং মঙ্গলময়তার সুনিশ্চিত পথযাত্রাই প্রত্যাশিত হোক।
(‘প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট জাতীয় মূকাভিনয় উৎসব, ২০০৯’ উপলক্ষে ২১.০৩.২০০৯ খ্রি: তারিখে আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে পঠিত)
জাহিদ রিপন ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ) : নির্দেশক, গবেষক, নাট্য ও মূকাভিনয় প্রশিক্ষক। স্বপ্নদল, ঢাকা-এর প্রধান সম্পাদক।