Full premium theme for CMS
মাদার কারেজ নাজমা আনোয়ার
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
তিনি ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হননি। কিন্তু চলে গেলেন উল্কা পতনের মতো, অকস্মাৎ। একেবারেই সবার কল্পনার বাইরে। তিনি কাজ করেছেন অবিরাম, সিডিউল ঠিক রেখেছেন। যে রাতে বিদায় নিলেন তখনও সব কাজ সাঙ্গ করার পর যখন নিজের জন্যে সময় হলো, তখন বাজে রাত দু’টো। শরীর চলছিলো ঠিকই কিন্তু হৃৎপিণ্ডটা চলছে না। সন্তান-সন্ততি সেদিন বাসায়ই ছিলো। কথা বলেছেন তাঁদের সঙ্গে প্রচুর। প্রাণবন্ত উচ্ছ্বল মানুষ ছিলেন যে বড়! বিদায়ের আগে মানুষ সব সাঙ্গ করে যেতে চান। পারে না। কত অসমাপ্ত কাজ থেকে যায়। তাঁর ক্ষেত্রে অতটা হয়নি। নিঃসঙ্গ হয়েছেন তাঁর কবি স্বামী আর নাট্যকর্মী কন্যা।
নাজমা আনোয়ারের কথা বলতে গিয়ে এটুকু ভূমিকা করতেই হয়; কারণ তিনি ভূমিকা পালন করেছেন আজীবন।
যিনি বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করেন মানুষ হয়তো তাকেই বড় করে দেখে, তা আকাঙ্ক্ষিতও। কিন্তু ঐ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে একজন শিল্পীর বেড়ে ওঠাকে কেউ তলিয়ে দেখার প্রয়োজনও বোধ করে না। এ-ও স্বাভাবিক। জগতের অন্য স্বাভাবিকের মতোই। কিন্তু নাজমা আনোয়ার?
জন্মেছিলেন এক রক্ষণশীল পরিবারে সেই উনিশশ চল্লিশ সালে। বাবা ছিলেন আরবীর শিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই শিল্প সাহিত্যে ছিলো প্রবল আগ্রহ। প্রথম রক্ষণশীলতার প্রাচীর ভাঙলেন বড়বোন আজমেরী জামান (রেশমা)। তখনকার চলচ্চিত্রে একটা বড় জায়গা করে নিলেন। সে এক ধুন্দুমার কাণ্ড! সেসময় কিন্তু নাজমা আনোয়ার মেনে নিয়েছিলেন সাংসারিক নিয়তিই। পরিবারের ইচ্ছায় বিয়ে করেছেন, সংসার করেছেন। সত্যিকারের গৃহবধু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। স্বামী-সন্তানদের দেখেছেন। আদর্শ বধু হিসেবে তিনি সম্মানিত। কিন্তু সেখানেও আসে আকস্মিক বিচ্ছেদ, বিন্দুমাত্র দায়ী হয়তো তিনি ছিলেন না। জীবনবাদী নাজমা আনোয়ারের দ্বিতীয়বার সংসারে এলো কবি স্বামী, যেখানে তাঁর অবরুদ্ধশিল্প মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
নাট্যপণ্ডিত বজলুল করিমের সংস্পর্শে আসেন। সেখানেই রুচিটা তৈরি হয়ে যায় আধুনিক নাটকের। শিল্পীর জীবনে সূচনাটা বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। অকালপ্রয়াত এই নির্দেশকের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাজ করতে পারেননি। তারচেয়ে বেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিলো আরণ্যক নাট্যদলের সঙ্গে। ইবলিশ নাটকের ‘আতশী’ চরিত্রে অভিনয় করতে এসে এত অবলীলায় যে একজন নিপীড়িত গ্রাম্য মহিলার আদলটির মধ্যে তিনি প্রবেশ করতে পারবেন তা আমরা ভাবিনি। এরপর বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, অববাহিকা, সাতপুরুষের ঋণ, নানকার পালা’য় গ্রামীণ চরিত্রে বিভিন্ন মাত্রা তিনি আরোপ করেছেন।
টেলিভিশনে তিনি প্রথম সার্থকভাবে ঢাকার সংলাপ আউড়ে ভীষণ জনপ্রিয় হন। তারপর সাম্প্রতিক নাটকে ছোট্ট একটি অপয়া স্ত্রীর ভূমিকায় তাঁর অসামান্য অভিনয়ও ভুলবার নয়। সাতজন যাত্রী, আকাশ ছোঁয়া, করিমন বেওয়া-সহ অসংখ্য নাটকে তিনি অভিনয়ে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন। সর্বশেষ অভিনীত নাটক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হারানের নাতজামাই এ তাঁর অভিনয়ের প্রসংশায় পরিচালক আপ্লুত হয়েছেন।
সময় অসময় নাটকে সেই মা যখন প্রথম সন্তান রেখে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে বাধ্য হয়, এক পর্যায়ে সন্তানের বেদনায় আর্তনাদ করে বলে ওঠে- ‘হায়রে ভাত!’ সেই কবেকার সময় অসময়! কিন্তু তা-ও কি ভুলবার? তিনি যাবার আগে চলচ্চিত্রেও কী চমৎকার অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গেলেন।
শেক্সপীয়ারেরও তুমি ‘মা’। কোরিওলেনাসের ‘মা’। আগের সব অভিনয়কে অতিক্রম করে এসে দাঁড়ালে রোমান বীরমাতা হিসেবে। দীর্ঘ দীর্ঘ সংলাপকে তুমি আওড়ে গেলে অবলীলায়, নবতর দেহ ভঙ্গিমায় সৃষ্টি করলে এক মহান চরিত্র। লোহা নাটকেও তুমি সৃষ্টি করলে আরেক মায়ের। তোমার অভিনয়ে দুই বাংলাই মুগ্ধ হয়েছে। অগণন দর্শকের স্মৃতিতে তুমি রয়ে গেছো। কেমন করে আমরা বিস্মৃত হব সেখান থেকে? নাট্যকারের সৃষ্টিকে বিস্তর ব্যাখ্যায় তুমি উদ্দীপ্ত করতে পেরেছ বারবার। সমতট নাটকে মায়ের চরিত্রটি কখনো ব্রেশটের মাদার মনে হয়। যেখানে একজন মা কতোভাবে সন্তানদের রক্ষার জন্যে প্রাণপণ লড়াই করছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও মনে হয়েছে তুমি যেন মাদার কারেজ। তাই শিল্পীর জীবনের নিজস্ব প্রেরণা চরিত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে।
আমরা তোমার সামনে আমাদের টিনের তলোয়ার অবনত করলাম।
তোমাকে আজ আমরা অশ্রুসিক্ত পতাকাটি উপহার দিলাম।
মামুনুর রশীদ : নাট্যব্যক্তিত্ব।