Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

এপিকের সারকথা

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

বের্টোলট্ ব্রেখ্ট বিশ্বের নাট্যজগতে কিংবদন্তী, কিন্তু কলকাতায় এক কুসংস্কার। তাঁকে নিয়ে যে টানা হ্যাঁচড়া চলছে সে আর কহতব্য নয়। বিষ্যুৎবারের বারবেলার মতন তাঁকে টেনে আনা হয় যে কোনো নাট্যব্যর্থতার কৈফিয়ৎ হিশেবে। ধান ভানতে শিবের গীত এ-শহরে আছেন হতভাগ্য বে-বে [ব্রেখ্ট্ নিজেকে ‘ডের আর্মে বে-বে’ নাম দিয়েছিলেন বোধহয় কলকাতার কথা ভেবেই]।

কলকাতার বিখ্যাত দৈনিক ও সাপ্তাহিকগুলিতে একদল লোক নিজেদের ‘নাট্যসমালোচক’ আখ্যা দিয়ে চলতি নাটকের সমালোচনা লেখেন। এঁদের অধিকাংশের মূর্খতা এব সর্বজনবিদিত প্রবাদবাক্য। সেই মূর্খতার একটি উৎকট প্রকাশ ব্রেখ্ট্ এর নামকে আশ্রয় করে। প্রযোজনায় নূতন কিছুর আঁচ পেলেই তাঁরা ‘ব্রেখ্টীয়রীতি’ আবিষ্কার করেন। অভিনেতারা যদি প্রেক্ষাগৃহ থেকে মঞ্চে ওঠেন, তবে অনিবার্যভাবে ওই সদ্যসাক্ষর ক্রিটিকরা লিখবেন, ‘নাটকে কিছু ব্রেখ্টীয় পদ্ধতি লক্ষ্য করা গেল’। কস্মিনকালে ব্রেখ্ট্ মঞ্চ ছেড়ে প্রেক্ষাগৃহে যাননি। সেটা এডমন্ড জোনস্ করতেন তিরিশের দশকে আর মস্কোয় অখ্লপ্কভ ষাটের দশকে। এমনকি অভিনেতারা যদি নিজেরাই আসবাব মঞ্চে বয়ে আনেন [যেমন কোনো নাটকে ঘটেছিল] শুক্রবারের এক সাপ্তাহিক অবলীলাক্রমে লিখতে পারেন, ‘ব্রেখ্টীয়রীতিতে অভিনেতারা নিজেরাই মঞ্চ সাজাচ্ছিলেন’। এই সকল গণ্ডমূর্খরা ছাপাখানা হাতে পেয়ে যা খুশি ছাই-ভস্ম লিখে ব্যাপারটা গুলিয়ে দিচ্ছে। কোনটা যে ব্রেখ্টীয় আর কোনটা যে নয়, ব্রেখ্টীয়রীতিটা আদতে কী- এইসব বিষয় ক্রমশ এক গ্রাম্য ধাঁধার আকার নিয়েছে।

নাট্যদলগুলির মধ্যে স্বভাবতই ব্রেখ্ট্-সম্পর্কে কৌতূহল ও আগ্রহ দেখা দিল। কিন্তু ওই রীতিরহস্যের ধোঁয়াশায় পথ হারিয়ে প্রায় সবাই ঘুরপাক খেয়েছেন। জর্মন ভাষা না জানায় দ্বারস্থ হয়েছেন উইলেট নামক ধূর্ত কমিউনিস্ট বিরোধীর বা উলটেছেন মার্টিন এসলিনের স্বৈরাচারী রায় সম্বলিত গ্রন্থখানার পাতা। ওইসব বই-এ ব্রেখ্টীয়রীতির সহজিয়া ভাবকে কুস্তি করে দুর্বোধ্য করে তোলা হয়েছে। ফলে কিছুই বুঝতে না পেরে মনগড়া সব প্যাঁচকে ব্রেখ্টীয় বলে চালিয়েছেন কিছু দল। একজন তথাকথিত পরিচালক ব্রেখ্ট্ সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়ার লোভ কোনোদিনই সংবরণ করতে পারলেন না, এবং এ-জ্ঞান কোনোদিনই একটি বিচিত্র বাক্যের বেশি কিছু হলো না: শিশির ভাদুড়ি মহাশয় নাকি ব্রেখ্ট্ পড়ে ওই জ্ঞানবান পরিচালককে বলেছিলেন, ‘দেখিস তো আমাদের যাত্রার সঙ্গে এর মিল আছে কিনা’। এতে আমাদের জ্ঞান কতটা বৃদ্ধি পেল জানি না, ভাদুড়ি মহাশয় একথা বলতে পারেন বলে প্রত্যয় হয় না, কারণ যাত্রাপালার অতি-নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে ব্রেখ্ট্-এর কোনো মিল নেই, থাকতে পারে না।

উইলেটের বই পড়েই ব্রেখ্টকে বুঝে ফেলেছি ভাবলে এই বিশ্বাস করতে হয় যে প্রথম মহাযুদ্ধের পরে বার্লিনের ক্রুদ্ধ, বিয়ার ভক্ত, বকসিং অনুরক্ত একদল বুদ্ধিজীবীর পানশালার আড্ডা থেকে ব্রেখটের উদ্ভব, আর কোনো পরিবেশ বা উপাদান অন্বেষণ প্রয়োজন নেই। ব্রেখ্ট্ যে বন্দুক হাতে বাভারিয়ান বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন বা সমান্তরাল বাভারিয়া সোভিয়েত সরকারের সদস্য ছিলেন, এসব বিচার করারও দরকার নেই। উইলেটের শোচনীয় প্রভাবের একটি বিশ্রী নিদর্শন দেখেছি দিল্লিতে জাতীয় নাট্যবিদ্যালয়ে; ইব্রাহিম আলকাজি একটি স্লাইডসহ বক্তৃতায় ছাত্রদের ঠিক উইলেটের কথা কটিই উপহার দিলেন- ব্রেখ্টকে বুঝতে হলে যেতে হবে সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন বিয়ার হলে।

নান্দীকার দলের ব্রেখ্ট্ প্রযোজনায় আন্তরিকতা যতটা ছিল, রীতিতত্বের অজ্ঞতাও ততোধিক। নইলে তিন পয়সার পালায় অত শস্তা খ্যামটা ঢোকাতে তাঁরা ইতস্তত করতেন। আর সবাইকে স্তম্ভিত করে অকস্মাৎ ১৮৭৬- এর কলকাতায় ইতশ্চেতঃ ‘বুর্জোয়া’ শব্দের ব্যবহার তাঁরা করতে পারতেন না। রুদ্র প্রসাদবাবু এতদূর গেলেন যে একটি সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলে বসলেন, ব্রেখ্টকে তাঁরা সংশোধন করে নিয়েছেন- ব্রেখ্ট্ যেখানে ব্যাংক মালিকের উল্লেখ করেছিলেন, সেখানে ‘নান্দীকার’ ‘কারখানা মালিক’ কথা ব্যবহার করে ব্রেখ্টকে আরো বিপ্লবী করে তুলেছেন! যাঁরা এই সামান্য কথাটা জানেন না যে বিশ শতকেও ভারতে বুর্জোয়া কতটা বেড়েছে সেটা বিচার সাপেক্ষ, যাঁরা জানেন না ব্যাংক মালিকের হাতেই অন্য সব মালিকের টিকি বাঁধা থাকে, তাঁদের হাতে ব্রেখ্ট্ মোটেই নিরাপদ নয়। ব্রেখ্টকে বাঙালি পরিবেশে রূপান্তরিত করা অবশ্যই চলবে, তাই বলে তাঁকে হত্যা করে নয়। দস্যু ম্যাকিকে যাঁরা নাটকের রোমান্টিক নায়ক সাজান, তাকে দিয়ে অনর্গল কবিতা বলান, বা তাকে রাধাকৃষ্ণের রাসনৃত্যে অংগ্রহণ করান, ব্রেখ্ট্-এর ম্যাকিকে কে এবং কি তাঁদের মস্তিষ্কে ঢোকেনি। সর্বপরি ব্রেখ্ট্ ও অন্যান্য বহু আধুনিক নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁরা বোঝেননি- নেগেটিভ নায়কের লোমহর্ষক জীবনবিরোধী মতামত কেন মঞ্চে আসছে তাই তাঁরা বুঝতে অসমর্থ। সুতরাং ম্যাকিকে ন্যাকা ন্যাকা প্রেমিক বানিয়ে তাঁরা বাঙালি মধ্যবিত্তের বরণীয় করে তুলেছেন। রূপান্তর অবশ্য মানবো, কিন্তু আত্মহত্যাকামী নীল আকাশের প্রতিবেশী বিমান চালককে ট্যাক্সি ড্রাইভার বানিয়ে কাব্যের বারটা বাজালে সহ্য করা শক্ত (ভালোমানুষ পালার কথা বলছি)।

আসলে ব্রেখ্ট্ যিনি প্রযোজনা করবেন তাঁকে আগে মার্কসবাদ-লেলিনবাদে দীক্ষিত ও রপ্ত হতে হবে। ব্রেখ্ট্ নিজেই শুধু মার্কসবাদী নন, তাঁর মতে (অমার্কিন কার্যকলাপ কমিটির সামনে সাক্ষ্য দেখুন) মার্কসবাদী না হলে আজকে আর নাট্যকারই হওয়া যায় না। তিনি আরো বলেন, শ্রেণী সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশ না নিলে অভিনেতা হওয়া যায় না (‘শর্ট অরগানুম’ দেখুন)। ফর্ম ফর্ম চিৎকারে ব্রেখ্টকে ধাওয়া করলে আদপেই সে ফর্ম করায়ত্ব হবে না কারোর। ব্রেখ্ট্ একজন বিপ্লবী নাট্যকার। তিনি নিরপেক্ষ নন, প্রতি মুহূর্তে তিনি শ্রেণী সংগ্রামের ব্যাখ্যাতা ও প্রচারক। আঠারো শতকের ইংল্যান্ডে (থ্রি পেনি অপেরার মূল কাহিনী হচ্ছে ইংরাজি নাটক বেগার্স অপেরা) গিয়ে তিনি বুর্জোয়া শ্রমিকের সংঘর্ষ খোঁজেন না। মার্কসবাদী খোঁজেন তৎকালীন শ্রেণী সংঘর্ষ। গালিলেও নাটকে উদীয়মান প্রগতিশীল বুর্জোয়া শ্রেণী ও তাদের জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রদূত এক বৈজ্ঞানিক হচ্ছেন নায়ক। কিন্তু মাদার কারেজ নাটকে তিনি নির্বোধের মতন বুর্জোয়া আবিষ্কার করেন না; সেটা ফিউদাল যুগ, বুর্জোয়া তখনো সংঘটিত হয়নি। মার্কসবাদের জ্ঞান ব্যতীত শ্রেণী বিশ্লেষণই করা যায় না, আর শ্রেণী বিশ্লেষণ করতে না পারলে ব্রেখ্ট্ প্রযোজনা নির্বোধের দুঃসাহস।

ফর্ম শূন্য থেকে মাদারি কা খেল মারফৎ ব্রেখ্ট্ -এর ঘারে গিয়ে ভর করেনি। ফর্মের উদ্ভব বিষয়বস্তু থেকে, নাট্যকারের চিন্তাকে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকে। ব্রেখ্ট্-এর নানা নাটকে নানা ফর্ম ব্যবহৃত, সর্বত্র একই এলিয়েনেশন বা একই এপিক পদ্ধতি তিনি ব্যবহার করেননি। এমন নাটকও তিনি লিখে মঞ্চস্থ করেছেন যেখানে তিনি হুবহু স্তানিস্লাভস্কি পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন (সেনোরা কারার প্রযোজনা একটি উদাহরণ)। ফর্মের খোঁজে ব্রেখ্ট্ পিকিং অপেরার কাছে গেছেন, কাবুকী বুঝতে চেয়েছেন, প্রাচীন সংস্কৃত নাটক পড়েছেন, মার্কস অধ্যয়ন করেছেন। তাঁর কাছে ফর্ম কোনোদিনই অনড় কোনো ফর্মূলা নয়। যেভাবে হোক সাত সমুদ্দুরের নানা পাড় থেকে যেকোনো রং জোগাড় করে হোক, বিষয়বস্তুটাকে পৌঁছে দিতে হবে দর্ককের মগজে, মিশিয়ে দিতে হবে দর্শকের চিন্তাধারায়। আর হঠাৎ ফর্ম ফর্ম রব উঠলো কেন? উত্তরের জন্য যেতে হবে সেই উইলেট -এসলিন- বেন্টলি- ভেসিদের জটলায়। এঁরাই হঠাৎ ব্রেখ্ট্-এর আঙ্গিক নিয়ে তোলপাড় করতে লাগলেন ইউরোপ আমেরিকার ঘোলা জল, পাছে কমিউনিস্ট ব্রেখ্টকে লোকে জেনে ফেলে। প্রথম অনুবাদগুলোর কথা ভাবুন-থ্রিপেনি, কারেজ, গালিলেও, চক সার্কল। অন্তত দুশ বছর আগের ঘটনা নিয়ে লেখা হওয়া চাই, যাতে প্যারি কমিউনের লাল ঝান্ডা নিয়ে শেষ যুদ্ধ, অথবা রুশ বিপ্লবের কাহিনীগুলির মারফৎ বিপ্লবী ব্রেখ্ট্ মঞ্চে আবির্ভূত না হয়ে পড়েন। ‘ব্রেখ্টীয় পদ্ধতি’ নিয়ে অসাধু এই চিৎকার শুনলে মাঝে মাঝে তো মনে হয় হিটলার ব্রেখ্টকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন তাঁর এপিক পদ্ধতির জন্য, অথবা অভিনেতাদের এলিয়েনেশন শেখাবার অপরাধে। এরিক বেন্টলি সাহেবের তো এতবড় হিম্মৎ যে মাদার কারেজ অনুবাদ করতে বসে তিনি কিছু কথা বাহুল্য জ্ঞানে বাদ দিয়েছেন!

ব্রেখ্ট্ যে বিপ্লবের চারণ কবি- এটাই প্রধান কথা, মূল কথা। তাঁর যুগের কোনো বিপ্লবী তাঁর চোখ এড়ায়নি। প্যারি কমিউন (ডি টাগে) থেকে শুরু করে ১৯০৫ সালের রূশ বিপ্লব (মা), স্পেনে গৃহযুদ্ধ (কারার), হিটলারের অভ্যুত্থান (উই), চিনের বিপ্লব (সমাধান), ফ্রান্সের নাৎসি বিরোধী পার্টিজান যুদ্ধ (সিমোন মাশার), স্তালিনের বিপুল কর্মযজ্ঞ (চক সার্কলের প্রস্তাবনা লুকুলুস) একের পর এক সব এসেছে নাটকের পটভূমিকা হিশেবে। ছুরির মতন তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টি চলে গেছে পুঁজিবাদের সারাৎসারে (হাইলিগে য়োহানা) এবং ধর্মপ্রাণ অহিংসাবাদীদের শোচনীয় ব্যর্থতায়। নাটকের পর নাটকের তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের সরব প্রচারক, অস্ত্রের উপাসক। প্যারি কমিউনের শেষ অধিবেশণে যখন উদার হৃদয় শ্রমিক নেতৃবৃন্দ বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন তখন মার্কসবাদী রিগোলত্ চেঁচিয়ে বলেন, ‘উন্টেরড্র্যুক্ট ওডের ভেরডেট্ উন্টেরড্র্যুক্ট’- ‘দমন কর নয়ত দমিত হবে’- মাঝে অন্য পথ নেই। এটাই ব্রেখটের প্রধান পরিচয়- তিনি বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র বিপ্লবের এক যোদ্ধা।

তাঁর যেসব নাটকে বিপ্লবের প্রত্যক্ষ চিত্র নেই, সেখানেও প্রতি মুহূর্তে মানুষের নানা বৃত্তিকে পরীক্ষা করা হচ্ছে শ্রেণীর ভিত্তিতে, শোষণভিত্তিক সমাজব্যবস্থার পটভূমিকায়। বোধকরি সবচেয়ে বেশি যে বৃত্তিকে ব্রেখ্ট্ বিশ্লেষণ করেছেন, তা হচ্ছে লোভ, মুনাফাগৃধুতা। কিন্তু কখনোই তা সমাজবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত কোনো ‘সহজাত’ লোলুপতা নয়, ব্যক্তির উৎকেন্দ্রীকতা নয়, কখনোই তাঁর চরিত্ররা কাম্যুর বহিরাগত মানুষ নয়। মাদার কুজের মুনাফালোভ হচ্ছে শাসকশ্রেণীর লুন্ঠনবৃত্তির অনুকরণ মাত্র; শাসকরা শতবর্ষ ধরে যুদ্ধ জিইয়ে রেখেছে মুনাফার জন্য; আর সর্বহারা কুরাজের এত বড় স্পর্ধা সে তাদের আদর্শে নিজেকে দীক্ষিত করতে গেছে, নিজ শ্রেণী ছেড়ে মুনাফাখোর শ্রেণীতে উঠতে গেছে! তাই ইতিহাস তাকে বোকা বানিয়ে দিয়ে চলে যায়। তুলনা করুন বুর্জোয়া লোভের হিংস্র প্রতিনিধি পিয়ারপন্ট মলার, হাইলিগে য়োহানা নাটকে। তাঁর হঠাৎ জাগ্রত জীবে দয়া, গোরুদের প্রতি মমত্ব, আসলে শিকাগোর মাংসের বাজার করায়ত্ব করার কৌশল। য়োনার দয়াধর্মে তাঁর যে আসক্তি সেটা শুধু শ্রমিকদের প্রতারিত করার জন্য। জমাট বাঁধা লোভের প্রতিমূর্তি পুঁজিপতি মলার - সুসংবদ্ধ আপোশহীন শোষণের মার্কিন বিশেষজ্ঞ। ভালোমানুষ পালায় ছোটোখাটো মানুষদের ক্ষুদ্রাতীত এলোমেলো লোভের উন্মেষ - সেও শোষিত ঔপনিবেশিক সমাজের ফল।

ব্রেখ্ট্ বোধকরি একমাত্র আধুনিক নাট্যকার যিনি নারী-পুরুষ সম্পর্ক চিত্রায়ণে ‘বিশুদ্ধ প্রেম’, ‘নিষ্পাপ আবেগ’ আর ‘নিঃস্বার্থ আত্মোৎসর্গ’ প্রভৃতি মিথ্যাকে কোনো আমল দিতেই  রাজি হননি। মার্কসবাদী ব্রেখ্ট্ জানেন, শোষিত সমাজে প্রেম কলঙ্কিত, বিকৃত, কদর্য হতে বাধ্য। ব্রেখ্ট্ জানেন, ফিউদাল সমাজে প্রেম হচ্ছে ধর্ষণের নামান্তর এবং বুর্জোয়া সমাজে প্রেম হলো লেনদেনের একটা হিশেবি সম্পর্ক। ব্রেখ্টকে ভাঁওতা দেওয়া যায় না। এসমাজে মানুষ তার সব সুকুমার বৃত্তি থেকে বিয়োজিত হয়ে গেছে, তার ভালোবাসা- স্নেহ-মমতা-শ্রদ্ধা যে টাকার ক্লেদাক্ত স্পর্শে কলুষিত হয়ে গেছে, এটাই বারবার ব্রেখটের সৃষ্টিতে ঘোষিত, প্রদর্শিত, বিশ্লেষিত। প্রেম নামক কোনো এক আদিম স্মৃতি হঠাৎ হয়তো ছুঁয়ে যায় মাদার কারেজের পাচক চরিত্রকে। তুষারাবৃত প্রান্তরে কুরাজ নামক এক ভীষণদর্শনা প্রৌঢ়ার সঙ্গে অন্বেষণে বেরিয়ে, এক সৃষ্টিছাড়া খেয়াল সে দেখে কয়েক মুহূর্ত। সে গান গেয়ে অভিযোগ জানায়- ‘জো ইস্ট ডী ভেল্ট উন্ড মুস্ নিশ্ট্ জো জাইন’- এইতো ভবের বাজার বানিয়েছ তোমরা, কিন্তু এরকম হওয়া উচিত নয়। জীবনক্লান্ত পাচক প্রেমের অংকুরটিকে আর আঁকড়ে থাকতে পারে না। যে কুরাজ আর দুদিন বাদেই দেউলে হতে পারেন তাঁর সঙ্গে নিজেকে জড়ানো কাজের কথা নয়- সমাজ পাচককে এই শিখিয়েছে। সুতরাং পলায়ন এবং অপেক্ষাকৃত সচ্ছল কোনো বৃদ্ধার খোঁজে যাত্রা। ম্যাকি নামক দস্যুর কাছে নারী হচ্ছে নিজের পৌরুষ জাহির করার মাধ্যম, আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠার সোপান। ম্যাকির চোখ মাস্তানের চোখ। নারী তার কাছে ব্যবহার্য মাংসপিন্ড (অন্য কোনো ব্যাখ্যা হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি করে মঞ্চে)। আর্টুরো উই প্রেম নিবেদন করে কুটনীতির প্রয়োজনে। হিটলারী শাসনে স্তব্ধ জর্মনিতে স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের সম্পর্ক পরিনত হয় পারস্পরিক সন্দেহ ও ত্রাসে (‘ফুর্শ ট্ উন্ড এলেন্ড ডেস ড্রিটেন রাইখ্স্’)। অধিকাংশ নাটকে ব্রেখ্ট্ প্রেমিক- প্রেমিকা নামক মিথ্যাবাদীদের সযত্নে পরিহার করেই চলেছেন, কারণ তিনি স্থিরনিশ্চয় যে বিপ্লবের পূর্বে প্রেম পূর্র্ণ রূপ পেতে পারে না, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রেম এক ধাপ্পা।

শুধুমাত্র শ্রেণীযুদ্ধের ব্যারিকেডে বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল রেখে যখন সহযোদ্ধা নারী ও পুরুষ পরস্পরের দিকে তাকায়, তখন ব্রেখ্ট্ তাদের মধ্যে দেখেন মৃত্যুঞ্জয় প্রেম, কেননা তখন সে প্রেম নূতন সমাজের গর্ভসঞ্চার, সে প্রেম শৃঙ্খলিত প্রেমকে মুক্ত করার প্রেম। তাই ডী টাগে ডের কম্যুনে নাটকে দেখি প্রবল যুদ্ধের মাঝে, আসন্ন ও অনিবার্য মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে জ্যঁ ও বাবেৎ, জেনেভীভ ও ফ্রাঁসোয়া পরস্পরকে প্রকৃত ভালোবাসার অভিবাদন জানায়, এবং পরমুহূর্তে গুলি চালায় অগ্রসরমান সরকারি ফৌজের পরে। তাদের মাথার উপর উড়ছে গুলিবিদ্ধ দগ্ধ বিবর্ণ একটি লাল নিশান (মধ্যবিত্তমনা পরিচালকদের জানাই, জ্যঁ ও বাবেতের তীব্র ও বলিষ্ঠ যৌন সম্ভাষণ আপনারা সইতে পারবেন না, তবে প্রথমত তারা পারিসের মজদুর, বালিগঞ্জি আলাপন তাদের আসে না, আর দ্বিতীয়ত তাদের দেহজ ভালোবাসাটা নূতনের জন্মদাতা, তাই সদর্থক)। সেইরকম মহত্বে উন্নীত ভালোবাসা সিমোন মাশার। ফ্রান্সের এই কৃষকতনয়া তার সব প্রেম সার্থক, এক লহমায় সে জোন অব আর্কের ভূমিকায় উন্নীত। মোটমাট দেখা যাচ্ছে বেন্টলি-উইলেট থেকে শুরু করে কলকাতার কিছু নাট্যকর্মী পর্যন্ত যে ভাবছেন ব্রেখ্ট্-এর প্রত্যক্ষ বিপ্লব প্রচারক নাটকগুলো চেপে গিয়ে ‘কম বিপজ্জনক’ ‘সামাজিক’ নাটক নিয়ে পড়ে থাকি, তাঁরা খরগোসের মতো চোখ বুঁজে আছেন। শ্রেণীচেতনা ও বিপ্লবচেতনা অখন্ড এক বিশ্ববিক্ষা, মার্কসবাদ একটি আস্ত ভেল্টানশাউং। সমাজ, প্রেম, বিবাহ, অপত্যস্নেহ, মাতৃভক্তি, ধর্ম, আইন, সাহিত্য, চিন্তার প্রতি আনাচে কানাচে বিস্তৃত ব্রেখটের শ্রেণীচেতনা। সব পথ বেঁধে দিয়েছেন ব্রেখ্ট, ভিতুরা পালাবেন কোন গলি দিয়ে? বন্ধনহীন গ্রন্থী সর্বত্র।

মার্কসবাদী বিপ্লবী ব্রেখ্টকে স্বীকার করে নিলে তবে আসে ফর্মের কথা, রূপরীতির কথা, প্রযোজনা তত্ত্বের কথা। বিপ্লবী নাট্যকারের মতামত আগে স্বীকার না করলে তাঁর নাটক প্রযোজনা করা যায় বলে আমি মনে করি না। বিপ্লবী নাটক আর পাঁচটা বিশুদ্ধ আনন্দের নাটক নয়, এখানে নাট্যকার ও পরিচালকের রাজনীতির ঐক্যের প্রয়োজন।

সমদৃষ্টি ব্যতীত এস্থলে সর্বনাশ অনিবার্য, কেননা এসব নাটকে রাজনীতিটাই প্রধান। ইওনেস্কোর মতন ব্যর্থ নাট্যকার কাগজে-কলমে লেখার স্পর্ধা রাখেন, ব্রেখ্ট্ একটা বয়স্কাউট মাত্র। ইওনেস্কোর নাট্যশালায় কোনোদিন লোক আসেনি, বুর্জোয়ার রাজনৈতিক প্রয়োজনে তাঁকে নানা প্রচারের ঠেকনো দিয়ে দাঁড় করাবার চেষ্টা হয়েছিল মাত্র। বর্তমানে ঠেকনো ও কিমিতিবাদ সমেত ইওনেস্কোরা ধরাশায়ী। কিন্তু বয়স্কাউট ব্রেখ্ট্-এর প্রভাবে পশ্চিম ইয়োরোপে এসেছে আঙ্গিক-বিপ্লব, শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীল স্ট্র্যাটফোর্ড নাট্যশালাতেও- মঞ্চস্থাপত্যে, অভিনয়রীতিতে, এমনকী পরিচ্ছদ পরিকল্পনায়। ইয়োরোপের অনুকরণেই ভারতের চিন্তাবিদরা ভাবেন, লন্ডনে বৃষ্টি হলে এখানে ছাতা খোলেন; কিন্তু ঔপনিবেশিক এই সুদূর কোণে সংবাদ পৌঁছুতে বড় দেরি হয়। ওখানে বর্ষা কেটে রোদ উঠলেও এখানে অনেকের ছাতা খোলা থাকে। তাই ওখানে ইওনেস্কো-পিন্টার কোম্পানির শৈল্পিক বিপর্যয়ের বহু পরেও কলকাতায় কিমিতিবাদ কিছুদিন সফরীর ন্যায় ফড়ফড় করেছে দশ বছর আগের ইয়োরোপের খবর এখন পৌঁছুচ্ছে- প্রায় সব উদীয়মান ইউরোপীয় পরিচালকই এখন ঘোর এস্ট্যাব্লিশমেন্ট বিরোধী, প্রচারধর্মী ও বয়স্কাউট ব্রেখটের মন্ত্রশিষ্য। এতে কলকাতায় অনেকের কপালে বলিরেখা দেখা গেছে, কেননা ইয়োরোপের এই সাম্প্রতিক ঝোঁকটাকে অনুকরণ করার বহু ঝামেলা এই জরুরি অবস্থার ভারতে। কিন্তু সেই দলকে কি বলা হবে যাঁরা একই সঙ্গে ব্রেখ্ট্ ও ইয়োনেস্কোর নাটক মঞ্চস্থ করেন? তাঁরা ঝগড়াঝাঁটির ঊর্ধে? নাটক তাঁদের কাছে নাটক মাত্র? শিল্পের জন্যই শিল্প করেন? তাঁরা তপোবনচারী নির্বিরোধ ঋষি? ব্রেখ্ট্ কিন্তু স্পষ্টতই এহেন নপুংসক চিন্তাসর্বস্বদের দুচক্ষে দেখতে পারতেন না। তাঁর প্রশ্ন পরিচালকদের কাছে: আপনি যদি নিরপেক্ষ হন, শ্রেণীসংগ্রামে যদি আপনার আগ্রহই না থাকে, তবে আমার নাটক স্পর্শ করবেন না (‘ডের ডিয়ারেকটিশে ড্রামাটিক’ দেখুন)। যাঁদের কাছে ইওনেস্কোয় ব্রেখটে কোনো তফাৎ নেই, তাঁরা স্পষ্টতই ব্রেখটের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা নন। সুতরাং তাঁদের পক্ষে ব্রেখটের রাজনীতি তো দূরের কথা ব্রেখটের ফর্ম বোঝাও সম্ভব নয়, কারণ ব্রেখটের এপিকরীতি নাট্যশালায় মার্কসবাদী ডায়লেকটিকস্ প্রয়োগের এক চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত মাত্র। তাঁর সারাজীবনের বিপ্লবচিন্তা, নাট্যচিন্তা এবং আঙ্গিকচিন্তা অঙ্গাঙ্গী জড়িত।

আঙ্গিককে রাজনীতির অধীন রাখলেও পরিচালক জীবনে প্রয়োজনানুযায়ী স্টাইলের বহু পরিবর্তন ঘটালেও, নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ব্রেখ্ট্ শেষ কটি প্রযোজনায় ফর্ম সম্পর্কে কতকগুলো সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। সেগুলোকেই তাঁর রাজনৈতিক মতবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিমূর্ত কতকগুলো ফর্মূলায় পর্যবসিত করেছেন পশ্চিমা কিছু নাট্যবিদ। ভেরফ্রেমডুং, এলিয়েনেশন, এপিক, এমপেথি প্রভৃতি কথাকে ব্রেখটের রচনা থেকে ছিঁড়ে এনে তাঁকে বিশুদ্ধ এক আঙ্গিকবিদে পরিণত করতে চেয়েছেন তাঁরা যাঁরা ব্রেখটের রাজনীতি সইতে পারেন না। যে বিষয়টি চাপা দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রয়াস চলছে সেটা এই- ব্রেখটের আঙ্গিক পুরোপুরি মার্কসবাদী নাট্যচিন্তার নূতন সম্প্রসারণ, নূতন সংযোজন মাত্র। মার্কস-এংগেলস থেকে শুরু করে মাও এর হাত ঘুরে আজকের গোর্কি, জদানভ, কডওয়েল, টমসন, জু-ইয়াং, লুকাচ, অ্যাশ প্রভৃতি পর্যন্ত মার্কসবাদী সংস্কৃতি চিন্তা ও বিতর্কের পরম্পরায় যদি ব্রেখ্টকে না দেখি, তবে তাঁর রূপরীতি হিং-টিং ছট হয়ে থাকবে। একটি পুরাতন প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ব্রেখটের এপিক তত্ত্বে, বিপ্লবী নাট্যকার দর্শকের আবেগে ঘা দেবেন, না বুদ্ধির কাছে আবেদন রাখবেন? মার্কসবাদী তো ডেমাগগ নন। প্রবল নাট্যক্রিয়ায় তিনি দর্শককে অভিভূত করবেন কেন? যুক্তির শান্ত পরিবেশনে যেমন মার্কসবাদী তাঁর বিপ্লবের তত্ত্ব পৌঁছে দেন শ্রমিক শ্রেণীর কাছে, নাট্যকারও তেমনি বিশ্লেষণী কৌশলে দর্শককে বোঝাবেন সমাজবিবর্তনের ধারা, সমাজ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু ব্রেখটের এই সমাধানই যে চরম ও সর্বশেষ এমন মনে করার কোনো কারণ ঘটেনি। মার্কসবাদীদের আলোচনা কখনোই থামে না। মার্কস ও এংগেলস-এর বিপরীত উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন নাট্যকারদের; বলেছিলেন, নাটককে শেক্সপীয়ারাইজ কর, শিলারাইজ করো না, প্রবল ঘাত প্রতিঘাতে  নাটককে আবেগময় কর, বিশ্লেষণ কোরো না।

স্তালিন নাটককে বলেছিলেন শ্রেণীসংগ্রাম ছাড়াও আরো অনেক কিছু, সুতরাং একান্ত পার্টিগত যে অভিধাগুলো- বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী- এসব নাটকের ক্ষেত্রে, দোহাই তোমাদের, কখনো ব্যবহার কোরো না। সমাজবাদী বাস্তবতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে গোর্কি ভিন্ন কথা বলেছেন। চেয়ারম্যান মাও যখন সর্বতোভাবে শ্রমিক কৃষক সৈনিকদের জন্য নাটক লিখতে বলেন, তখন আবার ব্রেখটের বিশ্লেষণী ভঙ্গির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়- বিশেষত ইয়োরোপীয় শ্রমিক শ্রেণী যেখানে ব্রেখটের লক্ষ্য। বিপ্লবের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার আগ্রহেই এইসব বিতর্ক; সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্যই ব্রেখটের ফর্ম অন্বেষণ। বিতর্কটা বহু পুরাতন, মার্কসবাদীর কাছে সুপরিচিত।

এপিক থিয়েটারকে সুতরাং গুপ্তমন্ত্রের মতন জটিল করে তোলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। বিশেষ করে প্রাচ্যের মানুষের কাছে তত্ত্বটা সহজ এবং অতি পুরাতন। চীন এবং ভারতের মানুষ এপিকেই বহুদিন অভ্যস্ত, ড্র্যামাটিকে তার আসক্তি অতিশয় সাম্প্রতিক। মহাভারতের সবটাই এপিক, ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ উপস্থাপিত নয়, কারুর মুখে বর্ণিত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটা সঞ্জয় উবাচ। এটাই এপিক ফর্ম, ব্রেখ্ট্ কর্তৃক আধুনিকভাবে ব্যবহৃত। মা নাটকের মে দিবসের রিপোর্টিংটা পড়লেই বোঝা যাবে মহাভারতের যুদ্ধপর্বগুলোর সঙ্গে তার গভীর মিল। বাংলার লোককবি চিরদিনই ভণিতা প্রয়োগ করেন, নিজ নাম উচ্চারণ করেন- সেটা এলিয়েনেশন, কাব্য-মধ্যে ইচ্ছাকৃত সুর কেটে দেওয়া, শ্রোতাকে সম্বিত ফিরিয়ে দেওয়া। পাঁচালিকার চিরদিন ঘটনা বিবৃত করেন, নানা চরিত্রের সংলাপ একাই বলেন। কীর্তনিয়ারও সেটাই কাজ- কখনো তিনি রাধা, কখনো কৃষ্ণ, কখনো বা গোপী। এটাই এপিক। এটাই এলিয়েনেশনের মূল কথা। কথকঠাকুরের মুখে মহাভারতের কাহিনী যে শুনেছে সে ব্রেখটের মূল কথাটা বুঝে নিয়েছে অনায়াসে। কথক অর্জুনের হয়ে কথা কইছেন, কিন্তু নিজে কখনোই অর্জুন হচ্ছেন না। কারণ পরমুহূর্তে তিনি অর্জুনের আচরণের ব্যাখ্যাকারও বটেন। নিজে চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলে আর ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রত্যক্ষ ঘটনাবলী অভিনয় করলে শ্রোতারা তাতে ডুবে যান; মাঝে কথক এসে দাঁড়ালে ঘটনাগুলো সরে যায় কিঞ্চিৎ দূরে, অন্যের মুখে ঘটনার কবিত্বময় বর্ণনা শুনলে শ্রোতা সমগ্র ছবিটা দেখতে পান। তখন তাঁরা শুধু আবেগমথিত হন না, ঘটনার কার্যকারণ বোঝেন। এই রীতি প্রযুক্ত হয়েছিল বলেই বাংলার কৃষক সাধারণ মহাভারতের নীতিকথা তথা দর্শন এত গভীরভাবে বুঝেছিলেন। এই এপিক ফর্ম বোঝবার জন্য এমন কষ্টকর আকুলিবিকুলি কেন? ব্রেখ্ট্ তো মহাকাব্যের ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনেছেন আজকের কথা বলার জন্য। অন্য আরেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন ব্রেখ্ট্- মানুষকে কীভাবে দেখাবো? ডায়ালেকটিকস প্রয়োগ করলে মানুষকে নানা বিপরীত বৈশিষ্ট্য সমেত এক জটিল দ্বন্দ্ব সংকুল চরিত্র করে দেখাতে হয়। শেকসপিয়ার ও বালজাকের একনিষ্ঠ পাঠক মার্কস তাই চাইতেন। গোর্কি নাটকের নায়ককে রোমান্টিক চোখে দেখতে বলেছিলেন বটে, কিন্তু নিজে কোনো নাটকে তা দেখাননি। তাঁর চরিত্ররা নির্মমভাবে বাসাতব ও দ্বন্দ্বজর্জর। চেয়ারম্যান মাও বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিলেন, বিপ্লবের কথা বলতে গেলেই আপনাদের চরিত্রগুলো অমন খড়ের পুতুল হয়ে পড়ে কেন? ডায়ালেকটিকস কখনো দ্বন্দ্বহীন মানুষের কথা চিন্তা করতে দেয় না। নাট্যচরিত্ররা হবে নানা দ্বন্দ্বে কম্পমান, বিপরীত সব ভাবে ভরপুর। সাম্প্রতিককালে চীনে জু-ইয়াং এ লাইন থেকে সরে এসেছিলেন অনেক। মার্কসবাদী গবেষক লুকাচ চরিত্রচিত্রণে আরো বেশি দ্বন্দ্ব ও সংশয় দাবি করেছিলেন বলে জু-ইয়াং তাঁকে কঠোরতম সমালোচনা করে বলেন, বিপ্লবী নাটকে বিপ্লবী হবে শাদা, প্রতিবিপ্লবী হবে কালো, জনতাকে বিপ্লব বোঝাবার একমাত্র পথ। জু-ইয়াং সাংস্কৃতিক বিপ্লবে তীব্রভাবে ধিকৃত হন, কিন্তু সেটা এই মত প্রকাশের অপরাধে নয়- কেননা আজো বিশ্বে এই বিতর্ক চলছে এবং বহু সংস্কৃতিকর্মী এই স্পষ্ট শাদা-কালো তত্ত্বের সমর্থক। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নামলেই বোঝা যায় দ্রুত কার্যকরী প্রচারের প্রয়োজনীয়তা।

ব্রেখ্ট্ও বহু চিন্তার পর এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন- একত্রে বহু ভাব দেখালে নাটকে জটিলতা সৃষ্টি হয়, সাধারণ দর্শকের পক্ষে বিপ্লব তত্ত্ব বুঝতে অসুবিধা হয়। অন্যপক্ষে মার্কসবাদী হিসেবে, ডায়ালেকটিশিয়ান হিসেবে তাঁর পক্ষে মানুষকে শ্রেফ শাদা বা শ্রেফ কালো মনে করা ছিল অসম্ভব। সমাধান হিসেবে তাঁর এপিকরীতি আবিষ্কার- বা বলা চলে পুনরাবিষ্কার। প্রাচীন মহাকাব্য থেকে যেমন তিনি দূরত্ব সৃষ্টি ও বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন, মানুষকে কীভাবে দেখাবো এই প্রশ্নের উত্তরও সেই মহাকাব্য থেকে সংগ্রহ করলেন। শেক্সপীয়ারের চরিত্ররা যেমন দৃশ্য থেকে দৃশ্যে জটিলতর হয়ে উঠতে থাকে, অন্তর্দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত হতে থাকে, প্রাচীন মহাকাব্যে তা কখনো হয় না। অর্জুন বা কর্ণে বিপর্যয় নেই, তারা পাষাণ প্রতিমার ন্যায় বৃহৎ ও শান্ত। তাদের একেক পর্বে একেক ভাব। অর্জুন কখনো প্রেমিক, কখনো মহাবীর, কখনো বা যুদ্ধ বিমুখ। কর্ণ কখনো নারী উৎপীড়ক, কখনো বীরশ্রেষ্ঠ, কখনো বা মাতৃস্নেহ লোলুপ জ্যেষ্ঠ পা-ব। শাদা ও কালো দুই চিত্রই উপস্থিত হচ্ছে, তবে একত্রে ধূষর রং ধারণ করে নয়, আলাদা, পরপর। এতে তথাকথিত লজিকের প্রয়োজন হয় না। মহাকাব্য নিজের দূরত্ব বজায় রাখে বলে দৈনন্দিনতায় আবদ্ধ নয়। উপকথার যেমন জাগতিক লজিক লাগে না, মহাকাব্যেরও নয়। থিয়েটারকে দিয়েছেন উপকথার বৃহত্ব, মহাকাব্যের গরিমা। মানুষকে ব্রেখ্ট্ দেখিয়েছেন একেক দৃশ্যে একেক রূপে, প্রতিরূপকে আরো স্পষ্ট করে দিয়েছেন বৃহৎ লিখিত বিজ্ঞপ্তি মারফৎ: ‘তখন কুরাজ ব্যবসায়ে নামলেন’ বা ‘য়োহানার ধর্মভাব’ অথবা ‘গালিলিও স্বর্গ উঠিয়ে দিলেন’। কুরাজ যে কখনো মাতা, কখনো কূট ব্যবসায়ী, কখনো ফিউদাল যুদ্ধবাজদের সমালোচক, কখনো বা হতভম্ব নির্বোধ- এইসব একের পর এক চিত্র চলে যায় দর্শক চক্ষুর সামনে দিয়ে। সবগুলোর সমন্বয়ে আস্ত মানুষ কুরাজ সৃষ্টি হয় দর্শক মনে। এইভাবে এপিকের দূরত্ব আপাত নির্লিপ্ততা এবং একেক পর্বে একেক ভাব মারফৎ ব্রেখ্ট্ সৃষ্টি করেছেন আজকের কুরুক্ষেত্র, আজকের কুরুপাণ্ডব।

মার্কসবাদীদের কাছে এ-ও কোনো তর্কাতীত বেদবাক্য নয়। জদানভ- এর নেতৃত্বে সোভিয়েত সমালোচকরা ব্রেখটকে এক মহান বিপ্লবী নাট্যস্রষ্টা আখ্যা দিয়েও, ডায়ালেকটিকস- এর অপপ্রয়োগের দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, মানুষের শাদা দিক ও কালো দিক একসঙ্গেই থাকে ও পরস্পরের মধ্যে চলে দ্বন্দ্ব। সেটাই ডায়ালেকটিকাল দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষকে কাটাছেঁড়া করে একেক দৃশ্যে দ্বন্দ্বহীন এক এক অস্তিত্বে প্রতিষ্ঠিত করলে আমরা দেখি পরপর কতকগুলো মৃতদেহ, এবং দশটি মৃতদেহের যোগফল কখনোই একটি জীবন্ত মানুষ নয়। তাঁরা বলতে চেয়েছেন, ব্রেখট্ ডায়ালেকটিকস-এ বুঝেছেন শুধু বৈপরীত্যের সহাবস্থান; আসলে ডায়ালেকটিকসের মূল কথা হল বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব। তাই মানুষকে কখনো বীর, কখনো কাপুরুষ দেখালে এপিক হয়তো হয়, কিন্তু ব্রেখ্ট্ যে দাবি করেন এটা মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদ, তা মানা যায় না। বীরত্ব ও কাপুরুষতা একত্রে থাকে ও পরস্পরের মধ্যে চলে তীব্র দ্বন্দ্ব- এই ছিল সোভিয়েত সমালোচনা। ব্রেখ্ট্ এ সমালোচনা স্বীকার করেননি। পরবর্তী সময়ে ‘লুকুলুস’ অভিনয়ের পর স্বদেশেও তিনি পার্টির সাংস্কৃতিক মুখপাত্রদের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন ওই ফর্মের প্রশ্নে। মানুষ ও জীবনকে অত্যধিক স্কিমেটিক বা ছকবাঁধারূপে ব্রেখট দেখান, এই অভিযোগ। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার প্রাকশর্তগুলো ব্রেখ্ট্ মানেন না, এ প্রশ্ন তোলে ‘নয়েস ডয়েটশলান্ড’ পত্রিকা। কিন্তু ব্রেখটকে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার বাইরের এক প্রচন্ড বিপ্লবী শক্তি বলে স্বীকার করে নিতে জর্মন পার্টির বাধেনি।

ফর্মের প্রশ্নে কোনো চরম বা পরম নেই। ফর্মুলা হচ্ছে নাটকের অশনিসংকেত। উপরন্তু স্তালিনের মতে ফর্ম হবে চিরদিন জাতিগত, বিষবস্তু হবে সমাজতান্ত্রিক। প্রতি জাতি নিজ নিজ প্রিয় ফর্ম সৃষ্টি করেছে বহু শতাব্দী ধরে। সেই ফর্মেই সে দেখতে চাইবে বৈপ্লবিক নাটক। জাপানিদের কাছে বিপ্লবের বার্তা হয়তো কাবুকি মারফৎ সবচেয়ে দ্রুত পৌঁছে দেওয়া যাবে, বাংলার মানুষের কাছে যাত্রায়, আর দক্ষিণ ভারতে নৃত্য মারফৎ, মহারাষ্ট্রে তামাশায়, উত্তরপ্রদেশে নৌটংকিতে, গুজরাটে ভাওয়াইয়ে। আসল কথা বিপ্লবিক বিষয়বস্তু। ফর্ম দেশকাল সাপেক্ষ- বিষয়বস্তু চিরন্তন। বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেই বের্টোলট্ ব্রেখ্ট্ এ শতাব্দীর মহত্তম নাট্যকার, বিপ্লবী নাটকের পতাকাবাহী।

[লেখাটি ‘উৎপল দত্তের গদ্য সংগ্রহ ১, নাট্যচিন্তা’ থেকে পুনর্মূদ্রণ করা হলো]

উৎপল দত্ত: বাঙলানাট্যের প্রবাদ পুরুষ